দহন পর্ব-২৮

0
652

দহন _ ২৮

আকাশের সার্জারীর একমাস হলো। আকাশ আগের মতো সুস্থ হয়ে গেছে।

প্রবল বর্ষণের ধারার ন্যায় তুষারের ফোয়ারা আছড়ে পড়ছে বাইরে। নীলা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। অথচ পছন্দের সেই তুষারপাত এক মুহূর্তের জন্যও আকৃষ্ট করতে পারছেনা তাকে। মনের মাঝে খেলে চলেছে অদ্ভুত এক দোলাচল। জীবনের হিসাব মেলাতে মেলাতে সে ক্লান্ত। আর কোনো হিসেব মেলানোর চেষ্টা করেনা। তবুও কিভাবে যেনো সব গড়মিল তার জীবনের সাথেই ঘটে।

তুষারপাতের ফলে আজকে সকালে শীতের প্রকোপ একটু বেশীই। ঘুমের ঘোরে ব্ল্যাঙ্কেটটা আরো খানিকটা টেনে নিয়ে বেডের ডানপাশে হাতড়ায় আকাশ । বেশ কিছুক্ষন খোঁজাখুঁজি করে কাউকে না পেয়ে চট করে চোখ খুলে ফেলে। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ একহাতে কচলে তাকায় রুমের আশেপাশে। জানালার কাঁচ লাগানো। বাহিরের দিকে দৃষ্টি মেলে নিমগ্ন হয়ে কিছু একটা ভাবছে নীলা । রুমের মধ্যে হিটার থাকায় শীত কম। তাও কেমন যেনো একটা শীত শীত ভাব থেকেই যায়। আস্তে ধীরে সেদিকে এগিয়ে যায় আকাশ। তড়িৎগতিতে নীলাকে কোলে তুলে ধপাস করে ফেলে দেয় বিছানায়। অতঃপর নীলার বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে সে। একহাত দিয়ে গলা পর্যন্ত টেনে নেয় কম্বল।

ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে হুলস্থুলরকম ভাবে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় নীলা । যতক্ষণে বোধগম্য হলো ততক্ষনে বেশ ভারী ভারী নিঃশ্বাস ছাড়ছে আকাশ । তপ্ত শ্বাস ফেলে আকাশকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় নীলা । অবাক হয়ে তাকায় আকাশ । টেনে ধরে নীলার বাহু। নীলা ছিটকে সরিয়ে দেয় হাতের বাঁধন। ভ্রুজোড়া আরো খানিকটা কুঁচকে যায় আকাশের। ঘুমের রেশ ছুটে গেছে সেই কখন। তবুও আস্তে ধীরে উঠে বসে সে। রাশভারী কণ্ঠে বলে,

“মন খারাপ?”

হাসে নীলা । আয়নার সামনে দাড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিজেকে। দেখে চোখের নিচের কালো দাগগুলো। এবড়ো খেবড়ো মুখের ত্বক ছুঁয়েও দেখে। দেখে এলোমেলো চুলগুলোকে। বিদ্রূপাত্মক কণ্ঠে বলে ওঠে,

“মনের খবর রাখতে জানলে, মন খারাপের কারণ হতেনা।”

ভারী চমকায় আকাশ । একে একে মনে করতে থাকে নিজের কর্মকাণ্ড। নাহ! কোথাও তো সে মন খারাপ হওয়ার মতো কিছু করেনি! তবে কেনো এ অভিযোগ! মনের কথা মনের মাঝে চেপে রেখে এগিয়ে যায় নীলার কাছে। বাহু ধরে টেনে বসায় বেডে। নিজেও বসে পড়ে পাশে। নীলার দুইহাত ভরে নেয় নিজের হাতের মুঠোয়। অতঃপর দীর্ঘ এক বিরতি নিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,

“সমস্যাগুলো কখন বড়ো হয় জানো? যখন আমরা তার সমাধান করিনা। একটা ছোটো বিষয়, ছোটো আঘাত অভিমান আকারে মনে পুষতে পুষতে একসময় তা দীর্ঘকায় রূপ নেয়। মানুষ তো সেখানেই থাকে, তবে মাঝে তৈরি হয়ে যায় এক অদৃশ্য দেয়াল। একজন অভিমান ভাঙ্গিয়ে দেয়াল টপকে ওদিকে পৌঁছাতে পারেনা। আবার অপরজন অভিমানে সিক্ত হয়ে দম্ভে দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করেনা। ফলে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একসময় অসহ্য রকম অসহনীয় হয়ে ওঠে একে অপরের কাছে। অতঃপর বিচ্ছেদ। অথচ একে অপরকে ভালোবেসে সংসার পেতেছিলো তারা।”

নিশ্চুপতাকে সঙ্গী বানিয়ে নিঃস্তব্ধ থাকলো নীলা। মুখে রা ও কাটলো না। তপ্ত শ্বাস ফেলে খানিকটা এগিয়ে গেলো আকাশ । বামহাতের বাহু দ্বারা চেপে ধরলো নীলার মাথা নিজের বুকে। সাথে সাথেই ভেজা অনুভব করলো বুক। বিস্মিত দৃষ্টি তাক করে ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে টেনে তুললো নীলার সিক্ত কপোল। মুক্ত কণার ন্যায় বারিরাশি উপচে পড়ছে আঁখিকোটর হতে। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে থাকে আকাশ। মস্তিষ্ক শুন্য শুন্য লাগছে। দূরত্ব কমিয়ে আরো খানিকটা কাছে টেনে নিলো নীলাকে। একেবারে বুকের সাথে জাপ্টে ধরে পিষে দেবে যেনো! বাড়লো কান্নার গতি। এবার সশব্দে কেঁদে উঠলো নীলা । প্রিয়মানুষের ছোঁয়া বোধহয় এমনি! একটু বেশিই আহ্লাদি। তাইতো আহ্লাদে আটখানা হয়ে ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে অশ্রু। বুকের মাঝে তির তির করে বিঁধছে প্রিয়তমার প্রতিটা অশ্রুকণা। ছারখার হচ্ছে ভেতরটা। যন্ত্রণায় হিম হয়ে আসছে শরীর। খানিকটা সময় অতিবাহিত হতেই ছিটকে দূরে সরে গেলো নীলা। হুট করেই যেনো কোনো অশরীরী ভর করলো তাকে। কান্নার ফলে ফুলে ওঠা চোখ মুছে ফেললো এক নিঃশ্বাসে। অতঃপর আবারো এগিয়ে এসে এক হাতের মুঠোয় ভরে টেনে ধরলো আকাশের কলার। শান্ত দৃষ্টিতে হিশহিশিয়ে বলে উঠলো,

“প্রতিশোধ শব্দটা এতো ভারী কেনো আকাশ? এই প্রতিশোধ শব্দের জন্য চারদিকে শুধু শূন্যতা। এতো ছোট বয়সে সাফা তার মায়ের কঠোর রুপ দেখলো। বলেনতো বাচ্চাটা কি শিখবে এখানে। ৩০ বছরের সংসার আজ দহনে। আপনি আজ পিতৃহারা। অথচো সেই মানুষটা আমাদের কিন্তু খুব ভালোবাসে? লোভ মানুষকে এতোটাই অন্ধ করে দেয় আকাশ। ভবিষ্যতের চিন্তা একবারো মাথায় আসেনা। এতো লোভ করে হলো কি? শেষ বয়সে জেলে থাকতে হচ্ছে। কোর্টে গেলে মানুষ টার মুখ দেখলে নিজেকে অসহায় লাগে। এতো পাপ করেছে যে, তাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য অনেক চেষ্টার পরেও বারবার বৃথা হচ্ছি। মা যদি একটু হেল্প করতো, অবশ্য এখন তিনিয়ো চায় বাবা ফিরুক। ”

” একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে নীলা। ভালো সময়ের জন্য অপেক্ষা করো। পরিস্থিতির স্বীকার যেমন আমরা ঠিক পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা এখন। বৃষ্টি জঘন্য অপরাধ করেছে, কোনোদিন আমি ওকে মাফ করতে পারবো না। যখন সে স্বামী হারিয়ে সাফার করতেছিলো, তখন আমি তার লড়াই করি সমাজের সাথে। তুমি তার হারিয়ে যাওয়া সবকিছু ফিরিয়ে দিলে। বাবাতো ভূল করেছে কিন্তু মানুষটা তার শাস্তি পেয়ে গেছে। তার বিনিময়ে প্রতিশোধের নেশায় আমাদের ক্ষতি করলো। ভালোবাসার কাঠগড়ায় মুখোমুখি হয়ে দাড়িয়েছিলাম আমরা। ”

” বৃষ্টি মাফ করার প্রশ্ন আসেনা। কারণ তার ভিতরে প্রতিশোধ নামক হিংস্রতা রয়েছে। তাকে বের করে আনলে আমাদের জন্য ক্ষতি। সাফার জীবনে বৃষ্টির হিংস্রতার প্রভাব ফেলতে দেওয়া যাবেনা। ”

থামে নীলা । ডুকরে কেঁদে ওঠে। আকাশ নিঃশব্দে আবারও বুকে টেনে নেয় তাকে। একহাত মাথার পিছে দিয়ে নিঃশব্দে ভরসা দেয়। চুলের মাঝে এঁকে দেয় গভীর চুম্বন। সরে যায় নীলা । নিজেকে ধাতস্থ করে কাঠ কাঠ গলায় বলে ওঠে,যখন তখন এভাবে কাছে আসবেন না

আকাশ আবারো বামহাত দিয়ে নীলার কোমড় ধরে, বুকের কাছে মাথা এনে, ডানহাতের বৃদ্ধা অঙ্গুলির মাধ্যমে মুখ তুলে ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে দেয় এক গভীর চুম্বন। নীলা ফ্যালফ্যাল করে আকাশকে দেখে। এরপরে বলে, কি করলেন এটা। আপনি জানেন না স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া স্ত্রীর সাথে জোড় করতে নেই।

স্ত্রী যদি স্বামীকে বারবার দূরে ঠেলে দেয়। তাহলে অবলা স্বামী তার ভালোবাসা এইভাবে প্রকাশ করে। স্ত্রীকে ভালোবাসার জন্য অনুমতি লাগেনা। এভাবে দূরে ঠেলে দিলে ভালোবাসা প্রকাশ করবো কিভাবে। নাকি মানুষের মতো পরকীয়া শুরু করবো। তুমি বলো,

” নীলা অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে আকাশের উপর। এরপরে রেগে বলে ফেসবুকে এরজন্য সুন্দর সুন্দর পিক আপলোড দেন। আকাশ মুচকি হেঁসে বলে পাগলী বউ। ফেসবুকে পিক আপলোড দিই ভালো লাগে তারজন্য। ”

” একাউন্ট ডিলিট করে দিবো আমি আপনার। আমার জামাইয়ের পিকে নানান মেয়ে রিয়েক্ট দিবে ক্যান! আর কমেন্টে ওয়াও, নাইস, হ্যান্ডস্যাম বলবে ক্যান। এসব বলার অধিকার শুধু আমার। ”

” তুমিতো আমার কাছেই আসতে চাওনা। তাই অন্য মেয়ের কমেন্টে প্রেম গুলো মনে মনে উপভোগ করি। ”

” ফেসবুক একাউন্ট আজকেই ডিলিট দিবো। ফেসবুক নামক সতীন রাখতে পারেন ওই মেয়েগুলোকে আনফ্রেন্ড করলে। মেয়েগুলো কেমন জানি লুচ্ছি স্বভাব। আমার বিবাহিত সুন্দর জামাইয়ের দিকে নজর দেয়। ”

” আকাশ ফিক করে হেসে দেয়। এরপরে বলে এতই যদি ভালোবাসো তাহলে জামাই কাছে গেলে দূরে ঠেলে দাও কেনো? ”

নীলা আকাশের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আয়নার সামনে দাড়ায়। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে নিজের রুপ দেখা শুরু করলো। আকাশ নীলার কাছে যেয়ে পিছন থেকে দুই হাতের বাহু দ্বারা নীলার পেট জড়িয়ে ধরলো। এরপরে নীলার কাঁধে থুতনী রেখে জিজ্ঞেস করলো! কি দেখছো আয়নায়।

” আমাকে খুব বিশ্রী লাগে তাইনা আকাশ। চোখের নিচের কালসিটে দাগগুলো মুখের সাথো আজকাল বড্ড বেমানান। এরজন্য আপনি ফেসবুকের লুচ্ছিদের দিকে নজর দেন। ”

” আমি থাকতে তোমার আয়না লাগে। আমিতো তোমার আয়না। আমার বউয়ের মতো দ্বিতীয় সুন্দরী এই পৃথিবীতে কেউ নাই। হাজার কপাল করে এরকম একটা বউ পেয়েছি। ”

” আজকাল আপনার কথাগুলো কেমন জানি মিথ্যা মনে হয়। আমিতো দেখছি আমি কেমন হয়েছি। আসলে নিজের যত্ন নিতে ভূলে গেছি। জানতাম না বিয়ের পরে এতো দায়িত্ব কাঁধে ভর করে। প্রতিদিন নতুন অভিজ্ঞতার সাথে মুখোমুখি হচ্ছি। চারদিকের পৃথিবী টা কেমন জানি অচেনা অচেনা লাগে। কাছের মানুষের দ্বারা প্রতারিত হতে হচ্ছে বারবার। ”

” তোমাকে না বলছি যন্ত্রনা গুলো দূরে রাখো। আমায় শুধু ভালোবাসো। তোমার কি ইচ্ছে করছেনা এতো ঠান্ডায় আমার বুকের পরশে নিজেকে জড়িয়ে নিতে? ”

” নীলা এবার চুপ করে যায় । আকাশ নিজের বাহু খুলে নীলাকে সামনের দিকে ঘুড়িয়ে বলে। আই লাভ নীলা। নীলা চোখ বন্ধ করে ফেলে আই লাভ ইউ শোনার পরে। আকাশ বলে নীলা আমাদের বিয়ের পর দেখছি তুমি বড্ড বোরিং হয়ে গেছো। আই লাভ ইউ শুনলে চোখ বন্ধ করতে হয়না। আই লাভ ইউ টু বলতে হয়। আমার লজ্জা করে আকাশ। আপনার এই লুতুপুতু স্বভাবগুলো চোখ বন্ধ করে উপভোগ করি। ”

” শুধু উপভোগ করলে হবে জামাইকে তো তৃপ্তি দিতে হবে। একা একা আর কতো ভালোবাসবো। তোমার কি ইচ্ছে করেনা আমাকে একটুখানি ভালোবাসা দিতে। ভালোবাসতে গেলে দুজনের ইচ্ছুকমুখি হতে হয়। একা একা ভালোবাসা কন্টিনিয়ো করা অনেক কষ্টের। ”

নীলা মনে মনে বলে বেডা শয়তান সারাক্ষণ আমার পিছনে লেগেই থাকে। একটু যদি পীরিত দেখাই তাহলে তো পিছন সাড়তেই চাইবেনা।

” কি নীলা এইরকম রণমুর্তির মতো ভাবলে হবে। ভালোবাসা শুরু করি কুয়াশার সকালে। ”

চলবে,,,
®️রিয়া জান্নাত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে