#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩২
#নিশাত_জাহান_নিশি
“উপপপস বাবা হতে চলেছেন আপনি! এত ব্যস্ততা দেখালে চলবে?”
টেলিফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি সম্পূর্ণ নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ, নির্বাক! অনুভূতি শূণ্য এক স্তব্ধিত মূর্তিপ্রায়। শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচলের ক্ষুদ্রতম আওয়াজ ও কর্নপাত হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন আমি একাই শূন্যতার সাথে কথা বলছি! মানুষটা কি খুশিতে মরেই গেল? পাল্লা দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হচ্ছে আমার। কিয়ৎক্ষনের মধ্যে ভয়ঙ্কর ভয় চেঁপে বসল বুকে। লোকটা এত নির্বিকার নির্লিপ্ত কেন? হয়েছেটা কি লোকটার? কখনো সখনো তো এমন হয়, অতি খুশিতে মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে যায় নতুবা ছোট খাটো হার্ট এ্যাটাক করে বসে! হায় আল্লাহ্! লোকটার আবার এমন কিছু হয়ে গেল না তো? এসব অবাঞ্ছিত বিষয় জল্পনা কল্পনার মধ্যেই টুং টাং শব্দে কখন যে ফোনটা কেটে গেল ঠিক ঠাওড় করতে পারলাম না আমি। ফোনটা কেটে যাওয়ার প্রায় পঞ্চদশ মুহূর্ত পরে ও সেই একই ভাবে ফোনটা কানে ধরে রেখেছি আমি। লোকটার প্রতিক্রিয়া আদৌ বুঝতে পারছি না আমি। আমার কি উচিত পুনরায় লোকটাকে ফোন করা? হ্যাঁ ফোন করাই উচিত! ফোনটা করেই দেখি না! কি হয়! কান থেকে ফোনটা দৃষ্টির সম্মুখে ধরে আমি পুনরায় লোকটার নাম্বারে ডায়াল করতেই শ্বাশুড়ী মায়ের নাম্বার থেকে পাল্টা কল এলো। ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি ফুটিয়ে আমি কলটা তুলতেই মা ঐ প্রান্ত থেকে আনন্দে আপ্লুত গলায় বললেন,,
“আলহামদুলিল্লাহ্ আলহামদুলিল্লাহ্ আলহামদুলিল্লাহ্। আল্লাহ্ র দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া মা। অবশেষে আমি দাদি হতে চলেছি। তুমি জানো না টয়া, আমি যে কি ভীষন খুশি হয়েছি! মায়ের উপর রাগ করে থেকো না টয়া। সব ভুলে তুমি বাড়ি ফিরে এসো। তোমার বাবাকে বুঝাও। প্রয়োজনে আমি এবং তোমার শ্বশুড় বাবা আসব তোমার বাবাকে বুঝাতে। তোমাকে ফিরিয়ে আনতে।”
“মা আপনি তো জানেন। আপনার ছেলে বাবাকে কিসব চ্যালেন্জ্ঞ ছুড়ে দিয়েছেন। ১ মাস পূর্ণ হওয়ার পূর্বে আপনার ছেলে হার মানবেন না। আমি বলেছিলাম আপনার ছেলেকে, আপনাদের নিয়ে এই বাড়িতে আসতে। কিন্তু উনি মুখের উপর মানা করে দিয়েছিলেন!”
মধুর স্বর পাল্টে মা কিঞ্চিৎ খড়তড় গলায় বললেন,,
“আমার ছেলেটা ও হয়েছে এক রোঁখা। আর তোমার বাবা ও কিন্তু কম যায় না টয়া! তোমার পাঁচ আঙ্গুলে কপাল বুঝেছ? আমার ছেলেকে স্বামী রূপে পেয়ছ! তুমি যে পরিমান অলস, নির্বোধ, কাজে অপরিপক্ক, হিতাহিত জ্ঞান শূন্য। আমি অন্তত মনে করি না পৃথিবীর কোনো সংসারে এত অনায়াসে তুমি টিকতে পারতে! আমার ছেলে তোমাকে ছাড় দেয় বলেই তুমি আমার সংসার জীবনে টিকে আছো! এই বিষয়টা তোমার বাবাকে বুঝতে হবে। এত অহংকারী, দাম্ভিক, নির্বোধ প্রকৃতির মানুষ আমার পছন্দ নয়। তোমার বাবা এই পর্যায়ে এসে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে!”
প্রসঙ্গ পাল্টাতে আমি বিষন্ন গলায় মাকে শুধিয়ে বললাম,,
“আপনার ছেলে কল করেছিলেন মা? নয়তো আপনি খবর টা জানলেন কিভাবে?”
“পরশ ম্যাসেজ করেছিল। ফোনে কথা হয় নি।”
“আমি তো ফোনে কথা বলছিলাম মা। কোনো কথা বার্তা ছাড়াই হঠাৎ করে উনি কলটা কেটে দিলেন! তাই টেনশান হচ্ছে!”
“টেনশান করার কিছু নেই। হয়তো কাজে ব্যস্ত আছে। কি পোঁড়া কপাল আমার। দাদি হচ্ছি জেনে ও বউমাকে কাছে পাচ্ছি না। সব হয়েছে তোমার বাবার হটকারী সিদ্ধান্তের জন্য!”
“থাক না মা। দয়া করে বাবাকে আর কিছু বলবেন না। মেয়ে হওয়ার বদৌলতে মন খারাপ আমার ও হয়!”
প্রত্যত্তুরে মা তটস্থ গলায় বললেন,,
“রাখছি এখন। ভালো থেকো, নিজের যত্ন নিও। আর হ্যাঁ, অতি শীঘ্রই নাতি, নাতনী সমেত আমার বাড়িতে ফিরে এসো।”
ফট করেই কলটা কেটে দিলেন মা। ঐ দিকে নিচ তলা থেকে খুশির আমেজ ভেসে আসছে আমার রুম অবধি! ফোন হাতে রেখেই আমি খুশির রেশ ধরে দরজার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই দেখলাম মা দ্রুত পায়ে হেঁটে এলেন আমার নিকটে। আনন্দে মা আমায় ঝাপটে ধরে বললেন,,
“আমি খুব খুশি রে মা। খুব খুব খুব খুশি। ফারিহার পূর্বেই তুই মা হতে পেরেছিস! তোর সন্তান দিয়েই আমাদের পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম বাড়বে!”
আমি নির্লিপ্ত গলায় মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,
“বাবা? বাবার প্রতিক্রিয়া কি মা?”
মা অট্ট হাসিতে ব্যস্ত হয়ে বললেন,,
“মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে! পরশের প্ল্যান এই মাত্র উনার ঘিলুতে ঢুকেছে!”
ফিক করে হেসে দিলাম আমি। ইতোমধ্যেই মিলি আপু সহ কাজিনরা এসে আমায় নিয়ে হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠল। বড় আপু কিছুক্ষন পর পর ভিডিও কলে আমাদের দেখছেন। আমাদের খুশিতে খিলখিল করে হাসছেন। মাঝে মাঝে নেত্র কোটরে জল ও জমে আসছে আপুর! আপু এবং জিজু অনেক চেষ্টা করে ও কোনো সু-সংবাদ দিতে পারছেন না আমাদের। এর জন্যই আপু সামান্য হতাশ। ঐদিকে বাবা সুখবরটা শোনার পর থেকে রুম বন্ধী হয়ে আছেন। কিছুতেই যেন রুম থেকে বের হতে চাইছেন না। হয়তো নিজেকে ব্যর্থ ভাবছেন! পরশের কাছে হেরে যাওয়ার কারনে নিজেকে ছোট ভাবছেন! অথবা হেরে যাওয়ার পর পরশের সাথে নিজ থেকে কথা বলতে খুব দ্বিধা-দ্বন্ধে ভুগছেন!
দুপুর হতেই আমি নিচে নেমে এলাম। বাবাকে ড্রইং রুমের কোথাও দেখতে না পেয়ে সোজা বাবার রুমে চলে এলাম। রুমের দরজাটা হালকা ভেজানো৷ তাই সহজেই আমি দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করতে পারলাম। ব্যালকনীতে পাতা ইজি চেয়ারটায় বাবা আঁখিদ্বয় বুজে শায়িত অবস্থায়। মন্থর গতিতে হেঁটে আমি বাবার সন্নিকটে এলাম। বাবার মুখোমুখি দাঁড়াতেই মুখমন্ডলে অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা, বিষন্নতার ছাপ দেখতে পেলাম! হাঁটু গেড়ে বসে আমি বাবার হাত দুটো আঁকড়ে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গেই বাবা হকচকিয়ে উঠলেন এবং বিস্ময় ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন আমার দিকে। পলকহীন দৃষ্টিতে আমি বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,
“কি হয়েছে বাবা? তুমি এতো স্যাড কেন?”
অনতিবিলম্বে বাবা মাথা নুঁইয়ে নিলেন। অল্প সময় মৌণতা বজায় রেখে অতঃপর বেদনাহত দৃষ্টিতে আমার দিকে দৃষ্টি স্থির করে বললেন,,
“সত্যিই কি বাবার ভালোবাসার তুলনায় স্বামীর ভালোবাসা বেশি বড়?”
“আমি কখন ও এই দুটো সম্পর্ককে তুলনা করে দেখি নি বাবা। দুটো সম্পর্ককেই দুটো সম্পর্কের জায়গায় সবসময় রেখেছি, মনে প্রাণে ধারন করেছি! কোনোটাই আমার কাছে কম, বেশি নয়! দুটোই সমান।”
“আমার কি মনে হয় জানিস? তোর কাছে তোর বাবার ভালোবাসার চেয়ে তোর স্বামীর ভালোবাসা অধিক প্রিয়! তাই তো তুই বাবাকে ছেড়ে, বাবাকে কষ্ট দিয়ে, বাবার মান-সম্মান নষ্ট করে, সমাজের কাছে বাবাকে ছোট করে ঐ ছেলেটার হাত ধরে নির্দ্বিধায় পালিয়েছিলি! ভুলে গিয়েছিলি বিগত ২২ বছর ধরে আমি তোকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে লালন পালন করেছি। লাইফে অনেক বড় বড় সেক্রিফাইজ করেছি। কত যত্নে, কত আদরে, কত ভালোবাসায় তোকে মানুষ করেছি! কয়েকদিনের ভালোবাসার কাছে সেই ২২ বছরের ভালোবাসা এতটা তুচ্ছ হয়ে গেল?”
মাথা নুঁইয়ে আমি অশ্রুবিলাসে মশগুল হয়ে পড়লাম। এই মুহূর্তে প্রত্যত্তুরে বাবাকে কি বলা উচিত সঠিক বুঝে উঠতে পারছি না আমি। এর মধ্যেই রুমে তৃতীয় কারো উপস্থিতি টের পেলাম। মা রুখে এলেন বাবার দিকে। তটস্থ গলায় বাবাকে বললেন,,
“ভুলে যেও না আফজাল। তুমি ও একজন স্বামী! বাবার পাশাপাশি তুমি ও কিন্তু একজন স্বামী। আমি ও কিন্তু একটা সময় আমার বাবা-মাকে ছেড়ে তোমার হাত ধরে তোমার এই বাড়িতে উঠেছিলাম। আমাদের বিয়েটা ও কিন্তু এরেন্জ্ঞ ছিল না! লাভ ম্যারেজ ছিল। আমার বাবা ও প্রথমে রাজি ছিলেন না তোমার মতো একজন বেকার যুবকের কাছে আমার বিয়ে দিতে! অনেক কথা কাটি, অনেক ঝগড়া- বিবাদ, অনেক মনোমালিন্যের দীর্ঘ একটা সময় পর পরিশেষে বাবা রাজি হয়েছিলেন। তখন কিন্তু আমি বাবার তুলনায় তোমার ভালোবাসাকেই অধিক প্রাধান্য দিয়েছিলাম! শুধু আমার ক্ষেত্রে নয় পৃথিবীর সবক’টা মেয়ে একটা নির্দিষ্ট সময় পর যখন তার জীবনে মা-বাবার পর বিশেষ কোনো ভালো লাগা বা ভালোবাসার মানুষ আসে তখন সে তাকেই প্রাধান্য দিবে এটাই নিতান্ত স্বাভাবিক এবং বাস্তবিক ব্যাপার। আর বিয়ের পর তো স্বামীই হবে তার ভবিষ্যত, তার বাঁচা-মরা! দীর্ঘস্থায়ী এক পবিত্র বন্ধনে তারা আবদ্ধ হয়ে পড়ে। এটাই জাগতিক নিয়ম। জগৎ সংসার তৈরী হওয়ার পর থেকেই এই নিয়ম যথারীতি প্রয়োগ হয়ে আসছে। তাহলে তুমি নিজের মেয়ের ক্ষেত্রে কেন এই স্বাভাবিক নিয়মটাকে মেনে নিতে পারছ না? যেভাবেই হোক, বিয়েটা তো হয়েই গেছে! এখন সে নতুন একটা সংসারে জড়িত। স্বামী এখন ও জীবিত তার। এখন তো আমাদের মেয়ে সন্তান সম্ভাবা ও। তুমি কে বলো? তাদের তিন তিনটে প্রাণকে আলাদা করার? তুমি কি বুঝতে পারছ না? তুমি পিতার ভালোবাসায় এতটাই অন্ধ হয়ে গেছ যে, নিজের মেয়ের ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষতি করছ? তার সাংসারিক জীবন নষ্ট করছ? একটা কথা বলি শোন? তোমার মেয়ের পাঁচ আঙ্গুলের কপাল বুঝেছ? পরশের পরিবারের মতো এত ভালো একটা সংসার পেয়েছে। পরশের মায়ের মতো একজন জ্ঞানী এবং মিষ্টি শ্বাশুড়ী মা পেয়েছে! কি গুন আছে তোমার মেয়ের? না জানা আছে ভালো কাজ না জানা আছে সহবোধ! আক্কেল, জ্ঞান আছে নাকি তোমার মেয়ের? সামান্য ভাতটা পর্যন্ত রান্না করতে পারে না সে! আর তুমি যে লাফাচ্ছিলে, পিয়াসের কাছে তোমার মেয়েকে বিয়ে দিতে। তুমি জানো না? বড় আপার স্বভাব, চরিত্র? আপা কতটা বদরাগী, অহংকারী এবং জালিম স্বভাবের? পরশের পরিবার তো তোমার মেয়েকে সহ্য করে আসছে আর ভবিষ্যতে ও করবে। কিন্তু আমার আপা? সংসারে যাওয়ার ঠিক ৪/৫ দিনের মধ্যেই তোমার মেয়েকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদায় করে দিতেন! তখন পারতে বাবা হয়ে বিষয়টা সামলে নিতে?
কিয়ৎক্ষনের মধ্যে বাবা গর্জে উঠলেন। হুংকার দিয়ে বললেন,,
“রুম থেকে বের হও তোমরা। আমাকে একটু একা থাকতে দাও প্লিজ। আজ সারাদিনের জন্য এই রুমে তোমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমি একটু একা থাকতে চাই!”
আমি ফ্যাস ফ্যাস করে কেঁদে উঠতেই মা দাঁতে দাঁত চেঁপে আমায় বললেন,,
“এই তোর ন্যাকা কান্না বন্ধ কর। রুম থেকে বের হ। নানা হওয়ার কোনো খুশিই দেখছি না এই লোকের মধ্যে! আছে শুধু নিজের দাম্ভিকতা নিয়ে। পঁচে মরুক এই লোক এই একাকিত্ব রুমে। আসব না আমি বলছি তো। আজ সারাদিনের জন্য আমি এই রুমে আসব না!”
আম্মু রাগে গজগজ করে আমায় নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলেন। দুপুরের খাবার খেয়ে আমি রুমে এসে শুয়ে পড়লাম। এক কদম ও রুমের বাইরে বাড়ালাম না। পরশটা ও সকাল থেকে কল তুলছেন না। টেনশানে আমার হাত পা থরথরিয়ে কাঁপছে। অস্থিরতা এবং অস্বস্তিতে ভুগছি ক্রমাগত। এই উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়েই রাত ১০ টা বাজতে চলল ঘড়িতে। রাতের খাবার খেয়ে রুমে প্রবেশ করতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল। পরশ বিছানার উপর হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে লম্বভাবে শুয়ে আছেন। তাড়াহুড়ো করে আমি রুমের দরজাটা আটকে বিছানায় বসেই ব্যতিব্যস্ত গলায় বললাম,,
“আপনি? কখন এলেন? নিচেই তো ছিলাম আমি। বাড়িতে প্রবেশ করতে তো দেখি নি!”
পরশ চোখ বুজা অবস্থাতেই নির্লিপ্ত গলায় বললেন,,
“শালীদের প্রয়োজন তো এই দিনেই। জিজুদের হেল্প করার জন্য। শালীরাই কায়দা করে আমায় তোমার রুম অবধি পৌঁছে দিয়ে গেছে!”
“সারাদিন কোথায় ছিলেন আপনি? কলটা ও তো তুলছিলেন না। একবার ও কি মনে হয় নি আমাকে কল ব্যাক করার?”
হুড়মুড়িয়ে পরশ শোয়া থেকে উঠলেন। ঠোঁটের কোনে প্রাণোচ্ছ্বল হাসি ফুটিয়ে পরশ ডেস্কের উপর থেকে ফুলের বগিটা হাতে নিয়ে হাঁটু মুড়ে বসলেন আমার মুখোমুখি! ফুলের বগিটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে লোকটা মাধূর্য্যমন্ডিত গলায় বললেন,,
“কংগ্রাচুলেশান আমার মেয়ের মাম্মাম! জানি বড্ড লেইট করে ফেলেছি আমার দু দুটো ভালোবাসার মানুষকে উইশ করতে। কি করব বল? সু-খবরটা শোনার পর থেকে আমি সারাদিনের জন্য অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়েছিলাম। বুঝে উঠে পারছিলাম এই খুশিতে ঠিক কতটা রিয়েক্ট করা উচিত। অফিসের কাজ ছেড়ে দিশেহারা হয়ে আমি বাড়ি ফিরি। মায়ের কোলে মাথা ঠেঁকিয়ে সারাটা দিন পাড় করেছি। খুশির কান্না যেন কিছুতেই থামছিল না আমার! সন্ধ্যা হতেই ফুল, মিষ্টি, গিফটস নিয়ে এই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া। আর এখন, অনেকটা দেরিতেই তোমাদের মুখোমুখি হয়ে বসা। বুকে হাত দিয়ে দেখতে পার টয়া, আমার হৃদস্পন্দন কতটা তিপ তিপ শব্দে কাঁপছে। বাবা হওয়ার অনুভূতি এতটা প্রখর আর প্রগাঢ় হয় তা আজ মাত্র উপলব্ধি করলাম আমি। জানি না আগামী ৮/৯ মাস আমি কিভাবে কাটাব! আমার সন্তান ভূমিষ্ট হওয়া অবধি আদৌ আমার শান্তি মিলবে কিনা!”
টলমল দৃষ্টিতে আমি ফুলের বগিটা হাত বাড়িয়ে নিতেই পরশ ঝড়ের বেগে প্যান্টের পকেট থেকে একটা লাল কাপড়ে মোড়ানো আংটির বক্স বের করলেন। বক্সটা খুলতেই ডায়মন্ডের রিং টা চকচক করে উঠল। বিস্মিত দৃষ্টিতে আমি রিংটার দিকে তাকাতেই পরশ মৃদ্যু হেসে রিংটা আমার বাঁ হাতের তর্জনী আঙ্গুলে অতি যত্নের সহিত পড়িয়ে দিয়ে বললেন,,
“মা হওয়ার প্রথম উপহার। আমি না ভেবে রেখেছি জানো? আগামী প্রতিটা মাসে আমি তোমার জন্য কিছু না কিছু একটা গিফটসের ব্যবস্থা রাখব। প্রতিটা মাস একই ভাবে স্মরনীয় করে রাখব। প্রথম বেবি আমাদের! দিন গুলো স্মরনীয় করে রাখতে হবে না?”
প্রেমময়ী নির্বাক দৃষ্টি আমার লোকটার দিকে সীমাবদ্ধ। কতটা খুশি লোকটা! বাবা হওয়ার আনন্দে। আমাকে পেয়ে ও বোধ হয় লোকটা এতটা খুশি হন নি! যতটা খুশি হয়েছেন বাবা হওয়ার উচ্ছ্বাসে! আংটি টা পড়ানোর পর লোকটা আচমকা চোখের পানি ছেড়ে আমার বাঁ হাতটায় দীর্ঘ এক চুমো খেয়ে বললেন,,
“থ্যাংকস টয়া। পৃথিবীর সব’চে মধুরতম এবং শান্তিময় অনুভূতিটা আমাকে অনুভব করানোর জন্য। আই কান্ট এক্সপ্লেইট দেট ফিলিংস টয়া! আই কান্ট এক্সপ্লেইন!”
ইতোমধ্যেই হঠাৎ রুমের দরজায় করাঘাত পড়ল। রুম্পা আপুর গলার আওয়াজ কর্নপাত হলো। উফফস বলতেই ভুলে গেছি! রুম্পা আপু আজ বিকেলেই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। কিছুদিন থেকেই আবার চলে যাবেন। দরজায় পর পর কয়েক বার কড়াঘাত পড়ার পর আমি দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের দরজাটা খুলে দিলাম। আপু চোখের চশমাটা ঠিক করে হাতে মিষ্টির প্লেইট সমেত অধৈর্য্য গলায় আমায় বললেন,,
“জিজু মিষ্টি এনেছেন। তোদের দিতে আসছিলাম। হঠাৎ দেখি জেঠু এই রুমের দিকে এগিয়ে আসছেন! যেভাবেই হোক, জিজুকে বল লুকিয়ে পড়তে। গেইমের শেষ পর্যায়ে এসে এভাবে হেরে গেলে চলবে না!”
অস্থির হয়ে উঠলাম আমি। পিছু ফিরে পরশের দিকে উৎকন্ঠিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম পরশ অলরেডি ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েছেন! দরজা থেকে মুখ বের করে পরশ ক্রুর হেসে বললেন,,
“আমি ওয়াশরুমে আছি। দজ্জাল শ্বশুড় কে ভেতরে আসতে দাও! হেরে যাওয়ার পর দেখি আমার শ্বশুড় মশাইয়ের প্রতিক্রিয়া কি!”
ফট করে ওয়াশরুমের দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন পরশ। সঙ্গে সঙ্গেই বাবা আমার রুমের দরজায় এসে অবস্থান নিলেন। রুম্পা আপু শুকনো ঢোক গিলে মিষ্টির প্লেইটটা আমার দিকে এগিয়ে বললেন,,
“খেয়ে নিস মিষ্টি টা। নানু হওয়ার খুশিতে জেঠিমনি অর্ডার করেছিলেন!”
মিষ্টির প্লেইটটা হাতে নিয়ে আমি জোর পূর্বক হাসি টেনে বাবাকে রুমে সাদরে আমন্ত্রন জানিয়ে বললাম,,
“এসো বাবা। রুমে এসো!”
ম্লান হেসে বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে রুমে প্রবেশ করলেন। বিছানায় আমার পাশে বসে বাবা হঠাৎ মাথা নুঁইয়ে আমায় শুধিয়ে বললেন,,
“আমি খুব খারাপ বাবা! তাই না রে টয়া?”
আহত হলাম আমি। বাবার এহেন হৃদয়বিদারক কথায়। উদ্বিগ্ন গলায় আমি বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,
“এসব তুমি কি বলছ বাবা? আমি কখনো বলেছি? আমার বাবা খারাপ?”
“বলিস নি৷ তবে মনে মনে তো ধারনা করতেই পারিস!”
“তুমি ভুল বুঝছ বাবা। আমি কখনো তোমায় নিয়ে এমন ধারনা পোষণ করি নি।”
“আজ আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি! বিয়ের পর মেয়ের শ্বশুড় বাড়িই হলো মেয়ের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল৷ যেখানে সে নিজ পরিবারের মতোই একটা নতুন পরিবার পায়, নতুন মা-বাবা পায়, নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষজন, নতুন সংসার, নতুন সব! আর তার স্বামীই হলো সেই সংসারের প্রাণ! সেই জায়গায় পরশ একদম ঠিক তোর জন্য! বিষয়টা প্র্যাক্টিক্যালি ভেবে দেখলাম, আমি অযথা চেষ্টা করছি তোর থেকে তোর স্বামী, সংসার আলাদা করতে। মন থেকে আমি কিছুতেই পরশকে মেনে নিতে পারছি না! কারন, পরশের সাথে আমার এখন ও, ঐ রকম ভালো কোনো সম্পর্কই তৈরী হয়ে উঠে নি। সেই সুযোগটাই এখন ও হয়ে উঠে নি। সবসময় দুজন দুজনকে দোষারোপ করেছি, গাল মন্দ করেছি, নিজেদের অহংকার বজায় রেখেছি! আমার না খুব খারাপ লাগছে! এইভাবে হেরে যাওয়ার পরে ও পরশের সাথে কথা বলতে। তাকে এই বাড়িতে ডেকে আনতে! খুব বিবেকে বাঁধছে আমার। কি করি বল তো? তুই একটু আমার হয়ে পরশকে বলবি এই বাড়িতে আসতে? তোকে সাথে করে নিয়ে যেতে? আর পারছি না নিজের কিঞ্চিৎ পরিমান দাম্ভিকতা ভুলে পরশকে আমন্ত্রণ করতে! সাথে এ ও পারছি না সন্তানসম্ভবা হওয়ার পরে ও তোকে জোর খাঁটিয়ে এই বাড়িতে আটকে রাখতে! কি করব আমি বল তো?”
ইতোমধ্যেই পরশ ওয়াশরুমের দরজা থেকে আমায় ইশারা করে বলছেন যেন বাবাই পরশকে কল করেন! আমি যেন কিছুতেই রাজি না হই পরশকে কল করে এই বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে!
#চলবে…?
#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩৩
#নিশাত_জাহান_নিশি
ইতোমধ্যেই পরশ ওয়াশরুমের দরজা থেকে আমায় ইশারা করে বলছেন যেন বাবাই পরশকে কল করেন! আমি যেন কিছুতেই রাজি না হই পরশকে কল করে এই বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতে!
সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি আমি! বাবার নেতিয়ে যাওয়া বিবর্ণ মুখমন্ডলে ক্লেশ, গ্লানি, লজ্জা এবং তীব্র অপরাধবোধ প্রগাঢ় ভাবে ফুটে উঠেছে। পৃথিবীর কোনো মেয়েই তার বাবাকে এহেন বিমূর্ষ অবস্থায় দেখে বাবার করা আবদারের বিপরীতে যেতে পারবে না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করবে বাবার আবদার মেটানোর। আমি ও ঠিক সেভাবেই বাবার নিরান্দন, বিষাদপূণ মুখশ্রীতে চেয়ে পরশের কাছে বাবাকে অতি পর্যায়ে টেনে এনে ছোট করতে পারছি না! বিবোধ বোধে তীব্র আঘাত অনুভব করছি! অন্যদিকে পরশ ক্রমাগত ইশারা করেই চলছেন, বাবার করা আবদারে রাজি না হতে! পরশকে হারিয়ে না দিতে! এই পর্যায়ে এসে আমি মাথা নুয়াতে বাধ্য হলাম। পরশের দিকে আর এক দফা তাকালেই হয়তো বাবার আবদারের বিপরীতে যেতে হবে আমার!
কিয়ৎক্ষন সবার মধ্যেই পিনপনত নীরবতা বিরাজমানের পর মাথা উঁচিয়ে আমি যেই না বাবাকে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে যাব অমনি বাবা দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে আমার মুখপানে চেয়ে বললেন,,
“বিষয়টা আসলেই খুব খারাপ দেখায় টয়া! মেয়ের বাবা হওয়ার সুবাদে আমার যথার্থভাবেই উচিত মেয়ের জামাই এবং মেয়ের শ্বশুড়, শ্বাশুড়ীকে নিমন্ত্রণ করা! বিয়ের দুমাস হতে চলল তোদের। অথচ মেয়ের বাবা হওয়া সত্ত্বে ও আমি এখন ও অবধি তোর শ্বশুড়বাড়ির লোকজনদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে পারি নি। আদর, যত্ন, সেবা, আত্নি কিছুই করতে পারি নি। বলা বাহুল্য, ভবিষ্যতে হয়তো তোর শ্বশুড় বাড়ির লোকজন তোকে খোঁটা দিতে পারেন! বলতেই পারেন, তোর বাবা খুব দাম্ভিক, বদরাগী, কিপটে এবং জাদরেল স্বভাবের! মেয়ের প্রতি, মেয়ের ভালো-মন্দের প্রতি এবং মেয়ের শ্বশুড়বাড়ির প্রতি কোনো খেয়ালই নেই উনার! তার উপর মেয়েকে দিয়ে আমাদের নিমন্ত্রণ জানিয়েছে, নিজ থেকে নিমন্ত্রণ জানান নি। বিষয়টা খুব দৃষ্টিকটু দেখায় না?”
বাবার সুবুদ্ধি উদয় হওয়ার খুশিতে আমি আনন্দঘন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করার পূর্বেই পরশ ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁত কপাটি কেলিয়ে হাসছেন আর চড়কির মতো গোল গোল আকারে ঘুঁড়ছেন। জিতে যাওয়ার পৈশাচিক খুশি লোকটার মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে! ফিক করে হেসে উঠে আমি বাবার হাত দুখানা চেঁপে ধরে বললাম,,
“কিছুটা দেরি হয়ে গেলে ও তুমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছ বাবা। আমি না চাই না জানো তো? শ্বশুড় বাড়ির লোকজনদের কাছে ছোট হয়ে থাকতে! আমার বাবাকে তাদের কাছে বিন্দু পরিমান ছোট করতে! কেউ না জানুক অন্তত আমি তো জানি, আমার বাবা কতটা মহান! হয়তো উপর থেকে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই রাগী। তবে ভেতরের মনটা শিশুর মতো কোমল এবং নমনীয়।”
ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটিয়ে বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মমতাময় গলায় বললেন,,
“আমি জানি, আমার ছোট মেয়ে আমাকে কতটা ভালোবাসে। তাই তো তার উপরই আমার সমস্ত রাগ, জেদ, জোর, অভিমান, সীমাবদ্ধ! নানা হওয়ার খুশিতে আমি ও দারুন খুশি জানিস? এই প্রথম তোর কাছে খুশিটা শেয়ার করলাম! নানা ভাইয়ের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি আমি। তোর প্রথম সন্তান কিন্তু এই বাড়ি থেকেই হবে টয়া। সব মেয়েদের প্রথম সন্তান তার বাপের বাড়ি থেকেই হয়। আশা করি, তোর স্বামী, শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী এই নিয়মটার কথা মাথায় রাখবেন!”
“তুমি যা বলবে ঠিক তাই হবে বাবা। পরশ বা আমার শ্বশুড়-শ্বাশুড়ী এতে দ্বিমত পোষন করবেন না।”
বাবা মিষ্টি হেসে স্থান ত্যাগ করে দাঁড়ালেন। পুনরায় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,,
“ঘুমিয়ে পড়। কাল সকালে কথা হবে। পরশের পরিবারকে ও কাল সকালেই নিমন্ত্রণ করব। ভাবছি পিয়াস এবং মিলির বিয়েটা ও কাল বা পরশুর মধ্যে ফিক্সড করে নিব। বড় আপা খুব তাড়া দিচ্ছেন!”
“তাহলে তো খুবই ভালো বাবা। আমরা মিলি আপুর বিয়েটা খেয়েই না হয় ঢাকায় যাব। তুমি বরং কাল বা পরশুর মধ্যেই বিয়ের ডেইটটা ফিক্সড করে নাও। শ্বশুড় বাড়ি যাওয়ার পর হয়তো আগামী ৪/৫ মাস ও আমি এই বাড়িতে আসতে পারব না বাবা! পিয়ালী আপু এবং পায়েলের বিয়ে ও অনেকটা ঘনিয়ে আসছে!”
“তুই যা বলছিস তাই হবে মা। এখন ঘুমা। বাবা আসছি কেমন?”
প্রস্থান নিলেন বাবা। যাওয়ার সময় রুমের দরজাটা হালকা ভেজিয়ে দিয়ে গেলেন। ইতোমধ্যেই পরশ ঝড়ের বেগে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে আমার হাত দুখানা টেনে ধরে সোজা দাঁড় করিয়ে দিলেন। বাঁ কোমড়টায় হাতে রেখে লোকটা আমার ডান হাতের আঙ্গুলে নিজের হাতের সবক’টা আঙ্গুল মিশিয়ে আমায় নিয়ে গোল গোল হয়ে ঘুড়তে লাগলেন আর দাঁত কেলিয়ে হেসে গুনগুন করে বললেন,,
“ইয়েস! মে জিত গেয়া। জাদরেল শ্বশুড়ের সাথে চ্যালেন্জ্ঞে আমি জিতে গেছি! এবার দেখার পালা এই দজ্জাল শ্বশুড় কিভাবে আমায় নিমন্ত্রণ জানান। ঠিক কতটা কাতর ভঙ্গিতে বলেন এই বাড়িতে আসতে, উনার মেয়েকে নিয়ে যেতে!”
“শুনুন পরশ। আমার বাবা যেহেতু ভুলটা বুঝতেই পেরেছেন। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় না আপনার উচিত হবে বাবার অনুভূতি নিয়ে কোনো হাসি, তামাশা করার। বাবাকে কোনো রকম ঠাট্টার খোড়াক তৈরী করার। বাবা কল করে নিমন্ত্রণ জানালে এক কথাতেই আপনি রাজি হয়ে যাবেন প্লিজ। বাবাকে বাধ্য করবেন না কাকুতি, মিনতি করতে। হাজার হলে ও বাবা আপনার বয়োজ্যেষ্ঠ, আপনার নিজের বাবার সমতুল্য!
পরশ আকস্মিক নাচ থামিয়ে বেশ তৎপর গলায় প্রত্যত্তুরে বললেন,,
“তুমি এত সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে কেন টয়া? বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা সাপে-নেউলের! আমি সবসময় চাইব বাবার সাথে হাসি, ঠাট্টা করতে। ইচ্ছেপূর্বক বাবাকে ক্ষ্যাপাতে! এর মানে এই নয় যে, বাবাকে আমি সম্মান বা শ্রদ্ধাবোধ করি না। বাবার প্রতি আমার আলাদা এক অনুভূতি আছে। যা আমি প্রকাশ করতে চাই না। আমি চাই সবসময় এভাবেই বাবার পিছনে লেগে থাকতে, ঝগড়া-বিবাদ করতে, সম্পর্কটাকে সবসময় এভাবে জমিয়ে রাখতে৷ অতিরিক্ত সম্মানবোধ দেখিয়ে সম্পর্কটাকে এক ঘেঁয়ে করতে চাই না। আমাদের শ্বশুড়, জামাইয়ের সম্পর্কটা হবে একদম আলাদা। আট, পাঁচটা শ্বশুড়-জামাইয়ের সম্পর্কের মতো অতোটা স্বাভাবিক বা সহজ নয়!”
“ওহ্ তাই? তার মানে আপনি সবসময় আমার বাবার পিছনে এভাবেই লেগে থাকবেন?”
“হ্যাঁ থাকব! এভাবেই লেগে থাকব। শ্বশুড়-জামাইয়ের লড়াই আজীবন ঠিক এই ভাবেই বহাল থাকবে!”
ফিক করে হেসে দিলাম আমি। পরশ আমায় ছেড়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের দরজাটা আটকে দিলেন। অতঃপর আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আচমকা আমায় কোলে তুলে নিলেন। কটমট দৃষ্টিতে লোকটার লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাতেই লোকটা আমার নাকে নাক ঘঁষে বললেন,,
“আজ যে আমার মেয়ের মাম্মাম আমাকে ঠিক কতটা খুশি করেছে তার কোনো এক্সপ্লেনেশান হয় না। তাই আজ রাতটা আমার মেয়ের মাম্মামকে আমি খুব বেশি ভালোবাসতে চাই। ঠিক প্রথম রাতের মতো!”
লজ্জায় কুঁকড়ে উঠে আমি লোকটার বুকের পাজরে মুখ লুকালাম। মন্থর গলায় বললাম,,
“আপনি কি করে জানলেন? আমাদের মেয়ে হবে?”
“ছেলে বাবু হলে ও কিন্তু আমার কোনো আপত্তি নেই! তবে আমি চাই আমাদের প্রথম সন্তান মেয়ে বাবু হউক!”
“আর যদি দুইটা মেয়ে বাবু হয়? তখন?”
“তখন তো আমি খুশিতে পাগল প্রায় হয়ে যাব। বাঁধ ভাঙ্গা খুশিতে ঠিক আত্নহারা হয়ে উঠব!”
“তখন আমায় কি গিফটস দিবেন হুম?”
“তুমি যা চাইবে!”
“আমাদের কিন্তু এখন ও হানিমুনে যাওয়া হয় নি!”
“মাথায় আছে আমার। জাস্ট কয়েকটা মাস সময় দাও আমায়। আমরা ও হানিমুনে যাব। চার চারটে কাপল মিলে আমরা হানিমুনে যাব!”
“মানে? আপনি মিলি আপু, পিয়ালী আপু এবং পায়েলের কথা বলছেন?”
“ঠিক তাই!”
মিষ্টি হেসে আমি পরশের গলা জড়িয়ে ধরলাম। ক্রুর হেসে পরশ আমায় নিয়ে বিছানায় শায়িত হলেন। তীব্র ভালোবাসায় আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন লোকটা এক অজানা শহরে! যে শহরে ভালোবাসার কোনো এক্সপ্লেনেশান হয় না!
,
,
পরের দিন। ঘড়িতে প্রায় ১০ টার কাছাকাছি। সকালের নাশতা শেষে বাড়ির সবাই বসার ঘরে গোল হয়ে বসে আছি। বাড়ির প্রতিটা সদস্য এই গোল বৈঠকে উপস্থিত। বৈঠকের মধ্যমনি হয়ে বসে আছেন বাবা। সবার উৎসুক দৃষ্টি বাবার দিকে। বাবা ফোন হাতে নিয়ে দারুন জড়তায় ভুগে কিয়ৎক্ষন পর পর আমাদের সবার দিকে ক্ষীণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। মা আমার পাশে বসে কেবলই দাঁতে দাঁত চেঁপে বাবাকে বলছেন, তাড়াতাড়ি পরশকে কলটা করতে। বেলা বয়ে যাচ্ছে। বাবা গলা খাঁকারী দিয়ে বার বার পরশের নাম্বারে ডায়াল করে ও মাঝ পথে হুট করে কলটা কেটে দিচ্ছেন। প্রায় চার বার এই একই কাজ পুনরাবৃত্তি হওয়ার পর মা অবশেষে রাগান্বিত গলায় বাবাকে শুধিয়ে বললেন,,
“কি চাইছটা কি তুমি? মেয়ের জামাইকে কল করবে না? মেয়ের শ্বশুড়-শ্বাশুড়ীকে নিমন্ত্রণ করবে না? এতই অহংকার তোমার?”
বাবা আবদার সূচক গলায় মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,
“তুমি একটু আমার বদলে মেয়ের জামাইয়ের সাথে কথা বলে দিবে?”
“কেন কেন? আমি কথা বলব কেন? চ্যালেন্জ্ঞ নেওয়ার সময় কি আমি চ্যালেন্জ্ঞটা নিয়েছিলাম? না আমি মেয়ের জামাইয়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম?”
বাবা মাথা নুঁইয়ে নিলেন। নিরুপায় হয়ে আঁখিদ্বয় বুজে বাবা বুকে এক গাধা সাহস সন্ঞ্চার করে পরশের নাম্বারে এবার ডায়াল করেই নিলেন। কানে ফোন চেঁপে বাবা চোখ, মুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছেন। বাবার এহেন হটকারী কার্যকলাপ দেখে উপস্থিত সবাই মুখ চেঁপে হাসতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। পর পর দুবার কান থেকে ফোন নামিয়ে বাবা পরশের নাম্বারে অনবরত ডায়াল করেই চলছেন। ঐ পাশ থেকে ফোন তুলছেন না পরশ। বুঝতে আর বাকি রইল না পরশ ইচ্ছাকৃত ভাবে বাবাকে ঘাটাচ্ছেন! চতুর্থ বারের বেলায় বাবা কপালের ভাঁজে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে বিড়বিড় গলায় বললেন,,
“ইচ্ছে করেই ছেলেটা আমায় রাগাচ্ছে। ভাব দেখাচ্ছে ভাব! আমার হেরে যাওয়ার খুশিতে নিশ্চয়ই সে শয়তানী চাল চালছে। আমাকে আর ও হেনস্তা করার ফন্দি আঁটছে। উফফফ অসহ্যকর এই ছেলে!”
হাসি গলাধঃকরন করে আমি বাবার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম,,
“কি হয়েছে বাবা? পরশ ফোন তুলছেন না?”
“নাম্বার ব্যস্ত বলছে। নিশ্চয়ই আমার সাথে বজ্জাতি করছে!”
উপস্থিত সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠতেই বাবা সবার দিকে অগ্নিঝড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই সবাই হাসি থামিয়ে শুকনো ঢোক গিলতে আরম্ভ করলেন! মা ঠোঁট কামড়ে হাসি চেঁপে বললেন,,
“দেখি, ডায়াল করতে থাক। যতক্ষন অবধি না জামাই ফোন তুলছে। ব্যস্ত মানুষ তো! হয়তো অফিসের কাজে মহাহাহা ব্যস্ত৷ আমার মেয়ে জামাই তো আর তার শ্বশুড়ের মতো নিকাম্মা নয়! যে সারাক্ষন বাড়িতে থেকে থেকে অলস সময় পাড় করবে!”
বাবা ক্ষেপে উঠে ও মায়ের উপর রাগ ঝাড়লেন না। সন্তপর্ণে রাগটাকে আয়ত্তে নিয়ে এলেন। প্রায় ষষ্ঠ বারের বেলায় ঐ প্রান্ত থেকে পরশ কলটা তুলতেই বাবা কলটা লাউড স্পীকারে রেখে দিলেন। গলা খাঁকিয়ে বাবা হ্যালো বলার পূর্বেই পরশ ঐ প্রান্ত থেকে রূঢ় গলায় বললেন,,
“হ্যালো কে? বার বার বিরক্ত করছেন কেন? কলটা কেটে দিচ্ছি মানে আমি ব্যস্ত আছি! এতটুকু বুঝার বুদ্ধি ও মাথায় নেই আপনার? ভারী আশ্চর্যকর লোক তো!”
বাবার পাশাপাশি উপস্থিত সবাই হকচকিয়ে উঠলেন। শার্টের কলারটা ঠিক করে বাবা নমনীয় গলায় বললেন,,
“স্ক্রীনের দিকে তাকাও। নাম্বারটা ভালো দেখে এরপর কথা বল!”
“দেখেছি! তো? কি হয়েছে? আননৌন নাম্বার। আপনাকে নিশ্চয়ই চেনার কথা নয় আমার!”
“ভয়েসটা ও চিনতে পারছ না?”
“উমমমমম..কিছুটা পরিচিত লাগছে! কিন্তু কেন বলুন তো?”
“কেন?”
“কারন আমার জাদরেল শ্বশুড়ের গলার স্বরটা ও কিছুটা এরকম! তবে উনি আপনার মত এতটা মিষ্টি স্বরে কথা বলেন না! খুব অহংকার আমার শ্বশুড়ের বুঝেছেন? গলায় অহংকারী একটা ভাব আছে! আপনি হয়তো আমার শ্বশুড়ের কাছের কেউ হতে পারেন! নিশ্চয়ই আপনাকে উনি হায়ার করেছেন তাই না? আমাকে মানিয়ে এই বাড়িতে আনার জন্য?”
“এই যে এই লোকটার সাথে কথা বলছ তার গলায় অহংকারী ভাব নেই?”
“না নেই। থাকলে এতক্ষন কথা বলতাম নাকি? ঠিক মুখের উপর কলটা কেটে দিতাম। অহংকারী পুরুষ মানুষ আমার পছন্দ না। তাই বোধ হয় আমার শ্বশুড় মশাই স্বয়ং অহংকারী স্বভাবের পড়েছেন!”
দাঁতে দাঁত চেঁপে ও বাবা রাগ সংবরন করতে না পেরে বললেন,,
“তুমি কি সত্যিই আমাকে চিনতে পারছ না? আমার নাম্বারটা সত্যিই কি তোমার ফোনে সেইভ করা নেই? আমাকে কি আমাকে হায়ার করা লোক মনে হচ্ছে?”
“না নেই! অপ্রয়োজনীয় কারো নাম্বার আমার ফোনে সেইভ করা থাকে না। অবশ্য জোর দিয়ে বলতে পারছি না, আপনি আমার শ্বশুড়ের হায়ার করা লোক। তবে সন্দেহ করছি!”
“আচ্ছা? তুমি কি এভাবে জনে জনে বদনাম করে বেড়াও তোমার শ্বশুড় মশাইয়ের নামে?”
“হ্যাঁ করি! প্রয়োজন হলে করি! আপনি নিশ্চয়ই আমার শ্বশুড় মশাইয়ের কাছে এসব বলতে যাবেন না! আচ্ছা যাই হোক, এখন বলুন? আপনি কে? আপনার পরিচয় কি?”
“মশকরা করছ আমার সাথে? ইয়ার, দোস্ত পেয়েছ আমায়?”
“স্যরি স্যার! আমি আপনার সাথে মোটে ও ইয়ার, দোস্ত হিসেবে কথা বলছি না। সম্পূর্ণ একজন অপরিচিত মানুষ হিসেবে কথা বলছি। সত্যি বলতে গেলে আপনার সাথে অহেতুক মশকরা করার পর্যাপ্ত সময়টা ও নেই আমার!”
“আমি তোমার শ্বশুড় বলছি! আফজাল হোসেন বলছি!”
“হ্যাঁ তো? কি করতে পারি? আমি জানি আপনি আমার শ্বশুড় মশাই বলছেন! যার সাথে আমার কোনো সু-সম্পর্ক নেই। না আছে কোনো বুঝা-পড়া। সেক্ষেত্রে তো আপনি আমরা অপরিচিতই হলেন তাই না?”
“তার মানে তুমি ইচ্ছে করে আমার সাথে নাটক করছিলে?”
“হ্যাঁ করছিলাম। আপনি ও কিন্তু আমার সাথে কম নাটক করেন নি! আপনার এক মেয়েকে নিয়ে যা নাটক করেছেন আপনি! বাপরে, বাপ! হেরে যখন ভূত হলেন ঠিক তখনই মেয়ের জামাইকে কল করতে বাধ্য হলেন তাই না? অহংকার ভেঙ্গেছে তো আপনার?”
“শুনো? আমি তোমার সাথে নতুন করে কোনো দ্বন্ধে জড়াতে চাই না। আজ বা আগামী কালের মধ্যে তোমার পুরো পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আসবে৷ নিমন্ত্রণ রইল তোমাদের!”
“স্যরি স্যার! আমি আসতে পারব না। আপনি এক কাজ করুন। আপনি এসে আপনার মেয়েকে আমাদের বাড়িতে দিয়ে যান!”
“গুরুজনদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানো না? মুখের উপর মানা করে দিলে?”
“আপনি জানেন না? মেয়ের জামাইদের সাথে কিভাবে আদুরে গলায় কথা বলতে হয়? সব ক্ষেত্রে ঝাঁঝালো গলায় কথা বললে হয় না! মেয়ের জামাইদের সাথে নমনীয় হতে হয়!”
“এখন কি আদর, সোহাগ করে বলতে হবে? বাবা এসো, তোমার পরিবার নিয়ে এসো, এসে আমার মেয়েকে নিয়ে যাও, আমাকে এবং আমার পরিবারকে উদ্ধার কর, তুমি বা তোমরা না এলে আমি ভীষণ কষ্ট পাব বাবা! এভাবে ননাই করে কথা বলতে হবে?”
“আলবাদ বলতে হবে! ঠিক এভাবেই আহ্লাদী স্বরে বলতে হবে! দেখি, বলা শুরু করুন। আমি অপেক্ষা করছি!”
#চলবে…?