তোমায় ছেড়ে যাবো কোথায় পর্ব-০৮

0
1021

#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখাঃ মুনিরা সুলতানা।
পর্বঃ ৮ ।

————–*
কামরানের কথা শুনে আমি বোধহয় বোকার মতো বড়সড় চোখে কামরানের দিকে তাকিয়ে আছি। ও প্রথমে ভ্রুকুটি করে পরে ভ্রু যুগল নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

” কি হল? ওভাবে তাকিয়ে আছ কেন? আমি কি অদ্ভুত কিছু বলেছি? ”

আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ” না তা নয়। মানে আপনি এখন এই এতো রাতে আমার সাথে গল্প করবেন? ”

” হুম। কেন আমার সাথে গল্প করতে তোমার কোন আপত্তি আছে? ”

আমি প্রায় ঝট করে জবাব দিলাম, ” না না। কি বলছেন, আপত্তি কেন থাকবে? আমিতো আরও ভাবছিলাম কাল আপনার অফিস যেতে হবে তাই নিশ্চয়ই ঘুমানো দরকার।”

” একচুয়েলি আমি শুক্রবার কাজ করিনা। সপ্তাহের এই একটা দিন আমি সম্পূর্ণ রিল্যাক্স করি। এটা আমার আম্মার দেয়া সেই স্টুডেন্ট লাইফের নিয়ম। যেটা আমি এখনো মেনে চলি। এটা সত্যি খুবই কার্যকর। কর্মব্যস্ত এই জীবনে এই একদিনের বিশ্রাম আমাদের শরীরকে একদম চাঙ্গা করে দেয়। পরেরদিন একেবারে নতুন উদ্যোমে কাজে মনোযোগ দেওয়া সহজ হয়।”

কামরানের কথা শুনে আমি বেশ লজ্জায় পরে গেলাম। কোন দুনিয়ায় বাস করছি কে জানে। কাল যে শুক্রবার ছুটির দিন সেটাই ভুলে বসে আছি। তবুও স্বাভাবিক গলায়
আমি বললাম,

” সত্যি! কাল শুক্রবার আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। আমার আব্বাও একই কথা বলতেন। আমাদেরও সমসময় শুক্রবারে ছুটি দিতেন। সেদিন একদম মনমতো সময় কাটানোর সুযোগ দিতেন। সত্যিই এটা খুবই আনন্দদায়ক ছিল। ”

কামরান এতক্ষণ চিত হয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে ছিল। এখন আমার দিকে ফিরে কাত হয়ে শুলো। আমি কাত হয়েই শুয়েছিলাম। ওভাবে চিত হয়ে শুয়ে থাকতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। খাটটা অনেকটাই বড়। আমাদের মাঝখানে প্রায় একহাতের মত দুরত্ব। আমাদের মাঝের এই দুরত্ব কবে ঘুচবে? কবে ওর বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারব? হঠাৎ হঠাৎ কেমন হ্যাংলা নির্লজ্জের মতো ভেবে বসি। আমি গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কামরান হঠাৎ শুধালো,

” তারপর? ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি? ”

” মানে? কিসের পরিকল্পনা? ” আমি প্রায় চমকে উঠে শুধালাম।

” এইযে এক্সাম দিলে। এরপরে কি করবা? ওহ্যা তুমি কোন সাবজেক্টে পড় বলোতো? ”

আমি চোখ দুটো পিটপিট করলাম। হাসবো না কাঁদব বুঝতে পারছিনা। আমার বর এখনো জানেনা আমি কিসে পড়ি। কি অদ্ভুত! তাইনা? আমি জবাব দিলাম,

” আমি আর্কিটেকচার পড়ছি। ফাইনাল এক্সাম দিয়ে এলাম। এইতো। ”

” রিয়েলি! আই ক্যান্ট বিলিভ দিস! ” বিস্মিত কন্ঠে বললো সে।

আমি বললাম, ” কেন? আমি আর্কিটেক্টএ পড়তে পারিনা? ”

” আমি সেটা বলিনি। তুমিতো জানো আমাদের ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের বিজনেস। বেশির ভাগ সময় এপার্টমেন্ট যারা কেনে তারা কমপ্লিট কাজ করিয়ে নিতে চায়। এইজন্য বাইরে থেকে লোক এনে কাজ করতে হয়। এখন তুমি যদি সেই দিকটা সামলাতে পার তাহলে বাইরের লোক আনতে হবেনা। বুঝতে পারছ? ”

সত্যিই আপাদমস্তক একজন বিজনেস ম্যান। লাভ ক্ষতির হিসেবে ষোলআনা জ্ঞান আছে। অবশ্য থাকারই কথা। আমি কেবল হলকা হাসলাম। একটুক্ষণ পরেই আবারো বললো,

” এই পর্যন্তই পড়াশোনায় ইতি নাকি বুয়েটে পড়তে চাও?”

” আমি আসলে এখনও এই ব্যাপারে ভেবে দেখিনি। তবে সুযোগ পেলে না পড়ার কোন কারন নেই। ”

” তাহলে রেজাল্ট হলেই বুয়েটে ভর্তি হয়ে যাবে। সেই সাথে চাইলে আমাদের সাথে কাজও শুরু করতে পার। ”

” ঠিক আছে। ”

এরপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ। কামরান আমার দিকেই চেয়ে আছে। আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। আমি তাই সেদিকে তাকিয়ে থাকতে না পেরে আমার চোখ দুটো চঞ্চল ভাবে এদিক সেদিক ঘুরছে। বিশ্ব চরাচরে সকলেই মধুর ঘুমে ঢলে পরেছে বহু আগেই। রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে কেবল একঘেয়ে সুরে ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দে ছন্দপতন ঘটছে। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রেডিয়ামের আলোয় জ্বলজ্বল করতে থাকা চলন্ত কাটাগুলোকে সারে বারোটার ঘরে দেখতে পেলাম। নাহ ঘুমানো দরকার। ভোর বেলায় আবার নামাজ পরতে উঠতে হবে। সকালেই শাশুড়ী মায়েরাও রওনা দিবেন। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে কামরান বলে উঠলো,

” আচ্ছা এইযে হঠাৎ করে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল এই ব্যাপারে তোমার রিয়াকশন কেমন ছিল? মানে হঠাৎ করে তোমার কোন অসুবিধা হয়নি মানিয়ে নিতে? কোন মানসিক প্রস্তুতি ছাড়া এভাবে ব্যাপারটাকে তুমি কিভাবে নিয়েছিলে? ”

হঠাৎ কামরানের এমন প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেলাম। গত তিন মাস যাবৎ নিজের মনের সাথে এই বিয়েটা নিয়েই তো যুদ্ধ করে যাচ্ছি। কিন্তু সেটা ওকে কিভাবে বলবো। বললাম,

” সব মানুষের যেমন রিয়্যাক্ট করার কথা আমারও একই অবস্থা হয়েছিল। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন বলেনতো? আপনি কি এভাবে বিয়ে হওয়া নিয়ে খুব চিন্তিত মানে মেনে নিতে প্রব..”

আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই মাঝপথে থামিয়ে কামরান বলে উঠলো, ” আরে না না, তুমি একটু বেশি ভাবতে শুরু করেছো। এমন কিছু না। আমি আসলে তোমার কথা জানতে চাচ্ছিলাম। কারণ আমি তো সুযোগ পেয়েছিলাম এই নিয়ে ভাববার। আমার দাদা অসুস্থ হওয়ার আগে থেকেই বেশ কয়েকদিন ধরেই বিয়ের কথা বলছিলেন। বুজুর্গ মানুষ হয়তো সময় যে হয়েছে যাওয়ার সেটা বোধহয় উনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই নিজের দেয়া কথা রাখতে চেয়েছিলেন যাওয়ার আগে। আমার কাছে দাদার চাওয়াটাই সবচেয়ে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। আমি ভেবেচিন্তে ডিসিশন নিয়েছিলাম কিন্তু তোমাদের যখন জানানো হয় একদম লাস্ট মোমেন্টে। আমি শিওর তুমি একদমই সময় পাওনি ভেবে চিন্তে নিজের মতামত জানানোর। বোধহয় হঠাৎই ডিসিশন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তোমার উপর। তাই জানতে চাইছিলাম। আমি চিন্তায় ছিলাম এটা নিয়ে।”

কামরানকে এভাবে ভাবতে দেখে আমার বেশ ভালো লাগলো। ও যে অপর পক্ষের মানুষটার মন নিয়েও ভাবনা চিন্তা করতে পারে সেটা আমাকে আস্বস্ত করল। আমি কি ভাবছি কি চাইছি, আমার ভালোলাগা মন্দ লাগা এই ব্যাপারগুলো স্বামী হিসাবে সে বিচার বিবেচনা করে আমাকে বোঝার চেষ্টা করবে এমন স্বামী পাওয়ার স্বপ্নই তো দেখছি। মানুষ হিসেবে কামরান অবিবেচক নয় বরং অনেক বেশিই বিবেচক ভাবতেই আমার কিযে ভালো লাগছে বলার নয় তা। কামরান আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বললাম,

” এটা সত্যি হঠাৎ জীবনের এত বড় একটা ঘটনা একদম বিনা নোটিশে সামনে চলে এলো যখন, তখন মনের ভিতর কিছুটা নাড়া দিয়ে গিয়েছিল বটেই। কিন্তু আমি আল্লাহর যেকোনো সিদ্ধান্তকে মন থেকে মেনে নিতে জানি। যতই সাময়িকভাবে মনটা হতবিহ্বল হয়ে উঠুক না কেন আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ তায়ালা যখন ঐ মুহুর্তেই আমার জন্য বিয়ের সময় নির্ধারিত করেছেন তখন সেটাই আমার জন্য মঙ্গলজনক বলেই করেছেন। সত্যি বলতে প্রথমে আমি মানতে পারছিলাম না এভাবে হঠাৎ বিয়ের কথা শুনে। তারপর দাদি ও আম্মার বোঝানোর পরে নিজেও শান্ত মনে ভেবে দেখলাম। তখন আমার জন্য সবকিছু সহজ এবং গ্রহনযোগ্য হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া মেনে নেয়া এবং মানিয়ে নেয়া ছাড়া আর কোন অপশনও তো নেই। তাইনা?”

কামরান আমার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে। কিছু সময় নিশ্চুপ রইল। আমি অস্বস্তি ভরা নজর কামরার চারিদিকে বুলাতে ব্যাস্ত। ডিমলাইটের আবছা আলোয় কামরার ভিতরে কেমন যেন একটা স্বপ্নজাল ছড়িয়ে দিয়েছে। কেমন আবেশে মাখানো পরিবেশ। নিরবতা ভেঙে কামরান অবশেষে বলে উঠলো,

” তোমার ভাবনা চিন্তাগুলো বেশ ম্যাচিউরড্। তোমার কথাগুলো অনুযায়ী তুমি যেকোন পরিস্থিতিতে সহজে মানিয়ে নিতে পারবে বলেই আমার বিশ্বাস। আমার এতদিনের টেনশন এবার দুর হলো। ”

” আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটে সব কিছুতেই কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে, সেটা কখনও আনন্দজনক হতে পারে আবার দুঃখজনকও হতে পারে। আসলে সেগুলো আল্লাহর তরফ থেকে কখনও পুরস্কার স্বরুপ আসে তো আবার কখনো পরীক্ষা স্বরুপও আসতে পারে। তাই আমাদের সব পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে হয়। আসলে জীবনটাই তো অনিশ্চিত। তাইনা? তাই এসব গুরুগম্ভীর ব্যাপারস্যাপার নিয়ে এত ভাবাভাবির কিছু নেই। জীবনে প্রবলেম আসলে তা সইবার ক্ষমতাও আল্লাহ তায়ালা সমাধানের সাথেই ফ্রী দিয়ে দেন। বুঝলেন। এখন রাত অনেক হয়েছে। ঘুমিয়ে পরেন। সকালে আম্মারা রওনা দিবেন খেয়াল আছে?”

” হ্যা এইতো শুয়ে পরছি। তুমিও ঘুমাও। ” বলেই কামরান ঠিক হয়ে শুয়ে পরল।

আমার জানতে ইচ্ছে করছে কামরান মেনে নিতে পেরেছে কি আমাদের বিয়েটাকে। নাকি ওর মনে দ্বিধা আছে বলেই আমার মনোভাব বুঝতে চাইছে। কিন্তু কোন এক সংকোচে আমার প্রশ্নগুলোকে মনের মাঝেই চাপা রয়ে গেল। হয়তো সময় দরকার ওর। তাই ধৈর্য্য ধারণ করে সবকিছু সময়ের এবং আল্লাহ তায়ালার হাতে ছেড়ে দেওয়াই সমীচীন মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে।

————-*
সকালটা শুরু হলো প্রচন্ড দৌড় ঝাপ নিয়ে। সেই ভোর বেলায় উঠেই আসমাকে নিয়ে নাস্তা পানির আয়োজনে লেগে পরেছি। নাস্তা করেই উনারা রওনা দিবেন। এরমধ্যে ভোরবেলায় খাসির মাংস বের করে মেরিনেট করে রেখেছি। আজ প্রথম নিজের হাতে কামরানের জন্য কিছু রান্না করবো। তাই ভাবলাম আজ যেহেতু শুক্রবার ছুটির দিন। আমার মাকে দেখেছি শুক্রবার বাবা সহ আমরা সবাই বাসায় থাকতাম বলে একটা উৎসবের আমেজে সেইদিন টাকে আনন্দমুখর করে তোলার চেষ্টা করতেন। আম্মা মনে করতেন তাহলে ছুটি শেষে আবার যখন আমরা যার যার কাজে ফিরে যাব তখন যেন পূর্ণ উদ্যোমে আমাদের কাজে মনযোগ দিতে ভরপুর এনার্জি নিয়ে শরীর মন তৈরি থাকে। তাই আম্মা ছুটির দিনে সবসময় ভালো খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতেন। দিনটাকে বিভিন্ন ভাবে আনন্দে ভরিয়ে তুলতেন। শাশুড়ী মায়ের কাছে রাতেই পারমিশন নিয়ে রেখেছি আজ কামরানের পছন্দের কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করব। তাই এতো ভোরবেলায় মাংসটা মেরিনেট করে রেখেছি।

জার্নির সময় সকালে খাওয়ার রুচি থাকেনা৷ তবুও কোনরকমে হালকা কিছু মুখে দিয়ে শাশুড়ি মা আরমান ও তিয়ানা রওনা দিল। কামরান ওদেরকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে গেলো। সবাই চলে গেলে বাড়িটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। মনটা খারাপ লাগছে। কতটা সময় ড্রয়িং রুমের বেলকনিতে বসে থাকলাম চুপচাপ। পরে এসে নাস্তা করে নিলাম। এর মধ্যে আরেকজন বুয়া চলে এসেছে। ওর নাম রানি। আশপাশের কোথাও থাকে। ও ঘর পরিস্কার করার যাবতীয় কাজ করে। আর আসমা রান্না করে এবং রান্না ঘরের যাবতীয় কাজ যেমন কু*টনা বাছা, বাসন পেয়ালা মাজা এসব আরকি।
আমি চা বানিয়ে ওদের দুজনের চা দিয়ে নিজের চা হাতে নিয়ে আমাদের কামরায় এলাম। কামরা সংলগ্ন বেলকনিতে বসে ধীরে সুস্থে চা খাওয়া শেষে করলাম।

বিরিয়ানি চুলায় বসিয়ে দিয়েছি। সাথে ডিমের কোর্মা, নারকেল দিয়ে চিংড়ির মালাইকারী বেগুন ভজা সালাদ করছি। চিংড়ি হয়ে গেছে। ডিমের কোর্মা রান্না করছি। হঠাৎ মনে হলো আসমাকে জিজ্ঞেস করে দেখা যাক এই বাড়ির হাঁড়ির খবর কিছু জানে কিনা। কিন্তু কিভাবে জিজ্ঞেস করবো বুঝতে পারছি না। ইতস্তত করে অবশেষে কৌতুহলেরই জয় হলো। তাই ওকে শুধালাম,

” আচ্ছা আসমা পিউলি আপু এই বাড়িতে প্রায় ঘন ঘন আসে তাই না? ”

আসমা বলল,” হ্যাঁ ভাবিজান পারলে তো সারাদিন এখানেই পইড়া থাকে। আর ভাইজানের লগে চিপকাইয়া থাকে।”

যাক কাজে লেগেছে, ভালো মানুষকেই জিজ্ঞেস করেছি। আমি বললাম, ” কি বল তুমি? এভাবে বলে না। চিপকায় থাকে মানে কি?”

” সত্যই তো কইতাছি। একবার বিয়ের কথা উঠছিল দুইজনার। কিন্তু আগাইতে পারেনাই দাদাজানের কারনে। তবুও দেখেন ঐ আপা মনির লাজ শরমের বড়ই অভাব। নইলে রিজেক্ট হইবার পরও এমন ছ্যাচরামো কেউ করতে পারে কন ভাবীজান? ”

” কেন তোমাদের ভাইজানের সাথে তো বেশ ভালোই খাতির দেখলাম। না কেন করলো? ” আমি অবাক হওয়ার ভান করে জিজ্ঞেস করলাম।

আসমা বলল, ” আরে ভাইজান তো বোন মনে কইরা মেলামেশা করে। বিয়ের কথা ভাইজান মনে হয় জানেইনা।”

” তুমি কিভাবে বলতে পারো তোমার ভাইজান জানেনা?”

” ভাইজান তখন বিদেশে আছিল। আর ভাইজানের তো বিদেশে গার্লফ্রেন্ড আছিল। তাইলে কেন পিউলি আপারে বিয়ে করতে চাইবো কন? ”

নতুন তথ্য আবিষ্কার করে আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। তবুও সাবধানে জিজ্ঞেস করলাম, ” বিদেশে গার্লফ্রেন্ড ছিল? তুমি শিওর? তাহলে তাকে বিয়ে করলনা কেন?”

আসমা কেমন চমকে উঠলো। থতমত খেয়ে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিল। কথা এড়িয়ে যেতে চেয়ে বললো,

” আমি কিছু জানিনা। কি বলতে কি বলছি ভুইলা যান।”

বুঝলাম আসমা বেখেয়ালে বলে ফেলেছে কথাটা। কিন্তু আমাকে সম্পূর্ণ কথা জানতে হবে। নইলে এই নতুন তথ্যটা আমাকে পাগল করতে যথেষ্ট।

” দেখ আসমা সেটাতো অতীত তাইনা? নইলে আমাকে বিয়ে করতোনা নিশ্চয়ই? আমি শুধু জানতে চাইছি সেই মেয়েটাকে ছাড়লো কেন? ফ্যামিলি মানেনি তাই?”

আসমা ইতস্তত করে শেষে মুখ খুললো, ” ঐরকমই শুনছি। যখন দাদা আর খালুজান বিদেশি মেয়েটার কথা জানতে পারে তখনই তো খালুজানের হার্ট অ্যাটাক হইছিল। এরপর ভাইজানও খবর পাইয়া চইলা আইল। দাদাজান সাফ সাফ কইয়া দিল কোন বিদেশি মাইয়ারে এই বাড়ির বউ করতে পারবেনা। তখনই আমরা আপনার কথা জানবার পারছি। সেই ছোডকালেই দাদাজানে আপনাদের বিয়া ঠিক কইরা রাখছে। বাস আরকি। খালুজান চইলা গেল। ভাইজানেও আর বিদেশে ফিরা যায়নাই। ভাইজান আবার দাদাজানের জন্য জান দিবারও পারতো আর এইটা তো সামান্য একটা মাইয়ারে ছাড়তে হইছিল। ”

” ঐ মেয়েটার সাথে আর যোগাযোগও হয়নি? আচ্ছা একটা খ্রিস্টান মেয়েকে তোর ভাইজানের পছন্দ ছিল? অদ্ভুত! ”

” না মনে হয়। আর মাইয়াটা খ্রিস্টান আছিলো না। কি যেন কয় লেব..না কি.. ”

” লেবানিজ? ”

” হ হ ল্যাবানিজ আছিল। হ্যারা নাকি মুসলমান হয়? ”

আমি মাথা নেড়ে বললাম, ” হ্যা ওরা মুসলিম হয়। ”

আসমা সাবধানী গলায় বলল, ” পিউলি আপামনি থেইকা সাবধানে থাইকেন। উনি এক্কেবারে সুবিধার মাইয়া না। ”

আমি আনমনে বললাম, ” হুম।”

ওকে সালাদ গুলো কা*ট*তে বলে চুলায় ফ্রাইপ্যান বসালাম। চাকা চাকা করে কে*টে রাখা বেগুনগুলো ফ্রাইপ্যানে বিছিয়ে দিলাম। আনমনে ভাবতে লাগলাম এই তাহলে ব্যাপার। কামরান বোধহয় মেয়েটাকে এখনো ভুলতে পারেনি। তাই আমার সাথেও সহজ হতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আমার বুক চিড়ে। তবু্ও পিউলির ব্যাপারটাও আমাকে ভাবাচ্ছে। জানিনা কি আছে সামনে।

কামরান এলো তখন প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে। আমার রান্না প্রায় হয়ে এসেছে। বিরিয়ানিটা উল্টে পাল্টে নেড়ে চেড়ে দিচ্ছিলাম তখন। হঠাৎ কামরানের কথা শুনে চমকে উঠলাম। ও বলছিল,

” কি রান্না হচ্ছে বলতো? পুরো বিল্ডিংএ খাবারের ঘ্রাণ ছড়িয়ে গেছে। আমি তো ভেবেছিলাম অন্য কোন ফ্লাটে, এখন দেখছি আমাদের রান্নাঘর থেকে ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। ”

আমি পিছন ফিরে দেখি কামরান দাঁড়িয়ে আছে রান্না ঘরের দরজার মুখে। হাড়িতে ঢাকনা চাপা দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। বললাম,

” কি মনে হয়, কি রান্না হচ্ছে বলুন তো? ”

” মনে তো হচ্ছে আমার পছন্দের কোন জিনিসই রান্না হচ্ছে।” কামরান একটু ভেবে বললো।

আমি হাসি মুখে বললাম, ” আচ্ছা? তা আপনার পছন্দের খাবারটা কি শুনি?”

” ওইটাই যেটা তুমি আজ রান্না করেছো?”

” বিড়ালের মত শুকে যখন ধরতে পেরেছেন তাহলে আপনিই বলুননা কি রান্না করেছি?”

কামরান একটু ভেবে নিয়ে বললো, ” বিরিয়ানি। ”

” উহু, বলতে হবে কোন বিরিয়ানি? ”

” কাচ্চি? ”

আমি হেসে উঠে বললাম, ” এইতো ঠিক ধরেছেন। তো এতো দেরি হলো যে ফিরতে? আম্মারা তো মনে হয় চট্টগ্রাম পৌঁছেও গেছে।”

” অফিসে গিয়েছিলাম একটু কাজ ছিল। হ্যা পৌঁছে ফোন দিয়েছিল। এক কাপ কফি করে দিতে পারবে?”

” কেন নয়? এখুনি দিচ্ছি। আপনি জুম্মার নামাজ পড়তে যাবেন না?”

” হ্যা যাবো। এইতো শাওয়ার নিয়ে আসছি। কফিটা খেয়েই নামাজে যাবো। আসলে বাইরে এতো গরম। মাথাটা ধরেছে। তোমারও তো কিচেনের গরমে ঘেমে নেয়ে কি অবস্থা হয়েছে দেখো।”

বলেই হঠাৎই একটাই হাত বাড়িয়ে আমার কপালের পাশে গাল বেয়ে পরতে থাকে ঘাম মুছে দিল কামরান। আচমকা কামরানের এমন আচরণে হকচকিয়ে গেলাম। কিন্তু এই ছোট্ট একটা যত্নশীল আচরণে মনটা আদ্র হয়ে গেল আমার। চারিদিকে আজানের ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো। কামরান সরে দাঁড়িয়ে বললো,

” আজান দিচ্ছে। আমি গোসলটা করে আসি।” বলেই ও আমাদের বেডরুমের দিকে চলে গেল।

আমি চুলায় কফির পানি বসিয়ে দিলাম। রান্নার বাকি কাজগুলো সারতে লাগলাম।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে