তোর ছায়ার সঙ্গী হব পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

2
1941

#তোর_ছায়ার_সঙ্গী_হব
লেখক-এ রহমান
শেষ পর্ব

৭০
ঈশা দাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। তার সামনে দাড়িয়ে আছে ইভান। দুজনের দৃষ্টি দুজনের উপরে। কিন্তু মাঝখানে বাধা হয়ে দাড়িয়ে আছে লোহার কয়েকটা শিক। ইভানের এই মুহূর্তে ইচ্ছা করছে সকল বাধা পেরিয়ে ঈশাকে জড়িয়ে ধরতে। কিছু সময় তার এই প্রান পাখিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের প্রানের অস্তিত্ব জানান দিতে। কারন তাকে ছাড়া যে ইভান নিষ্প্রাণ। সকল নিরবতা ভেঙ্গে ঈশাই বলে উঠলো
–সব কিছু আমাকে আগে থেকে বললে কি হতো? রাশিক ভাইয়া আমাকে সব সত্যিটা না জানালে আমি তো কিছুই জানতে পারতাম না।
ইভান সামনের লোহার শিক গুলো শক্ত করে দুই হাতে চেপে ধরে বলল
–তোকে টেনশন দিতে চাইনি জান পাখি।
ঈশা দাতে দাত চেপে বলল
–এখন তাহলে কি করছ? খুব ভালো লাগছে আমার তাই না? খুব আনন্দে আছি আমি।
ঈশার অবস্থা বুঝতে পেরে ইভান কিছু বলল না। কারন ঈশার মানসিক অবস্থা ভালো না। তারপর এই মুহূর্তে ইভানের উপরে খুব রেগে আছে। সে এখন যা বলবে তাতেই আরও রেগে যাবে। এতে হিতের বিপরিত হতে পারে। তাই সে চোখ নামিয়ে চুপ করে দাড়িয়ে আছে। ভাবছে সব ঝামেলা মিটিয়ে তারপর ঈশার সাথে ভালো করে কথা বলবে। ইভানের এমন চুপ করে থাকা দেখে ঈশার খুব রাগ হল। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই একজন পিছন থেকে বলল
–সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কিন্তু সরি একটু দেরি হয়ে গেলো।
তার কথা শুনে দুজনি তার দিকে তাকায়। কিন্তু সেই মানুষটাকে দেখে ঈশা অবাক হয়। এটা কিভাবে সম্ভব? এই মানুষটা এখানে কিভাবে থাকতে পারে। আর কিসেরই বা ব্যবস্থার কথা বলছে? কি হচ্ছে এসব সে কিছুই বুঝতে পারছেনা। সব কিছু এতো রহস্যময় লাগছে ঈশার কাছে। ইভান এতো কিছু তার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে কেন? সে অগ্নি দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকায়। ইভান হালকা হেসে সামনে দাড়িয়ে থাকা আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে। আরমান এগিয়ে এসে বলল
–তোর জামিন হয়ে গেছে। আমরা তোকে এখনি বাসায় নিয়ে যেতে পারব। কিন্তু আমি সত্যিই সরি। এতো দেরি হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি। আমার দেরির জন্য আজ তোকে এই অবস্থায় দেখতে হচ্ছে। নিজের কাছেই অপরাধী লাগছে।
ইভান হাত বাড়িয়ে আরমানের হাত ধরে বলল
–তুই যা করেছিস তার কোন তুলনা হয়না। আর এই সামান্য একটা বিষয়ে এতো অপরাধ বোধ রেখে আমাকে ছোট করিস না।

তাদের এসব কথার মানে ঈশা কিছুই বুঝতে পারল না। কিসের উপকার আর ওরা এমন ভাবে কথা বলছে যেন অনেক আগে থেকে দুজন দুজন কে চেনে। ঈশা অগ্নি দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে হাজারো প্রশ্ন। ইভান বুঝতে পারছে ঈশার সেই চাহুনির মানে। তার দিকে তাকিয়ে অসহায়ের দৃষ্টিতে বলল
–সব বলব জান। আগে কয়েকটা কাজ শেষ করতে দে।
ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান কে বের করে কয়েকটা কাগজে সই করে নিলো। ইন্সপেক্টর ইভানের কাছে এসে বললেন
–সরি মিস্টার ইভান আমাদের ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত। তবে আপনার গোপন ক্যামেরা আপনাকে বাচিয়ে দিয়েছে।
ইভান হাসল। ঈশা ইভান আর আরমান তিনজনে পলিশের গাড়িতে উঠে বসলো। এখন উদ্দেশ্য হসপিটাল। গাড়ি হসপিটালে এসে দাঁড়ালো। সবাই ভিতরে গেলো। ভিতরে ঢুকেই ইভান দেখল রিমা বেশ চেচামেচি করছে তাকে ভিতরে যেতে দেয়া হচ্ছেনা জন্য। সবাই দাড়িয়ে তার কাজ কর্ম দেখছে। রিমা চিৎকার করে বলল
–কেন আমি দেখা করতে পারবোনা?
–আমি নিষেধ করেছি।
ইভানের গলার আওয়াজ শুনে সবাই ঘুরে তাকাল। ইরা আর ইলহাম দৌড়ে এলো। তাদের চোখে মুখে খুশির ঝলক। ইভান তাদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে রিমার কাছে গেলো। কিন্তু রিমা ইভান কে দেখে খুশি হলনা। মুখ ঘুরিয়ে বলল
–আপনি তাহলে অবশেষে ছাড়া পেলেন।
তার কথায় ইভান বাকা হেসে বলল
–এখন ভিতরে যেতে পার। বোনের সাথে শেষ কথা বলে নাও। আবার কবে বলতে পারবে তার তো কোন ঠিক নেই।
কথা গুলো রিমার মাথায় বাজ পড়ার মত অনুভুতি তৈরি করলো। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল
–কি বলতে চাইছেন?
ইভান কিছু বলল না। ইশারা করে ভিতরে যেতে বলল। রিমা ভিতরে চলে গেলো। সে পিছনে ঘুরে ঈশার দিকে তাকাল। ইলহাম এসে বলল
–ভাইয়া কি হচ্ছে খুলে বলবে?
রিহাব এগিয়ে এসে বলল
–আসলে সবাই যা ভাবছে সেরকম কিছুই হয়নি।
–মানে?
ইরা আর ইলহাম দুজনেই একসাথে বলল। ইভান একটু হেসে বলল
–রিনি সম্পূর্ণ সুস্থ।
তাদের প্রশ্নবিধ্য চাহুনি ইভান বুঝতে পেরে খুব ধির কণ্ঠে বলল
–সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিবো। কিন্তু এটা সঠিক সময় না। সঠিক জায়গাও না। সময় মতো সব জানতে পারবি।
ইভান ঈশার সামনে এসে তাকে পাশের চেয়ারে বসাল। তার পায়ের কাছে বসে দুই হাত মুঠের মধ্যে আবদ্ধ করে নিয়ে খুব শান্ত ভাবে বলল
–তোর অনেক কিছুই জানার বাকি আছে জান। আমি সবটা তোকে জানাবো। কিন্তু তার আগে নিজে থেকে কোন প্রশ্ন করিস না। যা হচ্ছে হতে দে। আমাকে বিশ্বাস করিস তো? আমি কারন ছাড়া কিছুই করিনা তুই তো জানিস। ধিরে ধিরে সব জানতে পারবি জান। প্লিজ রাগ করিস না। আমাকে বুঝতে চেষ্টা কর।
ইভানের এমন আকুতি শুনে ঈশার রাগ দমে গেলো। কিছু বলতে যাবে তার আগেই দুইজন মহিলা পুলিশ রিনিকে ধরে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনল। সাথে রিমাও আসলো। রিমা ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–এসব কি ঈশা? কোন জন্মের শত্রুতা দেখাচ্ছিস।
ঈশা কোন কথা না বললেও তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। নিজের বোনের বোকামির জন্য আজ তাকেও ভুগতে হচ্ছে। ইভান উঠে রিমার সামনে গিয়ে বলল
–শত্রুতা কোন জন্মের সেটা তুমি না জেনেই এসবে যুক্ত হয়ে গেছো? বিষয়টা মানতে পারলাম না।
রিমা তার কথা শুনে একটু ভয় পেলো। ইভান কি ইঙ্গিত করেছে তা হয়ত বুঝতে পেরেছে সে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো। রিনিকেও পুলিশ নিয়ে গেলো।

৭১
ইভান রিনির সামনে দাড়িয়ে আছে। তার পাশেই বসে আছে ইন্সপেক্টর। সে কিছুতেই কথা বলছেনা। সব রকম চেষ্টা করা শেষ। ইন্সপেক্টর বলল
–শেষ বারের মতো বলছি কেন এমন করলে আর কার কথায় সেটা না বললে এবার যে শাস্তিটা তুমি পাবে সেটা কিন্তু অসহনীয়।
এটা শুনেও রিনির তেমন কোন ভাবান্তর হলনা। সে নিচের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ইন্সপেক্টর পিছনে ঘুরে ইশারা করতেই একজন পুলিশ এসে পাশে দাঁড়ালো। রিনির দুই গাল চেপে মুখটা উপরে তুলে উপর থেকে গরম পানি ঢেলে দিলো। চোখ বন্ধ করে তা হজম করে নিলো রিনি। ইভান এবার বেশ অবাক হল। এই মেয়েকে যেমন ভেবেছিল তেমন নয়। সে শক্ত পক্ত ভাবেই এসেছিলো তাকে ফাসাতে। সেটা তার বিচক্ষন্তার কারনে পারেনি ঠিকই কিন্তু এখন ইভানের বেশ চিন্তা হচ্ছে। কারন এই মেয়ে যদি মুখ না খুলে তাহলে বাকি শত্রুদের সে কিভাবে শাস্তি দিবে। সে সব কিছু জানলেও তার কাছে কোন উপযুক্ত প্রমান নেই যে তারা তার পরিবারের ক্ষতি করতে চায়। আর প্রমান ছাড়া সে কোনভাবেই তাদেরকে শাস্তি দিতে পারবে না। তাই চিন্তিত হয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। তাকে এতো ভাবতে দেখে আরমান বলল
–যদি মুখ না খুলে তাহলে কি করবি কিছু ভেবেছিস?
চিন্তিত মুখেই ইভান বলল
–আমি এতদিন ধরে অপেক্ষা করেছি এরকম একটা সময়ের যখন ওরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে আঘাত করার চেষ্টা করবে। তাই তো আমি এতদিন চুপ ছিলাম। কিন্তু প্রস্তুত ছিলাম সব রকম আঘাতের জবাব দিতে। এই সময় এসে হেরে যাবো তা কিভাবে হয়?
কিছুক্ষন চুপ থেকে বাকা হেসে বলল
–রিমাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা কর। তারপর দেখি কিভাবে মুখ বন্ধ রাখে।
মুহূর্তের মধ্যে পুলিশের কাছে রিমাকে আনা হল। রিনির সামনে বসিয়ে দেয়া হল। রিমাকে দেখে রিনি কোন কথা না বললেও সে যে ভয় পাচ্ছে সেটা বুঝতে কারও বাকি থাকলো না। মহিলা পুলিশ রিমাকে টর্চার করতে শুরু করলো। সবাই বাইরে থেকে দেখছিল। আরমান রিনির মুখ দেখে একটু হেসে বলল
–এবার মনে হচ্ছে কাজ হবে।
ইভান একটু হেসে বলল
–ওরা ওদের কাজ করুক। আমরা যাই চল।
বলেই তারা সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। গাড়িতে বসে রওনা দিলো।

৭২
গাড়ি এসে তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। ভিতরে ঢুকে সোজা ঈশাদের বাড়িতে গেলো। সেখানে সবাই ছিল। সবাই ইভান কে দেখে খুব খুশি হল। কিন্তু আরমান কে দেখে খুব অবাক হল। আরমান যে ঈশাকে বিরক্ত করত সবাই জানে। ইভান সামনে সোফায় বসে পড়লো। চোখের ইশারায় আরমানকেও বসতে বলল। আরমান বসতেই ইভান ঈশার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল
–বড় বাবা তোমার যে জমিটা নিয়ে সমস্যা ছিল সেটার কতটুকু সমাধান করতে পেরেছ?
ঈশার বাবা ইভানের মুখে এই সময় এমন কথা শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ইভান এই কথা কিভাবে জানলো। ঈশার বাবা তার দিকে প্রশ্ন বিধ্য চোখে তাকিয়ে আছে। ইভান একটু রাগী লুক নিয়ে বলল
–তুমি কি জানো আজ তোমার এই বোকামির জন্য কত বড় মাশুল দিতে হচ্ছে। যা কিছু হচ্ছে সব কিছু ওই একটা কারনেই। আমার সাথে যা কিছু হোক তাতে কোন আফসোস নেই। কিন্তু আমার ঈশার সাথে হলে আমি সহ্য করবো না।
ঈশার বাবা আঁতকে উঠলেন। সবাই তাদের দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশার বাবা বললেন
–আমি তো শুধু……।
ইভান রেগে বলল
–তুমি যা করেছো ঠিক করনি। আজ তোমার জন্য তোমার মেয়ের জীবন নিয়ে অন্য কেউ নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে। আর তুমি কিনা সেই ছেলের সাথেই তার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলে। নিজের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য। একবারও মেয়ের কথা ভাবলে না।
ঈশার বাবা কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন
–বিশ্বাস কর বাবা আমার কোন উপায় ছিল না। ওরা আমাকে হুমকি দিয়েছিলো।
–তুমি তো আমাকে সবটা খুলে বলতে পারতে। সেটাও করনি। বাবাকেও বলনি।
–আমি বলতে পারিনি। ভয় ছিল জানাজানি হয়ে গেলে তারা আমার পরিবারের ক্ষতি করবে। তাই তো তুই যখন ঈশাকে বিয়ে করলি আমি কোন কথা না বলেই মেনে নিয়েছিলাম। কারন নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম যে আমার ঈশাকে নিয়ে আর ভাবতে হবেনা।
ঈশা এবার রেগে চিল্লিয়ে বলল
–কেউ কি আমাকে সব টা বলবে কি হচ্ছে?
ইভান ঈশার দিকে তাকায়। তার রাগ এই মুহূর্তে অনেক বেশি। ইভানের পক্ষেও এই ঈশাকে সামলানো প্রায় অসম্ভব। তাই ইভান ঈশার কাছে গিয়ে বসলো। তার দিকে তাকিয়ে বলল
–বড় বাবা আরাফের বাবার সাথে ব্যবসা করত। কিন্তু তাদের ব্যবসার মুল উদ্দেশ্য ছিল অবৈধভাবে জমি দখল করে সেগুলো নিজের নামে করে বিক্রি করে দেয়া। বড় বাবা এতো কিছু না জেনেই ব্যবসায় যোগ দেয়। কিন্তু যখন ভিতরের সব কিছু জানতে পারে তখন তিনি এই ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চায়। আরাফের বাবা বড় বাবাকে দিয়ে অনেক কিছু করানোর প্ল্যান করে রাখে তাই তিনি বড় বাবাকে ছাড়তে চান নি। তিনি বড় বাবাকে তার নামে এক জমি দিয়ে ফাসিয়ে দেন। এমন ভাবে প্ল্যান সাজান যাতে বড় বাবা সেখান থেকে বের হয়ে আসতে না পারে। কারন সেই সময় বড় বাবার পরিচিত লোকজন গুলকে সে টার্গেট করে ফেলেছে। আর বড় বাবা সেখান থেকে সরে আসলে সেগুলো হাত ছাড়া হয়ে যাবে। সেটা নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়। বড় বাবা তার এই সমস্যার কথা কাউকে বলতে পারেনা। কারন এটা অবৈধ ছিল। উলটা নিজেই সেটা ঠিক করতে চান কিন্তু পারেন না। সেই জমির কেস মিটাতে তার অনেক টাকা দরকার হয় যা তখন আরাফের বাবা তাকে দেয়। বড় বাবার সেই সময় এই টাকার দরকার ছিল বলেই কিছুই বলতে পারে নি। কিন্তু আসল সমস্যা বাধে তখনি যখন আরাফের তোর উপরে চোখ পড়ে। সে তোকে বিয়ে করতে চায় বিনিময়ে এই সব কিছু থেকে বড় বাবাকে মুক্তি দেয়ার কথা দেয়। প্রথমে বাবা আপত্তি করলেও পড়ে তারা সব রকম সমস্যা আরও জটিল করে দেয় আর অনেক ধরনের হুমকি দেয়। যা থেকে মুক্তি পাওয়ার এক মাত্র উপায় ছিল তোর বিয়ে। আর তোর বিয়ে আমাকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণটাও এটাই যে আমি জানলে এই বিয়ে হতে দিবনা। আরাফ সবই জানতো তোর প্রতি আমার অনুভূতির কথা। তাই তো সে নিজেই আমাকে জানাতে নিষেধ করেছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্রমে আমি জেনে যাই। আর তোকে জোর করে বিয়ে করায় আমাদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করতেই সে সেদিন সবার সামনে প্রমান নিয়ে আসে।
ঈশা এবার সব কথা শুনে বলল
–এতো কিছু হয়ে গেলো বাবা আমাদের কিছুই জানালেনা।
ঈশার বাবা অপরাধির মত বসে থাকলো।
ঈশা আবার ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–সেসব নাহয় বুঝলাম। কিন্তু এখন এসবের সাথে সেই ঘটনার কি সম্পর্ক?
ইভান একটু হেসে বলল
–আরাফ কখনই চায়নি তোর সাথে আমার সম্পর্ক ঠিক হোক। আমি যখন রাগ করে চলে গিয়েছিলাম তখন আরাফ খুব খুশি হয়েছিলো। কিন্তু আমি তোর উপরে রাগ করে চলে যাইনি। বড় বাবার এই ভাবে আমাকে না জানিয়ে তোর বিয়ে দেয়াটা ঠিক মনে হয়নি। তাই আমি তার কারন জানতে উঠে পড়ে লাগি। কিছুদিন পরেই সবটা স্পষ্ট হয়ে যায়। আমি এটাও জানতে পারি যে আরাফ চায় আমাদের সম্পর্ক টা ভেঙ্গে যাক। তাই আমি সব ভেবে সিদ্ধান্ত নেই দূরে চলে যাওয়ার। যাতে তারা আমাদেরকে নিয়ে আর মাথা না ঘামায়। আর আমি সব কিছু নিজের মত গুছিয়ে নিতে পারি। তাই তো এতদিন তোর সাথে মান অভিমানের নাটক করে দূরে থাকতে বাধ্য হয়েছি। আমি এখানে ছিলাম না ঠিকই কিন্তু ভেবেছিস কি আমি না থাকার পরও তারা তোকে ছুঁতেও পারেনি। এই ক্ষেত্রে আরমান আমার চোখ হয়ে ছিল। সে আমার হয়ে তোকে আগলে রেখেছে। তোর আশে পাশেও কাউকে ভিড়তে দেয়নি। কিন্তু ওরা জানতোনা আরমান আমার বন্ধু। যখন জানতে পারে আরমান তোকে পছন্দ করে তখন আমাদের সম্পর্ক ভাঙ্গার জন্য আরমান কে ব্যবহার করে। আর আরমান তাদের সাথেই কাজ করতে শুরু করে। এর ভিতরে আমি সব গুছিয়ে নিয়ে এক বারেই চলে আসার সিদ্ধান্ত নেই। এতে তাদের খুব অসুবিধা হয়। এই জন্যই আমি হয়ে যাই তাদের সব থেকে বড় শত্রু। আর তার ফলেই আমাকে পদে পদে এভাবে ফাসান হচ্ছে।
ঈশা ভ্রু কুচকে বলে
–তাহলে আরমান ভাইয়ের কথা শুনে ওভাবে রিয়াক্ট করেছিলে কেন?
ইভান একটু হেসে বলে
–তোর সাথে যে সব সময় রিমা থাকে তুই কি জানিস ওর পরিচয়?
–হুম! আরমান ভাইয়ের কাজিন।
আরমান একটু হেসে বলে
–আমার দূর সম্পর্কের কাজিন কিন্তু আরাফের খুব কাছের লোক। ওকে তোমার আশে পাশে থাকতে আরাফই বলেছিল।
ইভান বলল
–রিমা সেদিন আমাদের সম্পর্কের গভীরতা মাপার জন্যই আরমানের কথা বলেছিল। কিন্তু আমার ওভাবে রিয়াক্ট করা দেখে বুঝতে পারল আমাদের মধ্যে আগের মত কিছুই নেই। মাঝখানে একবার ওরা আরমানের উপরে সন্দেহ করেছিলো। তখন আমাকে আরমানের এক্সিডেন্টের অভিনয় করতে হয়েছিলো। যাতে বিষয়টা তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বোকামিটা তখনি করেছিলো আরমান কে বিশ্বাস করে। তাই তো আজ সব কিছুতেই হেরে যাচ্ছে। আর হ্যা আমার এক্সিডেন্টের পুরো প্ল্যানটা তাদের সাজানো। আমার গাড়ির ব্রেক ফেল করে দিয়েছিলো। সেদিনও যদি আরমান না থাকত তাহলে আমি আজ বেঁচে থাকতাম না।
ইভান ঈশার গলার লকেট টা ধরে বলল
–এটার জন্য আমি সেদিন তোকে থাপ্পড় মেরেছিলাম। আন্দাজ করতে পারিস কেন?
ঈশা মাথা নাড়িয়ে না বলল। ইভান একটু হেসে বলল
–আমি জখন তোর কাছে ছিলাম না তখনো তোর সব কথা শুনতে পেতাম।
লকেট টা খুলে তার ভিতরে থাকা মাইক্রো চিপটা বের করে ঈশাকে দেখাল। ঈশা অবাক হয়ে দেখছে। এতো বছর ধরে সে ওই লকেট গলায় ঝুলিয়ে বেড়াচ্ছে কিন্তু বুঝতে পারেনি কখনও। ইভান একটু হেসে ঈশাকে বলল
–আমি তোকে এমনি এমনি মারিনি। এই মাইক্রো চিপটার কারনেই তুই কখন কি করিস আমি সব জানতে পারতাম। আর তোর উপরে আসা সব বিপদ আটকাতে পারতাম। তুই সেদিন যখন এটা খুলেছিলি তখন আমি কোন রেসপন্স না পেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। বাসায় এসে দেখি তুই বাসাতেই আছিস। কিন্তু রাগ টাকে কন্ট্রোল করতে পারিনি। আর তুই কি জানিস এই বাড়ির ভিতরে আর বাইরে ঠিক কতগুল ক্যামেরা লাগান আছে।
সবাই তার কথা শুনে হা হয়ে যায়। এতদিন যাবত সবাই ক্যামেরার মধ্যে চলাফেরা করছে অথচ কেউ জানতেই পারল না। ঈশা আবার ইভানের দিকে তাকায়। ইভান তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বলে
–আমার অফিসেও এমন অনেক ক্যামেরা লাগান আছে যা আমি ছাড়া কেউ জানেনা। রিনির সাজানো নাটক যে আমার সেই গোপন ক্যামেরায় ধরা পড়বে সে জানতোনা। কিন্তু দেখ ওর দুর্ভাগ্য।
ইভানের সব কথা শুনে সবাই যেন নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। ইভান এতো কিছু করেছে অথচ কাউকে কিছুই জানতে দেয়নি। সবাই এখন বাক রুদ্ধ। রিহাব ইভান কে উদ্দেশ্য করে বলে
–আমার একটা বিষয় মাথায় ঢুকছে না এটা নাটক হলে রিনির পেটে নেশা জাতীয় দ্রব্য পাওয়া গেলো কিভাবে।
ইভান একটু হেসে বলল
–এটার ক্রেডিট অবশ্য পুরোটাই ঈশার। সে যদি সকালে হঠাৎ করে আমার অফিসে না যেত তাহলে সেই নেশা জাতীয় পানি আমার পেটে যাওয়ার কথা ছিল।
আরমান চিন্তিত হয়ে বলল
–ঈশার অফিসে জাওয়াতে তাদের প্ল্যানে চেঞ্জ করতে হয়েছে। তবে সেটা যদি না হতো তাহলে কিন্তু আমাদের খুব অসুবিধা হতো প্রমান করতে।
এমন সময় আরমানের ফোন বেজে উঠলো। সে ফোনটা রিসিভ করে একটু সময় কথা বলে ইভানের দিকে তাকাল। তারপর হাসি মুখে বলল
–তোর প্ল্যান কাজ করেছে। ওরা দুই বোন সব স্বীকার করেছে। এখন আসল অপরাধির খোজে পুলিশ।
ইভান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। এতো বছরপর সে নিশ্চিন্ত হল। একবার ওরা ধরা পড়ে গেলে আর কোন ভয় নেই।

৭৩
কলিং বেল বাজতেই ঈশা দরজা খুলে দিলো। ইভান তার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা বাকিয়ে ঈশার পিছনে তাকাল। ঈশাও মাথা ঘুরে সেদিকে তাকাল। ইভান ধির পায়ে ঢুকে হাঁটু মুড়ে নিচে বসে পড়ল। সামনে থেকে একজন আলতো পায়ে এসে তাকে দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে আধো আধো কণ্ঠে বলল
–পাপা তুমি এসেছ?
ইভান একটু হেসে বলল
–আমার প্রিন্সেস আমার জন্য অপেক্ষা করছে আর পাপা না এসে পারে।
বলেই পকেট থেকে দুইটা চকলেট বের করলো। ঈশা হেসে ফেললো। ইভান প্রতিদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে আসার সময় দুইটা একি চকলেট আনে। একটা মায়ের জন্য আর একটা মেয়ের জন্য। কারন দুই জনেরই একি চকলেট পছন্দ। ইনায়া কে কোলে নেয় ইভান। চকলেটের প্যাকেট খুলে তার হাতে দেয়। এটা তার প্রতিদিনের রুটিন। সে মুগ্ধ হয়ে দেখে ইনায়ার চকলেট খাওয়া। মেয়েটার মাঝে মায়ের সব বৈশিষ্ট্য আছে। ইনায়া একদম ঈশার মতো। ইভান ইনায়া কে নিয়ে ঘরে চলে যায়। ঈশা তার পিছনে পিছনে ঘরে গিয়ে দাঁড়ায়। ইভান ইনায়ার গালে একটা চুমু দিয়ে ঈশার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। ঈশা একটু হেসে তার হাতে হাত দেয়। এক হাতে ঈশাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলে
–তোদের দুজনের মাঝেই আমার দুনিয়া। তোরা দুজনি আমার জীবন।
ঈশা ইভান কে ছেড়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে ইনায়াকে কোলে নেয়। তারপর ইভান কে বলে
–ফ্রেশ হয়ে এসো আমরা এক সাথে খাবো।
ইভান দুই হাতের মাঝে দুজনকে জড়িয়ে ধরে দুজনের গালেই চুমু দেয়। ইনায়াও ইভানের গালে চুমু দিয়ে বলে
–লাভ ইউ পাপা।
ইভান একটু হেসে বলে
–লাভ ইউ টু মাই প্রিন্সেস।
বলেই ওয়াশ রুমের দিকে যায়। কি মনে করে আবার ঘুরে দাঁড়ায়। ঈশা আর ইনায়া কি নিয়ে যেন হাসাহাসি করছে। ইভানের মন ভরে যায়। এই দুইটা মানুষের মুখে হাসি দেখলে ইভানের মনে হয় সে যেন জীবিত আছে। এই দুইটা মানুষ তার প্রানের অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়। একটু হেসে ওয়াশ রুমে চলে যায়।

সমাপ্ত
(ধৈর্য নিয়ে যারা গল্পটা পড়েছেন তাদের সবার জন্য আমার আন্তরিক ভালোবাসা। আসলে পাঠকরাই লেখকের অস্তিত্ব। পাঠক না থাকলে লেখক হয়ে উঠা সম্ভব না। তাই আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এই গল্পে আমি দুজন মানুষের সিমাহিন ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি ফুটে তুলতে চেয়েছি। যেখানে জীবনের অনেক বাধা বিপত্তি পার করেও তারা একসাথে থাকার প্রয়াশ করে। ধন্যবাদ সবাইকে। )

2 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে