দহন _ ২৪
” আসসালামু আলাইকুম মা । কেমন আছো তোমরা সবাই। দরজা ছাড়ো আমি ভিতরে যাবো। অনেক টায়ার্ড লাগছে। ”
রেহেনা শিকদার চোখগুলো হাতের আঙুল দিয়ে ঘসা দিয়ে সামনে আবার দেখে___
” আমি কি ঠিক দেখছি। নীলা তুমি সত্যি আমার সামনে দাড়িয়ে আছো। এরপরে নিজরে হাতের চামড়ায় চিমটি কেটে বলে সত্যি তো নীলা আমার সামনে দাড়িয়ে। ”
” হ্যা আমি তোমাদের নীলা। টিভিতে নিউজ দেখো নাই। নিউজে তো সবটা বলা হয়েছে। ”
” তাহলে কিছুক্ষণের আগের নিউজ সত্যি ছিলো? ”
” হুম মা আমাদের কাছের লোক গুলো পিছন থেকে বারবার ছুড়ি মারছে। যে মেয়েকে তুমি ত্রিশ বছর পর পেলে সেই মেয়ে আমাদের পিছন থেকে বুকে ছুড়ি মেরেছে। ”
” বাইরে থেকে কাউকে চিনা যায়না মা। আমার বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি বৃষ্টির সঙ্গে দেখা করে কথা বলবো ক্যানো নতুন আশ্রয়দাতার এভাবে ক্ষতি করলো। আমজাদ ও বৃষ্টির মধ্যে তফাত কই থাকলো তাহলে। দুজনেই একই দোষে দোষী। প্রতিশোধের নির্মম খেলায় ১৮ টা পরিবার এবং আমাদের পরিবারকে বিচিন্ন করলো। ওকে আমার মেয়ে বলতেও বিবেকে বাধছে এখন। ”
” এসব পরে বলা যাবে। আমার আকাশ কই? আমার আকাশ ঠিক আছে তো? একবারো এখানে আসলো না। আমি আকাশের কাছে যাবো মা। বলেই ভিতরে ঢুকতে পা বাড়ালো নীলা। ”
” আকাশ সোফা থেকে উঠে মুখ ঘুড়ে দাড়িয়ে বলে ওখানেই দাড়াও নীলা। ”
নীলা আকাশ কে দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। দৌড়ে যেয়ে আকাশকে জড়িয়ে ধরে। এ কেমন হাল করছেন নিজের? খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করেন নাই। এরকম শুকিয়ে গেছেন ক্যান। ঘুম ঠিকমতো পারেন নাই? চোখের নিচে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে। এ কিরকম হাল করেছেন নিজের।
আকাশ নীলাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ধাক্কা মারে।এরপরে বলে ___
” নাটক হচ্ছে। কই ছিলে এতোদিন, হুট করে স্বামীর কথা মনে পড়ছে। তাই নাটক করতে চলে আসলে। আর নিউজে এসব কি দেখাচ্ছে মা। শিকদার কোম্পানিতে কবে আগুন লাগলো? আর বৃষ্টিকে জেলে নিলো ক্যান। এসবের কিছু বুঝতেছি না আমি। আর নীলা কানাডা যখন আমাকে ফেলে গিয়েছো, আসার কি দরকার ছিলো? যাওয়ার আগে তো আমার কাছ থেকে একবারো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করো নাই। তা শুনতে চাই কি এমন দরকার ছিলো যে চারটা মাস জামাইকে ছাড়া থাকলা। চারটা মাসে একবারো আমার খোঁজ নেও নাই? হুট করে এসে পীরিত দেখাচ্ছো, এসবের মানে কি নীলা? আমিতো এইরকম নীলাকে ভালোবাসি নি? ”
আকাশের কথা শুনে নীলা অনেক বড় শক খেলো। যদিও নীলা সবটা জানে আকাশের মাথায় সমস্যা হয়েছে। স্ট্রোকের কারণে ট্রোমাতে রয়েছে। কিন্তু তবুও এসব প্রশ্ন যেনো নীলা নিজেকে দ্বিগুণ অপরাধী মনে করলো।
” আকাশ তুই চুপ কর বাবা। নীলাকে এভাবে ধাক্কা দেওয়া তোর মোটেও ঠিক হয় নাই! নীলা ফ্লোর থেকে উঠো। আকাশ মানসিক ভাবে অসুস্থ। আমি ওকে বুঝাচ্ছি তুমি রুমে যাও। ”
” আম্মা তোমাকে কিছু বলছি না মানে এই না যে, আমার সম্পর্কে যাতা বলে দিবে? প্রশ্ন তো তোমাকেও করেছি আম্মা উত্তর কই? বৃষ্টি আমাদের শিকদার কোম্পানি পুড়িয়েছে মানে? আমাদের শিকদার কোম্পানির তাহলে অস্তিত্ব নেই। ”
” বলছি না আকাশ কুল থাকতে। মাথা ঠান্ডা রাখ তোকে আস্তে আস্তে সবটা বলা হবে। এরকম করিস না। ”
” তোমরা কি আমার ভালো চাওনা। আমার কি হয়েছে? আমার কিছু মনে হচ্ছে না কেনো? নীলা নাকি কানাডা গিয়েছে কিন্তু ও বাংলাদেশে থেকে শিকদার কোম্পানিকে কে পোড়ালো তার রহস্য বের করলো? এসব কি আম্মা ? ”
নীলা ফ্লোর থেকে উঠে আকাশের কাছে যায় এরপরে বলে আপনি চিৎকার চেচামেচি করবেন না দয়া করে। মা যেটা বলছে ওইটা শুনুন। আপনি মানসিকভাবে অসুস্থ আকাশ। আপনার রেস্টের প্রয়োজন। আপনাকে সত্যি টা বললে নিতে পারবেন না।
” তোমরা দুটোই বিশ্বাসঘাতনী। আমি বুঝতেছি না আমার কি হয়েছে? আমার চারপাশে এতো অচেনা লোক কেনো? আমি তোমাদের কাউকে চিনি না? যেই বৃষ্টির আশ্রয়দাতা আমি ছিলাম সে নাকি আমার কোম্পানিকে ধ্বংস করেছে। অথচো এতোদিন থেকে আমি জানি,শিকদার কোম্পানি আমার অনুপস্থিতে আমার মা চালাচ্ছে। এতদিন জানলাম আমার স্ত্রী কানাডা গেছে দরকারি কাজে। এখন জানতে পারছি সে নাকি শিকদার কোম্পানির ধ্বংসের মূল কালপিটকে ধরার জন্য মুখোশের আড়ালে ছিলো। আম্মা ডক্টর এমন কি বলেছে যারজন্য আমাকে তোমরা ধোঁয়াশায় রেখেছো? আমাকে কিছু না বলে তোমরা তো এখন আমাকে অসুস্থ বানাচ্ছো। তোমরা কি চাও আমি আবারো হসপিটালে যাই। যদি না চাও সত্যি টা বলে দাও? ”
” তুই সত্যি টা নিতে পারবিনা আকাশ। ডক্টর বলেছে কোনোপ্রকার মানসিক যন্ত্রণা না দিতে। এখন যদি তোকে সত্যি টা বলি তাহলে উত্তেজিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বি আকাশ। ”
” নীলা তুমি এখনো এইখানে দাড়িয়ে আছো ক্যান? বের হয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। লাগবে না তোমার মতো স্ত্রী আমার, যে চারমাস আগে আমাকে রেখে চলে গেছে। এখন তার দরকার নাই আমার লাইফে। ”
” আকাশ আপনি আমাকে ভূল বুঝছেন আমি পরিস্থিতির চাপে আপনার কাছে আসতে পারিনাই। আমার হাত পা বাঁধা ছিলো। আমি যদি আপনার কাছে আসতাম তাহলে আমাকে আপনার কাছে নয় জেলে থাকতে হতো। আপনি কি চান আপনার স্ত্রী অন্য কারো সাজা পাক। যতদিন বাচবো আপনার স্ত্রী হয়ে বীরের মতো বাঁচবো, ভীতুর মতো নয়। ”
” দেশে কি আইন নাই। আর কিসের অপরাধে জেলে থাকতা। আমি তোমার কোনো কথা বুঝতে পারছিনা। আমাকে ক্লিয়ারলি বুঝাতে না পারলে কোনো কথা বলতে এসোনা। বিচ্ছেদ হোক আমাদের মাঝে। মিথ্যা সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর দরকার নাই। কোনো মিথ্যার সম্পর্কে আমি থাকতে চাইনা। ”
” আকাশ কি হয়েছে তোর। অনেক বাড়াবাড়ি করছিস। কিছু বলছিনা মানে এই না যে তুই নায়ক হয়ে গেছিস। নীলাকে ভূল বোঝার যথেষ্ট কারণ আছে মানলাম। কিন্তু তুই আগে সুস্থ হ বাবা। এরপরে তুই একাই বুঝতে পারবি নীলার উপর দিয়ে কি গেছে। আর হ্যা নীলা তোমাকে আমি কিছু বলতে চাইনা। আকাশ সুস্থ হলে পরে চারমাসের গল্প শুনবো। ”
এমন সময় খবরের নিউজ শুনে আশফাকুল খান, দিলারা খান ও নীলার দাদু শিকদারের বাড়িতে আসে। এসে অবাক হয়ে যায় নীলাকে দেখে।
” স্বার্থপর মেয়ে আমাদের মনে পড়ে নাই তোর? এইভাবে মরার নাটক ক্যান করলি। আমাদের তো সত্যি টা বলতে পারতিস। জানিস আমাদের উপর দিয়ে কি গেছে? ”
” দিলার চুপ করো। মেয়েটাকে বুকে টেনে না নিয়ে উল্টো প্রশ্ন করছো? একবারো জানতে চাইলা সেইদিন অগ্নিদহনে নীলার সঙ্গে কি হয়েছিলো? কিভাবে বেচে ফিরলো। শত্রুদের মুখোশের আড়াল থেকে ক্যান ধরলো। আমার মেয়ে সাহসী যোদ্ধা নাহলে সেইসময়ে এতো স্ট্রং থেকে এসবের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারতো না। ”
” বউমা তুমি কি আসলে ওর মা। মা হয়ে মেয়ের দুঃখ বুঝলে না শাশুড়ীর মতো শুরু করলা? ”
” তোমরা সবাই চুপ থাক। ও আমার ছেলের বউ। চোখ বন্ধ করে আমি নীলাকে বিশ্বাস করি। তাই আমার সামনে কেউ ওকে ছোট করতে আসবেনা মুখে ছেঁকা দিয়ে দিবো? নীলা এতদিন থেকে নিখোঁজ ছিলো মানে নিশ্চয় কোনো কারণ ছিলো। কারণ টা হলো মিথ্যার মুখোশ টেনে বেড় করা। আজকে ওর জন্যই জানতে পারলাম আমার স্বামীর মতো আমার মেয়েও আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিছে। ”
নীলা সবার অভিযোগ শুনে চোখ বন্ধ করে ফেলে। এরপরে চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি গাল বেয়ে পড়ে। এরপরে বলা শুরু করে
” আমি বেচে আছি তোমরা কেউ খুশী নও। বুঝতে পারছি আমি এতদিন পর আসলাম সবার মুখে শুধুু প্রশ্ন। খুব কষ্ট পেলাম আকাশ যার ভালোবাসার জন্য এতকিছু করলাম সেই বলে আমি অপরাধী। আর মা তুমিতো আমাকে ৯ মাস ১০ দিন পেটে রাখছো তাহলে নীলাকে চিনতে এতো ভূল করলে কিভাবে। আকাশ আমি তোমার কাছে এসেছিলাম ভালোবাসার টানে। আর তুমি আমাকে তার বিনিময়ে বের করে দিচ্ছো। তোমরা সবাই ভালো থেকো। আমি যেহেতু এখানে এসে সবাইকে কষ্ট দিয়েছি। তারজন্য সবার কাছে দুঃখিত। জানতাম না আমার উপস্থিতি তোমাদের এতোটা ব্যথিত করবে। নীলা ল্যাগেজ নিয়ে শিকদার বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য রওনা হলো। ”
” তোর বাবা বেচে থাকতে তুই কেনো অন্য কোথাও যাবি? আমার কি অন্য কোনো ছেলে মেয়ে আছে। আমার যা কিছু সবতো তোদের। চল আমার সঙ্গে ওই বাড়িতে। ”
” ক্ষমা করো বাবা। মেয়েদের বিয়ের পর আসল ঠিকানা স্বামীর বাড়ি। সেই স্বামী আমাকে বের করে দিতে চাচ্ছে। তাহলে আমি যাবো কই? মেয়েদের বিয়ের পর নিজের কোনো বাড়ি থাকেনা বাবা। যেদিকে দুচোখ চায় চলে যাবো। ”
” নীলা তুমিতো জানো আকাশ অসুস্থ তাহলে ওর কথা গায়ে মাখছো ক্যান? আমি কি কখনো তোমাকে উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করছি। আমি আমার ছেলের বউকে যথেষ্ট চিনি। আমিতো তোমার আত্নগোপনের কাহিনী বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে সেই আগুনে তুমি বাঁচলে কি করে? ”
” থাক মা আমি বেঁচে থাকাতে কেউ খুশি নয়। তাই সেই কারণটা নাহয় অজানা থাক সবার। ভালোবাসার মানুষটি আমাকে বের করে দিছে তার বাড়ি থেকে এরথেকে কষ্ট পৃথিবীতে আর নেই। ”
নীলা ল্যাগেজ নিয়ে সদর দরজার কাছে গেলো। আকাশের মাথায় প্রশ্নগুলো ঘোরপাক খাচ্ছে। শিকদার কোম্পানিতে আগুন। আগুন লাগালো বৃষ্টি ও আরমান,মায়ের মিথ্যা, প্রেয়সীর আত্নগোপন,প্রেয়সীর মারা যাওয়ার গল্প, কানাডা না যাওয়ার গল্প, বাবার অভ্যন্তরীয় রুপ। সবকিছুতে মাথায়, চক্কর দিয়ে আকাশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, ফ্লোরে পড়ে যায়। রেহেনা শিকদার, আশফাকুল আকাশ বলে চিৎকার করে। ওদের চিৎকারে নীলা ল্যাগেজ ফেলে আকাশের কাছে ছুটে আসে। আকাশ কি হলো আপনার? আপনি পড়ে গেলেন কেনো? রেহেনা শিকদার বলে নীলা ডক্টর আকাশকে মানসিক টেনশন দিতে না বলেছে। আকাশ আরেকবার স্ট্রোক করলে গোমায় চলে যাবে।
নীলা না বলে চিৎকার দিয়ে ওর বাবাকে বলে বাবা অ্যাম্বুলেন্স ডাকো। আশফাকুল অ্যাম্বুলেন্সের নম্বরে কল করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকে। আকাশের মাথায় পানি ঢেলেও জ্ঞান না আসাতে আশফাকুল ও নীলা আকাশকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে হসপিটালে নিয়ে রওনা হয়। অ্যাম্বু্লেন্সে নীলা চিৎকার করে আল্লাহর কাছে আকাশকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। কারণ নীলা বুঝতে পেরেছে আকাশ আবারো স্ট্রোক করেছে।
চলবে,,,,
®️রিয়া_জান্নাত