#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_২৬
#নিশাত_জাহান_নিশি
“আসছি আমি। সৌরভের সাথে কথা বলেই তবে বাড়ি ফিরব। নিজের যত্ন নিও। আর মা, পিয়ালী, পায়েল সবার খেয়াল রেখো। কিছু না বুঝলে মা কে অবশ্যই ডেকে দিও।”
পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠে আমি আবদারের স্বরে লোকটাকে বললাম,,
“সাবধানে যাবেন পরশ। আর হ্যাঁ, দুপুরের লাঞ্চটা কিন্তু একসাথেই করব।”
ক্ষনিকের মধ্যে লোকটা চৌকাঠের ওপার থেকে ফিরে এসে ঝড়ের বেগে আমায় আলিঙ্গন করে ঘাড়ে দীর্ঘ এক চুমু খেয়ে বললেন,,
“উঁহু। না খেয়ে অপেক্ষা করতে হবে না আমার জন্য। আর কাজ শেষ হলেই আমি বাড়ি ফিরব। আবদারটা রাখতে পারি নি বলে কষ্ট পেও না ওকে?”
দাঁতে দাঁত চেঁপে আমি বাম হাতের কনুই দিয়ে লোকটার বুকের পাজর মাঝে সজোরে এক খোঁচা মেরে বললাম,,
“যাত্রা পথ থেকে ফিরে এলেন কেন? আমি বলেছিলাম ফিরে আসতে?”
লোকটা আমায় ছেড়ে বুকে হাত রেখে মুখটা কাঁচুমাচু করে বললেন,,
“তুমি ও দেখছি এসব যাত্রা পথ মানতে আরম্ভ করে দিয়েছ। একদম মায়ের মতো। মানে সংসার জীবনে ঢুকতে না ঢুকতেই প্রাচীন যুগের বউদের মতো প্রাচীন চিন্তাভাবনায় প্রভাবিত হতে শুরু করেছ?”
“শুনুন? এসব মুরুব্বিদের মনের বিশ্বাস। তাদের বিশ্বাস বোধ থেকেই যুগের পর যুগ এই প্রথা গুলো চলে আসছে। আর ভবিষ্যতে ও চলবে। মানতে প্রবলেম কি হুম? ক্ষতি তো হচ্ছে না তাই না? উল্টে না মানলেই আমি দেখছি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তাই আমাদের উচিত তাদের বিশ্বাস বোধকে যথেষ্ট সম্মান করা।”
পরশ শার্টের কলারটা ঠিক করে গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে বললেন,,
“হয়েছে হয়েছে। আর শুনতে চাইছি না এসব নীতিকথা। আসছি আমি। নিজের যত্ন নিও।”
পরশ মৃদ্যু হেসে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। লোকটার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আমি মলিন হেসে বললাম,,
“আপনাকে ছাড়তে মোটে ও মন সায় দিচ্ছিল না পরশ। বিয়ের পর দিনই আপনাকে বাড়ি থেকে বের হতে হলো!”
দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে আমি রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হলাম। রান্নাঘরের চৌকাঠে পা রাখতেই দেখলাম শ্বাশুড়ী মা হাঁড়ি, পাতিল মাজছেন! জিভ কেটে আমি দৌঁড়ে মায়ের হাত থেকে পাতিলটা ছিনিয়ে নিয়ে অর্নগল গলায় বললাম,,
“এসব আপনি কি করছেন মা? আমি আসছিলাম তো। আমিই তো হাঁড়ি পাতিল গুলো মাজতাম।”
মা রগচটা ভাব নিয়ে আমার হাত থেকে পাতিলটা কেড়ে নিয়ে বললেন,,
“তোমার এসব কালির কাজ করতে হবে না। কয়েকদিন যাবত গ্যাস থেকে কালি উঠছে। পাতিলের তলা কালিতে ভরে যাচ্ছে। এই কালিতে হাত কালো হয়ে যাবে তোমার। পরে তো নিশ্চয়ই বদনামটা আমারই হবে! যে শ্বাশুড়ী মা কালির কাজ করাতে করাতে বউয়ের হাত কালো করে ফেলেছে! বাইরের কেউ না, আমার নিজের ছেলেই এসে আমার বদনাম করবে!”
“আপনি ভুল ভাবছেন মা। কেউ কিছু বলবে না। আপনার ছেলে তো মোটে ও না। উনি উল্টো খুশি হবেন, আপনার হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিলে। দিন পাতিলটা আমাকে। আমি করে নিচ্ছি এসব।”
“তুমি অন্য কাজ কর। ফ্রিজ থেকে মাছ, মাংস বের করে ভিজিয়ে দাও। পিয়ালীর জন্য চিংড়ি মাছের মালাইকারি করব। মেয়েটা এমনিতেই অসুস্থ। তার উপর আজ মেরেছি, বকেছি। ভেতরটা অশান্তি লাগছে আমার। তাই মেয়েটার পছন্দের খাবারই আজ রান্না করব। আর পরশের জন্য মুরগির মাংস ঝাল করে রান্না করতে হবে। ছেলেটা আমার এই কয়েকদিনের ধকলে একদম শুকিয়ে গেছে। ভালো করে খাওয়াতে হবে ছেলেটাকে। আর শুনো? তোমার তো শিং মাছের ঝোল খুব পছন্দ না? আমি বাজার থেকে নিয়ে আসছি শিং মাছ। আপাতত তুমি ঝাল করে মুরগিটা রান্না কর। আমি বাজার থেকে ফিরে এসে চিংড়ি মাছ আর শিং মাছটা রান্না করব!”
বিস্মিত আমি! মা আমার পছন্দের খাবারের কথাটা ও মাথায় রেখেছেন? মানতে ভীষন কষ্ট হলে ও ঠিক তাই হয়েছে! তবে এতো এতো আইটেম রান্না করাটা আমার পছন্দ না। তার উপর মা বলছেন বাজারে যাবেন! খুবই দৃষ্টিকটু! আমি অন্তত চাই না আমার পছন্দকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে মা রোদে, ঘেমে, পরিশ্রম করে বাজারে যাক। গলা খাঁকিয়ে আমি নিম্ন গলায় মাকে বললাম,,
“মা আজ থাক না। আপনাকে কষ্ট করে বাজারে যেতে হবে না। পরশ যেদিন বাজার যাবেন ঐ দিন না হয় শিং মাছটা আনিয়ে নিবেন। আজ প্লিজ থাক মা। এমনিতেই আজ অনেক পদ রান্না হচ্ছে। অযথা এতো রান্না করে কি লাভ বলুন? আমরা আর কতটুকুই বা খাব?”
“উঁহু। পরে তো বলবে, শ্বাশুড়ী শুধু নিজের ছেলে এবং মেয়েদের খাবার দাবারের খেয়াল রাখেন। আমি ছেলের বউ বলে আমার দিকটা খেয়ালই রাখেন না। আমি এতো সমালোচনার মুখে পড়তে চাই না বুঝেছ? তাছাড়া, শ্বাশুড়ীদের তো এমনিতে ও দোষের শেষ নেই!”
ফিক করে হেসে দিলাম আমি। মা ভ্রু যুগল কুঁচকে আমার দিকে খড়তড় দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি হাসি চেঁপে রেখে বললাম,,
“খল শ্বাশুড়ীর অভিনয়টা আপনাকে ঠিক মানায় না মা। আপনার অভিনয়ে আমার হাসি পায়, কান্না পায় না!”
বিকট শব্দে পাতিলটা বেসিনের উপর রেখে মা ময়লা হাতটা ভালো করে ধুঁয়ে রাগে গজগজ করে রান্নাঘর থেকে প্রস্থান নিচ্ছেন আর বলছেন,,
“বাজারে যাচ্ছি আমি। বেশিক্ষন লাগবে না ফিরতে। মসলা ব্ল্যান্ড করা আছে। ফ্রিজ থেকে নামিয়ে নাও। ফিরে এসে যেন দেখি আমার ছেলের মুরগির মাংসটা রান্না হয়ে গেছে!”
মায়ের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আমি মিটিমিটি হেসে বললাম,,
“আপনি খুব বোকা মা। যতই খারাপ শ্বাশুড়ী মা সাজার অভিনয় করুন না কেন আপনার ভালো দিকটাই বার বার প্রকাশিত হচ্ছে! আমি ঠিক বুঝতে পারছি মা, আপনি যা করছেন সাময়িক রাগ বোধ থেকে করছেন। মন থেকে একটা কাজ ও করছেন না।”
ফ্রিজ থেকে মাছ, মাংস বের করে আমি ভিজিয়ে দিলাম। মসলার বক্সটা বের করে শুকনো জায়গায় রাখলাম। দুটো হাড়ি এখন ও ঘঁষার বাকি আছে। হাত লাগিয়ে আমি হাড়ি গুলো ঘঁষতে আরম্ভ করলাম। হাঁড়ি গুলো ঘঁষা শেষে আলু কাটতে কাটতেই আই থিংক মাছ এবং মাংসের বরফটা গলে যাবে। মসলাটা ও নরমাল হয়ে আসবে।
,
,
ঘন্টা খানিক বাদে। মুরগির মাংস রান্নাটা প্রায় শেষের দিতে এগুতেই হঠাৎ পেছন থেকে পায়েল ব্যস্ত গলায় আমায় ডেকে উঠল। পিছু ফিরে তাকাতেই দেখলাম পায়েল ফোনে স্ক্রলিং করছে আর আমায় শুধিয়ে বলছে,,
“ভাবী? মা কোথায়?”
“মা তো বাজারে গেছেন পায়েল। কেন? কিছু লাগবে তোমার?”
“না ভাবী, এমনি।”
উদ্বিগ্ন গলায় আমি বললাম,,
“আচ্ছা। পিয়ালী আপু কি করছেন এখন? সুস্থ তো কিছুটা? দেখ না, আমি তো রান্নার কাজ ছেড়ে যেতেই পারছি না আপুকে দেখতে।”
পায়েল হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে ফোনটা চোখের সম্মুখ থেকে সরিয়ে নির্বোধ হেসে বলল,,
“ভাবী? তোমার সাথে না আমার জরুরী একটা দরকার ছিল!”
প্রশ্নবিদ্ধ গলায় বললাম,,
“কি দরকার পায়েল?”
“হিমেশ ভাইয়ার ফোন নাম্বারটা হবে?”
ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে আমি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে বললাম,,
“কেনো বল তো? কি এমন বিশেষ দরকার আছে হুম?”
পায়েল মাথা নুঁইয়ে লজ্জামিশ্রিত হাসি দিয়ে বলল,,
“তেমন বিশেষ কোনো দরকার না। এমনিতেই চাইলাম!”
ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করলাম মা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে রান্নাঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়ালেন। কপালে উদয়স্ত বিন্দু বিন্দু ঘাম রেখা মুছে মা অগ্রে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হঠাৎ প্রকান্ড চোখে দৌঁড়ে এসে আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি তাজ্জব দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাতেই মা এক টানে আমার গাঁ থেকে শাড়িটা খুলে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারলেন। অমনি দেখতে পেলাম আমার শাড়ির আঁচলটায় সামান্য আগুন লেগে আছে! ধীর গতিতে আগুনটা পুরো শাড়িতে ছড়িয়ে পড়ছে। মুখে হাত চেঁপে আমি ঘর্মাক্ত শরীরে সাংঘাতিক ভয় নিয়ে চেতনা শক্তি হারানোর পূর্বেই মা আমায় শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলেন। পায়েল বেকুব ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ভয়ে অনবরত কেঁপে কেঁপে উঠছে। মা দাঁতে দাঁত চেঁপে পায়েলকে বললেন,,
“কি করছিলি তুই এখানে? টয়া না হয় পিছন ঘুড়ে ছিল বলে আন্দাজ করতে পারে নি শাড়ির আঁচলে আগুনের আঁচ লেগেছে। তোর দৃষ্টি তো টয়ার দিকেই ছিল তাই না? দেখতে পাস নি তুই? মেয়েটার শাড়ির আঁচলে আগুনের তাপ লেগেছে? পোঁড়া পোঁড়া গন্ধ ও পাস নি?”
পায়েল প্রত্যত্তুরে শুকনো গলায় বলল,,
“বিশ্বাস কর মা। আমি একটু ও খেয়াল করি নি। কথার মধ্যে ডুবে ছিলাম প্রায়! শাড়িটায় যে ঐ পাশ দিয়ে আগুন লেগেছে বুঝতে পারি নি আমি।”
ভয়ে জানটা বের হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে আমার। কন্ঠনালিতে শব্দরা দলা পেকে আছে। ধীর গতিতে আমি মাকে ঝাপটে ধরে কম্পিত গলায় বললাম,,
“মামামা। পাপাপানি খাব।”
মা ব্যতিব্যস্ত গলায় পায়েলকে বললেন,,
“দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস এখানে? পানির গ্লাসটা এগিয়ে দে মেয়েটাকে।”
ধ্যান ভেঙ্গে পায়েল গ্লাস ভর্তি পানি এনে আমার মুখের কাছে ধরতেই আমি গড়গড় করে পুরোটা পানি শেষ করে মায়ের কাঁধে মাথা ঠেঁকিয়ে দিলাম। ঐদিকে পায়েল ব্যস্ত শাড়ির আগুনটা নিভাতে। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে নমনীয় গলায় বললেন,,
“আজ বিকেলে আমার সাথে শপিং এ যাবে। সালোয়ার স্যুট পড়বে এইবার থেকে। শাড়ি কাপড় অনেকেই সামলাতে পারে না। কি দরকার এত রিস্ক নিয়ে শাড়ি কাপড় পড়ার?”
মাথা নাঁড়িয়ে আমি সম্মতি প্রকাশ করতেই মা পায়েলকে ডেকে বললেন,,
“টয়াকে রুমে নিয়ে যা। আর শুন? আসার সময় পাশের বাড়ির রহিমাকে ডেকে দিস তো। মাছ গুলো কেটে দিলেই আমি রান্না বসাব।”
পায়েল তার বুকের ওড়নাটা আমার অর্ধনগ্ন শরীরে জড়িয়ে দিল। আমায় রুমে রেখে পায়েল পাশের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল। ভয়ে এখন ও আমার শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে। নিশ্বাস নির্গত করার বেগটা ও কুলাতে পারছি না। কেন জানি না আম্মুর কথা ভীষণ মনে পড়ছে! রান্না ঘরে কখন ও রান্নার কাজে যেতে হয় নি আমায়। সবসময় আম্মু, চাচীমনিরাই সব দিক সামলে নিয়েছিলেন। আমি এমনিতে ও অনেকটা বেপরোয়া স্বভাবের। হিতাহিত জ্ঞান খুব অল্প আমার মধ্যে। ধীরে, সুস্থে, গুছিয়ে কাজ করতে পারি না আমি। এর জন্য অনেক বকুনি শুনেছি আম্মুর কাছ থেকে। কতদিন হলো আম্মুর সাথে কথা হয় না, দেখা হয় না, আম্মুর কোলে মাথা রেখে কোন আবদার করা হয় না। পরিবারের সবাইকে ভীষণ মিস করছি। বাবার কথা ও খুব মনে পড়ছে। ইচ্ছে করছে এক ছুটে মা-বাবার কাছে ফিরে যাই। চাচা, চাচীমনি, চাচাতো বোনদের কাছে ফিরে যাই! তবে এসবের মাঝে একটা প্রশ্ন রয়েই যায়! মা-বাবা, বাড়ির বাকি সদস্যরা কি আদৌ আমায় মিস করছেন? আমার কথা মনে করে চোখের জল ফেলছেন?
এসব ভাবতে ভাবতেই জানি না কখন আমি ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলাম। শরীরের জোর খুঁইয়ে আসতেই নিস্তেজ শরীর নিয়ে আমি বিছানায় গাঁ এলিয়ে দিলাম। অর্ধ নগ্ন শরীরেই ঘুমিয়ে পড়েছি। গাঁয়ে কিছু জড়ানোর বোধটা ও মাথায় কুলায় নি!
,
,
মস্তিষ্কে কারো হাঁটার প্রকট শব্দ সক্রিয় হতেই আমি ফটাফট আঁখিযুগল খুলে ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসলাম। আশেপাশে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কাউকে অবলোকন করতে না পেরে আমি ব্যালকনীর দিকে দৃষ্টিকোণ করতেই দেখলাম দুপুরের কড়া রোদে পরশের অস্থির মুখখানায় নিদারুন দুশ্চিতার ভাব। জ্বলন্ত সিগারেটে ফুঁক দিয়ে লোকটা ব্যালকনী জুড়ে পায়চারী করছেন। কপাল কুঁচকে দেয়াল ঘড়িটার দিকে দৃষ্টি স্থির করতেই দেখলাম দুপুর ২ টা বাজছে ঘড়িতে। হুড়মুড়িয়ে বসা থেকে উঠতেই লক্ষ্য করলাম আমার অর্ধনগ্ন শরীরটা এখন মায়ের জামদানী কাপড়ে আবৃত। বুঝতে আর বিলম্ব হলো না, মা এসেছিলেন আমার রুমে! হয়তো আমার খোঁজ নিতে, আমাকে দেখতে। ঐ অবস্থায় আমাকে দেখেই হয়ত মা শাড়িটা শরীরে জড়িয়ে দিয়ে গেছেন! ঠোঁটের আলিজে ম্লান হাসি ফুটিয়ে আমি ব্যালকনীর দিকে কদম বাড়িয়ে অস্ফুটে স্বরে পরশকে পেছন থেকে ডেকে বললাম,
“পরশ?
পরশ প্রত্যত্তুরে নিম্ন গলায় বললেন,,
“হুম।”
“কখন এলেন আপনি? কোনো সাড়া শব্দ পেলাম না যে।”
পরশ সিগারেটটায় লাস্ট ফুঁক দিয়ে শার্টের প্রথম বাটনটা খুলে ম্লান গলায় বললেন,,
“এই তো কিছুক্ষন হলো। তুমি ঘুমুচ্ছিলে তাই ডেকে দেই নি।”
“বাহ্! আজ এত ভালো বর হয়ে গেলেন! হয়েছে টা কি?”
পরশ নিরুত্তর। দেখেই বুঝা যাচ্ছে মনে মনে লোকটা কোনো অভিসন্ধিতে ব্যস্ত। লোকটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি চিন্তিত গলায় লোকটাকে শুধিয়ে বললাম,,
“আপনাকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন পরশ? কিছু হয়েছে?”
আকস্মিকভাবে পরশ আমার চুলের ভাঁজে মুখ ডুবিয়ে আদুরে গলায় বললেন,,
“কোথায় আমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে হুম? আমার বউটা দেখছি ইদানিং একটু বেশিই বুঝছে আমাকে!”
“বেশিই তো বুঝব। আমি আপনাকে বেশি বুঝব না তো কে বুঝবে হুম? তাছাড়া আপনি অফিসের পোশাক না ছেড়েই সিগারেট ফুঁকতে শুরু করে দিয়েছেন না? মানে, সিগারেটের নেশা এতই গাঢ় আপনার?”
হাত থেকে সিগারেটটা ব্যালকনীর গ্রীল দিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করে পরশ আমার ঘাড় থেকে মুখ উঠিয়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন,,
“আচ্ছা? পিয়ালীর সাথে হিমেশকে ঠিক কতটা মানাবে?”
#চলবে….?
#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_২৭
#নিশাত_জাহান_নিশি
“আচ্ছা? পিয়ালীর সাথে হিমেশকে ঠিক কতটা মানাবে?”
হতভম্ব আমি! নিশ্চুপ, নিস্তব্ধ, নিভৃত। বিস্ফোরক দৃষ্টিতে পরশের সরল রৈখিক দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আমি জিগ্যাসু গলায় বললাম,,
“মানে?”
ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে পরশ আমার দিকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,
“এত আশ্চর্যিত হওয়ার কি আছে? আমি জাস্ট জানতে চাইছি হিমেশের সাথে পিয়ালীকে ঠিক কতটা মানাবে?”
“আপুর বিয়েটা ঠিক হয়েছে সৌরভ ভাইয়ার সাথে। মাঝখান থেকে আপনি আকস্মিক ভাবে হিমেশ ভাইকে টেনে আনছেন! বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবেই আশ্চর্যিক বিষয়!”
কিয়ৎক্ষন মৌণ রইলেন পরশ। কোনো রূপ অনুচিত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না। পরক্ষনে আচম্বিতে পরশ মুখমন্ডলে রুক্ষ ছাপ ফুটিয়ে বললেন,,
“একটা অমানুষের হাতে আমরা কিছুতেই পিয়ালীকে তুলে দিতে পারি না! পিয়ালী নিশ্চিতভাবে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। যে পিয়ালীকে ভালোবেসে আগলে রাখবে, স্ত্রী হিসেবে যথেষ্ট সম্মান করবে, তার পরিবারের কোনো খুঁত নিয়ে পড়ে থাকবে না, অথবা হুট করেই নিজেদের মধ্যকার কোনো মনোমালিন্যের কারনে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিবে না। তার সমস্ত প্রত্যাশা শুধু পিয়ালীকে ঘিরেই থাকবে। পিয়ালীর বাইরে সে অন্য কোনো দিককে প্রায়োরিটি দিবে না।”
শুকনো মুখে আমি পরশের রাগান্বিত মুখটায় দৃষ্টি মিলালাম। ভয়ঙ্কর রেগে গেছেন লোকটা। মুখমন্ডলে তা গাঢ়ভাবে স্পষ্ট। তবে কি সৌরভ ভাই প্রত্যাখান করেছেন বিয়েটা? পরশকে অপ্রত্যাশিতভাবেই ফিরিয়ে দিয়েছেন? আপুর বিস্তর ভালোবাসাকে অস্বীকার করেছেন? কিন্তু কেন? সবটাই কি পরশ এবং আমার করা ভুল কর্মকান্ডের জন্য? নাকি এর পিছনে ও বিশেষ কোনো কারন লুকায়িত আছে? সৌরভ ভাই যদি সত্যিই মন থেকে আপুকে ভালোবেসে থাকতেন তাহলে অবশ্যই আপুর পারিবারিক খুঁত নিয়ে বিন্দু পরিমান ভাবান্তর করতেন না। বিষয়টা সরল, সহজ এবং স্বাভাবিকভাবেই নিতেন। অথবা পরিবারকে এই বিষয়ে অল্প বিস্তর হলে ও বুঝানোর চেষ্টা করতেন! জোরপূর্বক হলে ও মানিয়ে নিতেন পরিবারকে। সৌরভ ভাই চরিত্রটা খুব মিস্ট্রিয়াস আমার কাছে। চরিত্রটাকে বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।
শুকনো ঢোক গলাধঃকরন করে আমি পরশকে শুধিয়ে বললাম,,
“সৌরভ ভাই কি সত্যিই বিয়েটা প্রত্যাখান করেছেন?”
ইন করা শার্টটা পরশ এক টানে প্যান্টের ভেতর থেকে খুলে দাঁতে দাঁত চেঁপে বললেন,,
“ইচ্ছে করছিল না? ঐ ব্লাডিটাকে ওখানেই পুঁতে রেখে আসি। এই কেমন ভালোবাসা তার? যে ভালোবাসায়, ভালোবাসার মানুষটার চেয়ে পরিবারিক কুটিলতা অধিক প্রাধান্য পায়? চাইলে তো জাস্ট একবার ট্রাই করতে পারতি, পরিবারকে মানানোর! কিন্তু না, সে তো পরিবারের করা অন্যায় আবদারটাকেই অতি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে। পরিবারকে অল্প বিস্তর বুঝানোর ও চেষ্টা করল না। একটা মেয়ের সাথে এনগেজড হওয়ার পর, তার সাথে বিগত অনেক গুলো দিন টাচে থাকার পর, মেয়েটার মনে অসীম অনুভূতি তৈরী করার পর, তার মধ্যে মেয়েটার প্রতি কি বিন্দু পরিমান ভালোবাসা বা সহানুভূতি ও জন্মায় নি? আমি রীতিমতো অবাক তার কর্মকান্ডে। এই অবিবেচক, স্বার্থবাজ ছেলে কিছুতেই আমার বোনের হাজবেন্ড হতে পারে না। আমার বোনের সীমাহীন ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা ও সে রাখে না। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি আমার বোনকে তার’চে অধিক ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিব। কথা দিয়ে এসেছি ঐ ব্লাডিটাকে। অন্যথায় হবে না এর। হিমেশই হবে পিয়ালীর যোগ্য স্বামী! পিয়ালীর সীমাহীন ভালোবাসা কেবলমাত্র হিমেশই ডিজার্ভ করে!”
ভাষা হারিয়ে আমি মূর্তি প্রায়। সচলতা কাজ করছে না আপাদমস্তকে। বিশেষ করে মস্তিষ্ক তার নিষ্ক্রিয়তা হারিয়ে বসেছে৷ “পায়েলের কথা” ক্রমাগত কড়াঘাত করছে আমার দুর্বল মস্তিষ্কে! মেয়েটা যে হিমেশ ভাইকে মন বিলি করে বসে আছে! আদান-প্রদান যদি ও এক তরফ থেকে! তবু ও তো মেয়েটা হিমেশ ভাইকে অতি সূক্ষ্মভাবে ভালোবাসে! কি হবে মেয়েটার তবে? পরশ যে এই দিকে পিয়ালী আপুর সাথেই হিমেশ ভাইকে বেঁধে দেওয়ার সিদ্ধান্তে মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন। মস্তিষ্ক কাজ করছে না আমার। তবে মনে হচ্ছে এই ব্যাপারে পায়েলের সাথে আমার কথা বলতে হবে। জানতে হবে, পায়েল আদৌতে কি চায়। হিমেশ ভাই কি সত্যিই তার ভালোবাসা? নাকি ভালো লাগা?
ইতোমধ্যেই রুমে তৃতীয় কারো উপস্থিতি টের পেলাম। আকস্মিকভাবে মা এক প্রকার দৌঁড়ে ব্যালকনীর দিকটায় কিঞ্চিৎ মুহূর্তের মধ্যে এসে হাজির হলেন। এক ঝটকায় আমি পরশের সম্মুখ থেকে সরে দাঁড়ালাম। পরশ শার্টের কলার ঠিক করে অতি নম্রভাবে ম্লান হেসে মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ালেন। বুকের উপর দুহাত বেঁধে মা মুখমন্ডলে শান্ত ভাব ফুটিয়ে পরশের দিকে প্রশ্ন ছুড়েঁ বললেন,,
“সৌরভ বিয়েটা প্রত্যাখান করেছে তাই তো?”
পরশ এবং আমি উভয়ই ভড়কে উঠলাম। পরশ তো এই বিষয়ে মাকে কিছুই জানান নি। তবে মা এই বিষয়ে অবগত হলেন কিভাবে?পরশের পূর্বেই কি তবে সৌরভ ভাই কোনোভাবে মাকে এই বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন? তন্মধ্যেই মা খানিক ইতস্ততবোধ করে পুনরায় বললেন,,
“আসলে আমি দরজার ওপার থেকে সব শুনছিলাম। তোদের দুজনকে ডাকতে এসে হঠাৎই কর্নপাত হলো পিয়ালী এবং সৌরভ সম্পর্কিত কথা। তাই আঁড়ি পাততে বাধ্য হলাম।”
পরশ দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে মায়ের দু কাঁধে হাত রেখে নমনীয় গলায় বললেন,,
“তুমি চিন্তা করো না মা। পিয়ালীর জন্য হিমেশ ই হবে বেস্ট চয়েজ। সৌরভ কোনো অংশেই পিয়ালীর যোগ্য না। যার মন মানসিকতা অতি খর্ব, তার ব্যক্তিত্ব যে ঠিক কতটা মার্জিত হবে তা আমার এবং আমাদের খুব স্বচ্ছভাবেই জানা হয়ে গেছে। এবার যা হবে ভালো হবে মা। সবার মঙ্গলের জন্যই হবে।”
“আমি ও চাই না পিয়ালীর সাথে সৌরভের বিয়ে হউক। যে পরিবারের লোকজন বিয়ের পূর্বেই মেয়ের পরিবারের খুঁত ধরতে আসে, মান্ধাতার আমলের মন মানসিকতা নিয়ে বসে থাকে, সেই পরিবারে আমি আমার মেয়েকে কিছুতেই নিরাপদ ভাবতে পারি না। নিরাপদ আশ্রয়স্থল বলে ও নিশ্চিন্ত হতে পারি না।”
মায়ের আঁখিপল্লবে বৃষ্টির আনাগোনা ঘটতেই পরশ বিষন্ন মনে মাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,,
“স্টপ ক্রাইং মা। ভেবো না তোমার মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে, সমাজ তোমার মেয়েকে দোষারোপ করবে, নিন্দে-মন্দ করবে, তোমার ছেলে এবং মেয়ের জন্য তোমার পরিবারের মান হানি হয়েছে, এর জের ধরে পিয়ালীর ও বিয়ে দিতে বিঘ্ন ঘটবে। এমন কিছুই হবে না মা! হিমেশকে আমি চিনি। যদি একবার মুখ ফুটে বলি না? পিয়ালীকে তুই বিয়ে কর। হিমেশ চোখ বুজেই রাজি হয়ে যাবে। কোনো রকম দ্বিমত পোষন বা পারিবারিক দুটানায় ভুগবে না। আমি অন্তত এইটুকু বুঝতে পারছি, পিয়ালীর সাথে হিমেশের লাইফ সিকিউরড!”
আকস্মিকভাবে আমি মুখ ফসকে বলতে বাধ্য হলাম,,
“জোর করেই কারো উপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া ঠিক না। আমার মনে হচ্ছে, এই বিষয়ে আপু এবং হিমেশ ভাইয়ার সাথে সরাসরি এবং খোলসা ভাবে কথা বলা উচিত। তাদের অভিমত নেওয়া উচিত। মতামতে বিবেধ থাকতেই পারে। বিয়েটা সারাজীবনের জন্য ঘটিত এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। সেই দিক থেকে দুটো পক্ষেরই মতামত নেওয়াটা ভীষন জরুরী। শুধুমাত্র লাইফ সিকিউরড হলেই তো হবে না তাই না? মনের দিকটা ও সিকিউরড হতে হবে। আমার মনে হচ্ছে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে বিষয়টা ভেবে দেখা উচিত।”
মা এবং পরশের মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো না, তারা আমার অভিপ্রায় অতি স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছেন! তেজর্শী রূপ ধারন করেছেন আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দু দুটো ব্যক্তিই। খোলসা ভাবে বলতে পারছিলাম না যে, পায়েল একপাক্ষিক ভাবে হিমেশ ভাইকে ভালোবাসেন। ব্যাপারটা এমন ও হতে পারে, হিমেশ ভাই ও পায়েলকে চাইতে পারেন! আমার মনে হয় না, এতগুলো দিনে ও হিমেশ ভাই পায়েলের অনুভূতি বুঝতে পারেন নি বা বুঝার চেষ্টা ও করেন নি! পায়েলের অভিব্যক্তি খানিকটা হলে ও আঁচ করতে পেরেছেন হিমেশ ভাই। যদি আমার ধারনা ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে হয়তোবা হিমেশ ভাই পরশের মুখের দিকে চেয়ে জোরপূর্বক পিয়ালী আপুকে বিয়ে করতে রাজি হতেই পারেন! আদৌতে এই সম্পর্কে কোনো ভালোবাসা থাকবে না। আমি অন্তত ব্যক্তিগত ভাবে কখনোই চাইব না ভালেবাসাহীন একটা সম্পর্ক শুধুমাত্র জোরের উপর টিকে থাকুক!
পরশ রাগ আয়ত্তে এনে নির্বিকার রূপ ধারন করলে ও বোধ হয় না মা খুব একটা নির্বাক থাকার প্রয়াসে আছেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে মা দাঁতে দাঁত চেঁপে পরশকে শুধালেন,,
“তোর বউ কি বলতে চাইছে? কি বুঝাতে চাইছে আমাদের? আমরা ভুল? পিয়ালীর জীবন নিয়ে আমরা ভুল সিদ্ধান্ত নিব? বা হিমেশকে জোর পূর্বক পিয়ালীর সাথে বিয়ে দিতে বাধ্য করব? সংসার জীবনে এসেছে মাত্র দুদিন হলো। এখন থেকেই উপদেশ দেওয়া শুরু করেছে? কলকাটি নাড়তে আরম্ভ করেছে?”
মাথা নুঁইয়ে নিলাম আমি। পরশের কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষিত হলো না। মানুষটা হয়তো দোটানায় ভুগছেন। কাকে কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তাই আমিই গলা খাঁকিয়ে নরম গলায় মাকে বললাম,,
“স্যরি মা। আমি কিছু ভুল বলে থাকলে মাফ করবেন আমায়। আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাইছিলাম, হিমেশ ভাইয়া এবং পিয়ালী আপুর সাথে আপনারা সবাই মিলে খোলসা ভাবে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করুন। দুজনের মতামত নিন। এরপর একটা সিদ্ধান্তে যান।”
কিয়ৎক্ষনে মা পুনরায় চটে গেলেন। হুড়মুড়িয়ে মা আমাদের সম্মুখ থেকে প্রস্থান নিচ্ছেন আর তটস্থ গলায় বলছেন,,
“দুজনই ফ্রেশ হয়ে জলদি খাবার টেবিলে চলে আয়। আর শোন পরশ? তোর বউকে বলে দিস, একটু সাবধানে কাজ-কর্ম করতে। এতো উদাসীন স্বভাবের মেয়ে মানুষ হলে সংসারে আর কাজকর্ম করা লাগবে না। একটা সংসার সামলানো চাট্টিখানি কথা না। সামান্য অসাবধানতার কারনে মর্মান্তিক কোনো বিপদ-আপদ ঘটে যেতে পারে। যেমনটা আজ ঘটেছিল! প্রতিবার কিন্তু আমি আসব না তোর বউকে সেইফ করতে! একটু সিরিযাস হতে বল। নয়তো উঠতে বসতে আমার কটুক্তি শ্রবণ করতে হবে!”
ধুর-ছাই! প্রসঙ্গ কোথা থেকে কোথায় ঘুড়ে গেল! চেয়েছিলাম পায়েলের প্রসঙ্গটা খানিকটা হলে ও সবার প্রকাশ্যে আনতে। কিঞ্চিৎ হলে ও বিষয়টা সবার কর্নপাত করাতে। কিন্তু না, তা আর হলো না। যাওয়ার সময় মা পরশকে বেশ ভালোভাবেই উসকে দিয়ে গেলেন। এই লোক নির্ঘাত এখন আমার দিকে তেঁড়ে আসবেন। প্রথমত, প্রশ্নে প্রশ্নে আমায় জর্জরিত কর তুলবেন। দ্বিতীয়ত, অগ্নিঝড়া রূপটা সম্মুখে আনবেন। তৃতীয়ত, আদর-সোহাগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন! চতুর্থত, পায়েলের বিষয়টা সম্পূর্ণ ভাবে ধামাচাঁপা দিয়ে দিবেন! এই লোককে আমার হারে হারে চেনা হয়ে গেছে! কম বিশ্লেষন করেছি নাকি আমি এই লোকটাকে নিয়ে? সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষন করার পরই তো লোকটার হাত ধরে পালিয়ে যেতে এক প্রকার উৎসাহিত হয়েছিলাম। পরবর্তীতে বিয়ে করে এখন সংসার ও করছি!
আমার ধারনা এক এক করে মিলতে আরম্ভ করল। লোকটা ঠিকই আমার দিকে তেঁড়ে আসছেন। প্রথম দিকেই প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,
“মা কি বলে গেলেন? কি হয়েছে আজ? কি করেছ তুমি?”
স্বাভাবিক কন্ঠেই আমি প্রত্যত্তুরে বললাম,
“সামান্য আগুনের তাপ লেগেছিল শাড়ির আঁচলে! কে জানত সেই তাপ পরবর্তীতে আগুনের আকার ধারন করবে?”
রাগে পরশ গুঙ্গিয়ে উঠলেন। মুহূর্তের মধ্যে শক্ত হাতে আমার কোমড় চেঁপে ধরে ব্যালকনীর গ্রীলের সাথে আমায় মিশিয়ে নিলেন। ভয়াল দৃষ্টিতে আমার হতবাক দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলিয়ে লোকটা চোয়াল শক্ত করে বললেন,,
“হুশ জ্ঞান নেই তোমার? শুধু কি শরীর দিয়েই লকলকে বড় হয়ে গেছ? বুদ্ধি, চিন্তা, জ্ঞানে, মননে এখন ও বড় হও নি তুমি? একটু ও বুঝতে পারো নি না? তোমার শাড়ির আঁচলে আগুনের উত্তাপ লেগেছিল?”
“বুঝলে অবশ্যই হা করে দাঁড়িয়ে থাকতাম না! কোনো একটা প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই করতাম। তাছাড়া আপনি কিন্তু জেনে শুনেই এই নির্বোধ, বোকা, জ্ঞানহীন মেয়েটাকে বিয়ে করেছেন। এক্ষেত্রে আপনি আমায় এক তরফা দোষারোপ করতে পারেন না।”
“আমি কিন্তু মোটে ও তোমার দোষ-ত্রুটি খুঁজছি না। শুধুমাত্র বলতে চাইছি, জ্ঞান- বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে। উদাসীন মনোভাবটা কাটিয়ে উঠতে। বরাবরই তুমি একটু বেশি বুঝ। ঐ যে ঐ দিন বলেছিলাম না? মেয়েদের বুদ্ধি হাঁটুতে থাকে। ঘিলুতে না!”
মুখ ফুলিয়ে আমি লোকটার দিকে দৃষ্টি স্থির করতেই লোকটা ফিক করে হেসে দিলেন। কোমড়টা আর ও শক্ত হাতে চেঁপে ধরে লোকটা আমার ওষ্ঠদ্বয়ে এগিয়ে এসে ক্রুর হেসে বললেন,,
“তোমার এই ফুলকো মুখভঙ্গিটা আমার খুব পছন্দের। গাল দু খানা কেমন লুচির মত ফুলে থাকে৷ আর প্রশ্বস্ত ঠোঁট জোড়া তখন রসগোল্লাতে রূপান্তরিত হয়। বিষয়টা সত্যিই খুব মজার!”
এক মুহূর্ত বিলম্ব করতে চাইলেন না লোকটা। আমার ধারনা অনুযায়ী আদর-সোহাগে মেতে উঠলেন। ঠোঁটে ঠোঁট মিশে আছে দুজনের। পিয়ালী আপুর বিয়ের ব্যাপারটা আজ এখানেই ধামা-চাপা! লোকটার বেহেসাবি পাগলামীতে আমি ও যেনো কিয়ৎক্ষনে মত্ত হয়ে উঠলাম। গাঁ ভাসালাম লোকটার নেশাক্ত ভালোবাসায়!
,
,
সন্ধ্যায় কেনা কাটা সেরে মাত্র বাড়ি ফিরলাম মা, আমি এবং পরশ। ঘড়িতে সন্ধ্যা প্রায় ৭ টা বাজছে। ব্যতিব্যস্ত ভঙ্গিতে আমরা বাড়ির ড্রইং রুমে পদার্পন করতেই মা, আমি এবং পরশ যে শুধু বিস্মিত হয়েছি ঠিক তা না, খানিক বিরক্তি বোধ ও করছি! কারন, সৌরভ ভাইয়া সহ সৌরভ ভাইয়ার মা-বাবা আমাদের বাড়ির ড্রইং রুমে এসে উপস্থিত। সামনেই পিয়ালী আপু এবং পায়েল হাসিমুখে তাদের চা, নাশতা এগিয়ে দিচ্ছেন। গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখে তারা চায়ের কাপে চুমুক দিতেই মা তাদের দিকে তেঁড়ে গিয়ে তটস্থ গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,
“আপনারা হঠাৎ? কি মনে করে?”
ইতোমধ্যেই সৌরভ ভাইয়ার মা জোর পূর্বক হাসি টেনে মায়ের দিকে প্রস্ফুটিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,
“স্যরি আপা। আপনাদের কিছু না জানিয়েই চলে এলাম। আসলে, সৌরভের বিয়ে নিয়ে বিশেষ কিছু জরুরী কথা ছিল আপনাদের সাথে। তাই হুট করেই চলে এলাম!”
“শুনুন আপা? আমরা জানি, আপনারা কেন এসেছেন! আপনার ছেলের সাথে আমার ছেলের এই বিষয়ে কথা হয়ে গেছে! আমরা ও এই বিয়েতে রাজি নই! বিয়ে ভাঙ্গতে আমরা ও ইচ্ছুক!”
কথার মাঝখানেই পিয়ালী আপু হঠাৎ বসা থেকে উঠে অবিশ্বাস্য গলায় মাকে শুধিয়ে বললেন,,
“এসব তুমি কি বলছ মা? কি বিয়ে ভাঙ্গবে তুমি?”
মা ঝাঁঝালো গলায় বললেন,,
“তুই জাস্ট চুপ থাক পিয়ালী। ন্যাকামো গুলো বন্ধ কর। এই ছেলে কোনো দিক থেকেই তোর যোগ্য না! তুই এর’চে যোগ্য কাউকে ডিজার্ভ করিস!”
সৌরভ ভাই গর্জে উঠলেন এবার। আচার-আচরণে সমঝোতা না রেখেই উনি বসা থেকে উঠে মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,
“আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে আমার ও জান বের হয়ে যাচ্ছে না। নেহাতই মা-বাবা জোর করেছিলেন বলে আপনার মেয়ের সাথে এনগেজড করতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি! আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি! যে আপনার মেয়ের চেয়ে ও দ্বিগুন যোগ্য! ভাগ্যিস সঠিক সময়ে আপনাদের পরিবারের কুকীর্তি আমাদের সামনে এসেছিল! নয়তো জীবনের মস্ত বড় ভুলটা আমি করে বসতাম!”
পরশকে আর থামানো গেল না। এতোটা সময় ধরে খুব জোরপূর্বক লোকটাকে থামিয়ে রেখেছিলাম আমি। আমার শক্ত হাতের বাঁধনটা ঢিলে করে লোকটা সৌরভের শার্টের কলার চেঁপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,,
“এক্ষনি, এই মুহূর্তে তুই আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবি। অনেক সহ্য করেছি তোর অবান্তর কথা। ওটা রেস্টুরেন্ট ছিল বলে বেঁচে গিয়েছিলি তুই। আর এটা? এখন আমার বাড়ি। গলা কেটে রেখে দিব তোর! ব্লাডি, বিচ!”
সৌরভ ভাই এবং উনার মা-বাবাকে কোনো রূপ প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ না দিয়ে পরশ দাঁত কিড়মিড়িয়ে কান্নারত অবস্থায় থাকা পিয়ালী আপুকে বললেন,,
“এই ছেলেটাকে তুই ভালোবেসেছিলি না? শুধু মাত্র এই ছেলেটার জন্যই তুই ঘুমের ওভার ডোজ নিয়েছিলি? দেখলি তো? কত বড় ধপবাজ এই ছেলে! শুনে রাখ তুই? এই পরশ, তোর ভাই কথা দিচ্ছে। এই এক সপ্তাহের মধ্যে এর’চে শতগুন যোগ্য ছেলের সাথে আমি তোর বিয়ে দিব৷ আর হিমেশই হবে তোর সেই যোগ্য পাত্র!”
#চলবে….?