#দখিনের_জানলা (পর্ব-২৫)
লেখনীতে — ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৫০.
সন্ধ্যার একটু আগেই চমচম বাসায় ফেরে। ড্রয়িং রুমে চিনিকে একমনে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। অন্যসময় হলে দরজা খোলার আওয়াজ পেলেই চিনি উঠে সামনে গিয়ে তাকে বকাবকি করত দেরি করেছে কেন সেজন্যে। আজ কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। চমচম দু’শ্চি’ন্তায় পড়ে গেল। চিনির হাবভাব তার ভালো ঠেকছে না। সোফায় বসে চিনিকে বলল,
-‘আপু একটু পানি এনে দে।’
চিনি চমচমের গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠল। চমচম যে এসেছে তা সে এতক্ষণে টের পেলো বোধ হয়। পানি এনে দিয়ে শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল,
-‘এত দেরি করলি যে?’
-‘আজকে আউট অফ টাউন যেতে হয়েছিল।’
-‘ওহ। চাকরিটা ছাড়ছিস কবে?’
চমচম কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,
-‘নতুন একটা প্রোজেক্টের কাজ ধরেছে কোম্পানি। আমি ইন চার্জে আছি। সেই কাজটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়তে পারব না।’
-‘ওহ। তবে আমি কাল থেকে বাবার ব্যবসায় বসছি।’
-‘তোমার অফিস!’
চিনি মলিন হাসে কথাটা শুনে।
-‘বিয়ের আগে সেটাতে ইস্তফা দিয়েছিলাম।’
চমচম বেশ অবাক হলো কথাটা শুনে। বিচলিত গলায় প্রশ্ন করল,
-‘কখন? কবে করলে এমন? আমি তো শুনিনি! আর এতদিন তবে তুমি চাকরি ছাড়া ছিলে!’
-‘দেড় মাস হয়ে গেছে তো।’
-‘আশফাক ভাইয়া কিছু বলেননি?’
-‘ওর কথা শুনেই তো!’
চিনি আর কথা বলতে পারল না। ভেতরের ঘরে বাবা ডাকছেন। চমচমকে ফ্রেশ হয়ে নিতে বলে সে সেখান থেকে উঠে এলো। বোনের যাওয়ার দিকে কিছু সময় অবুঝ চোখে তাকিয়ে থেকে চমচম উঠে দাঁড়ালো। ঘামে গা চিটচিটে হয়ে গেছে তার, এখনিই গোসল নিতে হবে।
নিজের রুমে গিয়ে জামা কাপড় না নিয়েই তাড়াহুড়ো করে বাথরুমে ঢুকল। একটু সময় নিয়ে গোসল সেরে বের হতেই দখিনের খোলা জানালার দিকে তার চোখ পড়ে। সামনে এগিয়ে যেতেই দেখল আব্রাহাম তার বারান্দায় রেলিং এর সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কফি পান করছে। তাকে দেখার সাথে সাথেই চমচমের বুকের ভেতর কামড় পড়ল। আব্রাহাম তাকে দেখে ঠোঁট কামড়ে হেসে চোখ মা’র’ল। তার এহেন কাজে চমচম ভড়কে যায়। আব্রাহামের চোখের দৃষ্টি তার ভালো ঠেকছে না। এমন বাঁকা চাউনির র’হ’স্য ভেদ করতে তার বেশি সময় লাগল না। যখন বুঝতে পারল আব্রাহাম তাকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করছে তখন সে নিজের দিকে তাকালো। সাথে সাথেই তার শি’র’দাঁ’ড়া’ বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। ঠাস করে জানালা বন্ধ করে দিয়ে হাঁ’পা’তে লাগল। ভুল বশত গায়ে কেবল টাওয়াল পেঁচিয়েই সে জানালার সামনে চলে এসেছিল। কি একটা স’ম্মো’হন কাজ করছিল তখন! দিন দুনিয়া ভুলে জানালার কাছে যাওয়ার তী’ব্র বা’স’না কাজ করছিল তখন তার মনের মধ্যে।
আব্রাহাম বাসায় এসেছে! এটা ভাবতেই চমচমের আরো বেশি অ’স্ব’স্তি হতে লাগল। আজ সারাদিন সে আব্রাহামের সাথেই ছিল। তখন অফিসে ঘটা সেই ইনসিডেন্টের পর থেকেই চমচম দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। অথচ আব্রাহামের সেদিকে খেয়াল ছিল না। ব্যাপারটা নিয়ে তাকে পরে আর মাথা ঘামাতে দেখা গেল না। সে কাজে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল! চমচম ও পরে সব মন থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের কাজে মন দেয়। বিকেলে অফিসের গাড়িতে করে সে অফিসে ফিরে যায়। সেখানে ওয়াসিমকে সব হিসেব বুঝিয়ে দিতে দিতেই তার আরো বেশি দেরি হয়ে গেছে। আব্রাহামের কথা তখন একেবারেই ভুলে বসেছিল সে। তবে এখন তার মনের মধ্যে একটা খচখচানি কাজ করছে। আব্রাহাম কেন বাড়ি ফিরেছে! চমচমের সাথে ঘটা সেদিনের ঘটনার জেরেই তো সে বাড়ি ছেড়েছিল তখন। আজ আবার চমচমের সাথে ঘটে যাওয়া আরেকটা ঘটনার জের ধরে ফিরে আসেনি তো! যদি কোনো আশা নিয়ে এসে থাকে তবে সে ভুল করছে। চমচম তাকে বিয়ে করবে না, কখনোই না! চমচম অনুভব করল তার গাল বেয়ে গরম তরল গড়িয়ে পড়ছে। আশ্চর্য! সে কাঁদছে কেন? কার জন্য তার এত ক’ষ্ট হচ্ছে? নিজের জন্য নাকি আব্রাহামের জন্য!
৫১.
পরদিন চমচমদের বাসায় সকাল সকাল নিগার খানম এসে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে চমচমের মা সে কি খুশি! চমচম নিগার খানমের আগমনে খুশি হয় আবার একটু ভ’য়ও কাজ করে তার মনের মধ্যে। পুনরায় না আবার নিগার খানম তাকে আব্রাহামের জন্য চেয়ে বসেন!
চমচমের ভ’য়টা সত্যি প্রমাণিত হয়, বলতে গেলে সে যতটা ভেবেছে তার থেকে বেশিই খা’রা’প কিছু ঘটে যায় তার সাথে। নিগার খানম তাকে জো’র করে একটা ডাইমন্ডের পেনডেন্ট পরিয়ে দিয়ে ফাতেমা বেগম কে বললেন,
-‘সি’ল মে’রে আমানত রেখে যাচ্ছি। আশা করছি খেয়ানত হবে না।’
চমচমকে দুজনের কেউই কিছু বলতে দিলো না। যাওয়ার সময় পেনডেন্টের সাথে থাকা কানের দুলের বক্সটা তিনি চমচমের হাতে দিয়ে বললেন,
-‘এগুলো নিজেই পরে নিবি। খবরদার চমচি! কানের গুলো তো পরবিই তারা সাথে গলারটাও খোলার চেষ্টা করবি না। যদি করিস তাহলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম।’
নিগার খানম চলে যেতেই চমচম নিজের রুমে গিয়ে গতকালের ফাইল খুঁজে আব্রাহামের নাম্বার বের করে মেসেজে লিখল,
-‘যেসব মানুষের কথা আর কাজে তফাৎ আছে আমি সেসব মানুষদের ঘৃ’ণা করি। আর বিয়ে তো দূরের কথা!’
আব্রাহাম মেসেজটা দেখে হতভম্ব হয়ে রইল। সে বুঝতে পারল না হঠাৎ আবার কি হয়েছে! কি করেছে সে! ফোনটা বিছানায় ছুড়ে মে’রে সে বলল,
-‘আমিও দেখি! আমাকে ছেড়ে তুই কাকে বিয়ে করিস।’
#চলবে।