দহন _ ২৬
ডক্টরের কথা শুনে সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে! আকাশকে কেবিনে শিফট করা হইছে। কেবিনে একজনের বেশি লোক অ্যালাও না। তাই সবাইকে এক এক করে আকাশকে দেখার অনুরোধ জানালো নার্স। প্রথমে দেখতে গেলো আশফাকুল।
” আকাশের কপালে চুমু দেয়। এরপরে আকাশকে বলে বাবা তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো। তোমাকে এইভাবে পড়ে থাকতে দেখে খুবই খারাপ লাগে। কি বয়স হয়েছে তোমার? এখনো আমাকে নানুভাই বানাতে পারলানা তার আগেই নিজের এই দশা বানিয়ে ফেলছো। অবশ্য তোমাকে কি বলবো? সবতো আমার মেয়ের এক লাইন বেশি বোঝার ফল। বাবা আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারছিনা। বাইরে তোমার দুইটা মা অপেক্ষা করছে। ভালো থেকো বাবা আগামীকাল যেনো আমার সঙ্গে কথার বলার মূহুর্ত তৈরি করে আল্লাহ তালা। ”
স্যার আপনি এবার বাইরে যান। নাহলে বাকিরা আসতে পারবেনা।
” হুম! ”
আশফাকুল বের হতেই দৌড়ে রেহেনা শিকদার ছেলেকে দেখতে যায়। রেহেনা শিকদার আকাশের মুখ দেখেই কেঁদে ফেলে। কারণ নিষ্পাপ বাচ্চার মতো শুয়ে আছে আকাশ। আকাশকে এইভাবে দেখে ২ বছরের বাচ্চা মনে হচ্ছিলো। ছেলের করুণদশা দেখে কেঁদে ফেলে মা। নার্স রেহেনাকে ধরে ধরে বাইরে বের করে আনে। এরপরে বলে পেসেন্ট সদ্য অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হইছে। পেসেন্ট রক্তক্ষরণের রোগী। আপনাদের এতো বুঝানোর পরেও রুমে যেয়ে কান্না করেন ক্যানো? এইরকম করলে নিউরনে সারা জাগাবে না পেসেন্টের। আপনারা কি চান পেসেন্ট ভালো না হোক।
” এইভাবে কঠোর হয়ে বলছেন কেনো? ওনি আমার স্বামীর মা। ছেলের করুণদশা কোন মায়ের সহ্য হয়। ভালো করে আমি বলছি মানুষের আবেগকে আঘাত দিবেন না। আমার স্বামীর কিছু হবেনা। আমার কোনো নার্স লাগবে না আমি নিজে আমার স্বামীর দেখাশোনা করবো। ডক্টরের কাছে আমি সব বুঝিয়ে নিছি। ”
” নীলার মুখে এই কথা শুনে রেহেনা খানিকটা অবাক হয়ে যায়। নীলাকে শক্ত হতে দেখেও আনন্দ পায় রেহেনা শিকদার। ”
” দিলারা খান আকাশকে দেখে কেবিনে থাকতে পারেনা শাড়ির কাপড়ের আচল মুখে গুজে বের হয়ে আসে। ”
নার্স বলে তাহলে আমি কি চলে যাবো? আমার ডিউটি এখানে ছিলো __
” হ্যা আপনি চলে যান। দেখেন আপনার ডিউটি বোধহয় অন্যরুমে দিছে। তাছাড়া আপনার এই বিরক্ত করা মুখটা আমার সহ্য হচ্ছে না। ”
নার্সটা মুখ বাকিয়ে চলে যায়। মনে মনে বলে নিজেকে নার্স মনে করা ওতো সহজ না। দেখিনা আমার সাহায্য পড়ে কিনা। তখন আমিয়ো কথা শুনিয়ে দিবো ইচ্ছেতালে।
” বাবা তুমি রক্ত ডোনেট করছো তুমি সবাইকে নিয়ে বাসায় যাও। কেবিনে একজন থাকার পারমিশন আছে নাহলে একজনকে থাকতে বলতাম। কিন্তু তোমরা চিন্তা করিয়ো না আমি সব ঠিকঠাক দেখে নিবো। কাল সকালের আগে আকাশের জ্ঞান ফিরবে না। এইখানে বেশিজন থাকা মানে গন্ডগোল। তোমরা চিন্তা করিয়ো না আমি আকাশের খেয়াল রাখবো। বাবা আম্মাদের নিয়ে যাও। নিজের খেয়াল রাখবেন সবাই কাল সকাল সকাল আসলেই হবে। ”
” কোন সময়ে কি লাগে না লাগে একাই তুমি কুলাতে পারবেনা নীলা আমি থেকে যাই। তোমার তো ঘুম আসতেও পারে। আমরা দুজন থাকলে ভালো হবে। ”
” বাবা তুমি আমার শাশুড়ী আম্মাকে বলে দাও। আকাশ যেমন ওনার ছেলে আমার স্বামী। আকাশ সেভ থাকবে । আমি এতো বকবক করতে পারবো না কারো সঙ্গে। ডক্টর বলে দিছে কেবিনে কোলাহল করা যাবেনা। তাই একজন থাকার অনুমতি দিছে, ওনি থাকতে চাইলেও সম্ভব নয়। যথেষ্ট ভালো থাকবে আকাশ। তোমরা যাও এখনো আকাশের মুখ আমি দেখতে পারি নাই। ”
” নিজের আর আকাশের খেয়াল রাখিস মা। আমরা যাচ্ছি। ”
” হুম বাবা! আমার শাশুড়ী মাকে ওই বাড়িতে যেতে দিয়ো না। তোমাদের সঙ্গে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যাইয়ো। নাহলে টেনশন করবে। ”
” তুমি নিজের আর আমার ছেলের খেয়াল রাখিয়ো আমার জন্য ভাবতে হবে না। রাগ করে রেহেনা শিকদার গমন করলো হসপিটাল থেকে। ”
” রাগ করিস না মা। তোর শাশুড়ী সন্তানের জন্য এরকম করছে। ”
” যাওতো বাবা। এসব আমাকে বুঝাতে হবেনা। ”
রেহেনা শিকদার, আশফাকুল খান,দিলারা খান, গাড়িতে উঠে বসলো। হসপিটাল ত্যাগ করে বাড়িতে রওনা হলো। সাফা নাকি খুব কান্না করছে আশফাকুলকে ফোন করে বলে তার বাবা । আশফাকুল বলে তুমি একটু দেখে রাখো আমরা যাচ্ছি। আর তোমার দাদুভাইয়ের কথা বাড়িতে যেয়ে বলবো।
” নীলা এবার কেবিনে যায়। নিজের প্রিয়তম কে দেখার জন্য। যেয়ে দেখে নিজের প্রিয়তমের করুন মুখ। মুখে বৃদ্ধর ছাপ স্পষ্ট লাগছে। মাথার চুলগুলো নেই। কারণ মাথায় অপারেশন করা হয়েছে। এরজন্য ডক্টর আকাশকে নেড়া বানিয়ে দিছে। আকাশকে দেখে বুঝার জো নেই সে ২৯ বছরের যুবক। মনে হচ্ছিল ৪০ এপার ওপার। নীলা যেয়ে আকাশের কপালে চুমু দেয়। কেনো তুমি আমাকে এতোটা ভালোবাসলে আকাশ। নিজের যত্ন নেওয়া বন্ধ করে দিছো। এই চারমাস তোমার উপর দিয়ে এতো কিছু গেলো। সব ওই বৃষ্টির কারণে। আমি ওই মেয়েকে ছাড়বো না। যতই সে কাছের হোক, ও তোমাকে আর আমাকে অনেক কষ্ট দিছে। ওর জন্য আমি তোমার ভালোবাসার স্পর্শ কাতরতায় ভূগেছি। তুমি ভুগছো দহনে। ভালো লাগেনা আকাশ, চারপাশে এত অপরাধ কেনো আমাদের ঘীরে। তোমাকে ঘীরেই আমার জীবন, তোমার কিছু হলে আমি বাঁচবো না আকাশ। তুমি শুধু আমার স্বামী নয়। তুমি আমার হৃদপিণ্ড, আমার কলিজা,আমার প্রাণ। তুমি ছাড়া নীলা অচল। এবার আকাশের গালদুটো আলতো ভাবে নেড়ে দেয়। চোখের পানি মুছে ডক্টরকে ডাকতে যায়। ”
” ডক্টর আকাশকে স্যালাইন দেওয়ার টাইম এখন। আপনি বলেছিলেন স্যালাইন না দিলে আকাশের জ্ঞান ফিরবে না। এই টাইমের কথা বলছিলেন। আমার কাছে তো নার্স নাই দয়া করে ইনজেকশন টা পুস করে চলে আসেন। ”
” হুম ম্যাডাম আমি যাচ্ছি, আমার আরেকটা অপারেশন আছে মেরুদণ্ড নিয়ে ভালো সময়ে এসেছেন। আমি যাচ্ছি আপনি স্যালাইন টা তৈরি করেন। ইনজেকশন পুশ করে চলে আসবো। কারণ মেরুদণ্ডের অপারেশন খুবই ক্রিটিকাল আপনি তো জানেন। ”
” হুম ডক্টর আমি সবই তৈরি করে আসছি। আপনি শুধু ইনজেকশন টা পুশ করে আসেন। ”
” ওকে ”
” ডক্টর আকাশের কেবিনে ঢুকে আকাশের বাম হাতের শিরায় ইনজেকশন পুশ করে। এরপরে নীলাকে বলে, কোনো চিন্তা করবেন না ম্যাম ভালো হয়ে যাবে। ভেবেছিলাম পরবর্তীবার স্ট্রোক করলে কোমায় যাবে। কিন্তু রক্ত যে এভাবে জমাটবাধা ছিলো তা ধারণা বাইরে ছিলো। অপারেশন হয়েছে জ্ঞান ফিরলে ঠিক হয়ে যাবে। তবে আপনিতো জানেন এই রক্তক্ষরণ খুবই রেয়্যার রোগ। কোনোরকম ভাবে মস্তিষ্কে অ্যাটাক করলে তাকে আর ফিরে পেতেন না। আমি শিউরিটি দিচ্ছি আপনার স্বামী আগের মতো সুস্থ পড়বে। ”
” নীলা মুচকি হেসে বলে, সবই উপর আল্লাহর ইচ্ছে স্যার। ওনি আমার ভালোবাসাকে অকালে কেড়ে নিতে পারেন না। আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে আকাশ সুস্থ হয়ে আসবে। ”
” আসি ম্যাডাম, আমার অপারেশন আছে। ”
” হুম যান স্যার। ”
নীলা চেয়ারে বসে আকাশের ডান হাত ধরে বসে থাকে। আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। একবার স্যালাইনের দিকে নজর রাখে কখন স্যালাইন শেষ হবে। চোখগুলো বারবার করে ভিজে যাচ্ছিলো। এরপরেও নীলা নিজের ওড়না দিয়ে চোখগুলো বারবার মুছে ফেলে। স্যালাইন শেষ হয়ে যায়। নীলা স্যালাইন টা খুলে ফেলে। এরপরে আকাশের উপড়ে পাতলা একটা চাদর দিয়ে অযু করতে যায়। নীলা অযু করে জায়নামাজ টা বিছিয়ে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে। মোনাজাতে শুধুই আকাশের সুস্থতা কামনা করে। এরপরে মোবাইল থেকে সূরা ইয়াসিন বের করে তিলওয়াত করে তিনবার। এরপরে সূরা রাহমান পড়ে আকাশের কানের সামনে। রাত ৪ টা বেজে যায়। কিছুক্ষণ পর ফজরের আযান হয়। নীলা আযান শুনে আকাশের কপালে চুমু দিয়ে অযু করে সালাত আদায় করতে বসে। নামাজ শেষে মোনাজাতে আকাশের সুস্থতা কামনা করে। আকাশের জ্ঞান তাড়াতাড়ি ফিরাতে বলে। জায়নামাজ উঠিয়ে নীলা আকাশের কাছে যায়। যেয়ে দেখতে পায় আকাশ পিটপিট করে চোখ খুলে রয়েছে।
নীলা আনন্দে আত্মহারা হয়ে আকাশকে বলে, কেমন আছেন আকাশ শিকদার? আমার অনুপস্থিতে নিজের এ কেমন হাল করেছেন? আপনি জানেন না আপনি ছাড়া আমি অর্থহীন? ক্যানো এতো টেনশন করেন। আপনার কি বিশ্বাস ছিলো না আপনার নীলা মরতে পারেনা?
আকাশ উঠার চেষ্টা করে। কিন্তু উঠতে পারেনা। নীলা বুঝতে পেরে আকাশের কাধ ধরে উঠিয়ে দিয়ে আকাশের সামনে আসে?
” আকাশ নীলাকে জড়িয়ে ধরে। এরপরে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে, আমি জানতাম আমার নীলার কিছু হতে পারেনা। আমার নীলা মারা যায় নাই? কিন্তু জানো নীলা ওরা আমার কথা বিশ্বাস করে নাই। ওরা কাকে না কাকে তোমাকে ভেবে দাফন করেছে। অবশেষে আমার বিশ্বাসের জয় হলো নীলা । আমার নীলপাখি আমার কাছে চলে আসছে। নীলার কাধে থুতনি রেখে শুধুই চোখের পানি ফেলে। ”
” আকাশের থুতনী সরিয়ে দিয়ে দুহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে। আজকে আমাদের কাদার দিন নয় আকাশ। আল্লাহ আমাদের ভালোবাসায় ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিলো। অবশেষে আমাদের মিলিয়ে দিছে। কিন্তু তোমার কাছে আমার অভিযোগ যদি তুমি জানতাই আমি মারা যাই নাই তাহলে নিজেকে এইভাবে শাস্তি দিছো ক্যান? ”
” ওরা আমাকে বাধ্য করেছিলো নীলা। তোমার মৃত্যুর গুজব আমি নিতে পারছিলাম না। তারজন্য স্ট্রোক হয়ে গেলে আমি কি করবো? ”
” কিন্তু আকাশ যেখানে সবাই বিশ্বাস করলো নীলা মারা গেছে? সেইখানে তুমি বিশ্বাস করলা না কেনো আমি মারা যাই নাই? ”
” কারন আমি যেই মানুষটাকে ভালোবাসি। তার প্রত্যকটা অঙ্গ প্রতঙ্গ নিখুঁত ভাবে চিনি । সেই দাফন মোড়ানো ডেড বডির চর্বিযুক্ত তীল ওয়ালা পেট নাই দেখে বুঝতে পারি। এ আমার নীলা নয়। ”
” কি তুমি অন্য মেয়ের এসব দেখছো? জানো তুমি কতবড় পাপ করছো? ”
” আমি কোনো অশ্লীল দৃষ্টি নিক্ষেপ করি নাই। প্রেয়সীকে চিনার প্রচেষ্টা করেছি শুধু। এতে যদি পাপ লাগে লাগুক। ”
চলবে,,,
®️রিয়া জান্নাত