তোমার নেশায় আসক্ত ২ পর্ব-১৩

0
1658

#তোমার_নেশায়_আসক্ত
#সিজন:2
#পর্ব:13
#Suraiya_Aayat

কোনরকম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আরু বাসায় সামনে এলো , শরীরটা ইতিমধ্যে ঠান্ডায় কাঁপছে তার উপরে মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানিতে চমকে উঠছে ও ৷ বারবার চোখের সামনে একটাই দৃশ্য ভেসে উঠছে , আর আরিশের স্পর্শগুলো কে বারবার অনুভব করার চেষ্টা করছে ৷ মুহূর্তগুলোকে বারবার স্মৃতিচারণ করতেও যেন আজ ওর মাঝে বিরক্তি কাজ করছে না ৷ কেন এ অদ্ভুত অনুভূতি ও নিজেও জানেনা ৷ এই প্রথম কোন পুরুষের ছোঁয়া পেয়েছিল তাও আবার এতটা গভীর ভাবে পাবে তা ভাবেনি ৷ মাথায় হাজারো সমস্ত চিন্তাভাবনা করছে আর বারবার মনের মাঝে উদয় হচ্ছে অদ্ভুত এক অনুভূতি আরিসের প্রতি , যা আগে কখনো হয়নি ৷
__” এর কারণ কি ? তাহলে কি আমি ওনাকে,,,,,,”
পর মুহূর্তে আবার আরু নিজের মনে মনে বলতে লাগল,,,,,,
__” না না , আমি এসব কি বলছি , ইউ আর স্টুপিড আরু ৷”

কথাটা কে বারবার উপেক্ষা করার চেষ্টা করছে ৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভোলার জন্য আরু আর দেরি না করে কাঁপা কাঁপা হাতে কলিং বেলটা বাজালো….

চটজলদি করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আরুর আম্মু দরজাটা খুলে দিল…..
দরজা খুলতেই ঝাঁজালো কন্ঠে উনি গর্জে উঠলেন,,,
__” তুই এভাবে ভিজলি কেন ? এত বৃষ্টির মধ্যে আর একা একাই বা এলি কেন, যদি রাস্তায় কোন বিপদ-আপদ হতো তাহলে কি হতো ? আর এত রাত্রে তোর যে জ্বর কাশি হবে তার কি কোন খেয়াল আছে! এমনিতে তোর জ্বর হলে সে তো আর ভালোবেসে ফিরে যেতে চায় না তাতো জানি তার পরেও কেন এরকম বাচ্চাগুলো করিস !”

আরু দু হাত দিয়ে নিজের সারা শরীরটাকে ঢাকার চেষ্টা করছে আর ঠান্ডায় থরথর করে কাঁপছে , ভেজা চুলগুলো থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে আর বেশিরভাগ জলটাই শরীর শুষে নিয়ে শরীরের তাপমাত্রা কমছে….

আরু কাঁপতে কাঁপতে বলল,,,,
__” তুমি কি আমাকে ঢুকতে দেবে না কি এভাবেই কথা শোনাবে কোনটা ?”

উনি বুঝলেন যে কিছু বলে আর লাভ নেই এর থেকে বরং এর পর আরুর যে অনাগত জ্বর কাশি আসছে তার সাথে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হওয়াই ভালো , তাই উনি আর কিছু না বলে দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালেন ৷ উনি সরে আসতেই আরু চম্পট দৌড় দিল , দৌড়ে দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজা আটকে থিতু হলো ৷

আরূর মা দরজা দিয়ে গজগজ করতে করতে বললেন,,,,,,,,
__” যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই মেয়েকে আমি আরিশের হাতে তুলে দিতে চাই এইভাবে আর কতদিন চোখে চোখে রাখব বলো তো ! বিয়ে করলে তখন পরিবর্তন আসবে আর ঠিক হয়ে যাবে সব, এভাবে চিন্তায় চিন্তায় তো শেষ হয়ে যাচ্ছি ৷”

আরমান সাহেব গালে হাত রেখে চিন্তার সুরে বললেন,,,,,
__” মেয়েটা বড্ড চঞ্চল , এভাবে সামলানো যায় না ৷ আমার এখন তাই মনে হচ্ছে , আরিশকে কথাটা জানাতে হবে ৷ তাছাড়া আরিস নিজেও এখন যথেষ্ট ম্যাচিওর , আশা করি ওর কোন আপত্তি থাকবেনা ৷ আর যদি আরিশ এখন বিয়ে না করতে চাই তাহলে তো অন্য কোথাও আরু মায়ের বিয়ে,,,,,,”

__” না না এটা তুমি কি বলছো, আমাদের দুই পরিবারেই কত ইচ্ছা বল তো যে ওদের দুজেন চারহাত এক করে দেবো ৷ আর তুমি সেখানে অন্য কোথাও,,,,, না না এমনটা বলো না , পারলে আমারা কয়দিন অপেক্ষা করব আরিশের জন্য তারপর না হয় বিয়ে দেবো ৷”

__” এরকম বলে নিজের মনকে সান্তনা দিবে ঠিক আছে তা বলে নিজের মেয়েটার চঞ্চলতা কিভাবে কামাবে ? কতদিন আর এভাবে চিন্তায় চিন্তায় সারা রাত জাগবে বল ৷”

আরূর মা চুপ হয়ে গেলেন, সত্যিই ওনার কথাটা গ্রহণযোগ্য একেবারে ফেলে দেবার মত নয় , তাছাড়া মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে বর্তমানে যথেষ্ট ত্রুটি আছে সমাজে, আর আরূ যখন-তখন রাতবিরেতে একা একাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় , মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তাভাবনার আর শেষ নেই…..

তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে এসে একটা প্লাজো আর একটা টপ পরে ব্ল্যাঙ্কেট এর মধ্যে ঢুকে গেল আরূ ৷ চুলগুলো এখনো ভিজে , মাথাটাও ধরেছে বেশ , এখন একটু কফি হলে মন্দ হতো না তবে এখন কফি খেতে গেলেই শুনতে হবে ওর মায়ের কাছে হাজারো বকুনি সেই কারণে সেই কথাটা দ্বিতীয়বার ভেবে দেখছে না আরূ…..

তখনই দরজায় নক করার শব্দ শুনে আরুর টনক নড়লো ৷

__” কিরে দরজা বন্ধ করে কি শুয়ে পরেছিস নাকি ? ওষুধ খাসনি তুই এখনো , রাত্রে আবার জ্বর হবে তখন কি হবে ! আর আজকে আমি তোর সাথে ঘুমাবো ৷”

আরু রুম থেকে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,
__” না তোমাকে শুতে হবে না , আর আমি একদম ঠিক আছি তুমি যাও তো , আমার এখন ঘুম পাচ্ছে ৷”

আরুর মা অনেক জোর করা সত্ত্বেও আরু ওনাকে রুমে আসতে দেননি,ওনার নিজের রুমে পাঠিয়ে দিলেন ৷ তারপর গুটি গুটি হয়ে শুয়ে পড়ল আরু ৷

ঘড়ির কাটা স্থান পরিবর্তন করার সাথে সাথে যেমন সময়টা এগিয়ে যাচ্ছে তেমনি আরুর শরীরের তাপমাত্রাটাও ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে ৷

চোখ দুটো ছোট হয়ে আসছে , মাঝেমাঝেই চোখের কোনে দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে ,গলাটা ধরে আসছে বেশ……
কিছুক্ষণের মধ্যেই আরূ জ্ঞান হারালো……

রাত আড়াইটা,,,,,

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে-থাকা অন্ধকারে মানুষের ছায়ামূর্তিটা রুমের ভিতরে প্রবেশ করল নির্দ্বিধায় যেন এই সময়টায় তার খুবই প্রয়োজন, সেই যে আরুর এ রোগের ঔষধ ৷

ধীর পায়ে এগিয়ে বিছানায় আরূর পাশে বসলো….

ঘরের ভেতর জ্বলতে থাকা লাল রঙের ডিম লাইটের আলোটা আরুর মুখের উপর সামান্য পড়তেই মুখটা বেশ স্পষ্ট বোঝ না গেলেও সামনের মানুষটির যেন আরূকে বুঝে নিতে অসুবিধা হচ্ছে না, এই অন্ধকারের মাঝেও আরু তার কাছে দৃশ্যমান বলেই মনে হচ্ছে ৷

তার ঠান্ডা শীতল হাত দুটো ধীরে ধীরে আলতো করে আরুর গলায় স্পর্শ করতেই আরূ সামান্য কেঁপে উঠল শিহরণে….
পরম আবেশে গলায় হাতদুটো রেখে আরূর কাছে এগিয়ে গেল, আরূর মুখের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে গিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সে , তার গরম নিশ্বাসগুলো আরূর মুখের উপর পড়ছে, মাঝে মাঝে তা চোখের দু পাতার উপর পরতেই চোখ দুটো হালকা কেঁপে কেঁপে উঠছে…..

ধীরে ধীরে তার নিজের ঠোঁট জোড়া দিয়ে আরূর ঠোঁটজোড়া কে দখল করে নিল , পরম আবেশে জড়িয়ে রেখেছে ঠোঁটজোড়া , দেখে মনে হচ্ছে যেন পুরনো সব ভালোবাসা আজ আরূকে ফিরিয়ে দিচ্ছে….

আজ তার একাকি ভালবাসার উষ্ণ ছোঁয়ায় শিহরন বইছে আরুর সমগ্র শরীর জুড়ে…..

বেশ কিছুক্ষণ পর আরূকে ছেড়ে দিয়ে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে আরুর ঠোটজোড়া আলতো করে মুছে দিল ৷ পকেট থেকে ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা বর করে তা আরুর হাতে পুষ করে দিল ৷ এই মুহূর্তে আরূ জেগে থাকলে হয়তো সারা বাড়ি মাথায় করে বেড়াতো , ইনজেকশন জিনিসটাকে খুব ভয় পায় ও…..
আরূর দিকে বেশ অনেকক্ষণ ধরে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল , আরূর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে আরুর থুতনীতে থাকা হালকা কালো তিলটাতে (যেটা খুব কাছ থেকে গভীরভাবে দেখলেই বোঝা যাবে) নিজের ঠোট ছোঁয়ালো ৷ ঘুমন্ত আরূর বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে ছবিগুলো দেখে মুচকি হেসতে লাগলো ৷
আরুর কানের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে গিয়ে বলল ,,,,,,,
__” ভালোবাসি আরুপাখি ৷”
কথাটা বলে বেরিয়ে গেল রুম থেকে ৷

সকালের প্রথম সূর্যের আলোটা আরুর মুখের ওপর এসে পড়তেই চোখের পাতা দুটো তার উত্তাপ হয়তো আর সহ্য না করতে পারলো না, চোখ দুটো খুলে শান্ত দৄষ্টিতে তাকালো আরু…..

কাল সারারাত বৃষ্টি হওয়ার পর বাইরের সমস্ত টা ঝলমলে আর প্রানবন্ত ৷ সূর্যটাকে আজকে দেখে মনে হচ্ছে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে নতুন করে ৷ গাছপালাগুলো নিজেদের আগেকার সেই প্রাকৃতিক মহিমা খুঁজে পেয়েছে ৷ শীতের দিনের ঘাসের ওপরে জমে থাকা শিশির সঙ্গে বৃষ্টির ফোঁটাগুলোও আজ ভিড় জমিয়েছে অজানা এই উদ্দেশ্যে ৷ বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা মাটিতে পড়তেই মাটির অদ্ভুদ যে ঘ্রান সৄষ্টি হয় তা সময়ের সাথে মিলিয়ে গিয়ে কর্দমাক্ত মাটির নিজস্ব ঘ্রানটাকে নতুন করে সৃষ্টি করেছে….

প্রকৃতিটা কতই অদ্ভুত তাই না কখনো রোদ কখনো বৃষ্টি আবার কখনো বা ঘন কুয়াশা….

কথাগুলো মনে আসতেই আরূ মুচকি হেসে উঠলো ৷ প্রকৃতির আসল রূপটা ভালোভাবে উপলবদ্ধি করতে পারছে ও ৷
কালকে রাতের জ্বর জ্বর ভাব টা ও আর নেই, মাথা ব্যাথাও কমে গেছে , অনেক ফুরফুরা লাগছে এখন নিজেকে ৷
রাতে ও নিজে ওষুধ খাইনি কখন জ্ঞান হারিয়েছে তার নিজেরও জানা নেই তবুও কি করে এতটা সুস্থ হল ও তা নিজেও জানেনা ৷ অসুস্থতা ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি কিছু ভাবতে চাইনা তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেটা নিজের মন থেকে ঝেড়ে ফেলে ধীর পায়ে ব্যালকনির দিকে হেটে গেল….

বেলকুনিতে ফুলগাছের টবগুলোতে জল জমে আছে , গোলাপ ফুলের পাপড়ি গুলোতে ফোঁটা ফোঁটা জলবিন্দু দেখা দিচ্ছে আর ফুলের মাঝে জমে থাকা জলে ফুলের রেণু গুলো ভেসে উঠছে ৷ জলটাই হাত দিতেই সমস্ত রেনূ ওর হাতে এসে ভিড় জমাচ্ছে , ব্যপারটাই আরূ আনন্দ পাচ্ছে বেশ ৷

বেলকনি রেলিং ধরে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস নিতেই অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করছে আরু ৷ আজ হয়তো প্রথম এমন একটা দিন যেদিন ও নিজে তাড়াতাড়ি উঠেছে আর প্রকৃতির যে আসল সৌন্দর্য সেটাকে উপভোগ করছে….

কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে প্রকৃতিতে মনোনিবেশ করতেই চোখে ভেসে উঠল কালকের বর্ষনের সেই রাতের কথা ৷ কথটা মনে পরে গেল , আরে তার সাথে আরিশের সেই উষ্ণ ছোঁয়া আর তার অল্প বকুনি ৷

তাড়াতাড়ি করে চোখ দুটো খুলে ফেললো আরূ ৷

__” আমার এমনটা হচ্ছে কেন? বারবার উনার কথায় কেন মনে পড়ছে ? সেই ভাবনা থেকে বের হওয়ার উপায় কি?”

__”ভালোবাসা ভালোবাসা…..”

কথাটা শুনতেই আরূ অবাক হয়ে পিছন দিকে ঘুরল , তাকিয়ে দেখল ইনু ওর দিকে তাকিয়ে ঘাড়টা এপাশ ওপাশ করছে….

আরু মুচকি হেসেই ইনুর কাছে গেল….

ইনু হলো আরূর পোষা তোতা পাখি , যাকে আরূ বেশ কয়দিন হলো ওর বাড়িতে এনেছে, এই কয়দিনে ইনুর সাথে ওর ফ্রেন্ডশিপ টা খুব ভালো হয়েছে ৷ একটা মানুষ আর জন্তুর মধ্যে এতটা ভালো সম্পর্ক হতে পারে সেটা আরু জোরে আর আরিশকে দেখে বুঝেছিলো ৷ কুকুরকে ও প্রচন্ড ভয় পায় তাই তাকে পোষ মানানোর কথা দ্বিতীয়বারের ভাবেনি, তাই আরিশের বাড়ি থেকে ফেরার পরই সেদিনই ওর বাবাকে বলে তোতা পাখি টা নিয়েছিল মার্কেট থেকে ৷ পাখিটা আগে থেকেই প্রচন্ড কথা বলে ৷ অবসর সময়ে আরু ওর সাথে কথা বলে সময় পার করে ৷ দিন শেষে নিজের জমিয়ে রাখা সমস্ত অভিযোগের কথাটুকূ ইনুকে জানায়….

__” তুই এটা কি বলছিস, আর ভালোবাসা মানে তুই কি বুঝিস?”

ইনু ঘাড় ঘুরিয়ে এ দিক ওদিক তাকিয়ে আবার একই কথা বলল,,,,,
__” ভালোবাসা ভালোবাসা….”

__” সত্যিই কি তাই ! যদি এমনটাই হয় তাহলে আমি কেন সেটা বুঝতে পারছি না , আর এই অদ্ভুত অনুভূতি মানে কি? আমি কি তাতেই আসক্ত……”

কথাটা ইনুকে বলে মেঝেতে বসে পড়ল, দেওয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে সেখানেই বসে রইল,, কতটা সময় যে ওভাবেই আরু পার করলো তা ও জানে না ৷

চলবে,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে