#তোমার_সন্ধানে
#ফারজানা_আফরোজ
৫
–” আমার কোনো দোষ নাই সব দোষ বাতাসের।”
শুদ্ধ কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিয়তির চোখের দিকে। সে স্পষ্ট ভয় দেখতে পাচ্ছে মেয়েটির চোখে। গতকাল রাতের বাঘিনী মেয়েটির সাথে আজকের মেয়েটির কোনো মিল নেই। শুদ্ধ চোখজোড়া সরিয়ে নিলো। তার কাছে মেয়ে মানুষ মানেই কালসাপ। নারী যেমন সংসার গড়তে পারে ঠিক তেমন ভাবেই ভেঙে দিতে পারে। নিয়তি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ অভ্র গিয়ে নিয়তির সামনে দাঁড়িয়ে হাত ভাঁজ করে বলল,
–” আরেহ কুইন এইখানে ভয়ের কিছু নেই। জাস্ট অ্যাকসিডেন্ট। হ্যাভ এ রিল্যাক্স, সী ইউ নট ফর মাইন্ড।”
অভ্রের কথা শোনে হেসে ফেলল নিয়তি। এতক্ষণ পর যেন কলিজায় পানি আসলো তার। সেও অভ্রের সাথে মজা করে বলল,
–” ইংলিশ ছাড়া কথা বলি না হিহিহিহি।”
বৃষ্টির ফোঁটা ধীরে ধীরে পড়তে লাগলো। তিনজন এক দৌঁড়ে দোকানের ছাউনির কাছে দাঁড়ালো। নিয়তির ইচ্ছা করতেছে ভিজতে কিন্তু মানুষজন থাকায় ইচ্ছাটা মাটি চাপা দিতে লাগলো।
–” মিস কুইন? এইখানে হঠাৎ তাছাড়া আপনার শিশু ফ্রেন্ড তাকে তো দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় উনি?”
অভ্রের কথা শোনে আবারো হাসলো নিয়তি। লোকটা আসলেই মিশুক। কত্ত বড় রিপোর্টার আর তার সাথে কি সুন্দর করেই না কথা বলছে। আর অন্যদিকে এলিয়েনের চাচাতো ভাই শুদ্ধ মুখ গোমড়া করে বৃষ্টি দেখছে। লোকটার কথা বলতে কি কষ্ট হয় নাকি তাই ভাবছে নিয়তি।
–” ওর সামনে শিশু ডাকবেন না তাহলে আপনাকে ওয়ার্নিং ছাড়াই খুন করে ফেলবে । আর ও ভার্সিটি।”
–” আপনি যাননি?”
–” আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না।”
এইভাবে কথা বলতে থাকে অভ্র এবং নিয়তি কিন্তু শুদ্ধ সেই চুপচাপ। অভ্র কিংবা নিয়তির কথা তার কানে যাচ্ছে নাকি সন্দেহ। আপনমনে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছে সে। কিছু যে একটা ঘটেছে শুদ্ধর ভালোই বুঝতে পেরেছে অভ্র।
নিয়তি এবং মিশু পড়ছিল তখনই নিয়তির আম্মু ফোন দিল,
–” কি করছিস?”
–” কিসের জন্য পাঠিয়েছ এইখানে সেটাই করছি।”
–” ফাজিল। শোন তোকে কাল আসতে হবে।”
–” কোথাও বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে মনে হয়। শুনো আম্মু, আমি সিদ্ধান্ত নিছি এখন থেকে অন্যের বিয়ের দাওয়াত খেতে যাবো না। বিয়ের দাওয়াত যদি খেতেই হয় তাহলে নিজের বিয়ের দাওয়াত খাবো। আচ্ছা আম্মু আমার জন্য কোনো সম্মন্ধ আসে না? আমাদের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে কী কেউ নাই আমাকে বিয়ে করার?”
–” আল্লাহ তুমি আমারে কি মেয়ে দিছো। মায়ের কাছে নিজেই নিজের বিয়ের কথা বলে। আমাদের সময়ে আমরা বিয়ের কথা শুনলেই লজ্জায় মুখ লাল করে ঘরের এক কোনায় বসে থাকতাম আর আমার মেয়ে কিনা ঠোঁট কাটা।”
–” আচ্ছা আম্মু তোমাদের কি নাতি নাতনির সাথে খেলতে ইচ্ছা করে না? সুমা আপুর মেয়ে নিয়ে দেখছি দিব্যি আছো। বলি আমার বাচ্চা কাচ্চা দেখতে হবে না।”
এইসব বলেই হাসতে লাগলো নিয়তি। মিশু তো সেই কখন থেকে পেট ধরে হেসে যাচ্ছে । নিয়তি ছোট থেকেই এমন বড্ড দুষ্টু। নিয়তির মা হাসি বন্ধ করে আনন্দ মাখা কন্ঠে বলল,
–” আগামীকাল চলে আছিস সারপ্রাইজ আছে তোর জন্য!”
–” কি সারপ্রাইজ আম্মু?”
–” বললে সারপ্রাইজ থাকবে না আর সাথে মিশুকে নিয়ে আছিস।”
–” যা হুকুম মাতাজী।”
ফোন কেটে দিয়ে নিয়তি ভাবতে লাগলো কিসের সারপ্রাইজ। মিশু সন্দিহান নজরে তাকিয়ে বলল,
–” তোর বিয়ে টিয়ে নয়তো আবার?”
চোখ জোড়া ছোট ছোট করে মুখ বাঁকিয়ে বলল নিয়তি,
–” আমার আব্বাজান কখনোই দিবে না বিয়ে। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও না। তবে কিসের সারপ্রাইজ সেটা নিয়ে একটু চিন্তিত আমি। আচ্ছা বাদ দে, আগামীকালই সব বুঝা যাবে।”
–” হুম।”
বড় দুতলা বাড়ি। চারপাশ জুড়ে নানান ধরনের গাছের বাহার। বাড়ির উঠোনের দিকটায় বিভিন্ন ধরনের ফুল গাছ। সাইকেলের টুং টুং শব্দে একদল বাচ্চা গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বাচ্চাদের চোখে মুখে রাজ্যর খুশি। নিয়তি এবং মিশু দুজন ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে উঠোনের সামনে দাঁড়িয়ে বুঝার চেষ্টা করছে, কি হয়েছে হঠাৎ? বাড়িতে এত মানুষই বা কোথা থেকে আসলো? এমনিতেই তাদের বাবার বাড়ির গুষ্টি রাজ্য জুড়ে, মামার বাড়ির গুষ্টির তো অভাব নেই। দুই গুষ্টির মানুষজনের অভাব নেই বাসায় আজ। মিশুর ভ্রু জোড়া কুচকে এলো, নিয়তির চোখজোড়া বারবার অবাক হওয়ার উপক্রম। একদল বাচ্চা দৌঁড়ে নিয়তির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো আর চিল্লিলে বলতে লাগলো,
–” বউ এসেছে , বউ এসেছে।”
বউ এসেছে ডাক শোনে রুমের ভিতর থেকে ভাবী, বড় আপুরা বেরিয়ে আসলো। নিয়তিকে দেখে তারা অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। বড় ভাবী তো বলেই ফেলল,
–” আগে শুনতাম কিংবা দেখছি বর এসেছে বলে বাচ্চারা চিৎকার করে কিন্তু আজকাল বউ এসেছে বলেও যে চিৎকার চেঁচামেচি হয় জানতাম না। নিয়তি বলতে হবে তোমার ব্যাপার সেপার।”
বিয়ে নামক শব্দ শোনে নিয়তি এমনিই অবাক। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না তার যে বিয়ে হতে চলেছে। তার কি এমন খুশি হয়ে নাচা শুরু করে দেওয়া উচিত নাকি হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের জন্য রাগী মুড করে থাকা উচিৎ? উচিৎ অনুচিত দুটনায় পরে সে বিভ্রান্ত। তার চোখ এখন তার বাবাকে খুঁজতে ব্যাস্ত। কেন যেন মনে হচ্ছে তার বাবাকে কোথাও কেউ পাঠিয়ে দিয়ে এই ভয়ানক কাজকর্ম করতে যাচ্ছে।
সাদা পাঞ্জাবি গায়ে দেওয়া একজন অর্ধেক বয়সী লোককে দেখে দৌঁড়ে গেল নিয়তি। বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলতে লাগলো,
–” বিয়ের কথা বলি বলেই কি আমি বিয়ে করতে চাই নাকি? আমি তো আরো দশ বারো বছর পর বিয়ে করব। বাবা আমি কিছুতেই বিয়ে করব না।”
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে ঠোঁটের কোনায় হাসি ঝুলিয়ে বললেন মিস্টার নিয়াজ আহমেদ,
–” আমি তো জানি তাই এখন শুধু কাবিন আর রিং পরানো হবে। কিছুদিন পর বিয়ে।”
–” পাত্র কে? যাকে চিনি না জানি না তাকে বিয়ে করব না আমি হুহু।”
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন নিয়াজ আহমেদ। নিয়তি খেয়াল করলো তার কপালে তরল জাতীয় কিছু টপটপ করে পড়ছে। চোখ মেলে তাকালো সে, বাবার চোখের পানি দেখে নিমিষেই মনটা হাহাকার করতে লাগলো।
–” আব্বু তুমি কান্না করছ কেন? আমি কি খুব বাজে কথা বলেছি?”
–” আমার ছোট্ট মেয়েটা কবে এত বড় হয়ে গেল। এই তো কিছুদিন আগেও তার বায়না ছিল পুতুল কিনে দেওয়া আজ নাকি সেই মেয়ের বিয়ে।”
–” কিন্তু হঠাৎ করে বিয়ে আমি ত কিছুই জানি না আব্বু।”
–” একমাস ধরেই কথা হচ্ছে বিয়ের। ভেবেছিলাম বিয়ের দিন সকালে তোমায় সারপ্রাইজ দিবো। তাছাড়া ছেলেটা লাখে এক। ফ্যামিলিও ভালো। সেই কারণে আর না করিনি। তাছাড়া তুমিও বিয়ে বিয়ে করছিলে তাই ভাবলাম বিয়েই দিয়ে দেই পরে আবার ঠিক করলাম এখন কাবিন আর রিং পড়ানো হোক পরে না হয় বিয়ে। এতদিনে তোমরা দুজন দুজনকে চিনতে সুবিধা হবে।”
নিয়তি আর কথা বাড়ালো না। সে জানে তার বাবা তার খারাপ হোক এমন কিছুই করবে না। একমাস ধরে যেহেতু বিয়ের আলাপ আলোচনা চলছে তার মানে দেখে শুনেই হচ্ছে।
নিজের রুমে ঘুমটি মেরে বসে আছে নিয়তি। মিশু অসহয়সের ভঙ্গিমা নিয়ে চোখ দুটো ছোট ছোট করে বলতে লাগলো,
–” একটু তো কান্না করতে পারিস বোন। আমাকে তো আনা হয়েছে তোর কান্না থামানোর জন্য সেই কখন থেকে বলছি একটু কান্না কর আমি শান্তনা নামক শব্দটি দিয়ে তোকে বুঝায় এই বলে যে, মেয়ে হয়ে জন্ম যেহেতু নিয়েছিস পরের ঘরে যেতে হবে, কান্নাকাটি বন্ধ কর এই যুগের মেয়েরা কান্না করে না , কিন্তু না তোর চোখে মুখে তো আমি হতাশ নামের ছিন্ন ভিন্ন দেখছি না।”
–” আশ্চর্য, আমার কান্না না আসলে আমি কি করবো? পেঁয়াজ কেটে কি কান্না করব নাকি আজব?”
নিয়তির কথা শোনে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠলো মিশু। নিয়তির মাথায় চাপড় মেরে বলতে লাগলো,
–” এত্ত ভালো বুদ্ধি দেওয়ার জন্য ধনেপাতা। আমি এক্ষুনি গিয়ে পেঁয়াজ আনতেছি। পেঁয়াজ কাটাও হবে আবার কান্নাও হবে, আমার শান্তনা দেওয়াও হবে একই বলে এক ঢিলে তিন পাখি শিকার করা।”
চলবে,
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।