তোর হতে চাই পর্ব-১০

0
1628

#তোর_হতে_চাই
#Ariyana_Nur
#Part_10

রাস্তার এক পাশে বেঞ্চের উপর বসে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে রয়েছে আদিয়াত।মাথায় কেমন ফাকা ফাকা লাগছে তার।মনের মধ‍্যে কেমন এক শূন্যতা অনুভব করছে।যা সে কখনো আগে অনুভব করেনি।চোখে সামনে বার বার তোহফার মুখটা ভেসে উঠছে।আদিয়াত তখন তোহফার কথার থেকে তোহফার চেহারা দেখে বেশি চমকে গিয়েছিলো।যেই চেহারায় সব সময় ভয় আর লাজুকতায় ঘিরে থাকে সেখানে এসে ভিড় করেছিলো অভিমান আর ক্রোধ।টলমল চোখের ভাষা বলছে এক কথা আর মুখে বলছে আরেক কথা।আদিয়াত তোহফার চেহেরা দেখেই ধরে নিয়েছিলো তোহফার কিছু একটা হয়েছে।যার জন‍্য সে এমন কথা বলছে।আদিয়াত ভেবে পাচ্ছে না মূহুর্তে মধ‍্যে তোহফার কি এমন হয়ে গেলো যার জন‍্য তোহা এমন করছে।এখন কথা বড়ালে ভয়ংকর কিছু হয়ে যেতে পারে।তাই আদিয়াত কথা না বাড়িয়ে তোহফার প্রতি মনের মাঝে এক রাশ অভিমান নিয়ে কোন টু শব্দ না করে রুম থেকে চুপচাপ বের হয়ে গিয়েছিল।

—হয়তো আমিই তোমার যোগ‍্য হয়ে উঠতে পারি নি।আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমার মনে নিজের জায়গা করে নিতে পারিনি।তোমার মনে তিল পরিমান বিশ্বাস জোগাড় করতে পারিনি।তাই তো তুমি এতোদিন আমার সাথে থাকার পরেও মুখ ফুটে তোমার সম্পর্কে আমায় কিছু বলনি।
আমি চেয়েছিলাম তুমি ভালোবেসে নিজ থেকে তোমার মনের সব কথা আমায় বলবে।কিন্তু তা আর হল কোথায়?আজকে তোমার কথায় আমার মনে যে দাগ কেটেছে সে দাগ মিটবে কিনা আমি নিজেও জানি না।

কথাগুলো মনে মনে বলে আদিয়াত একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে উঠে দাড়াল।

_______

আদিয়াত অনেক রাত করে বাড়িতে ফিরল।নিজের কাছে এক্সট্রা চাবি থাকায় কাউকে বিরক্ত না করে সোজা নিজের রুমে দিকে চলে গেলো।রুমের মধ‍্যে লাইট ফ‍্যান অন করা।আদিয়াত রুমে ঢুকে পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে তোহফাকে খুজে নিল।কোথাও তোহফা নেই।আদিয়াত ভাবল হয়তো তোহফা, আনিশার রুমে আছে।তোহফাকে এসে রুমে না পেয়ে তোহফার প্রতি চাপা অভিমানটা আরো বেড়ে গেলো।তাই অতো না ঘেটে ফ্রেস হতে চলে গেলো।আদিয়াত ফ্রেস হয়ে বের হয়ে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিজের তাওয়ালটা খুজে নিল।কোথায় তাওয়াল দেখতে না পেয়ে বেলকনির দিকে পা বাড়ালো।বেলকনি পা রাখতেই আদিয়াতের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। তোহফা বেলকনির ফ্লোরের এক কোনে পরে রয়েছে সাথে কিছু একটা বিরবির করছে।আদিয়াত তড়িঘড়ি তোহফার সামনে হাটু গেড়ে বসে বেশ কয়েক বার তোহফাকে ডাক দিল।কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না।সে নিজের মত কিছু একটা বিরবির করেই চলেছে।আদিয়াত তা শোনার জন‍্য তোহফার মুখের সামনে কান পেতে বসতেই তোহফার ভাঙা ভাঙা গলার কথা আদিয়াতের কানে এসে পৌছালো……

—প্লিজ আপনি আমায় ছেড়ে চলে যাবেন না।আমাকে ঐ জেলখানায় আর পাঠাবেন না।আপনাদের কে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।এবার সেখানে গেলে আমি মরেই যাব।বাবা আমায় মেয়ে ফেলবে।আমি এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না।আমি বাচতে চাই।আমি আপনার সাথে বাচতে চাই।

আদিয়াত কোন কথা না বলে কিছুক্ষণ তোহফার মায়া ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল সে নিজের থেকেই তোহফার সাথে তার বিষয়ে কথা বলবে।তার অতীত সম্পর্কে জানতে চাইবে।কথাটা ভেবেই দীর্ঘ নিশ্বাস এক নিশ্বাস ফেলে তোহফাকে পাজাকোলে করে রুমে দিকে পা বাড়ালো।

_________

কলিং বেলের শব্দ শুনে আসফিয়া (তোহফার ফুপি)দরজা খুলে তোহফাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠল।কেননা যাকে বিয়ের পর নানান ভাবে বলে কয়ে, নানান অজুহাত দিয়ে এই বাড়িতে একবারের জন‍্য আনতে পারেনি তাকে দেখে তো চমকানোটাই সাভাবিক।আসফিয়া অবাক কন্ঠেই বললেন……

—তোহফা তুই?

তোহফা মলিন হেসে বলল……

—ভেতরে আসতে দেবে না ফুপি?

আসফিয়া দরজার থেকে সরে দাড়িয়ে বলল……

—হ‍্যা,হ‍্যা আয়,আয় ভেতরে আয়।

তোহফা ভিতরে ঢুকতেই আসফিয়া দরজা সামনে দাড়িয়ে বাহিরে তাকিয়ে উকি ঝুকি মেরে বলল……

—কিরে তুই একা কেন জামাই বাবাজি আসে নাই?

তোহফা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বলল…..

—বাবা বাড়িতে নেই?

আসফিয়া কিছুটা তুতলিয়ে বলল…..

—তোর বাবা!না নেই তো বাড়িতে।ভাইজান বাড়িতে নেই।কি হয়েছে তোর বল তো?তোকে এমন দেখা যাচ্ছে কেন?হুট করে একা একা চলে আসলি যে?ঐ বাড়িতে কিছু হয়েছে?

তোহফা মাথাটা নিচু করে বলল……

—আমি ঐ বাড়ি থেকে একেবারে জন‍্য চলে এসেছি ফুপি।

কথাটা শোনার সাথে সাথেই আসফিয়া এর কপালে ভাজ পরে গেলো।সে উওেজিত হয়ে বলল…….

—কেন?কি হয়েছে?তারা কি তোকে মার ধর করেছে?কি হয়েছে বল আমায়?যদি কিছু করে থাকে তাহলে সব গুলোকে ১৪শিকের ভাত খাইয়ে ছাড়বো।

তোহফা ভাঙগা গলায় বলল…..

—না ফুপি কেউ আমায় কিছু বলেনি।এমনকি তাড়াও জানে না আমি একেবারে চলে এসেছি।তোমার অসুস্থর কথা বলে আমি এখানে এসেছি।আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরে যাব না।

—কেন?ঐ বাড়ির লোকজন কি ভালো না?সেখানে কি তুই সুখে ছিলি না?

তোহফা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলল…..

—আমার কপালে সুখ নেই ফুপি।আমার কপালে সুখ নেই।বিয়ের আগে তো বাবা কম অত‍্যচার করেনি।দিনরাত মেন্টেলি পেশার দিয়েছে।গায়ে হাত তুলেছে তা তো সব নিজের চোখেই দেখেছো তুমি।বিয়ের পর একটু সুখে দেখা পেয়ে ভেবেছিলাম একটু সুখে থাকবো।তা আর হল না ফুপি।বাবা আমায় সুখে থাকতে দিল না ফুপি সুখে থাকতে দিল না।

কথাগুলো বলতে বলতে তোহফার হেচকি উঠে গেলো।আসফিয়া তোহফাকে চেয়ারে বসিয়ে সান্তনা দিয়ে বলল……

—কি হয়েছে বলবি তো?হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন নিলি?নতুন করে কি করেছে ভাইজান?

তোহফা চেচিয়ে বলল…..

—কি করেনি সেটা বল?বিয়ের আগে তো মেন্টালি পেশার দিয়ে আধপাগল বানিয়েছিল।বিয়ের আগেই তো ঐ বাড়ির লোকদের নামে আজেবাজে কথা বলে আমার মনে তাদের প্রতি ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিলো।তারা আমায় দাষী করে রাখবে,মারধর করবে। যে ছেলের কাছে বিয়ে দিচ্ছে সে অনেক খারাপ।মানুষ খুন করতেও তার হাত কাপে না।সে আমায় তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মারবে।যেই না জেনেছে আমি ঐ বাড়িতে সুখে আছি সেটা তার সহ‍্য হল না।আমার বরকে ফোন করে আমাকে ডিভোর্স দেওয়ার জন‍্য ফোস করছে।সে যদি আমায় ডিভোর্স না দেয় তাহলে সে তাদের সবার ক্ষতি করবে বলে হুমকি দিচ্ছে।তোমার ভাইজান একটা সাইকো ফুপি।মানুষকে কষ্ট দিয়ে সে পৈচাশিক আনন্দ পায়।আমার মাকে তো আর কম কষ্ট দিয়ে তিলে তিল শেষ করেনি।এখন আমার পিছনে লেগেছে।কি দোষ করেছিল আমার মা?কি দোষ করেছি আমি?বাবা হয়ে মেয়ের সাথে এমন অমানবিক আচারন করতে তার কি একটুও কষ্ট হয় না?একটা কুকুর লালন পালন করলেও তো তার প্রতি একটু হলেও মায়া দয়া জন্মায়।তার কি মন বলতে কিছু নেই নাকি?

—তুই আমার মেয়ে হলে তো তোকে কষ্ট দিয়ে আমি কষ্ট পাবো।আমার মনে মায়া দয়া থাকবে তো ভালো কথা আমার তো মনই নেই।মায়া দয়া আসবে কোথার থেকে।

পিছন থেকে কথাটা কানে আসতেই তোহফা চমকে পিছনে তাকালো।পিছনে তাকাতেই তার চেহারায় ভয়ের আভা ফুটে উঠল।তোহফা তার ফুপির দিকে তাকিয়ে কাপাকাপা গলায় বলল…….

—ফুপি বাবা এখানে?

আসফিয়া তাহের রহমান এর সামনে গিয়ে তাকে টেনে অন‍্য রুমে নিয়ে যেতে চেয়ে বলল……..

—ভাইজান তুমি ঠিক নেই।তোমাকে অন‍্য রকম লাগছে।চলো আমার সাথে।

তাহের রহমান আসফিয়ার হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে হেলতে দুলতে হাতে বেল্ট প‍‍্যাচাতে প‍্যাচাতে তোহফার সামনে এসে বলল……

—কি যেন বলছিনি?তোকে কষ্ট দিয়ে আমার কষ্ট হয় না কেন?এক কথা কতবার বলব,তুই তো আমার মেয়েই না।তোকে কষ্ট দিয়ে আমার কষ্ট হয় না।তুই যতই বাবা,বাবা বলে মুখে ফেনা তুলিস না কেন তাতে কিন্তু আমার এই পাষান মন একটুও গলে নি।

তোহফার কাছে তাহের রহমানকে কেমন যেন হিংস্র লাগছে। তাই সে তার কাছ থেকে পালিয়ে অন‍্য রুমে যাওয়ার জন‍্য পা বাড়াতেই তাহের রহমান তার হাতের বেল্ট দিয়ে তোহফার পিঠে আঘাত করে।সাথে সাথে তোহফা গগন ফাটানো চিৎকার দিয়ে উঠে।

ফ্লোরের এক কোনে ব‍্যাথায় কাতর হয়ে পরে রয়েছে তোহফা।পাশে বসে তাহের রহমান তোহফাকে দেখে পৌচাশিক হাসি দিচ্ছে।আসফিয়া,তোহফা সেন্সলেস হয়ে গেছে ভেবে হাতে করে মদের বোতল নিয়ে এসে তাহের রহমানের সামনে বসে তার দিকে বোতলটা বাড়ায়ে দিয়ে বলল…..

—মেয়েটাকে যে এভাবে মারলেন ভাইজান যদি মরে টরে যায়।তখন কি হবে?আগে মরলে তো ব‍্যাপার ছিলো না এখন তো বিয়ে হয়েছে এখন তো সমস‍্যা হতে পারে।আমায় কিন্তু ভয় করছে।কোন সমস‍্যা হবে না তো?

তাহের রহমান মদের বোতলে চুমুক দিতে নিয়ে থেমে গিয়ে বলল…….

—তোমার মুখে এসব কথা মানায় না বুঝলে।চিন্তার কোন কারন নেই।কৈ মাছের প্রান কিছু হবে না।তাছাড়া এ মরলেই বা আমার কি?এর জন‍্য আমার জীবনটা নষ্ট হয়েছে।এর মুখের দিকে তাকিয়েই এর মায়ের সাথে আমার বিয়েটা হয়েছিলো তা কি করে ভুলে যাব।এর কারনেই আমার বন্ধুরা আমায় নিয়ে হাসাহাসি করেছে।আমার ভালোবাসা আমায় ছেড়ে চলে গেছে।এদের তো আমি জানেই মারতে চেয়েছিলাম।তোমার কথা মত শুধু এদের বাচিয়ে রেখে তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে মেরে পৌচাশিক আনন্দ পাচ্ছি।আর সবার কাছে আমি এক মহান মানুষ হচ্ছি।জানো সবাই আমাকে বাহবাহ দেয়।সবাই বলে ঐ দেখ তাহের সাহেব। যে কিনা বিধবা মেয়েকে বিয়ে করে তার মেয়েকেই নিজের মেয়ের মত আদর স্নেহ দিয়ে লালন পালন করে বড় করে বড় ঘর শিক্ষিত ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছে।কত মহান তিনি।তার মত মানুষই হয় না।জানো না আপা এসব শুনে মনটা তখন ঠাণ্ডা হয়ে যায়।আপা তোমায় যে কি বলে ধন‍্যবাদ দিব আপা আমি ভাষা খুজে পাই না।তোমার বুদ্ধিতে চলে আজ আমি এতো এতো সুনাম পাচ্ছি।আহা কত বুদ্ধি তোমার।আসফিয়া কিছু না বলে হাসতে লাগলো।

এতোক্ষন এদের সব কথাই তোহফার কানে গিয়েছে।শরীরে বেন্টের আঘাতের কারনে তার যতটা না কষ্ট হচ্ছে তার থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে এটা জানতে পেরে যেই ফুপিকে সে ছোট থেকে মায়ের মত দেখে এসছে,যাকে নিজের কষ্ট দূর করার মাধ‍্যম ভাবতো সেই তাদের কষ্টের মূল কারন ছিলো।তোহফা সব শুনে যেন পাথর হয়ে পরে রইল।শরীরে আর মনে রক্ত ক্ষরন হতে হতে সে চোখ বুঝে নিল।

(তাহের রহমান তোহফার আপন বাবা নয়।তোহফার যখন দু’বছর তখন তোহফার আপন বাবা মারা যান।তোহফার মা ছিলো তাহের রহমান এর বাবার বন্ধুর মেয়ে।তিনি সব জেনে শুনেই তাহের রহমান এর সাথে তোহফার মায়ের বিয়ে দেন।তাহের রহমান নিজের বাবাকে বাঘের মত ভয় পেতে তাই তিনি তার বাবার মুখের উপর কিছু না বলে বিয়ে করে নেন।বিয়ের পর থেকে শুরু হয় তোহফার মায়ের প্রতি অমানবিক অত‍্যাচার।তাহের রহমান তোহফাকে আরো অনেক বার বলেছে সে তার আপন বাবা নয়।কিন্তু তোহফা তা বিশ্বাস করেনি।কেননা তার মা বলেছে সেই তার আপন বাবা তাই সে সেটাই বিশ্বাস করে বসে রয়েছে।)

#চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে