দহন ফুল পর্ব-০১

0
515

#দহন_ফুল — ১

কই গো নবাবের বেটি ভাত তরকারি দিবানি? নাকি দুপুরের ভাত সন্ধ্যায় খাওয়াবা?
— এই তো নিয়ে আসছি মা ৫মিনিট। বলে ভাবী জানালার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন৷ ওখানে একটা কাক গম্ভীর ভাবে বসে আছে৷ ভাবী কি নিজের সাথে ওই কাকের তুলনা করলেন? স্বাধীন পাখি, পরাধীন নারী?
— হ উদ্ধার করো, সারাদিনে একটু রান্নাবান্না করো, সেটাও ঠিক টাইমে হয় না।

চোখের কোলটা মুছে রান্নাঘর থেকে ভাতের বাটি, তরকারির বাটি সব এনে এনে টেবিলে রাখছে ভাবী। ফেসবুক স্ক্রল করা থামিয়ে সেদিকে তাকালাম। বাটিগুলো সব রেখে আঁচলে ক্লান্ত শ্রান্ত চোখমুখের ঘাম মুছলেন ভাবী। শাশুড়ী বললেন
– যাও এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো কাপড়গুলো ধুয়ে ছাদে মেলে দাও রোদ পড়ে গেলে আর শুকাবে না ভালো করে।
ভাবী আমার দিকে ভেজা ও নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালেন, আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম।
— যাচ্ছি মা (বলে চলে গেলেন)
ভ্রুকুটি করলাম মনেমনে .. কাজ আর যেনো কেউ করে না ঢং, প্রতিদিন প্রচন্ড খিদে নিয়ে খাবার খেতে হয়।

প্রভা খাবার নিচ্ছ না কেনো?
শাশুড়ীর কথায় সম্বিৎ ফিরলো, প্লেটে ভাত আর সবজি নিয়ে মাখিয়ে খেতে লাগলাম। খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে শ্বশুর বাইরে থেকে ঘরে ঢুকলেন।
ভাবী এক বালতি ধোয়া কাপড় নিয়ে ছাদের দিকে যাচ্ছেন, শ্বশুরের চোখে পড়তেই — একি বউ মা! এতগুলো কাপড় তুমি ধুয়েছো? মনির মা কি করেছে?
— মনির মা ধুইলে কাপড় পরিস্কার হয় না। (শাশুড়ী বললেন)
— তা ও এখন গোসল করবে কখন, নামাজ পড়বে কখন খাবে কখন?
— হয়ে যাবে বাবা আপনি চিন্তা করবেন না, বলে ভাবী সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো।

শাশুড়ী মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,
— হয়ে যাবে তুমি হাত ধুয়ে খেতে বসো, তোমার অতো দরদ দেখাতে হবে না।
শ্বশুর হাত ধুয়ে এসে প্লেটে ভাত নিলেন,
তরকারি মাখিয়ে লোকমা মুখে তুলে বললেন.
— একটু বিবেক খাটাও সাবিরের মা, এতটা জুলুম ভালো নয়।
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন শাশুড়ী,
— জুলুম! কিসের জুলুম? ঘরের কাজ ছেলের বউদের করতে হয় এটাই তো স্বাভাবিক, এখানে জুলুমের কি হলো?
— ঘরের বউ তো তোমার আরো আছে, তাদের বেলায়ও কি তোমার একই মনোভাব ?

স্পষ্ট আমাকে ইঙ্গিত করেছেন, আমার গলা দিয়ে আর ভাত নামলো না। চুপ করে বসে থেকে, ভাতের প্লেট নিয়ে সিংকের দিকে গেলাম। শাশুড়ী রে রে করে উঠলেন, প্রভা খাওয়া বন্ধ করলে কেনো? হাত ধুয়ে ফেললে কেনো, মাংসটা তো চেখে দেখলে না?
— না মা আর খাবো না, পেট ভরে গেছে আমার।
প্লেট সিংকে রেখে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে শুনলাম, শাশুড়ী শ্বশুরকে বকছেন।
— দিলে তো মেয়েটার মন খারাপ করে? কত্ত বড় ঘরের মেয়ে, জীবনে কখনো একগ্লাস পানি ঢেলে খায়নি। আহারে খিদের কষ্ট পাবে মেয়েটা।
— দুচোখে বিচার বন্ধ করো সাবিরের মা, পর্দা সারাও চোখের, বিবেক খাটাও।

কষ্টে আমার চোখে পানি চলে আসলো, শ্বশুর বাবা আমাকে একদম পছন্দ করেন না। ঘরে এসে খুব কাঁদলাম, আমি কি কখনো ঘরের কাজ করে বড় হয়েছি, ঘরভরা চাকর বাকর ছিলো, শ্বশুর বাবা পারলেন আমাকে কাজের খোটা দিতে? কেঁদেকেটে চোখ ফুলিয়ে ফেললাম,আসুক আজ সামির একটা বিহিত করতে হবে? কতক্ষণ রাগে গজগজ করলাম তারপর উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি দিলাম। পেটে খিদে লেগেছে তাই ড্রাইফ্রুটস এর কৌটাটা নিয়ে বসলাম, টিভিটা অন করে নেটফ্লিক্সে মুভি দেখছি আর নাট খাচ্ছি।
মোবাইলে রিং হতেই ফোন তুলে দেখি মা কল করেছে,
হ্যালো বলেই কেঁদে ফেললাম,
মা ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, কি হয়েছে কাঁদছো কেনো?
আমি আজকের ঘটনা সব খুঁলে বললাম। সব শুনে মা নিরসভাবে উত্তর দিলো — ও আচ্ছা, এবার অন্য কথা বলো।
— তাজ্জব ব্যাপার মা!
— কোনটা তাজ্জব?
– এইযে সব শুনেও বিষয়টা তোমার কাছে কিছুই মনে হলো না।
— হ্যা… গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না হলে কিছু মনে হবে কেনো?
— এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না?
— না, উনি তো সত্যিই বলেছেন। তুমি তো কুটোটিও নাড়ো না।
— মা আয়ায়া… তোমার চেয়ে আমার শাশুড়ীই ভালো, সাথে সাথে প্রতিবাদ করেছেন।
— তাহলে তো হয়েই গেলো, বিচার তো পেয়েই গেছো।
— সবার মা কি আর তুমি কি?
— হুমম আমিতো সারাজীবনই খারাপ মা।
— বাপি হলেও কিছু বলতো, তুমি কেমন যেনো?
— বাপির আদরেই বাদর হয়েছো, শোনো বাপিকে আবার এসব বলতে যেও না। শ্বশুরবাড়িতে কতকিছুই হয় সব কথা, সবাইকে জানাতে হয় না। নিজে ছোট হতে হয়, এখন বুঝবে না, তবে আর কয়েকবছর যাক বুঝতে পারবে।
— যাও আর কথাই বলবো না।
— আচ্ছা ঠিক আছে ভালো থেকো।

মা ফোন কেটে দিতেই মনটা বিরক্ততে ছেয়ে গেলো? সবার মা কেমন আর আমার মা কেমন? অন্যকেউ হলে এর একটা বিহিত করতো, আমার মা একদম অন্যরকম। বাবা ইনকাম ট্যাক্স এর বড় অফিসার টাকার অভাব কখনো দেখিনি, ঘরের কুটোটিও নাড়ানো লাগেনি, বড় আপু তবুও মায়ের সাথে সাথে এটাসেটা কর‍তো। আমি ছিলাম বিন্দাস। বাপি দু’হাতে খরচ করলেও মাকে দেখতাম বস্তাপচা নীতিকথা নিয়ে পরে থাকতে। বাবার এত নিষেধ সত্ত্বেও স্কুলের চাকরি ছাড়েননি, বাবা জোর করেননি কখনো, বাবাকে দেখতাম যেনো মাকে একটু ভয় পায়। বড় আপু বিয়ের হয়ে গেলে অষ্ট্রেলিয়া চলে যাবার পর মা নিঃসঙ্গ হয়ে যান, আমার সাথে মায়ের সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, তবে বাপির সাথে আমি বন্ধুর মতো।

সামিরের সাথে রিলেশন হবার পর বাপির কাছেই বলেছি, বাপিও খোঁজ খবর নিয়েছে, সামির লন্ডন থেকে পড়াশোনা কমপ্লিট করার পর দেশে এসে একটা ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানীতে বেশ বড় পদে জয়েন করেছে।
মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি হলেও ছেলে যোগ্য তাই আর দ্বিমত করেনি।
দুই পরিবারের সম্মতিতে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে আমাদের বিয়েটা হয়। আজ দুইবছর হতে চললো, একা বাসা নিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়নি কখনো। এইতো বেশ আছি সংসারের কোনো কাজকর্ম করা লাগে না, তবে বিয়ের আগে মা জোর জবরদস্তি করে কিছু রান্নাবান্না শিখিয়েছেন, একেবারে কিছুই পারি না তা নয় তবে গা বাঁচিয়ে চলা যায় তাই একা বাসায় যাবো না যতদিন পারা যায়।

ধানমন্ডির অভিজাত এলাকায় এই বাংলো টাইপ বাড়িটা সামিরদের নিজেদের, লেকপাড়ের খুব কাছেই তাই কিছুক্ষণ হাঁটলেই লেকে যাওয়া যায়।
পঁচিশশো স্কয়ার ফিটের এই বাসাটায় পাশাপাশি দুটি রুম আমি নিয়েছি, ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দিয়ে ডিজাইন করিয়ে পুরো রুম সাজিয়েছি। দামী ঝাঁড়বাতি, এক্সক্লুসিভ সব পর্দা, দামী আসবাবপত্র, দেয়াল জুড়ে বিশাল টিভি কি নেই এই ঘরে? পুরো রুম জুড়ে একটা স্বপ্নময় আবহ। শাশুড়ীকে এনে বসিয়ে রাখি, উনি মুগ্ধ চোখে দেখেন, ফ্রিজ খুঁলে বিদেশি ফল, চকলেট খাওয়াই, ড্রাইফ্রুটস খাওয়াই, দামী কফি, মিল্কশেক উনার খুশি আর ধরে না। সারাক্ষণ আমাকে চোখে হারান।
আর বড় ভাবী মানে মাসুমা ভাবীর রুমের দিকে তাকাতেও ইচ্ছে হয় না, পুরনো খাট,তোষক, আলমারী, সোফা পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে থাকে। আমি পারতপক্ষে ও ঘরে যাই না, শাশুড়ী মা ও যান না।

দরজা খুলে শাশুড়ী মা ঘরে ঢুকলেন, আমি আধাশোয়া থেকে উঠে ঠিকঠাক বসলাম, মা এসে মাথায় হাত রাখলেন, আহ্লাদে আমার চোখে পানি চলে আসলো।
— এসো মা, একসাথে বসে নাস্তা খাই, তোমার শ্বশুরের কথায় কিছু মনে করো না। সব ওই হাভাতে ঘরের মেয়ের চাতুরী, তোমার শ্বশুর আসার সময় হয়েছে অমনি কাপড়ের বালতি নিয়ে হাজির। সব লোক দেখানো কাজ করে, আমার সংসারে কি এমন কাজ, ওই একটু রান্নাবান্নাই তো? কি দেখে যে আমার গাধা বড় ছেলেটা বিয়ে করে নিয়ে আসলো? মা বাপ নেই মামার ঘরে মানুষ, ভালো শিক্ষাদিক্ষা আর পাবে কই? বাপের বাড়ি থেকে ফুটো কড়িও আনতে পারেনি, তবুও কত্ত দেমাগ? চলো গিয়ে নাস্তা করি, গরম গরম চিকেন সমুচা আর মালাই চা করতে বলে এসেছি।

বড় ভাবীর রুমের সামনে দিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে যাবার সময় চোখে পড়লো ভাবী নামাজ পড়ছে।
শাশুড়ী মা দেখে বললে – সব লোক দেখানো বুঝলে।

আমরা গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসলাম, শাশুড়ী তার জীবনের গল্পজুড়ে দিলেন, কত কি করতে পারতেন, কোন খাবার খেয়ে কে কবে প্রশংসা করেছে এসব। এর মধ্যেই আবার রান্নাঘরের উদেশ্যে হাক দেন কই হলো তোমার?

ঘেমে-নেয়ে বড় ভাবী এক প্লেট চিকেন সমুচা আর ব্রোকলির পাকড়া এনে রাখলেন টেবিলে, শাশুড়ী মা প্রশ্ন করলেন — চা কই?
— আপনারা খেতে থাকুন, আনছি।
— তাড়াতাড়ি এনো, মাগরিবের আজান যেনো না দেয় আবার।

ভাবীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুবই ক্লান্ত, আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম, — ও বাবা চুলায় যেতে পারবো না।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে খুব যত্ন করে সাজছি আমি, দিবা আপু অষ্ট্রেলিয়া থেকে দেশে ফিরেছে, এই নিয়ে দ্বিতীয়বার এই বাসায় আসছে। পার্পল জামদানীর সাথে পার্লের গহনাটা সেটিং মিলিয়ে পরে নিলাম, মেকওভারটা ম্যাচিং করেই নিয়েছি শুধু একটু ফিনিশিং টাচটা দিয়ে নিচ্ছি। পাক্কা দু’ঘন্টা লাগলো, যাক এবার ইউনিক লাগছে।

মায়ের কল এলো ওরা গেটের কাছে এসে গেছে। আমি দ্রুত আয়নায় আরেক ঝলক দেখে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম, ড্রাইভার ফল মিষ্টি এসব এনে টেবিলে রাখছে।আমি এগিয়ে গিয়ে আপুকে জড়িয়ে ধরলাম, আলিঙ্গন শেষে আপু আমার দিকে তাকিয়ে বললো — ইউ লুকিং সো গর্জিয়াছ।
– ধন্যবাদ আপু, তোকেও দারুণ লাগছে। আমিও বললাম।
সবাই গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসতেই ভাবী ফ্রেশ জুস নিয়ে আসলো সবার জন্য। — কেমন আছেন আপনারা সবাই?
আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো, ত্যানা ত্যানা একটা কাপড় পরণে ঘাম তেল মশলায় বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। বললাম — হ্যা সবাই ভালো আছে ভাবী, সব এখানে রেখে তুমি যাও। ভাবীর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ম্লান হয়ে গেলো। মায়ের চোখ কঠিন হলো, আমার দিকে তাকালেন। ভাবীর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন
— ভালো আছি মা, তুমি কেমন আছো, সকাল থেকে বুঝি আয়োজনে ব্যস্ত আছো।
— আলহামদুলিল্লাহ খালাম্মা, ওইতো আর কী । আচ্ছা আমি রান্নাঘরে গেলাম, কিছু কাজ বাকী আছে।
— আচ্ছা, যাও
এসব দেখে আমার শাশুড়ীর চোয়াল শক্ত হলো,কিন্তু মুখে মেকি হাসি ধরে রাখলেন।

সবাই জুস নাস্তা খেয়ে গল্প গুজবে সময় পার করছে। দুপুরের খাবার সময় ঘনিয়ে আসছে, মাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। খুঁজতে খুঁজতে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি ছুরি দিতে সালাদ কাটছেন।
আমি দ্রুত গিয়ে হাত থেকে কেড়ে নিলাম,
— মা, ভাবী থাকতে তুমি এসব কাটছো কেনো?
— মাসুমাকে গোসল করতে পাঠিয়েছি। বেচারি ঘেমে নেয়ে একসার।
— সালাদটা কেটে গেলে কি হতো?
মা হাত থেকে ছুরি টেনে নিয়ে কাটতে লাগলেন। আমি আবার কেড়ে নিয়ে বললাম আমি করছি তুমি সরো।
— না না তা কেনো হবে, তুমি পটের বিবি সেজে বসে থাকো, শরীর বাঁচাও কবরে গেলে পোঁকায় খেতে সহজ হবে।
— মা আয়ায়ায়া
— কি মা? একটা মানুষ সকাল থেকে খেটে মরছে, আর তুমি ছিঃ….
পেছনে ফিরে দেখি মাসুমা ভাবী অশ্রুসিক্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি চোখ মেলাতে লজ্জা পাচ্ছিলাম।

টেবিল ভর্তি এতো এতো খাবার কিন্তু কোনটাই আমার গলা দিয়ে নামছে না, কষ্টের একটা দলা গলায় আটকে আছে।

চলবে….

#শামীমা_সুমি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে