#তোর_হতে_চাই
#Ariyana_Nur
#Part_07
সকাল সকাল কিচেন থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে।তার সাথে ভেসে আসছে কারো কথা আর খিলখিল হাসির শব্দ।কিচেনে আইরিন বেগম সবার জন্য নিজ হাতে নাস্তা তৈরি করছে।তার পাশে দাড়িয়ে মিতু তার কাজে সাহায্য করছে সাথে বকবক করে তার কানের তেরোটা বাজাচ্ছে।আইরিন বেগম কয়েক বার মিতুতে চোখ রাঙিয়ে নিষেধ করেছে বকবক বন্ধ করার জন্য কিন্তু তাতে কোন কাজ হয়নি।মিতু তো মিতুই। সে তার ননস্টপ বকবক করেই চলেছে আর একটু পরপর নিজের কথা শেষ করে নিজেই খিলখিল করে হাসছে।আইরিন বেগম মিতুর কাজে বিরক্ত হয়ে মিতুকে হাতের খুন্তি দেখিয়ে বলল……
—তোর মুখটা কি বন্ধ করবি পাজি মেয়ে নাকি খুন্তির বারি খাবি?
মিতু একটা ভূবন ভুলানো হাসি দিয়ে বলল…….
—খালাম্মা সত্যি আমায় মারবেন?একটু মারেন না দেখি মাইর খাইতে কেমন লাগে😍
আইরিন বেগম চোখ রাঙিয়ে বলল…..
—তুই থামবি?
—খালাম্মা আপনে জানেন না পাগলেরে কোন কিছু করতে না করলে সেটা বেশি কইরা করে।আপনে আমায় কথা বলতে নিষেধ করার পর এখন আমার পেটের মধ্যে কথারা লাফালাফি করতাছে বাইরে বের হওয়ার জন্য।এখন কথা বলতে না পারলে আমার দম আটকাইয়া আসবো।
—আমি কোন পাগল নিয়ে পরেছি, আল্লাহ রক্ষা কর।তোদের দুটোর জন্য আমার কানটা শেষ।দুদিন পর কানে মেশিন লাগাতে হবে।তোদের কথার জ্বালায় যে কি করবো?
—হ এহন সব দোষ আমগো দুইজনের।আমগো কথা তো এহন আপনার ভালোই লাগে না।আমরা হইলাম পুরান মানুষ। নতুন বউ পাইছেন তারে পাইয়া কি এহন আমগো কথা ভালো লাগবো?
আইরিন বেগম মিতুর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই মিতু হাতের কাজ রেখে পালানোর জন্য বলল…….
—খালাম্মা আমি যাই দেখিগা আনিশাফা উঠছে কিনা।
কথাটা বলেই মিতু তড়িঘড়ি করে আইরিন বেগমকে কিছু বলতে না দিয়ে কিচেন থেকে বের হয়ে গেলো।
এতক্ষণ কিচেনের দরজার সামনে দাড়িয়ে আইরিন বেগম আর মিতুর কথোপকথন শুনছিলো তোহফা।মিতু চলে যেতেই তোহফা গুটিগুটি পায়ে কিচেনে ঢুকে আইরিন বেগম এর পিছনে দাড়িয়ে বলল……
—মা…!
আইরিন বেগম তোহফাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলল……
—উঠে গেছো।
তোহফা আইরিন বেগম এর পাশে দাড়িয়ে চারোপাশে চোখ বুলিয়ে বলল…….
—কি করতে হবে মা।আমায় বলুন আমি করে দিচ্ছি।
—আপাতত কিছু করতে হবে না।মিতু সব করে দিয়ে গেছে।আদি উঠেছে?
তোহফা মনে মনে আদি নামটা কয়েকবার বলে মনে করতে লাগলো এ নামটা আগে এ বাড়িতে শুনেছে কিনা।পরে ভাবলো তার কাছে তো আর তার শাশুড়ি অন্য কারো কথা জিগ্যেস করবে না।নিশ্চই তার ছেলের কথা সে জিগ্যেস করছে।আর হয়তো সে তার ছেলেকে আদি বলে ডাকে।তোহফার ভাবনার মাঝেই আইরিন বেগম পুনরায় বলল…….
—জানো তো বউমা আমার ছেলেটা না একটু চাপা সভাবের।বাড়িতে আমাদের সাথে একটু আকটু দুষ্টুমি বেশি কথা বললেও বাহিরের লোকের কাছে ও খুব গম্ভীর।সহজে ও কারো সাথে মিশতে পারে না।রাগ নেই বললেই চলে।কিন্তু যখন রাগে তখন একেবারে তুরকালাম বাধিয়ে দেয়।
জানো তো ওর মনের মধ্যে ওর কোন প্যাচ নেই।মনটা খুবই ভালো।ও নিজের চাইতে ও ওর নিজের কাছের লোকদের কে বেশি ভালোবাসে।তুমি একটু সামলে নিও।আস্তে আস্তে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।আইরিন বেগম মিষ্টি হেসে বলল……
—এখন হয়তো ভাববে আমার ছেলে দেখে আমি একটু বেশি বেশি বলছি।দুদিন পর যখন তুমি ওকে কাছ থেকে চিনবে, জানবে,বুঝবে তখন বলবে আমি ওর সম্পর্কে একটু না অনেক কম প্রশংসা করেছি।
তোহফা,আইরিন বেগম এর কথার প্রতি উওরে শুধু মুচকি হাসল।মনে মনে বলতে লাগল……
—আমি জানি না মা,আপনি তার সম্পর্কে কতটুকু সত্যি বলছেন আর কতটুকু মিথ্যে।আমি চাই খুব করে চাই আপনার কথাগুলো যেন সত্যি হয়।তাহলেই আমি আমার লক্ষ্যে পৌছাতে পারবো।
________
ঘড়ির কাটা ৩:৩০ এর ঘরে।দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই যে যার ঘরে আরাম করে ঘুমাচ্ছে।তোহফা বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে।তার মত ঘুম পাগলির চোখে ঘুম না ধরা দেওয়াতে সে নিজে নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছে।কতক্ষন এপাশ ওপাশ করে চোখ খিচে বন্ধ করে টান টান হয়ে চুপ করে শুয়ে রইল।মনে মনে নিজেকে গালাগাল করে পণ করে বলল……
—ঘুম আসবে না।দেখি কি করে ঘুম না এসে থাকতে পারে।যেভাবেই হোক আজকে জোর করে হলেও আমি এখন ঘুমাবো।
মিতু টিপটিপ করে পা ফেলে তোহফার রুমের দরজার সামনে এসে ভিতর দিকে একটু উকি দিয়ে নিচু আওয়াজে বলল……
—ভাবি ঘুমিয়ে পরেছো।
মিতুর গলার আওয়াজ পেয়ে তোহফা চট জলদি চোখ খুলে দরজার দিকে তাকাতেই দেখে মিতু দাড়িয়ে আছে।তোহফা উঠে বসতে বসতে বলল…..
—দাড়িয়ে কেন ভিতরে এস।
মিতু ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল…..
—ঘুম আসছে না তাই চলে এলাম তোমার কাছে।ডিস্টাব করলাম না তো?
—আরে না।আমার ও ঘুম আসছিলো না।এসেছো ভালোই করেছো।তোমার সাথে বসে গল্প করে সময় কাটানো যাবে।
তোহফার কথা শুনে মিতু খুশি হয়ে তোহফার পাশে পা উঠিয়ে আরাম করে বসে তোহফার সামনে নিজের কথার ঝুলি খুলে বসল।
তোহফা,মিতু মিলে জমিয়ে গল্প করছে।কথার মাঝে মিতু মলিন হেসে বলতে লাগল…..
—এ বাড়ির লোকজনদের মত তুমিও খুব ভালো ভাবি।তোমার মনটাও খুব ভালো।তা না হলে কেউ আমার মত কাজের মেয়েকে এতো সহজে মেনে নেয়।
মিতুর কথা শুনে তোহফা অবাক হয়ে বলল…..
—মানে?
মিতু মাথা নিচু করে বলল…..
—মানে আমি এই বাড়ির কাজের লোক ভাবি।ছোট বেলায় মা মারা যাবার পর বাবা অনেকটা পাগলের মত হয়ে যায়।সাংসার,মেয়ে কোন কিছুই যেন তার মাথায় থাকতো না।দিন রাত মায়ের কবরের পাশে পরে থাকত।কিছুদিন পর সেও আমায় একা করে মায়ের কাছে চলে যায়।আমরা গরীব মানুষ ছিলাম।বাবা যতটুকু সম্পদ ছিলো তা অন্য মানুষ দখলে নিয়ে যায়।মা,বাবা মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর এ বাড়িতে আমার এক আত্মীয় আমায় নিয়ে আসে।তারা প্রথমে আমি ছোট দেখে না করে দেয়।পরে যখন জানতে পারে আমি অনাথ।সব হাড়িয়ে আত্মীয় স্বজনদের ঠোকর খেয়ে মরার মত বেচে আছি তখন খাল্লাম্মারা আমায় রাখতে রাজি হয়।ছোট থেকেই আমি এই বাড়িতে আছি।তারা সব সময় আমায় সবার কাছে মেয়ে বলে পরিচয় করিয়ে দেয়।এমনকি তারা আমায় পড়ালেখাও করায়।ছোট থেকেই তারা আমায় মেয়ের মত করে আদর,শাষন দিয়ে মানুষ করেছে।আমি যে এ বাড়ির কাজের লোক তাড়া কখনো কাউকে বুঝতেই দেয় না।মাঝে মাঝে তো আমি নিজেও ভুলে যাই আমি এ বাড়ির কাজের লোক।
কথাগুলো বলার সময় মিতুর গলা জড়িয়ে যাচ্ছিল।মিতু বড় করে কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে মলিন হেসে বলল……
—আসছি ভাবি।একটু কাজ আছে।
কথাটা বলেই মিতু তড়িঘড়ি রুম থেকে বের হয়ে গেল।তোহফা মিতুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলতে লাগল….
—আজকাল এমনো মানুষ আছে?যেখানে আমি নিজের বাড়িতে আপন লোকদের কাছে তুচ্ছতাচ্ছিল্য হয়ে ছিলাম সেখানে মিতু কাজের লোক হয়েও এদের সাথে কত ফ্রি।এরা কত আপন করে নিয়েছে মিতুকে।বাহিরের মানুষ কেন আমি তো ভিতরে থেকেই বুঝতে পারিনি মিতু এই বাড়ির কাজের লোক।
________
আনিশা,মিতু,তোহফা একের পর এক ফুচকার প্লেট সাবার করেই চলেছে সাথে চলেছে তাদের ননস্টপ কথা।আদিয়াত তাদের পাশে বসে তাদের খাওয়া আর কথা শুনে বিরক্ত হচ্ছে।এমনিতেই আদিয়াত এই মহিলা পার্টির সাথে এখানে আসতে চায়নি।আনিশা,আদিয়াত কে ধরে বেধে আদিয়াত কে তাদের সাথে নিয়ে এসেছে।আদিয়াতের মেজাজ এমনিতেই গরম হয়ে রয়েছে।এখন এদের কথা ও কাজে আরো গরম হয়ে যাচ্ছে।তিন জনের প্লেটের ফুচকা এক সাথে শেষ হতেই আনিশা ওয়েটার কে ডাক দিয়ে আবার তিন প্লেট ফুচকার অর্ডার করল।ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যেতেই আদিয়াত বিরক্তি মাখা গলায় বলল…….
—তোরা পারিসও।অলরেডি তিন প্লেট শেষ করেছিস আর এক প্লেটের অর্ডার করলি।ভালো খাবার খাওয়ার সময় তো একটুতেই পেট ভরে যায়।আজ পেটে এতো জায়গা আসছে কোথার থেকে শুনি?
আনিশাঃভাবি দেখছো ভাইয়ার টাকা শেষ হবে দেখে ভাইয়া আমাদের খাবারের খোটা দিচ্ছে।ভাইয়া তুমি তো কিপটে ছিলে না।এতো কিপটে কবের থেকে হলে শুনি?
মিতুঃভাইজান আপনি এতো কিপটা আগে জানতাম না তো?মাত্র চার প্লেট ফুচকা অর্ডার দেওয়াতে কথা শুনাচ্ছেন?
মিতুর কথা শুনে তোহফা,আনিশা মিটমিট করে হাসতে লাগল।আদিয়াত,মিতুর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই মিতু,আদিয়াতকে দাত কেলিয়ে একটা হাসি উপহার দিল।আদিয়াত দাতে দাত চেপে বলল……
—বাড়ি চল পাজিগুলো তারপর তোদের ক্লাস নিচ্ছি।
______
রাস্তার এক পাশে দাড়িয়ে রয়েছে মিতু, আনিশা,তোহফা।আদিয়াত হাতে করে আইসক্রিম নিয়ে এসে আনিশার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল……
—দেখ ঠিক আছে কিনা।তোর চকলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম পাইনি তাই ভেনিলারটা এনেছি।
আনিশা,আদিয়াতের হাত থেকে আইসক্রিম নিয়ে মিষ্টি হেসে বলল……
—সমস্যা নেই চলবে।
আদিয়াতঃআর কিছু লাগবে?
আনিশাঃআমাদের কিছু লাগবে না।মা বলেছে প্রেশারের ঔষধ নিয়ে যেতে।নাম মনে আছে তো…।
আদিয়াতঃহ্যা আছে।তোরা এক পাশে দাড়া আমি নিয়ে আসছি।
আদিয়াত চলে যেতে নিয়ে কিছু একটা ভেবে তোহফার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল……
—তোমার কোন মেডিসিন লাগবে?তুমি না ঘুমের মেডিসিন নাও।আছে নাকি লাগবে?
তোহফা,আদিয়াতের দিকে ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে বলল……
—আমি আর ঘুমের মেডিসিন?
#চলবে,