#দখিনের_জানলা (পর্ব-২৭)
লেখনীতে— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৫৪.
নতুন দিনের সূচনাটা অন্যরকম মনে হলো চমচমের। গত রাতের স্মৃতিটা এত বেশি উজ্জ্বল হয়ে আছে এখনও তার চোখের সামনে যে সে না চাইতেও আব্রাহামকে নিয়েই ভাবছে। একবার ভাবতে একটা নববধূর মতো ল’জ্জা অনুভব হচ্ছে আরেকবার ভাবতে গেলে প্রচণ্ড রা’গ আর আ’ক্রো’শ সৃষ্টি হচ্ছে। এই দুই ভাবনার জটিল সমীকরণে পড়ে সে তার ব্যক্তি জীবনের ব্যস্ততার কথা প্রায় ভুলেই বসেছিল! নয়টায় যে অফিস যেতে হবে এটাই মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে তার। সাড়ে আটটায় যখন বিছানা ছাড়ল তখন তার রীতিমত চিন্তায় অস্থির হয়ে হা’র্টফেইল করার মতো অবস্থা হয়।
তৈরি হয়ে রুম থেকে বের হতেই প্রথমেই ড্রয়িং রুমে নিজের বাবাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে চা খেতে দেখল। আরাফাত হোসেন তাকে দেখে এক গাল হাসলেন। বললেন,
-‘আজ অফিস নেই আম্মু?’
চমচমের একটা অজানা ক’ষ্টে বুক ভার হয়ে গেল তখনই। এত আম্মু আম্মু করে কথা বলছে! অথচ কালকে সেই আম্মুটাকেই জো’র জ’ব’রদস্তি এক বে’য়া’দ’বের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। চমচম নিজের ক’ষ্ট, দুঃখ প্রকাশ করতে পছন্দ করে না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই হেসে বলল,
-‘দেরি হয়ে গেছে। অফিস আছে বাবা।’
ডাইনিং টেবিলে যেতেই মা আর চিনিকে বসে নাস্তা করতে দেখল অন্যদিনের মতো। চিনি তৈরি হয়ে আছে। চমচম বুঝল সেও অফিস যাচ্ছে আজ। তাই তো বাবা এখন বাসায়। আজ থেকে তো চিনিই সবটা দেখবে। বাবা ঘরে বসেই যা করার করবে। চিনি চমচমের দিকে তাকাতেই অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলো চমচম। যে আপু তাকে শত শত দু’ষ্টুমি করার পর, বড় ধরনের অ’প’রা’ধ করার পরও বাঁচিয়ে দিতো সেই আপু গতকাল রাতে তাকে মে’রেছে। বাকি সব ভুলে গেলেও এটা সে ভুলতেই পারছে না। না, চিনির উপর তার রা’গ হয় না, চিনির উপর তার ক্রো’ধ জন্মায় না। তার শুধু একটু অ’ভি’মা’নই হয়েছে। তবে সেই সাথে তার খুব চিন্তাও হচ্ছে। তার এত শান্ত শিষ্ট বোনটার হুট করে কি হলো! এমন নির্জীব, শক্ত আচরণ চিনিকে কখনো করতে দেখেনি সে। চিনি এসেছে বেশ অনেকদিন হয়ে গেছে। এরমধ্যে আশফাক একদিনও তো এলো না। ফোনে কথা বলতেও সে দেখেনি। মা-বাবাও কিছু বলছেন না এই ব্যাপারে। আসলে তারা কি বলবে! এসব ব্যাপারে চমচমরই তো কিছু জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হয়।
এত চিন্তায় খাবারটা ঠিক মতো খাওয়া হলো না চমচমের। ঘড়িতে ৯:৪৩ বাজতে দেখেই তার চোখ কপালে ওঠে। সে ভুলেই বসেছিল যে আজ দেরি হয়ে গেছে। কোথায় তাড়াহুড়ো করবে তা না বরং ধীরে ধীরে সবকিছু করছে! হন্তদন্ত হয়ে নিচে নামার পর খেয়াল হলো চিনি আজ অফিস যাবে। বাবার গাড়িটা হয়তো ও নিয়ে বের হবে। তাই সে হাঁটা ধরল। উবার ডাকলে এখনই পাবে কিনা সেটাও শিওর না সে। একটু সামনে যেতেই পেছন থেকে গাড়ির হর্ণ শুনতে পায়। পেছন ফিরে আয়মানকে দেখতে পেল। জানলার গ্লাস নামিয়ে মাথা বের করে তাকেই ডাক দিলো সে। চমচম কাছে এগিয়ে আসতেই বলল,
-‘অফিস যাচ্ছিস?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘আজ তো কক্সবাজারের প্রোগ্রামটা নিয়ে আমাদের অফিসে একটা গোল বৈঠক বসবে। তোর বস সহ বাকি কলিগরা সেখানেই আসছে। তুই যাবি না?’
চমচম এটা জানত না। হুট করেই কিছু মনে পড়তেই সে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকলো। ওয়াসিম কাল রাতেই মেসেজ করে জানিয়ে দিয়েছিল আজ দশটায় আব্রাহামদের অফিসে মিটিং আছে। চমচম দেখেনি, দেখবে কি করে! যে সময় দেখাচ্ছে সেসময়ে তার বিয়ে হচ্ছিল। এরপর তো আর কোনো দিকেই তাকাতে ইচ্ছে করেনি তার। নেট অন ছিল না। আব্রাহাম তো নাম্বারেই মেসেজ পাঠিয়েছে সরাসরি। তাই ওরটা দেখেছিল।
-‘কিরে! যাবি না?’
-‘হ্যাঁ। ওখানেই যাব।’
-‘তাহলে আমার সাথে চল।’
-‘না না। তুমি যাও। আমি উবার ডেকে নিব।’
-‘চমচম দশটায় মিটিং। আমাদের এমনিতেও লেইট হবে। উবার ডাকলে কখন আসবে বা এখনই পাবি কিনা এর কি গ্যারান্টি! চল দেরি করিস না। ভাই আবার এসব ব্যাপারে খুব সিরিয়াস।’
-‘তোমার ভাই সিরিয়াস হলে আমার কি সমস্যা!’
আয়মান এক চোখ টিপ দিয়ে বলল,
-‘তোরই তো সমস্যা হবে।’
আয়মানের ইঙ্গিত চট করে ধরতে না পারলেও পরে ঠিকই বুঝল চমচম। ক্ষি’প্ত গলায় বলল,
-‘বা’জে কথা বলো কেন? আমি যাব না। যাও! তুমি একা যাও।’
-‘আরেহ তুই কি ভেবেছিস! আমি তো তোকে বলতে চাইছিলাম তোর সমস্যা, মানে ভাই তোর বসকে কথা শুনাবে তোর বস আবার তোকে! আর বুঝিসই তো! বসদের কত ধরনের কথা থাকে! সব সহ্য করা যায় না।’
চমচম চুপ হয়ে গেল। আসলেই! একে তো দেরি করে নিজের অফিসেই যায়নি। তারপর আবার আব্রাহামদের অফিসের মিটিং এ ও দেরি করে গেলে তাকে কি বলবে ওয়াসিম! শুধু ওয়াসিম না! বাকিরাই বা কি ভাববে? তাদের চমচমকে আর ওয়াসিমকে নিয়ে ভাবা কথা গুলো তো তখন তারা সত্যই মেনে নিবে। কেননা ওয়াসিম তাকে সবার সামনে কিছু বলবে না এটা সেও জানে। কেবিনে ডেকেই হয়তো বলবে যা বলার। আর সেটাকেই সবাই একটা বা’জে দিকে নিয়ে যাবে।
-‘কিছুক্ষণ পরপর এত কি ভাবছিস? আয় ওঠ! এখানেই পাঁচ মিনিট টাইম ওয়েস্ট হলো।’
উপায়ন্তর না পেয়ে আয়মানের গাড়িতে উঠে বসল সে। গাড়িতে আয়মান তাকে বারবার এটা সেটা বলে ল’জ্জায় ফেলে দিচ্ছিল। নানান কথার ছলে কিছুক্ষণ পর পরই নিজ ভাই আর চমচমের সম্পর্ক কে ইঙ্গিত করে কথা তুলতে থাকে। দুই তিন বার নাটক করে ভাবীও ডাকে। চমচম প্রথমে কিছুক্ষণ তাকে এসবের জন্য ডাক দিলেও পরে আর দেয় না। এই অ’ভ’দ্রটা তো ভাইয়ের চামচা। একে কিছু বলে লাভ নেই। দুটোই এক জাতের। কথা তো শুনবেই না। চমচমের এখনও মনে পড়ে ডাবের পানি আনার ছ’ল করে এই ব’দ’মা’ইশটা তাকে তার ভাইয়ের রুমে ব’ন্ধী করে রেখেছিল। সেটা মনে পড়লে এখনও ক্রো’ধে তার দুই ভাইকে ধরে সমানে পে’টাতে ইচ্ছে করে।
৫৫.
আব্রাহামদের অফিসে পৌঁছানোর পর চমচম দেখল সবাই বেশ হাসিখুশি মুখ করে এদিক ওদিক ঘুরছে। সকলের হাতে হাতে মিষ্টির প্যাকেট। আয়মানের দিকে অবাক নয়নে তাকাতেই আয়মান বলল,
-‘ওহ! ভাই আসলে বিয়ে করেছে তো! তাই আজ সবাইকে চমচম মিষ্টি খাওয়াচ্ছে।’
কথাটা শুনেই চমচমের মাথায় আ’গু’ন ধরে গেল। কেন? মিষ্টি যখন খাওয়াবেই চমচম মিষ্টিই কেন?
মিটিং তখনও শুরু হয়নি। সবাই অফিসের গেস্ট রুমেই বসা ছিল। সবার মধ্যে আব্রাহামও ছিল। অন্য দিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই সেজে গুজে এসেছে সে এমনটাই তাকে দেখে মনে হলো। চমচমকে দেখে অবশ্য আব্রাহামের হৃদয়ে এক অন্যরকম প্রশান্তি অনুভব হয়। সামনে থাকা রমনী তার বিবাহিতা স্ত্রী! ভাবতেই তো অদ্ভুত মোহনীয়, আবেশ জড়ানো এক অনুভূতিতে তলিয়ে যাচ্ছে সে। সবই ঠিক আছে মেয়েটার। শুধু রা’গটা যেন নাকের ডগায় থাকে। আব্রাহাম সবসময় রা’গী জে’দী আর একগুঁয়ে খ্যাত ছিল। তার জে’দ আর রা’গের কাছে অন্য কেউই টিকতে পারত না। সেখানে কিনা এই চমচম সবসময় উল্টো রা’গ আর জে’দ দেখিয়ে জিতেছে তার সাথে! এই এত এত হার স্বীকার করেছে সে মেয়েটার কাছে। তারপরেও কি একটু সহানুভূতির জন্ম হয়নি তার মনে! এত পা’ষা’ণ একটা মেয়ে কি করে হয়? সে তো জানে মেয়েরা কোমলমতী, নরম স্বভাবের। আর এই মেয়ে, এ তো একটা পাথরমতী আর শক্ত স্বভাবের মেয়ে। থাক! যেমনই হোক, এখন তো তার বউ। সহ্য করে নেওয়ার অভ্যাস করে নিতে হবে। এত বছরও তো করেছে। তবে আগে যেমন প্রতিক্রিয়া দিতো এখন থেকে আর তেমন করবে না। যথাসম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করবে সে চমচমের সামনে। চমচম তেমনই থাকুক যেমন সে ছিল। কারণ চমচমকে সব অবস্থাতেই সে ভালোবাসতে জানে। চমচমের কোনো প্রয়োজন নেই কারো জন্য নিজেকে বদলানোর। বরং সে বদলে যাবে। তবুও চমচম না বদলাক। পাথরবতী শক্তই থাকুক। এটাতেই তাকে মানায়।
আব্রাহামকে একমনে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে এত মানুষের মধ্যে চমচম খুব বিব্রত বোধ করে। মিটিং শুরু হলো কিছুক্ষণ পরেই। আব্রাহাম যখন চমচমের পাশের চেয়ারটায় এসে বসল তখনই সে নড়ে চড়ে উঠল। অ’স’ভ্যটা তার পাশে এসে বসেছে কেন! মিটিং এর সব মনোযোগ ন’ষ্ট হয়ে গেল তার। বারবার তার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় তাকে জানান দিচ্ছিল মানুষটা পাশে বসে আছে। তাকেই দেখছে। ওয়াসিম যখন স্পিচ রাখছিল তখনই আব্রাহাম আরেকটু কাছে আসে চমচমের। ফিসফিস করে বলে,
-‘ওয়াসিম ব্যাটাকে সান্ত্বনা পুরষ্কার দিয়েছি বুঝলি! সে তো আর মানুষ চমচমকে পাচ্ছে না। তাই তার প্রতি দয়া করে চমচম মিষ্টির ট্রিট দিলাম। কিন্তু ব্যাটা সেটাও খেতে পারল না। মিষ্টি নাকি খেতে পারে না। তুই বুঝ! যেই ব্যাটা একটা চমচম মিষ্টি হজম করতে পারে না সে কি করে আস্ত তোকে আই মিন আস্ত মানুষ চমচমকে হজম করবে! ভাবতে পারছিস!’
আব্রাহামের কথা শুনে চোখ গরম করে তার মুখের দিকে তাকালো। সে পাত্তাই দিলো না সেই গরম চোখকে। বরং মন ভরে তার নতুন বউকে দেখতে লাগল।
মিটিং শেষ হতেই ঘোষণা দেওয়া হলো আজকে একটা নামী দামী রেস্তোরাঁতে মিটিং এ উপস্থিত সবাইকে লাঞ্চের অফার দিয়েছে আব্রাহাম। ওয়াসিম সেই অফার এক্সেপ্ট করেছে। আর সেজন্যে এখন চমচমকেও যেতে হবে সকলের সাথে। চমচম এমনটা শোনার সাথে সাথেই নাকোচ করে দিলো বলল সে যাবে না। শেষে ওয়াসিম তাকে বলল,
-‘আজরা, তোমার থাকাটা খুবই জরুরী। আমাদের কোম্পানির নাম জড়িয়ে আছে তোমার সাথে। তোমার যে কোনো কাজের জন্য আমাদের কথা শুনতে হতে পারে। প্লিজ! ডোন্ট ডু এনিথিং দ্যাট ব্রিংস দ্য কোম্পানি ইনটু ডিসরেপিউট।’
অগত্যা সবার সাথে চমচমকেও চলতে হলো। তার তখন ইচ্ছে করছিল আব্রাহামকে ধরে ল’ট’কা’তে। অবশ্য রা’গটা পুরোপুরি চেপেও যায়নি সে। অন্য ভাবে রা’গ ঝারতেই আব্রাহামকে মেসেজে লিখল,
-‘স্বামী ও স্বামী, আপনার মনটা ভালো আমি জানি। প্রিয় বসের সাথে লাঞ্চ করতে পারব বলে আমি খুব খুশি। দোয়া করি আপনার মুখে পড়ুক গরুর ভুসি।’
#চলবে।