#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_১৮
#সারিকা_হোসাইন
ঘড়িতে সকাল দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট
মেজর আদ্রিয়ান কে নিয়ে মৌলভীবাজার বাস স্ট্যান্ড এ বসে আছে মুহিত।তারা তাদের আর্মি জিপটি রিসোর্ট এ রেখে শ্রীমঙ্গল এর লোকাল গাড়িতে করে এখানে এসেছে।
এখানে বৃষ্টির কোনো সময়,অসময় নেই।যখন খুশি তখন ই যেনো ঝুপঝুপ করে ধরনীতে ঝরে পড়তে হবে।
বৃষ্টির কারণে মুহিতরা তাদের কাজে আগাতে পারছে না।
আজকের দিনটা তাদের জন্য সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো।
মুহিত গোপন সূত্রে খবর পেয়েছে আজকে ড্রাগ সাপ্লাই হবে।
শকুনের মতো দৃষ্টি তাক করে আছে মুহিত আর আদ্রিয়ান।
হঠাৎই তারা একটি খালি ট্রাক দেখতে পায় যা বর্ডার এর দিকে যাচ্ছে,মুহিত আর আদ্রিয়ান দৌড়ে চলন্ত ট্রাকটিতে ঝাঁপিয়ে উঠে পড়ে।
ট্রাকের স্পিড কম থাকায় কোনো প্রকার ঝুঁকি স্পর্শ করেনি তাদের। বৃষ্টিতে ভিজে দুজনের অবস্থাই যবুথুবু।
বর্ডারে আসার আগেই ট্রাক ড্রাইভার তাদের উদ্যেশ্যে বিড়ি ফুকতে ফুকতে কেটকেটে কন্ঠে বলে উঠে
―নামুইন,এই গাড়ি বর্ডার জাইতোনা।
ড্রাইভার এর কথায় আধার নেমে আসে মুহিত আর আদ্রিয়ান এর মুখে।তারা দ্রুত নেমে পড়ে ট্রাক ড্রাইভার কে ধন্যবাদ জানায়।
ড্রাইভার তাদের নামিয়ে দিয়ে অন্য পথ ধরে।
যতটুকু পথ আছে দৌড়ে গেলে ত্রিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে।
মেজর অদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে মুহিত চোখ টিপ দিয়ে ফিচেল হেসে বলে উঠে―
তো একটা রেস হয়ে যাক মেজর আদ্রিয়ান আভিয়াজ!বলেই একটা ভ্রু উঁচু করে গুনতে লাগলো―
―রেডি,স্টেডি, গো
দুজন মেজর সমান তালে গাছ,মানুষ ,পাহাড় ছাপিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে,কিন্তু কেউ তাদের আসল পরিচয় জানে না।জানতে চায় ও না।আদিবাসী দের মেজর এর পরিচয় দিয়েই বা কি কাজ?
দৌড়াতে দৌড়াতে দুজনেই তাদের লক্ষে এসে উপস্থিত হয়,এর পর হাঁটুতে ভর দিয়ে হাপাতে হাপাতে মেজর আদ্রিয়ান ভেজা ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে।আশেপাশে কোনো মানুষ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।যতদূর চোখ যায় বড় বড় গাছ ঝোপঝাড় আর কাঁটা তারের বেড়া।
চারপাশে আরেকবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে
সুযোগ বুঝে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে যায় মুহিত আর আদ্রিয়ান।যেভাবেই হোক,ড্রাগস ভর্তি ট্রাকে তাদের উঠে যেতে হবে,এবং সেই ড্রাইভার কে কব্জা করে বর্ডার গার্ডের ক্যাম্প পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলেই কাজ অর্ধেক হয়ে যাবে।
তিন ঘন্টা ধরে ওঁৎ পেতে বসে আছে মেজর আদ্রিয়ান আর মুহিত,এখনো সন্দেহ জনক কিছুই চোখে পড়ছে না।
ঝোপের ভেতর মশার কামড়ে অতিষ্ঠ মেজর আদ্রিয়ান।তার কাছে মনে হচ্ছে সে এই মুহূর্তে উগান্ডা বর্ডার পাহারা দিচ্ছে।
দিনের আলো ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে,বিশ্রী শব্দে বন্য পশু গুলো ডেকে যাচ্ছে।দুজন মানুষ অজানা পরিবেশে ঝোপের মধ্যে স্যাতস্যাতে মাটিতে বসে আছে,সাপ খোপ ও তো কামড়াতে পারে !
মেজর আদ্রিয়ান ভয়ে চুপসে আছে।মুহিত নির্বিকার।
জঙ্গল পুরোটাই যখন ঘন কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেলো তখন ই একটি ট্রাক কোথা থেকে যেনো কাটা তারের বেড়ার কাছে এলো।
মুহিতরা সেদিন দুই পাশে বেড়ার তার কাটা দেখেই বুঝতে পেরেছে কাজ এই পথেই হয়।শুধু তাই নয় সেখানে একটি গোপন সুড়ঙ্গ ও তারা আবিস্কার করেছে যা দিনের বেলায় লতাপাতা দিয়ে ঢাকা থাকে।
হ্যারিকেন হাতে একে একে বেরিয়ে এলো পঁচিশ জন ব্যাক্তি,তাদের প্রত্যেকের মাথায় একটি করে বস্তা,ছোট ট্রাকটিতে বস্তা গুলো লোড করে প্রত্যেকেই জঙ্গলে হারিয়ে গেলো।
ট্রাক ড্রাইভার টি বারো কি চৌদ্দ বছরের একটা ছেলে।
এতো ছোট ছেলে এই কাজে জড়িত ভাবতেই মুহিতের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।
ট্রাক স্টার্ট দেয়ার সাথে সাথেই মুহিত আর মেজর আদ্রিয়ান ট্রাকে কৌশলে উঠে পড়লো,ট্রেনিং এর সময় এই কৌশল সবার আগে তাদের রপ্ত করতে হয়েছে।শুধু তাই নয় আর্মিদের বড় বড় চলতি গাড়িতে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠা নামা তাদের নিত্য দিনের অভ্যেস।
,জঙ্গল পার হতেই দুজনেই তাদের কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবার বের করলো,
এখনই ছেলেটাকে বাগে আনতে হবে এবং ট্রাকটির ব্যাবস্থা করতে হবে।
ভাবতে ভাবতে আদ্রিয়ান সামনে থাকা একটি শাল গাছে ফাঁকা গুলি ছুড়লো,ছেলেটি ভয়ে ট্রাকটি স্লো করতেই মুহিত নেমে ট্রাকের দরজা খুলে ছেলেটিকে বন্দুক তাক করে।
মুহিত অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় যখন সে ছেলেটির কাছেও বিদেশি একটি রিভলবার দেখতে পায়।
আদ্রিয়ান ও আরেক পাশের দরজা খুলে ট্রাকে উঠে বসে,দুইজন দুইপাশে থেকে গান পয়েন্ট করে ছেলেটিকে তাদের কথা মতো গাড়ি চালাতে বলে।
হঠাৎই ছেলেটি সিলেটি ভাষায় উঠে―
―আমারে ধইরা কোনো লাভ ঐতো না,স্যার
“”আমার থেইকা কোনো তথ্য বাইর করতে পারতাইন না।
―আমার থেকে তথ্য বাইর করার আগেই তারায় আমারে গুলি করে মাইরা লাইবো।
ছেলেটির মুখে মৃত্যুর কথা নির্বিকার স্বাভাবিক ভাবে বলার ধরন দেখে মুহিত আদ্রিয়ান দুজনেই অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায়।
এই টুকু ছেলে জীবনের ভয় করছে না ,কিসের ভয় তার তাহলে?
মুহিত কৌতূহল দমে রাখতে পারলো না,ছেলেটিকে প্রশ্ন করে ফেললো
―কেনো তুমি এই ঝুঁকিপূর্ণ জীবন বেছে নিয়েছো?
আমার মা,বইন আর ভাইয়ের লেইগা, ছেলেটির সোজাসাপ্টা উত্তর।
মুহিত ছেলেটিকে নির্দেশ দিলো গাড়ি বর্ডার গার্ড দের ক্যাম্পের রাস্তায় ঘুরাও।
ছেলেটি ভয়হীন কন্ঠে বলে উঠলো
―ঐহানে গেলেও লাভ হয়তো না,হেইনের বড় বাবু ও সব জানে,আপ্নেই বিপদে পরবাইন।
মেজর আদ্রিয়ান আর মুহিত দুজন দুজনের চোখ চাওয়া চাওয়ি করলো।
এসব অফিসার দের কিসের লোভ সেটাই মুহিত অনুধাবন করতে পারছে না।
ছেলেটির কথায় যুক্তি আছে,নাহলে এতো বছর ধরে এসব হচ্ছে কেউ কি কোনো ও দিন টের পায়নি?
মুহিত ছেলেটিকে আশ্বাস দেয় সে যদি মুহিত কে স্মাগলার সম্পর্কে সকল তথ্য দেয় তবে মুহিত তার পরিবার ও তাকে একটা ভালো লাইফ লিড করার ব্যাবস্থা করে দেবে।
ছেলেটিকে মুহিতের নম্বর আর ভিজিটিং কার্ড দিয়ে আর ছেলের কিছু কথা রেকর্ড করে নেমে আসে গাড়ি থেকে।
মুহিত শতভাগ নিশ্চিত ছেলেটি তাকে অবশ্যই ফোন করবে।
কারো চোখের ভাষা পড়তে মুহিত ওয়াসিফ কখনো ভুল করেনা।
******
সারাদিন মুহিতের কোনো দেখা সাক্ষাৎ পায়নি স্বর্গ।সেই যে মেডিসিন এনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো, এর পর না হোটেলে ফিরলো না তাকে ফোনে পাওয়া গেলো।
স্বর্গ জানে মুহিত এখানে তার একান্ত ব্যাক্তিগত কাজে এসেছে।তবুও তার কাছে মনে হলো মুহিত তাকে অবহেলা করছে,প্রায়রোটি কম দিচ্ছে।
এসব উল্টাপাল্টা ভেবে মন আকাশে কালো মেঘ জমলো সাথে অক্ষি কোনে জমলো জল।
রাত দুইটার দিকে মুহিত ক্লান্ত শরীরে হোটেলে ফিরে আসলো, তার উচিত স্বর্গকে একটু সময় দেয়া,দুজনে কিছু ভালো টাইম স্পেন্ড করা।কিন্তু বাবা ভাইয়ের খুনির শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত কিভাবে নিশ্চিন্তে সুখের সময় পার করবে মুহিত?
স্বর্গ টের পেয়েছি মুহিত এসেছে তবুও অভিমানে চোখ টিপে কাত হয়ে ঘুমের ভান ধরে পরে রইলো।
মুহিত ফ্রেস হয়ে এসে স্বর্গকে না ডেকে আস্তে করে পাশে শুয়ে পড়লো।
মুহিতের এমন আচরণে অভিমানের পাল্লা আরো ভারী হলো।স্বর্গ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো কাল ভোরেই মুহিতকে ফেলে সে ঢাকা চলে যাবে।
―――――――
মিসেস তারিন কে দীর্ঘ ছয় বছর পর কাছে পেয়ে নামিরার যেনো কান্নাই থামছে না।সোহাগ তাকে থামানোর চেষ্টা করে বার বার ব্যার্থ হচ্ছে।এই সময়ে তার এতো স্ট্রেস নেয়া ঠিক হবে না।
মিসেস তারিন নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছেন।মন দুর্বল থাকলে অল্প কারণেও কষ্ট পাওয়া যায়,আর যদি মনকে একবার শক্ত করা যায় তখন শত বিষাদ ও আর কষ্ট মনে হয় না।
নামিরাকে শান্তনা দিয়ে চুপ করালেন মিসেস তারিন।
নামিরাকে যেই সম্ভাব্য ডেলিভারি ডেট দেয়া হয়েছে সেটা আগামী কাল।
মিসেস তারিন নামিরা আর সোহাগ কে অভয় দিচ্ছেন আর ব্যাগপত্র গুছাচ্ছেন।কখন হসপিটাল এ দৌড়াতে হবে কেউ জানেনা।
মিসেস তারিন হেল্পিং হ্যান্ড কে ঘর কিভাবে গুছাতে হবে কি দিয়ে মুছতে হবে সব বুঝিয়ে দিলেন।
ব্যাগ গুছাতে গুছাতে হঠাৎই হাতের ধাক্কা লেগে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে ফুলদানি টা মোজাইক করা ফ্লোরে পরে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো।
চমকে উঠলো নামিরা,
মিসেস তারিনের মন কু ডেকে উঠলো।
মেয়েটার ডেলিভারি ভালোয় ভালোয় হবে তো?
★★★★★
সকাল বেলা মুহিতের ঘুম ভাঙলো ফোনের ভাইব্রেট শব্দে,একটা আননোন নম্বর থেকে কল এসেছে।
বিরক্তি তে চোখ মুখ কুঁচকে এলো।
এখনো ঘুমের রেশ রয়ে গেছে কে ফোন করলো এই সাত সকালে?
বিরক্তি তে ফোন রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে সালাম দিয়ে বলে উঠলো
―সালাম সাহেব,আমি রাশেদ।
ট্রাক ড্রাইভার ছেলেটি তাকে কল করেছে ভাবতেই সব ঘুম উধাও হলো,লাফিয়ে উঠে বসে দ্রুত ফ্রেস হতে ওয়াশরুমে চলে গেলো মুহিত।
স্বর্গ সব টের পেয়েও ঘাপটি মেরে রইলো।
মিনিট দশেক পরে মুহিত রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।
স্বর্গের জানার কৌতূহল হলো এতো ভোরে মুহিত যাচ্ছে কোথায়?
মুহিত কে ফলো করতে সেও হাত মুখ না ধুয়ে স্লিপিং ওয়ার এর সাথে চোখে কালো সানগ্লাস,আর মাস্ক পরে নিলো।
মনে মনে বললো―
ফলো হিম।
আর্মি জিপ নিয়ে মুহিত একটা রাস্তা ধরেছে।
মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে স্বর্গ একটা ট্যাক্সি নিয়েছে হোটেলের সামনে থেকে।
একটা চা বাগানের সামনে এসে মুহিত জিপ রেখে নেমে গেলো, স্বর্গ ও গাড়ি থামিয়ে ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলো।
তিনটা রাস্তা তিন দিকে গিয়েছে,চারপাশে আঁকাবাঁকা টিলা ,ঘন চা বাগান আর পাহাড়,
মুহিত কোন রাস্তায় গেছে স্বর্গ গুলিয়ে ফেললো।
তবুও মনে সাহস সঞ্চয় করে অপু,দশ, বিশ খেলে মাঝখানের রাস্তা দিয়ে পথ ধরলো।
*****
মুহিতকে রাশেদ দেখা করতে বলেছে এই পাহাড়ে,গুরুত্বপূর্ণ কথা সারবে তাই।তাড়াহুড়ো তে মেজর আদ্রিয়ান কে বলতে ভুলে গেছে মুহিত,অবশ্য টেক্সট করে লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছে,এসে যাবে তারাও।
কিছুক্ষণ হাটতেই কাঙ্ক্ষিত পাহাড়ের সন্ধান পায় মুহিত,জায়গাটা শহর থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে।বেশি মানুষের আনাগোনা নেই।কারন চা বাগান টা চা কালেক্ট করার অবস্হায় নেই।
অনেক খুজাখুজির পর রাশেদের সন্ধান পাওয়া গেলো,
ছেলেটি যতটা উচ্ছাস নিয়ে মুহিত কে ফোন করেছিলো ততোটাই বিরস লাগছে এখন তাকে।
ছেলেটি মুহিত কে নিয়ে বিভিন্ন কথার ছলে পাহাড়ের উপর উঠার রাস্তা ধরলো।
মুহিত ও কিছু বাছবিচার না করে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকে অনুসরণ করতে লাগলো।
হাটতে হাটতে হাঁপিয়ে উঠলো মুহিত,পাহাড়টি ভূমি থেকে প্রায় সাত থেকে আটশত মিটার উঁচু হবে।
আশরাফ চৌধরী সম্পর্কে বিভিন্ন কথা শুনতে শুনতে অনেকটাই উপরে উঠে গেছে তারা।
হঠাৎ মুহিতের মনে সন্দেহ দানা বাধে।আর উপরে উঠতে চায়না মুহিত।
প্রতিশোধ পরায়নতা এতোটা অন্ধ করে ফেলেছে তাকে?
একটা অচেনা,অজানা ,জায়গা,তারমধ্যে অপরিচিতের সাথে এতটা পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে গেছে?
হঠাৎ ই স্বর্গের স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই বুক ছ্যাত করে উঠলো মুহিতের।
হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ আর গুড়গুড় শব্দ শোনা গেলো।
বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজে ভীত হলো মুহিত।কিন্তু বাইরে প্রকাশ করলো না।
হঠাৎ ছেলেটি কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলো―
“”সাহেব আমারে মাফ করবায়ন, আমি আমার পরিবার বাঁচানের লেইগা আপনেরে মৃত্যু মুখে ঠেইলা দিলাম।
বলেই ছেলেটি চোখের জল মুছে পাহাড়ের উপরে তাকালো।
পাহাড় এর চূড়া থেকে একজন কালো কাপড় পরিহিত লোক দেখা যাচ্ছে যার চোখ মুখ সব ঢাকা।
মুহিত অবস্থা বেগতিক দেখে পাহাড় থেকে দৌড়ে নামতে চাইলো কিন্তু লোকটি মুহিতের বুকে গুলি করে দিলো।।
বুকে হাত দিয়ে হাটু মুড়ে বসে পড়লো মুহিত,তার চোখ দিয়ে জল ঝড়ছে,গলগল করে বের হওয়া তাজা রক্ত ভিজিয়ে দিলো মুহিতের শার্ট,হাটু,পাহাড়ের মাটি।
হঠাৎই মাথার উপর আকাশে একটি চিল চক্রাকারে ঘুরতে লাগলো আর ভয়ঙ্কর সুরে ডাকতে শুরু করলো।
মুহিতের স্বাস রোধ হয়ে আসছে,দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।
হায় নিষ্ঠুর নিয়তি,জীবনে কোনো সুখ ই আমার জন্য লিখলে না?
স্বর্গের কান্না ভেজা চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠলো মুহিতের।মেয়েটি জানতেও পারলো না তার স্বামী পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে।
নরম মনের পাগল মেয়েটা কিভাবে সহ্য করবে নিজের সদ্য বিয়ে করা স্বামীর অকাল মৃত্যু?
আর মা!
মা কি বাঁচবে আমার মৃত্যুর খবর শুনে?
এমন কঠিন জীবন দিয়ে কেনো তাদের সৃষ্টি কর্তা এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছে?
তারা সৎ,নিষ্ঠাবান এটাই কি তাদের অপরাধ?
শরীর আর সায় দিচ্ছে না,চোখ ভরে ঘুম আসছে।
লোকটি বিদঘুটে শব্দে হাসছে,হাসতে হাসতে মুহিতের কাছে এসে শার্টের কলারে ধরে দাঁড় করালো।
লুটিয়ে পড়তে চাইছে মুহিত,কিন্তু লোকটির এক হাতেই বহুত শক্তি।
মুহিতের মতো আশি কেজি একজন মানুষকে সামান্য কলারে ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে সে।
লোকটি হাসি থামিয়ে দাঁত পিষে বলে উঠলো
―কোথায় গেলো তোর বাহাদুরি মেজর মুহিত ওয়াসিফ?
আমি যদি আগেই জানতাম তোর বাপের আরো একজন ছেলে আছে ,তাহলে তোর ছোট ভাইয়ের মতো তোকেও পাতাল থেকে খুঁজে হলেও অস্তিত্ব মিটিয়ে দিতাম।
আজ তোকে দেখাবো আমার সাথে লড়ার পরিণাম,যেমন তোর বাপকে দেখিয়েছিলাম।
―আরেহ, তোর বাপকে পিস পিস করে কুপিয়েছি আমি।
কি ভেবেছিস তুই?
সিলেট এসে আমার নামে প্রমান জোগাড় করে জেল খাটাবি আমাকে?
আমার চোখ ফাঁকি দেয়া এতই সোজা?
কি পারলি?
ঠিক ধরে ফেললাম তোকে।
অনেক চেষ্টা করেছি তোকে বাগে আনতে,আজ সফল হলাম বলেই রাগে খড়খড়ে কন্ঠে বলে উঠলো―
“”বন্দুকের গুলির চাইতে কোপানোর হাত ভালো আমার!
কেনো জানিস?
এক কালে কসাই ছিলাম আমি!
― কসাই।
আহমেদ কসাই।
গরু আর মানুষ দুটোই খুব ভালো কাটতাম।
বন্দুকের হাত নয় আমার,চাকু,চাপাতি, চপার এসব ভালো চলে বুঝেছিস??
মরবি ই যখন মরার আগে আমার চেহারা টা দেখে মর।
বলেই মুখের কাপড় সরালো।
আশরাফ চৌধুরীর এমন ভালো মানুষির আড়ালে হিংস্র রূপ মুহিতের চোখে জলের সমাগম করলো।মুখ দিয়ে কিছুই প্রকাশ করতে পারলো না।তার বাবাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি সে রাখতে পারলো না।
―গুড বাই মেজর!
―ওপারে ভালো থাকিস,বহুত দৌড় করিয়েছিস আমাকে তুই
বলেই পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো মুহিত কে।
এমন মৃত্যু দিলাম তোকে তোর বাপ ভাইয়ের মতো জানাজাও পেলিনা।জঙ্গলের পশুর খাদ্যে পরিণত হ শালা চুতিয়া বলেই হাসি থামিয়ে চোখ মুখে রাগ এনে ফুঁসতে থাকলেন।
আর ট্রাকড্রাইভার কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো―
তুই আমার কোনো কাজের ই নস,যখন তখন মুখ খুলে দিবি সুযোগ পেলে,তোকে আর ভরসা করা যাচ্ছে না।
তুই ও মেজর এর সাথে ওপারে যা।
ছেলেটি ভয়ে পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলে আশরাফ চৌধুরী তার শীর্ন দেহ খানা ধরে ফেলে এক থাবায়।
গুলি ছুড়ে দেয় ছেলেটির পেটে।
ছেলেটি লুটিয়ে পড়ে আশরাফ চৌধুরীর পায়ে ঝাপটে ধরে।আশরাফ চৌধুরী ছেলেটির হাত পিষে দিয়ে চলে যায়।
ছেলেটি মাটিতে শুয়ে কাতরাতে থাকে।
―――――――
মেজর আদ্রিয়ান আপনি এখানে?
হঠাৎ ই গহীন পাহাড়ে নিজের নাম শুনে চমকে উঠে আদ্রিয়ান, পাশেই একটি মেয়ে স্লিপিং ড্রেস আর বড় কালো চশমা,মাস্কের সহিত মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে।বিদঘুটে লাগলো আদ্রিয়ান এর কাছে।
স্বর্গ মাস্ক খুলে নিজের পরিচয় দিতে ই চিনে ফেললো আদ্রিয়ান।
বিনয়ের সহিত বললো
―জি ম্যাম মেজর আমাকে এখানে আসতে বলেছে,যদিও একটু লেট করে ফেলেছি।
চলুন যাওয়া যাক বলে পায়ের গতি বাড়ালো আদ্রিয়ান।
কাঙ্ক্ষিত পাহাড়ের নিকট এসে স্বর্গ কে উদ্দেশ্য করে আদ্রিয়ান বলে উঠলো
―ম্যাম আমি উপরে উঠবো আমার কাজ আছে আপনি অপেক্ষা করুন।
পাহাড় টির দিকে তাকাতেই স্বর্গের স্বপ্নের সেই পরিচিত পাহাড়ের মতো মনে হলো।
হঠাৎই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো স্বর্গের।ভয়ে বমি বমি ভাব হচ্ছে তার।
আদ্রিয়ান কে ফেলেই সে পাহাড়ে উঠতে লাগলো।
ভেতর থেকে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে থেকে থেকে।
চল্লিশ মিনিট ওঠার পর স্বর্গ হাঁপিয়ে উঠলো।কতো উঁচু পাহাড়?আর মুহিত কোথায়?
মেজর আদ্রিয়ান ফোন চেক করে দেখলেন নেটওয়ার্ক নেই।জোরে জোরে ডাকতে শুরু করলেন
―মেজর মুহিত!
―মেজর মুহিত?
স্বর্গ এবার কেঁদে ফেললো।তার স্বপ্ন কি অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সত্যি হতে যাচ্ছে তবে?
ভেতর থেকে শক্তি সঞ্চয় করে
ছোট ছোট গাছ ধরে ধরে আবার পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠতে শুরু করলো।
আরো বিশ মিনিট হাঁটার পর চোখের সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় একটি ছেলেকে গোঙাতে দেখে চিৎকার করে উঠলো স্বর্গ।
মেজর আদ্রিয়ান দৌড়ে ছেলেটির কাছে গিয়ে আঁতকে উঠলো।
মেজর আদ্রিয়ান সমানে ছেলেটিকে ঝাকাচ্ছে আর প্রশ্ন করে যাচ্ছে মুহিত কোথায়?সেই তো মুহিত কে কল করে এখানে আসতে বলেছে।তাহলে এরকম অবস্থা কেনো তার?
ছেলেটির প্রতি স্বর্গের কোনো এটেনশন নেই।
সে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে ডেকে যাচ্ছে
মুহিত,মুহিত!
দিকবিদিক শূন্য হয়ে গেলো স্বর্গ।
ছেলেটি বহুত কষ্টে হাত ইশারা দিয়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলো।
স্বর্গ যা বোঝার তা বুঝে নিলো।অনেক উঁচু এই পাহাড়ের যেই সাইড টা ছেলেটি নির্দেশ করেছে সেখানে একটি খাল ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
স্বর্গ পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো
―প্লিজ মেজর আদ্রিয়ান আর্মি রেসকিউ টিম কে কল করুন।কেউ মুহিত কে নিচে ফেলে দিয়েছে
বলেই মাটিতে হাটু মুড়ে বসে কাঁদতে লাগলো।
একদিকে এই আহত ছেলেটি অন্যদিকে স্বর্গ।কাকে রেখে কাকে ধরবে আদ্রিয়ান?
এই মুহূর্তে তার নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে অসহায় ব্যাক্তি মনে হচ্ছে।
মেজর মুহিতের চিন্তায় তার কান্না এসে যাচ্ছে।
তার মধ্যে এই রক্তাক্ত ছেলেটির গোঙানি।
অনেক প্রতিকূল পরিবেশে যুদ্ধ করে মিশন শেষ করে দেশে ফিরেছে আদ্রিয়ান।কখনো এমন ফিল হয়নি।তবে আজ কেনো এত ভেঙে পড়ছে সে?
নাহ তাকে শক্ত হতে হবে।নিজের ডিউটি তাকে শতভাগ পালন করতে হবে।
নিজেকে স্বাভাবিক করে,ছেলেটির ক্ষত ভালো করে লক্ষ করলো আদ্রিয়ান।কোনো আনাড়ি হাতের গান শট মনে হচ্ছে।ছেলেটি সাময়িক জ্ঞান হারালেও প্রাণে বাঁচানো যাবে।
আদ্রিয়ান স্বর্গের উদ্দেশ্যে বললো
―ম্যাম নিজেকে শক্ত রাখুন,ছেলেটিকে বাঁচানো আমার ডিউটি।আমি ওকে নীচে নিয়ে যাচ্ছি,আর এখানে নেটওয়ার্ক নেই।
রেসকিউ টিম কে কল করতে হলে নীচে নামতে হবে।
প্লিজ আমার সাথে নীচে নেমে আসুন।
ছেলেটিকে এক ঝটকায় কাঁধে তুলে ফেললো আদ্রিয়ান,এখানে দ্রুততার সাথে কিছুই করা যাবেনা।যা করার সাবধানে করতে হবে।
একটু অসতর্ক হলেই নির্ঘাত পরপার।
ছেলেটিকে নিয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ের গাছ ধরে ধরে নামতে লাগলো আদ্রিয়ান।
দেড় ঘন্টা পর নিচে নেমে এলো তারা ততক্ষনে ছেলেটি জ্ঞান হারিয়েছে।
অদ্রিয়ানের জিপের কাছে আসা মাত্র ফোনে নেটওয়ার্ক এলো।
সাথে সাথে আদ্রিয়ান ডায়ালপ্যাড থেকে নম্বর ডায়াল করে দ্রুত কল লাগালো
―হ্যালো রেসকিউ টিম?
―ইটজ মেজর আদ্রিয়ান আভিয়াজ–
#চলবে।
#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#বোনাস_পর্ব
#সারিকা_হোসাইন
মুষলধারে বৃষ্টি পরেই যাচ্ছে থামার নাম নেই,আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে মাঝে মাঝে বাজ পড়ছে বিকট শব্দে।এরূপ বৈরী আবহাওয়া তে পাহাড় টাকে ভুতুড়ে মনে হচ্ছে।আর্মিদের বুটের চাপে পাহাড়ি লালচে মাটি গলে গলে যাচ্ছে।
আর্মির রেসকিউ টিম দুটো হেলিকপ্টার দিয়ে সমানে পুরো পাহাড় চক্কর কেটে যাচ্ছে।প্রায় দুশো সোলজার পুরো পাহাড় তল্লাশি চালিয়েও কিছুই পেলো না।
কয়েকজন সোলজার মিলে খালের পাশে যাবার জন্য জন্য প্রস্তুতি নিলো।
আদ্রিয়ান নাফিজ মাহমুদ কে ফোন করে সব কিছু জানালে তিনি হেলিকপ্টার সহযোগে দ্রুত এসে পড়েন।
মেয়ের এহেন বিধস্ত অবস্থা দেখে গোপনে চোখের জল মুছে ফেলেন নাফিজ মাহমুদ।
স্বর্গের অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নেই।কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে।ফ্যালফ্যাল চোখে বিবর্ণ মুখে সবকিছু দেখে যাচ্ছে শুধু।
দুটো ক্যাপ্টেন মেয়ে তাকে সামলে রেখেছে।
ঘন্টা খানেক পর দুজন সোলজার কাঁদাযুক্ত পায়ের একটা জুতা আর ভাঙা স্মার্ট ওয়াচ নিয়ে ফিরে আসলেন।
এগুলো যে মুহিতের চিনতে এক সেকেন্ড ও সময় লাগলোনা স্বর্গের।
সোলজার এর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে জুতা আর ঘড়ি বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
নাফিজ মাহমুদ মেয়েকে কিভাবে সামলাবেন আর বোনকে কি জবাব দিবেন এটা ভেবেই তার বুকে ব্যাথা শুরু হচ্ছে থেকে থেকে।
মেজর অদ্রিয়ান একটি জিপার ব্যাগে ভরে ফেললো মুহিতের জিনিস গুলো।
সারা দিনের তল্লাশি চালিয়ে রিক্ত হাতে ফিরে চললো রেসকিউ টিম।
নিকটস্থ আর্মি ক্যাম্পে স্বর্গকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আজকের মতো আপাতত তল্লাশি শেষ করতে হলো,কাল সকালে আবার চেষ্টা চালাতে হবে।
―――――-;
নামিরার লেবার পেইন উঠেছে সকাল থেকে,তাকে হসপিটাল এ আনা হয়েছে।ওটি রুমে নার্স আর ডক্টর নামিরার পাশে রয়েছে।
সোহাগ থেকে থেকে শুধু ঘেমে অস্থির হয়ে যাচ্ছে,বেসিনে বার বার চোখ মুখ ধুয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।
মিসেস তারিন তসবিহ পড়ছেন,
আধ ঘন্টা পরেই বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলো।
সোহাগ যেনো আরো উন্মাদ হয়ে গেলো
তার একটাই চিন্তা
―নামিরা ঠিক আছে তো?
কিছু সময় পর একটা নীল টাওয়েল এ মুড়িয়ে বাচ্চা টিকে নিয়ে একজন নার্স সমেত ডক্টর বেরিয়ে এলেন।
সোহাগ কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন
―কংগ্রাচুলেশন্স মি,সোহাগ।
―ইটজ এ বয়।
ইউর ওয়াইফ ইজ আউট অফ ড্যাঞ্জার, ইউ ক্যান ভিজিট হার।
বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে কেঁদে উঠলো সোহাগ।
মুকিতের মুখের আদল তার ছেলের চেহারায়।
সোহাগ বাচ্চার কপালে চুমু খেয়ে মিসেস তারিনের কাছে দিতে দিতে বলে উঠলো
―মা নিন আপনার ছোট মুকিত।
নাতির চোখে মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলেন মিসেস তারিন,
চোখে তার খুশির অশ্রু কনা।
মুহিত কে খবর জানাতে নামিরার পাশে বাচ্চাকে শুইয়ে দিয়ে সোহাগের ফোন থেকে কল করলেন মুহিত এর নম্বরে।
পর পর দুবার ডায়াল করেও ব্যার্থ হলেন মিসেস তারিন।
ভাবলেন হয়তো ব্যাস্ত আছে।
এর পর নাফিজ মাহমুদের নম্বর ডায়াল করলেন ফোন তুললেন না তিনি।
চিন্তিত হয়ে বাসার ল্যান্ড লাইনে ফোন দিলেন।
সমানে রিং বেজে যাচ্ছে তনুজা ফোন তুলছেন না।
নিজের মেয়ের কপাল কি তবে খারাপ হলো এতোটা?
তার মেয়েটা কিভাবে নিজেকে গুছাবে?
স্বর্গ তো জানে মুহিত তার হবু বর,এই দাগ কিভাবে যাবে স্বর্গের মন থেকে।
তনুজার কান্না যেনো আর বাঁধ মানছে না।
টেলিফোনের কর্কশ রিং আবার বেজে উঠলো।
নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন কানে তুললেন তনুজা।
ভারী স্বরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তারিনের উৎকণ্ঠা মিশ্রিত আওয়াজ পাওয়া গেলো।
―তোমরা কেউ ফোন ধরছো না কেনো তনুজা?
তনুজা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে আমতা আমতা করতে লাগলেন।
এর পর বললেন রান্না করছিলাম আপা।
মিসেস তারিন সকল কুশলাদি বিনিময় করার পর জানালেন
― নামিরার ছেলে বেবি হয়েছে
―মুহিত এলে যেনো তাকে কল করে।
―আচ্ছা আপা বলবো।আল্লাহ হাফেজ।
তনুজা ফোন কেটে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
কিভাবে বাঁচবে তারিন নিজের অন্ধেরজষ্ঠী টাকেও যদি হারিয়ে ফেলেন?
সুখ কোনোভাবে তার মাকে শান্ত করে বিছানায় শুইয়ে দিলো।
******
দ্বিতীয়বারের মতো অভিযান চলছে কালা পাহাড় নামক স্থান টিতে।
মেজর আদ্রিয়ান,সিলেট ক্যাম্প এর মেজর তুষার জাওয়াদ দাঁড়িয়ে আছে স্পেশাল ফোর্সের দুটো মাল্টিপারপাস ক্যানাইনস (কুকুর)এলেক্স আর জাস্টিন কে নিয়ে।
মুহিতের ব্যাবহার করা কাপড় শুকিয়ে তাদের দৌড়াতে দেয়া হলো।
কুকুর দুটো দৌড়ে পাহাড়ের পাশে খালটিতে চলে গেলো।
সেখানে গিয়ে ঘেউঘেউ করতে লাগলো উপরের দিকে তাকিয়ে।
মেজর আদ্রিয়ান কুকুরের দৃষ্টি বরাবর দৃষ্টি তাক করে একটি বড় গাছ দেখতে পেলো।কুকুর দুটো পাহাড় বেয়ে গাছের দিকে চলে যেতে চাচ্ছে।
মেজর তুষার এলেক্স কে নিয়ে সেই গাছের কাছে গেলে কুকুর বার বার গাছে উঠার জন্য গাছ খামচে চলছে।
দুজন সোলজার এর মধ্য থেকে একজন সোলজার গাছে উঠে গেলো।
সেখানে কি আছে জিজ্ঞেস করলো আদ্রিয়ান।
সোলজার জবাব দিলো রক্ত আর শার্টের ছেড়া টুকরো স্যার।
এবার ও খালি হাতে ফিরলেন দুই মেজর।
তারা শার্টের টুকরো এনে একটি জিপার ব্যাগে রাখতে রাখতে নাফিজ মাহমুদ এর উদ্দেশ্যে বলেন
―স্যার মেজর মুহিত কমপক্ষে দুশো মিটার উপর থেকে পড়েছে,আমরা ওখানে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পাইনি।
পাশের যেই খালটা আছে সেটা প্রচুর খরস্রোতা।
আমার মন বলছে মেজর প্রথমে গাছের উপর পড়েছে সেখানে বাড়ি খেয়ে খালটিতে পড়েছে।
গাছে উপর পড়ার কারণে তার শার্টের হাতার কিছু টুকরো কাপড় আর রক্ত গাছের ডালে পাওয়া গিয়েছে আর খালটিতে পরে থাকলেও তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
কারন পানির স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
মেজর অদ্রিয়ানের সকল বক্তব্য শুনে মাথার ক্যাপ খুলে বগলে রাখলেন নাফিজ মাফমুদ।
মনে তার একটাই চিন্তা তার মেয়েটাও তার বোনের মতো সারা জীবন নিজেকে অপয়া দোষী সাব্যস্ত করে বেঁচে থাকবে!
আবার সেই একই অতীতের পুনরাবৃত্তি?
কোন পাপের শাস্তি এটা?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোনে জমা জল মুছে আর্মি ক্যাম্পে ফিরে এলেন নাফিজ মাহমুদ।
স্বর্গকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাবেন।
আর সিলেটের আর্মি ক্যান্টনমেন্ট এর জেনারেল এর সাথে কথা বলে মুহিতের ছবি দিয়ে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিতে আর বিভিন্ন ক্যাম্প এর আর্মিদের বলে দিতে তারা যেনো মুহিতের খুজ পাওয়া মাত্র তাদের জানায়।
―――――.
স্বর্গ কোনো ভাবেই মুহিত কে না নিয়ে যাবে না এখান থেকে।তার বিশ্বাস মুহিত এখানেই কোথাও আছে কিন্তু আর্মি দের গাফিলতির জন্য তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
স্বর্গের জেদ চূড়ান্ত মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো।
নাফিজ মাহমুদ বুঝতে পারলেন মেয়ে মানসিক সমস্যার শিকার হচ্ছে।
জোর করে হেলিকপ্টার এ তুলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তারা।
********
কেটে গিয়েছে সতেরো টি দিন।কোনো ভাবেই মুহিতের খবর পাওয়া যায়নি।বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এ মুহিতের নিখোঁজ সংবাদ ই যেনো প্রধান হেডলাইন।
নামিরা ,তারিন নাফিজের কাছে ফোন করে পাগল হয়ে যাচ্ছে মুহিত কেনো ফোন ধরছে না।
নাফিজ বুকে পাথর বেঁধে চূড়ান্ত এক মিথ্যে বলে দিলেন তারিন কে
―আপা মুহিত কে হঠাৎই মিশনে যেতে হয়েছে।
ও ভালো আছে।তুমি তো জানো আফ্রিকা কেমন দুর্গম জায়গা।
ওখানে জঙ্গলে কি আর নেটওয়ার্ক আছে ?
ছয় মাস পরেই ফিরে আসবে,ওখানে আর্মি ক্যাম্প এর সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে।মুহিত ভালো আছে।
তাকে নামিরার বাবুর কথা বলা হয়েছে, অনেক খুশি হয়েছে মুহিত।
ফোন কেটে বিছানায় ছুড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন নাফিজ মাহমুদ।
―――――
একটি ছোট বাচ্চা মেয়ে যার বয়স পাঁচ কি ছয়, গায়ের রঙ তাম্র বর্ণের,কোঁকড়া চুল গুলো খোপার মতো করে বাধা,ছোট ছোট চোখ,বোঁচা নাক,পরনে কাজিম পিন পোশাক ।
মেয়েটির নাম ডিকো।
সে খুব মনোযোগ এর সহিত অবচেতন একটি আগন্তুক কে দেখে যাচ্ছে।আগন্তুক আজ পনেরো দিন ধরে তাদের বাড়িতে আছে,
আচ্ছা উনি কখনো ঘুম থেকে উঠেনা কেনো?
বাচ্চা মেয়েটির মনে অনেক ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
লোকটির চেহারা তাদের মতো নয়,অনেক ফর্সা,কি সুন্দর দেখতে!
দেবতাদের মতো,আর কতো লম্বা!
―গায়ে ক্ষতের কোনো অভাব নেই তবুও যেনো চেহারায় রাজ্যের মায়া।
আচ্ছা তার গালে থুতনিতে চুল কেনো গজিয়েছে?
তার বাবা দাদার তো নেই।
লোকটিকে তার মা বাবা নদীর পাড় থেকে তুলে এনেছে।
আচ্ছা লোকটি কি দেবতা উবলাই নাংথউ?
দেবতা বলেই কি বাবা মা উনাকে এতো যত্ন করে?
#চলবে