#দখিনের_জানলা (পর্ব-৬)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
১১.
চমচম আব্রাহামের সামনের সোফায় বসে চা খাচ্ছে। আর একটু পর পর আব্রাহামের দিকে গরম চোখে তাকাচ্ছে। আব্রাহাম প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে মনে করে ওইদিনকার ঘটনার জন্যই চমচম তাকে এমন লুক দিচ্ছে। সেটা ভেবেই কিছুটা অস্ব’স্তিতে পড়ে গেল সে। চোখ নামিয়ে ফেলে। চমচমের স’ন্দে’হ টা আরো গাঢ় হলো এতে। আব্রাহাম তারমানে এটা ছড়িয়েছে। এবার সে শিউর। মনে মনে আব্রাহামকে শা’প, শা’পান্তর করে সে চা খেয়ে চলে গেল। নিগার খানম বেশ কয়েকবার ডাকলেও সে শুনল না। আব্রাহাম কিছুটা চিন্তিত। মেয়েটা সেইসব এখনও ভোলেনি? ঘটনাটার দুই মাস তো হয়ে এসেছে। অবশ্য সে নিজেও তো পুরোপুরি ভুলতে পারছেনা। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে যায়। আর তখনই! তখনই একটা অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হয়।
চমচম আপাতত কিছু করবে না। এলাকা ঠান্ডা হোক। খবরটা চাপা পড়ুক। শো’ধ তো সে নিবেই! যে করেই হোক। তাছাড়া আব্রাহামের গতবারের করা কাজটার শা’স্তি তো এখনও বাকি আছে। চমচম তার জন্য বেশ জবরদস্ত একটা সা’জা প্রস্তুত করে রেখেছে। আপাতত সেটাই আব্রাহাম ভো’গ করুক। উফফ! ভাবতেই অন্তরে শান্তি অনুভব হচ্ছে। আহা!
বিকেলের দিকে মোড়ের মাথায় যেতেই আব্রাহামকে কেউ একজন ডাক দিল। আব্রাহাম তাকিয়ে দেখল এলাকার পরিচিত মুখ মোহনলাল চটপটিওয়ালা। হঠাৎ চটপটিওয়ালা তাকে ডাকছে কেন সে বুঝে পেল না। একবার নিজের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করতেই মোহনলাল পান খাওয়া দাঁত দেখিয়ে হাসে। আব্রাহাম এগিয়ে যায়। বলল,
-‘কি খবর মামা! কেমন আছেন? হঠাৎ কি মনে করে ডাকলেন?’
-‘মামা! খবর ভালো হইত যদি টাকাটা দিয়া দিতেন।’
আবারও পান খাওয়া দাঁত গুলো দেখিয়ে হাসে মোহনলাল। আব্রাহাম বেশ অবাক হলো। বলল,
-‘টাকা! কীসের টাকা?’
মোহনলাল আবারও হাসে। হেসে বলল,
-‘ভুইলা গেছেন নাকি মামা?’
-‘একটু ক্লিয়ার করে বলবেন প্লিজ। আমি বুঝতে পারছি না।’
-‘চমচম আফায় যে প্রায় দুই মাস বাকিতে খাইছে। সে টাকা! বলল তো আপনে আসলে দিবেন। আমি তো আপনারে চিনিই। তারেও চিনি। তাই বাকি দিছি। এখন আপনি আমার টাকাটা দিলে বেশ উপকার হইত।’
আব্রাহাম যেন আকাশ থেকে টুপ করে মাটিতে পড়ল। চমচম তার নাম ভাঙিয়ে খায়? সে ভাবতেও পারছে না। এখন সে কি বলবে! টাকা না দিয়ে গেলে তাকে নিয়ে লোকটা ম’ন্দ চিন্তা করতে পারে। টাকা যে দিবে সেটাও তো যৌক্তিক নয়। চমচম বাকিতে খেয়েছে আর টাকা দিবে সে। কেন? চমচম তার কী হয়? আব্রাহামের মেজাজ গরম হয়ে গেল। তারপরেও শান্ত স্বরে বলল,
-‘আচ্ছা। কত হয়েছে?’
-‘জ্বে প্রতিদিন পঞ্চাশ টাকার খাইত আর পঞ্চাশ টাকার নিয়াও যাইত। আমি হিসেব করে রাখছি। দাঁড়ান খাতাটা দেইখা লই।’
খাতাটা দেখে মোহনলাল বলল,
-‘পঁয়তাল্লিশ দিন খাইছে। টোটাল চাইর হাজার পাঁচশত টাকা।’
টাকার অঙ্কটা শুনে আব্রাহামের মাথায় হাত। বলে কী! এত টাকা হয়েছে? আব্রাহাম মানি ব্যাগ বের করল। তার কাছে ক্যাশ আছে চার হাজার। সে আমতা আমতা করে মোহনলালকে বলল,
-‘আমার কাছে তো চার হাজার আছে মামা। আপনি আপাতত এটাই রাখেন।’
-‘বিকাশ নগদ রকেট এসব নাই?’
আব্রাহাম একটু চমকে বলল,
-‘হ্যাঁ আছে।’
-‘তাইলে আর কী! খরচ সহ পাঠাই দেন বাকি পাঁচশত। এই যে দেখেন। সাইনবোর্ডের মতো বিকাশ নাম্বার ঝুলাই রাখছি।’
আব্রাহাম এই স্মার্ট চটপটিওয়ালাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর টাকা উঠানোর জন্য এক্সট্রা খরচ সহকারে সে তার একাউন্টে টাকা পাঠায়। আসার আগে অবশ্য মোহনলাল তার হাতে একশ টাকার চটপটি ধরিয়ে দিয়েছে চমচমের জন্য। এটা নাকি ফ্রী! আব্রাহামের ইচ্ছে করছিল চমচমের চুলির ঝুটি ধরে তাকে আ’ছা’ড় মা’রতে। কিন্তু সেটা তো আর হওয়ার নয়!
১২.
সন্ধ্যার দিকে চমচমদের বাসার কলিং বেল বাজতেই চমচম গিয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলতেই নিগার খানমের হাসি হাসি মুখটা উঁকি দিল। চমচম হেসে পথ করে দিতেই তিনি ভেতরে ঢোকেন। তার পেছন পেছন আয়মান আসে। আয়মানের পেছনে আসে আব্রাহাম। আব্রাহামকে দেখে চমচমের ভ্রু কুঁচকে গেল। তবে ।আতে চটপটির বক্স আর মুখে বি’র’ক্তি দেখেই চমচম বুঝে গেল। তার এতদিনকার সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা সা’জাটা আব্রাহামের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে। মনে মনে চমচম এক পৈ’শা’চি’ক আনন্দ অনুভব করে। আব্রাহাম ভেতরে এসেই চমচমের হাতে চটপটির থলে ধরিয়ে দিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে চলে গেল। চমচম মনের আনন্দে গুণগুণ করতে করতে চটপটি প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে গেল। চিনির রুমে অবশ্য এক বাটি দিয়ে আসে আগে। এতদিন চিনি সহ খেয়েছে। আজ কেন চিনি বাদ যাবে?
একে একে সবাইকে চমচম চটপটি দিল। আব্রাহামকেই দিল না। অবশ্য আব্রাহাম খায় ও না। আয়মান বলল,
-‘এই চমচম! তুই নাকি ভাইয়ের নাম ভাঙিয়ে চটপটি খাস। ব্যাপার কী? আমার ভাইকে কি তুই তোর জামাই পেয়েছিস নাকি?’
কথাটা শুনে চমচম ভীষণ বি’র’ক্ত হলো। বলল,
-‘আহ বাজে বকো কেন? সে আমার চেনা জানা মানুষ। আমার প্রিয় হাম ভাই। তার তো কর্তব্যের মধ্যে পড়ে আমাকে কিছু খাওয়ানো। তুমিও না! যা বলো! তাছাড়া বাজারে পাত্রের অভাব আছে নাকি? আমার জামাই যে হবে সে ইউনিক। প্রিন্স চার্মিং হবে!’
শেষ কথাগুলো শুনে আব্রাহাম ঠোঁট ভেঙায়। ইউনিক না ছাই! প্রিন্স চার্মিং? কচু হবে। সে বলল,
-‘হ্যাঁ। পেছনে দুইটা লেজ ঝুলবে। এমন ইউনিক!’
চমচম কটমট দৃষ্টিতে তাকালো আব্রাহামের দিকে। চমচমের মা মেয়ের কথা শুনে বললেন,
-‘আব্রাহামের উপরে আর ছেলে আছে? তোর চোখে ছানি পড়ছে। তাই হীরা চিনিস না।’
-আসছে আমার হীরা! ওটা একটা কাঁচ।’
আব্রাহাম অ’গ্নিদৃষ্টিতে তাকালো চমচমের দিকে। চমচমের মা রে’গে গিয়ে কিছু বলবেন তার আগে নিগার খানম তার হাত ধরে ফেলেন। বললেন,
-‘থাক। বাচ্চারা কত কথাই তো বলে। সব কি আর সত্যি সত্যি বলে নাকি। মজা করে।’
-‘আপনি এটারে এত প্রশ্রয় দিবেন না ভাবী। এটার ব’দ’মা’ই’শি’র শেষ নাই।’
-‘না থাকুক শেষ। আপনি চলেন। কি খাওয়ানোর জন্য ডাকছেন সেটা খাওয়ান।’
ফাতেমা বেগম বিরাট বড় ভুল করে ফেলেছে এমন মুখ করে বললেন,
-‘হায় হায়। কি কান্ড করছি দেখেন! আপনাকে এখনও কিছু খেতেই দিলাম না! যেই নতুন আইটেমটা ট্রাই করেছি সেটা তো দূরের কথা।’
চমচম ঠুস করে বলে উঠল,
-‘ওমা! মাত্রই তো চটপটি খাওয়ালাম।’
ফাতেমা বেগম কটমট দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। অর্থাৎ আজকে এরা যাক। তারপরে তিনি চমচমের খবর করে ছাড়বে। মায়ের তাকানো দেখে চমচম আর কোনো কথা বলল না। ফাতেমা বেগম আয়মান আর আব্রাহামকেও ডাইনিং এ ডাকলেন। আর অনামিকা আসেনি কেন সেই খবর জিজ্ঞেস করলেন নিগার খানমকে। সবাই চলে গেলে ড্রয়িং রুমে থাকে কেবল চমচম আর আব্রাহাম। চমচম আপনমনে তৃপ্তি করে চটপটি খাচ্ছিল। হঠাৎ করে আব্রাহামের দিকে চোখ পড়তেই দেখল আব্রাহাম তার দিকে তাকিয়ে আছে। চমচম ভ্রু কুঁচকে ইশারা করল। আব্রাহাম তবুও তাকিয়ে থাকে। চমচম তা দেখে আর সইতে না পেরে বলল,
-‘কি সমস্যা! তাকিয়ে আছো কেন? ওহ! চটপটি খাবে? আগেই বলতে। নাও খাও।’
আব্রাহাম উঠে আসে। চমচম ভাবে সত্যি সত্যিই চটপটি খাওয়ার জন্য উঠে আসছে। সে বাটি এগিয়ে ধরতেই আব্রাহাম সেটা ধরে সেন্টার টেবিলে রেখে দুই হাতে চমচমের মুখ উঁচু করে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় চমচম ভাষা হারিয়ে ফেলে। আব্রাহাম চট করেই এলোমেলো চুমু খায় চমচমের কপালে, গালে, চিবুকে! চমচম হতভম্ব হয়ে যায় তাতে। আব্রাহাম সরে এসে বলল,
-‘আমার ৪৫০০ টাকা তুই বরবাদ করলি। এটা তোর শা’স্তি। আবার যদি কিছু করিস তাহলে আবারও আমি এমন করব। বারবার করব। দেখিস তুই! অন্যভাবে তোকে আর বশ মানানো যাবে না আমিও ভালো বুঝতে পারছি।’
আব্রাহাম চলেই যাচ্ছিল। চমচমের চোখের কোণে পানি চলে এলো। সে চেঁচিয়ে বলল,
-‘ছিঃ তোর সাহস হয় কীভাবে আমাকে কিস করার। বে’য়া’দ’ব!’
আব্রাহাম আবারও উল্টো ফিরে চমচমের দিকে এগিয়ে আসে চিবুক ধরে টেনে বলে,
-‘এবার ঠোঁটে দেই?’
চমচম বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টো করে কেঁদে সোফায় উবু হয়ে বালিশ দিয়ে মুখ ঢাকে। আব্রাহাম তাতে বেশ মজা পায়। সে মুঁচকি হেসে চমচমদের বাসা থেকে বের হয়ে যায়। আব্রাহামকে যেতে দেখে চমচম হাতের চামচটা ছুঁড়ে মারে কিন্তু আব্রাহাম চট করে দরজাটা টেনে দিতেই দরজায় লেগে চামচ শব্দ করে ফ্লোরে পড়ে থাকে।
চমচম আবারও উবু হয়ে কাঁদে। ছিঃ ছিঃ আব্রাহামের মুখের জীবাণু লেগে আছে তার সারা মুখে। আয়মান এসে চমচমকে এভাবে কাঁদতে দেখে বলে,
-‘কীরে! ভাই কোথায়?’
চমচম উঠে দাঁড়ায়। কড়া গলায় বলে,
-‘তোর ভাই কোথায় আমি জানিনা। কিন্তু অস’ভ্যটাকে যদি সামনে পাই তো ওর কি হা’ল করব আমিও নিজেও জানিনা।’
আয়মান মশকরা করেই বলল,
-‘কেন রে? আবার কিস করল নাকি?’
চমচম চোখ বড়বড় করে তাকালো কিছুক্ষণ আয়মানের দিকে। তারপর হুড়মুড় করে নিজের রুমে ঢুকে দরজা ঠাস করে শব্দ তুলে বন্ধ করে দিল। ফাতেমা বেগম মেয়ের কান্ড দেখে ডাইনিং থেকে চেঁচাতে থাকে।
#চলবে।