#দমকা_হাওয়া
#ঝিনুক_চৌধুরী
#পর্ব-১২
স্বচ্ছ ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। পিউ কল দিল কি? খুশি মনে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে পিউ নয়, একটা ছেলের প্রোফাইল থেকে কল বাজছে। নাম নয়ন শিকদার।
ঘড়িতে তখন রাত দেড়টা ।
আমেরিকায় এখন দিন কিন্তু এখানে তো মাঝরাত। এমন অসময়ে কল দেয়া কেমন ভদ্রতা? হতে পারে নয়ন পিউর বন্ধু কিন্তু স্বচ্ছর বন্ধু তো নয়। একজন অপরিচিত মানুষকে কেউ এতো রাতে কল দেয়?
বিরক্তি নিয়ে কল ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নয়ন বলে, কি রে ভাই, এমন অনুভূতিহীন নির্বিকার, নিষ্ঠুর মানুষ আমি জন্মেও দেখি নাই। তুমি কি মানুষ নাকি এলিয়েন ?
অপমানে মুখ লাল হয়ে ওঠে স্বচ্ছর।
-দেখুন আপনি পিউর বন্ধু বলে যা তা কথা বলতে পারেন না। আপনি….
-আরে রাখো তুমি। তোমাদের কারণে আমি আজ দেশ ছাড়া আর তুমি আমাকে ভদ্রতা শেখাচ্ছো। তোমার বউ আমার নামে কি না কি বলে বেড়াচ্ছে আর তুমি মিয়া….
আমার ইচ্ছে কি করছে জানো? ইচ্ছে করছে দেশে এসে তোমাদের দুইটারে দাঁড় করায়ে চুম্মা দেই।
স্বচ্ছ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে, কি দিবেন?
-চুম্মা দিবো চুম্মা, জানেমান!
স্বচ্ছর পেট গুলিয়ে আসে।
-আপনি ফোন রাখুন, প্লিজ! আপনার সাথে কথা বলার কোন রুচি নেই আমার।
-কেন, কেন? আমি তোমার জন্য এতো বড় সেক্রিফাইস করেছি আর তোমার কোনো রুচি নেই? ইউ সেলফিশ!
-আপনি আমাকে গালি দিচ্ছেন কেন?
-আরে চুম্মা দিলেও খ্যাপো, গালি দিলেও চ্যাতো কি সমস্যা তোমার ব্রো?
-আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?
-আমি বোঝাতে চাইছি দুটো কথা। প্রথমত, আমি পিউর জানের বন্ধু। তাই তুমি আমাকে আপনি আপনি বলা বন্ধ করো। দ্বিতীয়ত এবং মোস্ট ইম্পর্টেন্ট পিউ তোমাকে ভালোবেসে একাকী অবহেলায় মরে যাচ্ছে আর তুমি মিয়া আয়েশ করছো!
-মরে যাবে কেন পিউ? কি বলেন এসব?
-তুমি আসলেই একটা তিমি মাছ। তুমি কি জানো সে তোমার উপর পাহাড় সমান অভিমান করে আছে?
-না।
-তুমি কি এটা জানো পিউ তোমার জন্য কত বড় রিস্ক নিয়েছিল?
-না। কিসের রিস্ক?
-তুমি নিশ্চয়ই এ-ও জানো না তোমার জন্য আমাকে কি বিশাল ফাঁসানো ফাঁসিয়েছে তোমার পিউ?
-না আমি এসব কিছুই জানি না।
-এরজন্যই তো তুমি একটা তিমি মাছ।
স্বচ্ছ এবার স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করে বলে, তুমি কি বোঝাতে চাইছ একটু খুলে বলবে?
– আরে বলতেই তো কল দিয়েছি। মন দিয়ে শোনো। তুমি পিউকে ভালোবাসতে কিন্তু মুখে বলো নি কখনো। পিউও তোমাকে ভালোবাসতো কিন্তু তুমি কিছু বলো না বলে সেও এগোয় নি।
ওদিকে আমি ভিন্ন দেশ, ভিন্ন কালচারের মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছি যা আমার পরিবার কোনোদিন মেনে নেবে না। সবাই আমরা প্রেমে মরা। বুঝলে? এসবের সমাধান বের করলো কে বলো?
-কে?
-তোমার বুদ্ধিমতী বউ পিউ।
স্বচ্ছ চুপ হয়ে থাকে। নয়নের কথা বিশ্বাস করার কোনো মানেই হয় না।
নয়ন বলে চলেছে, পিউর বুদ্ধিতে দেশে এসে আমি ওর সাথে পনেরো দিন প্রেম প্রেম অভিনয় করলাম মানে পিউকে না দেখে থাকতে পারি না এমন। তাতেই দুই পরিবার মহা আনন্দে আমাদের বিয়ে ঠিক করলো। ঠিক বিয়ের দিন সেরোয়ানী পরে আমি পালিয়ে গেলাম কার বুদ্ধিতে বলো?
স্বচ্ছ দ্বিধা যুক্ত কণ্ঠে বলল, পিউর….?
-শতভাগ!! ঠিক বিয়ের আগ মুহুর্তে আমাকে পালাতে হলো। এক ঘণ্টা আগেও না একঘণ্টা পরেও না। বাস! দুই পরিবার হৈ হৈ শুরু করলো তাদের আদুরে পিউর দুরবস্থা দেখে। আমি হলাম ভিলেন আর সিনেমার শেষ ভাগে তুমি উড়ে এসে হয়ে গেয়ে সুপারহিরো। কিছু বুঝলে?
-পিউ এসব কেন করবে?
-ওরে বেকুব! তোমার জন্যে।
নয়ন নামক আধ-পাগলা ছেলেটা কথায় কথায় স্বচ্ছকে অপমান করছে কিন্তু স্বচ্ছর এখন আর মন্দ লাগছে না। ওর মুখ ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
-আমার জন্য পিউ এসব… কিন্তু আমাকে একবার ভালোবাসি বললেই তো হতো। এতো ড্রামার দরকার ছিল না।
ও… তাই বুঝি? যার জন্য করল চুরি সেই বলে চোর।
স্বচ্ছ চুপ হয়ে গেলো। তবে খুশিতে বাকবাকুম করে ডানা ঝাপটাচ্ছে মন।
নয়ন বলল, আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দাও তো। তুমি পিউকে ভালোবাসলেও কেন ওকে বলো নি? সত্যি করে বলো।
স্বচ্ছ কিছু সময় চুপ থেকে ধীরে ধীরে বলল, আসলে সাহস পাচ্ছিলাম না…. আর কিছু কারণও ছিল।
-প্রথম কারণটি হলো পিউর বাবার আর্থিক অবস্থান, ঠিক কিনা ব্রো?
-হ্যাঁ, ওর পরিবার আমার মতো সাধারণ ছেলেকে মেনে নিত না কখনো। আমার কারণে আমার পরিবারকেও হয়তো অনেক ছোট করা হত। পিউ বিত্তশালী পরিবারে মেয়ে জানতাম কিন্তু ওকে ওর বাসায় নামিয়ে দিতে এসে বুঝে গিয়েছিলাম রাজপ্রাসাদের রাজকন্যা কখনোই আমার হবার নয়। আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছি। তাছাড়া পিউর মাঝেও কখনো আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায় নি। শ্বাস ছেড়ে স্বচ্ছ বলে, তাই পিউকে কেবল গোপনেই ভালোবেসেছি আমি, নিজের করে পাবার অভিলাষী হই নি।
-বাহ্ কী সেনসেটিভ তোমার চিন্তাভাবনা! একেবারে নিট এণ্ড ক্লিন! শোনো ব্রো…. তোমার মতো পিউও জানতো ওর আব্বু তোমাকে মেনে নিলেও সেটা খুশি মনে হবে না। তুমি বা তোমার পরিবার কোনো কারণে ছোট হোক তা পিউ চায় নি। তাই সে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিল। বিয়েটা হুট করে ভেঙ্গে যাওয়া ছিল প্রি-প্ল্যান। সেই দুঃসময়ে তোমার প্রত্যাবর্তন হওয়া ছিল ভালোবাসার পরীক্ষা। পিউর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তুমি আসবেই। হলোও তাই।
প্ল্যান অনুযায়ী তোমার উপস্থিতি খুব জোরালো ভাবে পজিটিভ ইমপ্যাক্ট ফেললো পুরো পরিবারে। এমন কি আমার পরিবারেও। তোমার সুনামের পাশাপাশি আমি ঘণ্টায় ঘণ্টায় গালি খেতে শুরু করলাম যা অব্যাহত রইল। আমি পালিয়ে গেছি বলে গালি খেলে ঠিক ছিল কিন্তু আমি ভয়াবহ অবাক হয়েছি শুনে, আমি নাকি এক ছেলেকে ভালোবাসে পালিয়েছি । এও কী সম্ভব!!
-তুমি বলতে চাচ্ছো এতো সুক্ষ্ম কুট চাল সব পিউর মাথা থেকে এসেছে ?
-শতভাগ। আমি বিয়ে থেকে পালানো পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। আমি গালি খাবো তাও জানতাম। কিন্তু আমাকে নিয়ে ওর পরবর্তী প্ল্যান সম্পর্কে একেবারেই জানতাম না আমি। জানলে কোনোভাবেই রাজি হতাম না। এমন অপমানকর মিথ্যা অপবাদ কে নিতে চায় বলো?
-এটা পিউ বাড়াবাড়ি করেছে। এমনটা না করলেও পারতো।
-নো নো ব্রো, ভাল কাজ হয়েছে। ছেলেকে ভালোবাসি শুনে আমার পরিবার যেখানে মরাকান্না কাঁদছিল, সোসাইটিতে কিভাবে মুখ দেখাবে ভাবছিল সেখানে মিষ্টি চেহারার সুইডিশ মেয়ের সাথে আমার ছবি দেখে তারা আনন্দে আত্মহারা। ব্যাপারটা খুবই সিনেমাটিক কিন্তু কি সুন্দর হ্যাপি এন্ডিং হলো! পিউ বিশাল রিস্ক নিয়ে খুবই সিনেমাটিক চাল চেলেছে কিন্তু ভাগ্যগুণে কাহিনী জমে ক্ষীর হয়ে গেছে অবিশ্বাস্য ভাবে।
স্বচ্ছ কোনো কথা বলছে না। একসাথে এতোগুলো ঘটনার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। মনে হচ্ছে মাঠে বসে উত্তেজনাপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচ দেখছে। যেখানে নয়ন একের পর এক ছয় মেরে যাচ্ছে।
-কি ব্রো, কথা বলছো না কেন? মুভি খতম পয়সা হজম, কি বুঝলে?
স্বচ্ছ হেসে ফেলে।
-মিস্টার স্বচ্ছ , তোমার গল্প কিন্তু শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। তুমি এমন কেন বলো তো?
-আমি কি করলাম?
-মেয়েটা তোমাকে ভালোবাসে। তোমাকে পাওয়ার জন্য এতো কিছু করলো। অথচ তুমি ওর চলে যাওয়ার দিন জোর গলায় একবার বলতে পারলে না পিউ যেও না।
কেমন ভালোবাসা তোমার?
স্বচ্ছর মন খারাপ হয়ে যায়। আহত মনে বলে, আমি আসলে ভেবেছিলাম পিউ তার পরিবারকে মিস করছে। ওখানে হয়তো ভালো আছে।
-ভেবেছিলাম, কিন্তু, যদি, হয়তো এসব দিয়ে প্রেম ভালোবাসা হয় না ব্রো! শেষ উপকারটুকু করে যাচ্ছি শুনো, পিউকে সবাই ভালোবাসে। সে যা চায়, যেমন চায় তাই সবাই করে। পিউর ধারণা সবাই তাকে করুনা করে। সত্যিকারের ভালোবাসে খুব কম মানুষ। তাদের মধ্যে আছে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড নয়ন মানে আমি আর হলে তুমি।
আমাদের ভালোবাসাকে কেন ওর কাছে সত্যিকারের ভালোবাসা মনে হয় জানো? কারণ আমরা ওর উপর জোর খাটাই, দরকারে ধমক লাগাই, আগলে যেমন রাখি তেমন শাসনও করি।
পিউকে তার মনের মতো স্বাধীনতা দেয়া হয় বলে সে খুব দুঃখ পায় করুনা হচ্ছে ভেবে। ও চায় ওর উপর কেউ অধিকার ফলাক। ভালোবাসার অধিকার। জোর করে বেঁধে রাখার অধিকার।
একটু ভালোবাসার জোর দেখাও ব্রো, মেয়েটা তোমার কাছে শ্বেত শুভ্র তুলতুলে মেঘের ভালোবাসা চায় না। চায় তোমার তপ্ত উষ্ণ ভালোবাসা।
নয়নের সাথে কথা শেষে স্বচ্ছর মন খুশিতে নেচে ওঠে। পিউ ওকে এত্তো ভালোবাসে! ওর জন্য এতো কিছু করেছে?
রাত তখন তিনটা বিশ। তাও স্বচ্ছ কল করে পিউকে।
পিউ মোবাইল হাতড়ে কানে ধরে।
-আমি ভিডিও কল দিয়েছি পিউ। তোমাকে দেখতে চাই।
পিউ মোবাইল স্ট্যাণ্ডে রেখে শুয়ে পড়ে।
-পিউ, এই পিউ, শুনছো!
-পিউ উত্তর করে না। ঘুমের রাজ্যে ডুবে আছে।
স্বচ্ছ হাসে। জানে পিউ কিছুই শুনছে না তবু বলে, তোমাকে ভালোবাসি পিউ। আমার কত রাত তোমার কল্পনায় কেটেছে জানো?
তোমার বন্ধু নয়নকে আজ সত্যিই জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। এই! ওঠো না পিউ! কথা বলতে ইচ্ছে করছে খুব।
তোমার ঠোঁটে আদর দিতে ইচ্ছে করছে। শোনো না, আজ না হয় নাই ঘুমালে।
পিউর কোনো নড়চড় নেই।
স্বচ্ছ বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুমন্ত পিউকে দেখতে থাকে। ভোর হলেই পিউর কাছে ছুটে যাবে। কোনো কথা বলবে না, চুপচাপ কোলে তুলে বাসায় নিয়ে আসবে। পিউ যেমন ভালোবাসা চায় তেমনি ভালোবাসবে। সারাক্ষণ সামনে বসিয়ে রাখবে। বুকের ঠিক মাঝখানে পুষে রাখবে। মন যখন চাইবে চুলের গন্ধ নিবে, গালে গাল ঘষবে ঠোঁটে গভীর চুমু খাবে। ভালোবেসে পাগল করে দিবে মেয়েটাকে।
পিউ হঠাৎ করেই ঘুম থেকে উঠে বসে। স্বচ্ছ চমকে তাকায়।
পিউকে স্বাভাবিক লাগছে না।
স্বচ্ছ ডাকে, পিউ কি হয়েছে?
পিউ বোধহয় শুনতে পায় নি। আচমকা গলগল করে বমি করে দেয় বিছানার উপর।
স্বচ্ছ হকচকিয়ে যায়। পিউ, তুমি ঠিক আছো? পিউ!
পিউ মাথায় হাত রাখে, বুকে একহাত রেখে জোরে শ্বাস টানে। বমির পাশেই গা এলিয়ে পড়ে যায় ।
স্বচ্ছ অস্থির হয়ে কয়েকবার ডাকে। চেঁচায়। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকে পিউদের বাসার উদ্দেশ্যে।
চলবে।।