#তোর_ছায়ার_সঙ্গী_হব
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৫
১০
ঈশাকে আজ হসপিটাল থেকে বাসায় আনা হয়েছে। ঈশা এখন বেশ সুস্থ। কিন্তু তার বিয়ে নিয়ে কোন কথা বলছেনা কেউ। আরাফের বাবার সাথে কথা বলতে চাইলে তারা সময় নিয়েছেন। তাই সবাই চুপচাপ আছে। কিন্তু ইভানের প্ল্যান অন্য রকম ছিল। একদিন সকালে প্রতিবেশীরা আসে ইশাদের বাড়িতে। তখন ঈশা সকালের খাবার খাচ্ছিল। তারা বিভিন্ন রকম কথা বলছিল ঈশাকে নিয়ে। ঈশার বাবা মা দুজনে চুপ করে শুনছিল। আসলে তাদেরও কিছু বলার নাই। কারন তারাও জানেনা কে ঈশাকে তুলে নিয়ে গেছিলো আর কি হয়েছে ঠিক তার সাথে। ঈশার ভবিষ্যৎ নিয়ে তারাও শঙ্কিত। সবার কথার তীক্ষ্ণ তির ঈশার চরিত্রের দিকে আঘাত করছে। সতীত্ব নিয়ে কথা হচ্ছিলো। এমন সময় ইভান এসে বলল
–আমি ঈশাকে বিয়ে করবো এই মুহূর্তে।
ইভানের কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেলো। কেউ ভাবেনি যে ইভান এমন কথা বলবে। আর এসব নিয়ে কেউ কখনও ভাবেনি। সবাই কিছুক্ষন চুপ থেকে ভাবল। ঈশার বাবা নিরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলো
–ইভানের হাতে আমার মেয়েকে তুলে দিতে পারলে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারব।
তার কথা শুনে সবাই তার দিকে তাকাল। ঈশার বাবা ইভানের কাছে গিয়ে দু ফোটা চোখের জল ফেলে বলল
–আগেই বলতি কথাটা। তাহলে আজ এই পরিস্থিতির স্বীকার হতে হতনা। আর তোর কাছে মেয়েকে দিতে পারলে আমার যে আর কোন চিন্তা থাকতো না। তোর থেকে ভালো আমার মেয়েকে কেউ রাখতে পারবে না। সেই ছোট বেলা থেকে তুই ওকে আগলে রেখেছিস।
ঈশার বাবার কথা শুনে তার মাও এগিয়ে এলেন। ঈশার দিকে তাকিয়ে বললেন
–আমার মনের ইচ্ছা ছিল কিন্তু তুই কি ভাববি তা ভেবেই বলা হয়ে উঠেনি। আজ দেখ তোর ভাগ্যে ঈশা লেখা আছে।
কথাটা শুনে ইভানের মনে অপরাধ বোধ জেগে উঠলো। তার মানে সবার মনে একি কথা ছিল। আর ঈশার চোখেও তার জন্য একি অনুভুতি সে দেখেছে। তাহলে সে এতদিন না বলে ভুল করে ফেলেছে। সহজে যে বিষয়টা হয়ে যেত তার ভুলের কারনে আজ এতো কিছু করতে হল।
অবশেষে তাদের বিয়ে হয়ে গেলো। সবাই খুব খুশি। কিন্তু এই খুশি বেশিক্ষন স্থায়ী হলনা তাদের জীবনে। সেই মুহূর্তে আরাফ এসে হাজির হল। ঈশার সাথে ইভানের বিয়ের কথা শুনে সে আকাশ থেকে পড়লো। সেই দিন ইভান নিজে ঈশাকে কিডন্যাপ করেছে তার সমস্ত প্রমান সে নিয়ে এসেছে। সব প্রমান সবার সামনে দেখিয়ে বলল
–আপনারা এতো বড় ভুল কিভাবে করলেন? কিভাবে না বুঝে ওই ছেলের সাথেই বিয়ে দিলেন যে আপনাদের মেয়েকে সবার কাছে অসম্মান করেছে।
ইভানের বাবা তার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মারলেন। ইভান মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। সবাই তার দিকে প্রশ্নবিধ্য চোখে তাকিয়ে।সে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল
–আমি ঈশা কে ভালবাসি। আর আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারবোনা। আমি ভেবেছিলাম তোমরা সব কিছু বুঝতে পেরেছ এতদিনে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। তোমরা আমাকে না জিজ্ঞেস করে ওর বিয়ে দিচ্ছিলে। বড় বাবা তুমি তো নিজেই বললে আমার থেকে ভালো কাউকে তোমরা ঈশার জন্য পাবেনা। তাহলে আমাকে জিজ্ঞেস না করে কেন এই আয়োজন? আমি আমার এই অনুভূতির কথা এতদিন বলিনি কারন ভেবেছিলাম নিজের পড়ালেখা শেষ করে তারপর ঈশাকে বিয়ে করে ঘরে তুলব। আর ঈশাও ছোট ছিল। তাই এতদিন সব কিছু ছেড়ে পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু পড়ালেখা শেষ করে এসে দেখি যার জন্য এতো কিছু করলাম তাকেই হারাতে বসেছি। সেটা কিভাবে মেনে নেই বল। ঈশা কে সব কিছু বলেছিলাম। কিন্তু সে সবার কথা ভেবে আমাকে ভুলে যেতে বলে। কিন্তু যার মাঝে আমার অস্তিত্ব আমি তাকে কিভাবে ভুলে যাই বল। আজ তাই তো ঈশাকে নিজের করে পেতে এতো কিছু করতে হয়েছে। আমি তোমাদের সবার অপরাধী। তোমরা আমাকে যা শাস্তি দিবে তা আমি মেনে নিবো।
সব কথা শুনে ঈশার মা বলল
–একবার বলতি আমরা খুশি হয়ে তোর হাতে ঈশাকে তুলে দিতাম। কেন বলিস নি?
ঈশার বাবা এতক্ষণ গম্ভীর ভাবে সব শুনছিল। তিনি ঈশার দিকে একবার তাকালেন। ঈশা ভাবলেশ হিন ভাবে দাড়িয়ে আছে। তার স্থির দৃষ্টি ইভানের উপরে। সে নিস্পলক ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ঈশার বাবা ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–যা হয়েছে এখান থেকেই শেষ। আজকের পর থেকে এসব নিয়ে আর কোন কথা উঠবেনা।
আরাফের দিকে তাকিয়ে বললেন
–বাবা তুমি যা করেছো তা নিসন্দেহে আমাদের জন্য উপকার। কিন্তু এটা আমাদের পরিবারের বিষয়। আমরা বুঝে নিবো।
তার কথা শুনে আরাফ চলে গেলো। সবাই সেদিন ইভানের ভালোবাসাটা বুঝতে পেরে তার অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলো। এসব নিয়ে কেউ আর কোন কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। কিন্তু এতো কিছুর পরেও একজন বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনি। ঈশা ইভান কে মাফ করতে পারেনি। ঈশার বিষয়টাকে মানতে খুব কষ্ট হয়েছিলো। ইভান যে তাকে ভালবাসে সেই কথাটা আগে বললেই এতো কিছু হতনা। আজ ইভানের জেদের কারনে ঈশাকে সমাজের কাছে কথা শুনতে হয়েছে। তার চরিত্র নিয়ে কথা উঠেছে। কিন্তু ইভান এতো কিছু না করে যদি তার পরিবারের কাছে নিজের মনের কথাটা বলত কেউ না করত না। ইভান তার মনের কথা না জানিয়ে যে ভুল করেছে তার মাশুল ঈশাকে দিতে হয়েছে পদে পদে।আজ ইভান নিজের জেদের বসে যে ভুল টা করে বসেছে তার কারনে ঈশার বাবাকে অনেক বড় মাশুল দিতে হবে। ঈশা জানে তিনি মেয়ের সুখের কথা ভেবে কিছুই বলবেন না কিন্তু ইভানের জন্য আজ তাকেও বিপদে পড়তে হল। তাই তো আজ মনের মাঝে ভালোবাসার চেয়ে অভিমানটাই বেশি জমা হয়ে গেছে। না বুঝেই ইভান আজ তাদের অনেক বড় ক্ষতি করলো। এতো কিছুর পর সে আর ইভান কে মাফ করে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারেনি তার সাথে। এইদিকে ইভানও পারেনি ঈশাকে মাফ করতে। কারন ঈশার উপরেও তার অভিমান ছিল। ইভান তার ভালোবাসার কথা ঈশা কে বলেনি ঠিকই কিন্তু ঈশাও যে ইভান কে ভালবাসতো সেটাও সে বলেনি।আর এতো কিছুর পরও ঈশা বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলো। ইভান কে না জানিয়ে বিয়ে করতে যাওয়াটা ঈশার বড় অপরাধ ছিল। কারন ইভান না বললেও তার অনুভুতি গুলো ঈশার সামনে সব সময় প্রকাশ করেছে। আর যেহেতু ঈশাও ইভান কে ভালবাসত তাহলে তার বোঝা উচিৎ ছিল। কয়েক মাস পর ইভানের বাবা ঢাকায় ব্যবসা শিফট করেন। এখানকার সব কিছু তিনি বিক্রি করে চলে জাওয়ার সিদ্ধান্ত নেনে। তাদের পুরো পরিবার সেখানে চলে যায়। ইভান ঈশাকে শুধু একবার বলেছিল তার সাথে যেতে। কিন্তু ঈশা যেতে রাজি না হওয়ায় সে ঈশার উপরে জেদ করে চলে যায়। তখন সে ঈশাকে বুঝতে চায়নি। নিজের জেদ টাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলো আগে। ঈশার খুব অভিমান হয়েছিলো তার উপরে। কিন্তু ঈশাও তখন ইভানের অভিমানটা বুঝতে চায়নি। তাই তো সেদিন ঈশার না বলায় ইভান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সে ঈশার কাছ থেকে দূরে থাকবে। তাই তো নিজের জেদ টাকে প্রাধান্য দিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে দূরে থেকেছে ৫ বছর। এই ৫ বছর সে শুধু ঈশার সামনেই আসেনি। কিন্তু ঈশার সব রকম খোঁজ খবর রেখেছে। সব প্রয়োজন মিটিয়েছে দূর থেকে। কিন্তু আজও ঈশার অভিমানের কাছে তার জেদ টাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে ঈশাকে কখনও বুঝতেও চায়নি। ছোটবেলা থেকে ইভানের কাছে সব কিছুর আগে ঈশার গুরুত্ব ছিল কিন্তু আজ সে নিজের জেদটাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছে। তাই তো সে নিজের ভিতরে কষ্ট পায়। এই কষ্টের কারনে সে ইভানের কাছে যেতে পারেনা। আর ইভানের কাছে না আসার জন্য সে ঈশা কে মাফ করতে পারেনা। তার সকল কষ্টের জন্য সে ঈশা কে দায়ী করে।
১১
দরজা খোলার আওয়াজে ঈশা ভাবনা থেকে বের হয়। রাশিক ঈশা কে দেখে জিজ্ঞেস করে
–কি অবস্থা ঈশা?
ঈশা খুব শান্ত ভাবে উত্তর দেয়
–এখন ঠিক আছে। ঘুমোচ্ছে।
তাদের কথোপকথন শুনে ইভানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে চোখ খুলে সামনে রাশিক কে দেখতে পায়। কার সাথে রাশিক কথা বলছিল তা দেখার জন্য পাশে তাকিয়ে ঈশাকে দেখতে পায়। সোফায় বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক কেঁদেছে। কিন্তু পরক্ষনেই তার আরাফের কথা মনে পড়ে যায়। সে ঈশার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। রাশিক সামনে এগিয়ে এসে বলে
–এখন কেমন আছিস?
–এমন ভাবে জিজ্ঞেস করছিস মনে হয় মরে গেছি। ভাবিস না এতো সহজে মরবনা। জিবনের সাথে অনেক হিসাব বাকি। সেসব না মিটিয়ে শান্তিতে মরতেও পারবোনা।
এসব কথা যে সে ঈশাকে উদ্দেশ্য করে বলছে তা ঈশার বুঝতে বাকি নেই। তাই সে এসব কথা শুনে বাইরে চলে গেলো। তার যাওয়া দেখে রাশিক বলল
–এই মেয়েটা না থাকলে আজ তুই সত্যিই মরে জেতি সেটা কি মানিস!
ইভান একটু হেসে বলল
–কি অদ্ভুৎ! যাকে মুক্তি দিতে আমি মরতে চাই আজ সেই আমাকে বাচিয়ে দিলো।
রাশিক তার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেলো। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–কেন এসব করছিস বল তো? দেখ মেয়েটার কেঁদে কেঁদে কি অবস্থা হয়েছে। অযথা কেন কষ্ট দিচ্ছিস মেয়েটাকে?
–ভালবাসা অদ্ভুত জিনিস। তোকে শান্তি মতো বাচতেও দিবেনা আবার মরতেও দিবেনা। আমি বেঁচে থাকতে ওকে মুক্তি দিতে পারবোনা। তাই মরে জেয়েই মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে নিজেই আমাকে বাচাল। ভুল করলি। মরতে দিলেই তুই বেঁচে জেতি জান।
–ইভান তুই কি এখনও ছোট আছিস? তুই কি বুঝতে পারছিস এসবের জন্য সম্পর্ক টা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তোরা দুজন দুজন কে ছাড়তে পারবিনা আবার কাছেও আসতে পারবিনা। এর শেষ পরিনতি কি হবে?
–এর কোন পরিনতি হবেনা বন্ধু! কারন আমরা বেঁচে থাকলে কখনই একজন আরেকজনকে মাফ করতে পারবোনা। আর যতক্ষণ দুজন বেঁচে থাকব কেউ কাউকে মরতে দিবনা। না কাছে আসতে পারব না মুক্তি দিতে পারব। তাই এই সম্পর্কের কোন শেষ নেই।
একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে কথাটা বলল ইভান। তার কথা শুনে রাশিক তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তাদের কথোপকথনের মধ্যেই ঈশা ভিতরে ঢুকে গেলো। ইভান ঈশা কে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো। ঈশা ঔষধ হাতে নিয়ে ইভানের দিকে একবার তাকিয়ে বলল
–ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
–এতো বছর নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পেরেছি। এখনো পারব। কারও দয়ার প্রয়োজন নেই।
ইভান তার দিকে না তাকিয়েই বলল। ইভানের এরকম ব্যবহার ঈশাকে ভিতর থেকে কষ্ট দিচ্ছে। না চাইতেও চোখ বেয়ে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো ঈশার। সে ঔষধ রেখে বাইরে চলে গেলো। তার যাওয়ার পর ইভান চোখ বন্ধ করে ফেললো। ঈশার কষ্ট সে সহ্য করতে পারেনা। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কাছে আর কোন উপায় ও নাই। কারন ঈশা তাকে কষ্ট দিয়েছে। সে আরাফের সাথে কথা না বলে বাড়িতে চলে আসলেই এতো কিছু হতনা। কিন্তু সে তা করেনি। ইভান কে বুঝতে চায়নি।
চলবে………