তোর ছায়ার সঙ্গী হব পর্ব-১০

0
1689

#তোর_ছায়ার_সঙ্গী_হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১০

২২
ইভান দরজা খুলে ঢুকতেই তাকে দেখে সামনের মানুষটা চমকে গেলো। ইভান খুব শান্ত সরে বলল
–রিলাক্স! আপনার জন্য এতো উত্তেজনা ভালো না। এমনিতেই অনেক কষ্ট করে আপনার জ্ঞান ফেরান হয়েছে।
ইভানের কথা গুলো শুনে আরমান জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। ইভান সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে বলল
–সো স্যাড! এভাবে দেখতে সত্যিই আমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কি করবো তুই যে আমার কোন উপায় রাখলিনা।
আরমান নিস্তব্ধ হয়ে ইভানের কথা গুলো শুনছিল। কারন আরমানের এই এক্সিডেন্টের পিছনে যে ইভানের হাত আছে তা বুঝতে আর তার বাকি থাকলো না। সে ভয়ে চুপসে গেলো। ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–আগেও তোকে ওয়ার্নিং দিয়েছি। তুই শুনিস নি। আমি বলেছিলাম এর পর খারাপ কিছু হলে সেটার জন্য আমি দায়ী থাকব না। দেখ তুই নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনলি।
আরমান এবার ভিত কণ্ঠে বলল
–তোর এই রুপ ঈশা জানতে পারলে তোকে ঘৃণা করবে।
আরমানের কথা শুনে ইভান তার মুখ চেপে ধরল। তারপর দাতে দাঁত চেপে বলল
–ঘৃণা করুক আর ভালবাসুক ওকে আমার সাথেই থাকতে হবে। আমি ওকে কখনও নিজের থেকে আলাদা হতে দিবনা।
আরমান কে ছেড়ে দিয়ে ইভান উঠে দাঁড়ালো। তারপর আবার ঘুরে বলল
–শেষ বারের মতো তোকে বেঁচে রাখলাম। একি ভুল আবার করলে আর বাঁচার সুযোগ পাবিনা। ঈশা আমার জান। ওর দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালে আমি তাকে কখনও ছেড়ে দিবনা। তুই ঈশাকে নিয়ে যে নোংরা খেলায় মেতেছিস সেটা আমি হতে দিবনা। বলে দিস তোর গড ফাদারকে। আমার ঈশার থেকে দূরে থাকতে। নাহলে ওর অবস্থাও তোর মতই হবে।
বলেই সেখান থেকে বের হয়ে গেলো ইভান। বাইরে এসে সাহিল কে বলল
–ওর ট্রিটমেন্ট ঠিক মতো যেন হয়। খেয়াল রাখিস। আর ওর সাথে কেউ যেন দেখা করতে না পারে।
সাহিল কে সব বুঝিয়ে দিয়ে ইভান সেখান থেকে বাড়ির দিকে চলে গেলো।

২৩
কয়দিন ধরেই মাইগ্রেনের ব্যথাটা বেড়েছে ঈশার। আগে মাঝে মাঝে হতো। কিন্তু এখন প্রায় সময়ই হচ্ছে। তীব্র ব্যাথায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। উঠে বসে পাশের টেবিলে রাখা বোতল টা হাতে নিয়ে দেখল পানি নেই। দরজা খুলে বাইরে ডাইনিং টেবিলে জগ থেকে পানি ঢেলে খেয়ে নিলো। গ্লাস টা রেখে পাশে ঘুরতেই চোখে পড়লো সোফায় শুয়ে ইভান ফোনে গেম খেলছে। ঈশা ধির পায়ে গিয়ে পাশে দাড়াতেই ইভান তাকে দেখে উঠে বসে পড়লো।
–তুই এখানে?
ঈশা শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো
–তুমি কি করছ?
ইভান রেগে বলল
–তুই উঠেছিস কেন?
–ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাই পানি খেতে এসেছিলাম। তোমাকে দেখে এদিকে আসলাম। তুমি ঘুমাওনি।
ইভান উঠে ঈশার হাত ধরে টানতে টানতে তার ঘরে নিয়ে গেলো। ঘরের দরজা টা বন্ধ করে দিল। ঈশাকে ছেড়ে দিয়ে বলল
–ঘরের চারিদিকে একটু চোখ বুলিয়ে দেখে নিলেই আর বাইরে যেতে হতনা।
ইভানের কথা শুনে ঈশা চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। টেবিলের এক পাশে পানি ভর্তি একটা বোতল রাখা আছে। সচরাচর যে পাশে থাকে তার বিপরিত পাশে আছে। তাই খুঁজে পায়নি। বোতলটার দিকে তাকিয়ে বলল
–এটা তুমি রেখেছ?
ইভান মাথা নেড়ে হ্যা বলল। তারপর ঈশাকে বিছানায় বসিয়ে দিলো। টেবিলে থাকা ঈশার ঔষধের বক্স টা হাতে নিয়ে খুলে ফেললো। সব ঔষধ একবার করে দেখে নিলো। একটা ঔষধের স্ট্রিপ হাতে নিয়ে বলল
–ঔষধটা খেলেই শান্তি মতো ঘু্মাতে পারতিস। খাস নি কেন?
ঈশা অসহায়ের মতো বলল
–তুমি জানো আমি ঔষধ খেতে পারিনা।
ইভান ঔষধের স্ট্রিপ টা হাতে নিয়ে ঈশার সামনে বসে বলল
–খেতে না পারলেও খেতে তো হবেই। নাহলে মাথা ব্যাথা কমবে কিভাবে?
এবার ঈশা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল
–তুমি কিভাবে বুঝলে আমার মাথা ব্যথা।
ইভান একটু হেসে ঈশার অনেকটা কাছে এসে চোখে চোখ রেখে বলল
–তোর চোখ দেখে।
ঈশা অবাক দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। এই ছেলেটা তাকে এতোটা কিভাবে বোঝে। ঈশা নিজেকে যতটা বুঝেনা তার থেকে বেশি ইভান তাকে বুঝে। একটা মানুষকে ঠিক কতটা ভালবাসলে তাকে এভাবে বোঝা যায় তা ঈশার জানা নেই। এই মুহূর্তে সে আন্দাজও করতে পারছেনা। হয়ত ইভানের ভালোবাসার গভীরতা বোঝার ক্ষমতা তার নেই। ঈশাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভান বলল
–কেন শুধু শুধু মাঝরাতে আমাকে এভাবে পাগল বানাচ্ছিস? এভাবে নেশা ভরা চোখে তুই তাকিয়ে থাকলে আমি কতক্ষণ আর নিজেকে সামলে রাখতে পারব জান? তুই কি বুঝিস না আমি তোর প্রতি কতটা দুর্বল।
আর একটু কাছে এসে নেশা ভরা কণ্ঠে বলল
–এবার যদি আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে কিছু করে বসি তাহলে তার জন্য কিন্তু আমি দায়ী থাকবনা।
ইভানের কথা শুনে ঈশা একটু সরে গেলো। মাথা নিচু করে ইভানের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইভান স্ট্রিপ থেকে ঔষধ খুলে ঈশার মুখের সামনে ধরল। ঈশা মুখ সরিয়ে নিলো। ইভান ঈশার কাছে এসে বলল
–ঔষধ তোকে খেতেই হবে। কিভাবে খাবি সেটা তোর ডিসিশন!
ইভানের কথা বুঝতে পেরে ঈশা মুখটা কাছে এনে ঔষধ টা মুখে নিয়ে নিলো। ইভান পানি খাইয়ে দিলো ঈশাকে। ঈশার ঔষধ খেতে খুব কষ্ট হয়। তাই ইভান অনেক গুলা চকলেট ঈশাকে দিয়েছে। যাতে সে ঔষধ খাওয়ার পর সেগুলা খেতে পারে। ঈশা তার বালিশের নিচে থেকে চকলেট বের করে মুখে পুরে দিলো। ইভান ঈশাকে দেখছিল। ঈশা চকলেট শেষ করে ইভানের দিকে তাকাল। ইভানের তাকানো দেখে ভ্রু কুচকে বলল
–কি দেখছ?
ইভান কোন কথা না বলে মুচকি হেসে ঈশাকে বিছানায় শুয়ে দিলো। ঈশা ভালো করে শুয়ে নিয়ে বলল
–তুমিও এখন ঘুমাও। অনেক রাত হয়ে গেছে।
ইভান কিছু বলল না। ঈশা আবার জিজ্ঞেস করলো
–না ঘুমিয়ে কি করছিলে এতো রাতে?
–ঘুম আসছিলনা। তাই গেম খেলছিলাম।
পাশে খোলা জানালাটা লাগিয়ে দিতে দিতে বলল। ঈশা ইভানের কথা শুনে আবেগি কণ্ঠে বলল
–মন খারাপ?
ইভান তার দিকে তাকাল। তারপর জানালার পর্দাটা সরিয়ে থাইয়ের বাইরের দিকে তাকিয়ে ছোট একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–সব দোষ তো এই মনটারই। এটাকে যদি নিজের আয়ত্তে আনতে পারতাম তাহলে কিছুই হতনা।
ঈশা এবার বিছানা থেকে উঠে বারান্দার দরজাটা খুলে বাইরে গিয়ে বসলো। ইভানও তার সাথে বারান্দায় বসে পড়লো। সামনে তাকিয়ে বলল
–ঘুমাবিনা?
ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। সে সামনে তাকিয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়েই বলল
–এখানে একটু বস মন ভালো হয়ে যাবে।
ইভান সামনে তাকিয়েই হাসল। তারপর ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–তুই কি জানিস তুই আমার আশে পাশে থাকলেই মন ভালো হয়ে যায়।
–কই দেখতে পাচ্ছিনা তো?
ঈশার কথা শুনে ইভান তাকে এক টানে কাছে আনল। গালে নাক ঘোষতে ঘোষতে বলল
–এটা এমন একটা অনুভুতি যা দেখা যায়না। অনুভব করতে হয়। বুঝে নিতে হয়। কবে বুঝবি তুই?
ঈশা এতক্ষন চোখ বন্ধ করে ইভানের কথা শুনছিল। ইভান তাকে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশা ইভানের অনুভুতি বুঝতে না পেরে চোখ খুলে ফেললো। ইভানের দিকে তাকাতেই এক অদ্ভুত অনুভুতি হল। ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–মন ভালো হয়েছে?
ইভান একটু হেসে ঈশার গালে একটা চুমু দিয়ে বলল
–শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে। আমি তোকে সুস্থ দেখতে চাই। তুই ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকব।
বলেই ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেলো। ইভান চলে গেছে কিন্তু ঈশা বারান্দায় বসেই তার দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবছে। আজ ইভানের কষ্টটা সে উপলব্ধি করতে পেরেছে। তার মনে যে ঈশাকে না পাওয়ার কষ্ট ক্ষত তৈরি করেছে সেটা ঈশার বুঝতে বাকি থাকলো না।

২৪
চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে ঈশা। দরজায় দাড়িয়ে তাকে দেখছে ইভান। ঈশা এখনো পুরপুরি সুস্থ না। একটানা ব্যথায় দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। কোন একটা বিষয় নিয়ে সে টেনশন করছে। যার কারনে মাইগ্রেনের ব্যথাটা কমছেনা। ঈশার রিলাক্সেশন দরকার। ইভান ঘরে ঢুকল। পাশে বসতেই ঈশা চোখ খুলে ফেললো। ইভান কে দেখে উঠে বসলো। ঈশা জন্ত্রনায় চোখ খুলে ঠিক মতো তাকাতে পারছেনা। ইভান তার দিকে তাকিয়ে বলল
–খুব কষ্ট হচ্ছে?
ঈশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। ইভান তার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–বাইরে যাবি?
ঈশা খুব কষ্ট করে চোখ খুলে তাকাল তার দিকে। মিন মিনে কণ্ঠে বলল
–কোথাও যাবনা। ভালো লাগছেনা।
ঈশাকে এই অবস্থায় দেখে ইভানের খুব কষ্ট হচ্ছে। ঈশার গালে হাত দিয়ে বলল
–সবাই মিলে বাইরে থেকে ঘুরে আসি দেখবি ভালো লাগবে।
ঈশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইভান আবার বলল
–বাইরে যেতে না চাইলে জোর করবোনা। ছাদে তো যেতেই পারিস।
ঈশা আর কিছু বলতে পারল না। হেসে মাথা নাড়ল। ইভান ঈশাকে নিয়ে ছাদের দিকে গেলো। সিঁড়ি বেয়ে উঠছে দুজন। উপর থেকে গীটারের আওয়াজ কানে আসতেই ঈশা বলল
–উপরে কে?
–ইলহাম আর ইরা গীটার বাজিয়ে গান গাওয়ার চেষ্টা করছে।
ছাদে উঠে ঈশা দেখে ইরা বিরক্তি নিয়ে ইলহামের দিকে তাকিয়ে আছে আর ইলহাম এলোমেলো ভাবে গীটার বাজিয়েই যাচ্ছে। ইরা খুব বিরক্ত হয়ে কানে হাত দিয়ে বললো
–বন্ধ কর ভাইয়া। খুব বিরক্ত লাগছে। তুমি তো বাজাতেই পারনা।
ইরার কথা শুনে ঈশা শব্দ করে হেসে ফেললো। ইভান পাশে তাকিয়ে ঈশাকে দেখছে। অদ্ভুত সুন্দর হাসি। ঈশা হেসেই যাচ্ছে। ঈশার হাসি শুনে ইরা দৌড়ে ইভানের কাছে এসে বলে
–ভাইয়া দেখ না ইলহাম ভাইয়া কখন থেকে শুধু শব্দ দূষণ করেই যাচ্ছে। কিছুই পারছেনা। গান শুনতে আমাকে ডেকে নিয়ে আসলো। এখন তো আমার মনে হচ্ছে এখান থেকে পালাতে পারলেই বাঁচি।
ইরার কথা শুনে এবার ঈশা আর ইভান দুজনেই হেসে দিলো। ইলহাম খুব অপমান বোধ করলো। ইরা ইভানের দিকে তাকিয়ে করুন সূরে বলল
–ভাইয়া তুমি আর আপু আগে কত সুন্দর গান গাইতে। আজকে একটা গান গাও না।
ইরার কথা শুনে ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–অনেক বছর গান গাইনা। এখন আর ইচ্ছাও নেই। তোরা তোদের মতো কনটিনিউ কর।
বলেই সামনে এগিয়ে গেলো। পিছন থেকে ঈশা বলল
–আমি বললেও না বলবে?
ইভান তার কথা শুনে একটু চোখ বন্ধ করে ফেললো। পিছনে ঘুরে ঈশার কাছে এসে বলল
–তুই কিছু চাইলে আমি সেটা কখনও না বলব সেই ক্ষমতা কি আমার আছে? তবে আজ ইচ্ছা নেই। তোকে না বলতেও পারবোনা। এক কঠিন পরিস্থিতিতে ফেললি আমাকে।
বলেই ইলহামের কাছে গিয়ে বসে পড়লো। ঈশা ইভানের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল তার মন কোন কারনে খুব খারাপ। কিন্তু সে নিজের কষ্ট গুলো কখনও কারও সাথে শেয়ার করেনা। এমন কি ইশাকেও বুঝতে দেয়না। ছোট বেলা থেকেই শুধু সুখটা সব সময় ঈশার সাথে ভাগ করে নিয়েছে। আজ এতো মন খারাপের মাঝেও সে ঈশার কথাই ভাবছে। তার মন ভালো করতে চেষ্টা করছে। ঈশাও ইভানের মন ভালো করতে চায় আজ। তাই একটু হেসে তার পাশে গিয়ে বসল। ইভান ইলহামের হাত থেকে গীটারটা নিয়ে বাজাতে শুরু করলো।

Duniya yeh jeet gayi dil haar gaya..
Nahi socha tha mil kar kabhi honge judaa..

ঈশাও তার সাথে গলা মিলিয়ে গাইতে শুরু করলো।

O Khuda
Bata de kya lakeeron mein likha
Humne toh
Humne toh bas ishq hai kiya
গান শেষ করে ইভান ঈশার দিকে তাকিয়ে একবার দেখল। ঈশা হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ধির কণ্ঠে ইভান জিজ্ঞেস করলো
–এখন ভালো লাগছে?
ঈশা তার হাসি প্রশস্ত করে সামনে তাকিয়ে বলল
–তুমি জানো আমার কখন কি প্রয়োজন!!

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে