#দর্পহরন
#পর্ব-১০
“কেমন আছো সালিম?”
“ভালো আপা। আপনার শরীর কেমন?”
নেত্রী মৃদু হেসে মাঝের চেয়ারে বসলেন। ও পাশের চেয়ারে রণ বসে আছে মুখে স্মিথ হাসি নিয়ে।
“আমার ভালো থাকাটা সম্পূর্ণ তোমাদের উপর নির্ভর করে। বয়স হয়েছে, যে কয়দিন বেচে আছি দেশের মানুষের জন্য কিছু করে যেতে চাই। আর সবচেয়ে বড় যে ইচ্ছা তা হলো সন্মান নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে চাই।”
সালিম সাহেব চুপ করে গেলেন। এসব কথার বিপরীতে কথা চলে না আর। নেত্রী ডাকলেন-“সালিম রণর সাথে তোমার আলাপ হয়েছে তো? আজ তোমাদের দু’জনের সাথে খোলাখোলি আলাপ করবো বলেই ডেকেছি। তোমাদের দু’জনার যদি দু’জনার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকে তাও শুনবো।”
রণ কথা বলে উঠলো-“ফুফু, আমার কোন অভিযোগ নেই। চাচা যথেষ্ট হেল্পফুল।”
নেত্রী সালিম সাহেবকে দেখলেন-“তোমার কথা বলো সালিম। ওকে নিয়ে কোন সমস্যা আছে?”
সালিম সাহেব চুপ করে থাকলেন। নেত্রী কি বুঝে বলে উঠলেন-“সালিম, দেখো তুমি হয়তো ভাবতে পারো তোমার জায়গায় ওকে কেন নমিনেশন দিলাম। তুমি দলের অনেক পুরনো সদস্য সেই বাবার সময়কার। আর তোমাকে খুব বিশ্বাস করি। তুমি এই দলের জন্য অনেক করেছ। তোমার ত্যাগ অনস্বীকার্য তবে এটাও অস্বীকার করা যাবে না সালিম, তোমার খুব বদনাম হয়েছে। আর এই বদনামের দূর্গন্ধ আমাদের দলের মধ্যে চলে এসেছে। যা আমাদের জন্য ভাবনার বিষয়। তোমাকে ছাড়া চলার কথা আমি ভাবতেও পারি না কিন্তু তোমার বদনামও আমার সহ্য হচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে এই ব্যবস্থা আমাকে নিতে হয়েছে। রণ তোমার জায়গায় দাঁড়াবে আর তুমি কিছুদিন পরে হওয়া মেয়র নির্বাচনে। আমার মনেহয় এবার তোমার মেয়র পদে ইলেকশন করাটা ভালো হবে।”
সালিম সাহেব আকাশ থেকে মাটিতে পড়েন-“আপা আমি!”
নেত্রী হাসলেন-“দুইবছর পর মেয়র নির্বাচন হবে। ততদিনে রণ এলাকায় আমাদের দলের ভালো রেপুটেশন তৈরি করে ফেলবে। লোকে তোমার কাজ ভুলে যাবে। আশাকরি নির্বাচনে জিততে তোমার কোন সমস্যা হবে না। তুমি আর রণ মিলে একসাথে কাজ করলে আমিও চিন্তা মুক্ত থাকি। বুঝতে পারছো তো?”
সালিম কি বলবে ভেবে পেলো না। নেত্রী পুনরায় বললেন-“শোন সালিম, সামনে প্রচুর বিনিয়োগ আসবে তোমার এলাকায়। জাপানিজরা ওখানে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে চায়। রাস্তাঘাটের নকশা পরিবর্তন হবে। ঢাকা থেকে সরাসরি যাওয়ার জন্য ফ্লাইওভার হবে। নদী বন্দরটা নতুন করে ব্যবহারের উপযোগী করা হবে। বুঝতে পারছো কত বড় ধরনের সুযোগ আসছে সামনে? আর এসব কাজের শর্ত হলো কোন ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকা চলবে না এলাকায়। শান্তি বজায় থাকতে হবে। আর শান্তি বজার রাখতে নিজেদের মধ্যে একতা থাকা খুব জরুরি। ক্ষমতায় টিকে থাকা জরুরি। বুঝতে পেরেছ?”
সালিম মাথা দুলালেন। রণ অবশ্য কোন কথা বলছে না চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে।
“রণ আর তুমি মিলেমিশে কাজ করবে। ছেলেটা নতুন এসেছে অনেক কিছু বুঝবে না তুমি ওকে সব বুঝিয়ে দেবে। আর রণ, যে কোন বড় কাজে তুমি তোমার সালিম চাচার মতামত নেবে তাকে সন্মান করবে। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে ফুপু।”
“সালিম তোমার কিছু বলার আছে?”
“না আপা, আপনি যেমন বলবেন তেমনই হবে সব।”
নেত্রী সন্তুষ্ট চিত্তে জবাব দিলেন-“নির্বাচনের আগমুহূর্তে তোমাদের ডাকার কারন এটাই যে নির্বাচনের পর যেন কোন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে। আমি ওই এলাকাকে সবচেয়ে শান্তিপূর্ন এলাকা হিসেবে দেখতে চাই। তোমরা দু’জন বিবেচক তাই ভরসা করছি তোমাদের উপর। জানি আমার আশা পূরণ করবে তোমরা।”
রণ উঠে এসে মাথা নিচু করে সালাম করলো ফুপুকে-“দোয়া করবেন ফুপু আপনার ভরসার মান যেন রাখতে পারি।”
নেত্রী রণর মাথায় হাত রাখলেন। পুরো দৃশ্য সালিম সাহেবের হৃদয়ে জ্বালা ধরাল। উনি উসখুস করে উঠলেন। রণ দাঁড়িয়ে বললো-“আমি তাহলে যাই ফুপু। শেষ মুহূর্তের প্রচারনাটা শেষ করি।”
নেত্রী মাথা নাড়লেন। রণ দু’জনকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে যায়। ওর ঠোঁটের কোনের চোরা হাসি সালিম সাহেবের নজর এড়ায় না। নেত্রী আরও কিছুক্ষণ আলাপ করেছিলেন সালিম সাহেবের সাথে কিছু কোন কথাই মাথায় ঢুকছিল না তার। কোন আলাপে মন ছিল না।
এরপরও আজ পর্যন্ত কয়েকবার দেখা হয়েছে রণর সাথে। রণ প্রতিবার বেশ নমনীয় হয়ে কথা বলেছে তার সাথে। তবুও কোথায় সুক্ষ জ্বলুনি টের পেয়েছে৷ এই নির্বাচনী এলাকা দীর্ঘ দিন ধরে তাদের পরিবারের ছিল। হুট করে সেটা নতুন একজন হস্তগত করবে এটা মেনে নেওয়া তার জন্য ভীষণ কষ্টকর। তার ও তার পরিবারের জন্য সন্মান হানিকর। সামনে এতো এতো কাজ হবে সবটাই ওই পুঁচকে ছেলেটা নিয়ন্ত্রণ করবে এটা ভাবতেই মাথাটা ভীষণ গরম হয়ে যাচ্ছে। সে জানে নেত্রী তাকে শান্ত রাখতে, হাতে রাখতে মেয়র নির্বাচনের মুলো ঝুলিয়েছে। আর জানে বলেই মেজাজ আরও বেশি বিগড়ে যাচ্ছে। এই বয়সে এসে এরকম হাড় মেনে নেওয়া যায় না। অপমানবোধটা বড্ড খোঁচাচ্ছে তাকে। কিন্তু তার হাত পা বাঁধা। কিছু করতে পারছেন না কেবল নিজের মাথার চুল নিজে ছিঁড়ছেন। তা না হলে ওই রণকে রাস্তা দেখিয়ে দিতেন ঠিক যেমনটা ওর বাপকে দেখিয়েছিলেন বারো বছর আগে।
নিজের কামড়ায় বসে ভাবনায় ডুবে থাকা সালিম সাহেব হঠাৎ চোখ খুললেন। বাইরের ঘর থেকে হইচই এর আওয়াজ আসছে। বেশ একটা হুলুস্থুল পড়ে গেছে মনেহচ্ছে। সালিম সাহেব বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
★★★
দীর্ঘ দুই মাস অপহৃত থাকার পর শুভ্রা বাড়ি ফিরে এলো। মাকে দেখে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো-“মা, শরীর কুটকুট করছে। গোসল করবো। আমার বাথরুমের গিজারটা ঠিক আছে তো?”
শুভ্রার মা রিমা মেয়েকে দেখে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শুভ্রার কথা শুনে বিহ্বলতা বাড়লো। আর্তনাদ বেড়িয়ে এলো মুখ থেকে। সে ছুটে মেয়ের কাছে যেতে গিয়ে আচমকা পিছলে পড়ে মাথা ফা/টি/য়ে ফেললো। ডাইনিংএ সকালের প্রাতরাশ করতে বসা বাড়ির বাকি সকলে রিমার আর্তনাদ শুনে টেবিল ছেড়ে উঠে এসে শুভ্রাকে দেখে হতবাক। হতবাক অবস্থা কাটর আগেই রিমাকে দেখে আঁতকে ওঠে সোহেল আর শরীফ। তুলতুল শাশুড়ীকে জাপ্টে ধরে চিৎকার দিল। সোহেল আর শরীফ বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে।
সালিম সাহেব বাইরে বেড়িয়ে শুভ্রাকে দেখে চমকে উঠলেন। শুভ্রা কখন এলো? পুরো পরিস্থিতি বুঝতে তিরিশ সেকেন্ড লাগলো তার। তিনি অবাক হয়ে একবার বউ আরেকবার মেয়েকে দেখলেন। শুভ্রা তার দিকে তাকালো-“বাবা, তুমি ভালো আছো?”
মানুষটা জবাব দিলো না। শুভ্রা বললো-“আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি। পেট চোচো করছে, খেতে হবে আমার।”
রিমাকে ফিরেও দেখলো না শুভ্রা। বাবার জবাবের অপেক্ষা করলোনা। খুব স্বাভাবিক ভাবে হেঁটে নিজের রুমে গেলো। পুরোটা সময় ইব্রাহিম সালিম মেয়েকে দেখলেন তাকিয়ে তাকিয়ে। তার ভ্রু কুঁচকে আছে। তিনি মেয়ের ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে এগিয়ে এলেন রিমার কাছে। রিমাকে ধরাধরি করে নিচে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তুলতুল আছে সাথে। শরীফ আর সোহেলকে হতভম্ব দেখাচ্ছে। সালিম সাহেব ধমক দিলেন-“আহাম্মকের মতন চাইয়া আছোস কেন? তোর মার লগে যা। এইদিকে আমি দেখতাছি।”
ছেলে দু’টো মাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো। সালিম সাহেব মেয়ের বন্ধ কামড়ার দিকে তাকালেন। শুভ্রা কোথা থেকে কিভাবে এলো এই সকালে? গতকাল নির্বাচন হয়ে গভীর রাতে এই এলাকার ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। ভোররাত পর্যন্ত এলাকায় আনন্দ মিছিল, আতশবাজি আর খাওয়া দাওয়া হয়েছে। আজ সকালে তাই চারিদিক নিরব। এরমধ্যেই শুভ্রার আগমন। প্রতিপক্ষ ভীষণ চতুর এতে কোন সন্দেহ নেই। তারা জানে আজ চারিদিক নিরব থাকবে, কেউ টের পাবে না কিছু। কোন প্রত্যক্ষদর্শী থাকবে না। সালিম সাহেব তুহিনকে ডাকলেন। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা তুহিন এগিয়ে এলো-“আপামনি গাড়িতে আইসা নামছে স্যার। সিসিটিভি ক্যামেরায় দেইখা মজিদ আমাকে ডাকছিল। উবারের গাড়ি। আমারে কইলো এয়ারপোর্ট থিকা উঠছে আপামনি।”
“তার মানে কোন ক্লু নাই?”
“নাহ। একমাত্র আপামনিই যদি কিছু বলে।”
সালিম সাহেব ভ্রু কুঁচকে তাকালেন-“যদি কিছু বলে মানে কি তুহিন? লুকাছাপা না কইরা ক কি কইতে চাস?”
তুহিন কেঁপে উঠলো। সত্যি বলতে ভয় পাচ্ছে সে।
“চুপ কইরা আছোস কেন?”
তুহিন কিছু বলতে চাইলো তখনই শুভ্রা বের হলো রুম থেকে। তার চুল ভেজা, চেহারায় স্নিগ্ধতা ছাপিয়ে ক্লান্তির ছাপ। শুকিয়ে গেছে অনেক, চেহারায় কমনীয়তার জায়গায় রুক্ষতা। তুহিনকে দেখে হাসলো-“তুহিন ভাই, আপনার হাতের ভুনা খিচুড়ি খেতে মন চাইছে সাথে কষা গরুর মাংস।”
তুহিন থতমত খেল। সালিম সাহেবকে দেখে নিল একবার। মৃদুস্বরে বললো-“কখন খাবেন আপামনি?”
“সন্ধ্যায়। এখন নাস্তা করে একটা ঘুম দেব। অনেকদিন ধরে ঘুমাই না। আজকে নিজের রুমে শান্তির ঘুম দেব। ঘুম থেকে উঠে আপনার হাতের খিচুড়ি খাবো।”
“আচ্ছা, আপামনি।”
শুভ্রা টেবিলে বসে প্লেটে খাবার নিয়ে খেতে শুরু করেছে। টেবিলে থাকা সব খাবার নিয়ে প্লেট ভর্তি তার। সালিম সাহেব তুহিনকে ইশারায় চলে যেতে বলে নিজে গিয়ে মেয়ের কাছে বসলেন-“আম্মু, কোথা থেকে আসলা এতো সকালে?”
শুভ্রা রুটি চিবাতে চিবাতে ঘড়ি দেখলো-“সকাল কোথায় আব্বু? সাড়ে এগারোটা বাজে।”
“আম্মা, কোথায় ছিলা এতদিন?”
শুভ্রার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। হাতের গ্রাস প্লেটে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়-“আমি যাই আব্বা। খুব ঘুম পাচ্ছে।”
শুভ্রা উঠে এলোমেলো পা ফেলে রুমে চলে গেলো। সালিম সাহেব তাকিয়ে দেখলেন, কি বলবেন ভেবে পেলেন না। মেয়েটাকে খানিকটা অস্বাভাবিক লাগছে তার কাছে। ওর সাথে কি খারাপ… না না কিছুতেই হতে পারে না। ওরা বলেছিল নির্বাচনে কোন ঝামেলা না করতে উনি মেনে নিয়েছেন। তাহলে? ওরা কেন কথা রাখবে না?
সালিম সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে মেজাজ ঠিক রাখার চেষ্টা করেন। নতুন ছেলেটার বিরুদ্ধে কোন প্রমান পাওয়া যায়নি। গত দেড়টা মাস ধরে তুহিন তার পেছনে লোক লাগিয়ে রেখেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। হয় ছেলেটা সত্যিই ইনোসেন্ট না হয় অতিরিক্ত চালাক। সালিম সাহেব খুব অসহায় বোধ করছেন। একটা মাত্র মেয়ে দুই মাসের অধিক সময় কারো কাছে বন্দী ছিল এটা মাথায় আসলেই মেজাজ চটে যাচ্ছে তার। সবচেয়ে কষ্ট দিচ্ছে যে ব্যাপারটা সেটা হলো তিনি এতোদিনেও কিছু করতে পারেননি। না মেয়ের অ/প/হ/র/ণকারীদের ধরতে পেরেছেন না মেয়েকে উদ্ধার করতে পেরেছেন। না জানি তার মেয়েটা এই দুইমাসে কত কি সয়েছে। চোয়াল শক্ত হয় তার। যদি কোনভাবে জানতে পারতেন এই অতি জঘন্য কাজটা কে করেছে তাহলে তাকে বুঝিয়ে দিতেন তিনি কি জিনিস। সালিম সাহেব অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন নিস্ফল আক্রোশ নিয়ে।
চলবে—
© Farhana_য়েস্মিন
#দর্পহরন
#পর্ব-১১
শুভ্রা শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। তার ঘুম আসছে না। না ঘুমাতে ঘুমাতে তার অভ্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে। সামান্য শব্দ পেলে চমকে উঠছে, ভয় পেয়ে উঠে বসে থাকছে। সবচেয়ে আজব ব্যাপার খাটে শুয়ে ভালো লাগছে না তার। সে কিছুক্ষণ মেঝেতে শুয়ে রইলো। কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে রইলো। তারপর আবার বিছানায় এলো। ঘুম নেই তবুও শুভ্রা চুপচাপ শুয়ে রইলো। তার দরজার বাইরে অস্থির পায়চারীর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পাশ ফিরলো। সে জানে তার সাথে কথা বলার জন্য সবাই ব্যাকুল হয়ে আছে। কিন্তু সে কারো সাথেই কথা বলতে চায় না। পরিবারের মানুষের হাজারো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে তার নেই। এইজন্য দরজার সিটকিনি আঁটকে আছে। তা না হলে দেখা যেত তার ঘরে একের পর এক লোক আসছে তো আসছে, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে। নিজেকে বাঁচাতে তাই শুভ্রা রুমের দরজা আঁটকে আছে।
শুভ্রা আসলে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই৷ একা থাকতে থাকতে এখন এতো মানুষ দেখে কেমন যেন অসস্তি হচ্ছে। তারউপর সবার অতি উৎসাহী চোখ শুভ্রাকে আরও বেশি মিইয়ে দিচ্ছে। শুভ্রা চোখ বুঁজে তার বন্দী জীবনের কথা ভাবলো। বন্দী জীবনে পালানোর চেষ্টা করাটা কি বিশাল ভুল ছিলো তা ধীরে ধীরে টের পেয়েছে শুভ্রা। এই চেষ্টা করার ফলে তার বন্দী জীবনটা ট্রমার মতো কেটেছে। রণ নামের মানুষটা সেইদিনের পর আর একদিনও যায়নি ওর কাছে। না খাবার দিয়েছে না ঘুমাতে দিয়েছে। ঘুমালেই পুরো বাড়ি অন্ধকার করে দিত। ফলে শুভ্রা ভয়ে জেগে উঠতো। একা একা অন্ধকারে বসে থেকে মনে হতো আশেপাশে কেউ আছে। চিৎকার করে কাঁদতো দিনের পর দিন। আর খাবারের কথা মনে এলেই গা শিউরে ওঠে শুভ্রার৷ উফফ! কী নিদারুণ কষ্ট। শুভ্রা গুঙিয়ে উঠলো। বালিশ চেপে ধরলো পেটের উপর। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। অনেকক্ষণ পরে বিরবির করে বললো-“আপনাকে মাফ করবো না কিছুতেই। নিজ হাতে কঠিন সাজা দেব আপনাকে।”
★★★
সকালে ঘুমিয়েছিল রণ। কিন্তু এতো এতো মানুষের ফোন পাচ্ছে যে ঘুমিয়ে থাকার উপায় নেই। বারবার ঘুমের ব্যাঘাত হওয়াতে বিরক্ত হয়ে দু’তিন ঘন্টা পরেই উঠে পড়লো। চোখ দুটো এখন ব্যাথা করছে রণর। উঠে ডাইনিং এ এলো রণ। ওকে দেখে জলি এগিয়ে এলো-“কিরে উঠে পড়লি যে?”
রণ হাই আঁটকালো-“ঘনঘন ফোন আসছে মা ঘুমাব কি করে?”
“তা তো আসবেই। নিজে পছন্দ করে এই পথ বেছে নিয়েছিস এখন বোঝ।”
রণ মায়ের দিকে তাকালো। জলির চেহারায় চাপা একটা খুশির আভা আছে। চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে আছে। রণ মুচকি হেসে বললো-“তোমার কি হয়েছে মা? তুমি তো সারারাত আমার সাথে জেগে ছিলে এখনও দেখছি জেগেই আছো। তারপরও চেহারায় কোন ক্লান্তি নেই। কি ঘটনা বলোতো মা?”
জলি মুখটা গম্ভীর করার চেষ্টা করলো-“কি আবার ঘটনা হবে? তোর দুনিয়ার গেস্ট আসছে তাদের আপ্যায়ন দেখতে হচ্ছে। কাজের মেয়ে দু’টো কি এসব বোঝে? ওদের পেছনে লেগে থাকতে হচ্ছে, সব দেখিয়ে দিতে হচ্ছে। একটু আগেই মিহির এসে বললো এলাকার গন্যমান্য কেউ এসেছে। ভালো আপ্যায়নের ব্যাবস্থা করতে।”
রণ এগিয়ে এসে জলিকে জড়িয়ে ধরে-“আমার এই এচিভমেন্টে তুমি খুব খুশি তাই না মা?”
জলির চোখের কোনে খুশির বারিধারা চিকচিক করছে। সে আপ্লূত হয়ে মাথা নাড়লো-“এবার কিন্তু বিয়ে করতে হবে রণ। তুই ব্যস্ত হয়ে যাবি আমার সঙ্গী লাগবে। এতোদিন নানা টালবাহানা করেছিস তবে এখন আর শুনবো না।”
রণ হেসে দিয়ে পিছিয়ে গেল-“তুমি পারোও বটে মা। কেবল নতুন করে সব শুরু করছি। তুমি আমাকে পিছুটান দিয়ে বাঁধতে চাইছো এখনই? সব আগে একটু গুছিয়ে নেই। সবচেয়ে বড় কথা ওই বাঁদর দুটো বিদায় না করে আমার কি বিয়ে করা ঠিক হবে মা? দুটো মিলে তো শুধু আমার বউকে হেনস্তা করবে। ভেবেই হবু বউয়ের জন্য চিন্তা হচ্ছে আমার।”
শেষের দিকে কথা বলতে বলতে খানিকটা গম্ভীর হলো রণ। জলি রেগেমেগে এগিয়ে এসে রণর কান মলে দিলেন-“খবরদার আমার মেয়েদের কথা বলবি না। ওরা অনেক লক্ষী। তুই বিয়ে করার আগেই বউকে নিয়ে ভাবছিস? বোনদের শত্রুর আসনে বসিয়ে দিচ্ছিস?”
“উফফ মা! দেখলে অবস্থা? শুধু বউয়ের কথা একটু ভেবেছি তাতেই তুমি কেমন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলে। তাহলে ভাবো বিয়ের পর কি করবে। এইজন্যই বিয়ে করতে চাই না মা। এই ভালো আছি।”
জলি অবাক হলো-“আরেহ! আমি কখন তেলেবেগুনে জ্বললাম? বুঝিনা ভেবেছিস? বিয়ে না করার ফন্দি সব। শোন এসব বলে লাভ হবে না এবার। তোর কোন..”
মিহির প্রবেশ করলো-“ভাই, উঠেছেন?”
রণ মিহিরকে দেখলো-“হ্যা, কেবলই উঠলাম। কি হয়েছে?”
“নিচে মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা আসছে। আপনি ঘুমিয়ে আছেন বলার পরও যায় না। ওরা আনন্দমিছিল করতে চায আপনাকে নিয়ে।”
“আনন্দমিছিল তো সম্পূর্ণ ফলাফল প্রকাশের পর করার কথা। আচ্ছা ঠিক আছে চল আমি কথা বলছি। মা আমার জন্য কড়া করে একমগ কফি দেবে?”
জলি মুখ গোজ করলো-“পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
রণ মিহিরের সাথে চলে গেল। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে ফিসফিস করলো-“কোন আপডেট পেয়েছিস?”
মিহির চাপা গলায় জবাব দিলো-“সব চুপচাপ। কোন আওয়াজ নাই।”
“পৌছেছে ঠিকমতো?”
“হ্যা। আমি নিজে দেখেছি।”
“আচ্ছা।”
রণর মুখেচোখে সস্তি ফুটে উঠলো। মিহির মিনমিন করলো-“কিন্তু ভাই, ওই মেয়ে আপনাকে দেখেছে। ওর বাপকে যদি বলে দেয় তাহলে কি হবে?”
“বলার কথা না। এমনকি ওর বাপেরও কোন উচ্চবাচ্য করার কথা না। করলে কি করবি তাতো জানিস।”
“ভয় করে ভাই। ওর বাপটা কিন্তু সাংঘাতিক।”
রণর চেহারায় অমনিশা নামে। সে ফিসফিস করলো-“মেয়েটাও কম সাংঘাতিক না।”
★★★
“তুমি তো ভারি মিষ্টি দেখতে। কে তুমি? মা, এই মেয়েটা কে?”
শুভ্রা তুলতুলের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললো। রিমার মাথায় চারটে সেলাই পড়েছে। তবুও তৃষিত নয়নে মেয়েকে দেখছেন। মাঝে মাঝে চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। শুভ্রা শুয়ে আছে মায়ের কোলে। তুলতুল জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। রিমা তুলতুলকে দেখে শুভ্রার দিকে তাকায়-“ও সোহেলের বউ তুলতুল।”
শুভ্রা মায়ের কোল থেকে উঠে বসলো। তার চোখে মুখে বিস্ময়-“ভাইয়া বিয়ে করেছে? কবে? আমাকে ছাড়া তোমরা ভাইয়ার বিয়ে দিয়ে দিলে? আমাকে তোমরা জানানোর প্রয়োজন বোধ করোনি?”
রিমাকে খানিকটা ব্যাকুল দেখায়। সোহেলের কীর্তি শুভ্রাকে বলা যাবে না। বাপ ভাইরা মেয়ের কাছে আলাভোলা মানুষ সেজে থাকে। তাছাড়া শুভ্রা এখন এসব ঘটনা শোনার মতো মানসিক স্থিতিতে নেই। তাই কি জবাব দেবেন বুঝে পেলেন না। দ্বিধা জড়িত কন্ঠে বললো-“কাউকেই জানাই নাই। ভাবছি তুই আসলে অনুষ্ঠান করবো।”
শুভ্রা সন্দেহ নিয়ে মাকে দেখলো-“কেন? কাউকে জানাও নাই কেন?”
রিমা কঠিন কন্ঠে বললো-“জানাবো কেমনে? তোর চাচী তো দেশে নাই জানোস। তুই মালিহা, তন্ময়, মুমু কেউ নাই। ওদের খবর দিতে হবে, দেশে আসবো তারপর না অনুষ্ঠান। আমি একা একা সব কাম পারিনা দেইখা তাড়াতাড়ি বিয়ে করাই দিছি।”
শুভ্রা তুলতুলকে দেখলো। মেয়েটা সুন্দরী, তবে চেহারা কেমন যেন ফ্যাকাশে। সবসময় তটস্থ হয়ে থাকছে। ও তুলতুলকে ডাকলো-“ভাবি, তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? এখানে এসে বসো আমার পাশে।”
তুলতুল রিমার দিকে তাকালো একবার-“না আপা, আপনারা গল্প করেন। আমি বরং একটু রান্নাঘর হয়ে আসি। দেখি আপনার খিচুড়ির কি হাল।”
শুভ্রা আবারও মায়ের কোলে শুয়ে গেলো-“আচ্ছা, দেখো। হলে খানিকটা বাটিতে নিয়ে এসো।গরম গরম খাব।”
তুলতুল মাথা নেড়ে চলে গেলো। শুভ্রা চোখ বুঁজলো। রিমা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। গালে হাত বুলিয়ে দিলো৷ শুভ্রার ত্বক রুক্ষ হয়ে গেছে, গায়ের রং ময়লা হয়েছে। অথচ শুভ্রার গায়ের রং মিলিয়েই নাম রাখা হয়েছিল। গলার বিউটি বোন একটু বেশিই দৃশ্যমান, শরীর শুকিয়ে কমনীয়তা হারিয়েছে। রিমা ফিসফিস করে ডাকলো-“ও শারমিন, ঘুমাইছোস?”
শুভ্রা ক্লান্ত গলায় জবাব দিলো-“ঘুম আসে না মা। অনেকদিন হলো ঘুমাই না তো।”
রিমা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলো-“ঘুমাস না কেন? কই আছিলি তুই? ঘুমাইতে দেয় নাই তোরে?”
“ভয়ে ঘুম আসতো না মা। একা থাকতাম তো।”
বলতে বলতে শুভ্রা কাত হলো। ওর কথাগুলো জড়ানো। ওর জীর্নশীর্ন চুলগুলো একপাশে দিলো রিমা। তখনই ঘায়ের নিচে কালসিটে দাগটা নজরে এলো। রিমা আলতো হাতে সেখানে হাত বুলায়-“এইখানে কি হইছে শারমিন? কেমনে ব্যাথা পাইছোস?”
জবাব এলো না কোন। মৃদু নাক ডাকার শব্দ পাওয়া গেলো। রিমা বিস্মিত হয়ে আবিস্কার করলো শুভ্রা ঘুমিয়ে গেছে তার কোলের মধ্যে। দু’হাতে রিমাক আগলে নিয়ে আছে। অনেকটা ভয় পাওয়া বাচ্চাদের মতো। রিমার কান্না পেয়ে গেল। তার মেয়েটা গত দুই মাস অনেক কষ্টে ছিল বোঝা যাচ্ছে। অথচ মা হয়ে কিছু করতে পারছে না।
“ঘুমাইছে?”
ফিসফিস করলো সালিম সাহেব। এতোক্ষণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে মা মেয়েকে দেখছিলেন। রিমাকে চোখ মুছতে দেখে এগিয়ে এলেন। রিমা মাথা দুলায়-“ভয় পায় একা থাকতে। দেখেন কেমনে ঘুমাইতেছে।”
নিচু স্বরে জবাব দিলো রিমা। সালিম সাহেব একদৃষ্টিতে মেয়েকে দেখে চলেছেন। রিমা ছলছল চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন-“ওরে মনেহয় মা/র/তো ওরা।”
সালিম সাহেব ভ্রু কুচকে তাকিয়ে স্ত্রীকে দেখলেন-“কেমনে বুঝলা?”
শুভ্রার ঘাড়ের দিকে ইশারা করলো-“এই যে দেখেন কেমন কালা হইয়া আছে। খাইতে দিত না। গায়ের রং কেমুন ময়লা হইছে দেখছেন? শুকায়া গেছে দেখেন না।”
সালিম সাহেবের চোয়াল শক্ত হলো। তার কলিজায় হাত দেওয়া মানুষটাকে কিছুতেই ছাড়বেন তিনি। শুধু জানতে দেরি তাকে সাজা দিতে দেরি করবেন না মোটেও। মনেহয় তাকে জায়গা থেকে সরানোর জন্য বেশ বড়সড় পরিকল্পনা হয়েছিল। এটা কারো একার কাজ হতেই পারে না। তাকে সরিয়ে নতুন কাউকে তার জায়গায় বসানো, তার ক্ষমতা কমানো। এসব কিসের ইঙ্গিত দেয়? তাকে কি এভাবে দমানো যাবে? প্রতিপক্ষ জানেনা কার বিরুদ্ধে নেমেছে তারা। সে দা ইব্রাহিম সালিম, এতো সহজ নয় তাকে সরানো। আর তার সন্মানে আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করলে কি হবে তা দেখিয়ে দেবেন শিগগিরই। এতোদিন চুপচাপ বসে ছিলেন কারন মেয়ে কাছে ছিলো না। এখন মেয়ে পেয়ে গেছেন, র/ক্তে/র ব/ন্যা বইয়ে দেবেন দরকার হলে। তবুও মেয়ের অ/প/হ/র/ণ কারীদের চাই তার। অপরাধী স্বয়ং নেত্রী হলেও তার ছাড় হবে না। কারণ, ইব্রাহিম সালিম এই দেশে একজনই। আর তাকে ঘাটালে, তার সন্মান নিয়ে টানাটানি করলে তার ফল যে ভালো হয় না এটা আবার নতুন করে বুঝিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে।
চলবে—
©Farhana_য়েস্মিন
#দর্পহরন
#পর্ব-১২
রণর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহনের দিন আজ। সাংসদ হিসেবে শপথ নিয়েছেন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পঞ্চমদিনেই। সংখ্যাগরিষ্ট দল হিসেবে জনতা পার্টি বাংলাদেশ ক্ষমতায় এসেছে দুই সপ্তাহের অধিক হবে। এরমধ্যে রাস্ট্রপতির আমন্ত্রণে নেত্রী নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করেছে। এবার তরুনদের অগ্রাধিকার দিয়ে গঠিত মন্ত্রীসভায় রণকে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যেটার পূর্ণ ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে থাকবে। রণকে তার কাজের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে। এইরকম অচেনা কাউকে প্রথমবারেই এতো বড় মন্ত্রনালয়ের দাঁয়িত্ব দেওয়াটা আশ্চর্যজনক বইকি। পুরনো নেতাকর্মীদের মধ্যে এ নিয়ে জোর আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। নেত্রী অবশ্য কোন কথাই আমলে নেননি। উনি ওনার সিদ্ধান্তে অটল আছেন।
রণ আনন্দিত হবে নাকি হবে না বুঝতে পারছে না। শুরুতেই এতোবড় দায়িত্ব সে চায়নি কিছুতেই। রাজনীতির র বোঝেনা এখনো। যেখানে অপজিশন পদে স্বয়ং নিজের দলের বর্ষীয়ান নেতা সেখানে এই দায়িত্ব অনেকটা বোঝার মতো লাগছে তার কাছে। নির্বাচনের পর এলাকায় একটা মিটিং হয়েছিল যেখানে সব শ্রেনীর দলীয় কর্মী উপস্থিত ছিল। মিটিং এ রণ কথাই বলতে পারেনি। মিটিংটা মুলত দলীয় নেতাকর্মীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা শোনার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল। মাঠপর্যায়ের নেতানেত্রীদের নানা দাবিদাওয়া ছিল যার মধ্যে এক নম্বর হলো তাদের জন্য কিছু করা। সরকারের সব কাজ একজনকে করার সু্যোগ না দিয়ে যেন সবার মধ্যে সমানভাবে বন্টন করা হয় যাতে দলের জন্য খেটে যাওয়া মানুষটাও কিছু টাকা উপার্জন করতে পারে। অতীতে এমন দাবী বারবার করা হলেও কেউ কানে নেয়নি। তাই এবার যেন বিশেষ নজর দেওয়া হয় এদিকটায়। এমন দাবী শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল ইব্রাহিম সালিম। তার দাবী মিটিং এ ডেকে এনে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপদস্ত করা হচ্ছে। তার মতো এমন বর্ষীয়ান নেতা, দলের জন্য যার অনেক অবদান তাকে অপমান করা এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। তিনি মিটিং বয়কট করে চলে গেলেন। দেখা গেলো সমগ্র এলাকার সত্তুরভাগ দলীয় নেতা তার পিছু নিয়ে মিটিং বয়কট করলো। বোকা বনে গেছিল রণ। বুঝতে পারলো, তার প্রতিপক্ষ তার ভাবনার চাইতে কয়েকধাপ এগিয়ে। তার ভাবনার সাথে তাল মিলাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে তাকে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায় রণ।
গায়ে নীল পাঞ্জাবির উপর অফ হোয়াইট কোটি চাপিয়েছে আজ রণ। চুরিদার পায়জামার সাথে কেতাদুরস্ত জুতো খুব মানিয়ে গেছে। চুলগুলোতে জেল লাগিয়ে সেট করে নিলো। জলি হাতে বাটি নিয়ে ঘরে ঢুকলো-“বাবাই, পায়েস রেঁধেছি তোর জন্য। একটু মুখে দে।”
রণ মুখের বিরক্তি কাটিয়ে হাসি আনার চেষ্টা করলো। মাকে সে এসব বুঝতে দিতে চায় না। না হলে মা ভয় পেয়ে যাবে।
“মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে না মা।”
জলি এক চামচ পায়েস তুলে ছেলের মুখের সামনে ধরলো-“শুভ কাজে যাচ্ছিস মানা করিস না।”
রণ চুপচাপ খেয়ে নিলো। মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো-“আসছি মা।”
জলি ছেলের মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন।
★★★
বর্তমানে তুলতুলের প্রধান কাজ শুভ্রার সাথে থাকা। তুলতুল ব্যাপারটায় বেশ আনন্দ পাচ্ছে। এতোদিন তার জীবনটা ছিল আলো আঁধারির গোলকধাঁধা। এখন শুভ্রা আসার পর যেন একটা দিশা খুঁজে পেয়েছে। সোহেলের সাথে তার সম্পর্ক নামকোবাস্তে। বিয়ের পর থেকে সোহেল কেন যেন তাকে সহ্যই করতে পারে না। যেই মেয়েটাকে তুলে এনে রেপ করলো তাকে বিয়ের পর একদিনও কাছে টানেনি। তুলতুল অবাক হয়েছে। সোহেলের প্রতি ঘৃনা ছাড়া আর কিছু ফিল করে না সে। দেখলে কেন যেন প্রথমদিনের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। ঘৃনায় তুলতুলের গা কাঁপে, বুক ধরফর করে।
সোহেলের অবশ্য এতোসব দেখার সময় নেই। প্রায় রাতে সে মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় ফিরে আসে। তুলতুল বুঝেছে অন্য মেয়ে মানুষের কাছে যায় সে। এসব বোঝার কিছু ক্ষমতা আল্লাহ মেয়েদের দিয়েছেন। তুলতুলের তাতে কিছু যায় আসে না। সে অবাক হয়ে এ বাড়ির মানুষগুলোকে দেখে। অন্যের মেয়েকে তুলে এনে রে/প করলেও এদের কিছু মনেহয় না। অথচ নিজের কন্যার বেলায় এরা কতটা মানবিক। ভেবেই হাসি পেল তুলতুলের।
এ বাড়িতে রিমাকেই খানিকটা নরম মনের মানুষ মনেহয়। কিন্তু এই মানুষটা কি কিছু জানে না? তার ছেলেটা এমন জঘন্য কাজ করে সে মেনে নেয়? সে নিজেও তো একজন মেয়ে। কি করে মেনে নেয় আরেকটা মেয়ের অসন্মান? তুলতুল অনেকবার ভেবেছে এই বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করবে রিমাকে। কিন্তু এখনো সাহস করে উঠতে পারেনি। তুলতুল যখন থেকে বুঝেছে এ বাড়িতে সে অনাহুত। অনেকটা বাধ্য হয়ে তাকে বউ বানানো হয়েছে তখন থেকেই তার মধ্যে ভয়টা জাঁকিয়ে বসেছে৷ পারতপক্ষে সোহেলের সামনে যায়না সে। রিমার সাথে মানিয়ে চলছে, চাবি দেওয়া পুতুলের মতো চলছে যাতে আবার পরিবারের কাছে ফিরতে পারে। মা ছোটভাই, চাচা চাচী আর অনেক মিস করে সে। মিস করে পড়ালেখার জীবনটাকে। এভাবে জীবনের মোড় ঘুরবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি।
তবে একটা ব্যাপার সে ভেবে রেখেছে, চলে যাওয়ার আগে এ বাড়ির ভিত নড়িয়ে দিয়ে যাবে। কিভাবে কি করবে তা জানে না কিন্তু করবে। বাবার বিভৎস মৃত্যু দৃশ্য এখনো ভোলেনি সে। শীতলক্ষ্যায় ডুবে থাকা দুইদিনের ফুলে যাওয়া মৃ/ত/দে/হ দেখে মায়ের অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ভোলেনি। আর নিজের স/ম্ভ্র/ম/হা/নির অপমানই বা কি করে ভুলবে? সব মনে রাখছে। একদম সময় মতো সব হিসাব চুকিয়ে ফেলবে।
★★★
শুভ্রা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। যদিও এখনও রাতে ঘুমায় না শুভ্রা। অন্ধকার সহ্য করতে পারে না। কোথাও অন্ধকার দেখলেই চেচিয়ে বাড়ি মাথায় করে। তার জন্য বাধ্য হয়ে রাতে বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। রাতে তুলতুল শুভ্রার সাথে থাকে। দিনে রিমা আঠার মতো মেয়ের পেছনে লেগে থাকে। সে প্রায়ই হরেকরকম মজাদার খাবার বানিয়ে আনছে, কাছে বসে মেয়েকে খাওয়াচ্ছে। তার জোরজবরদস্তিতেই শুভ্রা ধীরে ধীরে খেতে শুরু করেছে। ভগ্ন স্বাস্থ্য একটু একটু করে ঠিক হতে শুরু করেছে। চেহারার রুক্ষতাও কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। রিমা নিয়মিত অয়েল ম্যাসাজ দিয়ে যাচ্ছে মেয়ের চুলে। চেহারায় নানা রকম প্রাকৃতিক উপাদান মাখিয়ে রাখছে। শুভ্রার বিরক্ত লাগলেও রিমাকে দমানো যাচ্ছে না। সে শুভ্রাকে এক সেকেন্ড চোখের আড়াল করে না।
রিমা আসলে মনে মনে ভীষণ ভয়ে থাকে। মেয়েটা এতোদিন কোথায় ছিল, কেমন ছিল, তার সাথে কিছু হয়েছে কিনা সেসব জানার কোন উপায় নেই। এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করলেই শুভ্রা নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলে। তাই সে চেষ্টা বাদ দিয়েছে। কিন্তু মনের কু চিন্তা কিছুতেই দূর করতে পারে না। আচ্ছা, শুভ্রাকে কি… নিজের ভাবনা আগাতে দেয় না রিমা। দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হয় না। অবশেষে সেদিন যখন মেয়ের পিরিয়ড হলো মনের পাথর সরে গেলো রিমার। নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পেলো। নিজের মেয়েকে নিয়ে এরকম ভাবনা ভাবতে কোন মায়েরই ভালো লাগবে না। রিমারও লাগে না কিন্তু সে নিরুপায়। শুভ্রার নিরবতা তাকে এরকম ভাবতে বাধ্য করেছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শুভ্রা এখন একদমই কথা বলে না। সারাদিন চুপচাপ বসে থাকে। আবার যখন নিজ থেকে বলতে শুরু করে তাকে থামানো যায় না। বেশি লোকজন দেখলে ভয় পাচ্ছে। সারাদিন নিজের রুমে বই পড়ছে। তুলতুলও চুপচাপ ওর পাশে বসে থাকে। রিমা অবশ্য বলেছে ও যেন শুভ্রার সাথে এটাসেটা গল্প করে। তুলতুল মাঝে মাঝে চেষ্টা করে গল্প করার। কিন্তু ওর নিজের মনই তো ভালো থাকে না। জোর করে কি গল্প করবে?
আজ সালিম সাহেব বাড়িতে বলে পুরো বাড়ি একটু বেশি নিরব। সালিম সাহেবের মনমেজাজ খুব খারাপ থাকে ইদানীং। অকারণে চিৎকার চেচামেচি করে ফেলে মাঝে মাঝে। বাড়ির কাজের লোকেরা খুব তটস্থ থাকে। সালিম সাহেব বাসায় বলে রিমা আজ মেয়ের কাছে বসেনি বেশিক্ষণ। শুভ্রা হঠাৎ বই থেকে মুখ তুলে তুলতুলকে দেখলো-“আজ কি হয়েছে? কারো কোন সারা নেই।”
তুলতুল উদাস হয়ে জানালার ধারে বসে ছিল-“আপনার আব্বা বাসায়। তার খুব মেজাজ খারাপ আজকে। কারন কি জানি না। এখন টিভিতে কি যেন দেখতেছে।”
শুভ্রা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো-“কি দেখছে?”
“আমি দেখি নাই। তবে হলরুমে আপনার চাচারাও আছে।”
শুভ্রা উঠে দাঁড়ায় দেখে তুলতুল অবাক হয়ে তাকায়-“কই যান আপা?”
“মাকে দেখে আসি।”
তুলতুল অনিচ্ছায় দাঁড়াতেই শুভ্রা তাকে থামায়-“তোমার আসতে হবে না। আমি এখনই চলে আসবো।”
তুলতুল হাফ ছেড়ে বাঁচলো। হলরুমে সোহেলকে বসে থাকতে দেখেছে।
শুভ্রা পায়ে পায়ে হলরুমে এলো। সবাই গম্ভীর হয়ে বসে আছে। রিমা শুভাকে দেখে ডাকলো-“কি হইছে? কিছু খাবি? খিদা লাগছে?”
শুভ্রা মাথা নাড়ে। সালিম স্নেহময় দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখলেন-“আম্মা, আমার কাছে এসে একটু বসেন। আমার ভালো লাগবে।”
শুভ্রা সংকোচ নিয়ে বাবার পাশে বসলো-“তোমরা সবাই মিলে কি দেখছো টিভিতে?”
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন সালিম সাহেব-
“তেমন কিছু না আম্মা। আজকে আপার শপথ অনুষ্ঠান হইতেছে তাই দেখতেছি।”
শুভ্রা টিভির দিকে তাকালো-“কিসের শপথ?”
সালিম মেয়ের দিকে তাকায়। শুভ্রাকে কথা বলতে দেখে ভালো লাগছে তার। স্নেহার্দ কন্ঠে বললো-“নির্বাচন হইছে। দল জিতছে এখন প্রধানমন্ত্রী আর মন্ত্রীরা শপথ নিবে।”
“তুমি যাও নাই আব্বা? তোমাকে ছাড়া শপথ অনুষ্ঠান?”
সালিম সাহেবের বুকে লাগলো কথাটা। মেয়ে তার ক্ষমতা দেখে অভ্যস্ত। বুকে রক্তক্ষরন টের পেলেন। গম্ভীর হয়ে জবাব দিলেব-“আমার শরীর ভালো না আম্মা তাই যাই নাই।”
শুভ্রা কথাটা শুনলো কিনা বোঝা গেলো না। সে একদৃষ্টিতে টিভি দেখছে। হঠাৎ টিভির দিকে আঙুল তুললো-“এই ছেলেটা কে? ফুপুর পাশে দাঁড়িয়ে আছে?”
সালিমের চেহারায় বিস্ময়। মেয়ের নজর হঠাৎ রণর উপর কেন গেলো? তাহলে কি রণ সেই ব্যক্তি যে তার মেয়েকে….। সালিমের চোয়াল শক্ত হলো। সে মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। শুভ্রার জুলজুলে চাহুনি কি কিছু বলতে চাইছে?
চলবে—
©Farhana_Yesmin