#দর্পহরন
#পর্ব-৭০
সারাজীবন জেলে পচার চাইতে দেশের বাইরে সেটেল হওয়া লাভজনক মনে হয়েছে মোর্শেদ দম্পতির। অন্তত জেলের চার দেওয়ালের বন্দী জীবনের চেয়ে ভালো তন্ময় স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকতে পারবে এই আশায় রণর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলো তারা। সব প্রসেসিং শেষ করতে সাতদিন সময় লেগেছে তাদের। কাগজপত্রের সবকাজ শেষ হওয়ার পর রণর কাছে এসেছে তন্ময়ের মুক্তির আর্জি নিয়ে। রণ চুপচাপ মন দিয়ে সব কাগজ দেখে ফোন দিয়েছে দিলশাদকে। কি করতে হবে তা পইপই করে বুঝিয়ে দিয়েছে। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই মোর্শেদের। কারণ তারা এখন নখদন্তহীন বাঘ, কেউ ভয় পায় না।
তন্ময় প্লেনে ওঠার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রণ। একটা আপদ বিদায় হয়েছে তার জীবন থেকে। এবার অন্য কাজগুলোর উপর দৃষ্টি দেওয়া যায়। এই ভাবনা থেকেই একদিন গভীর রাতে নেত্রীর বাসায় চলে গেলো রণ। প্রতিবারের মতো আর অবাক হলো না নেত্রী। এতোদিনে রণর স্বভাব সম্পর্কে বেশ ভালোভাবেই অবগত হয়ে গেছেন তিনি। জরুরি আর ব্যক্তিগত আলাপ রাতের আঁধারে করতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে সে। নেত্রী রণর সামনে হাসিমুখে বসলেন-“বলো রাগীব, এবার কি নিয়ে চিন্তিত?”
রণ হেসে দিলো-“আপনি কি জানেন ফুপু, আপনার এই স্বভাবের জন্যই আপনাকে ভালো লাগে আমার। সবদিকে তীক্ষ্ণ নজর থাকে আপনার। সবার সবকিছু মনে রাখেন। সবাইকে বিশেষ ভাবতে বাধ্য করেন।”
নেত্রীর মুখের হাসি চওড়া হলো-“আজ কি বাটারের দাম কমে গেছে নাকি রাগীব? হঠাৎ করে এতো বাটারের ব্যবহার কেন?”
রণ হাসি ধরে রাখলো-“নাহ ফুপু, আমি মিথ্যা স্তুতি গাইতে পারি না এটা আপনি জানেন। সত্য কথাই বললাম। আপনার এই গুনাবলী আপনাকে বিশেষ করেছে। বাবা আপনার খুব প্রসংশা করতেন।”
নেত্রীর মুখে বিষাদের ছায়া নামে-“তোমার বাবা মানুষটা খুব সৎ হলেও একরোখা ছিলেন। রাজনীতিতে এই ব্যাপারটা যায় না জানো তো? তোমাকে বুদ্ধি করে সবার সাথে মিলে চলতে হবে। শত্রুকে সাথে রাখতে হবে। সেটাই রাজনীতির মাঠে সবচেয়ে বড় যোগ্যতা। আফসোস তোমার বাবা এই ব্যাপারটা বুঝতে অপারগ ছিলেন। যে কারণে তাকে বেঘোরে প্রান দিতে হয়েছে।”
রণর মুখে আঁধার নামে-“আপনি জানতেন সালিম সাহেব বাবাকে মেরে ফেলতে পারে তবুও তাকে বাঁধা দেননি ফুপু। একটাবার তাকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করেননি। কেন ফুপু?”
নেত্রীর চেহারায় বিস্ময়। কিছুক্ষণ নির্লিপ্ত থেকে উনি মাথা নাড়েন-“ভুল বুঝো না রাগীব। তোমার মতো বুদ্ধিমান মানুষের কাছ থেকে এই অভিযোগ আশা করিনি। সালিমের কথা বারবার বলার পরও তোমার বাবা কানে তোলেননি। বরং সব জায়গায় যেচে পড়ে সালিমের সাথে ঝামেলা পাকিয়েছে। তখন সালিমের দূর্দান্ত প্রতাপ, আমার ওকে মেনে চলতে হতো। বলা যায় আমি বাধ্য ছিলাম।”
রুম জুড়ে নিরবতা নেমে এলো। নেত্রীর দীর্ঘ শ্বাস অনেক কিছু বলে দেয়। সে কিছুটা ভরাক্রান্ত স্বরে বললো-“তোমার মধ্যে স্পিরিট দেখেছি বলেই তোমাকে ডেকেছিলাম রাগীব। তুমি প্রমান করলে বুদ্ধিমত্তায় তুমি বাবাকে ছাড়িয়ে গেছ। সালিমের পরিবারের দুই যুগের শাসন ব্যবস্থা গুড়িয়ে দিয়েছ। আই ফিল প্রাউড রাগীন।”
রণ স্মিত হেসে বললো-“ফুপু, চন্দ্র কিংবা আপনার পরিবারের অন্য কেউ যদি আপনার জায়গায় আসে সে আমার পরিপূর্ণ সাপোর্ট পাবে। লিডারশীপের জায়গা নিয়ে আমার কখনো কোন ভাবনা ছিলো না। আপনি আমাকে নিয়ে ভেবেছেন এতোদূর এসেছি আপনার সাহায্য সহযোগিতায়, আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু ফুপু আমি আমার স্ত্রী শুভ্রাকে ভীষণ ভালোবাসি। ওকে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব হবে না ফুপু।”
নেত্রীকে বিব্রত দেখায়-“হুট করে এসব কেন বলছো রাগীব?”
“কারণ মা জেদ ধরে আছে শুভ্রাকে ডিভোর্স দিয়ে চন্দ্রের সাথে আমার বিয়ে দেবে। আমার কোন মতামত মা শুনছে না। ফুপু ওই নিষ্পাপ মেয়েটাকে আমি ছাড়ব না কিছুতেই। তাছাড়া চন্দ্রের সাথে আমার কথা হয়েছে। ওকে আপনারা জোর করে দেশে নিয়ে এলেও ও এখনো মনে প্রানে জ্যাককে ভালোবাসে। এই অবস্থায় ওকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবা মোটেও ভালো কিছু হবে বলে মনেহয় না। আমাকে ভুল বুঝবেন না ফুপু। আমার আসলে জানতে হয়েছে এসব। বিয়েটা ছেলেখেলা নয় এটা আপনার চাইতে ভালো কে জানে। একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের সাথে সংসার করা কতোটা কঠিন তা আপনি ভালো জানেন। তাই চন্দ্রের ব্যাপারে এমন কিছু করবেন না আশাকরি। ফুপু আমাকে মাফ করবেন। আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারে এসব কিছুই বলতে চাইনি আমি। যেহেতু আমাকে নিয়ে ঘটনা ঘটছে তাই মনে হলে আপনাকে বলা দরকার। আশাকরি চন্দ্রের সাথে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা এখানেই থেমে যাবে। মাকে বোঝানোর দায়িত্বটাও আপনার ফুপু।”
রণ উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসলো-“ফুপু, আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে জানি। আপনার জন্য দলের জন্য কিছু করতে আপনার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কে থাকতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আপনি জেনে রাখুন, আপনার আর দলের যে কোন প্রয়োজনে আমি আছি। আসছি আজ।”
নেত্রীর পা ছুঁয়ে বেরিয়ে এলো রণ। মনটা খুব নির্ভার লাগছে আজ। মনের মধ্যে এতোদিনের জমে থাকা কথাগুলো বলতে পেরে অদ্ভুত শান্তি লাগছে। মাকে নিয়েও আর চিন্তা হচ্ছে না। জানে, আজ হোক কাল মা ঠিক শান্ত হয়ে যাবে। মাকে শান্ত করার কাজটা নেত্রী ওরফে ফুপুই করবে। অসংখ্য বিনিদ্র রজনী পার করে আজ বহুদিন পরে রণ শান্তির ঘুম দেবে।
*****
ইব্রাহিম নিবাসে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মোর্শেদ আর মিনু নেই। তারা তন্ময়ের সাথেই দেশের বাইরে গেছে। কবে আসবে বলে যায়নি। সালিম সাহেব কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন কেবল গো গো করেন। রিমা একদম চুপচাপ হয়ে গেছে। কারো সাথেই কোন কথা বলে না সে। দশটা প্রশ্ন করলে একটা উত্তর দেয় অবিচ্ছায়। তাহের আপাতত ইব্রাহিম পরিবারের কান্ডারী। সে তার নরম স্বভাবের খোলস থেকে বেড়িয়ে দায়িত্ববান মানুষে রুপ নিয়েছে।
তুলতুলের চল্লিশ দিন পার হওয়ার পরেই শরীফ তুলতুলকে বিয়ে করেছে। তারপর থেকে শরীফ দায়িত্ববান বাবার মতো সারারাত তুলতুলের ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ায় আর তুলতুল ঘুমায়। সারাদিন তুলতুলের যা কিছু প্রয়োজন তা সাথে সাথে দিতে যেন বদ্ধপরিকর শরীফ। তুলতুলের গরম মেজাজ, বাচ্চার কান্না সব সামলে নিচ্ছে দক্ষ হাতে। কোন একটা সময়ও বিরক্ত হয় না সে। ধৈর্য্য ধরে সব দায়িত্ব পালন করছে নিয়ম করে। মাঝে মাঝে তুলতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে শরীফকে। একই মায়ের পেটে এরকম বিপরীতমুখী স্বভাব কিভাবে হলো দুই ভাইয়ের? একজন উত্তর তো আরেকজন দক্ষিণ? তুলতুল মুগ্ধ হবে না হবে না বোঝে না। মনে বড় দ্বিধা। একদিন কি ভেবে যেন বলে ফেলেছিল-“আমার এ বাড়িতে দমবন্ধ লাগে। অন্য কোথাও থাকা যায় না?”
শরীফ গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলো-“দেশের বাইরে যাবে? আমার সাথে লন্ডনে শিফট করবে?”
তুলতুলের চোখ চিকচিক করে। সে অবিশ্বাস নিয়ে জানতে চাইলো-“আমি আর বাবু যেতে পারবো?”
“কেন পারবেনা? আমার তো ওয়ার্ক পারমিট আছে সেই সূত্রে তুমি আর বাবু সহজেই যেতে পারবে। চাইলে ওখানকার নাগরিক হতে পারবে।”
“তাহলে আমাকে নিয়ে চলুন প্লিজ। আর ভালো লাগছে না এই প্রাসাদ।”
“ঠিক আছে। আমাকে ক’দিন সময় দাও। কাগজ করতে দেই হলেই চলে যাব আমরা।”
তুলতুল মাথা দোলায়। যদিও তখন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেনা শরীফকে। শরীফ অবশ্য বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করলো না। যখন হবে তখন নিজেই দেখে নেবে এই ভেবে উঠে গেলো।
শুভ্রা খুব দরদ দিয়েই বাবার কাজগুলো করে। খাওয়াতে গেলে বারবার লালা গড়িয়ে পড়ে বারবার শুভ্রা মুছে দেয়। হাত পা ম্যাসাজের লোক এলে তাদের সাহায্য করে। বাবার পাশে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। সালিম সাহেব চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন ঘরের ছাদের দিকে অথবা দেয়ালের দিকে। বেশিরভাগ সময় সেটা শুন্য দৃষ্টি হয়। শুভ্রা মাঝে মাঝে তুলতুলের ছেলেকে কোলে
আসে বাবাকে দেখায়। নাতিকে দেখে চোখ উজ্জ্বল হয় সালিম সাহেবের। কিছু যেন বলতে চায়। দূর্ভেদ্য আওয়াজে কি বলে তা বোঝা মুশকিল হয় শুভ্রার। সে কেবল বাবার আনন্দটা বোঝে।
মানসিকভাবে ক্লান্ত বিদ্ধস্ত শুভ্রা মাঝে মাঝে বিনাশব্দে টিভিতে রণর ভিডিও ছেড়ে রাখে। রণকে দেখলে কেন যেন চোখ দুটো আপনাতেই জলে টলমল করে, বুকটা পোড়ে শুভ্রার। মিস করে ভীষণ। ভাত মুখে নিতে গেলে হাত থেমে যায় শুভ্রার। খুব যত্ন করে রণ খাইয়ে দিত তাকে। আর ভাত খাওয়া হয় না তার। কবে একটু একটু করে এই নিষ্ঠুর লোকটার প্রেমে পড়লো তা বুঝে পায় না শুভ্রা। নিজের মধ্যকার পরিবর্তন পুরোটাই মন্ত্রী মশাইয়ের অবদান সেটা ভালোই বোঝে শুভ্রা। মানুষটার সাথে সত্যিই কি তার সব সম্পর্ক শেষ? আর কোনই কি আশা নেই? ভাবতে ভাবতে শুভ্রা এলোমেলো পায়চারি করে পুরো বাড়ি জুড়ে। অবাক হয়ে দেখে তাদের বাড়ির সেই পুরনো জৌলুশ আর নেই। একসময় লোকের পদচারণায় মুখর বাড়িটা আজ সুনসান নিরব। ভাইয়া আর ভাবি শিগগিরই দেশের বাইরে চলে যাবে। হয়তো শেষ পর্যন্ত সেই একমাত্র থেকে যাবে এ বাড়িতে।
চলবে।