১৩+১৪+১৫
তোমার আকাশে হব প্রজাপতি
পর্ব ১৩
Writer Tanishq Sheikh
ইমা ব্যালকনিতে দাড়িয়ে চাকর বাকরদের রুম গোছানো দেখছে।মুখটা নিরস করে ঘুরে সামনে তাকায়।দূরেই বাংলোর ঐ ব্যালকনি দেখা যাচ্ছে ক’দিন আগেও যেখানে ইমা দাঁড়াতো।এ কদিনের জীবনে কতোকিছুই বদলে গেছে।ওপার থেকে এপারে চলে এসেছে।আজ পাশে পরিবার নেই।পাশে বসিয়ে আদর করা পিতাও পরের মতো ব্যবহার করেছে।ইমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মুখটা মলিন করে চুপচাপ মাথা হেট করে দাড়িয়ে থাকে।
” ম্যাডাম! স্যার আপনাকে ভেতরে আসতে বলেছে।”
গৃহপরিচায়িকার কথা শুনে ইমা চুপচাপ রুমে আসে।রুমের এককোনে বড় একটা সোফা বসিয়েছে তার পেছনেই নতুন কালো রঙের আলমারিটা।ইমা চোখ ঘুরিয়ে পুরো রুমটা দেখে নেয়।গৃহপরিচারিকা সহ সবাই রুম থেকে বের হয়ে যায়।শান দরজা লাগিয়ে বিছানায় বসে বলে
“ডিসাইড করো বিছানা না সোফা।”
শানের কথার অর্থ বুঝতে ইমার প্রথমে সমস্যা হলেও পরে বুঝতে পারে।শানের দিকে কটমট করে তাকিয়ে মনে মনে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে
” আমি বিছানা ছাড়া অন্য কোথাও ঘুমাতেই পারি না।”
কথাটা বলামাত্রই চেহারায় অসহায় ভাব নিয়ে আসে।শান ঝট করে আরামের বিছানা ছেড়ে উঠে সোফায় বসে।
” যাও তাহলে গিয়ে দখল করে নাও।”
ইমা শানের রাগ আচ করতে পেরে মনে মনে সেই মাত্রায় খুশি হয়।কিন্তু অসহায় মেয়ের ভঙ্গিতে বিছানায় গিয়ে চুপচাপ বসে।আড়চোখে শানের দিকে তাকিয়ে দেখে রাগে মুখ লাল করে সোফা ঝাড়ছে।ইমা ভেংচি কেটে আলমারি খুলে কাপড় ভাঁজ করার ভান ধরে শানের গতিবিধি দেখতে থাকে।
ইমা মনে মনে বলে
” ব্যাটা খবিশ!তোর দিন শেষ এবার আমার দিন শুরু।বলেছিলাম না লাগতে আসিস না। শুনলি না তো।আমার কষ্ট তোরে দ্বিগুন করে ফেরত না দিছি?”
শান আলমারিতে কাপড় গুছিয়ে সোফায় বসতে যাচ্ছিল হঠাৎ ইমার দিকে চোখ পড়তেই দেখে ইমা রাগী চোখে মৃদু হাসছে।শান না দেখার ভান ধরে রুম থেকে বের হয়ে যায়।শান বের হতেই ইমাও ধীর পায়ে দরজায় এসে উঁকি ঝুঁকি মারে গেছে না আছে দেখতে।অবশেষে শান নেই নিশ্চিত হয়ে ফিরে এসে সোফার সোজাসুজি দাঁড়ায়। ঘাড় ঘুরিয়ে সোফার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসে।তারপর লাফ দিয়ে সোফায় উঠে লাফাতে থাকে।সম্পূর্ণ সোফা পারা দিয়ে বসে ব্যাঙ্গ করে বলে
” ইরা জানে না আমার জিনিস ব্যবহার করা আমি পছন্দ করি না।তোর জিনিস ব্যবহার করবো না মানে! তোর জিনিস দিয়ে কমোড মুছবো।ঘর মুছবো,এলাকার বাচ্চাদের ডায়াপার হিসেবে গিফট করবো। খবিশের ঘরে খবিশ।”কথাটা বলে ইমা জিহ্বা কামড়ায়।
” আসতাফিরুল্লাহ! একা এই ব্যাটা শানই খবিশ।”ইমার মনে পৈশাচিক আনন্দ লাগে শানের সোফা পাড়িয়ে।মৃদুল সাথে থাকলে এসব জিনিসে ইমার বেশি মজা লাগে।মৃদুলের কথা মনে পড়তে ইমার খুব খারাপ লাগে।চুপচাপ মনখারাপ করে বিছানায় গিয়ে বসে।
রাতে খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। প্রতিদিনের মতো আজও সানা নেই।ইমা সানার শূন্য চেয়ারের সোজা শানের পাশেরটায় বসেছে।খাবার টেবিল স্যালাড,গরুর ,মুরগীর,খাসির মাংস মাছ,সবজি সব আছে।জ্বর থাকায় এ কদিন ইমা কিছুই খেতে পারে নি।টেবিলে এতো এতো খাবার দেখে পেট চো চো করছে কিন্তু লজ্জায় খেতে পারছে না।সামনে চাচা শ্বশুর, চাচী শ্বাশুড়ী,মামী শ্বাশুড়ি বসা।তাদের দেখে লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতেই পারছে না ইমা।ইরা বোনের অবস্থা দেখে ইশারায় বলে খেতে।ইরা ইমাকে ইশারা করতে দেখে মামী টিপুনি মেরে বলে
” গ্রাম গঞ্জের মানুষ তো এতো খাবার কোনোদিন চোখে দেখে নাই হয়তো।দেখে টাসকি খাইয়া গেছে।শোনো মেয়ে তুমি কার বউ জানো তো।এসব গাইয়াপানা ছাইড়া দাও।”
ইমার খুব খারাপ লাগলো মামী শ্বাশুড়ি টিপ্পনীতে।ইরা সহ বাকি সবাই রেগে তাকাতেই শান মামীর দিকে রেগে বলে
” মামী আপনার কথা শুনে কিন্তু কেউ বলবে না আপনি শান নিহান খানের মামী।এতোবার বলার পরও খাবার টেবিলে ফালতু কথা জুড়ে বসেন কেন?”
” শান বাবা আমি তো।”
শান বাকি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে খাবার ছেড়ে উঠে ইমার হাত ধরে টেনে রুমে চলে আসে।যাওয়ার আগে ইরাকে বলে ইমার খাবার রুমে দিয়ে যেতে।ইরা শানের কথা শুনে খুশি হয়ে মামীকে ভেংচি দিয়ে উঠে পড়ে।মামী রাগে মুখ কালো করে খেতে থাকে।আজকের খাসির রেজালাটা দারুন হয়েছে।এটা না খেয়ে উঠবেন না তিনি।তাতে যে যা বলার বলুক।
শান সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছে আর ইমা কোলের উপর প্লেট নিয়ে খাবার খাচ্ছে। আড়চোখে শানের দিকে তাকাচ্ছে শান এদিকে দেখছে কি না দেখার জন্য। না শান দেখছে না।সে তার কাজেই মগ্ন। ইমা খেয়ে দেয়ে প্লেট বাসন গুছিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে আসে।ইরা ইমাকে রান্নাঘরে দেখে খুশি হয়।
” ইমামনিটা আমার! খেয়েছিস? ”
” হুমম।”
“আচ্ছা রুমে গিয়ে রেস্ট নে। দুধ গরম করে দেই?!
” না আপা।দুধের গন্ধে বমি আসে।”
” আচ্ছা তাহলে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়।শরীর তো এখনও দূর্বল লাগছে।”
” আপা ঠিক আছি আমি।তুই একা এতো কাজ কেন করছিস।আমি তোকে সাহায্য করি দে।”
ইরা চোখ বড় বড় করে বলে
” না! একদম না।তোর শরীর এখনও ভালো না।আগে একটু সুস্থ হ তারপর তুই সব করবি আমি আরাম করবো।” কথাটা বলে ইরা ইমার এক গাল টেনে দেয়।
ইমা নাছোড়বান্দার মতো ইরাকে বিরক্ত করে কাজ করবে বলে অবশেষে ইরা কপাল চাপড়ে বলে,
” আচ্ছা বাবা! আচ্ছা! বাট সব তো চুমকিই করে আমি শুধু রান্নাটা করি।মাঝে মাঝে মাও করে।এ বাড়ির লোক যার তার হাতের রান্না খেতে পারে না তাই।এ ছাড়া আর কোনো বিশেষ কাজ নেই।আমিই ইচ্ছা করে চুমকিকে বসিয়ে এটা ওটা করে। এখন তুই বল তুই কোনটা করবি?”ইমা ভাবে সত্যি তো করবে টা কি তাহলে? রুমে ঐ হিটলারের সামনে বসে দম নিতেও ভয় লাগে।ইরা, চুমকি ইমাকে ভাবতে দেখে শব্দ করে হাসে।তা দেখে ইমা লজ্জায় বোনের কাঁধে মুখ লুকায়।
” হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না।চল বসার ঘরে গিয়ে টিভি দেখি গে।”
ইমা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে ইরার শাড়ির আঁচল ধরে পিছু পিছু যায়।ইরা চুমকি কে বলে সানার জন্য দুধ গরম করে দিতে।
দু বোন বসে টিভি দেখছিল এমন সময় ইরার শ্বাশুড়ি আসলো।ইমা দাড়িয়ে সালাম দিতেই ইরার শ্বাশুড়ি হেসে ইমাকে জড়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে পাশে বসায়।
” আমি জানি আমার বউমার বোন লক্ষিমন্ত একটা মেয়ে। যে যাই বলুক আমার ইরার বোনের উপর অগাধ বিশ্বাস।হ্যাঁ রে মা! আমার ঐ বদরাগী একরোখা ছেলেটাকে মানুষ করে দে না।”ইমার লজ্জা লাগে চাচী শ্বাশুড়ির কথা শুনে।নত মস্তকে চুপচাপ বসে আড়চোখে বোনের দিকে তাকায়।ইরা মৃদু হেসে শ্বাশুড়িকে বলে
“আম্মু তুমি আমার বোনকে চিনো না।তোমার ঐ একরোখা, বান্দর ছেলেকে ও নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে দেখো।”
ইমা বোনের কথা শুনে হা করে তাকিয়ে থাকলো।ইরার শ্বাশুড়ি হেসে ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো
“ছেলেটাকে তুই আপন করে নে মা।ও উপরে যতোটা শক্ত ভেতরে ততটায় নরম।কাওকে বোঝায় না।কিন্তু আমি ওর কাকী। আমি জানি ও এখনও একটু ভালোবাসার জন্য কেমন ছটফট করে।ছোট বেলা থেকে চোখের সামনে পাথর হয়ে যেতে দেখেছি রে মা।”শায়লা বেগম কথাটা বলে চোখ মোছে।ইমাকে প্রানভরে দুআ করে উঠে রুমে চলে যায়।ইমা সেদিক তাকিয়ে আছে দেখে ইরা ঠ্যালা দিয়ে বলে
” আমার শ্বাশুড়ি ইমোশনাল মানুষ।শান ভাইয়ের দ্বিতীয় মায়ের মতো।কাকি হলে কি হবে মায়ের মতো ভালোবাসে।তার মনে কষ্ট দিস না।খুবই ভালো মনের মানুষ উনি।”
” সে তো বুঝলাম এখন তুই বল।আমাকে ওসব কেন বললি? নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানো কিসব?”
” ভুল কি বলছি।তোকে আমি চিনি না ইমুনি?তুই যে চুপচাপ আছিস তার পেছনে ঘাবলা আছে।শান ভাইয়ের ১৩ টা বাজানোর প্লান করছিস তাই না?”
ইমা থতমত খেয়ে আমতা আমতা করে বলে
“ক-ওওঐ। সর। আমি যাই আমার ঘুম পাইছে।” ইমা উঠে সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ইরা শব্দ করে হেসে বলে
” ইমুনি! বোনের চোখে ধুলো দেওয়া অতো সম্ভব না।হেল্প লাগলে আমাকে বলিস।”
” কচু বলবো।” ইমা ভেংচি কেটে উপরে উঠতেই চুমকিকে মুখ কালো করে দুধ ভর্তি গ্লাস সহ সানার রুম থেকে ফেরত আসতে দেখে।ইমা যেতে যেতে শোনে চুমকি ইরাকে বলছে সানা দুধ খাবে না।তাতে ইরার ঠোঁটে সদ্য ফোটা হাসিটুকু ম্লান হয়ে গেল।
ইমা বিছানায় শুয়ে শানকে একমনে কাজ করতে দেখছে। মনে মনে বিরবির করে বলছে
” কি শান্তি! কি শান্তি। শান্তির মাইরে বাপ।দেখ তোর শান্তিকে আমি কি করি?”
ইমা অস্বস্তি হওয়ার মতো বিছানায় নড়ে চড়ে।মাথা ধরে উঠে বসে। মুখে এক আকাশ বিষাদের ছায়া।
শান ল্যাপটপ থেকে মুখ উচু করে ভ্রুকুটি করে বলে
” এনিথিং রং।”
ইমা বিরবির করে বলে
” হ!বহুত লাল নীলা রং।তয় আমার না তোর মুখের হবে।”
” কি হলো?রাতে জীন টিন ধরে নাকি তোমাকে?বিরবির করছ কেন?যা বলবে নির্ভয়ে বলতে পারো।কথা দিচ্ছি আর যা করি খেয়ে ফেলবো না।”
ইমা শানের কথা শুনে রাগ সংবরণ করে মুখটা ছোট, চোখ দুটোয় ঘুমে ঢুলুঢুলু ভাব এনে বলে
” আমার না ঘুম পাচ্ছে। ”
” তো ঘুমাও।নাকি গান,কবিতা বলে ঘুম পাড়ানো লাগবে।লাগলে বলো এর চেয়ে ভালো পদ্ধতি আছে আমার কাছে।”শানের ঠোঁটে স্পষ্ট দুষ্টুমির আভাস।ইমা লক্ষণ সুবিধার না ভেবে তাড়াতাড়ি বলে ফেললো।
” আসলে লাইট অন থাকলে আমি ঘুমাতে পারি না।”
শান ইমার বসে থাকার অর্থ বুঝে বিরক্ত হয়ে বললো
” অভ্যাস করে নাও।”
” আচ্ছা! উফ মাথাটা কি যন্ত্রনা করছে।বমি ও আসছে। ওয়াক।ইমা বমি করার ভঙ্গি করতেই শান লাফ দিয়ে দাড়িয়ে পড়ে।
” হোয়াট রাবিশ!কি শুরু করেছ এসব।আমি লাইট অফ করতে পারবো না। দেখছ না কাজ করছি।”
” ওয়াক! আল্লাহ গো মাথায় কি ব্যথা হচ্ছে? একটু বমি করলে হালকা লাগতো। আপনি কাজ করেন আমি ঠিক আস্তে আস্তে শুয়ে পড়বো।ওয়াক! ওয়াক।”
” ডিসগাস্টিং! শান ল্যাপটপ নিয়ে রেগে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
ইমা উঁকি দিয়ে শান চলে গেছে নিশ্চিত হয়ে খুশিতে একটা লাফ দিয়ে আনন্দিত মনে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
” ব্যাটা খবিশ! লাইট তো আমিও বন্ধ করুম না।কিন্তু তোরেও এ ঘরে থাকতে দিমু না।সবে তো শুরু শানের বাচ্চা চার কোনাচ্চা। তোর জীবন আমি তামা তামা না করে ছাড়ছি তাইলে আমার নাম ইমা না। আহ! ইমা প্রতিশোধ নিতে পেরে কি যে মজা লাগে রে।কলিজায় একটু শান্তি পাইলাম আহ!”
?তোমার আকাশে হব প্রজাপতি
পর্ব ১৪
Writer Tanishq Sheikh
রাত ২ঃ২০,
শহরের যান্ত্রিক কোলাহল থেমে পুরো শহরজুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে।গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন শহরের মানুষগুলো।তবে কারো কারো চোখে সে শান্তির ঘুম নেই।চোখজুড়ে শুধুই বিষন্নতা। শান তাদেরই মতো একজন। যার চোখে সর্বদা বিষাদের আগুন জ্বলে।ল্যাপটপ বন্ধ করে ঘরে এসে দেখে লাইট অন করেই ইমা ঘুমিয়ে পড়েছে।শান নিঃশব্দে ধীর পায়ে লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে দিল।পুরো ঘরটায় হালকা আলো ছড়িয়ে পড়েছে।শান ল্যাপটপটা সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই ইমার ঘুমঘুম মুখটা দেখে দৃষ্টি সরাতে পারে না।মানুষ ঘুমালে নিষ্পাপ মনে হয়।ঠিক সদ্য ভূমিষ্ঠ একটা বাচ্চার মতো দেখায়।হাত পা গুটিয়ে একপাশে গভীর ঘুমের রাজ্যে ইমা।শান মোহমুগ্ধতায় ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায়।ইমার মুখটা মন ভরে দেখে যায়।ধীরে হাটুমুড়ে বসে।ইমার চিকন লম্বা নাকটা,ঘন পাঁপড়ি দিয়ে ঢাকা চোখের পাতা,কোনো দক্ষ শিল্পীর তুলিতে আকা আকর্ষণীয় গোলাপি ছোট্ট ঠোঁট জোড়া।শান এসব ভাবতে ভাবতে আনমনেই হাসে।ইমার ফর্সা তৈলাক্ত গাল ড্রিম লাইটের স্বল্প আলোয় আরও বেশি আকর্ষণীয় লাগছে।শান নিজেকে সে আকর্ষণ থেকে ফেরাতে পারে না।অতি সাবধানে ইমার গালে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায়।ইচ্ছা করছে সিনার সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ঘুমাতে তাহলে যদি চোখে ঘুম আসে।কিন্তু না এই সুন্দর মুহুর্ত নিজের স্বার্থে নষ্ট করবে না শান।আরও কিছুক্ষণ দেখে শান উঠে ব্যালকনিতে চলে আসে।মিটমিট করা জ্বলা তারার দেশে শান নির্বাক চেয়ে থাকে।মাথার উপর এক ফালি চাঁদ। শান আকাশে পানে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বির বির করে বলে
” কি দিয়েছ আমাকে?দৈন্যতা, দুঃখ,অপমান,একাকিত্ব ছাড়া কিছুই না।চাই না তোমার দেওয়া কিছুই। শান নিহান খান তার শক্তি দিয়েই সব হাসিল করবে।হোক সেটা সুখ, সম্পদ কিংবা ভালোবাসা।”
এই রাতের মিটমিট জ্বলা তারারা, ঐ একা চাঁদ সাক্ষী শান নিহান খানও কাঁদে। সবার অলক্ষ্যে পাঁজর ভাঙা আর্তনাদে ঘুমড়ে কাঁদে।ভালোবাসা শূন্যতায় জর্জরিত হয়ে প্রতিনিয়ত একাকীত্বে ভোগে।কথিত আছে প্রতিদিন ১৫ টি সিগারেট খাওয়া আর একাকিত্বে থাকা সমান কথা।কেউ জানে না এই রাতের আঁধারে মুখ লুকিয়ে ডুবে ডুবে কষ্টে শ্বাস প্রশ্বাস ছাড়ে শান।এক ছটা আলোর প্রতিক্ষায় ছটফট করে।
ফজরের আজানের পরপরই ইমার ঘুম ভাঙে।আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠতেই সামনের সোফায় শানকে কুশন বুকে জড়িয়ে ঘুমাতে দেখে।শানকে দেখে ইমা ভাবে
” কি নির্মল,সুশ্রী মুখটা অথচ ভেতরটা কপট আর অসুন্দর।ঘুমিয়ে থাকলে কি সহজ সরল লাগে চেহারাটা কিন্তু বাস্তবে হিটলার।নাৎসিবাদীর মতো নিষ্ঠুর।”
ইমা মুখ ভেংচে উঠতে যাবে তখনই খেয়াল করে ওর বুকে ওড়না নেই।
” আল্লাহ গো! মানইজ্জত শেষ।ঐ ওড়না কই তুই?”ইমা বিরবির করতে করতে গায়ে দেওয়া চাদরটা উল্টে ওড়না খুজে বের করে।ওয়াশরুমে ঢুকে অজু করে রুমে ফিরে আসে।নামাজের জন্য জায়নামাজ খুজতে থাকে কিন্তু সেটা তো এঘরের কোথাও নেই।এতো সকালে ইরাপুর ঘরে যাওয়াটাও শোভনীয় লাগছে না।অবশেষে নিরুপায় হয়ে পরিষ্কার ওড়না পেতে তাতে নামাজ আদায় করে।শানের খুব পাতলা ঘুম।সামান্য শব্দ হলেই ঘুম ভেঙে যায়।ইমার জায়নামাজ খোঁজার সময় আলমারির আওয়াজেই শানের ঘুম ভেঙে যায়।তবুও চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে।মাথায় ওড়না পেচানো ইমাকে নামাজে দু’হাত তুলে মোনাজাতে বসা দেখে শান চোখ মেলে সেদিক তাকিয়ে থাকে।পবিত্রতা দৃষ্টি ভেদ করে অন্তর সতেজ করে তোলে।
শান ব্রেকফাস্ট করে অফিসে চলে যায়।ইমা ইরার সাথে এটা সেটা করে গল্প গুজবে দিন পাড় করে।শান সন্ধ্যার আগে আর ফিরবে না জেনে ঘরে গিয়ে একটু ঘুমিয়েও নেয়।বিকালে যখন ওঠে সবার দুপুরের খাওয়া শেষ।ইরা ইমাকে খাবার প্লেট সহ লিভিং রুমে নিয়ে আসে।ইমা খাচ্ছে আর দু বোন মিলে খোশগল্প করছে।
” বাহ! দুবোন তো ভালোই দখল করে নিছ বাড়িটা।বরিশাইল্লা চালাকের বংশ।দেশ ভাইজা খাওয়া এলাকার লোক।”
ইরা ইমার রাগে মুখ শক্ত হয়ে যায়।বাড়িতে এ সময় কেউ নেই জেনেই জহুরা মামী এসব বলছে।মনের খায়েশ মিটিয়ে ইরা ইমাকে অপমান করার ফন্দি এঁটে এসেছে।
ইরা কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইমা বলে
” আমরা তো দেশ ভাইজা খাওয়া এলাকার লোক আর আপনারা যে মানুষ ভাইজা খাওয়া এলাকার লোক।ঝগড়া করার জন্য জিহ্বা চুলকায় আপনার কেন? এলাকা নিয়ে কিছু বলবেন না মামী।আমি ইরাপু না।ইট ছুঁড়লে পাটকেল ফেরত দিয়ে দেব।”
” আল্লাহ গো আল্লাহ! কি সাংঘাতিক বউ।দুদিনও হলো এ বাড়ি পা দেয় নাই এরমধ্যেই কথার ধাচ শোনো।আজই শানকে বলবো তুমি আমাকে কি বলছ?”
মামীর কাঁদো কাঁদো মুখের কথা শুনে ইমা ভেটকি মেরে বলে
” ও মোর সুবহানাল্লাহ!মুই তো ভয় পাইয়া গেছি।মোরে কেউ ধরো।যান গিয়ে বলেন গা।আমার কচু করবো আপনার শান।খবিশের মামী খবিশ।”
জহুরা দেখছে এ মেয়ে ইরার চেয়ে বেশি চালাক।এর সাথে কথায় পেরে উঠবে না।আপাতত চুপ থেকে মোক্ষম সময়ের অপেক্ষা করতে হবে।জহুরা মুখ সিটকে বলে
” চাপা কি নতুন বউয়ের?মুখে খই ফোটে ও শৌখিনের মা!কি দজ্জাল বউ ঘরে তুলে আনছে।আমারে কয় খবিশ।” জহুরা মামী যেতেই ইমা মুখ ভেংচে খেতে বসে।ইরা চিন্তিত মুখে বলে
” এ মহিলা ডেঞ্জারাস। যা বলে ইগনোর করার চেষ্টা করবি নয়তো শান ভাইকে কানপড়া দেবে।”
ইমা তাচ্ছিল্য করে বলে,
” দিলে দিক।আমার তাতে কিছুই আসে যায় না।আমাকে অপমান করে কিছু বললেই আমি পাল্টা জবাব দেব।অনেক সয়েছি।ভালোগিরিও দেখাইছি।ফল কি পেয়েছি? লাঞ্ছনা, নির্যাতন।”ইমার চোখে জল থই থই করে।ইরা ইমাকে জড়িয়ে ধরে।
” থাক কাদিস না।ভালো মানুষের জন্য ভালো কিছুই অপেক্ষা করে দেখেনিস।এখন খা।আমি সানাকে দেখে আসি।মেয়েটা নিজের জীবনটা শেষ করে দিচ্ছে।এমন করলে পেটের বাচ্চাটা বাঁচানো যাবে না?”
ইমা খাবার এটো প্লেট টেবিলে রেখে বলে
” আপু সত্যি কি ওর পেটে বাচ্চা? ”
” হ্যাঁ রে।বেচারির জন্য কষ্ট হয়।আবির এতোবড় লম্পট ভাবতেও পারিনি।ফুলের মতো মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিল।তোর কপাল ভালো আল্লাহ শান ভাইকে দিয়ে তোকে বাঁচিয়েছে।”
ইরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে চলে যায়।ইমা ঠাঁই দাড়িয়ে থাকে। কথাগুলো ঝনঝন করে কানের পর্দায় আঘাত করে।মানুষ কতো রূপ বদলায়।ভালোবেসে বিশ্বাস করার ফল বিশ্বাসঘাতগতা করে দেয়।সানার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতেই গায়ে কাটা দেয়।সানার জন্য হঠাৎ ইমার কষ্ট হতে লাগলো।কিন্তু সাহস পেল না সানার মুখোমুখি হতে।
আবির শানের ভয়ে আত্মগোপন করে আছে উত্তরবঙ্গে।পাপের শাস্তি কতোটা ভয়ানক হয় মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে এমন ছন্নছাড়া জীবন কাটিয়ে।প্রতিনিয়ত মৃত্যুর ভয় মাথার উপর।মনে পড়ছে পাপের অধ্যায়।সানা সহ অনেক মেয়েকেই সে প্রয়োজন শেষে জীবন থেকে ছুড়ে ফেলেছে।সানাকে প্রথম দেখেই আবিরের ভেতরের যৌন ক্ষুধা জেগে উঠেছিল।সানা লম্বা,আকর্ষণীয় গায়ের গড়ন, দেখতে অনিন্দ্য সুন্দরী আর চোহারায় সরলতা ভরা।আবির কারো ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে সম্পর্কে যায় না।সানার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।সানাকে ফাসাতে তেমন একটা বেগ পেতে হয় নি।শহরের মেয়ে হয়েও সানা সরল।এই সরলতার সুযোগ নিয়ে আবির সানাকে প্রেমের পাগলামীতে দূর্বল করে ফেলে।অনেক কেয়ারিং,সারপ্রাইজ গিফট সহ নানা রোমান্টিক উপায়ে সানার সরল মনে সহজেই জায়গা করে নেয়।প্রেমে ফাসানো সহজ হলেও বিছানায় নিতে বেগ পেতে হয়।সানা বিয়ের আগে কিছুতেই এসব করতে রাজি ছিল না।আবির তখন ব্রেকাপের ভয় দেখিয়ে,অবিশ্বাস করার,ভালো না বাসার নানা দোষ দিয়ে সানাকে কষ্ট দিতে থাকে।সানা আবিরের মোহে এতোটাই মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল যে আবিরের সব কথায় সে বিশ্বাস করতে লাগলো।আবিরকে ছাড়া সানার শ্বাস প্রশ্বাস নিতেও কষ্ট হতো।অবশেষে আবির সফল হলো।সানা ভালোবাসার প্রমান দিতে আবিরকে স্বর্বস্ব লুটিয়ে দিল বিশ্বাসে।আবিরের মতো লম্পটদের জীবনে বিশ্বাস বলে কোনো শব্দ নেই।যা আছে তা শুধুই ধোঁকা। সরল সানা আবিরের ডাকে সাড়া দিতে থাকে।সানার ক্রমশ আবিরের ব্যবহারে সন্দেহ হতে থাকে।আবিরকে ধরে রাখার স্বার্থে সে নিজের পরিচয় দেয়।ভাবে এতে আবির লোভে পড়ে হোক আর ভয়েই হোক সানারই থাকবে।কিন্তু হয় উল্টোটা।আবির যখন জানে সানা শান নিহান খানের বোন।ভয়ে তার রোম রোম দাড়িয়ে যায়।এতোবড় বোকামী করে মাথায় হাত দিয়ে বসে।সানা আবিরকে বলে দু’জনে দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে।আবির সানাকে মিথ্যা স্বান্তনা দিয়ে বাড়ি এসে মা’কে সব জানায়।ছেলের নষ্টের হোতা আবিরের মা ছেলেকে ঐদিন চড় দেয় আসন্ন বিপদ সংকেত পেয়ে।কারন শান নিহান খানের জান তার বোন এ কথা শহরের সবাই জানে।শুধু বোনকেই চেনে না।কারন শান তার পরিবারকে কখনোই মিডিয়ার সামনে আনে না।আবিরের মার বিপি হাই হয়ে যায়।বিছানায় পড়ে আল্লাহ কে ডাকতে থাকে এই বিপদে।
তখন আবির বলে,
” আম্মু! এককাজ করি সানাকে আমি বিয়ে করে নেই।তাহলে রাজ্য, রাজকন্যা দুটোই পাবো।শান নিহান খান তখন ভগ্নিপতি হিসেবে মাথায় তুলে রাখবে।আমার তো লটারি লাইগা গেছে আম্মু।”ছেলের নির্বুদ্ধিতা দেখে আবিরের মা কষিয়ে আরও দুটো গালে বসায় আবিরের।
” হারামজাদা, কুত্তার বাচ্চা! শান নিহান খান ও। একমিনিটও লাগবে না তোর কুকর্ম ধরতে ওর।বিয়ে করলেও ও তোকে খুন করবেই।ওর কাছে মানসম্মান ই সব।তুই সানার সাথে যা করেছিস এর জন্য ও তোকে মেনে নেওয়া তো দূরের কথা কেটে কুঁচি কুঁচি করে শেয়াল কুকুর দিয়ে খাওয়াবে।”
” আম্মু তুমি ভয় দেখাচ্ছ কেন?এসব তোমার ভুল ধারণা।”
আবিরের আত্মবিশ্বাসে এক বালতি হতাশার জল ঢেলে বলে
” আমার ভুল ধারণা।যা নেটে গিয়ে ডিটেইলস জেনে দ্যাখ।আমাদের এলাকার মফিজ মাস্তানের চোখ উপড়ে ফেলেছে কে বলতো?”
” ওর শত্রু পক্ষ। ”
” ওর শত্রু পক্ষ টক্ষ কেউ না।শান নিহান খান নিজেই এটা করেছে।আজমত মাস্টারের মেয়েরে রেপ করেছিল মফিজ।মেয়েটা লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যা করে।শানের স্কুলের মাস্টার ছিল আজমত।শানের কানে কথাটা যেতেই রাতেই মফিজকে ধরে নিয়ে ওর দু চোখ উপড়ে ওর পুরুষত্ব নষ্ট করে দেয়।এখন ভাব অন্য মেয়ের জন্য যে এতোটা ভয়ানক হতে পারে। নিজের বোনের জন্য কি পরিমাণ হবে?”
আবিরের শরীর দিয়ে দরদর করে ঘাম ঝরে।মৃত্যুর ভয় চোখে মুখে স্পষ্ট ফুটে ওঠে।এরপর আবির নিজেকে গৃহবন্দী করে ফেলে।নেশায় ডুবে শানের ভয় ভুলতে থাকে।সানার সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।আবিরের ভবিষ্যত চিন্তা করে আবিরের মা কৌশলে স্বামীকে দিয়ে ইঙ্গিতে ইরার চাচাতো বোন ইমাকে বউ করতে চাই।বড় মিঞা বন্ধুর ইঙ্গিত বুঝে নিজেই অনুরোধ করে আবিরের সাথে ইমার বিয়ে দেওয়ার জন্য।কিন্তু এদের আসল কুটকৌশল বড় মিঞার সরল মন ধরতে পারে নি।আবিরের বাবা ভালো লোক হলেও গোবেচারা টাইপ।বউ ছেলের উপর তার এক কথাও চলে না।আবিরের আজ বাবার কথা বার বার মনে পড়ছে।বাবা নিষেধ করতো খারাপ পথে না যাওয়ার জন্য। কিন্তু আবির শোনে নি।আজ এতোদূর মানবেতর জীবনযাপন করে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে সে।এক বেলা খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছে।মা কে মোবাইল ও করতে পারছে না ভয়ে।দিনে অলি গলিতে লুকিয়ে রাতে কোনো নির্জন ঝোপের আড়ালে নিরাপদ স্থানে শুয়ে পাড় করে।মনে সর্বক্ষণ ভয় এই বুঝি শানের লোকের হাতে ধরা পড়লো।
শান নিহান খান ঢাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেও আবিরকে পাই নি।লোক লাগিয়েছে জেলায় জেলায়।আবিরকে না মেরে শানের শান্তি নেই।তিল তিল করে মারবে।সানার কষ্টের বহুগুন আবিরকে ফেরত দিয়ে তবেই সানাকে দেখবে।সানাকে আজ কতোদিন দু’চোখে দেখে না।বুকের বা পাশটা ব্যথায় কাতর হয়ে আছে। বোনের কষ্ট শানকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে।
পর্ব ১৫
Writer Tanishq Sheikh
সন্ধ্যার আলো নিভু নিভু করছে।ইরা, ইমা রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত। রাতের রান্না প্রায় শেষের দিকে।আজ ইমা কাঁঠালের এঁচোড় দিয়ে গরুর মাংস রান্না করেছে আর শেষ পাতের জন্য গাজরের হালুয়া।ইমাদের বাড়ির মেয়েরা ক্লাস সিক্স, সেভেনে ওঠার পরই রান্নায় হাতে খড়ি দেওয়া শুরু করে।এসএসসি শেষ করতে করতে তারা এ বিষয়ে পটু হয়ে যায়।ইমাও ঘড়কন্নার সকল কাজে সিদ্ধহস্ত বলা চলে।আজ ইরার কথায় সে ইরার পছন্দের কাঁঠালের এঁচোড় রান্না করেছে।রান্না শেষ করে ফ্রেশ হতে রুমে চলে আসে ইমা।বাকি কাজ চুমকিই করবে।রুমে এসে ওড়নাটা বিছানায় ফেলে হাত মুখ ধুয়ে ওজু করে ফিরে আসে।আবার সেই লজ্জাজনক মুহুর্তে পড়ে যায়।শান সোফায় ওর দিকে পিঠ করে বসে সু লেস খুলছে।ইমা এককোনে শিটে দাড়িয়ে থাকে ফ্লোরে আঙুল ঘষতে ঘষতে।ওড়নাটা যদি উড়ে আসতে পারতো? ইশশ এখন কি হবে? ইমার ভাবনারা একপ্রকার লড়াই শুরু করেছে শান দেখলে কি হবে ভেবে।কিন্তু মানুষের ভাবনা আর বাস্তবতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিন্ন হয়।মাঝে মাঝে অপ্রত্যাশিতও হয়।শান সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে বিছানা উপর থেকে ইমার ওড়নাটা নিয়ে ইমার সামনে তুলে ধরে।
” গায়ে জাস্ট ওড়নাই তো নেই অথচ ভাব নিচ্ছ যেন ন্যুড দাড়িয়ে আছো? আজব প্রাণী।হিয়ার ইউ আর।”
ইমা লজ্জা চোখে উপরে তাকিয়ে শানের তীক্ষ্ণ চাহনী দেখে শানের বাড়ানো ওড়নাটা খপ করে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে নেয়।মনে মনে যে আশঙ্কা করেছিল তা না ফলায় ইমা বেশ স্বস্তি পেল।শান ঘুরে শার্ট চেঞ্জ করে সোফায় রেখে আলমারি থেকে নতুন আরেকটা টিশার্ট, প্যান্ট বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়।ইমা শানের বলা কথায় শানের পেছনে তাকিয়ে ভেংচে দাঁত কিড়মিড় করে।বিছানার দিকে এগিয়ে আসতেই একপাশে নতুন একটা জায়নামাজ দেখে অবাক হয়।এদিক ওদিক তাকায় পরক্ষণে মনে পড়ে ইরা আপাকে জায়নামাজের কথা বলা হয় নি।তাহলে কে রাখলো এখানে?ইমা হাতে নিয়ে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবে জায়নামাজ এখানে এলো কি করে? অবশেষে ভাবনার সমাপ্তি টেনে নামাজে দাড়িয়ে যায়।নামাজ শেষে জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে জিকির করছিল তখনই শানের দিকে নজর পড়লো।মনের মধ্যে হঠাৎই উদয় হলো।জায়নামাজ টা আবার এই হিটলার আনে নি তো? কিন্তু এইটা তো শুনছি নামাজ পড়ে না।তাহলে? ইমা সংকোচ কাটিয়ে বলেই ফেললো
” এটা কি আপনি এনেছেন?”
শান মোবাইলে মুখ ডুবিয়েই বললো
” হুমম।”
ইমার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়।তাড়াতাড়ি জায়নামাজটা শানের পাশে রেখে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়
” সরি! আমি জানতাম না ওটা আপনার।ভুলে ব্যবহার করে ফেলেছি।”
শান চোয়াল শক্ত করে মোবাইলটা এমন ভাবে পাশে রাখলো যেন ইমা মহা বিরক্ত করে ফেলেছে।জায়নামাজের দিকে তাকিয়ে ওঠা হাতে নিয়ে ইমার হাতে ধরিয়ে দিল
” একবার বলেছি আমি কারো ব্যবহার করা জিনিস ব্যবহার করি না।এটা তুমি ব্যবহার করেছ তুমিই রেখে দাও।”
ইমা মলিন মুখে বললো
” আমার লাগবে না। আমি এখনই পরিষ্কার করে দিচ্ছি।”
” তোমার মনে হয় না ইদানিং একটু বেশিই পকপক করছ আমার সামনে।ডোন্ট ক্রস ইওর লিমিট।”শান চোখ পাকিয়ে কথাটা বলে আবার মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
” আপনি বিশ্বাস করুন,,,
ইমার কথা শেষ করার আগেই শান উঠে গিয়ে ইমার কোমর জড়িয়ে দেয়ালে চেপে ধরে।
” হু এবার বলো।”
ইমা শানের হাত কোমর থেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যায়।
” ছাড়ুন আমাকে।”
” না ছাড়বো না।শান আরও জোরেই কোমরে ধরতে ইমা ব্যথায় আহ করে ওঠে।
” আমি ব্যথা পাচ্ছি ছাড়ুন।আর কিছু বলবো না।”
শান ইমার গোমড়া মুখটা দেখে মৃদু হেসে আবার সোফায় এসে বসে
“ট্যালেন্ট আছে।অল্পতেই বুঝে যাও।গুড।
ইমার মনে হচ্ছে শানের ধরা কোমরের পাশটা অসাড় হয়ে আছে।এতো জোরে চেপে ধরেছিল। ইমা হাত দিয়ে মালিশ করতে করতে জায়নামাজের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে রাগে আবার মুখ ফোসকে বলে ফেলে
” আপনার জায়নামাজ আপনি যা খুশি করেন করতে পারেন। আমি নেব না। নেব না।”
শান ইমার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই, ইমা ঢোক গিলে দরজার দিকে তাকিয়ে ভো দৌড় দিতে যায় কিন্তু বিধিবাম। শান আগে দরজায় দাড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ায়।
” ভেবেছিলাম তুমি ট্যালেন্ট কিন্তু না তুমি তো গন্ড মূর্খ।শানের বউ এমন গন্ড মূর্খ বিষয়টা কেমন দেখায় না?”শান ঠোঁটে আঙুল বুলাতে বুলাতে তীক্ষ্ণ নজরে ইমার দিকে অগ্রসর হতে থাকে।ইমা ভয়ে ভয়ে পিছুপা হতেই বিছানার উপর চিৎপটাং হয়ে পড়ে।
শানকে নিজের উপর ঝুঁকতে দেখে বলে
” দেখুন আমি গন্ড মূর্খ ফন্ড মূর্খ যাই হই তাতেই ভালো।আপনার পাশে আমাকে না মানালে ছেড়ে দেন।যাকে মানায় তাকেই বিয়ে করেন যান।”কথাটা বলে ইমা জিহ্বা কামড়ে নিজের বোকামি কথায় চোখ বন্ধ করে মনে মনে নিজেকে বকতে থাকে।
বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে সামনে শানকে না দেখে উঠে বসে।পুরো ঘরে চোখ বুলিয়েও তার সন্ধান মেলে না।ইমা বুকে থু থু দিয়ে দরজা খুলে বাইরে চলে আসে। বুকটা সেই রকম ধুকপুক করছে।রান্নাঘরে গিয়ে দেখে চুমকি সব খাবার টেবিলে সাজাচ্ছে।ইমাও চুমকির সাথে হাত লাগায়।ইমা রান্না ঘরেই চুমকির সাথে গল্প করে কাটায়। উপরে আর যায় না।
রাতের খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসেছে।শান না করে দিয়েছে সে আজ খাবে না।বাকিরা খেয়ে উঠে যার যার রুমে চলে যায়।ইরা জোর করে ইমার হাতে ইমার রান্না করা খাবার ট্রে তে সাজিয়ে শানের জন্য পাঠিয়ে দেয়।ইমা শান আর ওর মধ্যকার সমস্যা কাওকে বলতে চাই না।তাই অনিচ্ছা স্বত্বেও খাবারগুলো নিয়ে শানের ঘরে আসে।রুমে এসে দেখে শান ল্যাপটপে কাজ করছে।ইমা যে ভেতরে ঢুকেছে সেদিকে সে দৃষ্টিও দেয় নি।ইমা ধীর পায়ে শানের সামনে এসে চুপ করে খাবার ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে থাকে।ভেবেছে হয়তো শান জিজ্ঞেস করবে।কিন্তু করছে না দেখে নিজেই বলে
” আপনার খাবার।”
না শানের কোনো জবাব নেই।ইমার রাগ লাগে।মনে মনে বিরবির করে।
” আজব একটা তো কিছু বলবে।হ্যাঁ বা না।ভাবে বাঁচে না।”ইমা আবার বলে
” এই শুনছেন! আপনার খাবার।”
” সমস্যা কি তোমার? ”
শানের রাগী চোখের দিকে তাকিয়ে ইমা কিছুটা ঘাবড়ে যায়।ভয়ে ভয়ে বলে
” আপা খাবার পাঠিয়েছে আপনার জন্য। খেয়ে নিন।”
” আমার সামনে থেকে যাও।যাও।শানের চিৎকার ইমা ভয় পেয়ে ট্রে নিচে ফেলে দেয়।খাবারে পাত্র ভেঙে ফ্লোরে খাবার পড়ে বিশ্রী অবস্থা হয়ে গেছে।সেদিকে তাকিয়ে লজ্জায় ইমা কেঁদে বিছানায় ছুটে যায়। শুয়ে কাঁদতে থাকে নিরবে।শান চোখ বন্ধ করে কপাল চাপড়ায় নিজের অসংযত ব্যবহারের কারনে। ইমার উপর এতো রাগ কেন করলো নিজেও বুঝতে পারছে না।শুধু জানে ইমার বলা ” আমাকে ছেড়ে দেন ” কথাটা শানকে কষ্ট দিয়েছে।এতোটাই যে শানের বুক কেঁপেছিল।সেই রাগটায় এখন ইমার উপর ঝেড়েছে।কিন্তু কেন? ইমার কাছে কিসের প্রত্যাশা শানের? কোনোকিছুরই না।তবুও প্রত্যাশা করছে অবচেতন মনে একটু ভালোবাসার।স্বামী হওয়ার দাবী করে বসে মনের অজান্তেই।যদিও শান জানে ইমার মনে ওর জন্য বিন্দুমাত্র জায়গা নেই।যদিও বা থাকে তবে যা আছে তা হলো ঘৃণা। শান নিজেকে শান্ত করে ইমার বিছানার পাশে গিয়ে দাড়ায়।
” দুঃখিত ওমন রূঢ় আচরণের জন্য। ”
শানের দুঃখিত বলা ইমার কাছে হাস্যকর লাগলো।চোখ মুছে ঝাঁঝালো গলায় বললো
” দুঃখিত!ইয়া আল্লাহ একি শুনাইলা।শান নিহান খান একটা তুচ্ছ মেয়েকে দুঃখিত বলেছে? কেন এমন নাটক করছেন?জীবনটা তো নষ্টই করে দিয়েছেন এখন এসব বলে কি লাভ?আমার কপালে এসব আচরণই ঠিক আছে।”
” ইমা প্লিজ! পরিস্থিতিই আমাকে ওসব করতে বাধ্য করেছে।হ্যাঁ আমি মানছি আমি ভালো মানুষ নই।কিন্তু,,,
” কিন্তু কি মি. শান?আমি বলি! কিন্তু আপনার এখন আমার সাথে বেড শেয়ার করতে ইচ্ছা করছে। আপনার চরিত্রার্থের খাতিরে এখন আমাকে আপনার চাই তাই তো?”
” যা ইচ্ছা ভাবতে পারো।তোমার ভাবনার উপর তো আর আমি প্রভাব খাটাতে পারবো না।তবে যেনে রেখো দুনিয়াতে কেউ খারাপ হয়ে জন্ম নেয় না।সমাজ,পরিস্থিতি মানুষকে খারাপ হতে বাধ্য করে।”
ইমা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে
” আপনার কথা শেষ হলে আমাকে একটু একা থাকতে দিলে খুশি হবো।”
” ঠিক আছে।আর কিছুই বলার নাই তোমাকে আমার।তবে হ্যাঁ এতো বেশিও ঘৃণা করো না যে পরে পস্তাতে হয়।”
শান যেতেই ইমা মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়ে।শানের জন্য মনে সত্যিই ঘৃণা ছাড়া কিছুই নেই।ক্ষমতা, সুযোগ থাকলে এই শানকে মেরে পালিয়ে যেত ইমা।বালিশ খামচে কাঁদতে থাকে।
শান ফ্লোরে পড়ে থাকা খাবার পরিষ্কার করতে গিয়ে কাঁচের টুকরোয় লেগে শানের হাত কেটে রক্তে ভেসে যায়।শান হাতটা ধুয়ে মেডিসিন লাগিয়ে নেয়।আজ আর ইমাকে কিছু করা লাগে না।শান স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে চলে যায়।ইমাও একসময় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে নামাজ পড়ে বিছানায় বসতেই দরজায় চুমকির চিৎকারে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয়।
” ম্যাডাম! স্যার কই? ”
ইমা চুমকির কান্নায় ভেজা ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলে
” জানি না তো! কেন কি হয়েছে?আপনি এমন করছেন কেন?”
” ম্যাডাম! সানা আপার অবস্থা খুব খারাপ।ব্লিডিং হচ্ছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ”
চুমকির কান্নাকাটিতে পাশে ঘর থেকে শান বের হয়ে আসে।ইমা দৃষ্টি নত রাখে শানকে দেখে।শানের খারাপ লাগলেও নিজেকে ইমার থেকে দূরে রাখার প্রতিজ্ঞা করে।শান চুমকির কাছে কান্নার কারন জিজ্ঞেস করে।চুমকি শানকে সবটা বলতেই শান হাতের ল্যাপটপ ফেলে সানার ঘরে ছুটে যায়।ইমার পা ভারি হয়ে গেছে।শরীর কাঁপছে অজানা আশঙ্কায়।শানের পড়ে থাকা ল্যাপটপটা কাঁপা হাতে উঠিয়ে বুকে চেপে দাড়িয়ে দেখছে সানাকে শান কোলে করে সিঁড়ি দিয়ে নামছে পেছন পেছন শৌখিন, ইরা,চুমকি,মামী,কাকী,কাকা।সবাই কাঁদছে। সানার মুখটা দেখে ইমার বুক ভারি হয়ে আসে।কি সুন্দর মেয়েটা কঙ্কালসার হয়ে গেছে।সানার শুকিয়ে বিবর্ণ হওয়া মুখটা দেখে ইমা নিজেকে সামলাতে পারলো না।ঘরে এসে কান্নায় ভেঙে পড়লো।একটা মেয়ের সহ্য শক্তি একটা পুরুষের বল শক্তির চেয়েও বেশি।নয়তো এতো প্রতিকূলতায় টিকতে পারতো না তারা।নিঃসঙ্গ,অসহায় নারীরা প্রতিনিয়ত নির্যাতন, কষ্ট,টিকে থাকার লড়াইয়ে মুখ থুবড়ে পড়েওতারা মাটি কামড়ে পড়ে থাকে।ধৈর্য ধরে একদিন সুদিন আসবে।কারো কারো ধৈর্যের মেওয়া ফলে আর কারো জীবনই শেষ হয় ধৈর্যের মেওয়ার স্বাদ না পেয়ে।হয়তো তারা পরকালে পাবে উত্তম ফল।সানার একটা পাপে আজ সে মরণ যন্ত্রনায় দিনাতিপাত করছে।কেউ ক্ষমা করে নি তাকে।একটা ভুলের কারনে তার সরলতা, অন্তরের শুদ্ধতা সব পাপের আবরনে ঢেকে গেছে।নামতে হয়ছে বাঁচার কঠিন লড়াইয়ে।একটা অবৈধ সম্পর্কের টানে সকল সম্পর্কের জাল ছিড়ে সানা আজ নিঃসঙ্গ। অবৈধ সম্পর্ক কখনোই সুখ বয়ে আনে না।ভুল মানুষকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসার ফল ভোগ করতেই হবে।কারন বিশ্বাসে পূন্য কিন্তু অন্ধবিশ্বাসে পাপ।পাপের শাস্তি প্রায়শ্চিত্তেই যায়।তবে সবকিছুর উপরে একটাকথায় চলে ভাগ্য কর্মের উপর নির্ভরশীল।যে যা কর্ম করবে তার ফল তাকে একচুল হলেও এই দুনিয়ায় ভোগ করে যেতে।সে শানই হোক কিংবা আবির!কর্মফল কেউ এড়াতে পারবে না।
চলবে,,,,