তোমায় ছেড়ে যাব কোথায় পর্ব-২৭

0
917

#তোমায়_ছেড়ে_যাব_কোথায়?
লেখা- মনিরা সুলতানা।
পর্ব – ২৭।

————-*
আজ সন্ধায় ভাইয়া ও ভাবির রিশেপশন অনুষ্ঠান হবে। সেই জন্য সকাল থেকেই সবার তুমুল তোড়জোড়, ব্যাস্ততা। কিন্তু
আজকের দিনটা একদম অন্যরকম চমক নিয়ে আমার সামনে এসেছে। দিনটা অন্যদিনের তুলনায় একটু দেরি করেই শুরু হয়েছিল। কেননা গতকাল রাতে দেরি করে ঘুমাতে গিয়েছিলাম আমরা সবাই। বিয়ে বাড়ি থেকে বউ নিয়ে ফিরে আসতে রাত বারোটা পেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর নতুন বউকে নিয়ে কিছু আনুষ্ঠানিকতা সারতে সারতে মধ্য রাত পেরিয়ে গিয়েছিল। আজ ভাইয়ার বাসর রাত। তাই তাদের রুম নতুন বউ সহ ছেড়ে দিতে হয়েছিল। আমার রুমে আমার আর জায়গা হয়নি। কেননা গতকাল আরমান আমার ভাইয়ার সাথে ছিল। কিন্তু আজ রাতে কামরান ও আরমান ওদের দুই ভাইয়ের জন্য আমার রুমটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমি, তিয়ানা ও তামান্না এক রুমে ছিলাম।
ভাইয়ার রিসেপশন অনুষ্ঠান করতে আমাদেরও কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করা হয়েছে। তাই বাসায় চাপ নেই। কিন্তু আত্মীয়-স্বজনের ভীড়ে বাড়িটা গিজগিজ করছে। তাই এত মানুষের খাওয়া দাওয়া হৈ হল্লোরর কারনে সমস্ত বাড়িটা গমগম করছে। সারাটা দিন তাই আম্মা চাচী ও ফুপুদের প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। একে একে সকালের নাস্তা সারতে সারতে প্রায় দুপুরই হয়ে গেল প্রায়। এরপরে শুরু হলো সবার গোছলের সিরিয়াল। চারটা বাথরুম থাকা সত্ত্বেও এই সিরিয়াল শেষ হতে বিকেল হবে। আমাকেও কেন জানিনা প্রথম সিরিয়ালেই ঠেলে ঠুলে গোসল করতে পাঠানো হয়েছে।
গোসল করে বের হতেই আমার জন্য এত বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল আমিতো ভাবতেই পারিনি। ঢাকা থেকে আমার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনরা প্রায় সবাই এসে বসে আছে। মামাশ্বশুর, বড় খালা শাশুরী, ফুপু শাশুড়িরা এমনকি আমার শাশুড়ি আম্মা এবং দুলাভাই ও তাসমিয়াও ছোট বাচ্চা দুইটাকে নিয়ে চলে এসেছে। শুধু পিউলি আপু এবং ওর মা আসেনি। ওদের দেখে আমার মাথা কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাপার কি? সবাই একসাথে চলে এসেছে আমার বিয়ের এতগুলো দিন পরে এই প্রথম সবাই আমাদের বাড়িতে এলো। সবার সাথে বসে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। হালকা নাস্তা ও ঠান্ডা শরবত পরিবেশ করা হলো। এরপর একে একে তারাও সবাই ফ্রেশ হতে চলে গেল। তারপর যথারিতি সবাই পর্যায়ক্রমে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে কিছু সময় বিশ্রাম নিচ্ছে। আমিও খাওয়া সেরে আমার বেডরুমে গেলাম। কামরান বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তার মনোযোগ মোবাইলের স্ক্রিনে। আমাকে দেখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবার মোবাইলে মনোযোগ দিলো। আমি এগিয়ে গিয়ে বিছানার আরেকপাশে বসলাম।
ওকে প্রশ্ন করলাম,

” কি ব্যাপার সবাই এসেছে দেখছি। তাসমিয়া আপু আর আম্মার আসাটা একেবারে সারপ্রাইজিং ছিল। আমি ওনাদের এইসময় আশাই করিনি তাও এতো ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে। ”

কামরান আমার কথা শুনে মুচকি হেসে বললো, ” কেন তুমি খুশি হও নাই? ”

” অবশ্যই খুশি হয়েছি। আসলে আশার চেয়েও বেশি কিছু পেলে যা হয়, আমি খুবই অবাক হয়েছি। ”

কামরানের মুখে রহস্যময় হাসি ঝুলে আছে। আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি। হঠাৎ ও হাসতে হাসতে বলল, ” ওভাবে তাকিয়ে আছো কেন? কি জানতে চাও বলো।”

” আপনার আচার ব্যবহার সুবিধার ঠেকছে না। কেমন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। কিছু কি লুকাচ্ছেন? ”

” বলতে পারি তার আগে তোমাকে কি বলেছিলাম এখনো আপনি আপনি করছো। আগে তুমি করে বল। তারপর সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।”

আমি হতবিহ্বল হয়ে বিছানার উপর দৃষ্টি রেখে তাকিয়ে আছি। কি বলবো বুঝতে পারছিনা। কামরান কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল,

” খুব কঠিন কিছু কি করতে বলেছি? তোমার বিহেভিয়ার দেখে মনে হচ্ছে অসম্ভব কিছু করতে বলেছি।”

কিছু না বললেই নয়। তাই ইতস্তত করে বললাম, ” হঠাৎ করে তোমার আচরণ কেমন যেন অনেক বদলে গেছে। বিশেষ করে অ্যাক্সি*ডেন্টের পর থেকে তুমি একদম অন্যরকম বিহেব করছো। ”

কামরান হাসতে হাসতে বলল, ” তাই? তা কেমন বদলে গেছি বলে তোমার মনে হচ্ছে? ”

এবার আমি লজ্জায় কি বলবো বুঝতে পারছি না। হঠাৎই বেশি কেয়ারিং, রোমান্টিক আচরণ করতে শুরু করেছে। আগে একটু দূরত্ব বজায় চলত খুবই ভদ্র আচরণ করতো যেন ভাঙ্গা মাছটা উল্টে খেতে পারে না। কিন্তু এখন সেসবের বালাই নেই। পারলে অসভ্য ও বেহায়া হয়ে উঠতেও বাঁধছে না। নিজের লজ্জা ভাব লুকিয়ে সামলে কোনরকমে নতমুখেই বললাম,

” জানিনা। বাদ দেন তো। ”

” আবারো আপনি? এই তুমি এত দূরে বসে আছো কেন এদিকে এসো। কাছে এসো। ” কামরান আমার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলো।

আমি নড়লাম না। আমাকে ঠায় বসে থাকতে দেখে আবারও সে বলল, ” তুমি আসবে নাকি আমি যাব? ”

এবার আমি উঠে বিছানা থেকে নেমে কামরান যে পাশে বসে আছে সেদিকে গিয়ে ওর পাশে বসলাম। সঙ্গে সঙ্গেই আচানক আমার হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের কাছে টেনে নিল। আমি তাল সামলাতে না পেরে একদম ওর বুকের উপর গিয়ে পড়লাম। হঠাৎ এমন করায় আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। বিচলিত দৃষ্টি তুলে ওর দিকে এক পলক তাকালাম। কামরান আমার দিকেই নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমি তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। ওর চোখের দৃষ্টি কেমন গভীর, গাঢ়, মোহগ্রস্ত। সেই দৃষ্টির উপর দৃষ্টি মেলে বেশিক্ষণ থাকতে পারলাম না। চোখ দুটো নিচু করে নিলাম। আবারও সেই অনুভূতির আন্দোলন। হৃদযন্ত্র নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে ধুকপুক করছে প্রচন্ড বেগে। শুধু আমার নয় ওরও নিশ্বাস কেমন ঘন হয়ে উঠেছে। সময় অসময়ে মানুষটা আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। এলোমেলো করে দিচ্ছে। লোকটার সামান্য স্পর্শে আমি এমন গলে যাই কেন নেতিয়ে পরি কেন। সমস্ত বল শক্তি কেমন করে শুষে নেয় যেন। কামরান ওপাশে একটু সরে গিয়ে জায়গা বের করে আমাকে টেনে নিজের বুকের উপর শুইয়ে দিল। আমি সরের পাশে শুতে গেলে কামরান সরতে দিলনা। শক্ত করে আমাকে আগলে ধরে রেখেছে। অগত্যা ওর বুকের ওপর দু’হাতের ভর দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে ওর দিকে মুখ তুলে তাকালাম। ওমনি সে মাথাটা একটু উচু করে উঠিয়ে প্রগাঢ় চুম্বনে আবদ্ধ করল আমার অধর যুগল। কয়েক মুহূর্ত ওভাবেই কেটে গেল। মাথাটা নামিয়ে আবার বালিশে শুয়ে আমার চোখের দিকে চেয়ে গাঢ় স্বরে বললো,

” এতোদিন কেবলমাত্র নতুন সম্পর্কে নিজেকে এডজাস্ট করে সহজ স্বাভাবিক হতে পারো তাই ছাড় দিয়েছিলাম। কিন্তু আর নয়। এখন মনে হচ্ছে সময় দিয়েও ভুল করেছিলাম। তুমিতো সহজ হওয়ার বদলে আরও কঠিন হয়ে গেছ। তাই আজ থেকেই আমাদের দাম্পত্য জীবন শুরু হবে। রেডি থেকো। কেমন? ”

আমার লাজলজ্জা সব নিমিষেই উড়ে গেলো কামরানের কথা শুনে। বলে কি লোকটা। আমি ইচ্ছে করে দুরে গেছি নাকি? তাই প্রতিবাদ করে বললাম,

” একদম নিজের দোষ ঢাকতে আমার দোষ দিবেননা। নিজে যে পিউলিকে দিয়ে মাথা ম্যাসাজ করাতেন, তার ছবি তুলতে চলে গেলেন, পিউলি আপু আপনার ছবি ‘পার্সোনাল ক্যামেরাম্যান’ ক্যাপশন দিয়ে পেজে আপলোড করে, রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে.. ”

কামরান আমার কথার মাঝেই বাধা দিয়ে বলে উঠলো, “দাঁড়াও দাঁড়াও পিউ মাত্র একদিন মাথা ম্যাসাজ করে দিয়েছিল। সেদিন সারাদিন এত বেশি ধকল স্ট্রেস গেছিল। তাই প্রচন্ড মাথা যন্ত্রণা হচ্ছিল। জানো সেদিন কেন জানিনা খুব আশা করেছিলাম তুমি এসে একটু মাথাটা ম্যাসাজ করে দিতে। কখন যেন পিউ এসেছিল। আমি আসলে সেভাবে খেয়ালও করিনি। আরাম বোধ হতে কখন ঘুমিয়েও পড়েছিলাম টেরই পাইনি। কিন্তু তুমি জানলে কি করে? ”

আমি আবারও ওর বুকের উপর থেকে নামতে চাইলাম। কিন্তু কামরান ছাড়লো না। তবে হাতের বাধন আলগা করলো কেবল। স্বামীর বুকের সান্নিধ্যে কাটানো ভালো লাগার মতোই ব্যাপার। আমারও ভালো লাগছে কিন্তু সেই সাথে কেমন লজ্জা এবং অস্বস্তিও হচ্ছে। অভ্যাস নাই যে। কামরান ওর দই হাতের বেষ্টনীতে আমার পিঠের ওপর জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আমি নিজেকে শান্ত করে সহজ হওয়ার চেষ্টা করছি। সামলে নিয়ে বললাম ,

” আপনি কদিন রুমে আসতেননা দেখে সেদিন আপনার খোঁজ করতে গিয়েছিলাম। পরে দাদার রুমে পেলাম। কিন্তু পিউলি আপুকে দেখে চলে এসেছিলাম। সত্যি বলতে আমার মনে সন্দেহের বিজ সেদিন থেকেই ঢুকেছিল। তারপর আম্মার সাথে আপুর তর্কও আমি শুনে ফেলেছিলাম। আপনাকে নাকি সে পেয়ে ছাড়বে। নিজের ভাগ্য নিজেই গড়বে এইসব কথা। আপনি বলেন এসব শুনলে কার মাথা ঠিক থাকে? ”

” তোমার কথা বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি কি ভাবছ আমাকে না বললে আমি কি করে জানবো? তোমাকে তো বলেছি তিয়াদের মত পিউকেও ছোট বেলা থেকে বোনই ভেবে এসেছি। সেদিন যদি পিউর যায়গায় তিয়া বা তাসমি থাকতো তাহলে কি একই রকম ভাবতে বল?”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, ” নাহ্।”

” তাহলে আমার মাথায় কিভাবে আসবে যে আমার এক বোন মাথা ব্যাথা করছে দেখে ম্যাসাজ করে দিচ্ছে এই দৃশ্য দেখে কেউ অন্য ভাবেও নিতে পারে। আমার মনে তো অন্য কোন ভাবনাই আসেনি। তাছাড়া সেদিন তুমি এসেছিলে তাও তো আমি জানতাম না। তাইনা? আর পিউর সাথে বিয়ের ব্যাপারটাও আমি জানতাম না। রোজার শুরুর দিকে পিউ যেদিন ওর ফটোসেশানে আমাকে করতে হবে বলতে এসেছিল আমি খুব ব্যাস্ত থাকায় এমনিতেও নাই করেছিলাম। তাও আরমান হঠাৎ আমায় ডেকে নিয়ে পিউর আপলোড করা ছবিগুলো দেখিয়ে বলেছিল আমি ওকে বোন ভাবলেও পিউ আমাকে ভাই ভাবেনা। এরপর একে একে আমার পিছনে ঘটে যাওয়া অজানা কথাগুলো বলেছিল। বিশ্বাস কর নিজেকে এতো বোকা মনে হচ্ছিল সেদিন। তারপর থেকে পিউ থেকে পারলে দশ হাত দূরে থাকি আমি। তাও সেদিন আমাকে রাস্তায় পেয়ে জানোইতো বাকিটা।”

” হুম জানি। কিন্তু আপনি যে..”

কামরান আমাকে থামিয়ে আবারও বললো, ” আবার আপনি বলে যাচ্ছ তখন থেকে।”

আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করলাম,
” তুমি যে পিউ আপুকে বোন হিসেবে দেখ সেটাতো আর আমি জানতাম না। তাহলে আমার সন্দেহ করাটাই স্বাভাবিক নয় কি বল?”

” হুম। তোমার রিয়াকশনও ভুল ছিলোনা। সত্যি আমাদের বিয়েটা এমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে হয়েছিল। সবকিছুই কেমন যেন আরও এলোমেলো হয়ে গেল। যাইহোক আজ তোমার ভাইয়ার রিসেপশনের সাথে তোমার বিদায় অনুষ্ঠানও হবে। এরপর আমরা সবকিছু নতুন করে শুরু করব। ঠিক আছে?”

আমার বিদায় অনুষ্ঠান হবে শুনে আমি ভ্রুকুটি করে তাকালাম। তখনই দরজায় করাঘাত হতে আমরা দুজনেই চমকে উঠলাম। দ্রুত বেগে কামরান থেকে আমি সরে এসে উঠে বসলাম। উচ্চ স্বরে শুধালাম,

” কে? দাঁড়াও আসছি।”

তিয়ানার গলা শোনা গেলো, ” ভাবি আমি। পার্লার থেকে আপুরা এসেছে। তোমাদের সাজাবে।”

আমাকেও সাজানো হবে শুনে আমি অবাক হয়ে কামরানের দিকে তাকালাম। ও হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। আবারও গলা উচিয়ে বললাম, ” আসরের নামাজ আদায় করে আসছি।”

এবার তামান্নার গলা,” আপু তাড়াতাড়ি এসো কিন্তু। ”

” ঠিক আছে। ”

বলেই আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। আজান না দিলেও ওয়াক্ত প্রায় হয়ে এসেছে। চুলগুলো হাত খোঁপা করছি তখন কামরান হঠাৎ বলে উঠলো,

” আজ দেখি আমার বউ রোমান্সের জন্য একদম রেডি হয়ে একেবারে দরজা বন্ধ করে এসেছে। ”

আমি অপ্রতিভ হলাম। লজ্জার কারণে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম, ” তোমারনা সত্যি মাথাটা গেছে। মুখে যা আসছে বলে যাচ্ছ। কোথাই বলবো না আর তোমার সাথে যাও।”

কথাটা বলেই আমি ওয়াশরুমের দিকে অগ্রসর হলাম। পিছন থেকে কামরান হাসতে হাসতে বললো, ” তোমার মুখে তুমি শুনতে দারুণ মিষ্টি লাগছে জানো।”

আমি আর কিছু বললাম না। পিছনেও ফিরে তাকালাম না। সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

————–*
আমাকে এবং ভাবিকে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে বাসায় লোক আনা হয়েছে। কামরান নাকি আমার শরীরের কথা চিন্তা করে ওদের বাসায় আসতে বলেছে। সাজগোজ শেষে যখন কাপড় বদলাতে গেলাম আমি তো অবাক বউয়ের শাড়ি গহনা দেখে। সবকিছুই এনেছে ওরা। বিশেষ করে শাড়িটা দেখে তো অবাক আমি। বসুন্ধরা সিটিতে যখন গিয়েছিলাম ঈদের শপিং এর জন্য তখন বড় একটা শাড়ির দোকানে নিয়ে গিয়েছিল সবার জন্য শাড়ি কিনতে। আদি মোহিনী মোহন কাঞ্জিলাল নামের ইন্ডিয়ান ব্র্যান্ডের সেই শো-রুমে বেশ কিছু শাড়ি দেখছিলাম তখন তিয়ানা বিয়ের কিছু বেনারসি দেখিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল দেখতো এগুলো কেমন লাগছে।আমিও এমনিই কথার ছলে কোনটা ভালো লাগছে বলেছিলাম। এখন দেখছি সেগুলোই কিনে নিয়ে এসেছে। ওরা যে ভিতরে ভিতরে এসব করছে আমি টেরই পাইনি সত্যি বিরাট সারপ্রাইজ দিয়েছে ওরা সবাই মিলে আমাকে। তবে গহনা গুলো আমাকে নিয়ে গিয়ে বানাতে দেয়া হয়েছিল। বিয়ের সময় ওদের বংশের অনেক পুরোনো ডিজাইনের গহনা দিয়েছিল। খুবই সুন্দর। কিন্তু সেগুলো বেশ ভারি চোকার নয়তো গলার হার। আমি যেহেতু হিজাব পরি তাই সেই হারগুলো হিজাবের আড়ালে ঢাকা পরে যায়। তাই লং শীতাহার বানানো হয়েছে।

আমি বললাম,” তোমাদের এসব প্ল্যান কবে থেকে চলছিল বলোতো। আমি কিছুই টের পেলাম না। ”

তিয়ানা বললো, ” কেন ঈদের পর রিসেপশন হওয়ার কথা তো ছিলই তুমি জানতে না ভাবি? ”

” হুম তা জানতাম কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম না ঠিক কবে হবে? কিন্তু এখানে যে আমাদের বাসায় অনুষ্ঠান করবে আমার বাড়ির কেউ বলেনি আমাকে। ”

” আঙ্কেলরা যখন আমাদের ওখানে গিয়েছিলেন তখনই সবকিছু ফাইনাল হয়। যদিও আগে থেকেই কথা হচ্ছিল তোমার ভাইয়ার বিয়ের সময় তোমার বিদায় অনুষ্ঠানও করা হবে। কারন এখানে তোমাদের দিক থেকে সেই সময় কিছু করা হয়নি। তাড়াহুড়ো করে ঢাকায় কোনরকম অনুষ্ঠান করেছিলেন তো তাই। আমার ভাইয়া তোমাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে কিছু বলতে মানা করেছিল তাই তোমাকে কেউ কিছু জানায়নি।”

আমি আর কি বলবো ভেবে পাচ্ছি না। এতো এতো সারপ্রাইজ পেয়ে আমি হতবাক, বাক শক্তিহীন হয়ে গেছি। শাড়িটি হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখছি। সোনালী জমিনে বেশ চওড়া মেরুন রঙের পাড়। সম্পূর্ণ শাড়িতে কলকা ডিজাইন করা জরি ও মেরুন সুতো দিয়ে। পাড়েও সোনালী জরির ভারি পেটানো কাজ। বাক্সের ভিতরে শাড়ির কাপড়ের ব্লাউজ এবং ম্যাচিং পেটিকোট দেখে অবাক হয়ে হাতে নিয়ে দেখলাম। তিয়ানার কাজ। কত কিছু করেছে মেয়েটা। কোন ত্রুটির গুনজায়িশ রাখেনি। একদম পারফেক্ট সবকিছু।

রেডি হয়ে সবাই একে একে কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে গেলাম। সেখানে স্টেজে আমাদের দুই জোড়া বরের কণের জন্য ডাবল বসার জায়গা করা হয়েছে। কামরান পাশে বসার একটু পরেই আমার দিকে ঝুকে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

” আজ আমাদের এক রুমে থাকতে দিবে তো?”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকালাম। তা দেখে ও আবারও বললো, ” না মানে তোমাকে আজ এমন বঁধু বেশে দেখে আমার পাগল পাগল দশা। এখন যদি তোমাকে শুধু সামনে এনে লোভ দেখিয়ে তারপর আবার চোখের আড়ালে সরিয়ে রাখে এটাতো অবিচার তাই না। আমার মতো বেচারার উপর এমন জুলুম করাটাতো অন্যায় তাইনা? ”

কামরানের অসহায় মুখ করে বলার ধরন দেখে আমি হাসি আটকাতে পারলাম না। ফিক করে হেসে দিলাম। আমিও একটু ঝুঁকে নীচু গলায় বললাম,

” বেশ করবে তাহলে। এতোদিন আমিতো তোমার হাতের নাগালেই ছিলাম। তখন তুমি তো সাধু সেজে বসে ছিলে। এখন এতো অধৈর্য্য হচ্ছ কেন? ”

” সেতো তোমাকে সময় দিয়েছিলাম বলে। এখন তো বলবেই যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। ” মুখ গোমরা করে বললো কামরান।

” কে চেয়েছিল সময়? হু? আমি চেয়েছিললাম? নিজেই একটু বেশি বুঝলে যা হয় আরকি।” বলেই আবারও ঠোঁট টিপে হেসে উঠলাম।

এবার কামরান কটমট করে তাকিয়ে বললো, ” আচ্ছা? তাই না? দাঁড়াও তোমাকে শুধু একবার একা পেয়ে নেই তারপর দেখো অহেতুক সময় নষ্ট করেছি যখন সব সুদে আসলে আদায় করে নিব। মাইন্ড ইট।”

আমি কেবল জবাবে মুচকি হাসলাম। ও আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনই ভাইয়া বেশ চড়া গলায় বলে উঠলো,

” এই তোদের এই গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর পিরিতের আলাপ বেডরুমের জন্য তুলে রাখ। এখানে চারপাশে এতো মানুষ। একটু সেদিকেও নজর দে। ”

কামরান বললো, ” কোন বেডরুমের জন্য তুলে রাখবো? এখানে হীবার নাকি ঢাকায় আমাদের বাসার বেডরুম। মানে এখানে তো দলের মধ্যে ঘুমাতে হচ্ছে তাই আরকি।”

ভাইয়া এমন ভাবে কামরানের দিকে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে কোন সপ্তম আশ্চর্য কিছু দেখছে। পাশ থেকে ভাবি খিলখিল করে হেসে ফেললো। আমি হাসবো নাকি কাঁদবো বুঝতে পারছি না। এই লোক এমন পাগলামি করতে পারে আমি কল্পনাও ভাবিনি। লজ্জায় মাথা নিচু করে হাসি আড়াল করার চেষ্টা করছি। তখনি ফটোগ্রাফার পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতেই যেন এসে হাজির হলো,

” আপনারা সবাই সামনে তাকান দেখি। ”

চোখ তুলে দেখি লোকটা ক্যামেরা হাতে আমাদের উদ্দেশ্যেই বলছে। আমাদের এবং ভাইয়াদের বিভিন্ন ভাবে জুটি বেধে কিছু ছবি তুললো লোকটা। হঠাৎ কামরান উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার কাছে গিয়ে কথা বলতে শুরু করল। কি কথা বলছে ওরা? কিছু শুনতেও পাচ্ছি না। চারিদিকে এত মানুষের কথার গুনগুন শব্দ। একটু পরেই ফটোগ্রাফার তার ক্যামেরাটা কামরানের হাতে তুলে দিলো। কামরানের কান্ড দেখে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানেও সে ছবি তুলবে নাকি? একেই বলে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধানই ভাঙ্গে!

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে