#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখাঃ মুনিরা সুলতানা।
পর্বঃ ৯।
—————-*
ঝটপট রান্নাঘরের কাজ শেষ করে আমি গোসল সেরে নিলাম। ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি সময় যদিও ঢাকার বাইরে ঠান্ডা পুরোপুরি যায়না কিন্তু ঢাকায় মোটামুটি গরম পরে যায়। এতক্ষণ আগুনের কাছে থেকে আমি রীতিমতো ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছিলাম। গা কেমন চিটচিট করছিল। এখন ঠান্ডা পানির ছোঁয়ায় নিজেকে সতেজ লাগছে। একটা লাল সোনালীর মিশেলে তসর শাড়ি পরলাম। যোহরের নামাজ আদায় করে নিলাম। কামরানের আসার সময় হয়ে এসেছে। ভেজা চুল গুলো দ্রুত হাতে আচরিয়ে নিয়ে চোখে কাজল পরলাম। কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ পরলাম। বাইরে যাওয়ার সময় টিপ পরিনা কখনও। তবে স্বামীর সামনে এটুকু সাজাই যায়। নিজেকে আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মনে মনে লজ্জা লাগছে এখন। বিয়ের সময় ছাড়া এই বাড়িতে আসার পরে আর কখনোই শাড়ি পরা হয়নি। আমার দাদি পইপই করে বলে দিয়েছেন যত বেশি সম্ভব স্বামীর সামনে শাড়ি পড়তে। কারন শাড়িতে নারীকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়। আমার মনে হয় শাড়িতে মেয়েদের ভিষণ ভাবে আবেদনময়ী লাগে। এই জন্য পর্দানশিন মেয়েদের জন্য শাড়ি পরাটা বেশ অস্বস্তিকর ব্যাপার। আমি নিজেও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনা। কিন্তু স্বামীর সামনে পরাই যায়। সেখানে তো পর্দার কোন ব্যাপার নেই। আর মেয়েদের সাজসজ্জা, সৌন্দর্য সবইতো স্বামীর জন্যই। তাই লজ্জা পেলে চলবে না। লজ্জাকে জয় করতে হবে। আয়নায় দিকে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে এক পলক তাকিয়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে এালম। আসমা মোটামুটি খাবার সাজিয়ে ফেলেছে । কেবল গরম গরম বিরিয়ানি বাড়তে হবে। কামরান এলে সেটা করা হবে। তখনই কলিং বেল বাজতেই আসমা গিয়ে দড়জাটা খুলে দিল। আমি রান্নাঘরে একটা ডিসে বিরিয়ানি বাড়ছি। আসমাকে বলতে শুনলাম,
” ভাইজান জলদি খাইতে আহেন। নইলে খাবার ঠান্ডা হইয়া যাইবগা। ”
কামরান বললো, ” আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
আমি টেবিলে সব খাবার ঠিকঠাক সাজিয়ে প্লেট জায়গা মত রাখছিলাম তখনই কামরান এসে চেয়ার টেনে বসল।
” কই জলদি দাও। আমার আর তর সইছে না। কাচ্চির ঘ্রাণে পেটের ভিতর ইদুর বিড়াল হুটোপুটি জুড়ে দিয়েছে। ”
ওর কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম। প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বললাম, ” ইদুরের সাথে বিড়ালও আছে? ”
কামরানও হেসে উঠলো। আমি প্লেটটা ওর সামনে রেখে বেগুন ভাজা ও সালাদ তুলে দিলাম। ডিমের কোর্মা, চিংড়ির বোওল ওর সামনে এগিয়ে দিলাম। ও খাওয়া শুরু না করে বললো,
” তুমি খাবেনা? ”
আমি একটা প্লেট নিয়ে পোলাও নিতে নিতে জবাব দিলাম, “হ্যা নিচ্ছি তো আপনি শুরু করেন। ”
খেতে খেতে কামরান বললো, ” আজ তো ছুটির দিন। ফ্রী আছি যখন চল কোথাও থেকে ঘুরে আসি। ”
আমি মুখ তুলে চাইলাম, ” কোথায়? ”
” তুমিই বল। কোথায় যেতে চাও? ”
আমি চিন্তিত স্বরে বললাম, ” আমি কি করে বলব? আমি ঢাকা শহরের কিছুই চিনিনা। কালেভদ্রে দু-তিনবার মামার বাসায় এসেছিলাম। তখন টুকটাক আশেপাশে নিয়ে গিয়েছিল। বলতে পারেন এই শহর আমার কাছে একেবারেই অচেনা। যেখানে নিয়ে যাবেন চলবে। ”
” ডোন্ট ওরি, এখন তোমার এটাই স্থায়ী নিবাস। সময়ের সাথে সাথে সব কিছু এক সময় চেনা হয়ে যাবে। তাহলে এই অল্প সময়ে কোথায় যাওয়া যায়…” একটু ভেবে আবার বললো সে, ” শপিংয়ে যাবা? ”
আমি মুখের খাবার চিবিয়ে গিলে নিয়ে বললাম, ” উঁহু না। আর কদিন বাদেই তো রোজা শুরু হবে। তখন তো ঈদের কেনাকাটা হবেই। এখন কিছু দরকার নাই। ”
কামরান আরেকটু ভাত নিতে নিতে বললো, ” তাও ঠিক। রোজার মধ্যে কোথাও বেড়াতে যাওয়াও যাবেনা। সো আজ তাহলে বেরিয়েই আসা যাক। তুমি খেয়ে উঠেই জলদি রেডি হয়ে নাও। ঠিক আছে? ”
” কোথায় যাব আমরা? ”
কামরান চিবোতে চিবোতে চাপা হেসে বললো, ” চলইনা, আগে বের তো হই। যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকেই নাহয় যাওয়া যাক। কেন তোমার আপত্তি আছে? ”
আমি লাজুক হেঁসে নত মাতা দুপাশে নাড়লাম কেবল। কামরানও প্রফুল্লচিত্তে বললো, ” তাহলে ঝটপট যাওয়ার জন্য রেডি হও।” বলেই সে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। কিছু সময় নিরবে খেয়ে গেলো। তারপর মুখ তুলে বললো,
” তোমার রান্নার হাত তো বেশ ভালো। নতুন রাধুনীদের হাতে পোলাও বিরিয়ানি রান্নাটা সাধারনত খুব কমই সুবিধাজনক হয়। সেখানে তোমার হাতের বিরিয়ানিটার স্বাদ পাকা রাঁধুনির মতোই লাগছে।”
” তাই? আপনাকে কে বললো আমি নতুন রাধুনী?”
” নতুন নও? মেয়েরা সাধারণত বিয়ের পরেই রাধুনী হয় তাই না? তোমারও কেবলই বিয়ে হলো। সেই হিসেবেই বললাম। দেখইনা আমাদের তিয়ানা রান্নার ধারে কাছেও যায়না। তাসমিয়াও বিয়ের পরেই রান্না শিখেছে। ”
” ও আচ্ছা। বুঝলাম। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো। সেই স্কুলে থাকতেই রান্নার প্রতি ঝোঁক থাকায় রান্নায় হাতে খড়ি হয়। এরপর থেকে রেগুলার না করলেও শখের বশে মাঝেমধ্যে নানারকম আইটেম করতাম। এভাবেই মোটামুটি সবকিছুই রান্না করতে শিখেছি। সত্যি বলতে আমি রান্না করতে ভালোবাসি।”
” বাহ্। বেশ ভালো। তাহলে প্রায়ই তোমার হাতের চমৎকার রান্না খাওয়ার সুযোগ মিলবে। আমি আবার খেতে ভালোবাসি। ” বলেই কামরান হেসে উঠলো। আমিও ওর কথা শুনে হেসে ফেললাম।
খাওয়া সেরে আসমাকে টেবিল পরিস্কার করে ধোয়ামোছার ফাঁকে ওর খাবার কন্টেইনারে তুলে দিলাম। আসমা রান্না করে কখনো এখানে বসে খায়না। নিচের তলায় সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে ওর স্বামি অর্থাৎ দারোয়ান সহ থাকে। ওদের একটা ছেলেও আছে। স্কুলে পড়ে। খাবার নিয়ে গিয়ে পরিবারের সাথে মিলে একসাথে খায়।
আমরা তিনটার পরপরই বেরিয়ে গেলাম। যদিও শাড়ি পরে বাইরে যাওয়ার অভ্যেস নেই। একটু অস্বস্তি লাগলেও শাড়িটা আর বদলাইনি। নতুন পাটভাঙা শাড়ি আজই প্রথম পরেছি। শাড়িটা শুধু ভালো করে পিন দিয়ে আটকিয়ে নিলাম। ওপরে একটা সেমি লং সোনালী সিল্কের কাফতান ধরনের শ্রাগ পরেছি। আর শাড়ির আচল মাথায় জড়িয়ে হিজাবের মত করে পরেছি।
গাড়িতে কামরানের পাশে প্যাসেন্জার সিটে বসেছি। ও নিজেই ড্রাইভ করছে। এই গাড়িতেই বিয়ের দিনে প্রথম উঠেছিলাম। তবে আজকের মত সামনে নয়। পিছনে বসেছিলাম। এই প্রথম ওর সাথে কোথাও বেরিয়েছি। কেমন অন্যরকম ভালো লাগা অনুভুতি আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তিনমাস আগের সেই সময় গুলো মনের মধ্যে যে তিক্ততা ভরে দিয়েছিল সেটা ধীরে ধীরে কখন যেন অজান্তেই ছুমন্তর হয়ে গেছে টেরই পাইনি। যদিও কিছু প্রশ্নের কারনে কিছুটা অস্বস্তি, বিচলিতা মনটাকে অস্থির করে রেখেছে। তবুও এবার ফিরে আসার পর থেকে ধীরে ধীরে সব কিছুই কেন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। যদি স্বপ্ন হয় তাহলে এমন মধুর স্বপ্ন কখনোই যেন না ভাঙে।
” এই হীবা কি ভাবছ এত? ”
আমি চমকে উঠে পাশ ফিরে তাকালাম। কামরান ড্রাইভ করার ফাঁকে আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমি বিব্রতভঙ্গীতে হাসলাম। এতক্ষণ ভাবনার ঘোরে এমন বুদ হয়ে ছিলাম যে কোথায় আছি কার সাথে আছি বেমালুম ভুলে গেছিলাম। ছিঃ কি লজ্জা! ও আমার জবাবের অপেক্ষায় আছে দেখে বললাম,
” নাহ, কিছুুনা। এমনি দেখছিলাম। মা- মানে ঢাকা শহর দেখছিলাম আরকি। ”
কামরানের ঠোঁট জোড়া হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো। সে বললো, ” এটাই এখন তোমারও শহর। এই পথঘাটেই ডেইলি চলাচল করতে হবে। দেখবে একসময় সবকিছু কেমন আপন হয়ে গেছে। ”
” হুম তা ঠিক। কিন্তু ভিষন জ্যাম রাস্তায়। তাওতো আজ কম মনে হচ্ছে। সেদিন আসার সময় তো জ্যামে বসে থাকতে থাকতে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছিলাম। ”
কামরান একপলক আমার দিকে তাকিয়ে দেখে আবার সামনে তাকিয়ে বললো, ” আজকের ছুটির দিন তো এই সময় একটু জ্যাম কম হয়। কিন্তু ফেরার পথে দেখবে কেমন অবস্থা হয়। আস্ত আস্তে এতেই একসময় অভ্যস্ত হয়ে যাবে।”
” হয়তো। ” আমি রাস্তায় দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই বললাম।
কিছ সময় গাড়িতে নিরবতা ছেয়ে রইল। একটু পরে আমি নিরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলাম,
” আমরা কোথায় যাচ্ছি বললেন না যে? ”
” গেলেই দেখতে পাবে। ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়। সো একটু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষায় থাকো। ”
আমি আর কিছু বললাম না। আবারও বাইরে চোখ রাখলাম। রাস্তা জুড়ে কত ধরনের কত রকম পেশার কত বিচিত্র মানুষের আনাগোনা আমি নিরবে অবলোকন করে চলেছি। গাড়ি যখন টিএসসি মোরে ঢুকল আমার চোখ দুটো বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। অসংখ্য নারী পুরুষ, শিশু, তরুণ তরুণীরা দল বেধে টিএসসির রাস্তা ধরে হেটে যাচ্ছে। তারা সবাই বাহারি পোশাকে সজ্জিত। মেয়েদের অনেকের মাথায় ফুলেব মুকুট। আমার এতক্ষণে মনে পরল এটা ফেব্রুয়ারী মাসের শেষের দিকে। বইমেলা চলছে। একজন একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে আমার বহুদিনের স্বপ্ন ছিল বইমেলায় আসার। আজ আমার সে স্বপ্ন পুরন হতে চলেছে। কামরানের দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকালাম। ও গাড়িটা অনেকটা দুরেই পার্ক করল। কেননা এখান থেকে গাড়ি যাওয়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তাই এটুকু রাস্তা হেটে যেতে হবে। গাড়ি যেখানে রাখা হয়েছে সেদিক থেকে রাস্তা পার হয়ে ঐপাশে যেতে হবে। আমার তো বুকের ভিতর রীতিমতো ধুকপুক করছে। এত ব্যাস্ত রাস্তা পার হওয়ার চিন্তায় আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। কামরান ঠিক সেই সময় যেন আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই আমার একটা হাত শক্ত করে আকড়ে ধরল। তারপর কি অবলীলায় সুন্দর ভাবে আমাকে নিয়ে রাস্তা পার করে নিয়ে এল। আমি যেন ঐ মুহূর্তে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে কামরানের দিকেই চেয়ে রইলাম। কখন রাস্তার এপাশ থেকে ঐপাশে পৌঁছে গেলাম টেরই পাইনি। কিছুদুর হেঁটে বইমেলা প্রাঙ্গনে এসে পরলাম। এখানে মেয়েরা ছেলেরা পৃথক ভাবে ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। এতক্ষণে খেয়াল হলো ও আমার হাতটা এখনও ধরে রেখেছে। এবার রাস্তা আলাদা হওয়ায় হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললো,
” তুমি মেয়েদের লাইন ধরে আস। ”
কথাটা বলেই ছেলেদের প্রবেশ পথের দিকে চলে গেল কামরান। আজ শুক্রবার বলে বেশ ভীড়। লাইন অনুসরণ করে অবশেষে ভিতরে প্রবেশ করলাম। কামরান আগেই গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কামরান চট করে সেই ফাঁকে নিজের সেলফোনে আমার ছবি তুলে নিল। আমি ব্যাপারটায় লজ্জায় পরলাম। এখনো ওর সাথে সংকোচ, জড়তা কাটিয়ে উঠে সহজ হতে পারিনি। তাই ওর স্বতঃস্ফূর্ত ভাব আমাকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। মনের লাজিনতা গোপন করে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কামরানের চোখে মুখে বেশ উচ্ছলিত ভাব ফুটে আছে। সত্যিই কি সে এতো…। যাইহোক দুজনে হাটতে হাটতে জনসমুদ্রের মাঝে ডুব দিলাম। বেশীর ভাগ স্টলে, প্যাভিলিয়নে পাঠকদের ভীড়ে ঢোকাই মুশকিল। তাও এখন যেটুকু ভীড় দেখা যাচ্ছে সন্ধ্যা হতে হতে নাকি এর কয়েক গুন ভীড় বেড়ে যাবে। তাই ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলাম। কোথাও সুযোগ মত এবং পছন্দ হলে টুকটাক বইও কিনে ফেলছি। এই একটা জায়গায় এসে দু-হাত ভরে খরচ করতে আমার একটুও চিন্তা করতে হয়না। ভালো মনে হলেই বইটি কিনে ফেলি। এটা আমার সেই স্কুল জীবন থেকেই অভ্যাস। আমার বাবার বাসায় বুকসেল্ফ ভর্তি যত বই আছে বেশির ভাগ আমার কেনা। কামরানও দেখলাম টুকটাক নিজের পছন্দ মত বই কিনছে। তবে সেগুলো কোন উপন্যাস নয়। ভিন্ন ধরনের বই। বোধহয় সে গল্প উপন্যাস পড়েনা। নাই বা পড়ল। বই পড়াটাই মুখ্য। হোক সেটা গল্প উপন্যাস কিংবা ভিন্নধারার বই। বই পড়লে জ্ঞানের পরিধি বাড়বে এটাই বড় কথা।
আমরা মাঝে আইসক্রিম কিনে নিয়ে এক জায়গায় বসলাম। চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। যেদিকে তাকাই কেবল নানাধরণের মানুষজনের ভীড়ে গিজগিজ করছে। যত বেলা যাচ্ছে মানুষের ঢলও বাড়ছে। হঠাৎ কামরান বললো,
” কেমন লাগছে বইমেলা? আগে কখনও এসেছিলে? ”
” নাহ। আসলে আমার ঢাকায় আসাই হয়েছে দুয়েকবার। তাই কোথাও তেমন ভাবে যাওয়া হয়নি। আর বইমেলার সময় কখনও আসিনি। কিন্তু আমার ভিষণ ইচ্ছে ছিল এখানে আাসার। আজ আপনার জন্য সম্ভব হল। সেই জন্য আপনাকে থ্যান্কিউ সো মাচ।”
” ওয়েলকাম। আচ্ছা। তাহলে আজকের অভিজ্ঞতা তোমার জন্য অনেকটা স্বরনীয় ঘটনা, তাইতো? ”
আমি অমায়িক হাসলাম, ” তা আর বলতে। ”
” এখন থেকে তাহলে আমরা প্রতি বছর বইমেলায় আসবো। ঠিক আছে? ”
আমি হাসি মুখে মাথা দুলিয়ে সায় জানালাম। কামরান যেভাবে আমরা বললো কেন যেন আমার মনে অদ্ভুত ভাবে আন্দোলিত হচ্ছে। আমি কি একটু বেশিই অভিভূত হচ্ছি ওর প্রতি? কিজানি? কিন্তু সবকিছু ভীষণ ভাবে ভালো লাগছে।
কয়েক প্রহর দুজনেই নিরবে আইসক্রিম খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। সেই ফাকে ফাঁকে চারপাশে নানান রকমের মানুষের উপর নজর বুলালাম। তারপর আমি বললাম,
” আপনি বেশ কিছু বই কিনেছেন দেখলাম। নিজের জন্যই নিশ্চয়ই? ”
কামরান এক মুহূর্ত ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে রইল। তারপর বললো, ” হ্যা নিজের জন্যই। কেন?”
” না মানে এমনি। আপনি উপন্যাস গল্প পরেননা? সব ভিন্ন ধরনের বই কিনেছেন দেখলাম। ”
” ভালো লাগার মতো বই পেলে সবই পড়ি। তবে নোভেলের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ইংলিশ নোভেল পড়া হয় বেশি। বাংলা উপন্যাস বলতে আগের নামকরা কিংবদন্তি রাইটারদের লেখা প্রচুর বই পড়েছি সেই স্টুডেন্ট লাইফে। এখনকার রাইটারদের বই সেভাবে পড়া হয়নি। ”
” তাহলে অনুবাদ বই দেখলাম তো কিছু স্টলে। নিতে পারতেন। ”
” নাহ। অনুবাদ পড়ে মজা পাইনা। আসল স্বাদ পেতে হলে অরিজিনাল ভাষায় লেখা বই পড়ার মজাই আলাদা। এনিওয়ে তুমিও তো অনেক বই কিনলে। বই পড় তাহলে। বেশ ভালো অভ্যাস। ”
আমি সম্মতি সূচক হাসলাম। বললাম, ” আসলেই তাই। আমাদের দেশের অনুবাদ বইগুলোর ভাষা মানসম্মত হয়না। পড়ে খুবই বিরক্ত লাগে। তাই আমিও অরিজিনাল বইগুলোই পড়ার চেষ্টা করি।”
” গ্রেট! আমাদের বাসায় স্টাডি রুমে বিভিন্ন দেশের নামকরা রাইটারদের প্রচুর বই আছে। অবসর টাইমে তোমার বই পড়ে ভালো সময় কাটবে। ”
আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম, ” সত্যি! আসলে এখনও ঐ রুমে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। বই পেলে আমার আর কিছুই লাগেনা। দিন দুনিয়া ভুলে আমি বইয়ের ভিতরে ঢুকে পরি।”
কামরান হেসে বললো, ” ভালো অভ্যাস। যারা বইয়ের মাঝে ডুবে দিন দুনিয়া ভুলে যেতে পারে তারাই প্রকৃত ভাবে সুখে থাকতে পারে। ”
আইসক্রিম খাওয়া শেষ হয়েছে অনেক্ক্ষণ। এবার উঠে পড়লাম দুজনে। এবার লেকের পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলাম। লেকের চারিদিকে সারি সারি বেন্চি আছে। কিন্তু সেসব বসার জায়গায় তিল ধরনের জায়গা নেই। তাই ভীড় ঠেলে এগোতে লাগলাম। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। প্রকৃতির নিজস্ব হলদে কমলা রঙের সান্ধ্য বাতির মতো ম্লান আলো ছড়িয়ে আছে চারপাশে। মানুষের ঢলের জন্য এখন আর কোন স্টলে ঢোকার উপায় নেই। কামরান আঙুলের ভাজে আঙুল গলিয়ে শক্ত করে আমার হাতটা ধরে রেখেছে। ভীড়ের স্রোতে যদি আলাদা হয়ে যাই। কিছুক্ষণ এভাবেই ঘুরে ফিরে দেখলাম। কোন কোন স্টল আবার খালি দেখা যায়। সেখানে ঢু মেরে এলাম। শুক্রবার বলে অনেক লেখক এসেছেন আজ। উনাদের ঘিরে আছে বিশাল জনসমুদ্র। দুর থেকে কেবল দেখে গেলাম। শেষে আস্তে ধীরে ভীড় ঠেলে আমরা বাইরের বেরোনোর জন্য হাঁটতে লাগলাম।
চলবে ইনশাআল্লাহ।