#দর্পহরন
#পর্ব-৩১
“খবর শুনছোস সালিম?”
মোর্শেদ উত্তেজিত কন্ঠে ফোনের ওপাশে চেচিয়ে উঠলো। সালিম সাহেব আজ এসেছে হারুনুর রশীদের সাথে আলাপ করতে। দলের মধ্যে কি চলছে সেসব জানতে। হারুন রাজনীতিতে সালিমের সমকক্ষ, বেশ ভালো বন্ধু তারা। সেই সুবাদে আসা। সালিম সাহেব দলে বেশ কোনঠাসা অবস্থায় আছেন৷ গত মেয়াদে তার ও তার পরিবারের কৃতকর্মের বেশ চর্চা হওয়ায় নেত্রীর বিরাগভাজন হয়েছেন। দলের বড় বড় নেতারাও নেত্রীর ভয়ে পারতপক্ষে তাকে এড়িয়ে চলছে। কেউ তার সাথে দলের ভেতরকার কোন কথা বলছে না। বাধ্য হয়ে বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করতে হয়েছে। বন্ধু হারুন তাকে আজ বাসায় ডেকেছে আলাপ করতে। খেতে বসে কেবলই আলাপ শুরু করেছে এরমধ্যে মোর্শেদের ফোন। সালিম ‘পরে ফোন করছি’ বলে ফোন কেটে দিলো। মোর্শেদ আরও দুইবার ফোন দিলো ফোন সাইলেন্ট থাকার কারণে সালিম সাহেব টের পেলো না।
হারুনর রশীদ বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী। দলের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে একজন। সালিমের কৃতকর্ম এবং পাওয়ার দুটো নিয়েই বেশ ভালো ভাবে অবগত। অনেকটা নিজের স্বার্থেই আজ সালিমকে ডেকে এনেছে। নেত্রী আজকাল বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের চাইতে তরুণদের প্রাধান্য দিচ্ছে। দিনে দিনে তরুন নেতৃত্বে তারা কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। এই অবস্থায় কি করা যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করাটাও খুব রিস্ক। কয়েকদিন আগে তারা কয়েকজন পুরনো সদস্য গোপনে আলোচনায় বসেছিল। নেত্রী টের পেয়ে মিটিং ডেকে তাদের সাবধান করেছেন। তারপর থেকে বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে তারা। কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে আরও কয়েকটি মন্ত্রনালয়ে নতুনদের সুযোগ দেবে। যেহেতু নতুনরা কাজ ভালো করছে। আর নতুনদের মধ্যে সালিমের মেয়ে জামাই এগিয়ে আছে। তাকে নেত্রী সব জায়গায় প্রায়োরিটি দিচ্ছে। মুরগী রানে কামড় দিতে দিতে হারুন বন্ধুকে দেখলো-“তোমার জামাই তো ভালোই খেল দেখাইতেছে সালিম। নেত্রী তাকে ছাড়া কিছু বোঝে না।”
সালিম অনিচ্ছায় হাসলো। হারুন বন্ধুর মনোভাব বোঝার চেষ্টা করলো-“শুনলাম তোমার এলাকায় শো ডাউন হবে। নেত্রী যাবে আগামী সপ্তাহে। এলাকায় দলীয় প্রধানের নির্বাচন হবে। তারপরই যাওয়ার কথা। তোমার জামাইকে সাপোর্ট দিতে।”
সালিম এবার অবাক-“কি বলো? আমি তো এমন কিছু শুনি নাই? নির্বাচন হবে আর আমি জানবো না? তুমি মনেহয় ভুল জানছো?”
হারুন বুঝলো তীর জায়গা মতো লেগেছে। সে বিজ্ঞের মতো হাসলো-“আমি ঠিক জানছি সালিম। এইগুলা ভিতরের খবর। তোমাকে জানাবে না তাই গোপনীয়তা। শুধু তুমি না দলে আমাদের সবার এই অবস্থা। কোন না কোনভাবে আমাদের চাপানোর চেষ্টা করতেছে। নেত্রী চায় নতুন মানুষ নেতৃত্বে আসুক। পুরনোদের অনেক কেচ্ছা, ঝামেলা তাই ফ্রেশ মুখ আসলেই ভালো। নেত্রী যা খুশি তাই করতে পারবে কেউ কিছু বলতে পারবে না। বুঝো নাই?”
সালিম চিন্তিত হয়ে মাথা দুলায়-“বুঝেছি। কিন্তু আমি তো এতো সহজে হাল ছাড়বো না। তিরিশ বছর হইলো নেত্রীর সেবা করতেছি এতো সহজে নিজের জায়গা ছাড়বো?”
হারুন মাথা দোলায়-“আমিও তাই বলছিলাম। তুমি কতো পুরনো মানুষ। নেত্রীর বিপদে আপদে পাশে থেকেছ। অথচ দেখো তোমাকেই আগে সরালো।”
সালিম দাঁতে দাঁত চেপে বলে-“এখনো সরি নাই বন্ধু। আমার এলাকায় আমি ছাড়া আর কাউকে দলের কান্ডারী হইতে দিব না। আমাকে সংসদের জন্য নমিনেশন দেয় নাই। সামনে মেয়র ইলেকশন ওইখানে দিতেই হবে। সেই ব্যবস্থা আমি করবো।”
“যা করার তাড়াতাড়ি করো সালিম। শুনছি মেয়র হিসেবে নতুন কাউকে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে তোমার জামাই। দেখো কি করা যায়। তোমার এলাকায় সামনে বড় বড় প্রজেক্ট হবে শুনছো তো?”
সালিম মাথা নাড়ে। হারুন অবাক হয়ে বললো-“প্রজেক্ট শীতলক্ষ্যা”র নাম শোন নাই? প্রচুর টাকার কারবার। বিশ্ব ব্যাংকের ইনভেস্টমেন্ট হবে। তার আগেই কিছু করতে হবে তোমার। না হলে কিছুই ভাগে পাইবা না।”
“হুমমম।”
চিন্তায় মুখ থেকে আর কিছু বেরুলো না। হারুন শেষ আরেকটা টোকা দিলো-“জামাই এর দিকে নজর রাইখো সালিম। নেত্রীর নজর আছে তার উপর।”
সালিম সাহেবের মাথা নষ্ট হয়ে গেলো। কোনরকমে আলাপ শেষ করে বেরিয়ে এলো হারুনের বাসা থেকে। একবার মনেহলো ফেরার আগে মেয়ের বাড়ি থেকে ঢু মেয়ে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই সে পরিকল্পনা বাদ দিতে হলো সোহেলের ফোন পেয়ে-“আব্বা, তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসেন জরুরি আলাপ আছে।”
সব বাদ দিয়ে সালিম বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটলো। মের্শেদ, সোহেল, তুহিন সবার মুখের রেখায় চিন্তার আভাস। সালিম সাহেব ঘাবড়ে গেলো-“কি হইছে ভাইজান। এমন চেহারা কইরা বইসা আছেন কেন? আর বারবার ফোনই বা দিতেছেন কেন? আমি জরুরি কাজে বাইরে আছিলাম।”
মোর্শেদ রেগে গেলো-“তোরে কি হুদা কামে ফোন দিমু আমি? শুনছোস কিছু? রবিবার আপা আসবো এলাকায়। শুনতেছি শুক্রবার বা শনিবার ভোট হইবো। এলাকায় দলীয় প্রধান নির্বাচন হইবো। জামাই চুপে চাপে কাম করতাছে। এলাকার যত টেন্ডার হইবো সব ভাগ কইরা দিছে জামাই। আমরা সব ঠিক দেওয়ার পরেও একটা কামও পাই নাই। দিন না আমাগোরে। উল্টা জাহাজ নতুন কারখানা হইবো শুনলাম। এতোকিছু হইতেছে কিছুই জানি না আমরা। এখন কেউ কোন কথা কইতেছে না। টাকার ভাগ পাইয়া মুখে কলুপ আঁটছে। এমনে তো চলতো না সালিম। আর কয়দিন এমন গেলে আমগো ব্যবসা লাটে উঠবো। এখন কি করবি ক?”
আজ সালিম সাহেবও উত্তেজিত। এতো কিছু চিন্তা মাথায় লোড নিতে পারছে না। সে হুট করে শুভ্রাকে ফোন দিলো-“আম্মা ভালো আছেন?”
রাতের বেলা বাবার ফোন পেয়ে শুভ্রা অবাক হলো-“জ্বি আব্বা, ভালো। আপনি?”
“আপনাকে কাজ দিছিলাম। কিছু কি করতে পারছেন? আজ পর্যন্ত কিছুই তো জানাইলেন না আমাকে।”
বাবার কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান বুঝতে পেরে শুভ্রা নরম গলায় জবাব দিলো-“সুযোগ নেই আব্বু। সে বাসাতেই থাকে না বলতে গেলে। কয়েক সপ্তাহ ধরে অনেক ব্যস্ত। কিভাবে কি করবো?”
“তনুও আম্মা। এই কথা বলতে লজ্জা হওয়া উচিত আপনার। সে আপনার স্বামী, তার একটা কাজের ব্যপারে আপনি জানেন না এইটা কেমনে হয়?”
বাবার স্পষ্ট ইঙ্গিত শুনে গাল লালিম হলো শুভ্রার। সে অতি দ্রুত ফিসফিস করলো-“সে আসছে আব্বা আমি রাখলাম।”
সালিম মেয়েকে ডাকলো-“আম্মা, আমাদের এলাকায় কি চলতেছে তার কাছ থিকা শুনে আমাকে জানান। আপনার জামাই আপনার আব্বার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতেছে। তার কাছ থিকা বাপরে উদ্ধার করেন।”
শুভ্রা জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দিলো। সালিম সাহেব ফোন নামিয়ে কয়েক জোড়া বিস্মিত চোখকে দেখলো। সে চোখ নাচায়-“কি হইছে?”
সোহেল অবাক হলো-“শুভ্রা কি করবো? ও রাজনীতির কি বোঝে?”
“কিছু বোঝা লাগবে না খালি আমারে খবর দিবে। এইটুক পারলেই হইবো।”
সালিম সাহেবকে ভীষন অস্থির মনে হলো। হারুনের কথা শোনার পর থেকেই অস্থিরতা পেয়ে বসেছে তাকে। আসলে এখন সালিম সাহেব হন্যে হয়ে সুযোগ খুঁজছে। কোনভাবে এমন কিছু করা যাতে নেত্রী তাকে আবার কাছে টেনে নেয়। কিন্তু কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শুধু জানেন কিছু একটা করতেই হবে।
*****
আজ গভীর রাত পর্যন্ত রণর জন্য জেগে বসে রইলো শুভ্রা। যত্ন করে শাড়ী পরলো। চোখে হালকা কাজল ঠোঁটে গোলাপি লিপবাম। আয়নায় নিজেকে দেখে লজ্জাই লাগলো। এভাবে সাজগোছ করতে দেখে ব্যাঁকা লোকটা না জানি কি বলে তাকে। নিজেই উদ্যোগী হয়ে রান্নাঘরে খাবার গরম করলো। শুভ্রাকে দরজায় দেখে অবাক হলো রণ-“আপনি ঘুমাননি? অনেক রাত হয়েছে তো?”
শুভ্রার বুক ধুকপুক করছে। মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বললো-“ঘুম আসছিলো না তাই মাকে ঘুমিয়ে পড়তে বলেছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন আমি খাবার বেড়ে আনছি।”
রণ মাথা দুলিয়ে চলে গেলো। শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলো শুভ্রা এরইমধ্যে খাবার এনে ছোট টেবিলে রেখেছে। প্লেটে সামান্য ভাত আর ভাজা মুরগী। সাথে ঘন ডাল। রণ খাবার খেতে বসলে শুভ্রাও বসলো ওর সামনে। রণ বিস্মিত হলেও স্বাভাবিক মুখভঙ্গি করে বললো-“আপনি চাইলে ঘুমিয়ে যেতে পারেন। আমি খেয়ে নেব।”
শুভ্রা মাথা নাড়ে-“না থাক। আমি বসে থাকি। একা খেতে কষ্ট হবে আপনার।”
রণ আরেকবার হোঁটচ খায়। স্মিত মুখে ভাত মাখিয়ে মুখে তোলার আগে জানতে চাইলো-“আপনি খেয়েছেন?”
শুভ্রা মাথা নাড়ে-“খিদে ছিল না তাই খাইনি।”
রণ হুট করে প্রথম লোকমাটা শুভ্রার মুখের সামনে ধরে-“খিদে ছিল না তারমানে এখন আছে। নিন হা করুন।”
শুভ্র চমকিত-“আরে না না আপনি খান। সামান্য ভাত আমি খেলে আপনি কি খাবেন?”
রণ হাসলো-“যদি হয় সুজন তেতুল পাতায় দুজন। কথা না বাড়িয়ে হা করুন।”
বাধ্য হয়ে হা করে শুভ্রা। রণ ভাতের লোকমা শুভ্রার মুখে দিয়ে নিজেও খেলো এক লোকমা। আবার শুভ্রাকে দেয় নিজে খায়। তিনবার এমন হওয়ার পর শুভ্রা ফট করে উঠে দাঁড়ায়-“আর খাবো না। পেট ভরে গেছে আমার। আপনি খাওয়া শেষ করুন আমি আপনার জন্য এককাপ চা বানিয়ে আনছি।”
বলেই ছুটে বেরিয়ে গেলো মেয়েটা। রণর মনে হলো শুভ্রার চোখের কোলে জল ছিলো। নিজেকে দূর্বল দেখাবে না বলে ওর সামনে থেকে পালিয়ে গেলো। সত্যি কি তাই? রণ বেশি ভালো না। কাঁধ ঝাঁকিয়ে পুনরায় খাওয়ায় মন দিলো সে।
চলবে—
©Farhana_Yesmin
#দর্পহরন
#পর্ব-৩২
রাতে মাতাল হয়ে বাসায় ফিরলো সোহেল। রুমে ঢুকে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে তুলতুলকে নরম কন্ঠে কাছে ডেকেছে-“ও তুলতুলি, কাছে আসো।”
মদের গন্ধে তুলতুলের গা গুলায়। কিন্তু টকটকে লাল চোখের সোহেলের ডাক অগ্রাহ্য করতে পারে না। এগিয়ে যেতেই সোহেল তাকে হাত ধরে টেনে কাছে বসায়-“তুমি কি আমাকে ঘেন্না করো? এমন দূরে দূরে থাকো কেন সবসময়?”
তুলতুল কিছু বললো না। মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। সোহেল তুলতুলের মুখ ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়-“রাগ হইছো আমার উপর? আমি খুব খারাপ মানুষ তাই না? তোমাকে অত্যাচার করি, আটকাইয়া রাখছি কোথাও যাইতে দেই না। বুঝি সবই। আচ্ছা, তুমি কি চাও আমার কাছে? একটা ইচ্ছার কথা বলো পূরণ করুম।”
তুলতুল এবার মুখ ফুটে বলে-“চাইলেই বুঝি দিবেন? বলে লাভ কি?”
সোহেল ক্ষন কাল চুপ করে থাকলো। তারপর তুলতুলকে টেনে শুইয়ে দিলো বালিশে। ঝুঁকে এলো তুলতুলের মুখের উপর। গালে হাত দিয়ে আরও মোলায়েম কন্ঠে বললো-“কইলাম তো পূরণ করুম কইয়া ফালাও।”
তুলতুলের কি মনে হলো বলে ফেললো মুখ ফুটে-“আমাকে একবার মায়ের কাছে যাইতে দেন। খুব ইচ্ছা করে মাকে দেখতে। তার শরীর ভালো না তাই একটা বার দেখতাম।”
সোহেল অাদুরে দৃষ্টি নিয়ে তুলতুলের অসহায় মুখ দেখলো। গালে চুমো দিলো, নাক নাক ঘষে বললো-“আচ্ছা, দিব যাইতে। এইবার তুমি নিজের ইচ্ছায় আমাকে একটু আদর দাও তাইলে। প্রতিদিন জোর করতে ভালো লাগে না।”
তুলতুল সিঁটিয়ে গেলো নিজের মধ্যে। যাকে ঘেন্না করে তাকে নিজ থেকে আদর দেওয়া যায় না এই কথা মোটা মাথার সোহেলকে বলা বৃথা। ওর মধ্যে একটা পশু ওত পেতে থাকে। সুযোগ পেলেই যে থাবা বসায়। সোহেল অনুনয় করে-“আরেহ কইলাম তো যাইতে দিমু। এইবার একটু আদর করো না।”
সোহেল মুখ এগিয়ে দিলো। উৎকট গন্ধে পেটের নাড়িভুড়ি উল্টে আসে তুকতুলের। জড়ভরত হয়ে শুয়ে রইলো সে। মনটা হাসফাস করে ওঠে তার। আর কতদিন এই অত্যাচার সইতে হবে সে জানে না। খুব খারাপ লাগে তার। এই বন্দী জীবন আর মেনে নিতে পারছে না। এবারও তুলতুলের কাছ থেকে সারা না পেরে রেগে গেলো সোহেল। তুলতুলের দু’হাত বিছানায় আঁটকে তুলতুলের উপর চরে বসলো সে-“কি হইলো। কথা কানে যায় না? কতবার কইরা কইলাম তবুও পাষানীর মন গলে না। তুই শোধরাবি না। ভালো ব্যবহার করলেই কি না করলেই কি। তোরে খালি ভোগ করাই ঠিক আছে।”
তুলতুল বাঁধা দেয় না। বাঁধা দিয়ে লাভটাই বা কি? শুধু শুধু নিজের শরীরকে কষ্ট দেওয়া ছাড়া। তবে একদিন সে অবশ্যই বাঁধা দেবে। সেইদিন হয়তো এই পৃথিবীতে সোহেলের শেষ দিন হবে। ততদিন পর্যন্ত তুলতুল সহ্য করবে নিজের মা আর ভাইয়ের জন্য।
*****
সালিম সাহেব আজ গোপনে নিজের অফিসে কয়েকজন ব্যবসায়ীকে ডেকেছে। উদ্দেশ্য আসন্ন নির্বাচনে এলাকায় তার সমর্থন পাকাপোক্ত করা। ব্যবসায়ীরা প্রতিমাসে নিয়মিত হারে চাঁদা দেয় দলের প্রয়োজনে। তবে রাজনীতিতে সরাসরি ইনভলভ হয় না। সালিম সাহেবের বিশ্বাস এনারা সকলে ওনাকে সমর্থন দেবে যেহেতু তিনি সবসময় এনাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেছেন। ওনাদের কাজে নিজ থেকে যতটা সম্ভব সাহায্য করেছেন। কিন্তু মিটিং শুরু হতে হতে তার মেজাজ খারাপ হতে শুরু করলো।
“ভাই, সামনে নেত্রী আসবে এলাকায়। শো ডাউন করতে হবে। এলাকায় দলীয় প্রধান নির্বাচন হবে এটা তো জানেন। আপনারা আমাকে সাপোর্ট দিবেন তো?”
মিল্টন নিট ওয়ারের মালিক মিল্টন খন্দকার বাকীদের দিকে তাকিয়ে হাসলো। সালিম সাহেব বললো-“কি মিল্টন ভাই, আপনারা আমাকেই চান তো দলীয় প্রধান হিসেবে। সামনে মেয়র নির্বাচনে প্রাথী হতে চাই ভাই। আপনারা যদি সাপোর্ট না দেন তাহলে বিপদে পড়বো।”
“ভাই, সবই ঠিক আছে। তবে কে এলাকায় রাজত্ব করবে তা কি আমরা ঠিক করি কখনো? যে আমাদের সু্যোগ সুবিধা দেবে, আমরা তাকেই চাইবো। তারপরও কথা থাকে কিন্তু। নেত্রী কাকে চান এটাও একটা বড় ব্যাপার। যতটুকু দেখলাম নতুন মন্ত্রী সাহেব কমবয়সী হলেও গত তিনমাসে ভালো কাজ দেখাইছে। সে আপনারই মেয়ের জামাই। যদি সেও দলীয় প্রধান হয় তাতেও আপনার কোন সমস্যা থাকার কথা না। আফটারঅল আপনারই মেয়ের জামাই। আপনার তো লাভলস নাই এখানে। সবদিক দিয়ে আপনিই জিতছেন।”
সালিম সাহেবের মুখ বন্ধ। দাঁতে দাঁত চেপে রণর প্রশংসা বাক্য গেলা ছাড়া তার করনীয় নেই কিছু। তবুও বয়সের অভিজ্ঞতার বলে বুঝলেন এখন কোনমতেই মেজাজ গরম করা যাবে না। তিনি স্মিত কন্ঠে বললো-“সবই ঠিক আছে ভাই। কিন্তু কোন পজিশনে না থাকাটাই বা কেমন দেখায়৷ রণর জন্য সেচ্ছায় সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে দিছি। এখন মেয়র তো হতে হবে। তাছাড়া এলাকায় দলীয় রাজনীতিতে আমিই সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ। দল করাটা আমার ধ্যান জ্ঞান। বাবার কাছ থেকে এটাই মন দিয়ে শিখেছি। এখন যদি রাজনীতি না করতে পারি তাহলে বেঁচে থাকা বৃথা মনে হবে আমার। আপনাদের জন্য সবসময় যথাসাধ্য করে গেছি। এখন আমার বিপদে কি আপনাদের পাশে পাবো না? আমাকে ম*রে যেতে বলছেন?”
আবেগী কথায় কাজ হলো মনেহয়। তৎখনাত তরফদার শিপিং এর মালিক বললো-“কেন পাবেন না ভাই? অবশ্যই আমরা আপনার পাশে আছি। আমাদের কি করতে হবে বলেন। সাধ্যমতো সাহায্য করবো আপনাকে।”
সালিম সাহেবের চেহারা উজ্জ্বল হলো-“তাহলে ভাই, দলের প্রধান হিসেবে আপনারা আমার নাম রেকমেন্ড কইরেন। আপা নিশ্চয়ই কাল আপনাদের সাথে মিটিং করবে তখন আপনারা আমার জন্য তদবির করবেন। বাকী ভবিষ্যতে আপনাদের প্রয়োজন আমি দেখবো। মিল্টন ভাই, আপনার কোম্পানির ব্যাংক লোনটা মওকুফ করে দিলে চলবে? জোবেদ ভাই, থানার পাশের জমি দরকার আপনার? ম্যানেজ করে দিবনে।”
হুট করে এমন একটা প্রস্তাব পেয়ে মিল্টন হচকে গেলো। সালিম সাহেব হাসলো-“আমি জানি আপনার কোম্পানি এখন কাজ কম পাচ্ছে। আপনি নতুন প্রতিষ্ঠান দিতে যাচ্ছেন। টাকার সমস্যা থাকলে আমাকে বলবেন না। এমনে পর বানায়া দিছেন আমাকে?”
শেষ পর্যন্ত পজেটিভ ইঙ্গিত দিয়ে সকলে বিদায় নিলো। সালিম সাহেবকে সন্তুষ্ট দেখালো। যে টোপ দিয়েছে তাতে মনেহয় না চিন্তার কোন কারণ আছে। পাঁচজনের মধ্যে তিনজন অন্তত তার হয়ে কথা বলবে। যেহেতু এনারা সবাই নিউট্রাল মতামত দেয়। এনাদের কাউকে সাপোর্ট দেওয়া মানে অনেকগুলো মানুষকে উৎসাহিত করা। আশাকরা যায় নেত্রী আসার পর ভালো কিছু হবে। নেত্রী আবার তার উপর ভরসা করবে। এখন শুধু একটু বুঝেশুঝে কাজ করতে হবে।
*****
আজকেও দরজা খুললো শুভ্রা। যথারীতি তার পরনে একটা হালকা বেগুনি রঙের শাড়ী লম্বা চুলগুলো মাথার পেছনে পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আঁটকানে। সাদা ব্লাউজে সুন্দর মানিয়ে গেছে মেয়েটাকে। রণ মৃদু হেসে ঘরে ঢুকে গেলো। শুভ্রার কিছুটা মন খারাপ হলো আজ। পরপর তিনদিন শাড়ী পড়লো একটা দিনও রণ ওকে কোন কমপ্লিমেন্ট দেয়নি৷ তাকে কি দেখতে ভালো দেখায় না? রান্নাঘরে খাবার গরম করে নিয়ে প্লেটে বেড়ে নিজেকে আরেকপ্রস্ত দেখে নিলো। শাড়ী টেনে ঠিক করলো, চুলগুলো খুলে পিঠময় ছড়িয়ে দিলো। হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে আঁচল টেনে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। রণ মাত্রই শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে কাপড় পরেছে। তার গা দিয়ে সুগন্ধ ভেসে আসছে। শুভ্রার খানিকটা মাতাল মাতাল লাগে রণকে দেখে। মানুষটা আসলেও খুব হ্যান্ডসাম। একহারা শরীরের কোথাও বাড়তি মেদের চিন্হ নেই। ফর্সা চেহারায় কাঠিন্যতা আর সরলতার মিশেল। গম্ভীর মুখটা দেখে ভয় লাগে আবার হাসলে সরলতার প্রতীক মনেহয়। রণ মনোযোগ দিয়ে মোবাইলে কিছু করছে। শুভ্রা তার দিকে চেয়ে থেকে ঢোক গিললো বারকয়েক। হঠাৎ রণর নজর পড়লো তার দিকে-“আরে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? খেতে দেবেন না আজ?”
“হ্যহহ, এই তো দিচ্ছি।”
শুভ্রা অতি দ্রুত খাবারটা দিতে যেয়ে প্লেট হাত থেকে নড়বড়িয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে রণ ধরে ফেলে প্লেটটা। উদ্বিগ্ন হয়ে শুভ্রার দিকে তাকালো-“আপনার শরীর খারাপ নাকি? এরকম করছেন কেন?”
শুভ্রা পাশের সোফায় বসলো-“না সেরকম কিছু না। আমি ঠিক আছি।”
রণ মোলায়েম কন্ঠে বললো-“রাত জাগছেন কেন? ঘুমিয়ে পড়লেই পারেন।”
বলতে বলতে ভাত মাখিয়ে শুভ্রার সামনে ধরে-“নিন হা করুন।”
শুভ্রা লাজুক হেসে মাথা নাড়ে-“আরে আমি খেয়েছি তো। আপনি খান। সারাদিন পর খেতে বসেন তাতেও আমি ভাগ বসালে হবে?”
রণ তবুও লোকমাটা মুখের সামনে ধরে থাকলো-“প্লেটে যত কম খাবারই থাক না কেন বউয়ের জন্য কখনো কম পড়বে না। আমি জানি আপনি কিছু খাননি রাতে। নিন তাড়াতাড়ি হা করুন। আমাকে কষ্ট দেবেন না আর। লোকমা ধরে রাখতে রাখতে হাত ব্যাথা হয়ে গেলো।”
শুভ্রা বাধ্য হয়ে হা করে। ওকে একবার দেয় নিজে একবার খায়। এটা যেন রণর জন্য নিয়ম হয়ে গেছে। শুভ্রা মুগ্ধ হয়ে দেখছে সামনের মানুষটাকে।
শুভ্রাকে লক্ষ করে রণ মুচকি হাসলো-“আমার হাত থেকে খাওয়াটা নেশা হয়ে যাচ্ছে নাকি আপনার?”
“হুমম। খুব ভালো লাগছে।” রণকে দেখতে দেখতে শুভ্রা আনমনা হয়ে জবাব দিলো। পরক্ষনেই হুশ ফিরে পেয়ে ভীষণ লজ্জা পেলো-“আমি আপনার চা নিয়ে আসছি।”
বলেই উঠে ছুটে পালালো। কিছুক্ষণ পর যখন দুইকাপ চা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো তখন রণর খাওয়া শেষ। সে আবারও মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে গেছে। শুভ্রা ডাকলো-“আপনার চা।”
“থ্যাংক ইউ। বসুন, একসাথে চা খাই।”
শুভ্রা মাথা দুলিয়ে রণর সামনে বসলো। রণ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শুভ্রার দিকে তাকালো। ওকে এই মুহূর্তে শান্ত দীঘির মতো লাগছে। টলটলে মুখ নিয়ে মাঝে মাঝে নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। রণ হুট করে শুভ্রার সামনে ঝুলে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে নরম গলায় বললো-“কাল আমি এলাকায় যাব। আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন আপনার বাবার বাসায়। যাবেন?”
রণর সামান্য স্পর্শ পেয়ে যেন মোমের মতো গলে গেলো শুভ্রা। ইচ্ছে হলে রণকে বলে আরও একবার অমন করতে। অনিচ্ছায় মাথা নাড়ে। কিন্তু পরক্ষণেই মনটা সচেতন হয়ে উঠলো-“কাল হঠাৎ যাচ্ছেন যে? বিশেষ কোন দরকার?”
রণ মাথা দুলায়-“হ্যা, ফুপু যাবে পরশু। দলের সম্মেলন হবে। আমি কাল যেয়ে সব গোছাব বলেই আজ ছুটির দিনেও অফিস করলাম।”
“হঠাৎ? কি এমন কাজ?”
রণ হাসলো-“হঠাৎ করে কিছু হয় নাকি? পরশু খুব বড় একটা প্রজেক্টের কাজের ঘোষণা দেবেন ফুপু। দলের কিছু জরুরি কাজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে।”
“কি সিদ্ধান্ত?”
শুভ্রা আলগোছে জানতে চাইলো। রণ কিছুক্ষণ চুপ থেকে শুভ্রাকে দেখলো-“সেসব আপনার না শুনলেও চলবে। যেটা শুনতে হবে সেটা বলি?”
শুভ্রা কৌতূহলে তাকায়-“কি?”
রণ মুচকি হেসে বললো-“আপনাকে সুন্দর লাগছে শুভ্রা।”
হুট করে শুভ্রার চারপাশটা রঙিন হয়ে গেলো। ওর বুকের মাঝে যেন কলকল করে ঝর্ণাধারা বয়ে যায়। এতটুকু কথায় মনটা স্নিগ্ধ কোমলতায় ভরে ওঠে। তারপরই অভিমানে মনটা কুটকুট করে-“তিনদিনে আজ প্রথম নজরে এলো?”
রণ মুচকি হাসলো-“নাহ, প্রতিদিন নজরে এসেছে। কিন্তু বললে তো আবার আপনার মাটিতে পা পড়বে না।”
শুভ্রা বড় বড় চোখে তাকায়-“তাই ভাবেন আপনি?”
রণ দুষ্ট হেসে মাথা দুলায়-“ভাবি তো। সুন্দরী মেয়েদের এমনিতেই অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। তাই তাদের প্রসংশা ভেবেচিন্তে করতে হয়।”
শুভ্রা হুট করে উঠে দাঁড়ায়-“আপনি খুব খারাপ মানুষ তো? প্রতিদিন আপনার জন্য সেজেগুজে বসে থাকছি আর আপনি কিনা আমাকে ইচ্ছে করে ইগনোর করছেন? কথা নেই আপনার সাথে।”
শুভ্রা ঘুরতেই রণ ওর হাত ধরে ফেলে। টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দেয়। হাতটা শক্ত করে মুঠোয় পুরে নিয়ে আচমকা ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে বললো-“আপনি অভিমান করতেও জানেন দেখছি?”
শুভ্রা লজ্জা পেয়ে গেলো। মানুষটা হুটহাট এমন সব কাজ করে যে লাজুক হওয়ারও সুযোগ দেয় না। শুভ্রা হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে রণ হাতটা আরও টেনে নিয়ে বুকের সাথে আঁটকে রেখে বললো-“এই বলছেন আমার জন্য সাজগোছ করেছেন আবার এপ্রিশিয়েট করলে রাগ করছেন। কি করি বলুন তো?”
রণর এমন কথায় শুভ্রা মাথা নিচু করে হাসলো। ওর ফর্সা গালে রক্ত জমেছে। তা দেখে রণ আরেকটু দুষ্টুমি করবে মনস্থির করলো। রণ শুভ্রার কানে ফিসফিস করলো-“একটা পঁচা কাজের ইচ্ছে জেগেছে মনে। করবো?”
শুভ্রা ভরকে গিয়ে রণর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে জানতে চাইলো-“কি পঁচা কাজ?”
রণ সুযোগ মতো শুভ্রার অধরে খুব আলতো করে অধর স্পর্শ করে বললো-“খুব ইচ্ছে করছিল মিষ্টি খেতে। খেয়ে নিলাম।”
শুভ্রা হতবিহ্বল। মনেহচ্ছে হুশ হারাবে যে কোন মুহূর্তে। নিজের অজান্তেই কি সে রণর খুব কাছে চলে যাচ্ছে দিনদিন? সে কি খুব ভুল কিছু করছে?
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#দর্পহরন
#পর্ব-৩৩
ঘুম থেকে উঠেই শুভ্রা বাবাকে ফোন দিলো। মেয়ের ফোন পেয়ে সালিম সাহেবের চেহারায় হাসির আভা ফুটে উঠলো। সে উৎফুল্ল কন্ঠে ফোন ধরলো-“আম্মা, কি খবর দিবেন?”
শুভ্রা বললো-“আপনার জামাই গেছে এলাকায়। কালকের জনসভার প্রস্তুতি নিতে।”
সালিম সাহেব গম্ভীর হলেন-“আর?”
“কালকে আপনার আপা কি একটা প্রজেক্টের ঘোষণা দেবে। আর দলের বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নেবে। উনি খুলে বলেননি কিছু।”
“আচ্ছা। আপনার শরীর ভালো আছে আম্মা?”
হুট করে প্রসঙ্গ পাল্টে যাওয়াতে শুভ্রা খানিকটা অবাক হলো-“ভালো আছি আব্বা।”
“আপনি আপনের আব্বাকে ভালোবাসেন তো?”
শুভ্রা হতবাক গলায় বললো-“এইটা কেমন কথা আব্বা? ভালো না বাসলে এইসব বলতাম আপনাকে?”
সালিম সাহেব হাসলো-“আচ্ছা আচ্ছা রাগ করেন কেন? এমনি জানতে চাইলাম।”
শুভ্রা ম্লান কন্ঠে বললো-“একটা কথা বলি আব্বা। তন্ময় ভাই আসছে তো অনেকদিন হইলো। চাচাকে বইলেন তাকে এইবার একটা বিয়ে করায় যেন?”
সালিম সাহেবের ভ্রু কুঁচকে গেলো। সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো-“কি হইছে আম্মা? তন্ময় কিছু করছে?”
বলবে কিনা দ্বিধায় পড়ে গেলো শুভ্রা। তার বাবা ব্যাপারটা কিভাবে নেবে সে জানে না। উল্টো রিয়্যাকশন হলে খুব বিপদে পড়ে যাবে সে। সালিন সাহেব উদ্বিগ্ন হয়ে আবারও প্রশ্ন করলো-“আম্মা, হইছেটা কি? কি করছে তন্ময়?”
“কিছু না আব্বা। বাদ দেন।” শুভ্রা ভীত কন্ঠে জবাব দিলো। সালিম সাহেব এবার জোর করলো-“আম্মা, কি হইছে তাড়াতাড়ি বলেন। নাইলে আমি এখনই তন্ময়কে ডেকে আনবো।”
শুভ্রা আঁতকে চেচিয়ে উঠলো-“না না আব্বা এমন কিছু কইরেন না। তন্ময় ভাই যেন কিছু না জানে আব্বা। সে আগে প্রায়ই আমার শশুরবাড়ি আসতো। আমার ননদকে নাকি পছন্দ। এইদিকে আপনের জামাই একদিন দেখে খুব রাগ হইছে। আব্বা তন্ময় ভাইকে আমি এখানে আসতে মানা করছি কিন্তু সে মানতেছে না।”
এবার সত্যি সত্যি সালিম সাহেবের কপালে ভাজ পড়লো। পরিস্থিতি এমনিতেই বিরুপ। সবদিক থেকে চাপে আছেন। এরমধ্যে যদি আবার তন্ময়ের কেস আসে তাহলে তো শেষ। কিছু একটা করতেই হবে। তন্ময়কে আঁটকাতে হবে কোনভাবে। মেয়েকে আশ্বাস দিলো-“ঠিক আছে আম্মা, আমি বিষয়টা দেখবো। আপনি চিন্তা কইরেন না।”
শুভ্রা হু বলে ফোন নামিয়ে রাখলো। বাবা আশ্বাস দিলেও শুভ্রা জানে তন্ময়কে ঠেকানো সহজ হবে না। সে আসলে চায় না ঘটনা রণর কান পর্যন্ত যাক। রণ জানলে খুব খারাপ হবে এতটুকু বোঝার জ্ঞান তার আছে। শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভাবলো, আর কিছু খারাপ না হোক। এতে খারাপ সহ্য হচ্ছে না।
*****
পুরো এলাকা জুড়ে সাজ সাজ রব। প্রধানমন্ত্রী আসবে বলে পুরো শহর সাজানো হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। রণ দফায় দফায় মিটিং করছে দলের লোকজনদের সাথে। কাল থেকে না ঘুমিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আপাতত তৈরি হওয়ার জন্য রুমে ফিরেছে। মিহির জানালো দিলশাদ এসেছে। জরুরি কথা বলবে। রণ মিহিরকে বললো দিলশাদকে ভেতরে নিয়ে আসতে।
“দিলশাদ, কি হয়েছে? হঠাৎ জরুরি ভাবে চলে এলি?”
“ভাই, সালিম সাহেব অনেক লিয়াজো করার চেষ্টা করতেছে। আমার আশঙ্কা আপনাকে খারাপ বানানোর জন্য সে হয়তো প্রধানমন্ত্রীর উপর হামলা চালানোর চেষ্টা করতে পারে।”
রণ প্রথমে অবাক হলো তারপর হেসে দিলো-“এতোটা নিচে নামবে না মনেহয়। আফটারঅল হাজার হলেও আমি তার মেয়ের জামাই।”
দিলশাদ মোটেও হাসলোনা-“ভাই, আমি সিরিয়াসলি বলতেছি। উনার প্রতিপক্ষ হিসেবে যেই থাক কাউকে গোনায় ধরে না সে। তাছাড়া সোহেলের চলনবলন খুব সন্দেহজনক। সে নিজের গ্যাং নিয়ে আপনার সমর্থক কয়েকজনকে হুমকি দিয়েছে অলরেডি।”
রণ একটু ভাবলো। চেহারায় কয়েকটা রেখা উঠে মিলিয়ে গেলো। মিহিরের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো-“খাদেমের বউ কই?”
“নিজের বাসায়। কেন ভাই?”
মিহির বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলে রণ বললো-“ওকে দূরে কোথাও সরায় নেওয়া যায় না? খাদেমের মামলাটা আবার ওপেন করতাম।”
দিলশাদ থামালো রণকে-“ভাই, একটা কথা বলি?”
রণ দিলশাদের দিকে তাকালো। দিলশাদ একবার মিহিরকে দেখে নিল-“খাদেমের বউকে দিয়ে হবে না। সত্যি বলতে কাউকে দিয়েই হবে না। ওরা কোন না কোনভাবে খুঁজে বের করে ফেলবে। তারপর মামলা ডিসমিস।”
রণ ভাবনায় ডুবে থেকে বললো-“তাহলে কি করবো বলে দে।”
দিলশাদ মাথা চুলকায়। যা মনে আছে তা বলে ফেলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলো। রণকে বললো-“ভাই, আজকের পর্ব শেষ হোক তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেন কি করবেন৷ দেখেন সালিম সাহেব আজকে কি করে। আর একটু চোখ কান খোলা রাইখেন ভাই। মিহির আর রাজীব যেন সবসময় আপনের সাথে থাকে।”
রণ মাথা দোলায়-“ঠিক আছে।”
ফোন বেজে উঠতেই রণ ছুট লাগালো। প্রধানমন্ত্রী কাছাকাছি এসে গেছে।
রণ পৌঁছে দেখলো সালিম সাহেব উপস্থিত তার দলবল নিয়ে। রণকে দেখে হাসলো-“তুমি আমাকে না বললেও আমি উপস্থিত আছি জামাই। আপার সাথে আমার সম্পর্কটা তোমার বয়সের চাইতেও অনেক বেশি পুরনো। এইজন্যই সব জায়গায় পাঙ্গা লাগা ঠিক না।”
রণ হাসলো-“কে বললো আমি পাঙ্গা লেগেছি? আপনি দলের পুরনো মানুষ। যে কোন জায়গায় আপনার অটো দাওয়াত ইস্যু হয়ে যায়। তো অনুষ্ঠান করে দাওয়াত দিতে হবে কেন? সব জায়গায় তো বিনা দাওয়াতে হাজির হয়ে যান।”
সোহেল তেড়ে এলো মারতে। সালিম সাহেব ঠেকালো-“তোর বোন জামাই হয়। খবরদার অসন্মান করবি না। আর আপার সামনে কোন কাহিনি না।”
সোহেল পিছু হটে গেলো। রণ কিছু বলার আগেই নেত্রী এসে নামলো।
*****
জলি নামাজে বসেছে। কাল রণর সাথে যেতে চাইলেও রণ তাকে সাথে নেয়নি। বউকে বলেছে সেও নাকি যাবে না। রণ একা একা এলাকায় গেলেই জলির বুক ধকধক করে। অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপে। শুভ্রাকে সে কথা বলা যায় না। তাই নামাজে বসে আছে কাল থেকে। জায়নামাজে বসে থেকেই কলিংবেলের আওয়াজ শুনলো সে।
বিকেলের দিকে হাসিখুশির সাথে বসে গল্প করছিল শুভ্রা। সেই সময় কলিংবেল বাজলো। হাসিখুশি প্রস্তাব করেছে লুডু খেলার। শুভ্রা কলিংবেল শুনে উঠে দাঁড়ায়-“তোমরা লুডু বের করো আমি দেখে আসছি কে এসেছে?”
“আচ্ছা ভাবি।”
হাসি ঘাড় হেলায়। শুভ্রা ছুটে এসে দরজা খুলতেই চমকে উঠলো। তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে মুখে হাসি নিয়ে। শুভ্রা ভয় পাওয়া গলায় বললো-“তুমি?”
“হ্যা আমি। আজ তো তোর বর নেই তাই এলাম।”
শুভ্রা মাথা নাড়ে-“তুমি চলে যাও ভাইয়া। প্লিজ চলে যাও। ও কোনভাবে জানলে খুব অশান্তি হবে।”
তন্ময় শুভ্রাকে ঠেলে ঘরের ভেতরে ঢুকলো-“কোনভাবেই জানবে না। তোর জামাই ভীষণ বিজি।”
এমন সময় খুশি উঁকি দিলো-“ভাবি, আসছো না কেন? লুডু সাজিয়েছি।”
তন্ময় চোখ নাচায়-“আরে বাহ! লুডু খেলা হবে নাকি? চল আমি খেলবো তোদের সাথে। টিম বানিয়ে খেলা যাবে।”
শুভ্রা খুশিকে ধমকে দিলো-“তুমি ভেতরে যাও খুশি আমি আসছি।”
খুশি ভয় পেয়ে ভেতর ঘরে দৌড়ে চলে গেলো। শুভ্রা তন্ময়কে দেখলো-“ভাইয়া প্লিজ। আমি কোন সিন করতে চাই না। তুমি চলে যাও প্লিজ। বারবার বলছি এখানে এসো না।”
তন্ময় কঠিন দৃষ্টিতে শুভ্রাকে দেখলো-“দেখ শুভ্রা, তোর চিন্তা দুলাভাইকে নিয়ে তো?”
শুভ্রা জবাব দিলো না। তন্ময় হাসলো-“এতো ভাবিস না শুভ্রা। আচ্ছা, ধর যদি তোর বর না থাকে, তাহলে?”
শুভ্রার ভ্রু কুঁচকে গেলো-“মানে? কি বলতে চাইছো?”
“তোর বর গেছে আমাদের এলাকায়। ও ছোট বাবার প্রতিপক্ষ। ছোট বাবা নিজের প্রতি পক্ষকে কোন ছাড় দেয় না এটা তুই ভালোমতোই জানিস। যদি তোর বর আজ বাসায় না ফেরে তাহলে কেমন হয়? কি করবি তুই?”
শুভ্রা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে তন্ময়ের দিকে-“তুমি কি বলতে চাইছো আমি বুঝতে পারছি না ভাইয়া।”
“ছোট বাবা খুব রেগে আছে তোর বরের উপর। বড় কিছু করে ফেলতে পারে তাকে।”
শুভ্রার মাথার উপর দিয়ে গেলো তন্ময়ের কথা। তার বাবা তার স্বামীকে কিছু করবে এমনটা সে কল্পনাও করে না। হাজার হোক মেয়ে জামাই সে। হঠাৎ পেছনে জলির কন্ঠ-“আমার রণর কি হইছে? ও বউ কি হইছে? তোমার ভাই কি বলে এইসব? আমার বাবুন। ওহহহ।”
বুক খামচে ধরে সেকেন্ডের মধ্যে জলি মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। শুভ্রা চেচিয়ে উঠে দৌড়ে এসে জলিকে ধরে-“মা!”
আমার নতুন বই অন্ধকারে জলের কোলাহল প্রি অর্ডার করেছেন তো?
চলবে—
©Farhana_Yesmin