#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩০
#নিশাত_জাহান_নিশি
আমি মিটিমিটি হেসে নিজেকে লোকটার থেকে ছাড়িয়ে সদর দরজার দিকে অগ্রসর হয়ে বললাম,,
“বোধ হয় মা এসেছেন!”
পরশ তড়িঘড়ি করে বসা থেকে উঠে কিঞ্চিৎ কুঁচকে থাকা শার্টের কলারটা ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হাসিমুখে দরজার খিল খুলে দিতেই মা এবং পায়েল হম্বিতম্বি হয়ে ড্রইং রুমে পদার্পন করলেন। পরশের দিকে কয়েক কদম পা বাড়িয়ে মা কপালে গুটি কয়েক বিরক্তির ভাঁজ ফুটিয়ে আচমকা নাক টেনে বললেন,,
“পোঁড়া পোঁড়া গন্ধ পাচ্ছি! রান্নাঘর থেকে আসছে বোধ হয়!”
হুশ ফিরল আমার! মস্তিষ্ক এতো অকেজো আমার ভাবতেই জিভ কেটে নিজেকে শাসাতে আরম্ভ করলাম। গ্যাসে যে সেই কখন ভাত বসিয়ে এসেছি বিষয়টা তো পুরোপুরি গুলে খেয়েছি! মা শুধু শুধু আমাকে বকেন না। সব বকুনির পিছনে ও নির্দিষ্ট গুটি কয়েক কারন থাকে। কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমি প্রানপনে দৌঁড়ে গেলাম রান্নাঘরে। ভাতের পানি শুকিয়ে একদম তলানীতে এসে ঠেকেছে। ভাতের সেই আকার আর নেই! পায়েসের আকার ধারন করেছে। তলানীর দিকটা আংশিক পুঁড়তে শুরু করেছে! মুখমন্ডলে ঘোর আতঙ্ক সমেত আমি গ্যাস থেকে ভাতটা নামিয়ে পাশে রাখতেই মা তেঁড়ে এলেন রান্নাঘরের দিকে। কিঞ্চিৎ মুহূর্তের মধ্যে আমার পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মা দাঁতে দাঁত চেঁপে আমায় শাসিয়ে বললেন,,
“এই? তুমি কি কখনো শুধরাবে না? খামখেয়ালিপনা ভুলে একটু তৎপর হবে না? এখন যদি আমি বাড়িতে না আসতাম বা নাকে পোঁড়া গন্ধটা না আসত তখন কি হতো? পুরো বাড়ি তো আগুনে ঝলসে যেতো। গ্যাস ফুটে তুলকালাম কান্ড বেঁধে যেতো। এত বকুনি দেই, এত রাগ ঝাঁড়ি এরপরে ও তুমি সংশোধন হবে না?”
মাথা নুঁইয়ে আমি ফুঁফিয়ে উঠতেই পেছন থেকে পরশ ইতস্তত গলায় মাকে ডেকে বললেন,,
“মা ছাড় না! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। মূলত দোষটা আমারই ছিল! আমি বাড়ি ফেরার পর থেকেই বিভিন্ন কাজে টয়াকে ব্যস্ত রেখেছিলাম! তাই হয়তো টয়া ভাতের কথাটা একদম ভুলে গিয়েছিল। ছাড় দাও না আজকের জন্য প্লিজ!”
“সবসময় বউকে সেইফ করতে চলে আছিস তুই তাই না? বউকে তার ভুলটা বুঝানোর চেষ্টা তো দূরে থাক একটা ন্যায় কথা ও শুনাতে আসবি না? সবসময় বউয়ের হয়ে সঙ্গ দিবি? মাঝখান থেকে যত জ্বালা আমার! প্রতি পদে আমাকেই হেনস্তা হতে হয়! সব দিকে আমারই নজর রাখতে হয়। কাজের বুয়াটা হয়েছে নবাবজাদী! সপ্তাহে তিন দিন তার ছুটি লাগবেই লাগবে। কলেজে মেয়েটার পিছনে খেঁটে এসেছি এতক্ষন! এখন আবার হেঁশেল ও সামলাতে হবে৷ এই সংসার থেকে যে আমি কবে উদ্ধার পাব আল্লাহ্ মাবুদ জানেন!”
রাগে গজগজ করে মা রান্নাঘর থেকে প্রস্থান নিলেন। বিষন্ন মনে আমি হেচকি তুলে কাঁদতেই পরশ পেছন থেকে আমায় ঝাপটে ধরে গলায় মুখ ডুবিয়ে আদুরে স্বরে বললেন,,
“হয়েছে, মন খারাপ করতে হবে না। মা রা একটু এই রকমই হয়। নেক্সট টাইম খেয়াল রেখ, তাহলেই হবে।”
“সবসময় কেন আসেন আমাকে সেইফ করতে? কে বলেছিল আমার হয়ে সাফাই দিতে?”
“একমাত্র বউ আমার! তা ও আবার কত সংগ্রাম করে পেয়েছি তাকে! মার খেয়েছি, হাজারটা বকা শুনেছি, অনেক জনের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেছি, মান-সম্মান ও খুঁইয়ে বসেছি। তাকে সঙ্গ দিব না তো কার দিব হুম?”
মনটা কিছুতেই যেন শান্ত হচ্ছে না আমার। চাঁপা একটা কষ্ট লুকিয়ে আছে। লোকটাকে এক ঝটকায় নিজের থেকে ছাড়িয়ে আমি রান্নাঘর থেকে প্রস্থান নিলাম। ড্রইং রুমে পা রাখতেই মা আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তটস্থ গলায় বললেন,,
“রেডি হয়ে নাও। পরশ বলল আজ কুমিল্লায় যাবে। কাজ শেষ করে বিকেলের মধ্যেই বাড়ি ফিরবে ওকে?”
কান্নাসিক্ত গলায় আমি মাথা নুঁইয়ে প্রত্যত্তুরে বললাম,,
“আমি বাড়ি যাব মা! বাবা-মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। আপনার ছেলে বলেছেন আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবেন!”
ঝাঁঝালো গলায় মা আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,
“কেন? আমার ছেলেকে আবার অপমান করাতে? একবারে তোমার মন ভরে নি না? আবার যাবে আমার ছেলেকে অপমান করাতে, হেনস্তা করাতে, মার খাওয়াতে?”
এই পর্যায়ে এসে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। সহ্য ক্ষমতা অবক্ষয়ের দিকে অগ্রসর হয়েছে। ধপ করে ফ্লোরে বসে আমি ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলাম! পরশ দৌঁড়ে এলেন। মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রূঢ় গলায় বললেন,,
“মা প্লিজ। সবসময় টয়ার সাথে খারাপ ব্যবহার করা বন্ধ কর। দেখছ মেয়েটা ফ্যামিলি ছাড়া গোটা একটা মাস রয়েছে। ফ্যামিলির কারো সাথে তার সম্পর্ক তেমন একটা ভালো নেই। সেক্ষেত্রে তোমার উচিত কিছুটা নমনীয় হওয়া। মেয়েটাকে বুঝা। মা হিসেবে তার মনের অবস্থাটা বুঝার চেষ্টা করা। সবসময় তাকে এক তরফা দোষ দিও না প্লিজ। দোষ কিন্তু তোমার ছেলের ও ছিল। আমি নিজের দোষেই টয়ার বাবার হাতে চড় খেয়েছিলাম! টয়ার বাবার কড়া কথা ও শুনেছিলাম। আর টয়া নিজের একার সিদ্ধান্তেই কিন্তু বাড়ি ছেড়ে পালায় নি। আমিই তাকে ইন্ধন যুগিয়েছিলাম বাড়ি ছেড়ে পালাতে! গোটা বিষয়টাতে আমিই সম্পূর্ণভাবে দায়ী। টয়ার কোনো দোষ আমার চোখে পড়ে নি, না কখন ও পড়বে!”
“তার মানে তুই কি বলতে চাইছিস? ঐ বাড়ি যাবি? তোর বউয়ের মনের আশা পূরণ করতে যাবি?”
“হ্যাঁ যাব। যাওয়াটা ভীষন জরুরী। এই ভাবে আর কত দিন মা? সম্পর্ক নষ্ট করার চেয়ে বরং সম্পর্কটাকে নতুন রূপে আবিষ্কার করাটাকেই শ্রেয় মনে করছি! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। রাগ, অভিমান পুষে রেখে আর লাভ কি বল? আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করব টয়ার বাবার রাগ ভাঙ্গানোর। সম্পর্কটা নতুনভাবে তৈরী করবার!”
“যা ইচ্ছে কর। আমি নাক গলাতে আসব না! তোর বউ, তোর শ্বশুড়, তোর শ্বশুড় বাড়ি! আমার কি? আমার কিছুই না!”
মা রাগে ফুসফুস করে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলেন। পরশ কাতর স্বরে মায়ের যাওয়ার পথে তাকিয়ে বললেন,,
“মা প্লিজ শোন। বিষয়টা বুঝার চেষ্টা কর! তোমরা সবাই অবুঝের মতো ব্যবহার করছ!”
“আমি কারো কোনো কথা শুনতে চাইছি না। তোর বউয়ের যেই ভাবে ভালো হবে তুই তাই কর!”
দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে পরশ কিঞ্চিৎ মুহূর্ত মৌন রইলেন। অতঃপর আমায় বসা থেকে দাঁড় করালেন। অতি যত্নে চোখের জল রাশি মুছে দিয়ে বললেন,,
“এমন ছিঁচকাদুনি মেয়ে মানুষ আমার মোটে ও পছন্দ না। কথায় কথায় এত কাঁদতে হবে কেন? কথায় কথায় মেয়ে মানুষরা হাসবে। হাসলে তাদের সুন্দর দেখায়। আর তুমি! তুমি কিনা ফ্যাস ফ্যাস করে কাঁদবে!”
বিষন্ন মনে ও আমার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠল। এক মুহূর্ত ও বিলম্ব না করে আমি পরশকে ঝাপটে ধরে বললাম,,
“ভালোবাসি আপনাকে। খুব খু্ব খুব বেশি ভালোবাসি।”
“ওহ্ শীট! কি করছ কি? মা হয়তো এক্ষনি রান্নাঘর থেকে খুন্তি নিয়ে আসছেন! রাতে রোমান্স করার সময় পাও না না? এই খানে এই জনসম্মুখে এসেছ রোমান্স করতে? বলেই দুজনকে খুন্তি দিয়ে দৌঁড়াতে আসছেন!”
ফটাফট আমি লোকটাকে ছেড়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে রান্নাঘরের দরজায় দৃষ্টিপাত করলাম! মায়ের ক্ষুদ্রতর অস্তিত্বের দেখা ও মিলছে না! তবে কি লোকটা ধপ মারল? চোয়াল শক্ত করে আমি অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম লোকটা আমার সম্মুখে নেই! তবে গেল কোথায় এই লোক? সিঁড়ির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই দেখলাম লোকটা কদাচিৎ হেসে বলছেন,,
“কাম ফার্স্ট! অলরেডি ১২ টা বাজতে চলল।”
চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে আমি লোকটাকে অনুসরন করলাম। খুশিতে মনটা কানায় কানায় পূর্ণ আমার! কতটা দিন পর আজ ঐ বাড়ি যাব! প্রিয় মানুষদের দেখব!
,
,
বাড়ির সীমানায় পা রাখতেই সদ্য লকলকিয়ে বেড়ে উঠা সেই সাত বছরের কিশোরী মেয়েটার পুরো বাড়ি চুষে বেড়ানোর প্রতিটা দৃশ্য সুস্পষ্ট ভাবে চোখের সামনে ভেসে উঠল। গত হয়ে যাওয়া স্মৃতি গুলোর কথা খুব মনে পড়ে গেল! বাড়ির উঠোন জুড়ে শিউলি ফুল বিছিয়ে আছে। অথচ একটা সময় প্রতি ভোরে নিয়ম করে শিউলির মালা গেঁথে কাজিনদের গলায় পড়িয়ে দিতাম। কখনো সখনো আবার মজার ছলে মা এবং বাবার গলায় শিউলির মালা পড়িয়ে বলতাম, আবার তোমাদের বিয়ে হলো মা! মা তখন খিলখিলিয়ে হেসে বলে উঠতেন,,
“পাগলী! আমরা তো মুসলিম! আমাদের আবার মালা বদলের মাধ্যমে বিয়ে হয় নাকি?”
অবুঝ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতাম তখন। মায়ের কথার ভাবার্থ বুঝতাম না! বাবা তখন গাল টেনে বলতেন,,
“আমার অবুঝ বাচ্চা! বাবা-মা কে আবার বিয়ে দিচ্ছে! খুব ভালোবাসি আমি আমার বাচ্চাটাকে! আমার বড় মেয়ের চেয়ে ও বেশি!”
অতীতের স্মৃতিরোমন্থন করতেই আঁখিপল্লব কানায় কানায় ভরে এলো। বাবার চোখে এখন আমি বিষের চেয়ে ও বিষাক্ত! অতি আদরের সেই বাচ্চা মেয়েটা আর নেই! বাড়ির পশ্চিম কর্ণারে অবস্থিত ছোট্ট দোলানাটা হালকা বাতাসে দোল খাচ্ছে! মনে হচ্ছে যেন সেই দোলনাটায় আমিই উন্মুক্ত চুলে দোল খাচ্ছি! ধুর! এই ফুলের গাছটাতে এখনো একটা ফুল ও আসে নি! বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে তো কত যত্ন করে রোজ স্প্রে করে ফুল গাছটার পরিচর্যা করেছিলাম! তবে কি আমার সব কষ্ট মাটি হয়ে গেলে? বাড়ির দেয়ালের রং টা ও কেমন যেন স্যাঁতস্যাঁতে লাগছে। বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে৷ বাবাকে অনেক আগেই বলেছিলাম, বাড়িটায় নতুন করে রং করাতে। কিন্তু বাবা আমার কথা শুনেন নি! মাত্র তো একমাস হলো বাড়ি ছেড়েছি! এই এক মাসে বাড়িটা এতো অগোছালো লাগছে? মনে হচ্ছে যেন দীর্ঘ অনেক গুলো বছর আমি এই বাড়ি থেকে দূরে ছিলাম! আমার যত্নের অভাবেই বোধ হয় বাড়িটা এতটা নির্জীব, অগোছালো হয়ে আছে!
পলকহীন দৃষ্টিতে পুরো বাড়িটা পর্যবেক্ষন করছিলাম। পরশ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। মেইন গেইটের খিলটায় হাত রেখে পরশ আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,
“কি হলো ম্যাম? এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন? ভেতরে যাবেন না?”
উদাসী চিত্তে আমি সামনে পিছনে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালাম! পরশ গেইট খুলে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই আমি অস্থির গলায় পরশকে ডেকে বললাম,,
“আমার ভয় লাগছে পরশ! বাবা আমাদের তাড়িয়ে দিবেন না তো?”
পরশ ঘাঁড় ঘুড়িয়ে আমার দিকে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর মলিন হেসে বললেন,,
“প্রয়োজনে বাবার পা চেঁপে ধরব! সম্মান গেলে আমার যাবে। বাবাকে উনার জেদের কাছে হার মানতেই হবে!”
“আপনার সম্মান যে আমার ও সম্মান পরশ। বাবা যদি সেই সম্মানের মর্যাদা না রাখেন?”
“অযথা ভয় পাচ্ছ তুমি। বাবাকে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। কথা হচ্ছে আমি কখন ও বাবার সাথে সম্মান দেখিয়ে কথা বলি নি! সবসময় উগ্র ভাষায় কথা বলেছি। বাবা হয়তো আমার কাছ থেকে একটু মার্জনীয় ভাষা আশা করছেন। আর যেটা আজ আমি বাবাকে অনুভব করাব। যথেষ্ট মার্জনীয় ভাষা এবং শ্রদ্ধার সহিত বাবার সাথে কথা বলব!”
স্বস্তির শ্বাস নির্গত করে আমি মনে এ ঝাঁক ভালো কিছুর প্রত্যাশা নিয়ে গেইটের ভেতর প্রবেশ করলাম। পরশের হাতে হাত ছোঁয়াতেই পরশ মৃদ্যু হেসে পাশ ফিরে আমার দিকে তাকালেন। সমভাবে উনি ও আমার হাতটা শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে ভরসাযোগ্য গলায় বললেন,,
“সাহস রাখ! এই পরশ তোমার পাশে থাকতে আদৌতে খারাপ কিছু হবে না। মেয়ে মানুষরা অল্পতেই সাহস এবং ধৈর্য্য হারিয়ে বসে। তাদের এই দিকটাই আমার পছন্দ না! কিন্তু দেখ? যা আমার পছন্দ না, তাই আমার ভাগ্যে এসে জুটল!”
“দয়া করে উস্কাবেন না আমায়! কথা বন্ধ করে সামনে হাঁটুন!”
পরশ ক্রুর হাসলেন। লোকটার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি সদর দরজার দিকে নজর দিলাম। ফুসফুসে দম সঞ্চার করে পরশ বাড়ির দরজার কলিং বেল বাজালেন। দু বার কলিং বেল বাজানোর পর দরজার খিল খুলে মিলি আপু হঠাৎ আমাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। আমাদের দেখা মাত্রই ধপ করে আপুর মুখ থেকে নারকেলের সন্দেশটা ফ্লোরে ছিটকে পড়ল। আঁখি জোড়া প্রকান্ড করে আপু কিয়ৎক্ষনের মধ্যে চেঁচিয়ে বললেন,,
“জেঠু দেখ! কে এসেছে! টয়া, পরশ এসেছে!”
অনতিবিলম্বে আমার হাওয়া ফুস হয়ে গেল! ভয়ে আঁতকে উঠে আমি পরশের বাহু চেঁপে ধরলাম। পরশ প্রথমে রাগী দৃষ্টিতে আপুর দিকে তাকালে ও পরক্ষনে রাগটা কিঞ্চিৎ আয়ত্তে এনে ঠোঁটের কোনে ম্লান হাসি ফুটিয়ে বললেন,,
“কথাটা একটু স্বাভাবিকভাবে ও বলতে পারতে! এত চেঁচানোর কি ছিল? শত্রু পক্ষ দেখলে ও তো মানুষ এভাবে চেঁচায় না!”
মিলি আপু হকচকিয়ে উঠে মুখভঙ্গি স্বাভাবিক করে আনতেই সদর দরজাটা সম্পূর্ণ খুলে গেল! বাবা কঠোর ভাবমূর্তি নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন আমাদের মুখোমুখি। বাবার পিছনেই বাড়ির সব সদস্যরা ভয়ার্ত রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের মধ্য থেকে মা হঠাৎ মিলি আপুকে উপেক্ষা করে এক ছুটে এসে আমাকে ঝাপটে ধরলেন। আর ফুঁফিয়ে কেঁদে বললেন,,
“কতদিন পর তোকে দেখলাম মা। আমার মনটা আজ শান্ত হলো। তোকে খুব মিস করেছি মা। কত রাত যে ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই!”
মুহূর্তের মধ্যেই বাবা ভয়াল থাবা দিয়ে মাকে আমার বুকের পাজর থেকে সরিয়ে নিলেন। পরশের দিকে ভয়ঙ্কর রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,
“তুই এখানে? কেন এসেছিস এখানে? তোর জায়গা আমার বাড়িতে নেই! এক্ষনি তোর বউকে নিয়ে এই বাড়ি ছাড়তে হবে তোকে!”
“বউ আমার হলে ও মেয়েটা কিন্তু আপনার! পৃথিবীর সব মেয়েদের কাছেই তাদের বাবারা আগে। এরপর সিরিয়ালে হয়তো আমার নামটা আসে। বাবা হওয়ার দায়িত্ব এত সহজে ভুলে গেলে চলবে? আপনার মেয়ে তো বাবা অন্তঃপ্রাণ! তাই তো আপনার মেয়েকে আপনার কাছে সারা জীবনের জন্য গচ্ছিত রেখে গেলাম! রেখে দিন আপনার মেয়েকে! যত দিন ইচ্ছে রেখে দিন। যদি কখন ও আপনার মনে হয় যে, আপনার মেয়ের ও তার স্বামী, সংসার প্রয়োজন। তাহলে আমাকে একবার খবর দিবেন। আমি পরিবার নিয়ে চলে আসব আপনার মেয়েকে স্ব-সম্মানে তার শ্বশুড় বাড়ি উঠিয়ে নিতে।”
উপস্থিত সবাই বাকরুদ্ধ। অবিশ্বাস্য দৃষ্টি আমার পরশের এক রোঁখা, দাম্ভিক দৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ! কি বলছেন এই লোক? আমাকে রেখে যাবেন মানে? এমন তো কথা ছিল না! লোকটা বলেছিলেন হাতে, পায়ে ধরে হলে ও আমার বাবাকে মানিয়ে নিবেন! তাহলে হঠাৎ আমাকে রেখে যাওয়ার প্রশ্নটা এলো কেন?
বাবা বোধ হয় অত্যন্ত খুশি হয়েছেন পরশের অযৌক্তিত প্রস্তাবে। কিয়ৎক্ষনের মধ্যে বাবা আমার ডান হাতটা চেঁপে ধরে বাবার বুকের পাজরে মিশিয়ে পরশের দিকে হেয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,
“কুর্নিশ জানালাম আমি তোমার সঠিক সিদ্ধান্তকে। আমার মেয়ে আজ থেকে আমার কাছেই থাকবে! ওর লাইফে বাবা হলেই চলবে! স্বামী, সংসারের কোনো প্রয়োজন নেই। আমার মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব একান্তই আমার! তার লাইফে তোমার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। এখন তুমি যেতে পার! আর কখন ও দেখা হবে না ভেবেই ভালো লাগছে!”
আমি নির্জীব রূপে বাবার বুকের পাজরে একাত্ন হয়ে মিশে আছি। চেতনা শক্তি বোধ হয় লুপ্তের পথে ঘনিয়ে এসেছে! পরশকে ঘোলাটে দৃষ্টিতে দেখে ক্ষনে ক্ষনে আমার বুকটা কেঁপে উঠছে। অনুভূতিরা যেনো জানান দিচ্ছে, পরশ বোধ হয় তোকে ঠঁকিয়েছে!
পরশ ক্রুর হাসলেন। কদাচিৎ হাসিতে মত্ত হয়ে প্রত্যত্তুরে বাবাকে বললেন,,
“চ্যালেন্জ্ঞ রইল! ঠিক ১ মাসের মাথায় যদি আপনি নিজে থেকে বাধ্য হয়ে আমায় এই বাড়িতে নিমন্ত্রণ না করেন তো আমি কথা দিচ্ছি সারাজীবনের জন্য আমার মেয়ের লাইফ থেকে এই পরশ নামটা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে!”
বাবা কথা বাড়াতে বোধ হয় চাইছিলেন না। তাই মুহূর্তের মধ্যে মুখমন্ডলে রুক্ষ ভাব ফুটিয়ে পরশের মুখের উপর ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন! সঙ্গে সঙ্গেই আমার আঁখিদ্বয় বুজে এলো! লুটিয়ে পড়লাম আমি বাবার বুকে। পরশ জেনে শুনে আমাকে এভাবে ঠকাবে বুঝতে পারি নি আমি! পরশ নিশ্চয়ই জানতেন, বাবা কখন ও নিজের দাম্ভিকতা ভুলে পরশকে সাদরে আমন্ত্রন করবেন না! সব জেনে শুনে ও পরশ আমায় ঠকালেন?
চলবে…?
#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_৩১
#নিশাত_জাহান_নিশি
বাবা কথা বাড়াতে চাইছিলেন না বোধ হয়। তাই মুহূর্তের মধ্যে মুখমন্ডলে রুক্ষ ভাব ফুটিয়ে পরশের মুখের উপর ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন! সঙ্গে সঙ্গেই আমার আঁখিদ্বয় বুজে এলো! লুটিয়ে পড়লাম আমি বাবার বুকে। পরশ জেনে শুনে আমাকে এভাবে ঠকাবে বুঝতে পারি নি আমি! পরশ নিশ্চয়ই জানতেন, বাবা কখন ও নিজের দাম্ভিকতা ভুলে পরশকে সাদরে আমন্ত্রন করবেন না! সব জেনে শুনে ও পরশ আমায় ঠকালেন?
,
,
মোটামুটি এক সপ্তাহ পাড় করে দিলাম! পরশ এবং আমার শ্বশুড় বাড়ির লোকজনদের সাথে কোনো রূপ যোগাযোগ ব্যতীত। পরিবারের প্রতিটা সদস্য আমায় এতটাই আদর, যত্নে, ভালোবাসায় মাতিয়ে রেখেছেন যে, সংসার জীবনের কথা অতোটা ও সাংঘাতিক ভাবে মনে পড়ছে না আমার! তবে পরশের নেওয়া অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত প্রতিনিয়ত আমায় ভীষণ ভাবে পোঁড়াচ্ছে! বাবার হাব-ভাব, কলা-কৌশল, গতিবিধি বা চিন্তা-ভাবনা দেখে মনে তো হচ্ছে না মাত্র এক মাসের মাথায় বাবা স্বয়ং পরশকে আমন্ত্রণ করবেন এই বাড়িতে বা সাথে করে আমায় শ্বশুড় বাড়িতে নিয়ে যেতে বলবেন! মনে মনে বোধ হয় ছক কষে রেখেছেন সারাজীবনের জন্য আমাকে এই বাড়িতেই বন্ধিনী হিসেবে রেখে দিবেন!
বাবা ভীষন খুশি আমায় পেয়ে। মনে হচ্ছে যেন সেই ছোটবেলার টয়া টিকে বাবা পুনরায় কাছে পেয়েছেন! সেই ছোট বেলার মতোন মুখে লোকমা তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন, সর্বক্ষণ আমায় আশে পাশে রাখছেন, আমার কথা মতো দেয়ালে রং করাচ্ছেন, প্রতিদিন ভোরে বাবা নিজ হাতে শিউলি ফুল কুঁড়িয়ে আমায় মালা গেঁথে দিচ্ছেন! বিকেল হতেই আমায় নিয়ে হাঁটতে বের হচ্ছেন। দোকান থেকে গাধা গাধা চকলেট, চিপস, আইসক্রীম, আঁচার কিনে দিচ্ছেন, দোলনায় আমায় নিয়ে দোল খাচ্ছেন, রাতে ঘুমানোর সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো! বাবা অতি ক্ষুদ্র কারনে ও আজকাল দাঁত কেলিয়ে হাসছেন। বরাবর মুগ্ধ হচ্ছি বাবার হুটহাট হাসিতে। চোখে আনন্দ অশ্রু বয়ে আনার জন্য বাবার এই অতি ক্ষুদ্র হাসিটাই যথেষ্ট। বাবার প্রতি দিন দিন খুব দুর্বল হয়ে পড়ছি। পিতার প্রতি গাঢ় টান অনুভব করছি। বাবার এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় কোনো ভনিতা বা ছলনার অবকাশ দেখছি না আমি। সম্পূর্ণ মন থেকেই বাবা আমায় ভালোবাসছেন। যতটা ছোট বেলায় বাসতেন।
আজ সকালেই বেঁধে গেছে এক হুলুস্থুল কান্ড! পিয়াস ভাই আমাদের পাড়ার এক ছেলেকে কেলিয়ে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে এসেছেন! এই বিষয়টা নিয়ে সমাজের লোকজন এসেছেন বাবার কাছে নালিশ জানাতে। মূল বিষয়টা ঘটেছিল মূলত মিলি আপুকে কেন্দ্র করে! আহত ছেলেটা মিলি আপুকে প্রায় অনেকদিন যাবত টিস করছিলেন। মাঝে মাঝে মিলি আপুকে অনুসরন করে বাড়ি অবধি চলে আসতেন! ঘটনাটা কোনো ভাবে একদিন পিয়াস ভাইয়ার নজরে পড়েছিল। আর সেই জের ধরেই আজ সময়, সুযোগ পেয়ে পিয়াস ভাই ঐ ছেলেকে রাম পিটুনি দিয়ে হসপিটালে ভর্তি করিয়ে এসেছেন। বিষয়টা জানার পর থেকেই মিলি আপু লুচির মতো ফুলছেন। পিয়াস ভাইকে সামনে পেলেই হয়তো আস্ত গিলে খাবেন! এই মহিলার হাব-ভাব বুঝি না আমি। পিয়াস ভাই তো তোর জন্যই গাঁ ভরাল, ঐ ছেলের সাথে লড়তে গেল, তোর সাথে বেয়াদবির শাস্তি দিল! কোথায় এসে তুই ভাইয়াকে একটু সাপোর্ট করবি তা না! তুই উল্টে ভাইয়ার উপর ফুলছিস? হাউ স্ট্রেন্ঞ্জ!
বিকেলের দিকে পিয়াস ভাইকে ডেকে এনে বাবা দু, এক কথা শুনিয়ে দিলেন। সাবধান করে দিলেন পরবর্তীতে যেন এই ভুলটা পুনরায় না ঘটে। পিয়াস ভাই নিশ্চুপ থেকে মাথা নুঁইয়ে শুধু সম্মতি জানিয়েছিলেন। মিলি আপুর রাগ যেন এতে ও দমছিল না। লুচির মতো কেবল ফুলছিলেন আর ফুলছিলেন! বাবার অনুরোধে পিয়াস ভাই আজ রাতটা আমাদের বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মিলি আপু সুযোগ খুঁজছিলেন কখন পিয়াস ভাইকে একান্ত ভাবে পাবেন আর সঙ্গে সঙ্গেই টুটি চেঁপে ধরবেন! এই মহিলার হিংস্রাত্নক হাব-ভাব দেখে ঠিক বুঝতে পারছি আমি!
রাত ঠিক ১১ টা বাজতেই আমি ঘুমুতে চলে এলাম নিজ কক্ষে। বাড়ির বাকিরা ও রাতের খাবার শেষ করে চলে গেলেন নিজেদের কক্ষে। বাবার সাথে কিছুক্ষন আড্ডা দিয়েই আমার এইমাত্র কক্ষে ফেরা। দরজায় খিল আটকে আমি ওয়াশরুমে গেলাম ফ্রেশ হতে। কিয়ৎক্ষনের মধ্যে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই মনে হলো দরজায় কেউ মন্থর গতিতে করাঘাত করছে। ভেজাক্ত মুখমন্ডল নিয়ে আমি তড়িঘড়ি করে রুমের দরজাটা আস্তে করে খুলে দিতেই তাজ্জব বনে গেলাম। ক্ষনিকের মধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল সবটাই আমার মাথার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলো। ব্ল্যাক হুডি পরিহিত অবস্থায় পরশ হালকা হাতে আমায় দরজার সম্মুখ থেকে সরিয়ে হুড়মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। ঝড়ের বেগে দরজার খিলটা আটকেই উনি পিছু ঘুড়ে আমায় ঝাপটে ধরলেন! নির্বাক, বিস্মিত, স্তব্ধিত আমি! শরীরের সমস্ত শক্তি আমার পরশের গাঁয়ের উপর সীমাবদ্ধ। উপরন্তু পনেরো মিনিট আমায় ঠিক এভাবেই ঝাপটে ধরে লোকটা হঠাৎ আদুরে গলায় বললেন,,
“খুব মিস করেছি খুব! বিয়ের পর বউ ছাড়া থাকা যায় নাকি?”
এখন ও নির্জীব আমি। বিশ্বাস ই হচ্ছে না মানুষটা এসেছে! আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে। আদুরে স্বরে আমার গলায় মুখ ডুবিয়ে কথা বলছে। তার গায়ের মাতাল করা গন্ধে আমার রন্ধ্রন শক্তিকে মাতিয়ে তুলছে। আমার অনুভূতিদ্বয়কে সন্তপর্ণে নেশাক্ত করে তুলছে! পিনপতন মৌনতা উপলব্ধি করা মাত্রই মানুষটা আমার গলায় আলতো চুমু খেয়ে বললেন,,
“কি হলো? আমি এসেছি, বিশ্বাস হচ্ছে না তাই তো?”
মৌনতা ভেঙ্গে আমি নির্লিপ্ত গলায় বললাম,,
“হবে কি করে? আপনি তো বলেছিলেন এক মাসের পূর্বে আপনি আসবেন না। যদি না বাবা নিজ থেকে আপনাকে আমন্ত্রণ জানান!”
“আমার বউটা হয়েছে চরম লেবেলের গাধী! ওটা তো আমি তোমার বাবাকে থ্রেড দিয়ে বলেছিলাম। দজ্জাল শ্বাশুড়ী হয় শুনেছি। তবে দজ্জাল শ্বশুড় ও যে হয় নিজের ব্যক্তিগত জীবনে না পেলে হয়তো জানতেই পারতাম না!”
“আমার বাবা আপনার কাছে দজ্জাল হলে ও আমার কাছে ভালো বাবা!”
“এক সপ্তাহে বাবার প্রতি খুব ভালোবাসা জন্মে গেছে না? দিব্যি আমার ভালোবাসা ভুলে গেছ?”
“আপনিই তো বাধ্য করেছেন! রেখে গেলেন কেন আমায় এই বাড়িতে? সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন না কেন আমায়? কথা তো ছিল দুজনেই মিলে বাবাকে মানাব। হাতে, পায়ে ধরে হলে ও বাবাকে মানাব। মাঝখান থেকে আপনি কি করলেন? সিদ্ধান্ত পাল্টে আমাকে একাই রেখে চলে গেলেন? আপনি জানেন? আপনি আমায় ঠকিয়েছেন!”
“ওটাকে ঠকানো বলে না রে গাধী। ওটাকে গেইম বলে। তুমি জাস্ট মিলিয়ে নাও, ঠিক এক মাস পর আমিই হব এই গেইমের উইনার! আর তোমার বাবা হবেন লুজার!”
“আচ্ছা! আপনার মাথায় কি ঘুড়ছে একটু বলবেন?”
লোকটা ক্রুর হেসে আমার ওষ্ঠদ্বয়ের দিকে এগিয়ে এসে বললেন,,
“বলব৷ আগে একটু আদর করে নেই!”
মুহূর্তের মধ্যে লোকটা আমায় পাজা কোলে তুলে নিলেন। রুমের লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। বিছানায় আমায় লম্ব করে শুইয়ে লোকটা হুডিটা গাঁ থেকে খুলে আমার গাঁয়ের উপর শায়িত হলেন। ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে লোকটা আমার শাড়ির আঁচলটা হালকা সরিয়ে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলেন। পরম আবেশে আঁখিদ্বয় বুজে আমি লোকটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলাম। ভালোবাসা গাঢ় হতে লাগল আমাদের। দুজনই যেন স্বর্গীয় সুখে পদার্পন করলাম!
মধ্যরাত প্রায় ২ টোর কাছাকাছি। দরজায় হঠাৎ কড়াঘাত পড়ল। দু, এক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে কেউ পর পর দরজায় টোকা মারছেন। সঙ্গে সঙ্গেই পরশ আমার ওষ্ঠদ্বয় ছেড়ে দরজার দিকে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। উনার সাথে সাথে আমি ও হকচকিয়ে উঠলাম। কিঞ্চিৎ মুহূর্তের মধ্যেই পরশ আমায় ছেড়ে হুডিটা গাঁয়ে জড়িয়ে নিলেন। তাড়াহুড়ো করে আমি শাড়িটা গাঁয়ে জড়াতেই মিলি আপুর গলার স্বর ভেসে এলো। মন্থর গলায় আপু আমায় ডেকে বলছেন,,
“এই টয়া, দরজাটা খোল!”
ইচ্ছাকৃত ভাবেই আমি ঘুম জড়ানো গলায় বললাম,,
“কেন আপু? কি হয়েছে?”
“আগে দরজাটা খোল। পরে বলছি কি হয়েছে!”
“আমি তো এখন ঘুমুচ্ছি আপু। কাল সকালে না হয় বলো!”
“ঘুমুলে কথা বলছিস কিভাবে? দরজাটা খুলতে বলছি, খোল!”
“তোমার ডাকাডাকিতেই তো আমার কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। তুমি প্লিজ এখন যাও আপু। কাল সকালে আমরা কথা বলছি।”
“তুই দরজাটা খুলবি কিনা বল? নতুবা আমি জেঠুকে ডাকতে বাধ্য হব!”
ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো আমার। শাড়িটা কোনো রকমে গাঁয়ে পেঁচিয়ে আমি পরশের মুখোমুখি দাঁড়াতেই পরশ হিংস্র রূপ ধারন করে দ্রুত পায়ে হেঁটে রুমের দরজাটা খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই মিলি আপু জেঠু বলে চিৎকার করে উঠতেই পরশ ঠাস করে আপুর গালে এক চড় বসিয়ে দিলেন! আপু গালে হাত দিয়ে টলমল দৃষ্টিতে পরশের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি নিজেই তাজ্জব দৃষ্টিতে পরশের দিকে চেয়ে আছি। দাঁতে দাঁত চেঁপে পরশ আপুর উদ্দেশ্যে বললেন,,
“তোমার মতো নির্লজ্জ এবং বেহায়া প্রকৃতির মেয়ে মানুষ পৃথিবীতে আমি দুটো দেখি নি। এত বেহায়া ধাঁচের কেন তুমি? বিয়ের আগে ও যেমন আমার পিছনে লেগেছিলে, এখন ও ঠিক আগের মতোই লেগে আছ! কিন্তু কেন একটু বলবে? আমার তো এখন বিয়ে হয়ে গেছে তাই না? তোমার আপন চাচাতো বোন এখন আমার ওয়াইফ! আমরা দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, আগের চেয়ে ও আমাদের মধ্যকার ভালোবাসা দ্বিগুন বাড়ছে। ভবিষ্যতে এর মাত্রা আর ও অধিক হারে বাড়বে৷ তুমি কি ভেবেছ, তুমি এবং তোমার জেঠু মিলে আমাদের আলাদা করতে পারবে? কখনো না! পৃথিবীতে কারো সাধ্য নেই আমাদের আলাদা করার। তোমার কখন ও মন চায় না না? পিয়াসের নিঃস্বার্থ ভালোবাসাটাকে একটু বুঝতে? ছেলেটা তুমি তুমি করে জাস্ট মরে যাচ্ছে। যত বার তুমি তার ভালোবাসা প্রত্যাখান করছ তত বার সে দ্বিগুন ভাবে তোমায় ভালোবেসে যাচ্ছে! আচ্ছা? তোমার কখন ও ইচ্ছে জাগে না? এসব কুটিলতা বাদ দিয়ে সুন্দর একটা ভালোবাসায় মোড়ানো বিবাহিত জীবন কাটাতে? কারো ভালোবাসায় গাঁ ভাসিয়ে দিতে? নিজের একটা সাজানো সংসার তৈরী করতে? কেমন মেয়ে মানুষ তুমি? যে মেয়ে মানুষের জীবনে কোনো ভালোবাসা নেই, কোনো ইচ্ছে নেই, কোনো চাহিদা নেই, ভালোবেসে কাউকে আপন করে নেওয়ার মন মানসিকতা নেই! পিয়াস কি তোমায় ভালোবেসে এতটাই অন্যায় করেছে যে তুমি তাকে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত মরণ যন্ত্রনা দিবে? তোমাকে ভালোবাসা কি এতটাই পাপ?”
মিলি আপু ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠতেই পাশের রুম থেকে পিয়াস ভাই বেরিয়ে এলেন। মিলি আপুর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মাথা নুঁইয়ে পরশকে বললেন,,
“মিলিকে আর কিছু বলো না পরশ! শুনতে খারাপ লাগে আমার। তোমাদের চোখে মিলি হাজার খারাপ হলে ও, আমার চোখে সে আমৃত্যু পৃথিবীর সব’চে ভালো মেয়ে মানুষ হয়েই থাকবে। আমি আজীবন ওর পিছনে ঘুড়তে রাজি। যতবার সে আমায় ফিরিয়ে দিবে, আমি ঠিক ততবারই তার কাছে ফিরে যাব! ভালোবাসায় বেহায়া হতে হয়। এতটুকুই আমি বুঝতে পেরেছি তাকে ভালোবেসে!”
মিলি আপু হেচকি তুলে কেঁদে হঠাৎ পিয়াস ভাইয়ার বুকের পাজরে মাথা ঠেঁকিয়ে দিলেন! পিয়াস ভাইয়ার শার্ট দ্বারা নাক মুছে ছলছল দৃষ্টিতে পিয়াস ভাইয়ার বিস্মিত দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,
“আজীবন বেহায়া থাকতে হবে আপনাকে। নয়তো আপনার গলা কেটে নিব।”
ছুটে পালালেন আপু! উপস্থিত সবাই তাজ্জব দৃষ্টিতে মিলি আপুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছি। কিয়ৎক্ষনের মধ্যে পরশ বাঁকা হেসে পিয়াস ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে বললেন,,
“ডোজ কাজে দিয়েছে তবে!”
পিয়াস ভাইয়া লজ্জা মিশ্রিত হাসিতে মাথা নুঁইয়ে নিলেন। পিছনের চুল গুলো কিঞ্চিৎ টেনে বললেন,,
“সবই তোমার অবদান! তোমার কয়েকটা খড়তড় কথার কারনেই প্রেয়সীর মন গলল!”
আমরা সবাই উচ্চ শব্দে হেসে উঠলাম। মিলি আপুর আকস্মিক পরিবর্তনে আমরা সবাই আনন্দে আপ্লুত প্রায়!
,
,
পরশের চ্যালেন্জ্ঞ নেওয়ার ১ মাসের মধ্যে ঠিক বিশ দিনের মাথায় আমার হঠাৎ পিরিয়ড সাইকেল বন্ধ হয়ে গেল! কিছুদিন যাবত আমি শরীরে ঠিকঠাক তাল খুঁজে পাচ্ছি না। খাওয়া, দাওয়া, চলাফেরায় সবকিছুতেই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে মাথা ঘুড়ানো আর বমি ভাবটা ভয়ঙ্কর পর্যায়ে আছে। এই তো আজ সকালেই শ্বাশুড়ী মায়ের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই হঠাৎ মাথা ঘুড়ে এলো আমার। ভাগ্যিস বিছানাতেই মাথা ঘুড়িয়ে পড়েছিলাম, নয়তো ফ্লোরে ছিটকে পড়লে সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটে যেত। আমার মা বিষয়টা জানার পর থেকেই ভীষন টেনশানে আছেন। ভাবছেন আমার হয়তো কোনো অসুখ করেছে। কিন্তু যখন বললাম আমার পিরিয়ড সাইকেল ও বন্ধ হয়ে আছে তখনই মা ফার্মেসী থেকে প্রেগনেন্সি কিট এনে বললেন পরীক্ষা করে দেখতে। পরদিন সকালে পরীক্ষা করতেই ফলাফল পজেটিভ এলো! বাকরুদ্ধ হয়ে আমি দীর্ঘ ১৫ মিনিট বিছানার উপর বসে ছিলাম। নেত্রযুগল থেকে অজান্তেই খুশির অশ্রু বাহিত হচ্ছিল। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করব! খবরটা কি প্রথমেই বাবা-মাকে জানাব? নাকি পরশকে একবার কল করব? দোটানায় ভুগে একই জায়গায় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতেই হঠাৎ মিলি আপু দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করলেন। ব্লু কালার একটা ড্রেস হাতে নিয়ে আপু মৃদ্যু হেসে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,
“ড্রেসটা কেমন টয়া? সুন্দর না?”
নিবার্ক চিত্তে আমি সামনে পিছনে মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালাম। আপু ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ড্রেসটা ট্রায়াল দিচ্ছেন আর বলছেন,,
“পিয়াস গিফট করেছে! একটু পরেই ওর সাথে ঘুড়তে বের হব!”
আমার মৌনতা দেখে আপু পিছু ঘুড়ে তাকালেন। অতঃপর কপালে কয়েক জোড়া উদ্বিগ্নতার ভাঁজ ফুটিয়ে বললেন,,
“কি করে? কি হয়েছে তোর? এই ভাবে চুপচাপ বসে আছিস কেন?”
হাতে থাকা কিটটা আমি আপুর সম্মুখে ধরে বললাম,,
“পজেটিভ!”
সঙ্গে সঙ্গেই আপু উচ্চ আওয়াজে হেসে আমায় ঝাপটে ধরে বললেন,,
“কংগ্রাচুলেশন বনু! উফফফস দাঁড়া। খবরটা আমি বাড়ির সবাইকে দিয়ে আসছি!”
আপু প্রানপনে ছুটে গেলেন নিচ তলার দিকে। আমি বালিশের তলা থেকে ফোনটা বের করে পরশের নাম্বারে ডায়াল করলাম। সঙ্গে সঙ্গেই লোকটা কলটা রিসিভ করে ব্যতিব্যস্ত গলায় বললেন,,
“অফিসে আছি টয়া। খুব ব্যস্ত এখন। একটু পর কল ব্যাক করছি। আর হ্যাঁ প্লিজ রাগ কর না। জাস্ট ফাইভ মিনিটস ওকে? ফাইভ মিনিটসের মধ্যেই কল ব্যাক করছি!”
নির্বিকার নির্লিপ্ত গলায় আমি প্রত্যত্তুরে লোকটাকে বললাম,,
“উপপপস বাবা হতে চলেছেন আপনি! এত ব্যস্ততা দেখালে চলবে?”
#চলবে…?