#দর্পহরন
#পর্ব-১৯
শুভ্রার ঘুম ভেঙেছে এগারোটায়। ঘুমঘুম চোখে সে ঘড়ি দেখে ধরমরিয়ে উঠে বসলো। রিমা তাকে পইপই করে বলে দিয়েছে বিয়েটা যেভাবেই হোক সে যেন বউ হওয়ার দায়িত্ব পালন করে ষোলআনা। সকালে যেন ঘুম থেকে ওঠে। মায়ের বাড়ি ভেবে সারাদিন শুয়ে না থাকে যেন। শুভ্রা নিজের উপর বিরক্ত হলো ভীষণ। এতো বেলা অব্দি কি করে ঘুমালো সে? তাও আবার অপরিচিত জায়গায়? পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখলো। নাহ সে নেই। স্বস্তি হলো না অসস্তি বুঝলোনা শুভ্রা। সে লোকটাকে যতটা সহজে কাবু করতে পারবে ভেবেছে এখন দেখছে ততটা সহজ হবে না ব্যাপারটা। মুখে হাত দিয়ে হামি ঠেকালো সে৷ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। শুভ্রা অলসতা ঝেড়ে উঠে দরজা খুললো। হাসিখুশিকে দেখা গেলো। ওকে দেখেই দুইবোন হাসলো। দু’জনই একসাথে বলে উঠলো-“তোমার ঘুম ভেঙেছে ভাবি? বাসায় অনেক মেহমান এসেছে। মা বললো তোমাকে তৈরী করে নিয়ে নিচে নামতে।”
শুভ্রাও পাল্টা হাসলো-“ভেতরে এসো তোমরা। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসছি।”
দু’জনই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো। শুভ্রা বাথরুম থেকে বেড়িয়ে দেখলো ঘর পরিপাটি হয়ে গেছে। বিছানার চাদর টানটান। এলোমেলো কাপড় সম্ভবত রণর সেগুলো ধোঁয়ার জন্য ঝুরিতে দিয়ে দিয়েছে। ওকে দেখে দুই বোন হাসলো-“নানু এসেছে তো। যদি তোমার ঘরে এসে যায় তাই গুছিয়ে দিলাম তাড়াতাড়ি। নানুর আবার ওসিডি আছে। এলোমেলো আর নোংরা দেখলে তার মেজাজ খারাপ হয়। বকাঝকা করে। মানুষ আর পরিস্থিতি বোঝে না।”
শুভ্রা জবাব না দিয়ে লাগেজ খুললো। কি পরবে ভাবছে। খুশি এগিয়ে এসে বললো-“ভাবি, দেখ শাড়ি আছে তোমার লাগেজে। লাল রঙের শাড়ী ওটা পরো। তুমি নতুন বউ না শাড়ীতে ভালো লাগবে।”
শুভ্র সালোয়ার স্যুট তুলে নিলেও হাসি এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে-“প্লিজ ভাবি, খুশি যা বললো সেটাই করো। মা বলেছে শাড়ী পরতে। আমার মামীরা এসেছে। তোমার উল্টো পাল্টা দেখলে ওনারা আবার মাকে কথা শোনানোর সুযোগ খুঁজবে। প্লিজ একটু কষ্ট হলেও এডজাস্ট করে নাও।”
“কিন্তু আমি শাড়ী তো পরতে পারি না।” শুভ্রার চেহারা অসহায় দেখায়।
“আরে তাতে কি? আমরা আছি না? আমরা পরিয়ে দেব।”
শুভ্রা শাড়ী বের করে রাখলো-‘তোমাদের এতো আত্মীয় তো কাল কেউ যায়নি কেন?”
খুশি হাসলো-“সে তো ভাইয়া কাউকে নেয়নি তাই। সকলেই চটে আছে ভাইয়ার উপর। ভাইয়া অবশ্য বলেছে রিসিপশন করে পুষিয়ে দেবে সব রাগ।”
শুভ্রা জবাব দিলো না। দুই বোন গল্প করতে করতে শুভ্রাকে তৈরি করে দিলো। গলায় কানে হালকা গহনা হাতে সোনার চুড় পরিয়ে দিয়ে হাসি শুভ্রাকে বললো-“ভাবি, নানু একটু উল্টো পাল্টা বকে। তুমি প্লিজ চুপচাপ থেকো। জবাব দিলে মা কষ্ট পাবে।”
শুভ্রা মাথা দুলায়। মনে মনে ভাবছে কত প্যাচরে বাবা। কোথায় ভেবেছিল লোকটাকে সারাক্ষণ কোন না কোন প্যাচে ফেলে অশান্তি দেবে এখন দেখা যাচ্ছে তার দেখা পাওয়াই দুস্কর।
“বউ তো সুন্দর কিন্তু আমার নাতি কই জলি? বিয়া করতে না করতে অফিস কিসের?”
“মা, ওর জরুরি ফোন আসছিল। ভোরে বের হইছে।”
জলি মোলায়েম কন্ঠে জবাব দিলো। সেলিনা কাটকাট কন্ঠে সুর তুললো-“তুই আজীবনের জেদি জলি। পোলা বড় হইছে তাও তার সব ব্যাপারে তোর মাথা ঢুকাইতে হবে। বিয়া শাদীতে জোর চলে? এতো সুন্দরী মেয়ে তবুও তো পোলার মন নাই। বিয়ার ক্ষেত্রে সৌন্দর্য না মন দেখা লাগে জলি।”
“আম্মা থামেন। নতুন বউয়ের সামনে কি বলেন এইসব? ওরে দোয়া করে দেন।”
সেলিনা মনোক্ষুণ্ণ হয়ে তার বড় বউমা রোকেয়াকে ডাকলো-“ও বড় বউ, গহনার বক্সটা দাও দেখি।”
পাশ থেকে ছোট বউ মোহনা টিপ্পনী কাটে-“আম্মা, সব রণর বউকে দিয়ে দিয়েন না। আপনার ছেলের ছেলেদের জন্যও কিন্তু রাইখেন।”
“কেন? তোমাদের কি কম আছে? তাছাড়া আমার রণ তো একশোর মধ্যে একজন। তার মতো যোগ্য কে আছে।”
শুভ্রার বিরক্ত লাগছে রণর প্রশংসা শুনতে। একবার শাশুড়ী মায়ের দিকে তাকালো। তার চেহারা ভাবলেশহীন। সেলিনা নাতবউের গলায় জড়োয়া হারটা পরিয়ে দিলো। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো-“মাশাল্লাহ, সুন্দর লাগতেছে। শোন মেয়ে, এইসব গহনা যত দামীই হোক বিয়ের পর স্বামীই মেয়েদের আসল গয়না। এইটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবা ততই মঙ্গল হবে। বুঝলা?”
শুভ্রা মাথা দুলায় আর মনে মনে মুখ ভেংচি কাটে, আমার বয়েই গেছে স্বামীকে গয়না বানাতে।
★★★
রণ বেরিয়ে পড়েছে ভোর সকালে ইমার্জেন্সি ফোন পেয়ে। কাল রাতে মায়ানমার সীমান্তে প্রচুর গোলাগুলি হয়ে দু’জন সেনা মারা গেছে এবং প্রচুর বহিরাগত অনুপ্রবেশ করেছে। খবরটা শোনামাত্রই অফিসে ছুটেছে রণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান ও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান আগেই তার অপেক্ষায় ছিল। নিজের কর্মক্ষেত্রে এসেই তাদের সাথে মিটিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দফায় দফায় মিটিং আলোচনা পর্যালেচনা শেষে করনীয় কাজ সম্পর্কে ব্রিফিং দিয়ে রণ অফিস থেকে বের হলো। এরইমধ্যে মিটিং এর ফাঁকে ফাঁকে সকলের শুভকামনা শুনতে শুনতে রণর প্রান ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়। সন্ধ্যায় ছুটলো প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের কর্যালয়ের দিকে। সেখানে দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে মিটিংএ গিয়ে সবার মিশ্র প্রতিক্রিয়া রণর কানে এসেছে। স্বয়ং সালিম সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। অনেককে আড়ালে বলতে শুনেছে, ‘মেয়ের সাথে বিয়ে দেবে বলেই রণর জন্য নিজের দীর্ঘদিনের নির্বাচনি সিট ছেড়ে দিয়েছে সালিম। সালিম বুদ্ধিমান, বুঝেছে ওর দূর্নাম অনেক বেড়েছে তাই সময় থাকতে সরে দাঁড়িয়েছে। এখন জামাইয়ের কাঁধে বন্দুক রেখে সব কাজ করবে। দূর্নাম হলে মেয়ে জামাইয়ের আর কাজ হবে সালিমের। একেই বলে অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি চালানো।’ সালিম সাহেবকে তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসতে দেখেছে রণ। সব শুনে বুঝে রাগে গা কাঁপে রণর। হাতের মুঠো মুষ্টিবদ্ধ হয়। হেরে যাচ্ছে সে হেরে যাচ্ছে। নিজের সব পরিশ্রমের ফল আরেকজন নিয়ে যাচ্ছে বিনা শ্রমে। এটা কিভাবে হতে দেবে? কিভাবে?
বাড়ি ফিরতে ফিরতে গাড়িতে গুম হয়ে বসে থাকে সে। ক্লান্ত লাগছে আজ। কাল আবার সারাদিন ব্যস্ত থাকবে। যেতে হবে খুলনা, মংলা বন্দরে নতুন জেটির উদ্বোধন করতে। এদিকে বিয়ে পরবর্তী একটা অনুষ্ঠান করাও জরুরি। যেহেতু বিয়ের ব্যাপার সবাই জেনে গেছে অনুষ্ঠান সেরে ফেলাই ভালো। অবশ্য অনুষ্ঠান একটা না দু’টো করতে হবে। একটা ঢাকায় আরেকটা নিজের এলাকায়। মায়ের সাথে আলোচনা করে ডেট ফাইনাল করতে হবে। এলোমেলো ভাবনায় রণর মনটা আছন্ন হয়ে রইলো।
রাজিব চুপচাপ দেখছে রণকে। অনেক কথা তার কানেও এসেছে। সে বুঝতে পারছে রণ কেন গুম হয়ে আছে। তাই আরেকটা খারাপ খবর দিয়ে তার মন খারাপ করতে চাইলো না। বাসার নিচে এসে নরম কন্ঠে ডাকলো রণকে-“ভাই, বাসায় আসছি।”
রণ চোখ বুঁজে ছিলো। রাজিবের ডাকে চোখ মেলে তাকিয়ে একবার দেখলো তারপর চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে গেলো।
জলি বসেছিল ছেলের অপেক্ষায়। রণ মাকে দেখে হাসলো-“এতো রাত অব্দি বসে আছো কেন?”
জলি হাসলো-“সকালে তাড়াহুড়ায় বেরিয়ে গেলি। সারাদিন কি খেয়েছিস তাতো জানি না। এখন হাতমুখ ধুয়ে আয় আমার সাথে বোস। তোর পছন্দের চিংড়ি মালাইকারি করেছি।”
রণ তখনই হাত ধুয়ে বসে গেলো-“তাহলে দাও খেয়ে নেই। খিদে পেয়েছে ভীষণ।”
জলি মানা করলোনা। প্লেটে ভাত আর চিংড়ি বেড়ে এগিয়ে দিলো। রণ গোগ্রাসে খেলো কয়েক লোকমা। মায়ের দিকে তাকালো-“তুমি খেয়েছ?”
“হুম। তোর নানি এসেছিল আজ। সারাদিন ছিলো এই কিছুক্ষণ আগেই গেলো। তোর সাথে দেখা করতে চাইছিল।”
“ওহহহ। আচ্ছা আমি সময় করে যাব একসময় দেখা করে আসবো। মা, অনুষ্ঠান তো করতে হবে একটা। কবে করা যায় বলো তো?”
“তোর সুবিধামতো একটা দিন ঠিক কর। কবে কাজ কম তোর?”
রণ একটু ভেবে জবাব দিলো-“আগামী শুক্রবার একটা করি আর তারপরের দিন এলাকায় আরেকটা। ঠিক আছে?”
“পরপর দুইদিন কেন? মেয়েটার জন্য অনেক ঝক্কি হয়ে যাবে। একদিন গ্যাপ দিয়ে কর।”
রণ একটু থমকায়। মেয়েটা বলতে মা কাকে বোঝালো সেটা বুঝতে খানিকটা সময় নিলো তারপর মৃদুস্বরে বললো-“আচ্ছা, তাহলে শুক্রবার আর রবিবার করি।”
“ঠিক আছে। দেখিস তোর দাদুর বাড়ি কেউ যেন বাদ না পরে।”
জলির কথায় রণ অবাক হয়ে বললো-“হঠাৎ ওদের কথা কেন বললে মা?”
জলি নাক টানে-“তোর চাচা ফোন দিয়েছিল আজ।”
“কি বললো?”
“তোকে ওদের থেকে দূরে রেখে ভালো করছি না এটাই বললো। এতোকিছু হয়ে গেলো তাদের কেন জানাইনি?”
“আশ্চর্য! এতোদিন পরে হুট করে কি চাইছে ওরা? তাছাড়া নিজেরা আমাদেরকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে এখন নিশ্চয়ই তাদের দরকারে কাছে আসার চেষ্টা করছে?”
জলি মন খারাপ করে বললো-“কারণ যাইহোক ওদের বলিস। এতো বছর পরেও নিজেকে কাঠগড়ায় দেখতে ভালো লাগে না।”
রণ থমকে গেলো। মায়ের কষ্টটা কোথায় সেটা বুঝে কথা না বাড়িয়ে মাথা দুলিয়ে নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করলো।
★★★
“এতোক্ষণে বাড়ি ফেরার সময় হলো? নতুন বউয়ের কথা একবারও মনে হয়নি?”
রণ জানতো রুমে ঢুকে এরকম কিছু শুনবে তাই না শোনার ভান করে নিজের কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেলো। গোসল সেরে বেরিয়ে দেখলো শুভ্রা তখনও বসে আছে বিছানায়। রণর বিরক্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে না এই মেয়ের সাথে ঝগড়া করতে। সে ক্লান্ত গলায় বললো-“আমার সাথে ঝগড়া করার জন্য বসে আছেন? আপনার ধৈর্য্য আছে বটে।”
শুভ্রা হাসলো-“ঝগড়া করার জন্য বসে আছি এ কথা কে বললো? আমি আমার গিফট নেওয়ার জন্য বসে আছি।”
“গিফট! আচ্ছা ঠিক আছে। কি চাই আপনার?”
শুভ্রা হা করে তাকালো। ওর বিশ্বাস হচ্ছে না রণর কথা। লোকটা এতো সহজে মেনে নিলো?
“আরে তাড়াতাড়ি বলুন কি চাই?”
“ভাইয়ার মুক্তি।”
রণ শান্ত দীঘির জলের মতো গভীর দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো শুভ্রার দিকে-“এটা তো সম্ভব না। অন্য কিছু বলুন।”
“আপাতত এটাই আমার চাই।”
“সরি তাহলে আবার মত বদলে ফেলতে হচ্ছে। গিফট নেই আপনার কপালে।”
শুভ্রা দাঁতে দাঁত চেপে বললো-“বউ ছাড়া রিসিপশন করবেন?”
“মানে?”
শুভ্রা হাসলো-“মানে তো খুব সহজ। আমি চাই রিসিপশনের অনুষ্ঠানে আমার পুরো পরিবার উপস্থিত থাকুক। তো সেজন্য ভাইয়াকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করতে হবে তো। ভাইয়া ছাড়া পরিবার অসম্পূর্ণ না?”
রণ কিছু না বলে তাকিয়ে রইলো চুপচাপ। শুভ্রা পুনরায় মুখ খুললো-“যদি তা না হয় তাহলে কিন্তু বউ ছাড়া রিসিপশন করতে হবে। আমি কিছুতেই আপনার কোন অনুষ্ঠানে পার্টিসিপেট করবো না। আপনার বউ হওয়াটা যেমন আমার চয়েজ ছিলো তেমনি বাকী সবটা আমার চয়েজে হবে। তা না হলে সবাই জানবে, মন্ত্রী মশাই একজন নারী অপহরণকারী। তিনি একজন মন্ত্রী হয়েও নারীর প্রতি নুন্যতম সন্মান রাখে না মনে। জনগণ এসব জানলে নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে না?”
রণ হাসলো-“সত্যিই তাই করবেন বুঝি? এতে আপনার সন্মান বাড়বে?”
“আমার সন্মান তো যেদিন আপনি আমাকে তুলে নিয়েছেন সেদিনই কমে গেছে। কাজেই ওতে আর ভয় করি না।”
রণ দাঁতে দাঁত চেপে অপমান হজম করলো। সে চুপচাপ আলমারি থেকে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো গুছিয়ে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো। এই মেয়ের সাথে একইরুমে থাকার কোন মানেই হয় না। এই নামমাত্র বিয়ের জন্য নিজেকে কষ্ট দেওয়া কেন?
চলবে—
©Farhana_Yesmin
#দর্পহরন
#পর্ব-২০
সারাদিন ছোটাছুটির উপর আছে রণ। এরমধ্যেই মিহিরের ফোন-“ভাই, একটা খারাপ খবর আছে।”
রণ দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এই মেয়েটাকে বিয়ে করার পর থেকে সব খারাপ খবরই পাচ্ছে। সে ম্রিয়মান কন্ঠে বললো-“কি হয়েছে বল।”
“খাদেমের বউ আর বাচ্চাকে সালিম সাহেব খুঁজে পেয়ে নিজের ডোরায় তুলে নিছিলো। ওর বাচ্চাকে আঁটকায়া রাখছে। বউকে বলছে মামলা তুলে নিতে। তাইলে বাচ্চাকে দিবে।”
খবরটা শুনেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো তার। চেচিয়ে উঠে বললো-“ওদের কিভাবে খুঁজে পেলো মিহির? কোথায় রেখেছিলি ওদের?”
মিহির মিনমিন করলো-“ভাই, কিভাবে খুঁজে পেলো জানি না। আমি নিজেও আশ্চর্য হয়ে গেছি। কেউ হয়তো ফাঁস করছে নাহলে তো খোঁজ পাওয়ার কথা না। এইদিকে নান্টুকেও পাওয়া যাইতেছে না।”
রণ গর্জন করে উঠলো-“কেমন লোক দিয়ে কাজ করাচ্ছিস মিহির? কে এমন কাজ করেছে খুঁজে বের কর। বিশ্বাসঘাতককে চিনে রাখতে হবে।”
“আচ্ছা ভাই। আমি দেখতেছি।”
রণ বিরবির করলো-“ইব্রাহিম সালিম, এই লোক কোনদিন ভালো হবে না। আর আমি ঘরের মধ্যে এই লোকের ছাও পুষতেছি। আচ্ছা রাখলাম। ব্যস্ত আছি এখন পরে কথা বলবো।”
মিহির চুপ করে রইলো। নিজেকে অপরাধী লাগছে তার। রণ ভাই কত ভরসা করে কাজ করতে দিয়েছিল।
দিলশাদের মেজাজ চরম খারাপ হয়ে আছে। রিমান্ডের পাঁচদিন পেরিয়ে গেছে অথচ সোহেলের কাছ থেকে একটা কথা বের করা যায়নি। কথা আদায়ের নানারকম পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় কিন্তু দিলশাদ দ্বিধান্বিত। চাইলে সোহেলকে শেষ করে দিতে পারে অন্তত ওর মনেপ্রাণে এমনই ইচ্ছা কিন্তু এখনও সময় হয়নি। কেবলই এখানে এসেছে, একটু পাকাপোক্ত ভাবে বসতে হবে। জাল ফেলে সুতো ছাড়ার সময় এখন। বড় বড় মাছ জালে এলেই কেবল সুতো গোটানো শুরু করবে। এখন ধৈর্য্য ধরে থাকতে হবে, কোন উপায় নেই। ফোন বাজছে। দিলশাদ বিরক্ত হয়ে মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রাখে। রণর ফোন দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ায়-“ভাই, আপনি হঠাৎ?”
“দিলশাদ, একটা বিপদ হয়ে গেছে রে।”
“কি হয়েছে ভাই?”
“খাদেমের বউয়ের খবর পেয়ে গেছে সালিম সাহেব। বউটা হয়তো যে কোন সময় তোর কাছে যাবে মামলা তুলে নিতে। সোহেল নিশ্চয়ই কিছু বলেনি এখনো?”
দিলশাদ অবাক হলো না। সে জানতো এমন কিছুই হবে। স্বাভাবিক গলায় জানতে চাইলো-“কিছু বলেনি ভাই। কি করবো তাহলে?”
রণ হাসলো-“আমাকে বিশ্বাস করিস তো দিলশাদ?”
“একশোভাগ। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন ভাই?”
“এমনিতেই। শত্রুর সাথে আত্মীয়তা করেছি সবাই ভুল বুঝতে পারে সেজন্যই জানতে চাইছি। আচ্ছা শোন, আপাতত সোহেলকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।”
দিলশাদ হাসলো-“খাদেমের বউ চলে আসছে ভাই। মামলা ডিশমিশ হলে তো ছেড়ে দিতেই হবে। আপনি চিন্তা করবেন না।”
রণ গম্ভীর হলো-“আপাতত বলেছি দিলশাদ। আপাতত ও খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিক। পরে দেখবো কি করা যায় ওকে নিয়ে।”
“ঠিক আছে ভাই। দেখছি আমি।”
রণ ফোন নামিয়ে রেখে চেয়ারে হেলান দিলো। আরেকটা হারের মালা গলায় চড়লো। সামনের পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে বুঝতে পারছে। কিভাবে সব গোছাবে বুঝতে পারছে না। চোখ বুঁজে রকিং চেয়ারে দোল খেতে লাগলো চোখ বুঁজে।
★★★
“আব্বা! আইছোস তুই?”
সালিম সোহেলকে বুকে জড়িয়ে নিলো। সোহেল বাবার বুকে মাথা গুঁজে অভিমানী কন্ঠে বললো-“দশদিন আব্বা। দশদিন জেলে থাকা লাগলো। কত কষ্ট হইছে বুঝতে পারছেন?”
সালিম অতি কষ্টে নিজের আবেগ দমন করলো। ছেলের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো-“যে অবস্থা ছিলো আব্বা। আমি ভাবছি তোকে আর দেখতে পাবো না। আল্লাহর শোকর, আমার শুভ্রা এইবার আমার দায়িত্ব তার কাঁধে তুলে নিছে।”
সোহেল বাবার বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বিস্ময় নিয়ে বললো-“শুভ্রা! ও কেমনে কি করলো?”
সালিম গর্বিত হাসি দিলো-“দেখতে হইবো না কার মাইয়া? আমার মাইয়া আমার মতোই সাহসী। প্রতিমন্ত্রীরে তোর দুলাই বানাইছে। বুঝছোস কিছু?”
সোহেল হতবাক-“বিয়া হইছে শুভ্রার? আমারে ছাড়া?”
“তোর লাইগা আব্বা। শুভ্রা তোর লাইগা তোরে ছাড়া বিয়া করছে। তোরে মুক্ত করার লাইগা। পরশু দিন জামাইবাবা পার্টি রাখছে। শুভ্রা চাইছে আমরা পুরা পরিবার সেই পার্টিতে উপস্থিত থাকি। তাই তো তোরে মুক্ত করতে পারছি।”
“সত্যি আব্বা! আমার ছোট বোন এতো বড় হইলো কবে?”
সোহেল আপ্লুত হয়, কেঁদে দিলো আবেগে। রিমা নরম কন্ঠে ধমক দিলো-“কি শুরু করছেন আপনেরা বাপ পোলা? ওয় কত্তদিন পর আইছে ওরে গোসল করতে দেন, খাইতে দেন।”
সালিম চোখ মুছলেন-“হহহ আব্বা, তুই যা। গোসল কইরা আয় আমরা একলগে খামু।”
সোহেল মাথা নাড়ে। জেলের মধ্যে এইবার খাতিরদারি হয় নাই। খুব কষ্ট গেছে। সেসব মনে করে মনটা তেতো হলো। আনমনা হয়ে নিজের রুমে ঢুকতেই তুলতুলের উপর নজর গেলো। মেয়েটা হঠাৎ ওকে ঢুকতে দেখে ভীষণ চমকে গেছে। এরপর ওর চোখে দেখা গেলো ভয়। ভয়ে ভীত হয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে মেয়েটা। সোহেল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সোহেলের চেহারা থেকে বিরক্তি মিলিয়ে গেলো। ক্রুর একটা হাসি দিয়ে বললো-“আমাকে ছাড়া কয়দিন খুব ভালো আছিলা মনেহয়? চেহারা তো খুব খোলতাই হইছে দেখাযায়?”
তুলতুল ঢোক গিললো। আসলেই কয়দিন সে খুব আনন্দে ছিলো। একদম নিশ্চিত নির্ভাবনায়। হুট করে সোহেলকে দেখে মনে মনে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। সোহেলকে দেখে তুলতুলের গা গুলিয়ে বমি পেলো। ওর গা থেকে ভুরভুর করে গন্ধ আসছে। সোহেল ওর নিশ্চুপতা দেখে কয়েকপা এগিয়ে এলো। তুলতুল পিছিয়ে গেলো দেখে সোহেল হাসলো-“পালাইয়া যাইবা কই? বউ লাগো না তুমি আমার? ভাবছিলাম তোমারে আর ধরুম না। সোহেল একবার ফেলা জিনিস ধরে না। কিন্তু আজই মনে হইতেছে ভুল কইছিলাম।”
সোহেল ঠোঁট চাটলো। তুলতুলের বুক ধুকপুক করছে। পালাতে মন চাইছে। কিন্তু কিভাবে পালাবে? সোহেল কি ভেবে বললো-“দাঁড়াও গোসল দিয়া আসি। ঘুপচি জেলের মধ্যে থাইকা খুব খারাপ অবশ্য হইছে। গায়ে গন্ধ করে।”
নিজের গায়ের গন্ধ শুকে নাকমুখ কুঁচকে গেলো সোহেলের। সে বাথরুম ঢুকে যেতেই তুলতুল ছুটে রুম থেকে বেরুলো।
★★★
জলি প্রতিদিন রাতে ছেলের অপেক্ষায় বসে থাকে। রণ খেতে খেতে মায়ের সাথে সারাদিনের গল্প করে। তারপর মা ঘুমিয়ে গেলে নিচে নেমে আসে। আজও জলি অপেক্ষা করছিল। শুভ্রা পানি খেতে এসে জলিকে দেখে দাঁড়ালো-“আন্টি, আপনার না শরীর খারাপ ছিলো?”
“রণর সাথে একটু জরুরি কথা আছে তাই জেগে আছি।”
“আপনি চাইলে শুয়ে পড়তে পারেন। উনি এলে আমি ডেকে দেব আপনাকে।”
জলি অবাক হয়ে তাকিয়ে শুভ্রাকে দেখলো। মেয়েটাকে ছেলের বউ বানিয়ে এনেছেন ঠিকই কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। মেয়ের মুখের দিকে তাকালেই বিশ্রী অতীত চোখের সামনে চলে আসে। সহ্য না হলেও দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। শুভ্রাকে কোনক্রমেই বুঝতে দেয় না কিছু। তবে বিশেষ কথাও বলে না। ছেলের জন্য কষ্ট হয় তার।
তিনি বুঝতে পারেন রণ কতটা কষ্টে এই তেতো করলাকে সহ্য করছে। মনে মনে হয়তো মাকে বকাও দেয়। কিন্তু তিনি বড়ই অসহায় মা। সন্তানের জীবনের মায়া বড় মায়া একজন মায়ের কাছে। রণ যদি কখনো বোঝে তাহলে হয়তো তাকে মাফ করতে পারবে।
“তুমি সত্যিই জেগে থাকবে তো?”
শুভ্রা হাসলো-“আমি তো অনেক রাত অবধি জেগে থাকি। অভ্যাস আছে আমার।”
“কিন্তু কাল তো অনুষ্ঠান আজ এতো রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে কাল সমস্যা হবে তো। থাকগে, তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়ো।”
শুভ্রা খানিকটা জোর খাটালো-“কোন সমস্যা হবে না। আপনি যেয়ে শুয়ে পড়ুন প্লিজ।”
অগত্যা জলি উঠলো। নিজের কামরায় গিয়েও ফিরে এলো। শুভ্রা তাকালো তার দিকে-“কিছু বলবেন?”
জলিকে দ্বিধান্বিত দেখায়-“আমি জানি বিয়েটা তুমি জেদ করেই করেছ। ওকেও বাধ্য করেছ আমায় দিয়ে। তোমার দিক থেকে তুমি হয়তো ঠিক আছো। কিন্তু একটা কথা মনে রেখ, বিয়ে যেভাবেই হোক স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক। বাবার পরে মেয়েদের একমাত্র আশ্রয়, ভরসার জায়গা হচ্ছে স্বামী। তাই বলছি সম্পর্কটা ঠিক করার চেষ্টা করো।”
জলি দাঁড়ায় না। ধীর পায়ে ঘরে ফিরে গেলো। শুভ্রা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। জলি হুট করে তাকে এতো কথা বললো কেন? সে নিজেও তো খুব একটা পছন্দ করে না শুভ্রাকে। তবে?
রণ দোতলায় এসে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে তারপর খেতে আসে। তাও শুধুমাত্র মা খাবার নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে সেজন্য। ইদানীং ব্যস্ততা বেড়েছে তাছাড়া রাতে দোতলায় থাকছে বলে বোনদের সাথে দেখা হচ্ছে না। কাল শুক্রবার তার উপর আবার অনুষ্ঠান। সেজন্য দুইদিনের ছুটি নিয়েছে রণ। কাজ গুছিয়ে দিতে যেয়ে আজ তাই ফিরতে রাত হলো। খুব ধীরে ধীরে দরজায় আওয়াজ করলো। খোলা দরজার ওপাশে শুভ্রার মুখ দেখে চমকে উঠলো সে। সেদিনের পর থেকে শুভ্রার সাথে না দেখা হয়েছে না কথা। আজ হঠাৎ কি মনে করে এই মেয়ে তার সামনে এলো। নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর মুখে ডাইনিং এ বসলো-“মা, ওমা তুমি কোথায়?”
“আন্টির শরীর খারাপ ছিলো একটু তাই আমি শুয়ে পড়তে বলেছি।”
শুভ্রাকে মোলায়েম কন্ঠে কথা বলতে দেখে রণ অবাক হলো। প্লেট টেনে ভাত বেড়ে নিতে নিতে বললো-“তা আপনি জেগে আছেন কেন?”
শুভ্রা মুচকি হাসলো-“আপনাকে ধন্যবাদ দিতে। আমার মুখ দেখার গিফটটা দিয়েছেন সেজন্য ধন্যবাদ।”
রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো। কথার সারমর্ম বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো। জবাব না দিয়ে পাতে তরকারি নেওয়ায় মনোযোগ দিলো।
“কাল দয়া করে ভরা মজলিসে আমার বাবাকে অপমান করবেন না। তাকে শশুরের মর্যাদা দেবেন। আপনার তো বাবা নেই, আমার বাবাকে বাবা মনে করুন তাহলেই হবে।”
রণর খাওয়া বন্ধ হলো। রক্তচক্ষু নিয়ে শুভ্রার পানে চাইলো। তার তাকানোর ভঙ্গি শুভ্রাকে বিবশ করে দিলো। সত্যি বলতে এবারই প্রথম রণর এমন রুপ দেখলো শুভ্রা। সে ভয় পেয়ে আঁতকে উঠলো। রণ কিছু না বলে খাবার থেকে হাত ঝেড়ে উঠে গেলো। এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে দোতলায় নেমে গেলো। কিছুই না বুঝতে পেরে শুভ্রা বোকাবোকা মুখ করে বসে রইলো।
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#দর্পহরন
#পর্ব-২১
“আব্বা, আমি যাবো না আজকে। আপনারা যান।”
সোহেলের এমন কথায় সালিম সাহেব বিস্মিত-“যাবি না কেন খামাখা? শুভ্রা তো আমাগো সবাইরে একসাথে যাইতে কইছে। তুই না গেলে ওর মন খারাপ হইবো না।”
“হইবো না। কইবেন পরশুদিনের অনুষ্ঠানে আমি যামু। এখন ঢাকায় যাইতে মন চাইতেছে না। কালকেই আসলাম শরীর ক্লান্ত একটু বিশ্রাম নেই।”
সালিম সাহেব কি ভেবে রাজি হয়ে গেলেন-“আচ্ছা ঠিক আছে। তুই থাক তাইলে আমরা ঘুইরা আসি।”
“আচ্ছা আব্বা।”
সালিম সাহেবরা সকলে বেরিয়ে যেতেই সোহেল গুনগুন করতে করতে নিজের ঘরে ঢুকলো। তুলতুলকে না দেখে ওর ভ্রু কুঁচকে গেলো। মেয়েটা গেলো কই? কিছুক্ষণ আগেই তো ঘরে দেখে গেলো? বাথরুম, বারান্দা কোথাও না পেয়ে সত্যি সত্যি চিন্তায় পড়লো সোহেল। আজব তো! কই গেলো অল্প সময়ে? ছাঁদ, বাবা মায়ের ঘর কোনটাই বাদ দিলো না খোঁজ করতে। হঠাৎ মনে পড়লো ওখানে নেই তো? ভাবনা মাথায় আসতেই শুভ্রার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় সোহেল। ভেতর থেকে বন্ধ পেয়ে ঠোঁটের কোনে হাসিটা চওড়া হলো তার। তার ধারণা ঠিক, তার বোনের ঘরটাকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে লুকিয়ে আছে তুলতুল। সে আদুরে গলায় ডাকলো-“তুলতুলি, ও তুলতুলি, তুমি নিজের ঘর বাদ দিয়ে এই ঘরে আসছো কেন? তাড়াতাড়ি গেট খুলো। দেখো আব্বা আম্মা সবাই গেছে গা। একা একা ভালো লাগতেছে না আমার।”
কোন সারা পাওয়া গেলো না। ভেতরে তুলতুলি বসে আছে, ঠকঠক করে কাঁপছে তার শরীর। সোহেল আবারও মোলায়েম কন্ঠে ডাকলো-“তুলতুলি পাখি, কালকে থেকে পালাই বেড়াইতেছ তুমি। আর কতো? স্বামীকে কষ্ট দিতেছ তোমার কিন্তু পাপ হবে। দরজাটা খুলে সোনা।”
তুলতুল তবুও সারা দিলো না। সোহেলের মেজাজ খারাপ হচ্ছে তবুও সে মাথা ঠান্ডা রেখে আবারও ডাকলো-“বউ এইবার দরজা না খুললে কিন্তু দরজা ভাইঙা ফেলবো। তারপর কি করবো তা তুমি জানো। আমি মেজাজ খারাপ করতে চাইতেছি না। লক্ষী মেয়ের মতো দরজাটা খুলে দাও। সত্যি বলতেছি কিছু করবোনা।”
বলার মিনিট খানেকের মাথায় দরজা খুলে গেলো। সোহেল দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। তুলতুলি ভয়ে জড়সড় হয়ে বিছানার এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে। সোহেল ওর দিকে এগিয়ে যেতেই তুলতুল পেছালো। সোহেল ওর হাত ধরে কাছে টানলো-“আরে আরে, ভয় পাও কেন? আমি কি বাঘ? স্বামী হই তোমার। হক আছে তোমার উপর। এমন করলে কেমনে চলবে?”
তুলতুল ভয়ে চেচিয়ে উঠলো-“না না ধরবেন না আমাকে। প্লিজ।”
সোহেল উচ্চস্বরে হাসলো-“আরে, এ কি কথা? আমি তোমাকে ধরবো না তো কে ধরবে?”
“আপনি তো বলছেন একবার ছুঁয়ে ফেলা মেয়েকে আপনি বউ মানেন না। প্লিজ ছেড়ে দেন আমাকে। আপনি চাইলেই অনেক মেয়ে পাবেন তাদের কাছে যান। তবুও আমার কাছে আইসেন না।”
তুলতুল অনুনয় করলো। সোহেল মেজাজ চরছে ধীরে ধীরে। সে ঠান্ডা গলায় বললো-“এতো সুন্দরী বউ থাকতে অন্য মেয়ের কাছে যাবো কেন? আজকে আমার তোমাকে লাগবে বউ।”
বলেই তুলতুলকে কাছে টানলো। গালে গলায় চুমো দিতে শুরু করলো। তুলতুলের আর সহ্য হলো না। সোহেলকে ধাক্কা দিলো-“আমার সহ্য হয় না আপনাকে। মাফ করেন আমাকে প্লিজ দয়া করে মাফ দেন।”
সোহেল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুলতুল তাকে রিজেক্ট করেছে এটা বুঝতে পেরেই মেজাজের দফারফা হলো। তুলতুলের দিকে তাকিয়ে কর্কশ কন্ঠে বললো-“কি কইলি তুই?”
তুলতুল পালানোর পথ খুঁজছে। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। সোহেল লাল আঁখি নিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে-“আমারে ঘেন্না লাগে তোর? ফকিন্নি, একটু ভালোমতো কথা কইছি ভাবছোস আমারে নাচাবি? তুই ভুইলা গেছোস তুই কি? এতোকিছুর পরেও তোর তেজ কমে নাই? আইজ তোরে…”
তুলতুল দরজা দিয়ে বেরুতে যেতেই সোহেল ওর শাড়ীর আঁচল ধরলো খপ করে। একটানে শাড়ির অনেকটা খুলে নিতেই তুলতুল ঘুরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। সোহেল এগুতে এগুতে পুরো শাড়ী ওর হাতের মুঠোয় নিলো। তুলতুল দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে বুকের উপর রাখে। ফোপাঁতে শুরু করেছে সে। ওই অবস্থায় উঠে রুমের দরজার দিকে এগুলো। সোহেল ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে নিজের কামরার দিকে হাঁটতে শুরু করলো-“ভাবছিলাম জোর করুম না তোকে কিন্তু তুই বাধ্য করলি। এর শাস্তি তুই পাবি। এমন শাস্তি দিব যাতে তুই নিজে থিকা আমার কাছে আসবি।”
বলেই নিজ ঘরের বিছানায় আছড়ে ফেললো তুলতুলকে। দরজা আঁটকে গায়ের কাপড় খুলতে খুলতে তুলতুলের দিকে এগুলো-“আইজকাই শেষ দিন। এরপর তুই আসবি আমার কাছে। নিজের থিকা আদর দিবি আমাকে। না দিলে কি করুম তুই ভাবতেও পারবি না। এই সোহেলকে এখনও চিনোস নাই তুই।”
তুলতুলে ভয়ে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। কিছু বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। সোহেল ততক্ষণে ওর মুখ বন্ধ করেছে নিষ্ঠুর দানবের মতো।
★★★
শুভ্রার পরনে আজ মেরুন রঙের বেনারসি শাড়ি। আলাদা করে ওড়না না নিয়ে মাথায় শাড়ীর আঁচলই তুলে দিয়েছে। আজ গায়ে রণর মায়ের দেওয়া গয়না শোভা পাচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে শোভা। সত্যি বলতে একদম অন্যরকম লাগছে ওকে। গায়ের পোশাক গহনা সবই শাশুড়ীর পছন্দের হলেও আজ নিজের রুপ নিজের কাছেই অচেনা লাগে। বাঙালি বউ যেমন হয় ঠিক তেমন লাগছে তাকে। দরজায় আওয়াজ হলো-“আসবো?”
রণর গলা শুনে শুভ্রা অবাক হলো-“হ্যা আসুন।”
রণ ভেতরে ঢুকে বউ সাজে সজ্জিত শুভ্রাকে দেখলো একপলক। চোখ আঁটকে গেলো ওর। মেয়েটাকে বউয়ের সাজে মোহনীয় লাগছে। যদি এটা স্বাভাবিক বিয়ে হতো তাহলে এই দেখাটা নিশ্চয়ই অন্যরকম আনন্দদায়ক হতো? হয়তো মধুর কোন স্মৃতি রচিত হতো এই মুহূর্তে। শুভ্রারও কি নজর আঁটকেনি রণতে? ব্লু কালারের কোর্ট প্যান্টে রণকে ড্যাশিং হিরোর মতোই লাগছে আজ। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দু’জনার নজর আঁটকে রইলো দু’জনাতে। রণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নজর ফিরিয়ে সোফায় বসলো। শুভ্রাকে ইশারায় বসতে বললো-“বসুন প্লিজ। আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে।”
শুভ্রা কিছু না বলে বসলো। সে মনে মনে ভাবছে কি এতো জরুরি কথা বলবে বদ মন্ত্রী। রণ একটু ভেবে নিলো তারপর মুখ খুললো-“আজকের দিনেই কেন কথা বলতে এলাম? এমন প্রশ্ন আপনার মনে এলে তার উত্তরে বলি আজকের জন্য জরুরি বলেই কথা বলতে আশা। আজ অনেক গন্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবে। উপস্থিত থাকবে আপনার পরিবারও। আমার ওয়াইফ হিসেবে অনুষ্ঠানের মধ্যমনি থাকবেন আপনি। প্লিজ খেয়াল রাখবেন আমার পরিবারের কোন সদস্য যেন আপনার বা আপনার পরিবারের কারণে অপমান বা অপদস্ত না হয়। ইচ্ছে বা অনিচ্ছা যেটাই হোক না কেন আপনি এখন এ পরিবারের বউ। এই পরিবারের সন্মান রক্ষা করা আপনার দায়িত্ব। আমি আমার মা বোন আত্মীয়দের ব্যাপারে ভীষণ সেনসেটিভ। ওদের জন্য কারো সাথে আপোষ করতে পারি না। আশাকরি এটুকু মাথায় রেখে চলবেন। আর রইলো ও বাড়ি যাওয়ার কথা। আপনি চাইলে আজও যেতে পারবেন আবার আগামী পরশু এলাকায় আরেকটা অনুষ্ঠান হবে তারপরও আপনার বাড়িতে যেতে পারেন। এতে আমার বলার কিছু নেই।”
খানিকক্ষণ থেমে দম নিলো রণ। আবার বলতে শুরু করে-“এই বিয়েটা নিয়ে আপাতত কিছু ভাবছি না আমি। আমি জানি আপনিও কিছু ভাবছেন না। আপনার আমাকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য কি জানি না। বিয়ের ভবিষ্যত কি হবে সেটা হয়তো ভাগ্যই বলে দেবে। তাই আপনার জীবনের কোন ব্যাপার নিয়েই আমার কিছু বলার নেই৷ ইটস আপ টু ইউ। ঠিক তেমনি আমার কোন ব্যাপারে আপনিও অযাচিতভাবে কিছু বলবেন না। শুধু একটা বিষয়ের অনুরোধ এমন কিছু করবেন না যাতে আমার পরিবার আহত হয়। বাকী আমার তরফ থেকে আপনি স্বাধীন। কোন কিছুতে কোন বাঁধা নেই। আপনি আপনার মতো স্বাধীন ভাবে চলতে পারেন। আপনি আমার বাধ্য নন আমিও আপনার বাধ্য নই। বুঝতে পেরেছেন?”
শুভ্রা না বুঝেই মাথা নাড়ে। রণ এত এত কথা বললো কোনটা মনে রাখবে সে? রণ উঠে দাঁড়ায়-“গুড। আমি এখন ভেন্যুতে চলে যাব গেষ্ট এটেন্ড করতে। আপনি মা আর হাসিখুশিকে নিয়ে একসাথে আসবেন। ঠিক আছে?”
এবারও শুভ্রা কেবল মাথা দুলিয়ে সায় জানায়। শুভ্রাকে ভদ্র বাচ্চার মতো মাথা দুলাতে দেখে রণ প্রসন্নচিত্তে উঠে যেতেই শুভ্রা হাসলো, বিরবির করলো-“এতো সহজ মন্ত্রী মশাই? সব ভুলে যাব এতো সহজে? আমার দুইমাসের কষ্ট একটু একটু করে শোধ তুলবো। খাবার না খেতে দেওয়া, দিনের পর দিন অন্ধকারে রাখা। কি ভেবেছেন, ভুলে যাব সব? আপনি সুখ ভিক্ষা চাইবেন আমার কাছে। কাঁদবেন পায়ে পড়বেন তারপর মাফ করবো কিনা ভেবে দেখবো। এই শুভ্রা নিজের উপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবেই নেবে।
চলবে—
©Farhana_Yesmin