#তোর_ছায়ার_সঙ্গী_হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২৬
৫৯
আজ সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। রিহাব আর ইরার বিয়ে। ঈশা আর ইভান ৩ দিন হল ফিরেছে। এই তিনদিনে সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। খুব একটা কষ্ট হয়নি কারন খুব ছোট করে ঘরোয়া একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। তবে ইভান খুব ব্যস্ত। আসার পর থেকে সে একরাতও ঘুমায়নি। দুই হাতে একটা প্লেট ধরে উপরে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে ঈশা। ভ্রু কুচকে সেই প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে। অন্য মনস্ক হতেই পা এলোমেলো ভাবে সিঁড়িতে পড়তেই পড়ে যেতে নিলে কেউ একজন তার কোমর জড়িয়ে ধরে। একটু ভয় পেয়ে উঠতেই হাতটা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। পাশে ঘুরে তাকাতেই ইভানের রক্তিম চোখ দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো। ইভান কে কিছু বলতে না দিয়েই চোখে চোখ রেখে আবেগি কণ্ঠে বলল
–আমি তো জানতাম তুমি ধরবে।
ইভান রাগ করে ঈশাকে সোজা করে দিয়ে বলল
–একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিবো গালে। এখান থেকে পড়ে গেলে কি হতো?
–পড়তাম না তো! তুমি আছো যে।
ইভান আরও রেগে গেলো। ঈশার চুল ধরে মুখটা নিজের কাছে এনে দাতে দাঁত চেপে বলল
–আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু তোকে নিয়ে কোন হেয়ালি আমি কোন ভাবেই সহ্য করবো না। কথাটা মাথায় রাখিস।
বলেই ঈশার চুল ছেড়ে দিলো। কিন্তু ঈশা এক চুলও নড়ল না নিজের জায়গা থেকে। ইভান একটু বিরক্ত হল। ভ্রু কুচকে নিতেই ঈশা তার মুখটা কাছে এনে আলতো করে ইভানের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুয়ে দিলো। কিছুক্ষনের জন্য ইভান থমকে গেলো। ঈশা যে এমন কিছু করবে সেটা তার ধারনাও ছিলোনা। একটু হেসে ঈশা চলে যেতে নিলে ইভান তার হাত ধরে তাকে টেনে এনে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। ঈশা চারিদিকে তাকিয়ে মুখে লজ্জা মাখা হাসি নিয়ে ফিস ফিস করে বলল
–কি করছ? এটা সিঁড়ি যে কেউ যেকোনো সময় এসে যাবে।
ইভান ঈশার কথার গুরুতু না দিয়ে বলল
–তুই আমার বিয়ে করা বউ। এসব আমার অধিকার। কারও উপস্থিতি আমাকে এসব থেকে বঞ্চিত করতে পারবে না।
কথা শেষ করে ইশার দিকে আগাতেই নিচ থেকে কথা বলতে বলতে ঈশার বাবা উপরে উঠছিলেন। ইভান তার গলার আওয়াজ পেয়ে সরে এক পাশে দাঁড়ালো। ঈশা একটু হেসে বলল
–এরকম সাহস না দেখানোই ভালো যার জন্য হাসির পাত্র হতে হয়।
ইভান তার কথায় রেগে গেলো। ঈশা এক দৌড় দিয়ে উপরে চলে গেলো। ইভান তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।
৬০
ঈশা অনেকক্ষণ যাবত আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুলের খোপায় ফুল লাগাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কোন ভাবেই পারছেনা। ইভান দরজায় দাড়িয়ে ঈশাকে দেখছে। একটু হেসে কাছে এসে তার চুলে ফুলের গাজরাটা আটকে দিলো। ঈশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই পিছন থেকে জড়িয়ে নিয়ে বলল
–কার জন্য এতো সাজগোজ?
ঈশা আয়নায় ইভানের চোখে চোখ রেখে বলল
–আমাকে বউ সাজতে দেখতে ইচ্ছা করেনা তোমার?
ঈশার কথা শুনে ইভান তাকে ছেড়ে দিলো। স্থির দৃষ্টিতে আয়নার মাঝে ঈশাকে দেখে নিলো। নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল
–একটা সময় এই ইচ্ছাটা খুব করে ছিল জানিস। কিন্তু এই ইচ্ছাটার অপেক্ষায় তোকেই হারিয়ে ফেলছিলাম। যদি তোকেই হারায়ে ফেলি তাহলে এসব চাওয়ার কি মানে? তাই এখন তোকে পাওয়ার পর এসব ভাবিনা। ভাবি কোন অপূর্ণতা নাই আর জীবনে।
ঈশা ইভানকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। ইভান বুঝতে পারে ঈশার মনের অবস্থা। তাকে জড়িয়ে ধরে বলে
–আমার সব চাওয়া পাওয়া তুই পর্যন্তই শেষ জান।
ঈশার চোখ বেয়ে দুই ফোটা পানি বেয়ে পড়ে। ভাবতে থাকে “একটা মানুষ এতোটা কিভাবে ভালবাসতে পারে। ক্লান্তি আসেনা তার? নাকি তার জন্মই আমাকে ভালোবাসার জন্য?”
ঈশার ভাবনার মাঝেই ইভান তার মুখ তুলে চোখ মুছে দিয়ে বলে
–আজ ইরার বিয়ে। এখনি কেঁদে সব মেকাপ নষ্ট করে ফেলবি? আর কিছুক্ষন থাক তারপর কাদিস।
ইভানের কথা শুনে ঈশা আয়নায় তাকাল। আসলেই তো চোখের পানিতে কাজলের এক অংশ লেপটে গেছে। টিস্যু দিয়ে সযত্নে মুছতে মুছতে বিরক্তি নিয়ে বলল
–তুমি আমার মেকাপ নষ্ট করে দিলে কেন?
ইভান রেগে বলল
–একটা থাপ্পড় লাগাব। আমি তোকে কাঁদতে বলেছি।
ইভানের কথা শুনে ঈশা একটু ভাবল। তারপর বুঝতে পারল ঠিকই তো। সে নিজেই ইভানের কথা শুনে কেঁদে ফেলেছে। অসহায়ের মতো মুখ করে বলল
–কেন এভাবে ইমোশনাল কথা বল।
ঈশার কথা শুনে ইভান তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–তাড়াতাড়ি বাইরে আয়। রিহাবরা এখনি এসে যাবে।
ঈশা মাথা নাড়াল। ইভান বাইরে যেতে নিয়ে আবার থেমে গেলো। পিছনে ঘুরে বলল
–ঈশা
ইভানের আবেগি কণ্ঠে নিজের নাম শুনে ঈশার সারা শরীরে এক তৃপ্তির শিহরণ বয়ে গেলো। পিছনে ঘুরে তাকাল। ইভান একটু হেসে বলল
–অনেক সুন্দর লাগছে জান।
ঈশা হেসে দিলো। ইভান বাইরে চলে গেলো।
৬১
বিয়ে শেষ হল। বিদায়ের পালা। ইরা কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দিচ্ছে। তার সাথে তার মাও। বাকি সবাই ছল ছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ধির পায়ে সামনে এগিয়ে গেলো। ইরার মাথায় হাত রাখতেই ডুকরে কেঁদে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরল। ঈশা আর কিছু বলতে পারলনা। চোখ বেয়ে অঝরে পানি পড়লো। ইলহাম এগিয়ে এসে ইরার দিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে ধরা গলায় বলল
–পেত্নি এতোই যখন কাদবি তাহলে বিয়ে করার কি দরকার ছিল।
তার কথা শুনে কষ্টের মাঝেও সবাই হেসে দিলো। ইরাও নিজের চোখের পানি মুছে ইলহামকে জড়িয়ে ধরে বলল
–আমাকে বিরক্ত করতে আসবে কিন্তু ভাইয়া।
ইলহাম পরম যত্নে তার মাথায় হা বুলিয়ে দিয়ে বলল
–আসবো রে। তোর সাথে ছোট বেলা থেকেই কত খেলেছি। খেলার ছলে অনেক মেরেছি। পারলে তোর এই ভাইকে মাফ করে দিস।
তার আবেগি কথা শুনে ইরার কান্নার মাত্রা বেড়ে গেলো। ইভান ইরার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–এতো কাদছিস কেন? আমরা তো যাবোই তোর বাড়িতে। এক বারেই তো আর চলে যাচ্ছিস না।
ইরা এবার ইলহাম কে ছেড়ে দিয়ে ইভান কে জড়িয়ে ধরল। ইভান ধির পায়ে তার সাথে কথা বলতে বলতেই গাড়ির সামনে এনে দাড় করিয়ে দিলো। গাড়ির দরজা খুলে তাকে ভিতরে বসিয়ে দিলো। ইরা দুই হাতে মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো। ইভান রিহাবের দিকে তাকিয়ে বলল
–সাবধানে যাস। পৌঁছে ফোন করিস।
রিহাব সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসে পড়লো। গাড়ি নিজ গতিতে চলছে। ইরা জানালার কাচে মাথা ঠেকিয়ে নিরবে চোখের পানি ফেলছে। রিহাব একবার তাকে দেখে নিয়ে বলল
–একেই তো পরিবারের কাছ থেকে এভাবে নিয়ে যাচ্ছি তারপর আবার এতো কাদলে নিজের অপরাধ বোধ টা বেড়েই যাচ্ছে। সেটা রাখার জায়গা আমার নেই।
রিহাবের এমন কথা শুনে ইরার মায়া হল। মনে হল সত্যিই একটু বেশি করে ফেলছে। সে তো জেনেই বিয়ে করছে যে তাকে শ্বশুর বাড়িতে যেতে হবে। তাহলে এতো কান্না কিসের? চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। রিহাব সামনে থাকা পানির বোতল টা এগিয়ে দিলো। ইরা সেটা হাতে নিয়ে একটু পানি খেয়ে নিলো। তারপর সেটা সামনে রেখে জানালা দিয়ে আবার তাকাল। রিহাব ধির কণ্ঠে বলল
–এখন ভালো লাগছে?
মন খারাপের মাঝেও এক রাশ ভালো লাগা ছুয়ে গেলো। মাথাটা আলতো নাড়িয়ে হ্যা বলল। খানিকবাদে গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাড়ির সামনে। তারা গাড়ি থেকে নামল। সবাই তাদেরকে দেখার উদ্দেশ্যে বাড়ির সামনে ভিড় করেছে। ইরার শাশুড়ি তাকে বরন করে নিলো। তারপর ভিতরে একজন কে উদ্দেশ্য করে বলল
–ওকে ঘরে নিয়ে যাও।
ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
–ঘরে গিয়ে এসব চেঞ্জ করে ফেল। অনেক টায়ার্ড লাগছে তাই না?
শাশুড়ির কথা শুনে ইরার মায়ের কথা মনে পড়লো। শাশুরিকে জড়িয়ে ধরল। তার শাশুড়ি পরম আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল
–আমিও একদিন বউ হয়ে এসেছি এই বাড়িতে। আজকের দিনটা কতটা কষ্টের তা আমার খুব ভালো মত জানা আছে।
ইরা চোখ থেকে দু ফোটা পানি ফেললো। তার শাশুড়ি মুখ তুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
–আর যেন চোখে পানি না দেখি। এখন যাও।
ইরা একটু হেসে মাথা নাড়িয়ে ঘরে চলে গেলো। সামনের ঘরের দরজাতে লাগান এক গুচ্ছ ফুল। দরজা খুলে ভিতরে যেতেই চোখে পড়লো সাজানো খাট। মেয়েটি ইরাকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল
–ভাবি আমি আসি। ভাইয়া এখনি চলে আসবে।
বলেই একটা হাসি দিলো। ইরা খুব শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো
–তোমার নাম কি?
–শান্তা।
ইরা একটু হাসল। মেয়েটি চলে গেলো। ইরা একা একা সব ঘুরে দেখছিল। ঘরটা অনেক সুন্দর করে সাজানো। আচমকা দরজা খোলার আওয়াজে চমকে উঠলো ইরা। রিহাব রুমে এসে ঢুকল। তারপর দরজাটা লক করে দিলো। ইরার এখন ভয়ে বুক কাঁপছে। হাত পা রীতিমতো কাঁপছে। এক হাতে শাড়ীর আচল মুঠ করে ধরে এক পাশে দাড়িয়ে আছে। রিহাব ইরার দিকেই আসছে। কিন্তু ইরার সাহস হল না চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে। সে মাথা নামিয়ে দাড়িয়ে আছে। রিহাব তার অনেকটা কাছে এসে পড়েছে। এবার তো ইরার মুখের কথাই বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু বলতে চাইলেও মুখ থেকে বের হচ্ছেনা। এই অবস্থায় রিহাব ইরাকে অবাক করে দিয়ে বলল
–এখনো চেঞ্জ করনি?
রিহাবের শান্ত গলার আওয়াজ শুনে ইরার একটু সাহস হল। হাতের মুঠোয় ধরে রাখা শাড়ী ছেড়ে দিলো। একটা শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–করতেই যাচ্ছিলাম।
রিহাব বিছানায় বসে পড়লো। ইরার দিকে তাকিয়ে বলল
–তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নাও।
ইরার এই মুহূর্তে রিহাবের মুখটা দেখতে খুব ইচ্ছা হচ্ছিলো। কিন্তু শত সাহস সঞ্চয় করেও চোখ তুলে তাকাতে পারল না। তাই আর চেষ্টা না করে লাগেজ থেকে নিজের কাপড় বের করে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। রিহাব একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ইরা ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দেখে রিহাব চোখের উপরে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে গেছে কিনা বুঝতে পারছে না। ধির পায়ে তার পাশে বসতেই রিহাব হাত সরিয়ে ইরার দিকে তাকায়। তারপর উঠে বসে খুব শান্ত গলায় বলে
–এখনো মন খারাপ?
ইরা চোখ নামিয়ে মাথা নাড়িয়ে না বলল। তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল
–আপনি চেঞ্জ করবেন না?
–করবো।
কিছুক্ষন এভাবেই চুপ করে থেকে রিহাব বলল
–তুমি রেস্ট নাও আমি চেঞ্জ করে আসি।
বলেই ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ইরা উঠে এবার পুরো ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ঘরে দেখা শেষ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। রিহাব ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে ইরাকে রুমে দেখতে না পেয়ে বারান্দায় গেলো। ইরা দাড়িয়ে আছে। থেমে থেমে ওঠা হাওয়ায় চুল গুলো অগছালোভাবে উড়ছে। রিহাব ইরার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার এক হাতের উপরে হাত রেখে অপর হাত দিয়ে কোমর ধরে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। আচমকা এমন হওয়ায় ইরা ভয় পেয়ে কেঁপে উঠলো। সামনে তাকিয়ে বলল
–তোমার সাথে নতুন জীবনের পথ চলা শুরু করতে চাই। মৃত্যু পর্যন্ত তোমার সাথে থাকতে চাই। সঙ্গ দিবে আমাকে?
ইরা চুপ করে থাকে। তার কোন উত্তর না পেয়ে রিহাব তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে মুখটা আলতো করে তুলে তাকায়। ইরার অস্বস্তি হয়। চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার ঠোঁট কাঁপছে অনবরত। রিহাব তার সেই ঠোঁটে আলতো করে নিজের ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে বলে
–আমার মনের সব টুকু ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে ভালবাসতে চাই। দিবে কি আমাকে সেই সুযোগ?
ইরা চোখ খুলে ফেলে। রিহাবের এই অদ্ভুত দৃষ্টি ইরার ভিতরে জমান সমস্ত আবেগকে অস্থির করে তুলছে। সে আর তাকিয়ে থাকতে পারল না। ইরা রিহাব কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। রিহাবও ইরাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।
চলবে…………