#তোমার স্মৃতি
#পর্বঃ১৪
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
নিবিড় আর ভাবতে পারলো না। নিবিড় আজিজ সাহেবকে জোর করায় আজিজ সাহেব নিবিড়কে পাশে রেখেছেন তিনি। নিবিড় চুপ করে সানজিদার হাত ধরে বসে আছে। সানজিদার হাতের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিবিড় হঠাৎ তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মাথাটা যেন তার ভনভন করছে। সারাশরীর ঝিমঝিম করছে তার। হঠাৎ সে পড়ে গেল। আজিজ সাহেব ফুস করে একটা শ্বাস ছাড়লো। তিনি এটার জন্যই নিবিড়কে অপারেশন থিয়েটারে আসতে মানা করেছিলেন। তিনি ইশারায় নিবিড়কে নিয়ে যেতে বললেন। দুইজনের মিলিত হাত ছুটে যায়।
প্রায় অনেকক্ষণ পর জ্ঞান ফেরে নিবিড়ের। সে নিজেকে আবিষ্কার করলো হাসপাতালের বেডে। সানজিদার কথা মাথায় আসতেই নিবিড় উঠে পড়ল। ছুটে চলে গেল সানজিদার অপারেশন থিয়েটারের সামনে। সেখানে ডাক্তারদের একসঙ্গে আলোচনা করা অবস্থায় দেখতে পায়। তাদের মুখে এক অন্যরকম গম্ভীরতা। তাদের এমন গম্ভীরতা দেখে নিবিড়ের বুক ধক করে উঠলো। তাকে দেখেই সবাই চুপ করে যায় আজিজ সাহেব ও মাথা নিচু করে আছে।
নিবিড় অস্থির হয়ে সবাই জিঙ্গাসা করতে লাগলো “স্যার সানজিদা কেমন আছে। বলেন প্লীজ আমার সানজিদা কি হয়েছে বলুন আমি আর পারছিনা।”
আজিজ সাহেব চুপ করে আছেন। তখন সেখানকার একটা ডাক্তার বলল
“সানজিদাকে আমরা অনেক বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু….!”
নিবিড় অস্থির হয়ে বলল “কিন্তু কি!”
ডাক্তারটি মাথা নিচু করে বলল “সানজিদাকে আমরা বাঁচতে পারিনি।”
নিবিড় যেন তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। সারাদুনিয়া তার ঘুরছে। নিবিড়ের চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। যেন রক্ত গড়িয়ে পড়বে এখনই। সে ধপ করে মেঝেতে বসে পরলো। সে কি যেন বিরবির করতে লাগলো। আজিজ সাহেব সহ সেখানকার সকল ডাক্তার মাথা নিচু করে আছে। পরিবেশটা থমথমে হয়ে আছে। হয় তো পরিবেশটাও নিবিড়ের সঙ্গে থমকে গিয়েছে।
———–
কেটে গেছে তিনদিন। সানজিদার জানাজার নামাজের সময়ই নিবিড় অজ্ঞান হয়ে যায়। নিবিড় যেন পাগল হয়ে গিয়েছে। অনেক কষ্টে দাফন দেওয়া হয়েছে সানজিদাকে। সে সানজিদাকে কিছুতেই ছাড়বেনা। বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। চোখ বেয়ে নোনা জল গরিয়ে পরছে তার। এতো কষ্ট হয় তো সহ্য হচ্ছিল না। তাই তো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে।
প্রায় একদিনপর জ্ঞান ফিরে আসে নিবিড়ের। নিবিড়কে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। রেহেলা বেগমও অস্থির হয়ে গিয়েছে। আর শশী তো চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সবদিকে খেয়াল রাখতে। কিন্তু সে যে পারছে না। তারজীবনে অনেকটা জায়গা নিয়ে ছিল মেয়েটা। সেই মেয়েটা আর নেই। ভাবতেই তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
নিবিড় চোখ পিটপিট করে তাকাতেই শশীকে দেখতে পেল। সে জানালার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নিবিড় উঠে বসলো সে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাড়ালো। এতক্ষণে শশী নিবিড়ের জ্ঞান ফিরেছে সেটা বুঝতে পেরেছে। সে এগিয়ে আসে নিবিড়ের দিকে। সে নিবিড়ের দিকে তাকাতেই অবাক হয়ে যায়। নিবিড়ের হাত বন্দুক দেখে শশী চোখ গোলগোল করে বলল “ভাইয়া আপনি কি করছেন এগুলো। রাখুন এটা।”
নিবিড়ের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। সে শশীকে ইগনোর করে চলে যেতে নিলেই শশী বলে উঠলো “ভাইয়া আপনি যদি রোহান ভাইয়ার কাছে যাওয়ার কথা ভেবে বেরিয়ে যেতে চান তাহলে লাভ নেই। ওনিও চারদিন আগে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করেছেন। আর ওনার মাও অসুস্থ হাসপাতালে। বাঁচবেনা বললেই চলে।”
শশীর কথায় নিবিড়ের পা থেমে গেল। কি বলছে এগুলো শশী। আজ ওই রোহানের জন্যই তো তার সানজিদা তার থেকে এতো দূরে চলে গিয়েছে। শশী নিবিড়কে থামতে দেখে ও দৌড়ে রুম থেকে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আবারও দৌড়ে আসে। হাতে একটা বক্স তার। সঙ্গে দুইটা ডায়েরি। নিবিড় প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে শশীর দিকে তাকিয়ে আছে। শশী নিবিড়ের রুমে থাকা সোফায় বসলো। নিবিড় ধীর পায়ে সোফায় বসে। নিবিড় দুইটা ডায়েরির মধ্যে একটা চেনে। একটা সানজিদার ডায়েরি কিন্তু আরেকটা। নিবিড় শশীর দিকে তাকিয়ে কিছু জিঙ্গাসা করতে নিবে তার আগেই শশী একটা সাদা কাগজ এগিয়ে দিলো আর বলল
“রোহান ভাইয়ার চিঠি সানজিদা জন্য লেখা। আর ওই যে ওইদিন আপনাকে পারসেল এর কথা বলেছিলাম ওই পারসেলে এই চিঠি ডায়রি আর কিছু সাদা গোলাপ আর কাঠগোলাপ ছিল।”
কপালে ভাঁজ ফেলে নিবিড় বন্দুক রেখে চিঠিটা খুললো চিঠিটা পড়তে লাগলো
প্রিয় বউ,
আমি জানি তোমাকে আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি চেয়েছিলাম তুমি ভালো থাকো। তুমি হয় তো আমাকে বেইমান মনে করছো। কিন্তু আমি বেইমান না। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি। আমি তোমার সুখের জন্য তোমার সঙ্গে এমন নাটক করেছি। জানো তো আমার নিজের ও অনেক কষ্ট হয়েছিল। বুকের বাঁ পাশটায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে। কিন্তু আমার যে করার কিছুই ছিল না। জানো আমি চেয়েছিলাম তুমি ভালো থাকো। সুখে থাকো। তাই তো তোমাকে ইগনোর করেছিলাম। জানো তো আমি যখন থেকে জানতে পেরেছি আমার দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমার হাতে বেশিদিন সময় নেই। সেইদিন যেন আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল। আমি ডিসিশন নিয়েছিলাম তোমাকে আমি বুঝতে দিবোনা যে আমার এতো বড় অসুখ বেঁধেছে আমার শরীরে। আমার অসুখের কথা শুনলে তোমাকে আমি স্বাভাবিক রাখতে পারবোনা। তুমি কষ্ট পাবে। যা আমি সহ্য পাবোনা। বেইমান ভেবে সরে যাবে। ঘৃণা করবে এটাই লক্ষ ছিল আমার। আমি সব খারাপ কাজ করতে লাগলাম। কিন্তু তুমি তাও আমাকে ছাড়ছিলে না। ডিভোর্সের ব্যবস্থা করেছিলাম যাতে আমার মৃত্যুর পর তুমি খোঁজ ও না নেও। কিন্তু তুমি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেনা। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম। কি করবো না করবো। এইদিকে ডাক্তার বলেছিল আমার বাঁচার কোনো উপায় নাই। শেষমেশ আমি সবচেয়ে খারাপ কাজটি করে ফেলি। সেইদিন আমি তোমার চোখে আমি ভালোবাসা ছাড়া ঘৃণা দেখতে পাই। জানো আমার খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু এটা ভেবে ভালো লাগছিলো যে তুমি আমাকে ঘৃণা করে আমাকে ছেড়েছো। আমি জানিনা তুমি কখনো এই চিঠি পাবে কিনা। যদি পাও হয় তো তখন আমি আর থাকবোনা। তবে একটা কথা কি জানো শশীর বাবা কিন্তু আমার শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমার কথায় তোমাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি। ওনার ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবোনা। আমি তোমার সব খবর পেতাম তার কাছ থেকে। কিন্তু তিনি হঠাৎ মারা যাওয়ায় আমি দিশেহারা হয়ে পড়ি। যাইহোক কেন জানি তোমাকে নিয়ে প্রতিদিন ভেবে ডায়েরি লেখতে না পারলে একটুও ভালো লাগে না। জানো তো আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। আল্লাহ যেন তোমাকে ভালো রাখে। জীবনে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারো। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি প্রিয়া। অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি। তুমি আবার নিজের জীবন সুন্দর করে সাজিয়ে নিও।
ইতি
তোমার বেইমান পুরুষ
রোহান
নিবিড়ের চোখ বেয়ে পানি পরতে লাগলো। সে যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। কতটা ভালোবাসা হলে মৃত্যু একসঙ্গে হয়। আসলেই ওদের ভালোবাসাটা ছিল পবিত্র সুন্দর। কিন্তু ওদের পরিণতি তো এমন না হলেও পারতো। কেন হলো এমন।
শশী গলা পরিষ্কার করে বলল “ভাইয়া এই পারসেলটা রোহান ভাইয়ার আম্মুই পাঠিয়েছে। যা তিনি আমাকে দুইদিন আগে ফোনে জানায়। ভাইয়া সত্যিই আমি কল্পণাও করিনি যে বিষয়টি এমন হতে পারে। দুইজনের ডায়েরি পড়ে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। দুইজনই চেয়েছিল অপরজনের ভালো থাকতে দেখে। কিন্তু…!” বলেই শশী আর কিছু বলতে পারলো না।
চলবে….