দহন পর্ব-৩১ এবং শেষ পর্ব

0
819

দহন _ ৩১ ( শেষপর্ব )

নয়মাসের বেশি সময় কেটে যায়। আকাশ ও আমজাদ শিকদারের প্রচেষ্টায় শিকদার কোম্পানি নতুন ভাবে পথ চলা শুরু করেছে একমাস হলো। বায়ার অন্য কোম্পানির তুলনায় শিকদার কোম্পানিতে ভালো প্রডাক্টের স্যাম্পল পায়। এরজন্য সব ভীর যেনো শিকদার কোম্পানিতে। নতুন ভাবে পথ চলা শুরু করেছে বলে বেশি লোক এখনো নিয়োগ দেয় নাই। যারা যারা কাজ করছে তাদের অতিরিক্ত ডিউটি করাচ্ছে শিকদার গ্রুপ। বায়ারদের অর্ডারের চাপে সিক্ত আকাশ শিকদার ও আমজাদ শিকদার। বেশকিছুদিন থেকে বাড়িতে সময় দিতে পারছেনা। বাড়িতে শুধু ঘুমানোর জন্য সময়টুকু পায়। সকাল আটটায় আবার অফিসে আসতে হয়। দক্ষ লোকের অভাবে সবদিক থেকে বাপ, বেটা সব ওয়ার্কারদের গাইডলাইন করছে। নীলা কোনোভাবে আকাশের ব্যস্ততা নিতে পারছিলো না। তাই প্রায় সময় দুজনের মধ্যে একটু কথা কাটাকাটি হয় রাতে।

” দেখেন আমার সময় কোন যাচ্ছে! এই সময়টাতে প্রতিটা স্ত্রী তার স্বামীকে কাছে চায়। অথচো আপনি সকাল আটটা থেকে রাত দশটা অব্দি অফিসে সময় কাটান। এতো কিসের ব্যস্ততা আপনার।”

” তুমি বুঝেও অবুঝের মতো করছো। কোম্পানিকে দাড় করিয়েছে সবে একমাস হলো। বায়ারদের প্রডাক্টের চাপে আমি সিক্ত। কারণ কোম্পানি এখনো সেরকম দক্ষ লোক পাচ্ছেনা। আমাদের আগের লোক গুলো কেউ কেউ অন্য জায়গায় চাকরি নিছে। কেউবা গ্রামে চলে গেছে। বাকি কয়েকজন তো মরে গেছে জানোই। সার্কুলার দিয়ে রাখছি সামনে মাসে লোক উঠাবো দক্ষ দক্ষ। তো লোকের অভাবে আমি যদি অফিসে না যাই প্রডাক্টগুলো তৈরি হবেনা সেল করতে পারবো না। বাইরের প্রতিষ্ঠানের কাছে। বায়ার আমাদের কাজ দিবেনা পরবর্তী সময়। তুমি কি চাও শিকদার কোম্পানি এখানেই স্থবির হোক। ”

” আমি এতোকিছু বুঝিনা। আমার আপনাকে কাছে চাই। কিছু খেতে ভালো লাগেনা এখন। যদিও একটু খাই পেট ব্যাথা করে। শরীরে প্রচুর ক্লান্তিবোধ লাগে। চারদিকে শুধু গরম গরম লাগে। আমাকে একটু কোলে করে ছাঁদে নিয়ে যাবেন। রুমে দম বন্ধ লাগছে। ”

” আকাশ মুচকি হাসি দিয়ে বলে, এইসময় এইরকম লাগে বউ। ধৈর্য ধরো ও কিন্তু আসতে বেশি সময় নাই। এরপরে তুমি মা আর আমি বাবা হবো। ”

” রাখেন আপনার বাবা হওয়া। আপনাকে বাবা বানাতে যেয়ে আমার অবস্থা শেষ। আপনি যেমন একটা শয়তান। আপনার বাচ্চাটাও সারাক্ষণ পেটের মধ্যে শুধু লাথি মারে। আমার দম বন্ধ লাগছে। অনেকদিন হলো ছাঁদে যাইনা আমাকে ছাঁদে নিয়ে চলেন। ”

” এই সময় মেয়েরা পাগলামী করে। কিন্তু তুমি কি নিজের ভিতরে আছো রাগ দেখিয়ে আকাশ এই কথাটা বলে। এখন বাজে রাত ১২.০০ টা ও নাকি যাবে ছাঁদে। ঘরে এসি অন করার পরেও নাকি গরম লাগছে। সারাক্ষণ অফিসে থাকি চাপের ভিতরে। ঘরে এসে বউয়ের নানান আবদার ভালো লাগেনা আমার। ”

” আকাশের কথায় নীলা কেঁদে ফেলে। এরপরে বলে আপনি কি করে জানবেন মা হওয়ার যন্ত্রণা কেমন? এই কষ্ট শুধু মেয়েরাই ভোগ করে। আপনার অফিসের থেকে হাজারগুন চাপে আমি থাকি। সবসময় পেট ব্যাথা করে কয়দিন থেকে। মাঝে মাঝে মাথা ব্যাথা। শরীর সবসময় ছটফট করে। এসির পাওয়ার সর্বোচ্চ দিয়েও গরম কুলাতে পারিনা আমি। আপনি আমাকে বকতেছেন। ”

” তুমি অবুঝ শিশুর মতো বায়না করো ক্যান? তুমি নিজেই বলো এখন ছাঁদে যাওয়ার সময়। ”

” আকাশ বাবুর ডেলিভারির ডেট কবে দিছে? ”

” কেনো? ”

” আজকে আমার খুব পেট ব্যাথা করছে আকাশ। আকাশ আমি থাকতে পারছিনা। আমাদের বাচ্চা আসার সময় হয়ে গেছে। আকাশ আমাকে ধরো। আকাশ! আকাশ! আকাশ! ”

” আকাশ নীলাকে তাড়াতাড়ি ধরে বিছানায় শুইয়ে দেয়। এরপরে বলে খুব কি ব্যাথা বউ? আম্মাদের ডাকবো? ”

” আকাশ আমি আর পারছিনা। এইটা কেমন ব্যাথা শুরু হলো আমার। আম্মাদের ডাকেন আকাশ। আমি বোধহয় আর বাঁচবো না। ”

” প্রেয়সীর মুখে মরণের কথা শুনে ভয়ে কেঁদে ফেলে আকাশ। কারণ নীলা ব্যাথায় চোখ মুখ নীল করে ফেলেছিলো। চোখগুলো বারবার উল্টোদিকে উল্টো যাচ্ছিলো। আকাশ নীলাকে বলে ওগো প্রেয়সী তুমি এরকম করছো ক্যান? আমার প্রাণ কলিজা কাপাকাপি করছে। হৃদপিণ্ড স্থবির হয়ে যাচ্ছে। ওগো তোমার চোখ মুখ নীল হচ্ছে কেনো? আমার হাত ছাড়ো আম্মাদের ডাকি। তোমাকে ডক্টরের কাছে নিতে হবে। ”

” প্রাণের স্বামী আমার মাথাটা একটু আপনার বুকে নেন। আপনার হাত আমি ছাড়তে পারবো না। আপনাকে বাবা করার আনন্দে মনে হয় আমার জীবনের প্রাণবায়ু আজ উড়ে যাবে। খুবই ব্যাথা করছে স্বামী। আমি যদি আপনার বাচ্চার মা হওয়ার সময় মারা যাই। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন স্বামী। ”

” প্রেয়সীর মুখে মৃত্যুর কথা শুনে আকাশের হৃদপিণ্ড চলতেছে না ভালোমতো এরপরেও বামহাত দিয়ে ফোন টিপে রেহেনা শিকদার, দিলারা খানকে ফোন দেয়। তাড়াতাড়ি আকাশের রুমে আসতে বলে। এরপরে আকাশ ৯৯৯ এ ফোন দেয়। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স কে আসতে বলে। ”

” স্বামী এর চেয়ে আমার মরণ দিক। তবুও এই ব্যাথা আমার আর সহ্য হচ্ছেনা। আমাকে ক্ষমা করেন স্বামী। আমি বোধহয় আপনাকে বাবা করতে পারবো না। ”

” আকাশ আল্লাহকে ডাকা শুরু করে, হে আল্লাহ এই আপনার কেমন বিচার সন্তান হবে,আমাদের দুইজনের। তাহলে প্রসব বেদনা ক্যানো আমার স্ত্রীকে দিচ্ছেন। আমার স্ত্রীর ব্যাথা কমিয়ে দিন। ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠে আকাশ। ”

” আকাশ আপনি কাঁদবেন না। আমি যে প্রসব বেদনা সহ্য করতে পারছিনা। আমি আপনাকে ছেড়ে যেতে চাইনা। আল্লাহ যেনো এই পরীক্ষায় আমাদের সফল করে। আমার জন্য দোয়া করেন আকাশ। কাঁদবেন না আপনি স্বামী। অ্যাম্বুলেন্স আম্মারা এখনো আসছে না কেনো? ”

” আসবে আসবে বউ ধৈর্য ধরো। আমাকে ধরে থাকো বউ।”

রেহেনা শিকদার, দিলারা খান দৌড়ে আকাশের রুমে আসে। এসে জিজ্ঞেস করে নীলা মা শরীরের জোড় দিয়ে ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টা করো।

” আমি পারছিনা মা। আমার ভাঙ্গা শরীরের সব শক্তি নুইয়ে পড়ছে। ”

” আম্মা আমার প্রেয়সী এমন করছে ক্যান? প্রসব যন্ত্রণা ওকে ক্যান একাই দিচ্ছে? আমাকেও কিছু দিক মা। দুই চোখ ভর্তি পানি শুধু টলমল করে পড়ছে আকাশের। ”

রেহেনা বলে বাবা আকাশ প্রসব যন্ত্রণা মরন যন্ত্রণার মতো। একটু কষ্ট হবে। ধৈর্য ধর বাবা নীলাকে শক্ত হতে বলো। তুমি ভেঙ্গে পড়লে নীলা শক্তি পাবো কোথায় থেকে।

অ্যাম্বুলেন্স আসে শিকদার বাড়ির দরজায়। আশফাকুল, আকাশ নীলাকে ধরে অ্যাম্বুলেন্সে শুইয়ে দেয়। আকাশ নীলার হাত ধরে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। দুই পাশে দুই মা বসে আছে। অ্যাম্বুলেন্স হসপিটালে এসে পৌঁছায়। নীলাকে ভর্তি করানো হয়। আশফাকুল, সাফা, আমজাদ শিকদার অন্য গাড়ি করে হসপিটালে আসে।

ডক্টর আসে নীলার সিজার ছাড়া বাচ্চার হওয়ার কোনো ওয়ে নাই। নীলা কিছুতেই আকাশের হাত ছাড়েনা। ডক্টর নীলাকে অবশ করিয়ে ফেলে। আকাশ ওই রুমেই নীলার হাত ছেড়ে দিয়ে। মাথায় টুপি দিয়ে অযু করে নফল নামাজ পড়তে বসে যায় এককোণে । একদিকে নীলার সিজার চলছে। অন্যদিকে আকাশের আট রাকআত নফল নামাজ। নামাজ শেষ করে আকাশ মোনাজাতে হাত তুলে। আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে শুধু নীলা ও তার অনাগত সন্তানের জন্য দোয়া করে।

প্রায় ১০ মিনিট অস্ত্রোপাচারের পর নীলার বাচ্চা পৃথিবীতে আসে। বাচ্চা এসেই কেঁদে দেয় ওয়া ওয়া করে। আকাশ নামাজ থেকে উঠে এসে বাচ্চাকে কোলে নেয়। এরপরে দেখে নীলার অবস্থা। নীলার অবস্থা দেখে প্রচুর ভয় খায় আকাশ। পেট কাটা দেখে ডক্টর কে বলে দ্রুত সেলাই করতে কারণ প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। ডক্টর বলে আমরা আমাদের কাজ ভালোমতে জানি স্যার। আপনাদের ছেলে হয়েছে। ছেলের কানে আযান দিন যান। এরপরে রেহেনা শিকদারের রুমে ঢুকে বাচ্চাটিকে কোলে নেয়। আকাশ আযান দেয়। আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর _______

৩০ মিনিট পর নীলার জ্ঞান ফিরে। জ্ঞান ফিরেই আমার বাচ্চা আমার বাচ্চা করে চিৎকার করে। আকাশ বাচ্চাকে সামনে এনে বলে আমাদের ছেলে হয়েছে নীলা।

ওগো আপনি আমার বাচ্চাকে আমার কাছে শুইয়ে দেন। আমি তাকে একটু দেখি, তার মুখ দেখলেই আমার শান্তি। আকাশ নীলার কাছে তাদের বেবিকে শুইয়ে দেয়। নীলা বাচ্চাকে দেখে চোখ বন্ধ করে একটা শান্তির হাসি দেয়। একটু নড়ার চেষ্টা করতেই অ্যাহ করে চিৎকার করে নীলা। আকাশ নীলাকে রাগীদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে। সদ্য সেলাই করছে, প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। এখন এভাবে নড়াচড়া করা যাবেনা। কিছুদিন যাক ঠিক হয়ে যাবে। নীলার বেডের পাশে আরেকটা বেডের ব্যবস্থা করে। নীলা যে কয়দিন হসপিটালে থাকবে আকাশ তার পাশের বেডেই থাকবে। ০৬ দিন পর নীলাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। নীলা খুবই অসুস্থ। বাচ্চার সম্পূর্ণ দেখাশোনা করে আকাশ। ডায়পার পরিবর্তন, বাচ্চা কোলে নেওয়া, বাচ্চার বিছানা পরিষ্কার সব কিছু আকাশ নিজ হাতে করে তিনমাস । কারণ হাইজিনের একটা ব্যাপার আছে না।

” এই তিনমাস তো হয়ে গেছে তুমি কি প্রিপেয়ার। আমি আরো আরেকটা মেয়ের বাবা হতে চাই এখন?”

” আমাদের ছেলের নাম তো এখনো ঠিক করলাম না। এক্ষুনি আরো একটা মেয়ে চাই আপনার? ”

” কে বলছে ঠিক করি নাই আমাদের ছেলের নাম আবির শিকদার। নামটা পছন্দ হয় নাই তোমার। ”

” নীলা নাম শুনে বলে বেশ তাই থাকুক। কিন্তু মেয়ের নামটা আমি রাখবো ঠিক করছি। ”

” আগেতো মেয়ে হওয়ার প্রসেসিং শুরু করি। এরপর লোডিং তারপর নাম। ”

” অসভ্য আমাদের একটা মেয়ে রয়েছে। আমার আর কোনো মেয়ে লাগবে না। এমনি মজা করলাম আপনার সাথে। সাফা থাকতে আর কিসের মেয়ে লাগে। একটাকে জন্ম দিতে আমার মরণ অবস্থা। আরো চাই আপনার। ”

” এই কথাতো আমি শুনবো না। সাফা,আবিরের, ছোট বোন বানানোর দায়িত্ব আমি নিয়ে নিছি। আবিরকে আমি কথা দিছি। খুব শ্রীঘই ও ওর বোন পাবে। ”

” তো আবির কি বললো? ”

” আবির কথাটা শুনে খুব খুশি হয়েছে। চলো শুরু করি! বলেই নীলার উপর ঝাপিয়ে পড়ে আকাশ। ”

” এই কি করছেন দরজা খোলা। আবির ঘুমায় নাই। ওর সামনে এসব করবেন। আপনার লজ্জা লাগবে না। ”

” আবির পুচকে। এসব কিছু বুঝে নাকি। বলেই নীলার ঠোঁট দখল করে নেয় আকাশ। এমন সময় সাফা ভিতরে ঢুকে বলে পাপা তুমি মাম্মির সঙ্গে কি করছো। ”

আকাশ ফট করে নীলার উপর থেকে উঠে বলে, কই কিছু নাতো মামুনি। তোমার মাম্মির মাথা টিপে দিচ্ছিলাম। নীলা নিজের কাপড় ঠিক করে সাফাকে বলে তোমার পাপা দুষ্ট হয়ে গেছে সাফা। তুমি কিছু খাবে।

পাপাকে বলো আমার জন্য চিপস কিনে নিয়ে আসুক। আমি চিপস খাবো।

” মামুনি চিপস পঁচা। খাওয়া যায়না। নীলাকে ইঙ্গিত করে সাফাকে বোঝাতে, যাতে ওর নানির কাছে যায়।”

নীলা মুচকি মুচকি হাসে,আকাশের ইঙ্গিত দেখে।

” না পাপা আমি চিপস খাবো। ”

” আচ্ছা মামুনি আমি টাকা দিচ্ছি। নিচে তোমার নানু আছে তাকে নিয়ে যাও। ”

সাফা টাকা পেয়ে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়। আকাশ সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে দেয়। দোলনায় যেয়ে আবিরকে দেখে আবির ঘুমাচ্ছে। এই সুযোগে আকাশ নীলাকে বলে চলো প্রসেসিং এর কাজ শুরু করি। নাহলে দুষ্টু গুলো আবার ওদের বাপের কাজে বাধা হয়ে দাড়াবে।

নীলা আকাশকে কোনো বাধা দেয়না। আকাশ নীলার সঙ্গে ভালোবাসার রাজ্য মিলিয়ে যায় ।

সমাপ্ত
®️ রিয়া জান্নাত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে