দহন পর্ব-২১ এবং শেষ পর্ব

0
949

#দহন
#রিয়া_জান্নাত
#শেষপর্ব_২১

আকাশ শিকদার অফিসের কাছে আসতেই বিস্মিত হয়ে যায়। ফায়ার সার্ভিসের হটলাইন নম্বরে দ্রুত কল করে।

” হ্যালো ফায়ার সার্ভিস শিকদার গ্রুপের বিল্ডিং এ আগুন লেগে গেছে। ভিতরে ১৪ জন ওয়ার্কার ও ০৪ জন স্টাফ রয়েছে। আপনারা দ্রুত এসে এই আগুন নিভারণ করুন। ”

আকাশের কথা শুনে ততক্ষণে ১২ টা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে ৭২ জন ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধারকর্মী আগুন নিভাতে চলে আসে। ফায়ার সার্ভিসের লোক এসে দেখে আগুন বিশাল রুপ ধারণ করেছে। চারদিকের মানুষ নানারকম চিৎকার / চেচামেচি করতেছিলো। ফায়ার সার্ভিসের হেড এসে বুঝতে পারলো এই আগুনের উৎস তেল থেকে। কেউ ইচ্ছে করে এই অফিসে তেল লাগিয়ে আগুন লেগে দিছে। ফায়ার সার্ভিসের লোক ফায়ার এক্সটিংগুইসার দিয়ে মূহুর্তের মধ্যে দাবানলের মতো আগুন থামিয়ে আনার চেষ্টা করে । ফায়ার সার্ভিসের লোক ভিতরের মানুষকে উদ্ধার করতে নেমে পড়ে। মূহুর্তের মধ্যে মিডিয়ার লোক এসে শিকদার গ্রুপের আগুন লাগার দৃশ্য ক্যামেরায় রেকর্ড করে। এরপরে টিভি চ্যানেল গুলোতে ব্রেকিং নিউজ হিসাবে প্রচার করে।

আজকের তরতাজা খবর বিকাল ৫.৪২ নাগাধ শিকদার গ্রুপের পুরো ব্লিডিং এ আগুন লেগে যায়। আগুন নিভাতে ৭২ জন ফায়ার সার্ভিসের লোক কর্মরত। শিকদার গ্রুপের মালিকের তথ্যমতে ভিতরে ১৮ জন লোক কর্মরত রয়েছে। এদের উদ্ধার করতে নেমেছে ফায়ার সার্ভিসের চাকরিরত উদ্ধারকর্মীরা। এখনো আমরা জানিনা, তারা কি আসলেই বেচে আছে নাকি মরে গেছে। আগুন এখন নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে প্রায় , পরবর্তী আপডেট জানার জন্য আমাদের সাথে থাকুন।

এই খবর শুনে মূহুর্তের মধ্যেই নীলার দাদা হার্ট অ্যাটাক করে। দিলারা খান বিল্ডিং থেকে সিড়ি বেয়ে নামতে পড়ে যায়। আশফাকুল খান অ্যাম্বুলেন্স এনে দিলারা খান ও তার বাবাকে হসপিটালে পাঠায়। এরপরে আকাশকে ফোন করে।

” বাবা আমার সব শেষ। আমি বাঁচবো কি করে বাবা? আমার বাচার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। বাবা এই খবর নানুর কানে দিয়োনা ওনি হার্টের পেসেন্ট। এই খবর জানলে হার্ট অ্যাটাক করবে। ”

” আকাশ কিছু শেষ হয়নাই। তুমিতো সুস্থ আছো আমরা আবারো শিকদার কোম্পানিকে দাড় করাবো। তোমার নানু ও মা এই খবর শুনে এখন হসপিটালে। তুমি ওদের চিন্তা করিয়ো না, আমি তোমার কাছে আসতেছি। মিডিয়ার লোক যেনো তোমার কাছে না যায়। আড়ালে থাকো আকাশ। ”

” বাবা মা ও নীলা কি এই খবর জানে? ওরা এই খবর শুনলে ভেঙ্গে পড়বে। তুমি ওদের কাছে শান্তনা দাও। আমার এইখানে আসতে হবেনা। ”

” ওরা কি ঘরে বসে থাকার লোক? এই খবর শোনার পর নিশ্চয়ই এতোক্ষণে তোমার কাছে পৌঁছে গেছে। আমি আসতেছি আকাশ। ”

আকাশ নিজেকে আর দাড় করে রাখতে পারেনা। শরীর অবশ অবশ লাগছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে। চোখগুলো দিয়ে আর আগুনের দিকে তাকাতে পারছেনা। নিজের শরীরের ভাড় নিতে পারছেনা তার দুই পা। শার্ট মূহুর্তের মধ্যে ঘেমে যেয়ে একাকার। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। আকাশ হাটু গেড়ে মাটিতেই ভেঙে পড়ে। এমন সময় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে আল্লাহকে বলে, আমি চিৎকার করে কাদিতে চাইয়া করতে পারছিনা চিৎকার। এমন সময় আকাশের কাঁধে দুটি ভরসার হাতের স্পর্শ পায়। আকাশ চোখ তুলে উপরে তাকায়। দেখতে পায় তার মা ছলছল নয়নে আকাশকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে চোখ দিয়ে।

” মা! আকাশ শিকদারের অধঃপতন হয়ে গেছে। বাবার পাপের রাজ্য আজ দহনে পুড়ছে। কিন্তু মা শিকদার গ্রুপতো ভালো কাজ করে। সৎ পথে চলে। ভালো কাজ করার জন্য আজীবন অঙ্গীকার বদ্ধ তাহলে কোয়ালিটি ইন আবাসিক হোটেল না পুড়ে শিকদার কোম্পানি ক্যান দহনে পুড়ছে। ”

” রেহেনাকে শিকদার ছেলেকে তুলে বুকে জড়িয়ে নেয়। বাবা কিছু হয়নাই। তুই সুস্থ আছিস এরচেয়ে বড় কিছু হতে পারেনা। আমরা আবারো শিকদার কোম্পানিকে দাড় করাবো। ভেঙ্গে পড়িস না, বি স্ট্রং আকাশ। ”

এমন সময় আশফাকুল খান এসে আকাশকে বলে___

” আকাশ তোমাকে না বলছি ভেঙে পড়বা না। আমি তোমাদের বাবা জীবিত থাকতে আমার ছেলে মেয়ের কেউ কিছু করতে পারবেনা। ”

” আকাশ নিজের শশুড়কে ধরে নাবালক বাচ্চার মতো কাঁদতে থাকে। ”

এমন সময় বৃষ্টি এসে বলে আকাশ নীলা কোথায়। ওর সাথে
আপনার দেখা হয়নাই?

” নীলা আসে নাই এখনো। তোমরা ওকে ছেড়ে আসলা কেনো? নীলাকেই বা একা ছাড়লা কেনো? ”

” আকাশ কি বলছেন আপনি? নীলাতো ৫.০০ টার সময় এইখানে রওনা দিছে? দেখা হয়নাই আপনাদের। ”

” মানে ”

” মানে আজকে আপনার জন্মদিন। জন্মদিন উপলক্ষে নীলা আপনাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য বাড়িতে আপনার বার্থডের আয়োজন করে। আপনাকে নাকি সকালবেলা দ্রুত আসতে বলেছিলো। আপনি আসাতে দেরি করায়। নীলা মায়ের থেকে অনুমতি নিয়ে আপনার অফিসে আসে। আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে। ”

” মা! বৃষ্টি এসব কি বলছে? নীলা এখানে এসেছে মানে। নীলা কোথায় তাহলে? ”

” ড্রাইভারকে ফোন কর। হয়তো ড্রাইভার সহ গাড়িতে বসে আছে। ”

” মা তুমি কি পাগল? নীলা আমার এতো বড় বিপদ জেনেও গাড়িতে বসে থাকার মেয়ে। এরপরে আকাশ ড্রাইভারকে ফোন করে। হ্যালো ড্রাইভার নীলা কোথায়? ”

” কেনো ম্যাডামতো আপনার সাথে দেখা করার জন্য আপনার অফিসে গেছে। অফিসে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আগুনের বিস্মরণ হয়। ম্যাডাম আপনার সঙ্গে নেই। ”

আকাশ নিজের ফোন রাস্তায় ফেলে দিয়ে আগুনের মধ্যে ঝাপ দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়।

” আশফাকুল খান বলে কি করছো আকাশ তুমি পাগল হয়েছে। আগুনে পুড়ে যাবে তো। ”

” বাবা আমার নীলা ভিতরে আছে। আমি নীলার কাছে যাবো। আমার নীলার কিছু হয়নাই তাইনা বাবা। ”

আশফাকুল খান ও রেহেনা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। মূহুর্তের মধ্যে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পৃথিবীটা অন্ধকার অন্ধকার লাগে। আকাশের কথা শুনে আশফাকুল নিজের চোখ উল্টে ফেলে মূহুর্তের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে যায়। অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত আশফাকুল খানকে হসপিটালে নিয়ে যায়। রেহেনা শিকদার রাস্তার মাঝে বসে চিৎকার করে, এই যদি কপালের লিখন হয় তাহলে আমাদের সবাইকে সেই দহনে পুড়ালে না কেনো আল্লাহ।

আকাশ নিজেকে আর কন্ট্রোল রাখতে পারেনা। চার পাচজনকে ছটকিয়ে দিয়ে সেই বিল্ডিং এ প্রবেশ করে। ততক্ষণে সেই আগুন নিয়ন্ত্রণ হয়ে গেছে একেবারে। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীগণ ০৭ জনের পুরো শরীর পুড়ে গেছে । ০৬ জন পঙ্গুত্ববরণ করছে। এই আগুনে কারো হাত কারো পা শরীর থেকে বিচিন্ন হয়ে গেছে। আর বাকি ০৫ জনের নিহত লাশ পায়। লাশগুলোর শরীর এতোটাই পুড়ে গেছে যে চিহ্নিত করার কোনো উপায় নাই এগুলা কে আসলে।

আকাশ শিকদার লাশগুলোকে দেখে এরমধ্যে নীলা আছে কিনা একটি লাশের হাতে নীলার ঘড়ি চিহ্নিত হিসাবে পাওয়া যায়।ঘড়িটা পুড়ে কালো হয়ে গেছে। বডিটা পুরো ছাইয়ের মতো রং ধারণ করছে।

আকাশ আর নিজেকে সামলাতে পারেনা ওইখানেই স্ট্রোক করে ফেলে। প্রেয়সীর ঘড়ি লাশের হাতে এই দৃশ্য যেনো পৃথিবীর আর কোনো স্বামী না দেখে। আকাশকে হসপিটালে পাঠানো হয় স্যালাইন লাগানো হয়।

ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীগণ ১৩ জন আহতদের হসপিটালে পাঠিয়ে দেয়। বাকি ০৫ জন নিহত লাশের মধ্যে ০১ টা আকাশ শিকদারের ওয়াইফ হলেও বাকি ০৪ জনকে তাদের বাবা মা ও স্ত্রী চিহ্নিত করতে পারে নাই। তাদের ছেলেমেয়ে / স্বামী আসলে কোনটা। রেহেনা শিকদার নীলার লাশকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। বাকি ০৪ টি লাশকে তাদের আত্মীয় স্বজন কেঁদে কেঁদে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করে।

মিডিয়ার লোক হেডলাইনে রাত ১০.০০ টার সংবাদে জানায়। অগ্নিদহনে পুড়ছে আকাশ শিকদারের কোম্পানি। তথ্যমতে আমরা জানছি ঘটনাস্থলে ১৮ জন লোক থাকার কথা। কিন্তু দুঘর্টনা বশত সেই সময়ে আকাশ শিকদারের ওয়াইফ নীলা শিকদার সেইখানে অবস্থান করে। তাহলে সেই সময়ে ১৯ জন লোক ভিতরে থাকার কথা। কিন্তু আমরা ১৮ জনকে পেয়েছি। এরমধ্যে একজন নিখোঁজ? ফায়ার সার্ভিসের কর্মীগণ জানায় এই আগুন প্লানমাফিক দুঘর্টনা। তাহলে কি সেই নিখোঁজ হওয়া ব্যাক্তি এই দুঘর্টনার মূল মাফিয়া। বিস্তারিত জানার জন্য আমাদের সঙ্গে থাকুন।

এই খবর দেখে একজন অন্ধকার রুমে মুখোশের আড়াল থেকে বৃষ্টিকে ফোন করে।

” বৃষ্টি ছাঁদে যেয়ে ফোন তুলে বলে কি হয়েছে আপনার। আপনাকে না বলছি পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পযন্ত আমাকে ফোন করবেন না।

” টিভিটা অন করো। নিউজটা দেখো। খেলাটা তো পুরে ঘুড়ে গেছে। আমাদের দিকে কেউ আঙুল তুলতেই পারবেনা। নিশ্চিতে থাকো। আমাদের কেউ কিছু করতে পারবেনা। শয়তান আমাদের সঙ্গে আছে। ”

” খুশি হওয়ার মতো এমন কিছু হয় নাই। আমি নীলাকে কখনো মারতে চাইনাই। কিন্তু এইটা কেনো হলো তার সাথে? ”

” নিজের ভালো চাইলে মুখ বন্ধ করো। ”

আপনি ফোন রাখেন। বৃষ্টি ড্রয়িংরুমে এসে রেহেনা শিকদারের মাথায় পানি ঢালে। কারণ রেহেনা শিকদার কিছুক্ষণ পর পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। দাঁত লাগছে। বৃষ্টি এসব সামাল দিচ্ছে।

বৃষ্টি মসজিদের ইমাম সাহেব আর কিছু মুসলিমদের ডাকে। নীলার দাফনের ব্যবস্থা করে।

সকাল হয়ে যায়। আশফাকুল খান, দিলারা খান, আকাশ শিকদার ও দাদুকে নিয়ে আসে। দিলারা খান লাশের মুখ দেখে বলে এ আমার নীলা নয় বলেই রুমে যেয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।

আকাশ শিকদার নিজের মনকে সামলিয়ে ইমাম সাহেবকে বলে __

” জানাযার আগে কারো আপত্তি না থাকলে আমার স্ত্রীর লাশকে আমি একাই কিছুক্ষণ দেখতে চাই নিরিবিলিতে। ”

এই কথা শোনার পর মুসলিম ভাইয়েরা নীলার লাশকে একা রেখে বাইরে চলে যায়।

” আকাশ অযু করে দাফনের কাপড় মুখের অংশ থেকে সরিয়ে পেটের দিকে মোড়ানো অংশ খুলে। আকাশ লাশকে দেখে নিজের আবেগ সংবরণ করে। দাফনের কাপড় ঠিক করে বলে সবাই এখানে আসুন। ”

এরপরে সবাই ভিতরে ঢুকে পড়ে লাশকে জানাযার মাঠে নিয়ে যাওয়ার জন্য!

” আকাশ বলে জানিনা আমি কতবড় পাপ করলাম আজকে। কিন্তু কথাটি বলে হালকা হতে চাই। যাকে আপনারা আমার ওয়াইফ বলে দাবি করছেন সে আমার ওয়াইফ নয়। আমার ওয়াইফ বেঁচে আছে। ”

” আশফাকুল খান বলে কি বলছো আকাশ? এ আমাদের মেয়ে নয় সত্যি বলছো? ___

” হুম বাবা! এ আমাদের নীলা নয়। আর আমি বাকি ০৪ টি লাশকে দেখেছিলাম ওগুলার ভিতর তিনজন পুরুষ ছিলো। আরেকজন মহিলা, ওই মহিলাটির মধ্যে নীলা ছিলোনা। ”

বাকিসব মুসল্লীরা বলে উঠলো আকাশ শিকদার নিজের স্ত্রীকে হারিয়ে ভূলবাল প্রলাপ বকছে।

” সমাপ্ত ”

এ যেনো শেষ হয়েও হইলো না শেষ। আপনারা চাইলে রহস্যের ভরা গন্ধ নিয়ে দহন দ্বিতীয় খন্ড শুরু হবে। গল্প যেখান থেকে শেষ হইলো, এইখান থেকেই দহন দ্বিতীয় খন্ড শুরু হবে। যারা যারা এতদিন থেকে এই কাচা হাতের লেখিকার সঙ্গে ছিলেন। তারা তারা আজকে বলুন দহণ প্রথম খন্ড কেমন লেখলাম। ভালোমন্দ সব মন্তব্যর অপেক্ষায় রইলাম। নতুন কোনো গল্প নিয়ে আবার দেখা হবে। আল্লাহ হাফেজ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে