#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৮৫|
মানুষের চারপাশ ঘিরে একটি বৃত্ত থাকে। যা কখনো জটিল। কখনো আবার খুব সহজ আর সুন্দর। ছোট্ট একটি জীবন। যার উত্থানপতন ঘটে বিস্তর। এসব মেনে নিয়েই জীবনের পথে অগ্রসর হতে হয়৷ জীবনের নিয়ম এটাই৷
দুপুরের আগমুহূর্তে আইয়াজ, ফারাহ এসে পৌঁছাল। ছ’মাসের উঁচু পেট নিয়ে ফারাহকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে প্রায় ছুটে এলো নামী৷ সাবধানে জড়িয়ে ধরে আবেগাপ্লুত হয়ে উঠল৷ ওর চোখে জল চিকচিক করছে। ফারাহ আবেগটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ কেঁদে ফেলল আচমকা। অভিমানী মনটা অভিযোগ তুলল শতশত। আইয়াজ সৌধ, সুহাসের সঙ্গে কুশলাদি সম্পন্ন করে ব্যাগপত্র নিয়ে ভেতরে এলো৷ নামী সাবধানে ফারাহকে ধরে এনে লিভিং রুমে বসল৷ ফারাহর মাথায়, শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে গেছে তোর! আমার গুলুমুলু বান্ধবীটার এত্ত পরিবর্তন। ঠিকঠাক খেতে পারিস না? বমি হয়? খাবারে অরুচি খুব? শোন আমি তোর পছন্দের সব রেঁধে খাওয়াব। অনেকদিন থাকতে হবে কিন্তু।’
‘ হয়েছে হয়েছে। নির্লজ্জের মতো কাছে এসেছি বলে দরদ দেখাচ্ছিস। তুই কত নিষ্ঠুররে নামী! এতগুলো দিন কীভাবে পারলি। ‘
ওরা একে-অপরের সঙ্গে কথায় মশগুল। ফারাহ অভিমান করে করে অনেক কথা বলল। নামী মৃদু হেসে ওকে বুঝিয়ে অভিমান ভাঙাল। একে অপরকে আরো একবার জড়িয়ে ধরে পিঠ বুলিয়ে দিল। এরপর ফারাহ উতলা হয়ে বলল,
‘ বাবু কোথায় রে? ওকে প্লিজ নিয়ে আয়। সামনাসামনি দেখে চোখটা জুড়াই। ‘
আর দেরি করল না নামী। উপরে গিয়ে সিমরানের থেকে সুহৃদকে নিয়ে এলো। ননদকে বলেও এলো, নিচে আসতে। ফারাহর কাছে নিয়ে আসার আগেই সুহৃদকে কোলে তুলে নিল আইয়াজ। দু-হাতে উঁচিয়ে ধরে বলল,
‘ আমাদের সুহাসের ব্যাটা নাকি? মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ। ‘
চশমাওয়ালা অপরিচিত মুখ দেখে হাসল সুহৃদ। হাত বাড়িয়ে চশমা ধরে খেলতে লাগল৷ আইয়াজের দুপাশে সৌধ, সুহাস৷ তিন বন্ধু মিলে অনেকক্ষণ মজা করল সুহৃদকে নিয়ে। সুহাসকে ক্ষ্যাপালো একটু। নামী, ফারাহ দূর থেকে ওদের কাণ্ড দেখে হাসল ভীষণ। সিমরান সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল। শুনতে পেল আইয়াজ ভাইয়া বলছে,
‘ এই সৌধ তুই তো পিছনে পড়ে গেলি ভাইই। প্রাচী নেক্সট ইয়ার একদম বেবি সহ বাংলাদেশে আসবে। তুই কি বসে বসে মুড়ি খাবি? আমাদের এতগুলো আব্বাজানের জন্য একটা আম্মাজান আনার ব্যবস্থা করবি না? ‘
আইয়াজের কথায় ফারাহ ফোঁড়ন দিয়ে বলল,
‘ এতগুলার জন্য একটা আম্মা মানে কি আয়াজ!
এক আম্মায় কী হবে? বাবা কয়টা হিসেব আছে? নিধি আপুর অনি, আমাদের একজোড়া, সুহৃদ বাবা৷’
মিটিমিটি হাসল নামী, সুহাস৷ এরপর হাসির ছলে নামী বলল,
‘ এক আম্মা আনলে কিন্তু ভেজাল হয়ে যাবে আয়াজ ভাই। ‘
দেহ শিরশির করে উঠল সৌধর৷ খেয়াল করল সিমরান আসছে৷ ত্বরিত আইয়াজের দিকে বড়ো বড়ো করে তাকাল৷ ইশারা করল চুপ করতে৷ সুহাসের মুখে হাসি হাসি ভাব দেখে ফিসফিস করে বলল,
‘ তুই কি ভুলে গেলি আমার বউ তোর বোন। ‘
ব্যস! বিমর্ষ মুখাবয়বে যাও একটু হাসির ঝাপটা লেগেছিল৷ সৌধর খোঁচা পেয়ে তা মুছে গেল। ওদের বন্ধুদের এসব কাণ্ড দেখে, শুনে তীব্র লজ্জায় লাল হয়ে গেল সিমরান। প্রচণ্ড ইতস্ততভাবে নিচে এসে আইয়াজ, ফারাহকে জিজ্ঞেস করল,
‘ কেমন আছো তোমরা? ‘
নিমেষে ফারাহ উঠে দাঁড়াল। কান্না পেয়ে গেল ভীষণ। কাছে টেনে জড়িয়ে ধরল সিমরানকে। একটা নারী বুক আর আদর পেয়ে সিমরানও কেঁদে ফেলল। নামী টের পেল, মেয়েটা অভিমান করে তার কাছে আসছে না৷ অথচ তাকে ভীষণ প্রয়োজন ওর ভীষণ। সিমরানের কান্না দেখে কিছুক্ষণ পূর্বের উৎফুল্লতা মিলিয়ে গেল৷ মুখভার হয়ে গেল সুহাস, সৌধর৷ আইয়াজ ওদের কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘ ঠিক হয়ে যাবে। একটু সময় লাগবে৷ তোরা শক্ত থাক। ‘
সুহাসকে স্পেশালি বলল,
‘ পুরুষ মানুষ আমরা৷ আমাদের শক্ত থাকতেই হবে। তবেই না আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নরম মনের নারীদের ভরসার জায়গা হতে পারব। ‘
কথাটা বলেই ফারাহর কাছে গেল আইয়াজ৷ সিমরান চোখ মুছে বসল। ফারাহ ওকে সান্ত্বনা দিয়ে সুহৃদকে কোলে তুলে নিল৷ আদর করল বান্ধবীর ছেলেকে। মন ভরে চুমু খেল কপালে, গালে। এরপর সিমরানের কোলে দিয়ে বলল,
‘ এমন মিষ্টি একটা আব্বু থাকতে কেউ এভাবে কাঁদে সিনু?’
ম্লান হাসল সিমরান। আলতো করে সুহৃদকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফারাহ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ফের বলল,
‘ শক্ত হও বনু। তুমি কত ভাগ্যবতী জানো? আমাকে দেখো, বাবা নেই, মা নেই৷ একটা বোন আছে৷ ভাগ্যের নির্মমতায় তাকেও পাশে পাই না। তোমার সুহাস ভাইয়ের মতো একটা ভাই আছে। নামীর মতো ভাবি আছে, সুহৃদ আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা সৌধ ভাইয়ের মতো হাজব্যান্ড আছে। এদের জন্য শুকরিয়া করো। আল্লাহ তায়ালা একেবারে কাউকে নিঃশ্ব করে না। ‘
ফারাহ কথা শেষ করতেই নামী সিমরানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ পৃথিবীতে কোনো মানুষই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়৷ আমি জানি সুহাস আর আমার সম্পর্কের জটিলতার কারণে শেষবেলায় বাবা আমাদের আর সুহৃদকে দেখতে পারেনি। এরজন্য সবচেয়ে বেশি কষ্ট আমি পাচ্ছি। কারণ আফসোসটা সবার চেয়ে অনেক বেশি আমার। কিন্তু মৃত্যুর ওপর আমার হাত নেই। জন্ম, মৃত্যুতে আমাদের কারো হাত থাকে না। ‘
চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াল নামীরও৷ সিমরান চুপচাপ শুনল ওর কথা। বলল না কিছুই। ফারাহ বলল,
‘ হ্যাঁ রে আমরা সবাই সেটা জানি, বুঝি৷ সিনুও বুঝে সেটা। তাই না? ‘
মৃদু চমকাল সিমরান৷ এক পলক নামীর পানে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। কী যে অদ্ভুত এক অভিমান চেপে ধরেছে তাকে। ইচ্ছে হলেও কথা বলতে পারছে না৷ সৌধ এসে ওর কোল থেকে সুহৃদকে নিয়ে নামীকে কী যেন ইশারা করল। নিমেষে সিমরানের মুখোমুখি হলো নামী। কাছে এসে ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু এঁকে বলল,
‘ বড়ো ভাই, ভাবি বাবা, মায়ের মতো সিনু৷ আমি, সুহাস সবসময় তোমার পাশে আছি। ঠিক বাবা, মা যেভাবে থাকত সেভাবেই চেষ্টা করব আমরা। তাদের অভাব পুরোটা পূরণ করতে পারব না হয়তো৷ যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করব৷ তুমি প্লিজ আর অভিমান করে থেকো না৷ এই ভাঙা পরিবারটা আমি শক্ত হাতে গড়ে তুলতে চাই। রাই বাঘিনী ননদিনী হয়েই না হয় পাশে থাকো। তবু নিজেকে আমার থেকে নির্লিপ্ত করে রেখো না৷ ‘
ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল সিমরান৷ ভেতর থেকে সমস্ত অভিমান উপচে এলো। সহসা দু’হাতে জড়িয়ে ধরল নামীকে। বুকে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো ফুঁপাতে লাগল। এ দৃশ্য দেখে সুহাস সরে গেল ওখান থেকে। সে ভাঙবে না, কিছুতেই না৷
আইয়াজ, সৌধও সুহৃদকে নিয়ে ওর পিছু পিছু উপরে উঠে গেল৷
.
.
বাড়ির সবাই রান্নাবান্নায় ব্যস্ত৷ আজ সুহাসের বন্ধু, বান্ধবে ভরপুর বাড়ি৷ আগামীকাল অনাথ শিশু, আর গরিবদের একবেলা খাওয়ানো হবে৷ দোয়া করা হবে বাবা, মায়ের নামে। এরপর সুহাসের মামা, মামি আর কাজিনরা চলে যাবে। থেকে যাবে শুধু নানু মনি। সুহাসের ভরা সংসার না দেখে এক পাও নড়বেন না বৃদ্ধা।
প্রাচী বলেছিল সবাই আণ্ডাবাচ্চা সহ এক হয়ে ভিডিও কল দিতে৷ দুপুর হয়ে এলো। অথচ আজিজ আর নিধির খবর নেই। বাধ্য হয়ে ওরা লাঞ্চের জন্য ডাইনিংরুমে এলো। সৌধ, সিমরান, আইয়াজ, ফারাহ পাশাপাশি বসেছে৷ সুহাস বসলে নামীকে ওর পাশে বসতে বলল আইয়াজ৷ নামী বসল না৷ সেলিনা আপার সঙ্গে মিলে সবার পাতে খাবার তুলে দিল। সুহাস ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে অত্যন্ত গম্ভীর মুখে তাকাল নামীর পানে। ঠান্ডা গলায় বলল,
‘ সেলিনা আপা তো আছে। বসলে সমস্যা কোথায়। এখানে সবাই আমরা আমরাই। নিজেরটা নিজে নিয়েই খেতে পারব। ‘
সুহাসের পেটে গুঁতো দিল সৌধ। কণ্ঠ নিচু করে বলল,
‘ এত সিরিয়াস হয়ে থাকিস না তো। নিজের ফর্মে ফিরে আয় দোস্ত৷ ‘
সুহাসকে কথাটা বলে মুখে হাসি টেনে গলা চওড়া করে নামীকে বলল,
‘ নামী বসো, বসো। তিন বন্ধু খেতে বসেছি৷ তিনজনের পাশে বউ থাকলে ব্যাপারটা সুন্দর হবে৷ ‘
সৌধর কথা শুনে লজ্জা পেল সিমরান৷ আড়চোখে তাকিয়ে পানি খেলো৷ আইয়াজ বউয়ের পাতে খাবার তুলে দিতে দিতে ওর কথায় সহমত পোষণ করল। সবার তোষামোদে বসল নামী। নিমেষে চোখ জুড়ানো দৃশ্য তৈরি হলো৷ ওরা তিনজন টুকিটাকি গল্প করতে করতে খাচ্ছিল। আইয়াজ ভীষণ যত্ন নিয়ে ওটা, সেটা তুলে দিচ্ছিল ফারাহর পাতে৷ ফারাহ নাক কুঁচকালেও স্বামীর মিষ্টি শাসনে খেতে বাধ্য হলো। সবার মাঝে সবচেয়ে কম খেলো সিমরান। সে অল্প একটু খেয়ে আচমকা উঠে দাঁড়ায়। মুহুর্তেই সৌধ বাম হাত বাড়িয়ে ওর বাহু টেনে ধরে। সুগভীর দৃষ্টিজোড়া মেলে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলে,
‘ পেট ভরে গেছে? আমার তো ভরেনি। মাছ খেতে ইচ্ছে করছে। নাও বসো কাঁটা বেছে দাও৷ ইউ নো হোয়াট তোমার বর মাছের কাঁটা বাছতে জানে না। ‘
এ কথা শুনে আইয়াজ মুচকি হেসে বলল,
‘ হ্যাঁ সিনু, তোমার বর দুনিয়া উদ্ধার করতে পারলেও কাঁটা বেছে মাছ খেতে পারে না৷ আর কাঁটা সহ খেলে নিজেকে উদ্ধার করতে হিমশিম খায়। ‘
সুহাস চুপচাপ থাকলেও আইয়াজের কথা শুনে সৌধকে টিপ্পনী দিল,
‘ ঢঙ সব। ‘
সৌধ পাত্তা দিল না ওদের কথায়৷ সিমরান গায়ে জড়ানো চাদরটা আরো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে বসে কাঁটা বাছতে শুরু করল। সে কাঁটা বেছে সৌধর প্লেটে দেয় আর সৌধ নিজে খাওয়ার পাশাপাশি তার মুখেও তুলে দেয়৷ সিমরান নিতে চায় না অবশ্য৷ সৌধ আলতো হেসে বলে,
‘ ত্যাড়ামি নারীদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থাকে। অন্তত উপস্থিত তিনজন নারীর অবস্থা সেটাই প্রমাণ করে দিয়েছে। নাও হা করো৷ কী খেয়েছ পেটই উঁচু হয়নি। নো ঘাউড়ামি, কথা শোনো। ‘
সিমরান হা করল না। আইয়াজ সৌধর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘ পেট উঁচুর ব্যবস্থা করলেই পারিস। দেরি করিস না৷ তোদের বেবি নেওয়া উচিত। অন্তত সিনুর মাইন্ড অন্যদিকে ফোকাস করার জন্য এক্ষুনি নেওয়া উচিত। ‘
সৌধ চুপ করে রয়৷ কিছু বলে না। আইয়াজ মিটিমিটি হাসতে হাসতে সরে যায়৷ কেউ শুনতেই পায়নি ওর বলা কথাটি৷ আর না ধারণা করেছে সে এমন কথা বলেছে। বন্ধুমহল ব্যতীত সর্বমহলে বরাবর ইনোসেন্ট তকমা পাওয়া ছেলে কিনা…। সিমরান অবশ্য চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল৷ কিন্তু বুঝতে পারল না৷ সৌধ ভাজা মাছ দিয়ে ওর মুখে ভাত তুলেছে। তৃতীয়বারের মতো সে খাবার নাকোচ করলে চোখ গরম করল সৌধ। ঢোক গিলল সিমরান। সবার পানে একবার করে তাকিয়ে দেখল কেউ তাদের দেখছে কিনা৷ সৌধর থেকে শব্দহীন ধমক খেয়েছে সে৷ বিষয়টি অন্য কেউ টের পেলে ভীষণ লজ্জা পাবে৷ সম্মানে লাগবে৷ তাই ইচ্ছে না করলেও মুখে তুলল খাবার৷ নামী ফারাহর সঙ্গে টুকটাক কথায় ব্যস্ত ছিল। অকস্মাৎ গলায় খাবার আঁটকে কেশে উঠল। পাশে সুহাস। চকিতে তাকিয়ে ত্বরিত পানির গ্লাস সামনে ধরে। একনিশ্বাসে সে পানি খেয়ে নেয় নামী৷ সুহাস ওর মাথায় পিঠে মৃদু মৃদু থাপ্পড় দেয় তিনবার৷
.
আজিজ এলো ওরা খেয়ে উঠার পরপরই। এসে বন্ধু আর তাদের বউদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করে সুহৃদকে সোজা কাঁধে তুলে নিল। দুষ্টু সুহৃদ ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওর মাথার চুল গুলো কাকের বাসা বানাতে। নামী গেল আজিজের জন্য খাবার গরম করতে। ওকে সাহায্য করতে গেল সিমরান৷ তিন বন্ধু মিলে আজিজকে বেশ ভালোই ক্ষ্যাপালো। আইয়াজ বলল,
‘ কী বন্ধু বয়স তো বসে নেই৷ বিয়েশাদি করবি না? ‘
উত্তরটা বেশ সরল মুখে দিল আজিজ,
‘ আম্মা মেয়ে দেখতেছে। ‘
সৌধ খোঁচা মেরে বলল,
‘ আম্মাই তো দেখবে ভোলাভালা, অবলা পুরুষ তুই। মেয়ে মানুষ থেকে দশহাত দূরে থাকতিস কিশোরকাল থেকে। ‘
আজিজ কাঁধ থেকে কোলে বসাল সুহৃদকে। এরপর ওর দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ আমার মতো ভদ্রপোলা বাংলাদেশে বিরল তাই না?’
আজিজের কথা বলার ঢং দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল সুহৃদ। সে হাসি দেখে আনন্দে বিগলিত হয়ে মার্বেলের মতো চোখ দু’টো বড়ো বড়ো করে এমন
এক চিক্কুর দিল আজিজ,
‘ আরে সুহাইস্যার ব্যাটা কী হাসি দিছেরে। ‘
যে তাকানো, আনন্দ প্রকাশ আর চিৎকারে ভয় পেয়ে চোখমুখ খিঁচে কান্না শুরু করল সুহৃদ। সুহাস টের পেল তার ছেলে ভয় পেয়েছে। তাই গা লি দিল আজিজকে। ছোঁ মেরে সুহৃদকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখল। ছেলের কান্না শুনে ছুটে এলো নামী। পরিবেশ বদলে গেল আচমকা। সুহৃদের কান্না কিছুতেই থামছে না৷ আজিজ বেআক্কলের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সুহৃদের সামনে এসে কানে ধরল। কান্না বেড়ে গেল আরো। সকলে হতভম্ব। আজিজ পায়ে ধরল সুহৃদের। অধৈর্য্য হয়ে বলল,
‘ আরে বাপ থাম না৷ ‘
হতভম্ব আইয়াজ, সৌধ আজিজের কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল। ওর হাসি দেখে মুখে ওড়না চেপে আড়ালে হাসল সিমরানও৷ নামী এই হট্টগোলে ছেলেকে আর রাখলই না। সেলিনা আপাকে কাজ দিয়ে সে উপরে চলে গেল৷ ওদেরকে বলে গেল,
‘ চিন্তা করো না তোমরা৷ ঘুমের সময় হয়েছে ওর। একটু ভয়ও পেয়েছে তাই এমন করছে। আমি সামলে নিচ্ছি৷ ‘
নামীর পিছু পিছু সুহাসও গেল। আজিজ যখন খেতে বসবে তখন আগমন ঘটল নিধির৷ একটা ঝড় বয়ে প্রকৃতি শুনশান নীরবতায় ছেয়ে যাওয়ার পর এক টুকরো রোদ উঠার আনন্দ যেমন হয়৷ নিধির আগমনে অমন একটি আনন্দ হলো সবার৷ সৌধরা জেনেভা থেকে ফেরার পর নিধি এ বাড়িতে আসেনি আর৷ কারণ সিনুকে সামলাতে তখন সৌধ এসে গেছে৷ তাই আজ আসাতে সিমরান অনেক বেশি খুশি হলো। অনিরূপকে আদর করল কোলে নিয়ে। বলল,
‘ হাই বাবা, কেমন আছো তুমি? ‘
সিমরানের সঙ্গে কথা বলে আইয়াজ, সৌধ, ফারাহর সঙ্গে কথা বলল নিধি। ওরা খুব খুশি মনেই স্বাগত জানালো ওকে। ফারাহর চোখ, হাত পা সুক্ষ্ম নজরে দেখল নিধি। আইয়াজকে জিজ্ঞেস করল ওর হালচাল। সৌধ আলগোছে ওদের থেকে সরে গেল। সিমরানের কাছে গিয়ে অনিরূপের দিকে কয়েক পল তাকিয়ে রইল নিশ্চুপ। এরপর শুধাল,
‘ হেই লিটল স্টার, হাউ আর ইউ? ‘
সৌধকে অবাক করে দিয়ে অনিরূপ আধো স্বরে বলল,
‘ ফান, ইউওও।’
‘ফাইন ইউ’ শব্দটি স্পষ্ট বলতে না পারলেও বুঝল ওরা। সিমরান আশ্চর্য হয়ে তাকাল সৌধর পানে। এরপর হেসে ফেলল দু’জনকে। সৌধ কোলে নিল অনিরূপকে। আজিজ খেয়েদেয়ে পেট ফুলিয়ে এসে অনিরূপের দিকে হাত বাড়াল,
‘ আরে মাম্মা আসো কোলে আসো। ‘
আকস্মিক ওর উচ্চ গলায় ভয় পেয়ে গেল অনিরূপ৷ সৌধর গলা জড়িয়ে ভীত হয়ে তাকিয়ে রইল ড্যাবড্যাব৷ সৌধ চোখ কটমট করে তাকাল আজিজের পানে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘ ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলবি না৷ সরে যা ভয় পাচ্ছে ও। ‘
‘ উফ বুঝলাম না দুনিয়ার সব বাচ্চা আমি বলতে অজ্ঞান। আর এই সুহাইস্যা, আর নিধিপিদির বাচ্চা এমন করে ক্যান! ‘
সিমরান হেসে ফেলল শব্দ করে। হাসির শব্দ শুনে আজিজ তাকাল ওর পানে। অবাক হয়ে বলল,
‘ আরে সুহাসের বোন না? ওহ সরি সৌধর বউ আমার ভাবি না? এ তো পুরাই বলিউডের অনন্যা পান্ডের মতো হাসিরে! ‘
উত্তরে সৌধ কিছু বলতে উদ্যত হবে তক্ষুনি আইয়াজ ডাকল ওদের৷ আজিজ সৌধর কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান শুরু করল,
‘ দোস্ত সত্যি বলছি ভাবিকে দেখতে অনন্যা পান্ডের মতো। হাসি আর চোখ দু’টো বস খাপে খাপ কিউট।’
সৌধ বিরক্ত হলো, মেজাজ খারাপ করে বলল,
‘ মুখটা বন্ধ কর। অন্যের বউয়ের সৌন্দর্যের প্রশংসা করে মুখে ফেনা না তুলে নিজের বউ কবে ঘরে তুলবি সে চিন্তা কর। ‘
‘এ ভাইই তুই কি আমাকে ঠান্ডা মস্তিষ্কে অপমান করলিইইই!’
.
.
বন্ধুরা মিলে প্রাচীকে ভিডিও কল দিল। ওকে ভিডিও কলে রেখে ওরা সবাই মিলে আড্ডা দিল খুব। কত গল্প, কত স্মৃতিচারণ! ওদের গল্প, আড্ডা এ বাড়ির শোকাবস্থা মলিন করে ফেলল একদম। এত অল্প সময়ে এই আমেজ অন্যান্য পরিবারে দৃষ্টিকটু লাগলেও সুহাসের পরিবারে লাগল না৷ কারণ নিকটাত্মীয় বলতে ওর মামা বাড়ির লোকেরাই। বাবার ভাই, বোন না থাকায় দাদা, দাদির মৃত্যুর পর সে পক্ষের আপন কেউ নেই৷ তাই সুহাসকে খুব তাড়াতাড়িই উঠে দাঁড়াতে হবে। সামলাতে হবে গোটা পরিবার আর বিজনেস। এর জন্য বন্ধুদের এই সঙ্গকে সবাই সাদরে গ্রহণ করল। প্রাচীর সঙ্গে কথা শেষে ওরা নিজেরা মিলেও অনেকক্ষণ আড্ডা দিল। কে কেমন আছে। কার ফ্যামিলিতে কী অবস্থা। আজিজের বিয়ে নিয়ে কত কাহিনি হচ্ছে। সব শুনল আর হাসির রোল পড়ল। ঊনত্রিশ বছর বয়সী আজিজের পছন্দ সতেরো, আঠারো বছর বয়সী যুবতী। কিন্তু সতরো, আঠারো বছর বয়সী যুবতীরা তাকে বুড়ো বলে রিজেক্ট করছে! এই নিয়ে তার মায়ের হতাশার শেষ নেই৷ আজিজ বলল,
‘ আমাকে মনে হয় আমার এক্সরা অভিশাপ দিছে। ‘
হাসির রোল পড়ল নিমেষে। সে হাসি থামল আইয়াজের কথায়। সে হঠাৎ অর্পণ স্যারের কথা তুলে সৌধকে বলল,
‘ আমি আর সুহাস স্যারকে সরি বলেছি। তোরও সরি বলা উচিত সৌধ। হাজার হোক আমাদের বেস্ট ফ্রেন্ডের বর সে। ‘
প্রশ্ন শুনে নিধি আড়চোখে তাকাল সৌধর পানে। সে নিজেও মনে মনে চায় সেই ঘটনার জন্য সৌধ সরি হোক তার স্বামীর কাছে। মানুষটার তো সত্যি কোনো দোষ নেই৷ সময়ের স্রোতে তার প্রতি সৌধর অনুভূতিও ফিঁকে হয়ে গেছে৷ নিধির তাকানো খেয়াল করে তীক্ষ্ণ হলো সৌধর দৃষ্টি৷ লম্বা এক নিঃশ্বাস ফেলে দৃঢ় গলায় বলল,
‘ একদমই উচিত না৷ ‘
সৌধর এহেন কথায় পরিস্থিতি গুমোট বেঁধে গেল৷ থমকানো দৃষ্টিতে তাকাল নিধি৷ সিমরান নিশ্চুপ। ওর নীরব দৃষ্টি সৌধতে স্থির৷ বোনের নীরবতা দেখে সুহাস প্রসঙ্গ বদলাতে বলল,
‘ এই আলোচনা এখানেই বন্ধ হোক। ‘
সত্যি সত্যি আলোচনা বন্ধ হলো। কিন্তু গুমোট একটা অনুভূতি দৃঢ় হয়ে রইল সৌধ, নিধি আর সিমরানের মনে।
সন্ধ্যার পর,
ছাদে কাঠ জড়ো করে আগুন ধরানো হয়েছে। একটু পর সবাই মিলে সেখানে আড্ডা দেবে। শীত মৌসুমে শহুরে ছেলেমেয়েদের এই আড্ডাটা দারুণ হয়৷ যাতে অভ্যস্ত সুহাসদের সার্কেলটা। সৌধ অনেকক্ষণ ধরেই নিধিকে একাকী খুঁজছিল। অনিরূপ ঘুমিয়েছে। তাই নামীর ঘরে ওকে শুইয়ে দিয়ে বেরোলো নিধি৷ সৌধ ওকে দেখতে পেয়েই ডাকল,
‘ নিধি, ছাদে চল। ‘
চমকে তাকাল নিধি৷ ইতস্ততভাবে বলল,
‘ নামী ওরা কোথায় আমি একা যাব?’
কপালে ভাঁজ ফেলে গম্ভীর স্বরে সৌধ উত্তর দিল,
‘ হু, একা যাবি। ‘
|চলবে|
® জান্নাতুল নাঈমা