তোর ছায়ার সঙ্গী হব পর্ব-১৮

0
1534

#তোর_ছায়ার_সঙ্গী_হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৮

৪১
বারান্দায় সামনে তাকিয়ে ভাবছে ইভান। এই কয়দিনে ঈশার সাথে ভালো করে কথাই হয়নি তার। এমন কি ঈশা যে একবারেই তার কাছে চলে এসেছে সেটাও তাকে জানায়নি। আজ সকালে হসপিটাল থেকে বাসায় এসে জানতে পেরেছে। সে এখন পুরপুরি সুস্থ। তবে রিহাব বলে দিয়েছে কয়দিন বাসায় রেস্ট নিতে। এখনি যাতে অফিসে না যায়। তাই কয়দিন বাসাতেই থাকবে। ভাবতেই তার মুখে এক প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো। এই কয়দিন ঈশার সাথেই কাটাবে।
ঈশা মাত্র ওয়াশ রুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বের হয়েছে। চুল গুলো ভালো করে মুছে ভেজা টাওয়ালটা বারান্দায় মেলে দিতে গিয়ে দেখে ইভান বারান্দায় হাত গুঁজে দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা শান্ত ভাবে বলল
–কিছু বলবে?
ইভান গম্ভীর কণ্ঠে বলল
–তুই উপর থেকে একবারেই চলে এসেছিস আমাকে বলিস নি কেন?
ঈশা টাওয়ালটা মেলে দিতে দিতে বলল
–বাসায় এসে তো দেখতেই। তাই বলিনি।
ইভান কঠিন গলায় বলল
–আর যদি মরে যেতাম তাহলে তো জানতেই পারতাম না।
ঈশা কঠিন দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–জীবনের হিসাব না মিটিয়েই মরে যাবে? হার মেনে গেলে?
ঈশার কথা শুনে ইভান তার কাছে এসে তাকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে বলে
–তোর সাহস খুব বেশি হয়ে গেছে। আমার কথার জালে আমাকে ফাসাতে চাস?
–এমন কথা বল কেন যেটাতে নিজেই ফেসে যাও।
ইভান ঈশার হাতের বাধন আলগা করে দিয়ে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ঘাড়ে নাক ঘোষতে ঘোষতে বলে
–তুই আমাকে তোর জালে অনেক আগে ফাসিয়েছিস। এখন আমি চাইলেও সেখান থেকে বের হতে পারবোনা। আর আমি চাইওনা।
ঈশা ইভানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। ইভান ঈশাকে ছেড়ে দিলো। ঈশা একটু দূরে গিয়ে বলল
–আমি তোমাকে ফাসাইনি। তুমি নিজেই ফেসেছ।
ইভান ঈশাকে আবার ধরে উলটা ঘুরিয়ে নিজের বুকের সাথে তার পিঠ লেপটে নিয়ে বলল
–তোর মাঝে এক অদ্ভুত মায়া আছে। যেখান থেকে বের হওয়া আমার সাধ্যের বাইরে। কি করেছিস আমাকে বল তো! কেন এমন হয়? কেন তোকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারিনা।
এমন সময় ইভানের মা ঈশাকে ডাকে। ইভান আলতো করে ঈশার গালে একটা চুমু দিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। ঈশা ছাড়া পেয়ে তার কাছ থেকে একটু দূরে গিয়ে উলটা ঘুরে বলল
–জাদু করেছি। যাতে সারা জীবন এভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে পারি। আমার এই মায়ার জাল কেটে বের হওয়া এতো সহজ না মিস্টার ইভান মাহমুদ।
ঈশার কথা শুনে ইভান ভ্রু কুচকে একটু চিল্লিয়ে বলল
–কি বললি তুই?
ঈশা তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে একটু হেসে চলে গেলো। তার হাসি দেখে ইভান হেসে ফেললো। দেয়ালের সাথে হেলানি দিয়ে বলল
–তোর মায়ার জাল থেকে আমি কখনই বের হতে চাইনি। আর তোকেও আমার মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছি। তাই তো আজ তুই আমার কাছে। তোকে আমি অনেক সুখে রাখব জান। তোর জীবনে কষ্ট বলে কিছুই থাকবে না।

৪২
বারান্দায় দাড়িয়ে আকাশের বিশাল চাঁদটার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছে ইভান। গভীর ভাবনায় ডুবে আছে। ঈশা পিছনে দাড়িয়ে বেশ বুঝতে পারছে ইভান কোন বিষয় নিয়ে ভাবছে। ঈশা ধির পায়ে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। সামনে তাকিয়েই বলল
–কি ভাবছ?
ইভান ঈশার কথা শুনে চমকে উঠলো। পাশে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–আর তো ভাবার কিছু নেই। সব ভাবনা আজ থেকে শেষ। তুই এখন আমার কাছে।
ঈশা ইভানের কথার গুরুত্ব না দিয়ে একটু হেসে বলল
–কি এমন কথা যা আমাকে বলতে চাইছনা?
ইভান ঈশার কথা শুনে একটু ভাবল। সত্যিই এমন কিছু কথা আছে যা সে ঈশাকে বলতে চায়না। হয়ত এটা ঈশার সাথে অন্যায়। কিন্তু তারই বা কি করার আছে। ঈশা যে তার অনেক সাধনার প্রাপ্তি। তাকে সে যে কোন উপায়েই ভালো রাখতে চায়। আর সবটা দিয়েই ভালো রাখবে। তাই তো এতো লুকচুরি। ঈশার দিকে ঘুরে একটু হেসে বলল
–তুই জানিস আমি কোন কারন ছাড়া কিছুই করিনা। কখনও যদি জানতে পারিস কিছু লুকিয়েছি তাহলে সেটারও কারন আছে। বিশ্বাস করিস তো আমাকে?
ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
–তোমাকে আমি কতটা বিশ্বাস করি সেটা বোধ হয় এখনো বলার প্রয়োজন নাই। বিশ্বাস করেই এতো বছর ছেড়ে দিয়েছিলাম।
ইভান ভ্রু কুচকে বলল
–বিশ্বাসের কত টুকু মর্যাদা রাখতে পেরেছি সেটা তুই কিভাবে সিউর হচ্ছিস?
ঈশা একটু হেসে বলল
–তোমার একটা বান্ধবি ছিল তন্নি। মনে আছে?
ইভান মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। একটু ভেবে বলল
–কিন্তু তার সাথে অনেক দিন কোন যোগাযোগ নেই।
–কত বছর হল বলতে পারবে?
–প্রায় ৪ ব……।
কথাটা শেষ না করেই ঈশার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশা সামনে তাকিয়ে আছে। ইভান গম্ভীর গলায় বলল
–এই তন্নির সাথে যখন আমার বন্ধুত্ব হয়েছিলো তার কিছুদিন পরেই তোর সাথে আমার বিয়ে হয়। আর তারপর পরিস্থিতির স্বীকারে আমি তোকে ওর কথা বলতে পারিনি। কিন্তু হঠাৎই ও আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এমন কি আমি করার চেষ্টা করলেও ও কোন রকম রেসপন্স করেনা। কিন্তু তুই জানলি কিভাবে?
ঈশা একটু হেসে ইভানের কাছে আসে। তার কপালে ছোট ছোট চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। সেগুলো আলতো করে সরিয়ে দেয়। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে
–আমার বর কোথায় কি করছে সেটা আমাকে জানতে হবেনা? নাহলে বউ হলাম কিভাবে?
ইভান ঈশার কথা শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। একটু ভেবে বলে
–এই তোর বিশ্বাসের নমুনা! বড় বড় লেকচার দিলি তো ঠিকই কিন্তু পরক্ষনেই আবার সন্দেহও করলি।
ঈশার মুখের হাসি বন্ধ হয়ে চোখ মুখ কুচকে গেলো। রাগ নিয়ে বলল
–বিশ্বাস করেছি বলে কি মেয়েদের মাঝে তোমাকে ছেড়ে দিয়ে আসবো? এটাই কি আশা করছ? মোটেই না।
ইভান মুখ টিপে হাসল। ঈশার কোমর আঁকড়ে ধরে বলল
–কি করেছিস মেয়েটার সাথে?
ঈশা নরম গলায় বলল
–নাম্বার খুঁজে বের করে ফোন করে হুমকি দিয়েছি। আমার বরের কাছে আমি কোন মেয়েকে এলাউ করিনা। তোমার থেকে যেন দূরে থাকে।
ইভান অবাকের সূরে বলল
–কি মেয়ে রে বাবা! তোকে বিয়ে করে কি জীবনের সব সখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছি? কি যে ভুল করলাম এখন বুঝতে পারছি।

ঈশা রেগে ইভানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো। ইভান মুচকি হেসে ভিতরে এসে দরজাটা লক করে দিলো। পিছন থেকে ঈশাকে জড়িয়ে ধরে। পকেট থেকে চেনটা বের করে ঈশার গলায় পরিয়ে দেয়। তারপর সামনে ঘুরিয়ে লকেট টাতে একটা চুমু দেয়। লকেটে আই লেখা আছে। ঈশা নিজের ওড়নার মাথা মুঠ করে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইভান ঈশাকে কোলে তুলে নিলো। বিছানায় শুয়ে দিলো। ঈশা উঠে বসতে চেষ্টা করতেই ইভান তাকে চেপে ধরল বিছানার সাথে। ঈশার মুখে ফু দিয়ে সামনের চুল গুলা সরিয়ে দিলো। ঈশার গলা শুকিয়ে আসছে। সে চোখ বন্ধ করে শুকনো ঢোক গিলে ফেললো। ইভান ঈশার গলায় কিস করতে লাগলো। ঈশা আর সহ্য করতে না পেরে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো। ইভান তাকে আরও জোরে চেপে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল
— পৃথিবীর সব সুখ তখনি নিজের মনে হয়, যখন ভালোবাসার মানুষটি ভালোবেসে পাশে থাকে। আর তখনি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হয় যখন ভালোবাসার মানুষটি বিশ্বাস দিয়ে বিশ্বাস রাখে। আজ আমার সুখের শেষ নেই। কিন্তু এই মুহূর্তটা আরও সুখের করতে চাই। আমাকে একটু ভালোবাসা দিবি? যে ভালোবাসায় থাকবে না কোন দুঃখ । থাকবে না কোন,না পাওয়ার যন্ত্রনা। থাকবে না মায়া কাঁন্না। থাকবে শুধু সীমাহীন অনুভূতি । যেই অনুভূতি কে সাথি করে কাটিয়ে দিবো সারাটা জীবন।

ইভানের কথা শুনে ঈশা লজ্জায় মিইয়ে গেলো। ইভান ঈশার সম্মতি বুঝতে পেরে তাকে ভালোবাসার স্পর্শে ভরিয়ে দিতে লাগলো। আজ দুজন দুজনকে ভালোবাসার পরম স্পর্শে ভরিয়ে তুলছে। দুজনের ভালোবাসার মাঝে তারা একে অপরকে বিলিন করিয়ে দিচ্ছে। সারা ঘরময় ছড়িয়ে পড়া তাদের ভারি নিশ্বাস অফুরন্ত ভালোবাসার সিমাহিন অনুভূতির সাক্ষ্য দিচ্ছে আজ।

৪৩
ইভান ঘুম থেকে উঠে দেখে ঈশা নেই। পাশে পড়ে থাকা টি শার্টটা পরে নিয়ে বাইরে গেলো। পুরো বাড়ি কেমন নিস্তব্ধ। কেউ নেই। রান্না ঘরে চোখ পড়তেই দেখল ঈশা কিছু একটা করছে খুব মনোযোগ দিয়ে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষন আগেই গোসল করেছে। চুলের পানিতে কোমরের নিচে ভিজে গেছে। ইভান ধির পায়ে তার কাছে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। ঈশা চমকে উঠতেই বলল
–রিলাক্স জান। আমি।
ঈশা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল
–এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে। আমি ভয় পেয়েছিলাম কত।
–আমি ছাড়া তোকে এভাবে কেউ ধরবে সেই সাহস কারও নেই। সেটা মাথায় রাখলেই এতো ভয় পেতিনা।
ঈশা ইভান কে একটু ধাক্কা দিয়ে তার দিকে ঘুরে বলল
–ফ্রেশ হয়ে এসো চা খাবো।
ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে হাসল। এক আঙ্গুল দিয়ে ঘামে লেপটে থাকা কপালের ছোট ছোট চুল গুলো সরিয়ে দিলো। ঈশা ইভানের চোখের দিকে তাকাল। কিন্তু তার চোখে আজ পূর্ণতা। ঈশাকে পুরপুরি ভাবে পাওয়ার প্রশান্তি। সেই শান্তির দৃষ্টি ঈশাকে অস্থির করে দিচ্ছে। বেশিক্ষন তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান বুঝতে পেরে নিশব্দে হাসল। তারপর হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে দিয়ে বলল
–আমি তোর এই ভালবাসাটাই সব সময় দেখতে চেয়েছিলাম। জোর করে নিতে চাইনি। চাইলে অনেক আগেই অধিকার ফলাতে পারতাম। তুই আটকাতেও পারতিস না।
তার কথায় ঈশার রাগ করার কথা থাকলেও আশ্চর্য জনক ভাবে সে ইভানের কাছে এসে বলল
–আমি আটকাতাম না। তোমার ভুল ধারণা।
ইভান একটু হেসে ঠোঁটে কিস করার জন্য তার মুখ ঈশার মুখের কাছে নিয়ে যেতেই পিছন থেকে ইরা বলল
–ভাইয়া তুমি কি করছ?
ইভান তার গলার আওয়াজ পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে পিছনে ঘুরে বলল
–কিছুনা। চা খেতে এসেছিলাম।
ইরা ভ্রু কুচকে বলল
–ওঃও চা খাবে তো কাপে নিয়ে বাইরে যাও। এখানে তো অনেক গরম। আর তুমি আপিকে ওভাবে কেন ধরে রেখেছিলে। এমনিতেই অনেক গরম ওভাবে ধরে রাখলে আরও গরম লাগবে। তুমি বের হয়ে যাও তো এখান থেকে।
বলেই ইরা চলে গেলো। ইভান তার দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। তারপর ভ্রু কুচকে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–সিরিয়াসলি! ইরা এতো বোকা না অভিনয় করে। আমি তোকে জড়িয়ে ধরে কি করছিলাম সেটা একটা ছোট বাচ্চাও বুঝতে পারে। আর ও বুঝতে পারল না নাকি বুঝতে চাইলো না। অবশ্য তোর বোন। একটু হলেও জিন গত ব্যাপার তো থাকেই। বুঝেও অভিনয় করে।
ঈশা এবার রেগে গেলো।
–কি বলতে চাচ্ছ?
ইভান একটু হেসে বলল
–এই যে এই দিনটার জন্য আমি সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছি। আর এতো বছর পর এসে তুই বুঝলি। তাও আমার কাছে আসলে লজ্জা পাস। আল্লাহ জানে এতো লজ্জা কোথায় থেকে আসে।
ঈশা কিছু না বলে ঘুরে যায়। ইভানও বের হতে যায় রান্না ঘর থেকে তখনি ঈশা বলে
–এতদিন তো আমি অপেক্ষা করতে বলিনি। অনেক আগেই চান্স দিয়েছিলাম। তুমিও যদি এখন ইরার মত অবুঝ হও তাহলে তো আমার কিছুই করার নেই।
ঈশার কথা শুনে ইভান থেমে ঘুরে অবাক হয়ে তাকায়।

চলবে………।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে