#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_২৪
#নিশাত_জাহান_নিশি
“যা শুনার কাল সকালে শুনব। এখন প্লিজ আমায় বিরক্ত কর না।”
কি আশ্চর্য! লোকটা এত বেপরোয়া স্বভাবের কেন? মানে আমি কি বলতে চাইছি তা তো একটু শুনতে হবে। বুঝতে হবে কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পিয়ালী আপুর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন। না এই লোক তো এখন নিজের দেহের খোরাকে ব্যস্ত বিপরীত পাশের মানুষটার কথা ভাববার সময় আছে নাকি লোকটার? তা ও আমি অতি তৎপর হয়ে লোকটাকে এক ঝটকায় ঘাড় থেকে সরিয়ে বিরক্ত মিশ্রিত গলায় বললাম,,
“আমি একটা কথা বলতে চাইছি। শুনতে পারছেন না আপনি?”
লোকটা পূর্বের তুলনায় অধিক উত্তেজিত হয়ে আমার ঠোঁট জোড়া আঁকড়ে ধরে বললেন,,
“না। শুনতে পারছি না। বুঝতে পারছ না তুমি? তোমার বর এখন অধিক রোমাঞ্চে প্রলোভিত হয়ে আছে? সো চুপচাপ থেকে এখন আমায় সঙ্গ দাও! বিরক্ত করলেই রাতের ঘুম হারাতে হবে। অনিদ্রায় সারা রাত কাটাতে হবে!”
একদম হেড মাস্টার টাইপ কথা। চূড়ান্ত বদ, অসভ্য, বেহায়া এই লোকটার কথা মতই আমাকে লোকটার সঙ্গ দিতে হলো। অসম্ভব নাছোড়বান্দা এই লোক। নিজে যা বলবে ঠিক তাই করবে। আমার ভালো লাগা, খারাপ লাগার কোনো প্রাধান্যই নেই! তবে লোকটার অতি অত্যাচার পূর্ণ ভালোবাসায় আমি ও এখন সিক্ত প্রায়। এক অদ্ভুত সুন্দর এই অনুভূতি। না পারি দূরে ঠেলে দিতে পারি, না পারি স্ব-ইচ্ছায় বরণ করে নিতে। জান বের হয়ে যায় লোকটার এই পাগলামী পূর্ণ ভালোবাসায়। মরণ বুঝি অতি সন্নিকটে এই অনুভূতিটাই তখন বেশি প্রশ্রয় পায়!
,
,
ফজরের মিষ্টি আযানের ধ্বনি কানে ভেসে আসতেই ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল আমার। তবে আযানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙ্গে নি আমার। ঘুম ভেঙ্গেছে দরজায় কড়া নড়ার শব্দে। বিক্ষিপ্ত ভাবে পরশের গাঁয়ের উপর হাত, পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম আমি। সম্পূর্ণ বস্ত্রহীন শরীরে। লোকটার যন্ত্রনায় বস্ত্র পরিধান করা সম্ভব হয় নি আমার! অর্ধ খোলা নেত্রযুগলে আমি দরজার দিকে নজর দিতেই দরজায় পুনরায় কড়া পড়ল। শ্বাশুড়ী মা দরজায় কড়া নাঁড়ছেন আর উচ্চ আওয়াজে বলছেন,,
“টয়া শুনছ? তাড়াতাড়ি উঠো।”
কপালের ভাঁজে উদ্বিগ্নতা ভর করতেই আমার আঁখিদ্বয় থেকে তন্দ্রা পরীরা ডানা ঝাপটে উড়াল দিল। ধরফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠতেই পরশের ভারী হাতটা আমার বুকের উপর ঠাঁয় পেল। বিরক্তি নিয়ে লোকটার হাতটা দ্রুত গতিতে সরিয়ে আমি ফ্লোর থেকে শাড়িটা উঠিয়ে গাঁয়ে পেঁচিয়ে নিতেই পরশ উবুড় হয়ে শোয়া অবস্থাতেই ঘুম জড়ানো গলায় বললেন,,
“এই? কোথায় যাচ্ছ?”
শাড়ির কুঁচি সামলে আমি অগোছালো গলায় বললাম,,
“মা ডাকছেন!”
পরশ নিশ্চুপ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি তড়িঘড়ি করে দৌঁড়ে রুমের দরজাটা খুলে দিতেই শ্বাশুড়ী মা দৃষ্টি নুঁইয়ে তটস্থ গলায় বললেন,,
“বাড়িতে নামাজ, কালাম করো নি? এতক্ষন অবধি কিসের ঘুম?”
মাথা নুঁইয়ে আমি নিম্ন আওয়াজে বললাম,,
“কাল থেকে আর ভুল হবে না মা।”
“কাল কেন? আজ থেকেই নামাজ ধর। নামাজের পর প্রতিটা রুম ঝাঁড়ু দিয়ে এরপর রান্নাঘরে আসবে। মনে থাকবে?”
“জ্বি মা। মনে থাকবে।”
“আর একটা কথা। মাথায় সবসময় ঘোমটা টেনে রাখবে। বাড়িতে কত মেহমান, অতিথি আসে। তাছাড়া তোমার শ্বশুড় বাবা ও বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই থাকে৷ তাই এই জিনিসটা একটু মাথায় রাখবে।”
“ঠিক আছে মা। মাথায় থাকবে।”
“আসছি আমি। ঠিক ৬ টায় রান্নাঘরে যাবে। সবার জন্য নাশতা তৈরী করবে।”
“যদি বলতেন ব্রেকফাস্টে কি কি করতে হবে?”
“চা, পরোটা, ওমলেট।”
“ঠিক আছে মা। আমি চেষ্টা করব।”
মা প্রস্থান নিলেন। রুমের দরজাটা আটকে আমি বিছানার এক পাশে দু হাতে ভর দিয়ে বসে পড়লাম। শরীরে প্রচন্ড ব্যাথার অনুভূতি হচ্ছে। মাথাটা খুব ঘুড়ছে এবং মস্তিষ্ক জুড়ে চিনচিনে ব্যাথার উৎপত্তি ও হচ্ছে। আর একটু ঘুমুলে হয়তো শরীরটা ভালো লাগত। রাতে হাতে গুনে ৩ ঘন্টা ঘুমিয়েছি কিনা সন্দেহ আছে। লোকটার জ্বালায় ইদানিং আমার ঘুম পূর্ণ হয় না। আর ঘুম পূর্ণ না হলেই আমার শরীর এমনিতে ও ঝিমঝিম করে। হাঁটা চলা, খাওয়া-দাওয়া এবং কাজে মন বসাতে পারি না। প্রচন্ড অলসতা কাজ করে। ইচ্ছে করছে আর একটু ঘুমিয়ে নিতে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলাম ৫ঃ১০ মিনিট বাজছে ঘড়িতে। শ্বাশুড়ী মায়ের নির্দেশ মতো ঠিক ৬ টায় রান্নাঘরে থাকতে হবে। গোসল, নামাজ, রুম ঝাঁড়ু দেওয়া সব মিলিয়ে ৫০ মিনিট সময় তো ব্যয় হবেই। তার মানে, ঘুমানো হলো না আর। এক্ষনি কাজে লেগে পড়তে হবে আমার।
ঢুলুঢুলু শরীরে আমি বসা থেকে উঠতেই পরশ পিছন থেকে পুনরায় আমায় ঘুম জড়ানো গলায় ডেকে বললেন,,
“কি হলো? আবার কোথায় যাচ্ছ?”
“শাওয়ার নিতে হবে। নামাজ পড়তে হবে।”
“আযান তো দিল মাত্র। আর একটু ঘুমিয়ে নাও।”
“না। নামাযের সময় চলে যাবে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”
পরশ প্রত্যত্তুরে কিছু বললেন না। বেচারা নিজেই ঘুমে কাত। তা ও আমার যত্ন রাখার খাতিরে বার বার ঘুম থেকে জেগে উঠছেন। খবরা খবর নিচ্ছেন আমার। দীর্ঘশ্বাস নির্গত করে আমি শরীরের আড় মোড়া ভেঙ্গে শাওয়ারে চলে গেলাম। কিছু সময় পর শাওয়ার সেরে আমি নামায আদায় করে চুল থেকে টাওয়াল টা সরিয়ে যেই না ভেজা চুলে পরশের পাশে বসলাম অমনি পরশ হেচকা টানে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। আঁখি যুগল বুজে লোকটা আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বললেন,,
“নামায পড়া তো শেষ এবার। আর একটু ঘুমিয়ে নাও।”
আমি লোকটার বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে আনমনে বললাম,,
“সময় নেই। রুম ঝাঁড়ু দিতে হবে। রান্নাঘরে যেতে হবে।”
“তাড়া নেই কারোর। এই বাড়িতে সবাই ৭ টা ৮ টার পূর্বে সচরাচর ঘুম থেকে জাগে না। সো এক, দু ঘন্টা তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমুতেই পারো।”
“মা রেগে যাবেন না তো?”
“উঁহু। মা রাগ করবেন না। তুমি ঘুমাও!”
মৃদ্যু হেসে আমি লোকটাকে শক্ত হাতে ঝাপটে ধরে ঘুমের অতলে তলিয়ে পড়লাম। লোকটা কিছুক্ষন বাদে বাদে আমার মুখমন্ডলে নাক দ্বারা শুড়শুড়ি দিচ্ছেন, চুমু খেয়ে দিচ্ছেন, শাড়ির আঁচল সরিয়ে দিচ্ছেন, বুকে মুখ গুজে দিচ্ছেন। ঘুমের মাঝে ও বেশ টের পাচ্ছি আমি। বড্ড অসভ্য এই লোক। সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইবেন না।
,
,
সকাল ৯ টা বেজে ১০ মিনিট বাজছে ঘড়িতে। এদিকে আমি মাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। পরশের শাওয়ারের ফাঁকে কোনো মতে ফ্রেশ হয়ে আমি প্রচন্ড ভয়, ভীতি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে দ্রুত পায়ে হেঁটে যেতেই দেখলাম শ্বাশুড়ী মা রান্নাঘরে পরোটা সেঁকছেন আর বিড়বিড় করে কিসব যেন বলছেন। ভয়ে অন্তর্আত্তা কেঁপে উঠল আমার। নিশ্চয় আমাকেই মা মনে মনে বকছেন! অনবরত শুকনো ঢোক গিলে আমি শ্বাশুড়ী মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললাম,,
“সসস্যরি মা। আআআমি আসলে…
সম্পূর্ণ উক্তি শেষ করার বেগ পেলাম না পর্যন্ত। এর অতি পূর্বেই শ্বাশুড়ী মা আমার দিকে রক্তিম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,
“বিয়ের প্রথম সপ্তাহেই তোমার এই অবস্থা? বাকি দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগ এই গুলোতে কি করবে তুমি?”
মাথা নুঁইয়ে আমি অপরাধী গলায় বললাম,,
“স্যরি মা। কাল থেকে আর এমন হবে না।”
“তুমি যদি ভেবে থাক রোজ আমি তোমাকে ঠিক এভাবেই ছাড় দিব, তাহলে তুমি ভুল ভাবছ টয়া! কিছুতেই তোমাকে ছাড় দেওয়া যাবে না। বউমা হিসেবে তোমাকে মেনে নিয়েছি এই অনেক। এর’চে অধিক কিছু আর কি এক্সপেক্ট করো তুমি আমার থেকে? শুধু মাএ ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে তোমাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। নয়তো তোমার বাবার মতো আমি ও তোমায় বর্জন করে দিতাম! একমাত্র ছেলে আমার। নির্ঘাত ছেলের অন্যায় আবদার ফেলতে পারছিলাম না তাই!”
চোখের কানায় কানায় জল পরিপূর্ণ হতেই শ্বাশুড়ী মা রাগে গজগজ করে পরোটা এবং ওমলেট সমেত রান্নাঘর থেকে প্রস্থান নিলেন। মাথা নুঁইয়ে আমি চোখের জল ছাড়তে ব্যস্ত। কতটা বিচিত্র মেয়েদের জীবন। বিয়ের পর সম্পূর্ণ বদল ঘটে মেয়েদের নিত্যদিনকার চলাচলে, কাজ কর্মে, অভ্যেসে। সামান্য ভুলের কারনে ও তাদের প্রতি পদে হেনস্তা হতে হয়, কটুক্তি শুনতে হয়, হৃদয়ে আঘাত ধরানোর মতো কুৎসার মুখোমুখি তে হয়, সুযোগ সুবিধা, ভালো মন্দ বিচার বিবেচনা না করেই তাদের একপাক্ষিক ভাবে বিবেচনা করা হয়। আর বিয়েটা যদি হয় পরিবারের অমতে। তাহলে তো কথাই নেই। সে জায়গায় তো আমি পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম উনার ছেলেকে। দোষটা উভয় পক্ষের থাকলে ও দোষটা সম্পূর্ণ এখন আমার কাঁধেই এসে বর্তাবে। এটাই আমাদের সমাজ। যেখানে মেয়ে হয়ে মেয়ে জাতির দোষটাই বড় করে দেখা হয়!
ঢুকড়ে কেঁদে উঠতেই পেছন থেকে শ্বাশুড়ী মা ঝাঁঝালো গলায় আমায় শুধিয়ে বললেন,,
“চা টা কি আমি করে আনব?”
তড়িঘড়ি করে আমি চোখের কোনে আবদ্ধ জলরাশি মুছে অতি স্বাভাবিক গলায় মা কে বললাম,,
“আমি করে আনছি মা। আপনি যান।”
চায়ের পাতিল গ্যাসে বসিয়ে আমি অতি মনযোগের সহিত চা টা বানিয়ে ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়ালাম। ডাইনিং টেবিলে প্রায় সবাই ই আছে। তবে আমার শ্বশুড় আব্বু এবং পিয়ালী আপুকে দেখা যাচ্ছে না। পরশ ভেজা চুলে খুব মনযোগ দিয়ে পেপার পড়তে ব্যস্ত। গ্রীণ কালার টি শার্টে লোকটাকে বেশ মানিয়েছে। দৃষ্টি ফেরানো দায় হয়ে পড়েছে। পাশেই পায়েল হাসি মুখে ফোনে স্ক্রলিং করছে। শ্বাশুড়ী মা সবার প্লেটে নাশতা সার্ভ করছেন। আমি চায়ের ফ্লাক্সটা টেবিলের উপর রেখে জিগ্যাসু স্বরে মা কে বললাম,,
“বাবা কোথায় মা?”
মা অতি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,,
“অফিসে। এই প্রথম মানুষটাকে ব্রেকফাস্ট না করেই অফিসে যেতে হলো!”
সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নুঁইয়ে নিলাম আমি। আমার একটু আরামের জন্যই বাবাকে আজ খালি মুখে অফিসে যেতে হলো। নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। পাশ থেকে পরশ খবরের কাগজটা টেবিলের উপর রেখে প্রশ্নবিদ্ধ গলায় মা কে বললেন,,
“বাবা ব্রেকফাস্ট করে যায় নি অফিসে?”
“বাড়ির বউ যদি দিনের ৯ টা ১০ টা পর্যন্ত আরাম করে ঘুমিয়ে থাকে। তাহলে বাড়ির বাকি সদস্যদের তো না খেয়েই কাজে কর্মে যেতে হবে তাই না?”
পরশ অতি সাবলীল গলায় প্রত্যত্তুরে বললেন,
“তুমি যদি টয়াকে মিন করে থাক। তাহলে বলব আমিই টয়াকে বলেছিলাম, একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠতে! আসলে, ওর শরীরটা খারাপ ছিল মা। দুদিনের ধকলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল অনেকটা। তাছাড়া তুমি কোথায় ছিলে মা? অন্তত বাবাকে এক কাপ কফি বা চা করে দিতে! তাহলে খালি মুখে বাবাকে বের হতে হতো না!”
মা হেয় গলায় বললেন,,
“আমি না? রোজ তোকে দেখি আর অবাক হই! কি যাদু করেছে রে ঐ মেয়েটা তোকে? সবসময় দেখি ঐ মেয়েটার পক্ষ নিয়ে কথা বলিস! এক কালে তো আমি ও এই বাড়ির বউ ছিলাম। আমার ও শ্বাশুড়ী মা ছিলেন। বিয়ের পর দিন থেকেই শ্বাশুড়ী মায়ের কড়া নির্দেশে আমাকে চলতে হয়েছে। হাজার শরীর খারাপ, অসুস্থতা এবং ক্লান্তি নিয়ে ও আমি কাজ করেছি, পরিবারের প্রতিটা সদস্যের যত্ন নিয়েছি, খেয়াল রেখেছি। দুদিন পর পর বাড়ি ভর্তি মেহমানদের ঢল পড়ত। সব একা হাতে সামলেছি৷ তোর বাবা ও কখন ও আমার ভালো লাগা, মন্দ লাগা এবং সুযোগ, সুবিধার প্রতি খেয়াল রাখেন নি। মা যা বলেছিলেন তাই! কখন ও মায়ের মুখের উপর দু কথা বলার সাহস দেখান নি। আর তুই এই দুই দিনের সংসারে বউয়ের পক্ষ ধরে কথা বলা শিখে গেছিস? বউয়ের হয়ে আমাকে বলছিস কাজ করতে? আমার ছেলের বউ আরাম করে শুয়ে থাকবে আর আমি কাজ করব? এই তোর নীতি? এই দিন দেখার জন্যই তোদের মেনে নিয়েছিলাম আমি?”
পরশ নির্বোধ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,,
“এসব তুমি কি বলছ মা? কোথা থেকে কোথা চলে গেলে তুমি? আমি এত কিছু ভেবে চিন্তে কিন্তু কথা গুলো বলি নি। আমি জাস্ট বলতে চেয়েছিলাম তুমি যেহেতু জেগেই ছিলে, আর ফ্রি ও ছিলে বাবাকে সামান্য কফিটা করে দিতে পারতে। তাহলেই বাবাকে আর খালি মুখে বের হতে হতো না। তাছাড়া টয়া আজকের দিনটাই একটু ছাড় পেয়েছে নিতান্তই অসুস্থতার জন্য৷ কাল থেকে নিশ্চয়ই সে ঠিক সময়ে উঠে সবার ব্রেকফাস্ট তৈরী করবে। পরিবারের সবার ভালো-মন্দের খেয়াল রাখবে। টয়ার প্রতি সেই আস্থা আছে আমার। তুমি অযথা টয়া এবং আমাকে ভুল বুঝছ মা!”
“বলে দে তোর বউকে। কাল থেকে যেনো সকাল ঠিক সাড়ে ছয়টার মধ্যে রান্নাঘরে উপস্থিত থাকে। সবার নাশতার দিকটা খেয়াল রাখে। সাথে দুপুরের রান্না বান্নার দিকটাতে ও নজর রাখে। কাজের বুয়া এক সপ্তাহের জন্য ছুটিতে গেছে। অন্তত এই কয়েকটা দিন কাজের প্রতি একটু যত্নশীল হতে।”
“খেয়াল রাখবে মা। তুমি একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিও তাহলেই চলবে!”
“কেন বাপের বাড়ি থেকে শিখে পড়ে আসে নি কিছু? শুধু কি প্রেম ভালোবাসাই শিখে এসেছে? আর শিখেছে কিভাবে ছেলেদের নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে হয়?”
পরশ এবার রাগ সংযত করতে না পেরে খাবার চেয়ার ছেড়ে উঠে তেজী গলায় মা কে কিছু বলতেই আমি গলা জড়ানো স্বরে পরশকে থামিয়ে বললাম,,
“কেনো কথা বাড়াচ্ছেন আপনি? বসুন না। নাশতাটা করুন প্লিজ!”
মা পরোটা মুখে দিয়ে গাঁ ছাড়া ভাব নিয়ে পরশকে বললেন,,
“হ্যাঁ হ্যাঁ নাশতাটা করে নে। জবটা তো ছেড়েই দিয়েছিস। ঐ এক মেয়ের জন্য। কি এমন যাদু করেছিল আল্লাহ্ মাবুদ জানেন। এখন আর কি? বাবা তো আছেনই তাই না? আবার তোর জন্য চাকরী ও খুঁজছে। শুন? তোর বাবা বলে গেছেন, নাশতা করে ১১ টার পূর্বেই তোর বাবার অফিসে প্রেজেন্ট থাকতে। উনার অফিসে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের একটা পদ খালি আছে। ওটাতেই তোকে নিয়োগ দিবেন।”
পরশ রাগ দেখিয়ে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে যেতেই মা পেছন থেকে পরশকে ডেকে বললেন,,
“রাগ দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। খাবারটা খেয়ে যা। এমন এক সময় আমরা ও উঠতে বসতে শ্বাশুড়ী মায়ের অনেক কথা শুনেছি। তোর বাবা ও শুনেছেন। তাই এসব বিষয় গুলো ধরতে নেই!”
পাশ থেকে পায়েল বিরক্ত মিশ্রিত স্বরে মা কে বললেন,,
“মা এবার তুমি একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছ! আগের কার দিন কি এখন ও আছে? সময়ের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা ধারা ও বদলেছে। ভাইয়া, ভাবী আগে যা করেছিল প্লিজ ভুলে যাও এসব। আর বিয়ের পরের কয়েকটা দিন টুকটাক ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। নতুন পরিবেশ, নতুন বাড়ি, নতুন মানুষজন ভাবীর একটু মানিয়ে নিতে সময় তো লাগবেই তাই না? ধরেই তো আর ভাবী সবজান্তা এবং কাজ কর্মে পারদর্শী হতে পারবে না তাই না? একটু তো সময় দিতে হবে, ছাড় দিতে হবে।”
“হয়েছে হয়েছে। ভাই, ভাবীর পক্ষ নিয়ে কথা বলতে হবে না। পিয়ালীকে ডেকে দে। ইদানিং মেয়েটার ও ঘুম ভারী হয়ে আসছে। বিয়ে ও ঘনিয়ে এসেছে মেয়েটার অভ্যেস গুলো ও খারাপ হচ্ছে!”
পায়েল খাবার টেবিল ছেড়ে উঠতেই আমি পায়েলকে থামিয়ে বললাম,,
“তুমি বসো পায়েল। আমি যাচ্ছি। আপুকে ডেকে দিচ্ছি!”
পায়েল মিষ্টি হেসে বলল,,
“ঠিক আছে ভাবী!”
পরশ এখন ও রাগান্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। জোরপূর্বক হেসে আমি লোকটাকে চোখের ইশারায় বললাম,,
“বসে পড়ুন। মায়ের কথায় আমি মন খারাপ করি নি।”
পরশ মুখটা ভাড় করে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। রাগে অতি ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন লোকটা। আমার বিরুদ্ধে বলা কোনো কথাই যেন লোকটার সহ্য হয় না! একদম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন। ধন্য আমি এই লোকটাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে। অন্তত নিজের ভালো দিকটা এই লোককে বলে কয়ে বেড়াতে হয় না আমার। লোকটা নিজেই আমার ভালো দিকটা বের করে সেই দিকটাই সবার কাছে জাহির করেন!
ম্লান হেসে আমি সিঁড়ি টপকে পিয়ালী আপুর রুমের দিকে অগ্রসর হয়ে প্রায় অনেক বার কড়া নাড়লাম আপুর রুমের দরজায়। ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ আসছে না। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ যত বিকট হচ্ছে নিস্তব্ধতা ততোই গাঢ় হচ্ছে। হুট করেই গত কাল রাতের কথা মনে পড়ে গেল আমার৷ বোধ হয় এই ভয়টাই গতকাল রাতে আমি পেয়েছিলাম। বুকটা ধড়ফড় করে কেঁপে উঠতেই আমি আপুর রুমের দরজা থেকে সরে এসে উপর তলা থেকে ড্রইং রুমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে বললাম,,
“পরশ শুনছেন? পিয়ালী আপু দরজা খুলছেন না!”
#চলবে….?
#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_২৫
#নিশাত_জাহান_নিশি
বুকটা ধড়ফড় করে কেঁপে উঠতেই আমি আপুর রুমের দরজা থেকে সরে এসে উপর তলা থেকে ড্রইং রুমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে বললাম,,
“পরশ শুনছেন? পিয়ালী আপু দরজা খুলছেন না!”
পরশ, মা এবং পায়েল বিস্ফোরক দৃষ্টিতে পিছু ফিরলেন। কপালের ভাঁজে হটকারি ভাব ফুটিয়ে পরশ দৃঢ় গলায় বললেন,,
“আবার ডেকে দেখ। হয়তো ঘুমুচ্ছে।”
“অনেক বার তো কড়া নাড়লাম দরজায়। ভেতর থেকে কোনো প্রত্যত্তুর, আওয়াজ বা প্রতিধ্বনি ও আসছে না। আমার ভীষণ টেনশান হচ্ছে পরশ। প্লিজ আপনি একবার এসে দেখে যান।”
এই পর্যায়ে এসে পরশ ভীষন ভড়কে উঠলেন। মুখমন্ডলে উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট। ঝট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে উনি সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হলেন। মা বসা থেকে উঠে দ্রুত পায়ে হেঁটে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছেন আর পেরেশানি গলায় বলছেন,,
“মেয়েটাকে বিগত দু, তিন দিন যাবত খুব আপসেট দেখাচ্ছিল। সময়, সুযোগ বের করে যে জিগ্যেস করব কি হয়েছে মেয়েটার তার ও জোঁ পাচ্ছিলাম না। সব হয়েছে আমার এই কুলাঙ্গার ছেলেটার জন্য। এই এক ছেলের জন্য চিন্তা করতে করতে আমার মেয়েটার দিকে তাকানোরই সময় পাই নি।”
পেছন থেকে পায়েল তিক্ততা মিশ্রিত গলায় মা কে শাসিয়ে বলল,,
“মা প্লিজ। এখন এই কথা গুলো বলা বন্ধ কর। এই সংকটাপন্ন মুহূর্ত গুলোতে ও তোমার অহেতুক বিষয় নিয়ে বকবক করতে হবে? দেখছ, আমরা সবাই টেনশানে আছি আর এই দিকে তুমি আছো আউল ফাউল টপিক নিয়ে ব্যস্ত।”
মা নিশ্চুপ হয়ে পরশের পিছু পিছু পিয়ালী আপুর রুমের দরজায় এসে থামলেন। পর পর কয়েক বার শুকনো ঢোক গিলে পরশ রুমের দরজায় করাঘাত করে চেঁচিয়ে বললেন,,
“পিয়ালী শুনছিস? দরজাটা খোল। এই পিয়ালীলী?”
পরশের পাশাপাশি মা ও কান্নাজড়িত কন্ঠে পিয়ালী আপুকে ডাকতে আরম্ভ করলেন। পায়েল থরথরিয়ে কেঁপে আমার হাত দুখানা চেঁপে ধরে কম্পিত গলায় বলল,,
“আপুর কি হলো ভাবী? আমার না ভীষণ টেনশান হচ্ছে। ভয় ও করছে।”
আমি ও পায়েলের হাত দু খানা চেঁপে ধরে শুকনো গলায় বললাম,,
“আমার মনে হচ্ছে আপুর উডবির সাথে কিছু হয়েছে৷ উভয়ের মাঝে কোনো ঝগড়াঝাঁটি বা কথা কাটাকাটি হয়েছে। যার রেশ ধরেই আপু নির্ঘাত খারাপ কিছু একটা করেছে!”
ইতোমধ্যেই পরশ সামনের চুল গুলো টেনে আতঙ্কিত গলায় বললেন,,
“আই থিংক দরজাটা ভাঙ্গতে হবে। আমি বাহির থেকে লোকজন নিয়ে আসছি।”
মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। ধপ করে ফ্লোরে বসে গুঙ্গিয়ে কেঁদে বললেন,,
“যা করার তাড়াতাড়ি কর পরশ। আমার মন সায় দিচ্ছে না। মনে হচ্ছে মেয়েটা নির্ঘাত খারাপ কিছু একটা করেছে।”
পরশ আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করলেন না। ছুট দিলেন বাড়ির বাইরে। আমি এবং পায়েল মায়ের পাশে বসে মা কে শান্তনা দিচ্ছিলাম। এই পর্যায়ে এসে পায়েল ও ফুঁফিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করেছে। আমি বসা থেকে উঠে দরজায় আবার ও কড়া নাড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মাঝে মাঝে দরজাটায় সজোরে ধাক্কা ও মারছিলাম। যে জায়গায় পরশ একজন সবল পুরুষ মানুষ হয়ে দরজাটার কিছু করতে পারেন নি সে জায়গায় আমি তো দুর্বল এক মেয়ে মানুষ। আমার দ্বারা আর কতটুকুই বা সম্ভব হবে? ধৈর্য্য হারিয়ে দরজাটায় লাস্ট ধাক্কা দিতেই আচমকা মনে হলো যেন অবিশ্বাস্য ভাবেই দরজাটা সত্যি সত্যি খুলে গেল! ঘটনার আকস্মিকতায় আমি প্রকান্ড দৃষ্টিতে দরজার ওপাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখলাম পিয়ালী আপু অর্ধখোলা চোখে এবং ঢুলুঢুলু শরীরে দরজার এক পাশ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। হতভম্বিত হয়ে আমি মুখ হাত চেঁপে ধরে চিৎকার করে বললাম,,
“আপুপুপু?”
চেতনা শক্তি হারিয়ে আপু মাথা ঘুড়িয়ে পড়ে যাওয়ার পূর্বেই আমি আপুকে শক্ত হাতে ঝাপটে ধরে বললাম,,
“কি হয়েছে তোমার আপু? কি করছিলে তুমি রুমে?”
ফটাফট মা এবং পায়েল বসা থেকে উঠে আমার মতোই পিয়ালী আপুকে ঝাপটে ধরে কান্নাজড়িত গলায় সমস্বরে বললেন,,
“এই? কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেনো তুই?”
পিয়ালী আপু এবার সত্যি সত্যিই চেতনা শক্তি হারালেন। শরীরের ভার আমাদের গাঁয়ের উপর ছেড়ে দিলেন। আমি, মা এবং পায়েল পেরেশানগ্রস্থ হয়ে আপুকে কোনো মতে বিছানায় এনে লম্বভাবে শুইয়ে দিলাম। কাঁদতে কাঁদতে মা পিয়ালী আপুর শিথিল হয়ে আসা হাত-পা দ্বয় ঘঁষতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি ডেস্কের উপর থেকে পানির জগ থেকে পানি ঢেলে আপুর সমস্ত মুখমন্ডলে ঠান্ডা পানি ছিঁটাতে শুরু করলাম। পায়েল আপুর মাথার পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে আপুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ইতোমধ্যেই পরশ হম্বিতম্বি হয়ে লোকজন নিয়ে পিয়ালী আপুর রুমে প্রবেশ করলেন। পরশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি গলা জড়ানো স্বরে বললাম,,
“আপু নিজে থেকেই দরজাটা খুলে দিয়েছেন। চলে যেতে বলুন উনাদের। আর যত দ্রুত সম্ভব ডক্টর ডাকুন। আমার মনে হচ্ছে আপু স্লিপিং পিল খেয়েছেন!”
পরশ পিছু ফিরে লোকজনদের ইশারা করে বললেন চলে যেতে। লোকজন রুম থেকে প্রস্থান নিতেই পরশ উদ্বিগ্নতা নিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্যামিলি ডক্টরের নম্বরে ডায়াল করতেই পায়েল হাসি মুখে পেছন থেকে ডেকে বলল,,
“ভাইয়া, ভাবী। আপুর জ্ঞান ফিরেছে!”
আমি এবং পরশ দৌঁড়ে পিয়ালী আপুর মুখোমুখি দাঁড়াতেই পিয়ালী আপু আঁখিদ্বয় বুজে ঢুকড়ে কেঁদে বললেন,,
“সৌরভ আমাকে ঠকিয়েছে! সৌরভ এখন অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইছে!”
মা কান্না থামিয়ে বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েই পিয়ালী আপুর ডান হাতটায় চুমু খেয়ে শান্ত গলায় বললেন,,
“তোদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে তাই তো? কোনো ব্যাপার না মা, আমি এই বিষয়ে সৌরভের পরিবারের সাথে কথা বলব। সামান্য ঝগড়াঝাঁটির জন্য এসব পাগলামো করতে হয় মা? তোর ভাইয়া-ভাবীকে দেখ না? এত ভুল বুঝাবুঝি, এত মারধর, শাসন করার পরে ও দুজন কেমন একসাথে আছে! এদের দেখে ও তো কিছু শিক্ষা নিতে পারিস! টয়াকে আমি কম কথা শুনিয়েছিলাম? এখন ও তো শুনাচ্ছি। হয়তো ভবিষ্যতে ও শুনাব! তাই বলে কি টয়া খারাপ কিছু করে বসবে? রুমের দরজা আটকে বসে থাকবে? স্লিপিং পিল নিবে? পরশকে দেখিস না? কি সুন্দর বউয়ের পক্ষে কথা বলে বউকে শান্ত রাখে? দুজন দুজনের ভালোটা কত বুঝে। সৌরভ ও এমন হবে দেখিস। তোকে খুব বুঝবে। সাময়িক ভুল বুঝাবুঝির কারনে আর কখন ও এমন ভুল সিদ্ধান্ত নিবি না মা। মনে থাকে যেন কথাটা!”
আমি এবং পরশ তাজ্জব দৃষ্টিতে মায়ের দিকে দৃষ্টিগোচর করতেই পিয়ালী আপু হিংস্র গলায় বলে উঠলেন,,
“তোমার ছেলে এবং ছেলের বউয়ের জন্যই আমার বিয়েটা ভেঙ্গে যাচ্ছে মা! তাদের কুকীর্তির জন্যই সৌরভের বাবা-মা বিয়েটা থেকে পিছিয়ে যাচ্ছেন। উনারা বলছেন, যে পরিবারের ছেলে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। পরিবারের মান-সম্মান নষ্ট করতে পারে। সে পরিবারের মেয়ে হয়ে আমি যে ভবিষ্যতে তাদের মান সম্মান নষ্ট করব না তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই!”
পরশ তুখাড় রেগে দাঁতে দাঁত চেঁপে বললেন,,
“সৌরভের পরিবার এবার একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। সৌরভের নাম্বারটা দে তো। আমিই সৌরভের সাথে কথা বলছি!”
মা এবার চটে গেলেন। রাগান্বিত গলায় পরশকে বললেন,,
“সৌরভের সাথে কোনো কথা নেই আমাদের। কথা হবে সৌরভের পরিবারের সাথে। আর সৌরভের সাহস হয় কিভাবে? আমার মেয়েকে সরাসরি বিয়ের ভাঙ্গার কথা বলার? দু পরিবার মিলে বিয়েটা ঠিক করেছিলাম আমরা। সম্পূণ এরেন্জ্ঞ। বিয়ে ভাঙ্গতে হলে সৌরভের পরিবার এসে আমাদের সাথে কথা বলবেন, নয়তো আমরা যাব। এখানে সৌরভ কে হ্যাঁ বিয়ে ভাঙ্গার? সৌরভের পরিবারকে এক্ষনি কল করে বল আমরা বিকেলের দিকে যাচ্ছি সৌরভদের বাসায়। ছেলে খেলা পেয়েছে নাকি? মুখে বলল আর বিয়েটা ভেঙ্গে গেল?”
মায়ের মুখ থেকে কথা টেনে পিয়ালী আপু পুনরায় হিংস্র গলায় বললেন,,
“কেন যাবে ঐ বাড়িতে মা? আমার বিয়েটা ভাঙ্গতে? তোমার ছেলের কুকীর্তি পুনরায় সামনে আনতে? পরিবারের মান-সম্মান ডুবাতে? ছেলেকে নিয়ে খুব গর্ব করতে না? এখন সেই মুখটা থাকবে তো মা? ভাইয়া হাতে ধরে আমাদের পরিবারের বদনাম রটাল। পরিবার, পরিজন, আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সম্মুখে আমাদের পরিবারের মান সম্মান নষ্ট করল। অথচ এক সময় ভাইয়াকে আমি আইডল মানতাম! আর এখন কি? ভাইয়াই আমার জীবনটাকে নষ্ট করে দিল?”
ইতোমধ্যেই ঠাস করে এক চড় পড়ল পিয়ালী আপুর বাঁ গালে। চড়টা অবশ্যই মা মেরেছেন! বাজখাঁই গলায় মা পিয়ালী আপুকে বললেন,
“বাড়ির মেয়ে হয়ে তুই বাড়ির বিরুদ্ধে বদনাম করছিস? নিজের ভাই সম্পর্কে কটুক্তি করছিস? সেই ভাই, যেই ভাই কিনা তোকে এবং পায়েলকে সেই ছোট বেলা থেকে আগলে আগলে আসছে। তোদের যেকোনো প্রয়োজনে আমাদের চেয়ে বেশি ভেবেছে। তোদের দু বোনের জন্য কম সেক্রিফাইজ করে নি আমার ছেলে। আমি স্বচক্ষে দেখেছি আমার ছেলে তার বোনদের জন্য ঠিক কতটুকু করেছে। সেই ভাইয়ের একটা ভুলের জন্য তুই একটা বাইরের ছেলে এবং বাইরের পরিবারের হয়ে কথা বলছিস? মান-সম্মান গেলে আমাদের গেছে। সাফার করলে আমরা করেছি। এতে সৌরভের পরিবারের কি আসে যায়? বিয়েটা ভাঙ্গলে আমরাই ভাঙ্গব! এক্ষনি আমি সৌরভের বাবার সাথে কথা বলছি!”
মা বসা থেকে উঠতেই পরশ মায়ের হাতটা টেনে ধরে মাথা নুঁইয়ে বললেন,,
“থাক না মা৷ বিষয়টাকে এত জটিল করে দেখছ কেন? ঠান্ডা মাথায় ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নাও। আমার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে সৌরভের সাথে পার্সোনালী কথা বলাটা ভীষণ জরুরী। তুমি চাইলে আমি সৌরভের সাথে পার্সেনালী কথা বলতে পারি!”
“তুই না এক কাজ কর। বউয়ের সাথে বসে বসে পার্সোনালী কথা বল!”
হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না! মাকে চেনা বড় দায়। এই ভালো তো এই খারাপ৷ পরশ নির্বোধ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাতেই মা রাগে গজগজ করে বললেন,,
“ব্রেকফাস্ট করে অফিসে যা। জবটা আগে কনফার্ম কর৷ সৌরভের পরিবারের সাথে আমিই কথা বলব। আমার ছেলের বিরুদ্ধে কোনো কটুক্তি আমি সহ্য করব না। আমার ছেলে আমার কাছে সবসময় ঠিক। যা বলার আমি আমার ছেলেকে বলব। মারব, কাটব, বকব যা ইচ্ছে তা করব। বাইরের কেউ অধিকার রাখে না আমার ছেলে সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করার। আমার ছেলের চরিত্র নিয়ে দু কথা বলার।”
রাগে গজগজ করে মা প্রস্থান নিলেন। শুকনো ঢোক গিলে আমি স্বয়ং মনে বিড়বিড় করে বললাম,,
“বাপরে! এতো দেখছি ছেলে অন্ত প্রাণ। পূর্বের তুলনায় আমায় আর ও সাবধান হতে হবে। কিছুতেই মায়ের সামনে পরশের সাথে খারাপ ব্যবহার করা যাবে না। বিন্দু পরিমান রাগ, ঝাল ও দেখানো যাবে না। বর্বর তো ভুলে ও বলা যাবে না। আগের বার তো মা রাগ করে মিলি আপুর সাথেই বিয়ে ঠিক করে নিচ্ছিলেন৷ দেখা যাবে এবার বাড়ি থেকেই আমায় বের করে দিবেন ডিভোর্স পেপার সমেত! তখন পরশের কথা ও মা শুনবেন না। বাপরে বাপ! গাঁয়ের লোম দাঁড়িয়ে উঠছে আমার। মা রা সত্যিই বুঝি এতটা ছেলে পাগল হয়?”
পিয়ালী আপু ঢুকড়ে কেঁদে চলছেন। বেহায়ার মত পরশ পিয়ালী আপুর পাশে বসতেই পিয়ালী আপু পরশ ভাইয়ার হাত জোড়া চেঁপে ধরে কান্নাজড়িত গলায় বললেন,,
“স্যরি ভাইয়া। বিশ্বাস করো? আমি মন থেকে কিছু বলি নি তোমায়। অতি দুঃখে মুখ ফসকে কথা গুলো বের হয়ে গেছে৷ তুমি আমার কথায় কষ্ট পেও না ভাইয়া প্লিজ। তুমি যেমন ভাবীকে খুব ভালোবাসো। তেমনি আমি ও তো সৌরভকে ভীষণ ভালোবাসি। তাই তো আমি বিয়েটা ভাঙ্গতে চাইছি না ভাইয়া। প্লিজ তুমি মা কে বুঝাও ভাইয়া। একটু শান্ত হতে বলো মা কে। তুমি বুঝালেই মা বুঝবেন। পারলে তুমি আজকের মধ্যেই সৌরভের সাথে কথা বলো ভাইয়া প্লিজ!”
পরশ ম্লান হেসে অতি সাবলীল গলায় বললেন,
“তুই চিন্তা করিস না। আমি মাকে ঠিক বুঝিয়ে নিব। জানিসই তো! মা যতোটা গর্জেন ততোটা আসলে বর্ষেন না। আর আজই আমি সৌরভের সাথে কথা বলব এই বিষয়ে। তুই এখন একটু রেস্ট নে। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া কর।”
পিয়ালী আপু মলিন হাসলেন। পরশ দৃষ্টি ঘুড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,
“পিয়ালীর একটু খেয়াল রেখো। মা আজ ভুলে ও এই রুমে আসবেন না। সো তোমাকেই পিয়ালীর খেয়াল রাখতে হবে। মনে থাকবে?”
মাথা নাঁড়িয়ে আমি হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানালাম। মা, আমি, পরশ এবং পায়েল মিলে ব্রেকফাস্ট করে বাকি ব্রেকফাস্ট টুকু নিয়ে আমি পিয়ালীর আপুর রুমে প্রবেশ করলাম। পিয়ালী আপুকে ফ্রেশ করিয়ে খাইয়ে দাইয়ে আমি রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হতেই উপর তলা থেকে পরশের ডাক এলো। বুঝতে পারছি না কি করব এখন! রান্নাঘরে এক গাধা হাড়ি পাতিল পড়ে আছে৷ আগে হাড়ি পাতিল মাজব নাকি পরশের কাছে যাব? দুটানায় ভুগে আমি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেই পেছন থেকে মায়ের গলার স্বর কর্নকুহরে ভেসে এলো। মা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে আসছেন আর তটস্থ গলায় আমায় বলছেন,,
“পরশ ডাকছে কেন শুনে এসো। আমি রান্নার জোগাড় করে দিচ্ছি। পরশ বাড়ি থেকে বের হলেই কাজে লেগে পড়বে। ঘুমিয়ে পড় না আবার! হাত চালিয়ে রান্না করতে হবে। কিছু না বুঝলে অবশ্যই আমায় ডেকে দিবে। আর শুনো? পায়েলকে বলে দিও। আজ ভার্সিটি মিস করতে। পিয়ালীর আশেপাশে থাকতে!”
আমি মাথা নুঁইয়ে বললাম,,
“ঠিক আছে মা!”
মা প্রস্থান নিলেন। আমি ও দু তলায় উঠে প্রথমে পায়েলকে বলে দিলাম ভার্সিটি মিস করে পিয়ালী আপুকে সময় দিতে। এরপর নিজের রুমে প্রবেশ করলাম। পরশ ফরমাল ড্রেসে সিগারেট ফুঁকছেন রুমে! এই বিরক্তি ভরা দৃশ্য দেখতেই আমার ভ্রু উঠে গেল কপালে। চ্যালচ্যালিয়ে হেঁটে আমি লোকটার হাত থেকে সিগারেট টা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললাম,,
“লজ্জা করে না আপনার? রুমে বসে বসে এই অস্বাস্থ্যকর জিনিসটা ফুঁকতে?”
পরশ বিরক্তি সূচক গলায় বললেন,,
“না করে না। আর এর পুরোটা দোষই তোমার!”
“মানে? কি করলাম আমি?”
”এত লেইট করছিলে কেন আসতে? ১৫ মিনিট পর এসেছ। ১৫ মিনিট আমাকে অযথা ওয়েট করতে হয়েছে!”
“কাজ করছিলাম আমি। শ্বাশুড়ী মা ছুটি দিলেই তবে আমায় আসতে হয়।”
নাক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া নির্গত করে পরশ আমার হাত থেকে সিগারেটটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিতেই আমি নাক ফুলিয়ে বললাম,,
“আবার ও আপনি সিগারেটটা নিয়েছেন? কথা শুনবেন না আপনি আমার?”
মুহূর্তের মধ্যে পরশ হাত থেকে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে শক্ত হাতে আমায় ঝাপটে ধরে আমার ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে বললেন,,
“শুনব তো কথা। তোমার নেশা লেগে গেছে এখন! সিগারেটের নেশা তো এর কাছে অতি তুচ্ছ!”
মিটিমিটি হেসে উঠতেই পরশ কিছু সময়ের ব্যবধানে আমায় ছেড়ে ভেজাক্ত ঠোঁট জোড়া মুছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ফাইলসহ অফিসের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিচ্ছেন আর বলছেন,,
“আসছি আমি। সৌরভের সাথে কথা বলেই তবে বাড়ি ফিরব। নিজের যত্ন নিও। আর মা, পিয়ালী, পায়েল সবার খেয়াল রেখো। কিছু না বুঝলে মা কে অবশ্যই ডেকে দিও।”
#চলবে…?
(তাড়াহুড়োর মধ্যে লিখেছি। রি-চেইক ও করা হয় নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)