থার্টি ওয়ান
লিখা> Abir Hasan Niloy (মি. ভূত)
১
“আমাকে কি হট হট লাগছে? ভালো করে দেখে বলুন তো।”
আমি কিছুসময় নিয়ে জেরিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা আমার সাথে এভাবে কথা বলবে আমি তা কখনো কল্পনাও করিনি। কল্পনাও বা করবো কি করে, জেরিনকে তো আমি আমার সামনেই কখনো আসতে দেখিনি। মাঝে মাঝে দরজার দিকে তাকালে জেরিনকে পুতুল কোলে নিয়ে বসে থাকতে দেখতাম। তাও আবার আসা যাওয়ার পথেই দেখা হতো। মাথাটা কেমন করে যেন ঝাকাতো।
কখনো ভাবিনি মেয়েটা আমার সাথে এসে কথা বলবে। কারন মেয়েটার আচরণগুলো সাধারন মেয়েদের থেকে একটু বেশিই অন্যরকম লাগে আমার কাছে। যদিও আমার সাথে কোনোদিন কথা বলেনি এবং সামনে আসেনি তবুও আচরণগুলো কেমন কেমন যেন মনে হতো।
– কি হল, আমার দিকে তাকান। আমাকে কেমন লাগছে?
– ইয়ে মানে,, সুন্দর। (আমি)
– শুধুই সুন্দর?
– হুম।
কথাটা বলে পাশ কাটিয়ে চলে যাবো মেয়েটা আমার সামনে পথ আগলে দাঁড়ায়। আমি ভয়ে একটা ঢোক গিললাম। কিছুই বলতে পারছি না। এমনিতেই জেরিন সুন্দরি, তার উপর আমার কাছে মনে হয় ওর মাথায় কোনো বড় রকমের সমস্যা আছে। আরো একটা ব্যাপার ও হল আমার স্টুডেন্ট এর বড় বোন।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। জেরিনের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছি না। জীবনকে পড়াতে আসি আমি আটমাস হল। এই আটমাসে এই বাড়ির সবাইকে মোটামুটিভাবে চিনে ফেলেছি আমি। প্রথম যেদিন জীবনকে পড়াতে আসি এক বড় ভাইয়ার দৌলতে। বাড়ির সামনে আসতেই দুইতলা থেকে ঘরের ডাস্টবিনের সব ময়লা আমার গায়ে এসে পড়ে।
প্রথমে ভেবেছিলাম আমার স্টুডেন্ট এর কাজ। হয়ত পড়তে চাইনা বলে, টিচারকে তাড়ানোর একটা ধান্দা। কিন্তু যখন দাঁড়িয়ে গা থেকে ময়লা সরাচ্ছি তখন বাড়ির ভিতর থেকে একটা মেয়ের জোরালো শব্দ কানে আসে। একটা মেয়ে তার মা বাবার সাথে উঁচু গলায় বেশ রাগি মুখেই কথা বলছে। এক কথায় মেয়েটা ঝগড়া করছে।
আমি কিছুটা অবাক হলাম। প্রথম দিনই এরাকম একটা পরিস্থিতিতে পড়বো ভাবিনি। একবার ভাবলাম চলে আসবো। কিন্তু কিছু সময় পর কাজের লোক এসে বলে “আপনি জীবনের টিচার তাই না? স্যার বলেছে আপনি এ সময়ে আসবেন। আসুন ভিতরে আসুন।” মাথাটা একটু নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা করে ভিতরে প্রবেশ করি। কাজের লোকটার পিছু নিয়ে উপরে চলে যায়। প্রথম ঘরটা ক্রস করবো দরজা খোলা ছিল।
অবশ্য অপরিচিত কারো বাসার দরজায় কখনো উঁকি দেওয়া ঠিক না। কিন্তু ঝগড়াটা ঠিক ঐ ঘর থেকেই আসছিল। তাই না চাইতেও চোখটা সে দিকে চলে যায়। একটা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। চুলগুলো এলেমেলো, মুখের সামনে এসে পড়েছে। হুট করে যেকেও দেখলে ভয় পাবে পাগলি ভেবে। দেখলাম একটা আপেল কাটা ছুরি নিয়ে বাম হাতের উপর জোরে টান দেয়। চিৎকার করে বলে “আমি না বলেছি আমার কোনো ব্যাপারে তোমরা কখনো নাক গলাবে না। কেনো এমন করো?”
আমি ভয় পাই। মেয়েটাকে ভয়ের দৃষ্টিতেই দেখতে থাকি। কেমন যেন ভয়ে চুপসে যায় আমি। ভয় পাওয়ার কারন, মেয়েটা উদ্ভট টাইপ আচরন করে মা বাবার সাথে কথা বলছে। কাজের লোকটা আমাকে প্রায় টেনে নিয়েই যায় স্টুডেন্ট এর ঘরে। ক্লাস নাইনের স্টুডেন্ট ও। বেশ মজার একটা ছেলে। সপ্তাহে তিনদিন পড়াতে আসতে হবে। এরপর যতবারই পড়াতে এসেছি, সেই রুমের দরজা খোলা দেখতাম। আড়চোখে তাকাতাম, একটা মেয়ে পাগলিদের মত করে বসে থাকতো। আবার যখন পড়ানো শুরু করবো তখন চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হতো।
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
এমনটা রোজকার রুটিন ছিল। প্রতিদিন পাশের ঘর থেকে আমি কাঁচের গ্লাস ভাঙার শব্দ, ঝগড়ার শব্দ, কান্নাকাটির শব্দ, আর বলতে শুনতাম “আমার ছুরিটা কোথায়?” বুঝেছিলাম মেয়েটার মেন্টালি কিছু প্রবলেম আছে হয়ত। নিজের হাত কাটতো, না খেয়ে থাকতো। সামনে যা পেত তা ছুড়ে মারতো। ঝগড়া করতো। জীবনের থেকে শুধু নামটাই জেনেছিলাম “জেরিন।” এরপর কখনো জীবনের সাথে ওর আপুর বিষয়ে কোনোদিন কথা বলা হয়নি। কি না কি হয়ত মনে করতো ভেবে জিজ্ঞাসা করিনি।
.
“এই যে জায়িন সাহেব, চুপ করে আছেন কেনো? ওহ আমাকে দেখতে বাজে লাগছে তাইনা?”
একটু ঝাড়ি নিয়েই কথাটা বললো জেরিন। আমি ভয়ে ঢোক গিললাম। এমনিতেই মেয়েটা বেশ সুন্দর। তার উপর শাড়ি পরেছে। হালকা সাজুগুজও করেছে। এই প্রথমবার তাকে আমি শাড়িতে এবং বেশ গোছালো ভাবে দেখছি। তার উপর প্রথমবার কথা হচ্ছে। কেমন যেন ভয় ভয় করছে আমার। না জানি রেগে যেয়ে কি করে বসে। আমি একটু মুচকি হাসলাম। জেরিন দরজার মাঝে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে কোনো ভাবেই আমি বের হতে পারবো না।
পিছনে তাকালাম। আংকেল আন্টিকে বসে থাকতে দেখি। আংকেল পেপার পড়তে ব্যস্ত, আর আন্টি টিভি দেখছে। ওনাদের মেয়ে যে এভাবে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটা ওনারা যেন ফিরেও তাকাচ্ছে না। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। এ পাগল মেয়ে না জানি এখন কোনো কান্ড করে বসে কিনা কে জানে।
– আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে।
– কেমন? হট নাকি সাধারন?
– একদম পরীর মতই।
– পরী দেখেছেন? মেয়েদের দিকে তাকাতে ভালো লাগে তাই না? বেয়াদপ ছেলে কোথাকার। এত মেয়েদের দিকে তাকাতে হয়? আমাকে বলতেন আমি আপনার সামনে এসে দাঁড়াতাম। আমার দিকে তাকাতেন। এরপর যদি শুনি তাকিয়েছেন তো আপনার চোখে আঙ্গুল দিয়ে চোখ তুলে নিয়ে আসবো। দেখেছেন আমার হাতে কতবড় নখ?
জেরিনের কথা শুনে আমার ঠিক কি বলা উচিৎ তা ভেবে পাচ্ছি না। হাসবো নাকি কাঁদবো সেটাও বুঝতে পারছি না। যদিও ওর কথাগুলো শুনে মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে আমার। আসলেই কি তার কোনো সাইকোলজিক্যালি প্রবলেম আছে? এভাবে কেনো কথা বলছে? পরী কোথা থেকে দেখবো আমি? মেয়েদের দিকে কারন ছাড়া তাকায় না। আর আপনিও তো একটা মেয়ে, তাহলে আপনার দিকেও কেনো তাকাবো? কথাগুলো বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভয়ে বলতে পারিনি।
জেরিন নখ দেখিয়ে সামনে থেকে চলে যায়। আমি বড় একটি নিঃশ্বাস নিই। তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় আসি আমি। কি মনে করে বাড়ির দিকে একবার ফিরে তাকালাম। জেরিনকে ব্যালকণিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। এটা প্রায়শই হচ্ছে। আগে প্রথম প্রথম যখন আসতাম পড়াতে,আসার সময় জেরিনকে দেখতাম ব্যালকণিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। চুলগুলো বারবার আঙ্গুল দিয়ে পেঁচিয়ে খেলা করছে। আবার মাঝে মাঝে দেখেছি লম্বা চুলগুলো গ্রীলের ফাঁক দিয়ে বের করে নিচে নামিয়ে দিয়ে খেলা করতে।
পড়ানো শেষ করে যখন ফিরতাম প্রথম প্রথম মেয়েটাকে আর ব্যালকণিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি। তবে আজ বেশ কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করেছি আমি বের হওয়ার পরই মেয়েটা ব্যালকণিতে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আগে আকাশ দেখতো এখন আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
২
তিনদিন পর পড়াতে এসেছি। বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করেই শুনতে পাই “আমার টাকা লাগবে, আমাকে এখনি টাকা দাও। কেনো টাকা দিচ্ছো না তোমরা? আমি মরে যাচ্ছি, আমার নেশা করতেই হবে। আমি বাঁচতে পারছি না। আমার এখনি টাকা দাও।”
জেরিনের বলা কথাগুলো শুনে বড় রকমের অবাক হলাম। মাথার ভিতরে কতগুলো কথা একনাগাড়ে এসে জমা হতে থাকে। কিছু ভাববার আগেই বড় কিছু পড়ার শব্দ শুনতে পাই আমি। ওর রুমে টিভি ছিল সেটা জোরেই আঁছাড় মেরেছে ও। “দেখ মা, আমরা ভূল করেছি, এবার তো আমাদের মাফ করে দে। তুই কেনো এমন করছিস? তোর জন্য ডক্টরের কাছেও যেতে পারছি না। যেতে চাস না তুই। দুই দিন পর পর তোকে কতগুলো টাকা দিতে হয়। কেনো এমন করছিস তুই?”
আংকেলের কথা শুনতে শুনতে কখন যে ঐ রুমে প্রবেশ করলাম ঠিক বুঝতেই পারিনি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জেরিনকে বলতে শুনি “আমি কিছু শুনতে চাই না, আমি টাকা চাই। আমার নেশা করতেই হবে। দেখ তোদের বলছি তাড়াতাড়ি টাকা দে। না হলে আমি নিজেকে মেরে ফেলবো। আর নোট লিখে রাখবো, তোরাই দায়ী। আমার এখনি টাকা দে। না হলে…”
জেরিন একদমই উন্মাদের মত আচরণ করতে থাকে। এতদিন পর বুঝেছি সে নেশার জন্যই এমন আচরণ করতো। বাকি সময় একদমই স্বাভাবিক। এত সুন্দর একটা মেয়ে, বিশাল বাড়ির এই মেয়েটা এমন নেশা করবে কখনো উপলব্ধি করিনি। জেরিন কথাগুলো বলে ওর টেবিলের উপরে রাখা মাছের একুরিয়ামে জোরে একটা ঘুসি দেয়। একুরিয়ামটা নিচে পড়ার আগেই জেরিনের হাত কেঁটে রক্ত বের হতে থাকে। আংকেল আনটিরা ছুটে ওর দিকে আসবে জেরিন বলে “কেউ আমাকে ছুবে না।” কথাটা বলে বালিশ উঁচু করে সেইদিনের ছুরিটা হাতে নেয়।
আংকেল ছুটে আসবে তার আগেই জেরিন আবার বলে “বললাম না আমার কাছে কেও আসবে না। আমাকে বাধা দেবে না কেও। নিজেকে মেরে ফেলবো।” আমি এগিয়ে গেলাম। জেরিনের সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম। জেরিন আমার দিকে তাকিয়ে রইল। পুরো বাড়িটা তখন একদম চুপচাপ হয়ে গেছে।
পাগলি মেয়েটাও আমার দিকে চুপ হয়েই তাকিয়ে আছে। আংকেল আন্টিরা হয়ত ভাবেনি আমি আসবো, যদিও অনুমতি ছাড়াই রুমে প্রবেশ করেছি। আমিও কিছু না বলে জেরিনের হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিলাম। অবাক করা বিষয় জেরিন কিছু না বলেই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এমনকি ছুরিটা নেওয়ার পরও সে চুপচাপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওকে ধরে বিছানায় বসালাম। একদম শান্ত মেয়ের মত অপলক হয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আংকেলকে বললাম “বাসায় স্যাভলন আর তুলা আছে?” উনি হুম বলে দৌড়ে চলে যান। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি স্যাভলন আর তুলা নিয়ে আসে। জেরিনকে বিছানায় বসিয়ে ওর পাশে বসলাম আমি। ওর ডান হাত টেনে নিয়ে আমার পায়ের উপর রেখে দিলাম। স্যাভলনের বোতল থেকে তুলার সাথে লাগিয়ে ওর হাত যেখানে যেখানে কেটে গেছে সেখানে স্যাভলন লাগাতে থাকি।
একবার আড়চোখে জেরিনের দিকে তাকালাম। ও আমার মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। মেয়েটা যখন রেগে ছিল ওর নাগের ঢগা লাল হয়ে কেমন যেন লাগছিল। এখন বেশ স্বাভাবিক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বেশিক্ষন জেরিনের দিকে তাকানোর সাহস পেলাম না আমি। আংকেলদের দিকে তাকালাম। ওনারা একবার অবাক হয়ে জেরিনের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার আমার দিকে তাকাচ্ছে। ওনারা হয়ত ভাবছে “এমন অশান্ত মেয়েটাকে আমি কিভাবে এত তাড়াতাড়ি শান্ত করে ফেললাম, যে কিনা নেশায় পুরো বুদ হয়ে আছে।”
.
– এরপর যদি আর কোনোদিন পাগলামো করতে দেখেছি, জীবনের বদলে আপনাকে এসে পিটিয়ে যাবো। শান্ত ভাবে থাকবেন। আর যেন নেশা করতে না শুনি।
কথাগুলো বলে চলে আসবো তখনি জেরিন বলে ওঠে.. “আপনি এভাবে রোজ কেয়ার নিবেন তো? আদর করে বকা দেবেন তো?” আমি থেমে যায়। ঠিক কি বলবো বুঝতে পারছি না। আংকেল আন্টিদের দিকে তাকালাম। ওনারা ইশারায় সম্মতি দিতে বললো। কিন্তু কেনো দিতে বলল? আমি তো রোজ কেয়ার নেবো না। বড় কথা আমি কেনোই বা কেয়ার নিতে যাবো? ঘুরে জেরিনের দিকে তাকালাম। হাতটা তখনো সামনে মেলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন যেন বাচ্চা বাচ্চা লাগছে মুখটা। গোল গোল চাহনি আর আবেগী আলাপনে আমি কখন যে হ্যা বলে দিলাম নিজেই তা বুঝতে পেরে অবাক হই।
আর সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে সোজা চলে আসি। সেদিন আর পড়ায়নি। পড়াতে ইচ্ছেই করেনি। মেয়েটা নেশা করে। হয়ত আগে করতো না। কিন্তু কেনো করে? মা বাবার সাথে নেশা খোরেরাই এমন করে কথা বলে। বিষয়টা আমাকে অনেক ভাবায়। জেরিনের মা বাবার কাছে শুনতে হবে সব।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাড়ির বাইরে আসি। আজকে পিছনে তাকাতে ইচ্ছে করছে না। ভাবনাতে “জেরিন কেনো এমন?” প্রশ্নটা চলাচল করছে। বাইরে আসতেই শুনতে পেলাম “এই যে জায়িন সাহেব, কালকে তাড়াতাড়ি আসবেন।” আমি একটু তাকায়। জেরিন ব্যালকণিতে দাঁড়িয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওর ডান হাতে ফুঁ দিতে লাগল। আমি ওর কান্ড দেখে একটু হাসলাম। আমি তখনো অবাক হয়ে আছি আমি কাজটা কি করেছি।
৩
অনেকটা সকালে বাড়ি থেকে বের হলাম। আগে তেমন বের হয়নি। তবে আজকে সকালে হাঁটতে বেশ ইচ্ছে করছে। অবশ্য আজকে সকালে ঘুমায়নি বলেই বের হলাম। কাল মাঝ রাতে জেরিনের বাবার ফোন পেয়ে অবাক হয়েছিলাম খুব। প্রথমবার রিং হতেই ভাবনাতে চলে আসে “জেরিন কি আবার পাগলামো শুরু করেছে?” ভাবতে ভাবতে আবার রিং আসে। নাম্বারটা জীবনকে পড়ানোর ব্যাপারে সেভ করা ছিল আগেই। তাই আর দেরি না করে রিসিভ করলাম। “জায়িন, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। তুমি জানো এত চেষ্টা করেও আমরা ওকে টাকা না দেওয়া অবদি সে কখনো চুপ করেনি। পুরো বাড়িতে প্রায় সে সামনে যা পেত তা ভেঙে ফেলতো। ওর জন্য রোজ আমার কত অপমানও সহ্য করতে হয়। কিন্তু আজকে তোমার জন্যই সেই যে মেয়েটা চুপ চাপ শান্ত হয়ে আছে যা সত্যিই অবাক করার মত। কোনো ভাবে ঘুমের ঔষধ দিয়ে ওকে ঘুম পাড়াতে হয় আমাদের। প্রায়শই না খেয়ে থাকে ও। কিন্তু আজ কি করেছে জানো? তুমি যাওয়ার একটু পরেই সে নিজে থেকে ওর মায়ের কাছে খাবার চেয়েছে। তোমার আন্টি আমার দিকে বড় বড় চোখে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে ছিল। আমরা অনেকটাই খুশি। জেরিনের মা যখন খাবার খাওয়ানোর জন্য ওর ডান হাত স্পর্শ করবে তখনি সে চিল্লিয়ে বলে ওঠে “আমার এই হাত আজকে কেউ ছোঁবে না। আর আমি এখন ঘুমাবো। কেউ যেন না জ্বালায়।” বাবা জায়িন, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমার মেয়েটাকে একটু খেয়াল রেখো।”
.
উনি ফোন কেটে দেয়। আমি ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে কিছুক্ষর ফোনের স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে থাকি। কিছুই বুঝতে পারছি না জেরিনের হঠাৎ কি হল? আমার কথা শুনেই জেরিন এমন বিহেভ করবে কেনো? আংকেলই বা খেয়াল রাখতে বললো কেনো? ধুর কিছুই মাথায় আসছে না আমার। বাকিটা রাত আর ঘুম আসেনি। প্রশ্নগুলো নিয়ে ভেবেছি অনেক। তাই সকাল হতেই হাঁটতে বের হলাম। ছোট পার্কের ভিতরে আসতেই দেখি জেরিনের বাবা বসে বসে হাঁপাচ্ছে। জগিং করার জন্য দৌড়ে এসে জিরোচ্ছে। কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেলো।
আমি সামনে গেলাম। আমার দিকে বেশ খোশ মেজাজেই তাকালেন তিনি। ইশারায় পাশে বসতে বললেন। আমিও বসে গেলাম। জেরিন কেনো এমন নেশা করে প্রশ্নটা অনেক আগে থেকেই ভাবাচ্ছে। কিন্তু ওনাকে জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছিলাম না।
– কেমন আছো? সারারাত ঘুমাওনি তাইনা? আমরাও ঘুমাতে পারতাম না। কখন যে ও পাগলামো করতো, ওর রুমে দুজন সারারাত বসে থাকতে হয়। কিন্তু কাল রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পেরেছি। মেয়েটা এখনো ঘুমাচ্ছে।
জেরিনের আলাপ করাতেই কেমন যেন সাহস পেলাম। প্রশ্নটা করতে যাবো তখনি আংকেল বলে..”ভাবছো মেয়েটা কেনো এমন করত? আসলে ছোট থেকেই ওকে আমরা কখনো খেয়াল করিনি। রাখিও নি। আসলে তোমার আন্টি ডক্টর, আর আমার তো এমন ব্যবসা, কখনো রাতে কখনো দিনে এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। জেরিন হওয়ার পর থেকেই ওকে দেখার জন্য কাজের লোক রাখা হয়। তারপর আমরা আমাদের মত করে চলতে থাকি। কখনো জানতে চাইনি সে কেমন আছে,কি করছে, খেয়েছে কিনা, কি পরবে ও, কি লাগবে ওর? কখনো জানতে চাইনি। রোজ পালা করে ওকে টাকা দিতাম। একদিন টাকা দিতে পারিনি বলে প্রথম ও আমাদের সামনে এমন রিএ্যাক্ট করে। বুঝেছিলাম সে সেই টাকা দিয়ে নেশা করতো নিজের রুমে বসেই। সবসময় সে একা থাকতো। চুপচাপ থাকতো। দরকার ছাড়া কখনো কারো সাথে কথা বলেনি। আমাদের সাথেও না। প্রতিবেশিরা ওর এমন আচরণে আমাকে অনেক কিছুই বলতো। কিন্তু…
আংকেলের দিকে তাকালাম। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো ওনার। আমি বললাম “সরি আংকেল আপনাকে ইমোশন করে দিয়েছি।” উনি মুচকি হেসে বলে “আরে ধুর পাগল, কোনো ব্যাপার না। আমার মেয়েটাকে বাঁচাও প্লীজ। আমি বুঝে গিয়েছি আমার মেয়েটা তোমাকে চাই। তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে ও। তুমি যখন পড়াতে বসো অনেকবার জীবনের রুমের সামনে দিয়ে পায়চারি করেছে জেরিন। আমরা দেখে হাসতাম। ব্যালকণিতে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো তোমাকে দেখবে বলে। প্লিজ ওর পাশে তুমি সবসময় থেকো। জানি ও নেশা করে এ কারনে তুমি এড়িয়ে চলো, তবুও তুমি একবার চেষ্টা করো, ও তোমার সব কথা শুনবে, কাল রাতেই বুঝেছি।”
.
আংকেল আর বসলো না। উনি জগিং করতে করতে দৌড়ে চলে গেলেন। আমি হাবার মত বসে আছি। সে কারনেই সেদিন দরজার সামনে ও শাড়ি পরে আমার সাথে যেভাবে কথা বলছিল আংকেলরা কেনো কিছু বলেনি। আমিও আর বসলাম না। বাড়ির দিকে চলে আসি।
৪
“এত দেরি করে আসলেন কেনো?”
জেরিনদের বাড়িতে ঢুকতে যাবো তখনি দেখি মেইন গেইটের সামনে জেরিন দাঁড়িয়ে আছে। আমার সামনে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে ওর নিঃশ্বাস আমার গায়ে এসে পড়ছে। আমি হালকা পিছিয়ে এসে দাঁড়ায়। হাত ঘড়ির দিকে তাকালাম। পড়াতে আসতে এখনো দশ মিনিট বাকি। কই দেরি করলাম? এ পাগলি মেয়েটা যে কি বলে নিজেই জানেনা।
– আমার দিকে তাকাচ্ছেন না কেনো? দেখুন না আজকে আমাকে কেমন লাগছে। আমার প্রিয় রং এর ড্রেস পরেছি। দেখুন না চুলগুলো মা নিজেই গুছিয়ে দিয়েছে। দেখুন না চোখে হালকা করে কাজল দিয়েছি। জানি দেখতে খারাপ আমি। তবুও বলুন না কেমন লাগছে?
আংকেলের থেকে সবটা শোনার পর জেরিনের উপরে যে ভয় কাজ করতো তা সরে যেয়ে কেমন যেন একটা অন্যরকম অনুভুতি আসতে থাকে। জেরিনকে কেমন অসহায় অসহায় লাগছে আমার কাছে। মেয়েটা ছোট থেকেই এমন একা থাকে। যা সত্যিই অসহায়ত্বের ব্যাপার। ওর পাশে থেকে ওকে আগলে রাখতে ইচ্ছে করছে। আমি মুচকি হাসলাম। জেরিনের ডান হাতের দিকে তাকালাম। কালকের সেই রক্ত এখনো লেগে আছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে ডান হাত এখনো পরিষ্কার করেনি।
– আপনার হাতে এখনো রক্ত লেগে আছে।
– হুম, এখনো ভিজাইনি। গোসলের সময় সাবধানে রেখেছিলাম যেন না ভেজে।
– কেনো? (একটু ঝাড়ি দিলাম)
– জানিনা। (মাথা নিচু করে নিল)
– বলুন।
– আপনি ছুয়ে ছিলেন বলে। আপনার স্পর্শ যেন সবসময় থাকে।
– পাগল নাকি আপনি?
মেয়েটার কথা শুনে হাসবো না বকা দেবো নাকি কাঁদবো কিছুই বুঝতে পারছি না। মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে। হয়ত খায়নি ও।
– আচ্ছা সরুন, পড়াতে যাবো।
– না। (জেরিন)
– কেনো?
– আজকে অনেকটা রাত অবদি দুজন হাঁটবো ঘুরবো। আপনি আইস্ক্রীম কিনে দেবেন।
– কিহ? না না পড়াতে হবে। আপনার আব্বু জানতে পারলে পিটাবে।
– সবাই জানে, কেউ কিছুই বলবে না। কারো কিছু বলার সাহস নেই। সবাই আমাকে ভয় পাই।
– আমি তো পাই না।
– হুমম, আর আমি আপনাকে ভয় পাই। (জেরিন)
– দুপুরে খেয়েছেন?
– না। (জেরিন)
– আচ্ছা তাহলে বাসায় যাচ্ছি। আমি তো ঘুরবো না। দুপুরে খান নি কেনো?
– বাবাকে বলেছিলাম আপনার নাম্বার দিতে। কিন্তু তিনি দেয়নি। তাই রাগ করে না খেয়ে আছি। প্লীজ চলুন না ঘুরতে। আমি কিন্তু কান্না করবো।
– যেতে পারি যদি এখনি কিছু খেয়ে আসেন। (আমি)
– আচ্ছা আচ্ছা,, এখনি যাচ্ছি। আপনি ভিতরে এসে বসুন।
– আর শুনুন, হাতটা ভালো করে পরিষ্কার করবেন।
– না।
– ভাবছিলাম আপনার হাত ধরে সারাটা পথ হাঁটবো কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে চলে যেতেই হবে।
– ইন্না… না না, এখনি সব করছি। আপনি ভিতরে আসুন।
জেরিন দৌড়ে চলে যাচ্ছে। কয়েক পা যেয়ে থেমে যায়। আমার কাছে আবার দৌড়ে আসে। আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিয়ে বলে.. “আমার সাথে আজীবন এমন মিষ্টি শাষন, আদর আর কেয়ার নিয়ে থাকবেন?” কথাটা বলে সে আর দাঁড়ালো না। দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো। আমি এগিয়ে গেলাম। শুনতে পেলাম “মা তাড়াতাড়ি খেতে দাও। আমি ওয়াশ রুমে গেলাম।” আমি হাসলাম। মেয়েটার এমন উদ্ভট প্রপোজ শুনে ঠিক কি বলবো আমি পরে ভেবেই চলেছি। আপাতত বাড়ির ভিতরে যেয়ে তো বসি। পরে না হয় ভেবে কিছু একটা বলা যাবে।
—“(সমাপ্ত)”—-