#তোমার_জন্য_সব -৩১
✍️ #রেহানা_পুতুল
তারপরের দিন কলি ভার্সিটিতে যায়। মাহমুদ যায়নি কারণবশত। কলি ক্লাশ শেষে বের হয়ে নিচে যায়। হেঁটে গিয়ে বাস স্টপেজে দাঁড়ায়। অপেক্ষা বাসের জন্য। কিন্তু তার কাঙ্ক্ষিত বাস আসছে না। কলি পা বাড়ায় সামনের দিকে।
তখনি বাস এসে পড়ে। অমনি কলি বাসে উঠে যায়। বাস ছেড়ে চলে গেলে খেয়ার ঠিক করা সেই দুজন ভাড়াটে ছেলে মাথায় হাত দিয়ে ফেলে। নিদিষ্ট সময় অপেক্ষা করে খেয়া পল্টু মাস্তানকে ফোন দেয়।
“অপারেশন সাকসেসফুল?”
“না আপু। আমার লাইফে এই প্রথম ব্যর্থ হলাম। সে বাসে উঠে গিয়েছে। আমরা তাকে আগে থেকেই ফলো করতেছিলাম। কিন্তু যেই নিরব গলি থেকে তাকে তুলে নিতাম।সেখানে আজ মানুষজনের আনাগোনা ছিলো। তাই সম্ভব হয়নি। তাও পারতাম সে যদি বাসে না উঠে সামনে আরো হেঁটে যেতো। কারণ সামনেও আরেকটা নিরব গলি ছিলো।
খেয়া তাদের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হলো।অনুরোধ করলো তারা যেন আরো দু’চারদিন ট্রাই করে। তারা ট্রাই করলো। এবং ব্যর্থ হলো। কারণ তারপর কলি সেই কয়দিন ভার্সিটি যায়নি। অতঃপর এই বিষয়টার সমাপ্তি হলো।
দিন গেলো। মাস পেরুলো। সময় গড়ালো। ঋতু বদল হলো। দিনে দিনে কলি, মাহমুদের সঙ্গে সহজ হয়ে উঠলো। অবসান হলো সকল দূরত্বের। ঘুচালো সব লজ্জা। নানান খুনসুটি, ছোট ছোট অনুরাগ,অভিমান,অনুযোগে দুজনের দাম্পত্য জীবন মধুর থেকে মধুরতম হলো। কলিদের ‘মজা’ ফাস্টফুড দিনে দিনে উন্নতি লাভ করলো। পাশাপাশি আরেকটা ব্রাঞ্চ খোলা হলো। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা সচ্ছল হয়ে গেলো। দূর হলো মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন ও দিন শেষে আক্ষেপের ধারাপাত পাঠ।
দেখতে দেখতে এক বছর ফুরিয়ে গেলো। কলির অনার্স কমপ্লিট হলো। জুলির এস এস সি পরিক্ষা সম্পন্ন হয়ে গেলো। কলির ভার্সিটি থেকে শিক্ষা সফরে গেলো তারা। লোকেশন টাংগাইল মহেড়া জমিদার বাড়ি। মিসেস হেড স্টুডেন্টদের ঘুরে ঘুরে দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে অবগত করছেন। তারা মুগ্ধ চোখে সব অবলোকন করে যাচ্ছে।
এই জমিদার বাড়ির সামনে প্রবেশ পথের আগেই রয়েছে ‘বিশাখা সাগর’ নামে বিশাল এক দীঘি এবং বাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে ২টি সুরম্য গেট। এছাড়াও মূল ভবনে পিছনের দিকে পাসরা পুকুর ও রানী পুকুর নামে আরো দুইটি পুকুর রয়েছে এবং শোভাবর্ধনে রয়েছে সুন্দর ফুলের বাগান। বিশাখা সাগর সংলগ্ন দক্ষিণ পার্শ্বে রয়েছে বিশাল আম্র কানন ও বিশাল তিনটি প্রধান ভবনের সাথে রয়েছে নায়েব সাহেবের ঘর, কাছারি ঘর, গোমস্তাদের ঘর, দীঘিসহ ও আরো তিনটি লজ। সেখানে একটি ফোয়ারা আছে সেটা ১৮৯০ সালে র্নিমান করা হয়েছে। সবাই এখানে ওখানে দাঁড়িয়ে সিঙ্গেল ফটো,গ্রুপ ফটো,সেলফি তুলল।
কলির খুব মন চাচ্ছে মাহমুদের সাথে একাকী ছবি তোলার। কিন্তু পারছে না। একইভাবে মাহমুদের ও খুব ইচ্ছে করলো।খেয়া কলি ও মাহমুদের পথ থেকে সরে দাঁড়ালো। ভিডিও ক্লিপ নিয়ে কলির ঠান্ডা গলার হুমকি খেয়াকে চিরদিনের জন্য স্টপ করে দিলো। সব ঘুরে দেখা শেষ হলে দুপুরে লাঞ্চ করে নিলো সবাই। তারপর শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে সবার অনুরোধে মাহমুদ পুরনো সিনেমার একটি গান গাইলো।
“ভালোবাসা যত বড় জীবন ততো বড় নয়/তোমায় নিয়ে হাজার বছর বাঁচতে বড় ইচ্ছে হয়।
বড় দেরী করে দেখা হলো/হলো চেনাজানা।
আরো দিন গেলো কেটে মনেরই ঠিকানা।
হায়! জন্ম থেকেই হয়নি কেন তোমার আমার পরিচয়?
শুধু কিছুদিন পাশে পেয়ে ফুরাবে না আশা/কবে যে মরণ ঝড়ে ভেঙে যাবে বাসা।
হায়! সব পেয়েছি তাই কি আমার সব হারানোর এত ভয়?
…………
ভালোবাসা যত বড়….”
মাহমুদ কলির দিকে সরাসরি চেয়েই পুরো গান শেষ করলো। কলির লাজরাঙা আবেশী চাহনি নিবদ্ধ রইলো দূরে ফুলের ফুলের বাগানের দিকে। তবে হৃদয় পড়েছিলো মাহমুদের হৃদয় গহীনে।
সবার সম্মিলিত উচ্ছ্বাস, আনন্দে তাদের শিক্ষাসফর শেষ হলো। ভার্সিটির বাসে করে সবাই ভার্সিটিতে পৌঁছে গেলো। চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলো। তাই মাহমুদ কলিকে নিয়ে সিএনজিতে করে বাসায় চলে গেলো। আজ সে বাইক আনেনি যেহেতু শিক্ষা সফরে গেলো তারা।
রুমে গিয়েই মাহমুদ বলল,
“লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে, শত শত মানুষকে সাক্ষী করে বিয়ে করলাম। অথচ লোকালয়ে বউর সামনে থাকতে হয় দূরের মানুষের মতো। এই দুঃখ কই রাখি।”
কলি ঠোঁট উল্টিয়ে হাসলো। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“ইসসইরে কতভাবে পাওয়ার শখ? পেয়েছেন যে সেই কপাল।”
মাহমুদ পিছন হতে দু’হাত দিয়ে কলির কোমর জড়িয়ে ধরলো। নিজের গায়ের সঙ্গে কলিকে ভিড়িয়ে নিলো। দূরত্ব রাখলো না হাফইঞ্চিও। দাঁত খিঁচিয়ে বলল,
“ইচ্ছে যে করে, কি করি না…উফফস…!
” ছাড়েন বলছি। আমার কিন্তু কামড় দেওয়ার হেবিট আছে স্যার।”
” সুস্থ বত্রিশটা দাঁত কিন্তু আমারও আছে ছাত্রী। কামড় দেওয়ার হেবিট না থাকলেও অভ্যাসটা করে ফেলতে আমিও সময় ব্যয় করব না। প্রয়োজনে সামনের দুপাটি দাঁতকে ঝামা দিয়ে ঘষে ধার বৃদ্ধি করে নিবো।”
রসিকতা করে বলল মাহমুদ।
কলি মাহমুদের দিকে চোখ কটমট করে চাইলো। বলল,
ইউউ..একটা ইম্পসিবল ম্যান, বলে কলি সত্যি সত্যি মাহমুদের হাতে কামড় বসিয়ে দিলো। মাহমুদ হাত সরিয়ে নিলো। কলিকেও ছেড়ে দিলো। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
“ছেড়ে দিয়েছি বলে কেউ যেনো না ভাবে, আমি ভদ্র আছি। রাতেই দাঁতের গরম গরম ব্যবহার চলবে।”
“ইসসইরে..দিলেই ত আমি।”
কলি তার ড্রেস চেঞ্জ করে রুম হতে বেরিয়ে শ্বশুর শাশুড়ীর রুমে চলে যায়।
তার দুইদিন পরে ভার্সিটি গিয়ে শুনতে পেলো খেয়া ব্রেন স্ট্রোক করেছে। ধানমন্ডি ইবনেসিনায় ভর্তি। হায় খোদা! অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে সেই গর্তে নিজেই পড়তে হয়। খেয়া যেন তার জ্বলন্ত উদাহরণ। তবুও কলি ও মাহমুদের খারাপ লাগলো বেশ। মানুষ হিসেবে মানবিকবোধের জায়গা থেকে এমন লাগাটাই বাঞ্চনীয়।
আজ কলি ও মাহমুদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী। সেই উপলক্ষে দুই পরিবারের সবাই উপস্থিত ছিল। কেক কাটা হলো। সবাই সবাইকে মিষ্টিমুখ করালো। কলির মা বাবা মেয়ে ও জামাইয়ে জন্য উপহার আনলো। কলির বড় দুলাভাইও শালি, ভায়রাকে পছন্দনীয় প্রীতি উপহার দিলো। জুলিও দিলো প্রীতি উপহার। সেটাতেই কলি ও মাহমুদ বেশ খুশী হলো। সে ফ্রেমে বাঁধাই করা দুটো ছবি উপহার দিলো। একটা হলো তিনবোনের ছোটবেলার ছবি। বাকিটা হার্ট শেফের ফ্রেম। যার ভিতরে কলি ও মাহমুদের একটা বিয়ের ছবি। দুজন দুজনের দিকে মুখ ভার করে চেয়ে আছে।
মাহমুদদের বাসা থেকে কলির পরিবার নৈশভোজ সেরে রাতে চলে গেলো। রাতে সুখ সুখ মনে কলি ও মাহমুদ নিজেদের রুমে গেলো। দরজা বন্ধ করে দিলো।
মাহমুদ কলিকে বলল,
“কলি খাতুন, আমার প্রাণপ্রিয় একমাত্র শ্যালিকা জুলির এই ছবিটা দেখো। আমাদের দুজনের মুখ ভার। মলিন। কিন্তু উদ্দেশ্য ভিন্ন।”
“হুম জানি। তা আর বলতে হয়?”
বলেই কলি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।
ফাগুনের নিশিরাত। ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। কলি উদাস দৃষ্টি মেলে দিলো বাইরের দিকে। মাহমুদ গিয়ে কলির পাশে দাঁড়ালো।
“কলিই? ”
“হুঁ।”
“ঘুমাবে না?”
“কি হয় একনিশি জেগে থাকলে?”
“আমিতো বলিনি কিছু হয়? কলি তুমি বলেছ যেদিন আমাদের বিয়ের এক বছর পূর্ণ হবে,সেদিন আমাকে তুমি করে বলবে।”
“অস্বীকার করব না।”
“তাহলে ‘মাহমুদ তুমি’ বলে কথা বলো?”
“কথা যেহেতু দিয়েছি,কারো সাধ অপূর্ণ রাখব না। কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঠান্ডা যুদ্ধ গেলো আমাদের দুজনের মাঝে। কতকিছু। ভাবলেই সব কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়।”
“আমার কাছে ত দুঃস্বপ্ন লাগে সব চিন্তা করলেই।”
“কিইই দুঃস্বপ্ন?” বলে কলি মাহমুদের গেঞ্জির কলার চেপে ধরলো।
“এইতো কাজ হলো। এটা বললাম বলেই ত এই কাজটা করেছে। আর আমি পেলাম তোমার ছোঁয়া।”
“আমি চির কৃতার্থ আপনার ও আপনার পরিবারের প্রতি। কারণ আমার পরিবারের জন্য যে সাপোর্ট দিয়েছেন আপনারা, তা কয়টা পরিবার দিবে বলেন।”
মাহমুদ কলির হাত ধরে রুমের ভিতরে নিয়ে গেলো। কলির সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসলো। বলল,
“তোমার_জন্য_সব করতে পারি। সব।
কলিকে ভালোবাসি। অনুভব করি প্রতিটি মূহুর্তে।”
পরক্ষণেই মাহমুদ কলির উদাম পেটে গাঢ় চুমু খেলো। কলির চোখে চোখ রেখে বলল,
“এই মসৃণ পেটের ভিতরে একদিন আমাদের বাবু থাকবে। সেই বাবুর জন্য অগ্রিম আদর করে রাখলাম।”
কলি দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল লজ্জায়। মাহমুদ কলিকে কোলে তুলে নিলো। বিছানায় শুইয়ে দিলো। নিজেও কলির গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। কলিকে নিজের বাহুর উপরে এনে বলল,
“এক বছর পূর্তি উপলক্ষে রাতে বিনোদন করবো না আমরা? তবে তার আগে তুমি করে বলো। নয়তো রাতে বেশি ব্যথা দিবো।”
কলি আদুরে বিড়ালছানার ন্যায় মুখ লুকিয়ে ফেলল মাহমুদের বুকের ওমে। দুচোখ বুঁজে ফেলল। নিজের অধরযুগলকে মাহমুদের গাল ছুঁই ছুঁই করে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তোমাকে চাই ভোরের স্নিগ্ধতায়, দুপুরের ব্যস্ততায়, বিকেলের অবসরে,সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে,রাতের নির্জনতায়। তুমি আমার এক পৃথিবী নির্ভরতা।”
মাহমুদ আকুল গলায় প্রতিউত্তর দিলো,
“তোমাকে চাই প্রতিটি নিঃস্বাসে। তোমাকে চাই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে। তোমাকে চাই মান অভিমানে। তোমাকে চাই ঝগড়া করার মুহূর্তেও।”
ঝগড়া করার মূহুর্তেও? বলে অমনি কলি রিনরিনিয়ে হেসে উঠলো। কলির হাসির ফোয়ারার সারথি হয়ে মাহমুদও হেসে ফেলল হোহোহোঃ করে।
নিশি হলো উতলা। উপচানো সুখের প্লাবনে ভেসে গেলো দুটো হৃদয়। ভালোবাসার পবিত্র মুহূর্তে ক্ষণকাল বিলীন হলো অনন্তকালে।
৩১ ও শেষ পর্ব।