#দমকা_হাওয়া
#ঝিনুক_চৌধুরী
#পর্ব-৯
রাত আটটায় হুট করে পিউর আব্বু, রুবিনা ফুপি ও দিলু ফুপিকে সঙ্গে নিয়ে স্বচ্ছদের বাসায় উপস্থিত হয়।
জেসমিন আরার মাথায় হাত। এভাবে না বলে কয়ে কেউ আসে? এখন হুট করে কি করবেন তিনি!
রুবিনা ও দিলু, জেসমিন আরাকে একা কোনো কাজ করতে দিল না। সবমিলে ঘরে একটা পিকনিক আমেজ তৈরী হলো।
পিউকে শাশুড়ীর দেয়া শাড়িতে দেখে দুই ফুপি মহা খুশি। শাশুড়ী নিজে শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে পিউকে, এই গল্প শুনে দুই ফুপির চোখ ভিজে আসে আনন্দে। যাক, তাদের আদরের রাজকন্যা ভালো পরিবারে এসেছে। স্বচ্ছ ও পিউর লাজুক দৃষ্টি বিনিময় দেখে এক রাশ প্রশান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তারা।
আহমেদ সাহেব যথারীতি বিদায় বেলা কেঁদে উঠলেন। এবার জেসমিন আরার দুহাতে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদলেন। বার বার মিনতি করলেন পিউ যেন চির জীবন এমনি আদর পায় এ পরিবারে।
মিজান সাহেব পিউর বাবার কন্যাপ্রীতি ভুলে নিজ স্ত্রীর ধরে রাখা হাতের দিকে অসহায় চোখে চেয়ে থাকলেন।
সবাই বিদায় হলে জেসমিন আরা ভাবুক হয়ে বললেন, কত ভালো পরিবার! আহমেদ সাহেবের মন অনেক বেশি নরম, তাই না?
মিজান সাহেব গলা ঝেড়ে বলেন, হুম এতোটাই নরম যে অন্যের স্ত্রীর হাত ধরে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়।
জেসমিন আরা বিস্ময় চোখে তাকালেন মিজান সাহেবের দিকে। মুখ থেকে শুধু একটি শব্দ বের হল, ছিঃ!
মিজান সাহেব ঠোঁট বাকিয়ে বলেন, ছিঃ ছাঃ বলে লাভ নেই। আমার সুন্দরী বউয়ের হাত ধরে কেউ কান্নাকাটি করুক তা আমার পছন্দ না।
-ছেলের বিয়ে হয়েছে। দুদিন পর নাতি হবে। কি বলো এসব?
— সুন্দরী বউয়ের স্বামীদের যন্ত্রণা তুমি কি বুঝবে?
—————-
রাতের কাজে মাকে সাহায্য শেষে রুমে ঢুকে স্বচ্ছ। এতো গরম পড়েছে। আকাশ একেবারে থমকে আছে। যেকোনো সময় ঝড় শুরু হবে।
পিউ ব্যালকনিতে কার সাথে যেন কথা বলছে।
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। স্বচ্ছ না চাইতেও কান খাড়া করে। অন্যপাশের কথা শোনা না গেলেও পিউর কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
–আমি ভুল করেছি, বিরাট অন্যায় করেছি। আব্বু একা হয়ে গেছে রে.. একদম ভেঙে পড়েছে।
……
না, আমি পঁচা মেয়ে…. পিউর কান্নার আওয়াজ ।
……..
না না.. তুই কী করবি? সব আমার দোষ।।
…….
আমিও নেই, তুইও আব্বুর কাছে নেই। আব্বুর চোখের দিকে আমি তাকাতে পারি না।
…….
জানি না আমি… না, বুঝি না … তোকে খুব মিস করছি।
প্লিজ আমাকে একটা উপায় বলে দে নয়ন…
স্বচ্ছ ধাক্কা খায়। নয়নের সাথে কথা বলছে পিউ?
–স্বচ্ছর কথা বলে লাভ নেই, ও কিছুই বুঝে না।
……
-কচু ভালোবাসে। ও একটা তিমি মাছ। পেট ভর্তি হিংসা। ওর বউ হয়ে গেছি অথচ আমার লিস্টে কার কার নাম ছিল তা নিয়েই ওর মাথাব্যথা ।
……
-হাসিস না।
……..
-না, বললাম তো। কেন বার বার জিজ্ঞেস করছিস? এক বারের জন্যও জড়িয়ে ধরে নি আমাকে। স্বচ্ছর মনে ভালোবাসা কম, কেবল হিংসে করতে জানে। তোকেও হিংসে করে।
………..
পিউ কেঁদে কেঁদে নয়নের সাথে আরো কিছু কথা বলে কিন্তু স্বচ্ছর কানে একটি কথাই বার বার বাজতে থাকে, ” একবারের জন্যও জড়িয়ে ধরে নি আমাকে “।
তারমানে পিউ চায় ওকে….
স্লাইড ডোর ঠেলে পিউ রুমে ঢুকে। চুল এলোমেলো, শাড়ি অগোছালো, কাজল লেপ্টে আছে, নাক, গাল লাল হয়ে আছে। কেঁদে কেঁদে কি অবস্থা করেছে মেয়েটা!
স্বচ্ছর দিকে চেয়ে ঠোঁট ভেঙে আবারো কান্না জুড়ে দেয়। আশ্চর্য, এতো কাঁদছে কেন?
বুকে জড়িয়ে কান্না থামাবে ভাবতেই পিউ নিজেই ছুটে এসে স্বচ্ছর বুকে পড়ে। হেঁচকি তুলে কাঁদতে থাকে।
–এই পিউ, এতো কাঁদছো কেন?
পিউ ভেঙে ভেঙে বলে, আমি… পঁচা মেয়ে, আমি… অন্যায় করেছি। আব্বু একা হয়ে গেছে, সব আমার দোষ। আব্বু নিজেকে অপরাধী ভাবছে, অথচ…..
–কি বলছো এসব? মেয়েদের বিয়ে হলে সব বাবা মায়েরা একটু অসহায় বোধ করে, এতে নিজেকে দোষী ভাবছো কেন তুমি?
–তুমি বুঝছো না…..
দুহাতের তালুতে পিউর মুখটি তুলে ধরে স্বচ্ছ। ভালোবাসা জড়ানো কণ্ঠে বলে, তোমার ইচ্ছে হলে কদিন আব্বুর কাছে থেকে এসো। আমি নিজে তোমাকে দিয়ে আসবো। তবু এভাবে কেঁদো না সোনা…
ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে থাকে পিউ। যেন নীড় হারা পাখি নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছে।
পিউর কপালে আলতো করে চুমু এঁকে দেয় স্বচ্ছ। সেই চুমু বিন্দু বিন্দু করে ছড়িয়ে পড়ে চোখের পাতায়, ভেজা গালে, কানে.. সবশেষে অধরযুগলে।
পিউ চুপ করে থাকায় স্বচ্ছর তৃষ্ণা যেন গতি পায়। আবার ঠোঁট ছোঁয়।
পিউ একপা সরে পিছাতে চাইলে শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরে স্বচ্ছ।
শহর জুড়ে হঠাৎ বৈশাখী তাণ্ডব শুরু হয়। সেই তান্ডব গ্রাস করে স্বচ্ছর চেতনশক্তি । জানালার গ্লাস গুলো থরথর করে নড়ছে। বাইরের গাছপালা আছড়ে পড়ছে এপাশ ওপাশ। সেদিকে তাকানোর সময় কোথায়?
ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় নবদম্পতি গভীরঅরণ্যে। মিষ্টি সুবাস, বুনো স্পর্শ, নিবিড় আলিঙ্গনে হারিয়ে যায় একে অন্যের মাঝে, একেবারে অপরিচিত এলোমেলো নতুন পথে।
___________
ভোরের মিষ্টি আলো পিউর সুখনিদ্রার ব্যাঘাত ঘটালেও দেহমনের মিষ্টি রেশ কেড়ে নিতে পারে নি। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় পিউ। মানুষটি বিছানার ওপর নতমুখে বসে আছে। ভেজা চুলের পানি ঘাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
গতরাতে ঠোঁটের গাঢ় স্পর্শ মনে হতেই শরীরে শিহরণ জেগে ওঠে। হাত বাড়িয়ে ভেজা চুলগুলো স্পর্শ করতে নিলে করুন কণ্ঠ ভেসে আসে স্বচ্ছর,আই এম সরি পিউ…
তুমি কাল বিধ্বস্ত ছিলে আমার উচিত ছিলো তোমাকে সামলে নেয়া, তোমাকে সাপোর্ট করা, সেখানে আমি….
পিউ স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকে।
–আমি কাল নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি…. আমি সত্যি খুব লজ্জিত… এমন কিছু হবে আমি আসলে…..
কান্নারা দলা পাকিয়ে গলায় এসে আটকে গেছে।তীব্রভাবে আন্দোলন করছে বেরুবার পথ খোঁজে। নিজেকে সামলে পিউ বলে, আর কখনো আমাকে ছুঁবে না। তুমি একটা ভণ্ড!
ছুটে বাথরুমে চলে যায় পিউ। কল ছেড়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এতো মিষ্টি মুহূর্ত এভাবে নষ্ট করে দিলো স্বচ্ছ!
বিভ্রান্ত চোখে চুলগুলো টেনে ধরে স্বচ্ছ । একি করলো সে! ঠিকমতো কথাই এগুলো না পিউর সাথে অথচ….
হোক সে বিয়ে করা বউ তবু সব কিছুর সঠিক সময় দরকার। পিউকে ভালোবাসে স্বচ্ছ, মন থেকে ভালোবাসে, অনেক বেশি ভালোবাসে। সেখানে শারিরীক কামনা কোনোদিন প্রাধান্য পায় নি। অথচ এমন কাণ্ড করে বসলো সে?
কতটা ভালবাসা মনের মাঝে লুকানো তা তো পিউকে বলাই হলো না। অথচ পিউর চোখে আজ সে ভন্ড প্রমাণিত হলো।
নাস্তায় বসে পিউর ভেজা নাক চোখ, স্বচ্ছর বিব্রত- বিধ্বস্ত মুখ দেখে বাবা-মা দুজনই নিরবে নাস্তা সারেন।
মিজান সাহেব অফিসের জন্য তৈরি হলে জেসমিন আরা বলেন, কি হচ্ছে এদের মাঝে? এই ঝলমলে আকাশ তো এই কালো মেঘ!
–ওদেরকে ওদের মতো ছেড়ে দাও ।
–তুমি বুঝছো না, পিউ অনেক বেশি অবুঝ একটা মেয়ে। কত হাসিখুশি ভালো মেজাজে ছিল গতকাল। স্বচ্ছটাই কোনো ভুল করেছে বোধ হয়…..
মিজান সাহেব কথা থামিয়ে বলেন, বড্ড বাড়াবাড়ি হচ্ছে তোমার। পিউ সোজা সরল হতে পারে অবুঝ নয়। আর পিউতে এতোটা হারিয়ে যেও না যে নিজের ছেলেকে তুমি দোষী ভাবতে বসে যাও।
–না, না, আমি স্বচ্ছকে দোষী ভাবছি না। ওরা এখনো ছোট, সম্পর্কের শুরুটা একটু সময় নিয়ে, ভালোবাসা, বিশ্বাস দিয়ে গড়তে যদি না জানে…
–জেসমিন, মন দিয়ে শোন, বাবা মায়ের কাছে তাদের ছেলেমেয়ে ছোট হতে পারে তাই বলে তারা আসলেই ছোট নয়। অন্তত এই যুগে তো নয়। ওদের সমস্যার সমাধান ওদের করতে দাও। স্বচ্ছর সকল সিদ্ধান্ত তুমি নিতে অথচ ছেলেটা বিয়ে করল তোমার সিদ্ধান্ত ছাড়াই।
–আমি তো তাতে রাগ পুষে রাখিনি।
–আমি তা বোঝাচ্ছি না। আমি বোঝাচ্ছি স্বচ্ছ নিজেকে সামলে নিতে, নিজের সিদ্ধান্ত নিতে জানে। পিউ স্বচ্ছকে পুরোপুরি চেনে বা জানে কিনা আমি জানি না তবে আংশিক হলেও পছন্দ করে এ আমি নিশ্চিত।নইলে এ বাড়ির বউ হয়ে আসতো না। আমার কাছে মনে হচ্ছে ওদের মাঝে ছেলেমানুষী মান অভিমান চলছে। ওরা নিজেরা সময়মতো ঠিক করে নেবে। তুমি এসবে নাক গলাতে যেও না।
_______
জেসমিন আরা দুপুরের রান্না চড়ান। পিউ থমথমে মুখে টিভি দেখছে। মাঝে মাঝেই চোখ মুচছে। জেসমিন আরা না পারতে একবার পাশে বসে বলেন, মাকে বলতে চাও কিছু?
-না মা, আমি ঠিক আছি।
জেসমিন আরা কথা বাড়ান না। হাজার হোক স্বামী স্ত্রীর ব্যাপার। মায়ের অনাধিকার চর্চা ঠিক না।
স্বচ্ছ একবারের জন্য রুম থেকে বের হয় না। পড়ার টেবিলেই মুখ গুজে রাখে।
দুপুরে ঝটপট খেয়ে জেসমিন আরা বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন কাজ আছে বলে। একা বাসায় দুজনে যদি বোঝাপড়াটা শেষ করে। কিন্তু পিউ বা স্বচ্ছ কেউ-ই অগ্রসর হয় না। পিউ অপেক্ষা করে স্বচ্ছর এগিয়ে আসার, ওদিকে স্বচ্ছ ভাবে একবার কি পিউ বলতে পারে না, নিজেকে কেন দোষী ভাবছো?
রাতে মিজান সাহেবের সাথে বাসায় ফিরেন জেসমিন আরা। দেখেন পিউ সেই টিভির সামনেই বসে আছে। স্বচ্ছর দরজা বন্ধ।
অসহায় চোখে মিজান সাহেবের দিকে তাকান।
রাতের খাওয়া শেষে টেবিল গোছাতে জেসমিন আরাকে সাহায্য করে পিউ। স্বচ্ছ খাওয়া শেষ করেই থমথমে মুখে নিজের রুমে ঢুকে গেছে।
_________
বিছানায় শুয়ে ছিল স্বচ্ছ। পিউকে রুমে ঢুকতে দেখে সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে। পিউও লাইট অফ করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে।
রুমে মিটিমিটি লাইটের আলোয় দুজন নীরব হয়ে পড়ে থাকে বেশ কিছুসময়।
স্বচ্ছ উঠে পানি খেতে যায়। ডাইনিংয়ে অযথা হাঁটাহাঁটি করে আবার এসে শুয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণ বাদে পিউ ওয়াসরুম হয়ে আসে। ঠোঁটে ভেসলিন মেখে আবার শুয়ে পড়ে।
এবার স্বচ্ছ উঠে ওয়াসরুমে যায়। তার কিছুক্ষণ পর পিউ উঠে পানি খেয়ে আসে।
বিছানায় দুজন আবার মরার মতো পড়ে থাকার ভান ধরে।
স্বচ্ছ বামপাশ থেকে ডান পাশ হয় , পিউ বালিশটাকে অযথাই এপাশ ওপাশ করে।
স্বচ্ছ মোবাইলে সময় দেখে, পিউ উঠে মোবাইল চার্জে বসায়।
স্বচ্ছ গলা ঝাড়ে, পিউ জোরে শ্বাস ফেলে।
একসময় দুজনই নিরব নিশ্চুপ হয়ে যায়।
বিচ্ছিরি ভাবে টিকটিকি ঠিক ঠিক ঠিক শব্দ করে দুজনার আত্মা কাঁপিয়ে দেয়।
পিউ মনে মনে মুখ বাঁকায়, কিছুই ঠিক নেই তবু ঠিক ঠিক ঠিক। ফালতু!
আচমকা পিউকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বচ্ছ। ওভাবেই চুপ করে জড়িয়ে রাখে।
ধীরে ধীরে পিউ চাবি দেয়া পুতুলের মতো স্বচ্ছর দিকে ঘুরে। পোষা বিড়ালের ন্যায় নাক ঘসতে থাকে স্বচ্ছর খোলা বুকে।
নিঃশব্দে হাসে স্বচ্ছ ।
কিছু মানুষ সিক্ত ভালোবাসা পেয়ে আপ্লূত হয় না। তপ্ত ভালোবাসায় রিক্ততা দূর করতে চায়। তারা আদর বোঝে না, অধিকার ফলিয়ে জয় করে নিলেই খুশি হয়।বোকা মেয়েটা তাদেরই দলের।
সময় ক্ষেপন করে না স্বচ্ছ।
হাতের বাঁধন শক্ত করে। অভিমানী ঠোঁটজোড়া জবর দখল করে নেয় মুহূর্তে। বেয়াড়া মনে হানা দেয় নব্য চেনা অলিতে গলিতে।
চলবে।।