তোমার স্পর্শে পর্বঃ ০২

0
3674

তোমার স্পর্শে পর্বঃ ০২
– আবির খান

এরপর দীর্ঘ ৪ ঘন্টা কেটে যায়। ওটি থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এসে আমাদের যা বললেন তার জন্য আমি আর আমার বন্ধু মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সে বললেন,

ডাক্তারঃ দেখুন, রোগী এখন বিপদ মুক্ত। কিন্তু…

আমিঃ কিন্তু কি?? চিন্তিত হয়ে।

ডাক্তারঃ কিন্তু সে তার স্মৃতি শক্তি হারাতে পারে। আসলে রোগী মাথার ঠিক জটিল স্থানেই বেশি আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। জ্ঞান ফিরলেই বুঝা যাবে। এখন বাকিটা আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা।

আমি ডাক্তারের কথা শুনে ঠাস করে বসে পরলাম। আমার জন্য মেয়েটা আজ তার স্মৃতি শক্তি হারাতে বসেছে। রাফি পাশ থেকে আমাকে স্বান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু কিভাবে আমি শান্ত থাকবো!! মেয়েটার এখন কি হবে?? কে এই মেয়ে?? কি তার পরিচয়?? কোনো কিছুই আমি জানি না। কেন এমনটা হলো আমার সাথে?? আল্লাহ তুমি সাহায্য করো।

রাফিঃ ভাই শান্ত হ। সব ঠিক হয়ে যাবে। ৭২ ঘন্টার আগেই দেখবি জ্ঞান চলে এসেছে। চিন্তা করিস না।

আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না। হাজারো চিন্তা মাথার ভিতরে ঘুরপাক কাচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চিন্তা হলো মেয়েটা তার স্মৃতি শক্তি আবার না হারিয়ে ফেলে। সে সব চিন্তা নিয়ে আমি বসে আছি বাইরে।

একটা কথা আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত পোহাতে হয়। ঠিক তাই হলো। গত দুই দিনে মেয়েটির জ্ঞান ফিরে আসে নি। আজ যদি তার জ্ঞান না ফিরে আসে, তবে সে স্মৃতি শক্তি হারাবে না বরং ডিরেক্ট কোমায় চলে যেতে পারে। সারাদিন শুধু আল্লাহকেই ডাকছি। হঠাৎই..

নার্সঃ আপনাদের পেসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।

নার্সের কথায় যেন অামার জানে জান আসলো। কিন্তু সাথে আরো একটা বড় ভয় মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগলো। আমি আর রাফি দ্রুত মেয়েটার কাছে চলে যাই। ডাক্তারও ছিলেন।

আমিঃ স্যার, ও কি ঠিক আছে?? অস্থির ভাবে।

ডাক্তারঃ সরি আবির সাহেব, আমরা যা ভয় পেয়েছি তাই হলো। উনি ওনার স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। উনি কিচ্ছু বলতে পারছেন না নিজের সম্পর্কে।

ডাক্তারের কথাটা যেন আমার বুকের মাঝে অজস্র তীরের মতো এসে লাগলো। শুধু আমার কারণেই মেয়েটা আজ স্মৃতি শক্তি হারালো। শুধু আমার কারণে। আমি ধীরে ধীরে মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেলাম।

মেয়েটা চোখ খুলে তাকিয়ে আছে। আমি কাছে যেতেই আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছি না। আমার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। কি নিষ্পাপ তার চোখের চহনি। কিন্তু অসুস্থতা তাকে বড় অসহায় করে দিয়েছে। আমি আর পারলাম না তার দিকে তাকিয়ে থাকতে। দ্রুত ডাক্তারের কাছে ছুটে গেলাম।

আমিঃ স্যার স্যার, ওর কি আর কোনো দিন স্মৃতি শক্তি ফিরে আসবে না?? অসহায় ভাবে।

ডাক্তারঃ অবশ্যই আসবে। তবে তার খুব ভালো যত্ন নিতে হবে। মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে৷ কোনো প্রকার ব্রেনে চাপ দেওয়া যাবে না। ভালো যত্নই তাকে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তুলবে।

আমিঃ কতদিন লাগতে পারে ডক্টর??

ডাক্তারঃ দেখুন, এটা এমন এক মেডিকেল টার্ম যে তার স্মৃতি শক্তি চাইলে কালও আসতে পারে আবার ১/২ বছর পরও। তবে আমরা ঔষধ লিখে দিচ্ছি। ঠিক মতো খাওয়ালে ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি তিনি সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু মোট কথা তার ভালো সেবাশুশ্রূষা করতে হবে। অন্যথায় আমাদের আর কিছু করার থাকবে না।

বলেই ডাক্তার চলে গেলেন। আমি কেবিনের সোফায় গিয়ে ঠাস করে বসে পরলাম। রাফিও এসে বসলো আমার পাশে আর বলল,

রাফিঃ দোস্ত, এখন কি করবি?? কে দেখবে এই মেয়েকে?? কে ওর যত্ন নিবে?? ওর পরিবারের কাউকেই তো আমরা চিনিনা।

আমার মাথাটা বেশ ব্যাথা করছে। ভার হয়ে আছে। কোনো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। সব কেমন ঘোলাটে লাগছে৷ রাফির কথাগুলো মাথার মধ্যে ঝড় তুলেছে।

আমিঃ দোস্ত, এক কাপ চা এনে দিতে পারবি?? আস্তে করে বললাম।

আমার এমন ভাবে আবদার শুনে রাফি হতভম্ব হয়ে যায়। কিন্তু দ্রুত উঠে বাইরে চলে যায়। আর ফিরে আসে এক কাপ না দুকাপ চা নিয়ে।

রাফিঃ নে দোস্ত তোর চা। দুধ ছাড়া কড়া লিকার দেওয়া আর দেড় চামচ চিনি দেওয়া।

আমি চা’টা নিয়ে সব ভুলে চুমুক দিলাম। চা খাচ্ছি আর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি। সে নিথর হয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। তার সেই চাহনি দেখে আমার চোখের কোনায় নোনা জল এসে পরেছে। চা’টা শেষ করতেই আমি আমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাই।

রাফিঃ কিরে এভাবে জেগে উঠলি যে??

চায়ের কাপটা পাশে রেখে বললাম,

আমিঃ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।

রাফিঃ কিসের??

আমিঃ ওকে আমিই দেখাশোনা করবো। আর ওর যত্ন আমিই করবো। আমার কারণেই যেহেতু ওর এই অবস্থা তাই আমিই ওর সব করবো।

রাফিঃ পাগল হলি নাকি?? তুই একা মানুষ কিভাবে কি করবি?? তার চেয়ে ওকে এখানে ভর্তি করে দে।

আমি চোখদুটো বড় করে রাফির দিকে তাকিয়ে বললাম,

আমিঃ না দোস্ত না। তাকিয়ে দেখ কি নিষ্পাপ মেয়েটা। ওকে এখানে রেখে গেলে ওর ক্ষতি হবে। আমি না আমার মন বলছে। আমার চেয়ে ওর ভালো খেয়াল আর কেউ রাখতে পারবে না। আমাকেই ওকে সুস্থ করে তুলতে হবে।

রাফিঃ সব ভেবে বলছিস তো?? ও কিন্তু একটা মেয়ে।

আমিঃ তো কি হয়েছে?? আমি সেই কাপুরুষ না যে একটা অসহায় মেয়েকে এভাবে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যাবো। হাজার কষ্ট হলেও ওর সব দায়িত্ব আমার। আমার কারণেই আজ ওর এই অবস্থা। তাই আমিই ওকে দেখবো।

রাফিঃ তুই বার বার নিজেকে কেন দোষ দিচ্ছিস। ও নিজেই তোর গাড়ির সামনে এসে পরেছে। তুই ইচ্ছা করে ওর গায়ে উঠিয়ে দিসনি তো।

আমিঃ যাই হোক। ওকে আমি একা ছাড়বো না ব্যাস।

রাফিঃ তাহলে কি করবি??

আমিঃ আমার বাসায় নিয়ে যাবো।

রাফিঃ তোর অফিস??

আমিঃ দরকার হলে কয়েকদিন যাবো না। কিন্তু ও আমার কাছেই থাকবে।

রাফিঃ পারবি ওর সব করতে??

আমিঃ আমাকে পারতে হবে দোস্ত। তুই সাথে থাকবি না??

রাফিঃ আবার জিজ্ঞেস করতে হয়। সাথে আছি সবসময়। বন্ধুর বিপদে যদি বন্ধুই পাশে না থাকে তাহলে কিসের বন্ধুত্ব। আছি দোস্ত সাথে আছি।

আমিঃ তাহলে আর কোনো সমস্যা নেই। চল ডক্টরের কাছে যাই।

রাফিঃ চল।

ডাক্তারের কাছে,

আমিঃ স্যার, ওকে কবে রিলিজ দেয়া যাবে??

ডাক্তারঃ আমরা ওনাকে আরো দুদিন অব্জার্ভেশনে রাখবো। যদি সব ভালো থাকে তারপর ওনাকে নিয়ে যেতে পারবেন। তবে মেইক সিউওর ওনার যেন কোনো অযত্ন না হয়।

আমিঃ জ্বি না কখনোই হবে না।

ডাক্তারঃ আচ্ছা উনি আপনাদের কি হন তাইতো জানা হলো না।

আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। পাশ থেকে রাফি বলে উঠলো,

রাফিঃ স্যার, ওর স্ত্রী।

ডাক্তারঃ ওহহ। আগে বলবেন না।

আমি রাফির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি। পরে বাইরে এসে,

আমিঃ তুই এটা কি বললি ভাই??

রাফিঃ আর কি বলতাম বল?? ও তোর গাড়িতে এক্সিডেন্ট করছে। ওর পরিবারের কোনো খবর নাই। পরে থানা পুলিশ আরো কত কিছু। তার চেয়ে তোর বউ বলছি যাতে আর কোনো প্রশ্ন না করে।

আমিঃ ওহহ আচ্ছা। চল ওর কাছে যাই। একা শুয়ে আছে।

২ দিন পর,

ডাক্তারঃ এখানে ওনার সব ঔষধ লিখা আছে। আর কোনটা কিভাবে খাওয়াতে হবে তাও লিখা আছে। খুব যত্ন সহকারে ওনার খেয়াল রাখবেন। আর তাকে কোনো ধরনের চাপ দেওয়া যাবে না।

আমিঃ জ্বি স্যার অবশ্যই।

ডাক্তারঃ তাহলে এখন ওনাকে আপনারা নিয়ে যেতে পারেন।

আমিঃ আচ্ছা। ধন্যবাদ স্যার।

এরপর আমি আর রাফি মিলে মেয়েটাকে গাড়িতে করে আমার বাসায় নিয়ে আসি। রাফি গাড়ি ড্রাইভ করছিলো। মেয়েটা আমার কাঁধে মাথা দিয়ে পুরো রাস্তা বসে ছিলো। এখন অবধি ও আমার সাথে একটা কথাও বলেনি। অবশ্য আমি কিছু জিজ্ঞেসও করিনি। চুপচাপ বসে ছিলো। শুধু মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল আমার দিকে। যেন আমি কে ও জানতে চায়।

আমার বাসায়,

আমি আর রাফি ওকে আমার মাস্টার বেডরুমে শুইয়ে দিয়ে আসি। আমি আর রাফি সোফায় বসে আছি। রাফি গাল চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞাসা করলো,

রাফিঃ দোস্ত মেয়েটার নাম, ঠিকানা কিছুইতো জানি না। কিভাবে ওর পরিবারকে খুঁজে বের করবি??

আমিও রাফির কথা শুনে চিন্তায় পরে গেলাম। আসলেইতো কিভাবে?? হঠাৎ মনে পরলো সেই কালো ব্যাগের কথা। আমি দৌড়ে গিয়ে সেই বড় কালো ব্যাগটা এনে রাফির সামনে রাখি আর বসতে বসতে বলি,

আমিঃ এই ব্যাগই আমাদের বলতে পারবে এই মেয়ে কে??

চলবে….

সবাই সাথে থাকুন। আর কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে