দমকা হাওয়া পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
1135

#দমকা_হাওয়া
#ঝিনুক_চৌধুরী
#পর্ব-১৩ (শেষ পর্ব)

স্বচ্ছকে এতো ভোরে দেখে সবাই অবাক। অস্থির অবস্থায় স্বচ্ছ যখন বলে পিউর রুম কোনটা তখন সবাই পিউর রুমের দিকে ছুটে।
পিউ নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে বিছানায় । তপ্ত গরম শরীর। পিউকে বুকে টেনে নেয় স্বচ্ছ। কি করবে বুঝে পায় না। সবকিছু ঝাপসা মনে হয়।
-পিউকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে, আঙ্কেল।
রুবিনা ফুপি পিউর কপালে হাত রেখে বলেন, অস্থির হয়ো না বাবা। প্রথমে পিউর জ্বর নামানোর ব্যবস্থা করি তারপর দেখা যাক।
বিছানা, ফ্লোরে বমি ছড়িয়ে আছে। পিউর জামাও বমিতে মাখামাখি। দিলু ফুপিকে রুমটা পরিস্কার করার অনুরোধ করে রুবিনা ফুপি জ্বর কমানোর ব্যবস্থা করতে ছুটেন।
স্বচ্ছ নিজেও হাত চালায় দিলু ফুপির সাথে। পিউর জামা বদলের সময় আহমেদ সাহেব রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। পুরো সময়টায় দম আটকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিলেন। বরাবরের মতো বাবা হিসাবে অথর্ব ই রয়ে গেলেন তিনি।
মেয়েটা একা একা রুমের মাঝে অচেতন হয়ে পড়ে ছিল অথচ কেউ টেরও পেল না। মনে মনে আক্ষেপ করলেন, দক্ষ ব্যবসায়ী হলেই যত্নশীল বাবা হওয়া যায় না। এই গুণ আহমেদ সাহেবের নেই।

পিউর ঘুম ভাঙতে বেশ সময় নেয়। ততোক্ষণে জ্বর নামিয়ে সবাই যার যার রুমে। বলা যায় স্বামী স্ত্রীকে একান্তে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে।
ক্লান্ত শরীরে চোখ খুলে নিজেকে স্বচ্ছর বুকে আবিষ্কার করে পিউ। হালকা নড়ে উঠতেই স্বচ্ছ চোখ খুলে তাকায়।
— এখন কেমন লাগছে শরীর?
— বুঝছিনা। খুব একটা ভালো না।
— কিছু খাবে?
— তুমি কেন এসেছো?
— আমার পিউ অচেতন হয়ে পড়ে রইবে আর আমি আসবো না।
পিউ চোখ নামিয়ে নেয়। নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে যেন কিছু লুকাতে চাইছে।
স্বচ্ছ জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে?
– কিছু না।
– কিছু বলবে?
– তুমি আমাকে ভালোবাসো না কেন?
প্রশ্নটায় এতো অভিমান মেশানো স্বচ্ছর চোখ ভিজে আসে। পিউকে গভীরভাবে জড়িয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে, কেন তোমার এমন মনে হলো সোনা?
-আমি অসুস্থ বলে এসেছো। নইলে কি আর আসতে?
– আমি বুঝিনি পিউ, আমি সত্যিই বুঝিনি। আমাকে এবারের মতো ক্ষমা করো। তোমাকে আমার কাছ থেকে কোথাও আর যেতে দেবো না। এভাবেই জড়িয়ে রাখবো সারাজীবন ।
স্বচ্ছর বুকে বন্দি পাখির মতো চুপ করে থাকে পিউ। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে। গত দুইদিনে অভিমানের পাহাড় এতো ফুলে উঠেছে সেখানে স্বচ্ছর অনুশোচনা স্পর্শ করতে ব্যর্থ।

বিকালে মিজান সাহেব কল দিয়ে জানতে পারে পিউর জ্বর এসেছে। স্বচ্ছ এখন পিউদের বাসায়।
– তুই সামলাতে পারছিস তো বাপ?
– পারছি আব্বু।
– আমরা আজই তাহলে রওনা দেই।
– তোমাদের কাজ শেষ হয়েছে?
– না, আগামীকাল কিংবা পরশু গড়াতে পারে।
– তোমরা কাজ শেষ করে আসো। আমি সামলে নেবো। তাছাড়া পিউর পুরো পরিবার আছে। সমস্যা হবে না।
– এটা ঠিক হবে না বাপ। পিউ অসুস্থ আর আমরা পরে আসবো? তোর আম্মু শুনলে প্রচন্ড রাগ করবে।
জেসমিন আরা এলে পিউ পুরোপুরি তার তত্বাবধানে চলে যাবে। স্বচ্ছকে কেবল চিন্তিত স্বামী হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এটা ভেবে স্বচ্ছ বলল, আম্মুকে এখন কিছু বলার দরকার নেই। সাধারন জ্বর-ই তো আমরা সবাই মিলে সামলে নিবো। তুমি চিন্তা করো না আব্বু।
মিজান সাহেব দ্বিধায় পড়ে গেলেন। স্বচ্ছ হয়তো চাচ্ছে না জেসমিন আরা এসে পিউর দায়িত্ব নিক। স্বচ্ছর চাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। পিউর প্রতি জেসমিন আরার মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা চোখে পড়ার মতো। জ্বর হয়েছে শুনলে সে উড়ে চলে আসবেই। স্বচ্ছর ইচ্ছাটাকেই প্রাধান্য দিলেন তিনি। আবার ভাবলেন, অসুস্থতা গোপন করা কি ঠিক হবে?
সিদ্ধান্ত নিলেন, আজ অন্তত জানাবেন না জেসমিনকে। আগামীকাল দেখা যাবে।

থেমে থেমে বার বার জ্বর আসে পিউর। ঔষধ দিলে কিছুক্ষণের জন্য নামে কিন্তু পরক্ষণেই তা তীব্র হয়ে ওঠে। সাথে গা ব্যাথা যুক্ত হয়েছে। বেশিরভাগ সময় পিউ ঘুমিয়েই থাকে, জেগে থাকা সময়টুকু স্বচ্ছর প্রতি অভিমানী চোখে তাকায়। কতভাবে স্বচ্ছ বোঝায়, লাভ হয় না। নিজেকে অসহায় লাগে। পিউর হাত ধরে বলে, ভুল হয়েছে আমার। বিয়ে করার আগে একবছর প্রেম করা উচিত ছিল। তাহলে বুঝতে আমার ভালোবাসা কতটা গভীর ছিল।
–লাভ হতো না। সুযোগ কি পাও নি? চেষ্টাই তো করোনি।
– তুমি আমাকে ভালোবাসো তা তো আগে বুঝি নি।
– আমি ভালো না বাসলে বুঝি আমাকে ভালোবাসতে নেই?
– পিউ তুমি এতো জটিল করে কেন ভাবছো ?
– কারণ আমাকে পাওয়ার জন্য তুমি কোনো চেষ্টাই করো নি।
– জ্বরে তোমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। অযথা ঝগড়া করছো।
– তুমি বাসায় চলে যাও। তোমাকে আমার লাগবে না। পিউ মুখ ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে।
স্বচ্ছ নিজের দিকে পিউর মুখ ঘুরিয়ে বলে, অনেক হয়েছে। আমার বউকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। বউ ভাল থাকবে ভেবে ছাড় দিয়ে ভুল করেছি। উল্টো আমাকেই দোষী বানানো হচ্ছে। এমন বউকে আগে কতটা ভালোবাসি বোঝাবো তারপর কোলে তুলে বাসায় নিয়ে যাবে।
পিউ হেসে ওঠে। দূর্বল শরীরে কেঁপে কেঁপে হাসে।
– তোমার ভালেবাসা প্রদর্শন খুবই হাস্যকর!
-পিউ, যে ছেলে মায়ের কথা ছাড়া চলে না সে শুধু একটি কল পেয়ে মায়ের অবাধ্য হয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে নিয়েছে তাও তোমার প্রমাণ চাই?
পিউ পলকহীন চেয়ে থাকে স্বচ্ছর দিকে।
-কি, বলো এরপরও প্রমাণ চাই তোমার?
– আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি স্বচ্ছ।
স্বচ্ছর চোখ আবার ঝাপসা হয়ে ওঠে।
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বাক্য ভালোবাসা। একজন সর্বস্বহারা মানুষও এ বাক্যটি শুনলে প্রাণে শক্তি খুঁজে পায়। সত্যিই স্বচ্ছ পিউকে পিউর মতো ভালোবাসতে পারে নি। নইলে এই বাক্যটি পিউ বলার আগে স্বচ্ছর বলা উচিত ছিল। কতটা মায়া জড়ানো বাক্য!
ঝাপসা চোখেই পিউর অভিমানী তপ্ত ঠোঁটজোড়া নিজের করে নেয়। বিড়বিড় করে বলে, আমি সে ভালোবাসার পূর্ণ মর্যাদা দেব সোনা!
-আমাকে আরেকটু আদর করো না!
স্বচ্ছ মৃদু হাসে। তোমার শরীর খারাপ পিউ।
-সেটা আমি বুঝবো।
স্বচ্ছ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
পিউ অভিমানী চোখে বলে, আমি আদর চেয়েছিলাম। পালিয়ে যেতে বলি নি।
স্বচ্ছ হেসে পিউর নাক টেনে বলে, সবকিছু এতো কম বোঝো কেন তুমি? দরজা লক করতে যাচ্ছি।
____________
পিউর জ্বর নামার নাম নিচ্ছে না। আহমেদ সাহেবের ফ্যামেলী ডাক্তার বিভিন্ন টেস্ট লিখে দিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে ডেঙ্গু। পরিবারের সবার মুখ থমথমে হয়ে আছে। স্বচ্ছ অনুভব করে জেসমিন আরাকে বড্ড প্রয়োজন তার পাশে। পিউর পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে চাইলেও নিজের পায়ের নীচের মাটি যেন সরে যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই পরীক্ষার টেনশনে বা অন্যান্য সমস্যায় পড়লে জেসমিন আরা স্বচ্ছর বুকে হাত রেখে বলত, তোর সব সমস্যা আমি মুঠো ভরে আমার বুকে নিয়ে এলাম। দেখ তো বুকটা হালকা লাগছে কি না?
মায়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাসী স্বচ্ছর সত্যি সত্যি মনে হতো বুকটা হালকা হয়ে গেছে।
আজ সত্যিকারে বুকটা বড্ড ভারী লাগছে।

পরদিন রিপোর্ট এলো, ডেঙ্গু।
সবাই ভয় পেয়ে গেলেও ডাক্তার মিথ্যা সাহস দিতে পারলো না। কারণ পিউর প্লেটলেট কমে আসছে। রক্তচাপও বেশ কম। অনেক বেশি দূর্বল পিউ।
ডাক্তারের পরামর্শে সহসা হসপিটালে এডমিট করা হলো। স্যালাইন দেয়া হলো।

পিউ চোখ খুলে দেখল অন্ধকার মুখে স্বচ্ছ সামনে বসে আছে। কি এমন অসুখ যে স্বচ্ছর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে!
স্বচ্ছর হাত ধরে পিউ বলল, আমি কি মারা যাচ্ছি?
স্বচ্ছ বিরক্ত প্রকাশ করে বলল, কি সব ফালতু প্রশ্ন করো!
— তাহলে তুমি এমন দুঃখী চেহারা করে বসে আছো কেন? তোমার প্রতি আমার অভিমান খুব হালকা। ওতো সিরিয়াস কিছু না।
কণ্ঠে জোর এনে স্বচ্ছ বলল, শরীরে শক্তি বাড়াও পিউ। তুমি অনেক বেশি দূর্বল। এমন দূর্বল হলে বাসায় নেব কি করে?
— হুম। মা শুনলে অনেক বকবে। কিন্তু আমি তো আর ঐ বাসায় যাবো না।
-কি বলছো, কেন যাবে না?
-ওখানে আমার কে আছে?
স্বচ্ছ বুঝতে পারলো মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। অভিমানী মেয়ে সবার উপর অভিমান করে আছে। এতো বড় ভুল করলো কি করে স্বচ্ছ! পিউ যতবার চোখ খুলেছে মাথা ঘুরিয়ে কাউকে খুঁজেছে। কেন বুঝলো না পিউ মাকে খুঁজচ্ছে? স্বার্থপরের মতো নিজের কথাটাই আগে ভাবলো স্বচ্ছ!
পিউর সঙ্গে থাকার চেয়ে পিউকে সুস্থ করে তোলাটা বেশি জরুরি ছিল। জেসমিন আরা এলে হয়তো পিউ অর্ধেকই সুস্থ হয়ে যেত, মনের জোর বাড়ত।
এতোবড় ভুল করলো স্বচ্ছ! নিজেকে পিউয়ের জন্য যথেষ্ট মনে করলেও এখন মনে হচ্ছে সবার আগে স্বচ্ছরই মায়ের আশ্রয় দরকার।
বাইরে বের হয়ে জেসমিন আরাকে কল করে।
– হ্যাঁ রে স্বচ্ছ, গতকাল এতো ব্যস্ত ছিলাম যে তোদের কল দিতে পারি নি। মিজান বলল তুই পিউর বাসাতে আছিস। ভালোই হয়েছে। আমারই ভুল হয়েছে। তোকেও তোর শ্বশুরবাড়ি পাঠানো উচিত ছিল। তোর শশুরটাই বা কেমন? জামাইকে কি ডেকে নিতে পারতো না? এবার এলে উনার আমি ক্লাশ নিবো? বেয়াই হয়েছে তো কি হয়েছে?
জেসমিন আরা হেসে বলেন, খুব জামাই আদর হচ্ছে বুঝি?
স্বচ্ছ ঠোঁট কামড়ে চুপ করে থাকে।
-পিউটা আজ সকাল থেকে ফোন ধরছে না কেন, বল তো? মেয়েটা কি আমার উপর অভিমান করে আছে? তিনদিনের কথা বলে পাঁচদিন হয়ে গেল এখানে পড়ে আছি। দুইদিন ফোনও দিতে পারিনি। দে তো পিউকে।
স্বচ্ছ কেঁদে ওঠে, আম্মু!
-কি হয়েছে বাপ?
-আম্মু, আমার বুক খুব ভারী লাগছে। তুমি এসে হালকা করে দাও না।
স্বচ্ছর কণ্ঠ শুনে ঘাবড়ে যান জেসমিন আরা।
-কি হয়েছে স্বচ্ছ? তুই ঠিক আছিস? পিউ কোথায়?
– পিউর খুব জ্বর। ওর ডেঙ্গু হয়েছে। তুমি চলে আসো আম্মু। আমার খুব ভয় হচ্ছে। পিউ অনেক দূর্বল।
– কবে থেকে জ্বর?
-তিনদিন ধরে।
– জানাস নি কেন?
স্বচ্ছ চুপ থেকে থেমে থেমে বলল, আম্মু,…. আমি… পিউকে অনেক ভালোবাসি আম্মু। অনেকদিন ধরে ভালোবাসি। কাউকে বলি নি সে কথা। তোমাকেও বলিনি কখনো। আমি পিউকে ছাড়া বাঁচবো না। তুমি জলদি আসো আম্মু। আমার বুক খুব ভারী লাগছে। তুমি পিউকে বাঁচাও প্লিজ, আমার পিউকে বাঁচাও আম্মু।
জেসমিন আরা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন দেখে মিজান সাহেব বলেন, কে কল করেছে।
জেসমিন আরা বিড়বিড় করে বলেন, পিউ ভালো নেই।
মিজান সাহেব জিজ্ঞেস করেন, জ্বর আরো বেড়েছে ?
জেসমিন আরা অবিশ্বাসী চোখে তাকান। তুমি জানতে?
মিজান সাহেব চমকে যান। আমতা আমতা করে বলেন, সামান্য জ্বর ছিল, স্বচ্ছ বলল সামলে নিবে, তাই তোমাকে আর জানাই নি।
জেসমিন আরা চিৎকার করে মিজান সাহেবের বুকে জোরে ধাক্কা দেন। মিজান সাহেব দুপা পিছিয়ে নিজেকে সামলান।
– শান্ত হও জেসমিন, কি হয়েছে?
-আমার মেয়ে অসুস্থ, আর তুমি আমাকে এই সম্পত্তির জন্য, নিজের স্বার্থের জন্য কিচ্ছু জানাও নি?
-এমন কিছুই নয়। পিউ আমারও মেয়ে। স্বচ্ছ বলেছিল ও সামলে নিবে ..
–কি করে পারলে মিজান? নাতাশা হলে আজ তুমি এভাবে এখানে পড়ে থাকতে? আমি একটা মেয়ে হারিয়েছি, তুমি কিভাবে… তুমি এতো নিষ্ঠুর কি করে হলে মিজান?
জেসমিন আরা অস্থির চোখে ফুঁসতে ফুঁসতে বলেন, জলদি গাড়ি ঠিক করো। আমরা এখনই এই মুহূর্তে বের হবো।
-ঠিক আছে আমরা এখনই রওনা দিবো। কিন্তু কি বলেছে স্বচ্ছ? পিউ কেমন আছে?
-তোমার ছেলে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে। বলছে পিউকে ছাড়া বাঁচবে না। পিউর ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। আর আমি… আমি কিছু জানিই না। মেয়েটা আমার অপেক্ষা করছে নিশ্চয়ই। আমি কেমন মা…. কথা শেষ করতে পারে না জেসমিন আরা। দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

গাড়ি যখন হসপিটালে পৌছায় তখন রাত চারটা চল্লিশ বাজে।
করিডোরে আহমেদ সাহেব বসে আছেন। জেসমিন আরাকে দেখে ছুটে আসেন। আপা, আমার মেয়েটার ডেঙ্গু হয়েছে বলেই কেঁদে ওঠেন। পিউকে আইসিইউতে নিয়ে গেছে। আমি কি করবো আপা? আমার কি করা উচিত বলতে পারেন। আমি….
কথা শেষ করতে পারে না আহমেদ সাহেব। অসহায় চোখে একবার মিজান সাহেবের দিকে আবার জেসমিন আরার দিকে তাকান। আপা, আমার মেয়েটা বাঁচবে তো!
মিজান সাহেব আহমেদ সাহেবের কাঁধে হাত রাখলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
জেসমিন আরা সামনে এগুতে থাকেন। কারো কথা শোনার আজ সময় না। আজ তিনি রণাঙ্গনে নামবেন। উপরওয়ালার সাথে যুদ্ধ হবে। প্রয়োজনে নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও লড়ে যাবেন। বার বার নিজের কোল খালি হতে দিবেন না।
দরজা খুলতেই স্বচ্ছ সামনে এসে দাঁড়ায়। বিধ্বস্ত, বুকের পাজর ভাঙ্গা, হেরে যাওয়া মানুষ।
জেসমিন আরা শরীরের সর্বচ্চ শক্তি দিয়ে সপাটে চড় বসিয়ে দেন স্বচ্ছর গালে।
স্বচ্ছ এক মুহূর্ত দেরী না করে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।
-সর স্বচ্ছ, আমি কাঁদতে আসি নি। তোর কাঁদার ইচ্ছে থাকলে বাপের গলা ধরে কাঁদ।
আমি আমার মেয়েকে নিতে এসেছি। আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে আমার সাথে ফিরে যাবে। কোনো এক অশুভ দমকা হাওয়া এসে আমার পিউকে কেড়ে নিতে পারে না। আমার বিশ্বাস কেউ টলাতে পারবে না। সয়ং উপরওয়ালাও না।
মিজান সাহেব বলেন, আমাদের মেয়ে ফিরে আসবেই জেসমিন। আমাদের এতোগুলো মানুষের দোয়া বৃথা যাবে না।

নিস্তেজ পিউর হাত ধরে জেসমিন আরা শক্ত হয়ে বসে থাকেন। চোখের একফোঁটা জলও তিনি গড়াতে দেবেন না। আজ নাতাশা বেঁচে নেই, কিন্তু পিউ বেঁচে উঠবেই। উপরওয়ালা এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে না। একটা মায়ের বুক বার বার খালি করতে পারেন না। পিউকে সুস্থ হতেই হবে।
মায়ের ভালোবাসার জোর আজ জিতবেই, জিততে হবেই।

সমাপ্তি।।

গল্পে চাইলেই নাটকীয় মোড় দিয়ে হ্যাপি এন্ডিং দেয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে কি পারা যায়?
আমি এক রাজকন্যাকে চিনতাম। পুতুলের মতো সুন্দর সে রাজকন্যা। বাবার আদরের, মায়ের স্বপ্ন। অষ্টম শ্রেণিতে ভিকারুননিসা স্কুলে চান্স পেয়ে রঙীন স্বপ্ন নিয়ে সপরিবারে ঢাকায় এসেছিল । ছয়মাস যেতে না যেতেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় পুরো পরিবার। একে একে সবাই সুস্থ হয়ে উঠলেও আইসিইউতে থাকা ঘুমন্ত রাজকন্যাটি আর জেগে ওঠে নি।
বন্ধুদের সাথে অনেকটা না বুঝেই দেখা করতে গিয়েছিলাম পরিবারটির সাথে। রাজকন্যার মায়ের সাথে কুশল বিনিময়ে কেঁদে ওঠেন তিনি। দূর্বল শরীরে বলেন, আমার মেয়েটা বাঁচবে না। ওর জন্য দোয়া করেন আপনারা। আমার মেয়েটা মরে যাচ্ছে। প্লিজ দোয়া করেন।
সন্তান হারানোর ভয় কোনো বাবা- মা ই সহ্য করতে পারে না। আমিও পারি নি। সেখান থেকে পালিয়ে আসি। কিন্তু নিরুপায় মায়ের আকুতি, আর্তনাদ মাথা থেকে নামাতে পারিনি বহু দিন। বার বার মনে হয়েছে কেন মেয়েটা ফিরে এলো না! কি এমন ক্ষতি হতো যদি রাজকন্যাটি পরিবারের সাথে ফিরে যেত।
সেই রাজকন্যাকে কল্পনা করেই সবার প্রিয় চরিত্র পিউকে সাজিয়েছিলাম। গল্পে চাইলেই ইচ্ছে মতো জীবনটাকে সাজিয়ে তোলা যায়। যাকে বলে হ্যাপিং এন্ডিং। কিন্তু বাস্তবতা খুব নিষ্ঠুর। আমরা সেখানে নিরুপায়।

ভালো থাকবেন সবাই। জানি অনেক পাঠকের মন ভেঙে দিয়েছি। চেষ্টা করেছিলাম আনন্দঘন হ্যাপি এন্ডিং দিতে। অনেকটুকু লিখেছিলাম কিন্তু মনঃপূত হয়নি বলে বাদ দিয়েছি। সময় নিয়ে নতুন করে যদি আবার সাজিয়ে আপনাদের সামনে আনি তবে তাতে হ্যাপি এন্ডিং হবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে