দহন _ ২৯
রাত ১২.০০ টা নিভূ নিভূ চোখে নীলা অপেক্ষা করতেছিলো আকাশের জন্য। চারদিকের অ্যালবাম গুলোতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেছিলো নীলা। আকাশের একটা অ্যালবাম হাতে নিয়ে বললো প্রিয় আপনাকে কালো শার্ট-প্যান্টে দারুণ লাগে। চোখে চশমা, মুখে গোঁফ গাল ভর্তি দাড়িতে সেই লাগে আপনাকে। এমনিতেও আপনি আমার পিছু ছাড়েন না, তাহলে আজকে কোথায় যেয়ে লুকিয়ে বসে রয়েছেন? সেই বিকাল থেকে আপনার পাত্তা নাই। আপনার কি মনে পড়ে আমাদের ভালোবাসার দিনগুলি প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা হয় ছাঁদে নাহলে ফুচকা খেতে নিয়ে যেতেন? কিন্তু এখনতো সব ভূলে গেছেন। আমি অভিমান করলে ফুচকার পরিবর্তে শুধু ফালতু ফালতু কাজ করেন আমার সঙ্গে। বিয়ের পর দুষ্টুমি যেনো দুই ধাপ বেড়ে গেছে।
টিপ টিপ পায়ে আকাশ তার রুমে ঢুকে। নীলার কাছে আসে। এসে দেখতে পায় প্রিয়তমার হাতে নিজের অ্যালবাম। নিখুঁতভাবে মুখে হাত বুলাচ্ছে প্রেয়সী। তা দেখে আকাশ যেনো ফিল করছে তার মুখেই হাত বুলাচ্ছে। কিন্তু আকাশ যে রুমে এসে এরকম কিছু দেখতে পাবে ভাবতে পারে নাই। নীলা আকাশের অ্যালবামের দুই গালে চুমু খাচ্ছিছিলো। এরপরে ডানহাতের আঙুল গুলি দ্বারা দাঁড়ি গুলো বুলাচ্ছিলো। আকাশ এরকম অবস্থা দেখে নিভূ নিভূ মুচকি হাসি দেয়। ঠোঁটগুলি দিয়ে মুচকি হাসিটা পাকিস্তানের তেরেবিন নাটকের মুরতাসিমের মতো লাগছিলো।
” কি ব্যাপার প্রেয়সী? অ্যালবামে আমার সঙ্গে লুচ্চামি চলছে। ”
” নীলা আকাশের ভয়েস শুনে কেপে উঠে।অ্যালবামটি সোফাতে ফেলে, হন্তদন্ত ভাবে দাড়িয়ে যায়। অ্যা অ্যা আপনি কখন এসেছেন রুমে। আর কারো রুমে ঢুকতে গেলে দরজা নক করে আসতে হয় জানেন না। ”
” আমার রুমে এসেছি। নিজের রুমে কেউ নক করে ঢুকে। নক করে ঢুকলে কি জানতে পারতাম। আমার প্রেয়সী আমারই অগোচরে আমার অ্যালবামের সঙ্গে প্রেম করে। ”
” তবুও একটিবার গলা বাজিয়ে আসবেন না। নীলা লজ্জা পায় প্রচুর, আকাশের হাতে ধরা পড়ে। চোখ বন্ধ করে ফেলে, মনে মনে ভাবে আমার জন্য এখন সুনামি অপেক্ষা করতেছে। এই লোক এখন তার পাওনা চাইবে আমি নিশ্চিত। ”
” লজ্জা পেতে হবেনা প্রেয়সী। চোখগুলো বন্ধ করলে মনে করছো আমি কিছু চাইবো না? আমার ভালোবাসা অ্যালবামের উপড়ে দিচ্ছো। অথচো আমি একটু ভালোবাসতে বলে লজ্জায় পড়ে যাও, নাহলে কিছু বাহানা করে চোখ বন্ধ করে ফেলো? এভাবে আর কতদিন একা একা ভালোবাসা ভোগ করবে। আমারতো ইচ্ছে করে প্রেয়সীর আলতো স্পর্শ অনুভব করি। ”
” নীলা চোখ খুলে ফেলে। এরপরে কাটকাট গলায় বলে, সেই বিকাল অব্দি কোন জাহান্নাম থেকে ঘুড়ে আসলেন? রাত ১২.০০ টা বেজে গেছে। আমি এখনো আপনার জন্য না খেয়ে বসে আছি। পাঁচবার ফোন দিলাম ফোনটাও ধরলেন না। আমাকে রেখে একা একা ঘুরেন? আপনার কি মনে পড়েনা, ভালোবাসার দিনগুলির কথা। কত জায়গায় আমাকে নিয়ে ঘুড়ে বের হয়েছিলেন। এখন বউ হয়েছি বলে সব ভূলে গেছেন। ”
” আকাশ আবার ঠোঁটগুলি মেলে মুচকি হাসি দেয়। এতো টেকনিক কবে থেকে শিখলে প্রেয়সী। আমার প্রশ্ন আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করছো। ”
” কফি খাবেন আপনি? বাইরে থেকে ঘুরে আসলেন হয়তো মাথা ধরেছে। কফি বানিয়ে আনি। ”
” আকাশ আবারো মুচকি হাসি দেয়। স্বামীকে ভালোবাসার কথা বললে নানান প্রসঙ্গ টেনে কথা আড়াল করার চেষ্টা করো। আমি কফি চাইনা প্রেয়সীর ভালোবাসা,গালদুটি দেখিয়ে বলে। ”
” নীলা মনে মনে বলে আচ্ছা মচিবতে পড়লাম। এই লোককে এখন চুমু দিলে রাতের ডিনার টাই ক্যান্সেল করবে। আমি দিবো না দেখি ও কি করতে পারে? ”
” আকাশ রাশভারী মুখ করে বলা শুরু করলো, কি হলো কথা কানে যায়না তোমার। ”
” নীলা মনে মনে বলে, অসভ্য লোক কোথাকার। নিজেতো পাগল আমাকে পাগল বানানোর প্রচেষ্টা চলছে? ”
এমন সময় আকাশের রুমে ডেকোরেশনের লোক এসে বলে স্যার সবকিছু রেডি হয়েছে। আপনারা এবার আসতে পারেন।
যাওয়ার সময় পেমেন্ট টা নিয়ে যাইয়েন ঠিক আছে।
” হুম ”
” কি ব্যাপার আকাশ? ওরা কারা এতো রাতে আমাদের রুমের সামনে এসেছে? কি রেডি হওয়ার কথা বলছিলো যেনো ওনারা। ”
” এসব পরে হবে। আমিতো তোমাকে ভালোবেসে সুইটহার্ট, নীলপাখি,বউ,প্রেয়সী কতকিছু ডাকি। তারবিনিময়ে তুমি শুধু আমাকে আকাশ বলে ডাকো। ভালোবেসে মিষ্টি একটা ডাক দিতে পারোনা। ”
” না আমি পারিনা। আমার মুখে এতো প্রেমপ্রেম ভাব পায়না বুঝলেন। ”
” হুম একটু আগেতো দেখলাম আমার অ্যালবামে ছি! ছি! । খালি আমাকেই অসভ্য বলো। আমি যা করি সবার প্রকাশ্য করি আর তুমিতো আড়ালে আড়ালে না জানি কতকিছু করো। ”
” আকাশের মুখ বন্ধ করার জন্য নীলা আকাশের গালে চুম্বন দিয়ে দেয়। এরপরে বলে এবার শান্তি হয়েছে। ক্ষ্যাপা বন্ধ করুন। ”
” আকাশ খানিকটা অবাক হয়। এরপরে বলে বাহ্ বউয়ের অনেক উন্নতি হয়েছে দেখছে। স্বামীর মুখ কি করে বন্ধ করতে হয় ভালোই জেনেছে। ”
” নীলা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে, নীলা কাঠকাঠ গলায় বলে, আপনার সাথে আমি কোনো কথা বলতে চাইনা। আমার প্রচুর ঘুম পেয়েছে। ঘুমাতে যাবো আমি।”
” না বউ এখনি ঘুমালে হয়। সারপ্রাইজ এখনো বাকি আছে। ”
” কিসের সারপ্রাইজ। ”
” গার্ডেনে গেলেই বুঝতে পারবা। ”
নীলা স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে থাকে আকাশের উপর। আকাশ নীলার হাত ধরে গার্ডেনের দিকে রওনা হয়।
গার্ডেনে এসে নীলা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। চারদিকে লাইটিং এর ব্যবস্থা, লাল নীল সবুজবাতি টপাটপ জ্বলা নিভা করছে। বাগানটা ফুলের আস্তরণ দিয়ে সাজানো গোছানো। মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে সবটা দেখতেছিলো আর এগোচ্ছিলো। আকাশ নীলার পিছনে পিছনে যাচ্ছিছিলো, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি রেখে। এরপরে নীলা বলে আকাশ আজকে কোনো ইভেন্ট আছে। এরপরে সবাই ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়। সবাই একসঙ্গে বলে উঠে হ্যাপি বার্থডে নীলা। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। নীলা নিজের মনকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এগুলা আসলেই তার সঙ্গে হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে হাতে চিমটি কাটে। এরপরে নীলা বলে এগুলা সত্যি তাহলে। রেহেনা শিকদার,আশফাকুল,দিলারা, দাদু, সাফাকে দেখে অনেক খুশি হয়। এরপরে নীলা সামনে এগোতেই দেখতে পায়। একটা টেবিলে লাইটিং এর ব্যবস্থা, তারনিচে পছন্দের কেক। মোমবাতি সবকিছু টেবিলে রয়েছে। আর উপরে গাছের সঙ্গে কার্ডে লেখা আছে হ্যাপি বার্থডে নীলা। নীলার নিজেরেই মনে নাই আজকে তার বার্থডে। খুশিতে গদগদ হয়ে নীলা পিছন ঘুড়ে আকাশকে জড়িয়ে ধরে। জড়িয়ে ধরতেই উপর থেকে ফুল পড়ে দুজনের উপর। গাছের উপর থেকে ডেকোরেশনের লোক বলে উঠে হ্যাপি বার্থডে নীলা ম্যাম। নীলা আকাশকে ছেড়ে দিয়ে উপর থেকে ফুল পড়ার দৃশ্য মুখ হা করে দেখছিলো।
” আকাশ বামহাত দিয়ে নীলার কোমড় নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলে হ্যাপি বার্থডে নীলা। ”
এই দৃশ্য দেখে রেহেনা, দিলারা,আশফাকুল লজ্জায় পড়ে যায়। সাফা চিৎকার করে বলে পাপা মাম্মিকে জড়িয়ে ধরছে। পাপা মাম্মিকে জড়িয়ে ধরছে।
আশফাকুল ওপাশ থেকে বলে উঠে, দিনদিন কি লজ্জার মাথা খেয়ে বসছো আকাশ। নিজের বাবা মায়ের সামনে ছি!
” নীলা তাড়াতাড়ি আকাশ এর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে কিছু হয়নাই বাবা। যা কিছু দেখছো সবকিছু ভূলে যাও। আকাশের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে নীলা। ”
” আকাশ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি প্রকাশ করে বলে, কি ব্যাপার বাবা। আমি অন্য কাউকে কি জড়িয়ে ধরছি। আমার দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ। ভালোবাসবো না। ”
” আশফাকুল খান আকাশের কথায় লজ্জিতবোধ করে, মনে মনে বলে আজকালকার ছেলেমেয়ের লজ্জা নামক গুনটা একবারে নেই। ”
” তোমরা ওদিকে মুখ করে আছে ক্যান। মুখ ঘোরাও। এতো লজ্জা পেলে হবে। আর তোমরা নিজেও এতো সাধু না। তোমরা যদি ভালো হতে আমরাও হতাম। নিজেরাই আকাম করে বসে আছো। তোমাদের তাড়াতাড়ি দাদু,নানু বানানোর ব্যবস্থা করতেছি। ”
” আকাশের কথায় তিনজনে লজ্জায় পড়ে যায়। তিনজন আকাশের কথা শুনে চিব্বায় চিমটি কাটে। এরপরে আশফাকুল মুখ ঘোরায় বলে , জামাই সময় থাকতে ভালো হয় একটুখানি। ”
” বাবা তুমি কি নিজে ভালো, তুমি ভালো হলে তো নীলাই আসতো না।”
আকাশের খোলামেলা কথা শুনে নীলা রেহেনাকে বলে মা এইটা তোমার কেমন ছেলে। মুখে কিছু আটকায় না। আল্লাহ আমাকে তুলে নেয়না ক্যান। কোথায় কি বলতে হয় তাও জানেনা?
” রেহেনা শিকদার নীলাকে ইশারা করে কেক কাটার জন্য। রেহেনা শিকদার মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়। নীলা মোমবাতিতে ফু দেয়। ডেকোরেশন লোক স্প্রে চিটায় চারদিকে। কিছু কিছু লোক বাজি ফোটায়। নীলা কেক কেটে আকাশের মুখে আগে দেয়। সবাই শুধু হ্যাপি বার্থডে বলে উইশ করছিলো। নীলা একে একে সবাইকে কেক দিলো। কেকের বাকিঅংশ সাফাকে দিলো। আকাশ ওইখান থেকে কেকের অংশ উঠিয়ে নীলার মুখে দিলো। এরপরে বললো হ্যাপি বার্থডে প্রেয়সী। যুগ যুগ বছর বেঁচে থাকো আমার হৃদয়ে। নীলা কেকের অংশটুকু খেতেই বমি করে ফেলে। আকাশ দ্রুত পানির বোতল আনতে আনতেই নীলা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। সবাই চিৎকার উঠে নীলা তোমার কি হলো। আকাশ দ্রুত এসে নীলাকে মাটি থেকে তুলে ড্রয়িংরুমে নিয়ে গেলো। এরপরে হোম ডক্টর কে ফোন করে দ্রুত আসতে।
সবাই চিন্তায় পড়ে যায়। কি হলো নীলার? আবছা আবছা ধারণা মনে মনে করতেছিলো রেহেনা শিকদার ও দিলারা খান। কিন্তু মুখ ফুচকে কিছু বলছে না শিউর না হওয়া পর্যন্ত। ডক্টর এসে নীলার সেন্স ফিরায়। এরপরে চোখ মুখ দেখে। নীলাকে জিজ্ঞেস করে কবে থেকে এরকম লাগে। নীলা বলে সপ্তাহখানেক। ডক্টর বলে আমি ধারণা করছি নীলা ম্যাম মা হতে চলেছে। আকাশ স্যার আপনি একটা প্রেগনেন্সি পরীক্ষার কাটি নিয়ে আসিয়েন। এইগুলা ঔষধ দিলাম দুর্বলতা কেটে যাবে। এই বলে ডক্টর চলে যায়। আকাশ খুশিতে গদগদ হয়ে সবাইকে বলে আমি বাবা হতে চলেছি।
চলবে,,,
®️ রিয়া জান্নাত