#তোর_ছায়ার_সঙ্গী_হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ২৪
৫৫
সকাল সকাল চায়ের সাথে আড্ডায় মেতে উঠেছে পুরো বাড়ির সবাই। সাথে যুক্ত হয়েছে ঈশার ফুপু আর তার মেয়ে সিমানা। ইরার বিয়ের আলোচনায় মেতে উঠেছে সবাই। ইভান সদ্য শাওয়ার নিয়ে একটা ডার্ক ব্লু রঙের শার্ট পরেছে। ইন করা শার্টটার হাটা ফোল্ড করা। ভেজা চুলের মধ্যে দুই হাত চালাতে চালাতে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। ঈশার চোখ তার উপরে পড়তেই আটকে গেলো। আজ একটু হলেও ইভান কে অন্য রকম মনে হচ্ছে। ঠোটের কোনের ক্ষীণ হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেজাজ বেশ ফুরফুরে। একটু ভাবতেই রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। ইভানের এমন মেজাজের কারন উদ্ধার হতেই ঈশার এবার চোখ পড়লো শার্টের দিকে। এই রঙটা ঈশার খুব পছন্দ। ইভান এমন রঙ সচরাচর পরেনা কিন্তু ইভান কে এই রঙ পরলে যে অনেক সুন্দর লাগে সেটা ঈশা ছোট বেলায় একবার ইভান কে বলেছিল। তারপর থেকে কয়েকবার এমন রঙের পাঞ্জাবি পরতে দেখেছে। কিন্তু এই প্রথমবার শার্ট পরতে দেখল। ঈশা হালকা হাসি নিয়ে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
–আরে ভাইয়া তোমাকে তো অনেক সুন্দর লাগছে!
সিমানার কথাটা কানে আসতেই ইভান সামনের দিকে তাকাল। সবার আগে ঈশার দিকেই চোখ পড়লো। ঈশার অমন দৃষ্টির মানে ইভান একটু বুঝতে চেষ্টা করলো। তারপর নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরে একটু হাসল। ঈশা ততক্ষনে চোখ নামিয়ে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান হালকা হেসে ঈশার পাশের চেয়ারটাতে বসতে বসতে সিমানার কথার উত্তর দিলো।
–থ্যাঙ্ক ইউ!
ঈশা ইভানের দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলো। চায়ে একটা চুমুক দিতেই তার ফুপু বলল
–বিয়ের ডেটটা আর কিছুদিন পর করলে হতোনা। ইরার বয়স কম। এখনি সংসারের দায়িত্ব নিয়ে সব সামলে উঠতে পারবে?
–কেন ফুপু আমারও তো ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছে। আমি সামলে উঠতে পারিনি? আমার যখন বিয়ে হয়েছে তখন আমি আরও ছোট ছিলাম। বিয়ের বিষয়ে কিছুই বুঝতাম না। ইরা তো এখন সেই অনুযায়ী অনেক বড়। তাহলে এতো চিন্তা কিসের?
ঈশা কথাটা বলতেই তার ফুপু কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। যেন মস্ত বড় একটা পাপ করে ফেললো। কঠিন গলায় বলল
–অযথা কথা বলিস না। বিয়ে যখনি হোক সংসারত আর তখন করিস নি। তখন তো এসবের ছিটে ফোটাও পাস নি। এই বুড়ো বয়সে সংসার করছিস।
কথাটা শুনে ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কি বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নামিয়ে নিলো। তিনি আবার হতাশার সূরে বললেন
–বেচারা স্বামীটাকেও এতো বছর কাছে ঘেষতে দিস নি।
এই কথার পর সবাই মুখ চেপে হাসতে লাগলো। আর ঈশা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলো। ঈশার অবস্থা আন্দাজ করেই ইভান চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার জন্য ঠোটের কাছে ধরেও চুমুক দিতে পারল না।ঠোঁট চেপে হাসি আটকাতে চেষ্টা করলো। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে শেষ পর্যন্ত নিঃশব্দে হেসে ফেললো। ঈশাকে আর একটু অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলতে খুব শান্ত কণ্ঠে বলল
–আমাদেরকে বের হতে হবে মনে আছে। আমি নিচে আছি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আসো মিসেস ইভান মাহমুদ।
সবাই ইভানের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সেদিকে কোন পাত্তা না দিয়ে সে ফোনে ব্যস্ত। ঈশার এবার চরম অস্বস্তি হচ্ছে। সে আর বসে থাকতে পারল না। উঠে চলে গেলো। ইভান আড় চোখে একবার ঈশাকে দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সবার উদ্দেশ্যে বলল
–আমি গেলাম।
বলেই নিচে চলে গেলো। গাড়িতে বসে পড়লো। ঈশার জন্য অপেক্ষা করছে। ঈশাকে নিয়ে রিহাব দের বাড়িতে যাবে। সব কিছু আলোচনা করে নিয়ে শপিং করবে। সময় যেহেতু খুব কম তাই অনেক কাজ বাকি। একবার ঘড়িটা দেখে নিয়ে সামনে তাকাল। ঈশা এতো দেরি করছে কেন কে জানে। কি যে করছে মেয়েটা। ভাবতেই পাশে তাকাতেই তার চোখ আটকে গেলো। ঈশা একটা লাল রঙের জামা পরেছে। লাল ওড়নাটা মাথায় টেনে দিয়েছে। ইভান তাকে নিস্পলক দেখছে। নিজের হাতে পার্সের মাঝে কি যেন হাতড়াতে হাতড়াতে এসে ইভানের পাশের সিটে বসলো। নিজের কাজ শেষ করে ইভানের দিকে তাকাতেই তার অমন চাহুনি দেখে নিজের ভ্রু কুচকে নিয়ে বলল
–আমাকে দেখার অনেক সময় পাবে। এখন অনেক কাজ যেগুলো শেষ করতে হবে।
ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখ খুলে একটা হতাশা ভরা শ্বাস ছেড়ে সামনে তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়। ঈশা বুঝতে পেরে একটু হাসে। ইভান আড় চোখে তাকে দেখে বলে
–আজকাল দেখি আমাকে ইম্প্রেস করার চেষ্টায় থাকিস!
ঈশা নিজের ভ্রু কুচকে নিয়ে বলল
–তখন ওভাবে বললে কেন সবার সামনে?
ইভান শব্দ করে হেসে ফেললো। ঈশার দিকে না তাকিয়েই বলল
–ফুপুর কথাতে লজ্জায় তোর চেহারার যা অবস্থা হয়েছিলো। সেটা দেখেই সেই চেহারার লজ্জাটা আর একটু বাড়িয়ে দেয়ার লোভ টা সামলাতে পারলাম না। তুই জানিস তোকে ওই অবস্থায় কত কিউট লাগছিলো?
ঈশা ইভানের কথা শুনে রেগে গেলো। একটু কঠিন হয়ে বলল
–ফুপু না বুঝেই অমন কথা বলেছে আর তুমি ইচ্ছা করে আমাকে অমন অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেললে।
ইভান একটু মন খারাপ করে বলল
–সরি!
ঈশা বিরক্তি নিয়ে বলল
–আচ্ছা তুমি তো এমন ছিলেনা। এখন কথায় কথায় এতো অভিমান রাগ কোথা থেকে আসে।
ইভান স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–ওই যে ফুপু বলল এতো বছর কাছে ঘেষতে দিস নি। তাই প্রতিশোধ নিচ্ছি।
ঈশা রেগে গেলো। ঈশার রাগ করা দেখে ইভান এক হাত দিয়ে ঈশার হাত আলতো করে ধরে নিজের কোলের উপরে রেখে বলল
–সরি জান! মন খারাপ করিস না। এমনিতেই দুষ্টুমি করে বললাম। তোর মন খারাপ দেখলে আমারও মন খারাপ হয়ে যায়।
ঈশা ইভানে দিকে তাকাল। সে সামনে তাকিয়েই কথা গুলো বলল। ইভানের মনটা আজ খুব ভালো। ঈশা সেটাকে কোন ভাবেই খারাপ করতে চায়না। তাই বলল
–এতো ইমোশন যে কোথা থেকে আসে। আমি কি বলেছি আমার মন খারাপ।
বলেই একটু হেসে ইভানের ঘাড়ে মাথা দিলো। কিছুক্ষন পরেই চমকে উঠে বলল
–আমরা কোথায় যাচ্ছি?
ইভান কোন কথা বলল না। এতো স্বাভাবিক আচরণ করলো যে ঈশার কথা তার কানেই যায়নি। ঈশা আবারো জিজ্ঞেস করলো
–কি হল? আমাদের তো রিহাব ভাইয়াদের বাসায় যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমি যতদূর জানি এই রাস্তা তাদের বাড়ি থেকে উলটো দিকে।
ইভানের দিকে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকলো। কিন্তু ইভান তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে একটা হাসি দিলো। সেই হাসির অর্থ বোঝার ক্ষমতা ঈশার নেই। তাই সে চুপচাপ দেখে বোঝার চেষ্টা করছে কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছে না। ইভানও আর কোন কথা বলছে না। বেশ কিছুদুর যাওয়ার পর গাড়ি থেমে গেলো। ইভান গাড়ি থেকে নেমে ঈশার দরজা খুলে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। ঈশা কোন কথা না বলে তার হাত ধরে ফেললো। ইভান একটু হেসে তাকে নিয়ে ভিতরে গেলো। ঈশা ভিতরে ঢুকেই বুঝতে পারল এটা একটা রেস্টুরেন্ট। কিন্তু শহর থেকে অনেক দূরে। দিনের বেলাতেও পুরো জায়গাটা অন্ধকার। কিছুই তেমন দেখা যাচ্ছেনা। পাশ ফিরে কিছু বলতে যাবে দেখে ইভান নেই। একটু ঘাবড়ে গেলো সে। চার পাশে ইভান কে খুজতে লাগলো। এক কোনায় হালকা নীল আলো জলে উঠলো। সেদিকে ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো। সেদিকে মনোযোগ দিতেই পুরো ঘরে আলো জলে উঠলো। ইভান ঈশার সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। হাতে ফুলের তোড়া। ঈশা একটু ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভান হেসে বলল
–হ্যাপি এনিভারসারি জান।
ঈশার মুখ হা হয়ে গেলো। আজ থেকে ঠিক ৬ বছর আগে এই দিনে ইভানের সাথে তার বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু এতো বছর ধরে ঈশা কখনও এই দিনটা ছেলিব্রেট করেনি। এমন কি মনেও রাখেনি। কিন্তু ইভানের ঠিকই মনে আছে। ঈশা খুব অবাক হয়। ইভানের হাত থেকে ফুলটা নেয়। কিন্তু তার চোখে পানি চলে আসে। ইভান উঠে ঈশাকে জড়িয়ে ধরে। ঈশা কেঁদে ফেলে। ইভান ইশাকে শক্ত করে ধরে কোমল কণ্ঠে বলে
–প্লিজ জান। এভাবে কেঁদে আমার দিনটা নষ্ট করিস না।
ঈশা চোখের পানি মুছে ফেললো। সামনে তাকাতেই দেখল তাদের এনিভারসারির কেক। ঈশা নিস্পলক সেটার দিকে তাকিয়ে আছে।ইভান ঈশার মুখটা তুলে বলল
–আরও অনেক সারপ্রাইজ বাকি। এখানেই সব সময় নষ্ট করিস না।
ইভানের কথা শুনে ঈশা তার দিকে তাকাল। ইভান ছুরিটা হাতে নিয়ে ঈশার হাত ধরে দুজন মিলে কেকটা কেটে ফেললো। দুজন দুজন কে খাইয়ে দিলো। ইভান ঈশার গালে হাত দিয়ে বলল
–আমি যদি তোর কাছে আজকের জন্য গিফট চাই দিবি?
ঈশা একটু হেসে বলল
–কি চাও বল?
–তোর দুইটা দিন আমি আমার মতো করে চাই। তোর সাথে যে মুহূর্ত গুলো কাটানোর স্বপ্ন দেখেছি সেগুলো সত্যি করতে চাই। এই দুইটা দিন শুধুই আমার হবে। এর মাঝে আর কিছুই থাকবে না।
ঈশা কিছু না ভেবেই বলল
–আমার জীবনের সব দিনগুলোই তো তোমার। তবুও তোমার জন্য দুইটা দিন। শুধুই তোমার জন্য।
ইভান ঈশার চোখে চোখ রেখে বলল
–এই দুইটা দিনেই আমি আমার জীবনের এতো বছরের সব না পাওয়া পেতে চাই। সব অপূর্ণতা পুরন করতে চাই। এতো বছরের জমানো সব স্বপ্ন সত্যি হতে দেখতে চাই।
ঈশা কোন কথা বলতে পারল না। ইভান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ইভানও ঈশাকে শক্ত করে ধরে বলল
–আমি কোন সময় নষ্ট করতে চাইনা। আমার কাছে ৪৮ ঘণ্টা অনেক মুল্যবান। প্রতিটা সেকেন্ড আমি আমার মতো করে অনুভব করতে চাই।
ঈশা মাথা তুলে বলল
–তা বুঝলাম। কিন্তু এখন কি করবে?
ইভান একটু হেসে বলল
–প্রথম সারপ্রাইজ শেষ। এখন দ্বিতীয়টা শুরু।
–মানে?
–একটু পরেই সব বুঝতে পারবি।
ঈশা অসহায়ের মতো মুখ করে বলল
–বলনা!
ইভান একটু হেসে বলল
–আমি যদি এখানেই সব ডিটেইল বলতে শুরু করি তাহলে আমরা ফ্লাইট মিস করে ফেলব। তাই আর কথা না বাড়িয়ে আমাদের এখনি এয়ারপোর্ট যেতে হবে।
ফ্লাইট আর এয়ারপোর্ট এর কথা শুনে ঈশার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বেশ অবাক হয়ে বলল
–আমরা কোথায় যাচ্ছি?
ইভান একটু বিরক্ত হয়ে বলল
–তোকে বিদেশে বিক্রি করে দিবো।
বলেই উলটা ঘুরে হাটতে লাগলো। ঈশা তার কথায় বিরক্ত হয়ে গেলো। কিন্তু কিছুই করার নেই। তাই ইভানের পিছনে পিছনে চলে আসলো। গাড়িতে বসে পড়লো। কিন্তু কোন কথা বলছে না। ইভান গাড়ি চালাতে চালাতে ঈশাকে একবার দেখে নিয়ে অভিমানের সূরে বলল
–এতো ধৈর্য কম কেন তোর? বললাম তো সব বুঝতে পারবি। আমি এতো বছর অপেক্ষা করলাম আর তুই দুই এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে পারিস না।
ঈশা নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–আচ্ছা বাবা আর জিজ্ঞেস করবো না। ঠিক আছে? যা হবে চুপচাপ পুতুলের মতো দেখবো।
ঈশার কথা শুনে ইভান একটু দুষ্টুমির সূরে বলল
–ইশ!!!! সারা জীবন এমন থাকলে কি যে ভালো হতো।
ঈশা শুনতে পেয়ে বলল
–কি বললে?
ইভান একটু হেসে বলল
–কিছু না।
কিছুক্ষন পরেই গাড়ি এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছে। সব ফর্মালিটি শেষ করে দুজনি প্লেনে উঠে যায়। প্লেনে বসেই কিছুক্ষন পর ঈশা বলে
–আমরা কোথায় যাচ্ছি? আর ইরার বিয়ে? বাসায়ও তো বলা হয়নি।
ঈশার কথা শুনে ইভান চোখ বন্ধ করে ফেলে। তারপর রাগ করে বলে
–তোকে প্লেন থামিয়ে নামিয়ে দেই। তুই ইরার বিয়েতে যা। আমি একাই যাবো।
বলেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। ঈশা অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে।
চলবে……।