#ত্রিধারে_তরঙ্গলীলা
|৭৯|
জেনেভাতে সকাল দশটা। হসপিটাল থেকে সুহৃদকে নিয়ে বাসায় ফিরল নামী৷ সঙ্গে অ্যালেন। সুহাস ফিরে গেছে হোটেলে। লম্বা একটি শাওয়ার নিয়ে চটজলদি ছেলের কাছে ফিরবে। এদিকে সৌধর মন বিচলিত হয়ে আছে খুব৷ পরশু রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিল সে৷ সিমরানকে নিয়ে। তীব্র জ্বরে বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে সিমরান। সুশ্রী মুখটা বিবর্ণা। সুগঠিত দেহে করুণ ভাঙন। যে রূপে অর্ধাঙ্গিনীকে দেখে ঘুমের ঘোরেই হৃৎস্পন্দন থেমে গিয়েছিল সৌধর। হাসফাস করতে করতে ঘুম ভেঙে বসেছিল সটান৷ উদ্ভ্রান্তের মতো ফোন করেছিল বউকে। সে কী আবেগঘন মুহুর্ত!
সুহাস শাওয়ার নিয়ে রুমে এলো। দেখল চিন্তিত মুখে বসে আছে সৌধ। ঘড়ি দেখছে বারবার। ঘড়ির কাঁটা নির্দিষ্ট একটি সময়ে গেলেই ফোন করবে সিনুকে। জানে সুহাস। তাই মলিন মুখে মৃদু হাসি টেনে বলল,
‘ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে নে সৌধ। আমি বেরুবো।’
গায়ে শার্ট চাপাতে চাপাতে কথাটা বলল সুহাস৷ সৌধ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। চিন্তিত ভঙ্গিতে এসে দাঁড়াল সুহাসের সম্মুখে। দু-হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল সুহাসের কাঁধের দু’পাশ। এরপর ঠোঁটে অল্পখানি হাসি টেনে বলল,
‘ বউ, বাচ্চার পাশে থাক। আগলে রাখ ওদের। এতদূর এসে বিফল হয়ে যেন ফিরতে না হয়। ‘
বন্ধুর কথায় স্মিত হাসল সুহাস৷ দৃষ্টি দৃঢ় করে তাকাল সৌধর মুখপানে। বলল,
‘ টেনশনে আছিস মনে হচ্ছে? কাকে নিয়ে টেনশন করছিস সুহৃদ না সিনু? ‘
মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল সৌধর৷ সুহাসকে ছেড়ে সরে দাঁড়াল। দু’টো হাত পকেটে গুঁজে দিয়ে বুক টানটান করে শ্বাস নিল। অন্যরকম গলায় বলল,
‘ পরশু সিনুকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। মনটা অশান্ত ছিল। এখন সুহৃদের এই বিপদ স্বপ্নটাকে ভাবাচ্ছে নতুন করে। ‘
ভ্রু কুঁচকে গেল সুহাসের। আশ্চর্য হয়ে এসে দাঁড়াল সৌধর সামনে৷ বলল,
‘ কিরে ভাইই, আজকাল তুইও দুঃস্বপ্ন টুঃস্বপ্ন মানিস? ‘
সম্বিৎ ফিরে পেল যেন সৌধ। সত্যি তো! এমনটা সত্যি তার ব্যক্তিত্বে যায় না। তবু কেন এত অস্থির অস্থির লাগছে? বিষয়টা সিনুকেন্দ্রিক তাই কী?
নিজের ভেতরে চলা অশান্তি আর চেপে রাখতে পারল না সৌধ। অন্যমনস্ক হয়ে বলে ফেলল,
‘ সিনুকে নিয়ে আমার এত ভয় লাগছে কেনরে সুহাস? ডোন্ট মাইন্ড ব্রো। কিন্তু কথাটা না বলে থাকতে পারছি না। নিধি আমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার পর যে অনুভূতিটা হয়েছিল। সেই অনুভূতিটাই যেন আরো গভীর হয়ে দানা বেঁধেছে বুকে। এমনটা কেন লাগছে সুহাস? সিনু তো আমারি বল। তবু কেন এই ফিলিংসে অসহনীয় হয়ে উঠছি আমি? ‘
আকস্মিক বুক কেঁপে উঠল সুহাসের। পরোক্ষণেই আবার স্বাভাবিক হয়ে বলল,
‘ আ’ম সিয়র সিনুর প্রতি এতদিন তোর ভালোবাসা টালোবাসা কিচ্ছু ছিল না৷ এখন দূরে এসে ওকে মিস করছিস। ভালোবাসাও তৈরি হয়ে যাচ্ছে ওর জন্য। ‘
সুহাসের বোকা বোকা মন্তব্যে নিমেষে পরিবেশ বদলে গেল। সৌধ চোখ দু’টো ছোটো ছোটো করে বিড়বিড় করে বলল,
‘ আসছে আমার বুদ্ধিজীবী। ‘
সুহাস বলল,
‘ কিছু বললি? ‘
‘ না, বুঝলাম। ‘
‘ কী? ‘
‘ তুই বুঝবি না। ‘
‘ দূর শা’লা। ‘
‘ আমি তোর শা’লা নাকি তুই আমার। ‘
আচমকা সৌধর কলার চেপে ধরল সুহাস। খোঁচা দিয়ে বলল,
‘ তোর বউয়ের বড়ো ভাই আমি। সম্মান দিয়ে কথা বল। ‘
একই ভঙ্গিতে সৌধও কলার টেনে ধরল ওর। দর্পের সঙ্গে বলল,
‘বোন জামাইয়ের সঙ্গে মেপেঝেপে কথা বলতে হয় বুঝলেন আমার বউয়ের ভাই?’
.
.
বৃহস্পতিবারের গোধূলি বিকেল। ননদ, ভাবি মিলে ব্যাডমিন্টন খেলায় মগ্ন। দীর্ঘদিন বাবার বাড়ি থাকার পর গতকাল শশুর বাড়িতে এসেছে সিমরান। শাশুড়ি আর দাদি শাশুড়িকে সময় দিয়েছে বেশ। এবার ননদের সঙ্গে বিকেলটা উপভোগ করার জন্য বাড়ির সামনে লনে ব্যাডমিন্টন খেলছে৷ বাড়ির ভেতর থেকে তখন ঝুমায়না ওর ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সিমরান আর তাহানীকে দেখে গা জ্বলে উঠল খুব। সে বাংলাদেশে এসেছিল খুবই অল্প সময়ের জন্য। কিন্তু অল্প সময়টা দীর্ঘ হয়ে উঠল শুধুমাত্র জায়ের প্রতি তীব্র ঈর্ষা থেকে। এতদিন এ সংসারে একমাত্র বউ সে ছিল। এখন এসেছে আরেকজন। অল্প সময়েই মেয়েটা সবার মন জয় করে নিয়েছে। এ বাড়িতে ঝুমায়নার নাম কেউ একবার নিলে সিনুর নাম নেয় দশবার। এতদিন সিমরান বাবার বাড়িতে ছিল। উঠতে, বসতে সকলে এতভাবে সিনু সিনু করেছে, যে ঝুমায়নার ঈর্ষা প্রগাঢ়ত্বে রূপ নিয়েছে। শশুর বাড়িতে না থেকে, সংসারে মন না দিয়ে সে কতবড়ো ভুল করেছে। এবার হারে হারে টের পাচ্ছে। বরাবরের মতো এবার তাই অতিথির মতো এসেই চলে যায়নি। নিজের জায়গা, নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এ বাড়ির বড়ো বউ সে অথচ সবকিছুতে আধিপত্য থাকবে দুদিন আসা সিমরানের? এমনটা কক্ষনো হতে দেবে না৷ তাই স্বামী সৌরভ কানাডা চলে গেলেও ছেলেকে নিয়ে সে একাই থেকে গেছে বাংলাদেশে৷
সুশ্রী, প্রান চঞ্চল মেয়ে সিমরান। এ বাড়ির সুখী বধূ৷
ছেলেকে নিয়ে হাঁটছিল ঝুমায়না৷ আর তাকিয়ে দেখছিল দেবরের বউকে। ভাবছিল তাকে ঘিরে নানাবিধ ভাবনা। হঠাৎ খেলা থেমে গেল ওদের। তাহানী ছুটে গিয়ে পানির বোতল নিয়ে এলো। সিমরান কপাল আর মুখের ঘাম মুছে পানি খেল। খেলায় বিরতি দিল ওরা। তাহানী গিয়ে ধরল সুরের হাত। ঝুমায়না কিছু বলল না। বরং তাহানীর কাছে ছেড়ে দিল ছেলেকে। এরপর সে গেল সিমরানের কাছে। লনের একপাশে বেঞ্চিতে ক্লান্ত সিমরান বসেছে মাত্র। পরনে জিন্স প্যান্টের সাথে সূতি গাউন। গাউনের একপাশে পকেট সিস্টেম। পকেট থেকে সেলফোন বের করে ক্লান্ত মুখে কয়েকটা সেলফি তুলছিল। এমন সময় ঝুমায়না এসে বসল পাশে। বলল,
‘ কী খবর সিনু? সৌধ আসবে কবে? ‘
মন থেকে ঝুমায়নাকে একটুও পছন্দ করে না সিমরান। সেই তিক্ত মুহুর্তটুকু আজো তার মন থেকে মুছে যায়নি। যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে এই মানুষটাকে। ঝুমায়নাও যে তাকে পছন্দ করে না। জানে সে। তাই আজ হঠাৎ আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসাতে অবাক হলো। মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘ খবর ভালো ভাবি৷ সৌধ ছুটি শেষ হতে হতেই এসে যাবে। ‘
সৌধভাই থেকে শুধু সৌধ সম্বোধন। স্বামী, স্ত্রীর সম্পর্কের গাঢ়ত্ব নিয়ে সংশয় থাকে না৷ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল ঝুমায়না। প্রশ্ন করল,
‘ তোমার ভাবি আসবে? ‘
‘ হুম, আসবে। ‘
আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর। সিমরানের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঝুমায়না খেয়াল করল, বিয়ের সময়ের সিমরান আর এই সিমরানে বিস্তর ফারাক। মেয়েটা তখন কেমন স্বাস্থ্যহীন ছিল। এখন স্বাস্থ্য ঘুরেছে। পরিপূর্ণা যুবতী দেহ। আলাদা এক সুবাস ছড়ানো সর্বাঙ্গে। চোখে লাগার মতো উদ্ভাসিতা। মুখশ্রী, দেহের গড়ন, স্মার্টনেস। সবকিছু মিলিয়ে এই মেয়েটা ঈর্ষা করার মতোই। নিঃসন্দেহে তার প্রতিদ্বন্দ্বী। আপাদমস্তক সিমরানকে এমনভাবে দেখছিল আর ভাবনায় মশগুল ছিল ঝুমায়না যে সিমরান অস্বস্তি অনুভব করল। তার অস্বস্তি টের পেয়ে ঝুমায়না বলল,
‘ তুমি কিন্তু বেশ সাহসী। আমি বাইরের দেশে, বাইরের কালচারে বড়ো হয়েই এ বাড়িতে জিন্স পরার কথা ভাবতে পারি না। ‘
খোঁচাটা টের পেল সিমরান৷ তাই বলল,
‘ আমি আগে থেকেই কেয়ার করি না টাইপের মেয়ে ভাবি৷ তবে শশুর বাড়ির সবাইকে রেসপেক্ট করি৷ সবার পছন্দকে গুরুত্বও দিই। তাছাড়া আমি জিন্স পরব না পাজামা পরব এটা ফ্যাক্ট না। আমি কতটা শালীনতা মেইনটেইন করব এটাই ফ্যাক্ট। এই মেইনটেইন শুধু এ বাড়িতে করি না। সব জায়গাতেই করি। ‘
এমন স্পষ্ট সত্য, সরাসরি উত্তর পছন্দ করল না ঝুমায়না। এ যেন সৌধর ফিমেল ভার্সন তার ঈর্ষান্বিতা মনকে দুমড়েমুচড়ে দিল। পরোক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে। বলল,
‘ ঠিকই বলেছ। ওই দাদুনি এসব পছন্দ করে না তো। সেই বলল, সৌধর বউ ব্যাটাছেলেদের মতো কী সব পরে। লাফিয়ে লাফিয়ে খেলাধুলা করে। বাড়ির বউ তো নয় যেন উড়নচণ্ডী। ‘
মহা অবাক ভঙ্গিতে সিমরান গালে হাত রাখল। বলল,
‘ তাই, দাদুনি বলল এটা? ‘
ঝুমায়না মাথা দুলালো। সিমরান মুচকি হেসে বলল,
‘ শশুর বাড়িতে সবাই ভালোবাসা, আদর দিলে জমে না ভাবি। এক দুইজন শাসন করবে, বাঁকা চোখে তাকাবে। খোঁচা মেরে কথা বলবে, হিংসেই জ্বলেপুড়ে নিজের আগুনে পুড়াতে আসবে। তবেই না শশুর বাড়ি, শশুর বাড়ি ফিলিংস হবে। আমার তো বেশ ভালোই লাগে এসব। ভেরি এঞ্জয়েবল। ‘
অপমানে মুখ থমথমে হয়ে গেল ঝুমায়নার। নিমেষে ফোন বেজে উঠল সিমরানের। স্ক্রিনে ভেসে উঠল টগবগে যুবক সৌধ চৌধুরীর ছবি৷ ঝুমায়না উঠে পড়ল ত্বরিত। সিমরান ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সৌধ বলল,
‘ কী করা হচ্ছে মিসেস? ‘
‘ ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম। এখন রেস্ট নিচ্ছি। তুমি কী করছ? সুহৃদ কোথায় আজ যাওনি ওর কাছে। ‘
সুহৃদের অ্যাকসিডেন্টের বিষয়েটা কেউ জানায়নি সিমরানকে। অযথা মন খারাপ করবে। দুঃখে হয়তো কেঁদেও ফেলবে। তাই সৌধ বলল,
‘ না যাইনি। সুহাস গেছে। ওরা ওদের মতো সময় কাটাক এখন। তুমিও ফোন টোন করো না। একা ছেড়ে দাও। ওরা ওদের মতো থাকুক৷ ভুল বুঝাবুঝি, দূরত্ব মিটিয়ে নিক। তারপরই ফেরার পালা। ‘
সৌধ কথা বলছিল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে ছিল সিমরান। সুহৃদের প্রসঙ্গ আপনাআপনিই বদলে গেল। ওরা তাকিয়ে ছিল দু’জন দু’জনের পানে। হঠাৎ লজ্জায় আরক্ত হয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল সিমরান। উঠে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘ জানো ফারাহপুকে আচার করে পাঠিয়েছি আমি। তোমার জন্যও রেখেছি। কবে আসবে বলো তো? ‘
একটু মরিয়া স্বর। সৌধ বুঝল তা। নির্নিমেষে তাকিয়ে নিজের আকুলতা গোপন করল। এরপর জিজ্ঞেস করল,
‘ খুব শিঘ্রই আসব। কিন্তু বউটির জন্য কী নিয়ে আসব ভেবে পাচ্ছি না। ‘
লাজুক ভঙ্গিতে মৃদুস্বরে সিমরান জবাব দিল,
‘ বর এলেই চলবে আর কিচ্ছু চাই না। ‘
নিঃশব্দে হাসল সৌধও। বলল,
‘ কিছু তো লাগবেই। কী লাগবে বলো। ‘
আকস্মিক আশপাশে তাকিয়ে চুপিচুপি সিমরান বলল,
‘ কিছু লাগবে নিশ্চয়ই। সেটা ওদেশ থেকে আনতে হবে না৷ তুমি এসো তারপর নিয়ে নিব। ‘
দৃষ্টি গাঢ় করল সৌধ। কৌতূহলে ভরপুর। সিমরান সে গাঢ়তা মিশানো কৌতূহল দেখে তীব্র লজ্জায় পড়ল। শীতল প্রকৃতিতে উষ্ণ পরিস্থিতি বদলাতে বলল,
‘ শোনো? ‘
‘ ইয়েস? ‘
‘ এক বাক্স বরফ টুকরো এনো। ‘
‘ বরফ? কী হবে তা দিয়ে? ‘
‘ বরফস্নান করব। ‘
শব্দ করে হেসে ফেলল সৌধ। লাজুকতা ভরে মৃদু হাসিতে টলমল হয়ে রইল সিমরানও। একটুখানি দূরে ঝুমায়না দাঁড়িয়ে। বকুলফুল গাছের পানে তাকিয়ে। শুনছিল সিমরান, সৌধর কথোপকথন। এত সুখ, আহ্লাদের কথা শুনে মুখ ভেঙচাল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ ন্যাকা বউয়ের সঙ্গে থেকে থেকে এই সৌরভের ভাইটাও ন্যাকা হয়ে উঠছে দেখি! ‘
ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে প্রতিটি মানুষই নিষ্পাপ, বাচ্চাসুলভ হয়ে যায়৷ এই সুন্দর, মিষ্টি, আদুরে অনুভূতি কি ঝুমায়নারা বুঝে?
.
.
কে’টে গেল বেশকিছু দিন৷ আজ সুহৃদের সেলাই কা’টা হয়েছে। কান্নাকাটি করেছে খুব। বাবা, মা মিলে আগলে রেখেছে সম্পূর্ণ সময়। ছেলে সামলাতে গিয়ে নাওয়াখাওয়া হয়নি কারো। দুপুর পরে সুহৃদ ঘুমালো। বাবার বুকে। সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়েছে সুহাস৷ নামীও নিজের সব কাজ ফেলে সুহাসের পিছু পিছু ঘুরেছে। না জানি কখন তার প্রয়োজন পড়ে৷ কিন্তু নাহ। প্রয়োজন পড়েনি মায়ের। বাবাই সামলে নিয়েছে। তাই সে গিয়ে বিছানা ঠিকঠাক করল। সুহাস এসে শুইয়ে দিল সুহৃদকে। নামীকে বলল,
‘ ফ্রেশ হয়ে নাও। লম্বা সময় ঘুমাবে এখন। ‘
নামী সম্মতি দিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ তোমার খিদে পেয়েছে তো? তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও। খেতে দিচ্ছি। ‘
‘ দরকার নেই। আমি রিসোর্টে ফিরে খেয়ে নিব। ‘
এই নিয়ে কতবার যে ব্যর্থ হলো নামী। সুহৃদ অসুস্থ হয়েছে অবধি সারাদিন সুহাস এখানে থাকে। কখনো মধ্যরাতও হয়ে যায়। বাচ্চাটার অভ্যেস খারাপ হয়ে গেছে। বাবা ভক্ত হয়েছে ভীষণ। না ঘুমোনো পর্যন্ত সুহাস যেতে পারে না৷ চোখের সামনে চলে গেলে কান্নাকাটি করে। অমন কাঁদিয়ে যেতে কষ্ট হয় সুহাসের৷ নামীরও খারাপ লাগে সুহৃদ এভাবে কাঁদলে। মূলত বাচ্চার কারণেই এখন দীর্ঘসময় থাকতে হয়। নিজের কাছে নিয়ে রাখলে নির্দিষ্ট একটা সময় পর আবার মায়ের জন্য কাঁদে। তাই দু’জন মিলেমিশেই সময় দিচ্ছে বেবিকে। কিন্তু সুহাস এ বাড়িতে একবেলাও খাবার খায় না৷ রাতে থাকেও না৷ মধ্যরাত হোক তবু ফিরে যায়। বিশেষ জোর করে না নামীও৷ সে সম্পূর্ণভাবে সুহাসকে গ্রহণ করেনি বলেই হয়তো এখানে থাকতে, খেতে আত্মসম্মানে লাগে সুহাসের। দীর্ঘশ্বাস ফেলল নামী। চলে গেল ফ্রেশ হতে৷ কেন জানি নিজেরও খেতে ইচ্ছে করল না। অ্যালেনের স্ত্রী উইরা খেয়াল করল বিষয়টা। লাঞ্চ করবে কিনা জিজ্ঞেস করলে মিথ্যা বলে দিল,
‘ আমরা বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। ‘
.
অন্যদিনের তুলনায় আজ তাড়াতাড়িই চলে গেল সুহাস৷ সুহৃদ ঘুম থেকে উঠে মায়ের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে কী হলো কে জানে? কান্নাকাটি শুরু করল। অ্যালেন এসে থামাল একবার। ঘুরল বাড়িজুড়ে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আবার কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেল। রাত বাড়ল। ঘুম থেকে একবার উঠল সুহৃদ। নামী রাতের খাবার তৈরি করে চেষ্টা করল খাওয়াতে। একবার মুখে দিয়ে ফেলে দিল। বিরক্ত হলো নামী। একটু ধমক দিল। ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলল ছেলেটা। অভিমান করে দূরে বসে রইল নামী৷ কিছুক্ষণ পর অভিমান সরিয়ে কাছে টেনে নিল বুকের ধনকে। শরীরটা নরম, ঈষৎ উষ্ণ। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই উষ্ণতা বৃদ্ধি পেল। থার্মোমিটারে জ্বর মেপে দেখল, ১০১ ডিগ্রি। চমকে উঠল মায়ের মন। এসব কেন হচ্ছে? এত ধকল যাচ্ছে কেন বাচ্চাটার ওপর? মনটা অশান্ত হয়ে উঠল খুব৷ সৃষ্টিকর্তা কেন বারবার তার মাতৃহৃদয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে? এ কিসের ইঙ্গিত? বুকের মাঝে ছেলেকে জড়িয়ে মোবাইল ফোন হাতে নিল নামী। কল করল সুহাসকে। জেনেভায় সময় তখন রাত বারোটা পঁয়ত্রিশ মিনিট৷ দুই বন্ধু সন্ধ্যায় বেরিয়েছিল। ফিরেছে এগারোটার দিকে। ঘুমানোর উদ্দেশ্যে বিছানায় এসেছে বারোটায়। অর্থাৎ এখন সবে চোখ লেগেছে ওদের। এমন সময় ফোন বেজে উঠতেই চমকে চোখ খুলল সুহাস। সৌধ নড়েচড়ে ফিরে তাকাল। স্ক্রিনে নামীর নাম দেখেই সটান উঠে বসল সুহাস। বুকটা ধক করে উঠেছে নাম দেখেই। সামান্য কাঁপল হাতটাও৷ শুকনো একটা ঢোক গিলে ফোন রিসিভ করতেই নামী রুদ্ধশ্বাসে বলল,
‘ সুহৃদের জ্বর এসেছে। একবার আসতে পারবে? ‘
‘ এক্ষুনি আসছি। ‘
বলেই ফোন কেটে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল সুহাস। এপাশে স্থবির হয়ে গেল নামী। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এমন ছেলেমানুষী সে কেন করে ফেলল? সুহৃদের জ্বর হয়েছে। সে কি একা সামলাতে পারত না? তবে কেন এতটা ভেঙে পড়ল? কেন এভাবে সঙ্গ চাইল ওই মানুষটার? পরোক্ষণেই নিজেকে করা প্রশ্ন গুলোর উত্তর নিজেই দিল, আর কত রাগ, জেদ ধরে থাকবে? এভাবে সত্যি দম বন্ধ লাগছে। এবার একটু হাঁপ ছাড়া উচিত। বাঁচা উচিত মুক্ত শ্বাসে। এভাবে ক্লান্ত লাগছে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।
সুহাস এসে দেখল, নামীর মুখ বিধ্বস্ত। কান্না করেছে টের পেল। সুহৃদের জ্বর মাপল নিজহাতে। কী মেডিসিন দিয়েছে দেখে নিল একবার। এরপর ডাক্তার বাবা, মা মিলে এফোর্ট দিয়ে বাচ্চার জ্বর কমাতে সফল হলো। ঘড়িতে সময় তখন তিনটা বিয়াল্লিশ মিনিট। জ্বর ছাড়ার পর বাবার বুকে খচমচ করছিল সুহৃদ। নামী পাশেই শোয়া। টের পেল মায়ের বুক খুঁজছে। তাই হাত বাড়াল। সুহাস আলতোভাবে ছেলেকে তার কাছে দিলে সে মৃদুস্বরে বলল ওপাশ ফিরো। বুঝে উঠল না সুহাস৷ নামী দ্বিতীয়বার বোঝালও না৷ ছেলেকে কৌশলে নিজের বা’পাশে নিয়ে সে নিজেই পিছু ফিরল। দীর্ঘক্ষণ পর মায়ের দুগ্ধপানে শান্ত হলো সুহৃদ। সুহাস স্তব্ধ দৃষ্টিতে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইল ওদিকে। পুরো বিষয়টা বুঝে নিয়ে হাসল কিঞ্চিৎ। বুকের ভেতর জেগে উঠল অদ্ভুত এক শিহরণ। অচেনা এক আনন্দ ভরে উঠল মন। আলগোছে চিত হলো সে। চোখ বুজে শ্বাস টানল বড়ো করে। ঠোঁটে লেগে রইল অমায়িক এক হাসি।
সুহৃদ ঘুমিয়ে গেলে আবার সুহাসের দিকে ফিরল নামী। সুহৃদকে মাঝখানে শুইয়ে দিয়ে গায়ের উপর কম্বল টেনে দিল। ছেলের পানে স্নেহভরে তাকিয়ে সুহাস বলল,
‘ তুমিও ঘুমাও এবার। সারারাত ধকল গেছে খুব। ‘
কথাটা বলে উঠতে উদ্যত হলে গম্ভীর কণ্ঠে নামী বলল,
‘ উঠছ কেন? তোমারও ঘুম প্রয়োজন। ‘
চোখে বিস্ময় খেলে গেল সুহাসের। এ প্রথম একসঙ্গে ঘুমানোর ইশারা করল নামী। প্রশ্ন করল,
‘ সিয়র? ‘
‘ মাইকিং করে বলতে পারব বা। ‘
কথাটা বলেই গায়ে ভালো করে কম্বল চেপে চোখ বুজল নামী। সুহাস মৃদু হাসতে হাসতে সুহৃদের সঙ্গে ঘেঁষে শুয়ে রইল। সময় গড়াল। ভারী নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করল নামী। সুহাস বুঝল বউ বাচ্চা দু’টিই গভীর ঘুমে তলিয়ে। সুযোগ পেয়ে একটুও অপেক্ষা করল না। মুখ বাড়িয়ে বউয়ের কপালে আলতো এক চুম্বন করল। বলিষ্ঠ, লম্বা হাতটি দিয়ে আগলে ধরে সুখের ঘুম ঘুমালো সে নিজেও। অথচ টের পেল না। অনাকাঙ্ক্ষিত এই মুহুর্তটুকুর সুখে বদ্ধ চোখ বেয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে নামীর।
.
.
ভোরবেলা। ফোনের শব্দে ঘুম ছেড়ে গেল সৌধর। নাম না দেখেই রিসিভ করল। ভেবেছিল, সিনুর ফোন৷ কিন্তু ওপাশ থেকে ক্রন্দনরত কণ্ঠ ভেসে এলো। আশ্চর্য! সিনু নয়। কণ্ঠের মালিককে চিনতে পেরে মস্তিষ্কে ঝংকার দিয়ে ঘুম ছেড়ে গেল। মুখে অস্ফুটে উচ্চারণ করল,
‘নিধি!’
চলবে!
®জান্নাতুল নাঈমা।