তোমায় ছেড়ে যাবো কোথায় পর্ব-০৩

0
920

#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখাঃ মুনিরা সুলতানা।
পর্বঃ ৩ ।

————*
আমার শশুর বাড়িতে যখন পৌছলাম তখন বেশ রাত। বাড়ির সামনে বিশাল ফটকের সামনে গাড়ি দাঁড়াতে দারোয়ান গেট খুলে দিলে গাড়ি ভিতরে এগিয়ে গিয়েছিল। কি বিশাল আকারের দালান! অকেনখানি জায়গা জুড়ে সাত তলা এপার্টমেন্ট বিল্ডিং। শুনেছি উনাদের ডেভেলপমেন্ট ব্যাবসা। হয়ত নিজেদের মনের মাধুরি মিশিয়ে মনমতো করে এই বাড়ি বানিয়েছেন। সামনে বেশ কিছু জায়গা জুড়ে লন এরিয়া। প্রচুর গাছপালা লাগানো সেখানে। কিছু ফল তো কিছু ফুলের গাছ। মাঝে গাড়ি চলাচলের মত পিচঢালা কংক্রিটের ঝকঝকে রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে গাড়ি ভিতরে ঢুকে গাড়ি বারান্দায় এসে থামলে আমরা গাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসেছিলাম। আমি চারপাশে দ্রুত চোখ বুলিয়ে একনজরে দেখে নিলাম। গ্যারেজ ছাড়াও আরও কিছু কামরা আছে। সম্ভবত দারোয়ানের কামরা ও অন্যান্য কামরা গুলো ঠিক কিসের আমি ধারণা করতে পারছিনা। হয়তো অফিস কিংবা স্টোর রুম হতে পারে। পাশে তাকিয়েই দেখেছিলাম তামান্না আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। ও অবাক দৃষ্টি মেলে দেখছিল। ওরা নিজেরাও এপার্টমেন্টে থাকে। ওর অবাক হওয়ার কি ছিল বুঝতে পারলাম না। আমি চোখের ইশারায় প্রশ্ন ছুড়লাম ‘ কি?’

তামান্না আমার কাছে ঝুকে ফিসফিস করে বলেছিল, ” হুম, তোমার ভাগ্য খুবই ভালো, দেখেছ তোমার শশুর বাড়ি কত্ত বড় আর সুন্দর। ”

আমি চোখ পাকালাম। আমাদের লাগেজ ততক্ষণে বের করে ফেলেছিল। আমরা সবাই এরপর লিফটের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। দোতলা পর্যন্ত এসে লিফট থামলে আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম। বাড়ির ভিতরে ঢুকে আমার বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এতো সুন্দর করে সাজানো গুছানো ভিতরটা। আমি একজন আর্কিটেক্ট। সব কিছু এতো পারফেক্ট ভাবে সাজানো দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলাম। ভিতরে প্রবেশ করতে প্রথমেই সরু করিডোর। সেখানে দেয়াল ঘেঁষে পাশাপাশি দুটো কাবার্ড রাখা। একটা সম্ভবত জুতোর বক্স। জুতোগুলো খুলে একটু সামনে এগোতেই আমরা বিশাল আকারের লিভিং রুমে প্রবেশ করলাম। মাখন রঙের সোফাগুলো এতো সুন্দর নরম মোলায়েম লাগছিল দেখতে মনে হচ্ছে ওগুলোতে বসলে ওগুলোর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে। ভিতর থেকে ততক্ষণে একজন মাঝবয়েসী মহিলা এবং একজন অল্প বয়সী গর্ভবতী নারী বেরিয়ে এসেছিল। মাঝবয়েসী মহিলা একদম আমার বরের চেহারার মহিলা ভার্সন। ইনিই বোধহয় আমার শাশুড়ি মা। অন্যজনের সাথে তিয়ানার চেহারার মিল আছে। বোধহয় আমার আরেক ননদ। উনারা হাসি মুখে আমার কাছে এগিয়ে এসেছিলেন। উনাদের দেখে আমি সালাম দিলাম। শাশুড়ি মা সালামের জবাব দিয়েছিলেন। তবে গর্ভবতী মেয়েটি আমার কাছে এসে আমার একটা হাত চেপে ধরেছিল। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠেছিল,

” ওয়াও কি সুন্দর দেখতে গো তুমি! আমার খুব ইচ্ছে ছিল ভাইয়ের বিয়েতে কত মজা করব। কিন্তু দেখ যাওয়ারই সুযোগ হলোনা। জার্নি করে আজই এসেছি। শরীরটা খুব একটা ভালো ছিলনা। তাই আর যাওয়া হলোনা। ” শেষের কথাটা বলার সময় উনার মুখটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল।

আমি লাজুক হেঁসে বিব্রত ভঙ্গিতে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কি বলা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। সে আবারও বলেছিল, ” আমি তাসমিয়া, তোমার বড় ননদ। ”

আমি কিছু বলতে চাইলাম। কিন্তু তার আগেই আমার শাশুড়ি মা বলে উঠলেন,

” এসব কথা পরে হবে। হসপিটাল থেকে এসেছ। এখন তোমরা যাও চেঞ্জ করে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। তাছাড়া রাতও হয়েছে। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। তোমরা ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নাও। ” তারপর তামান্নার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “তোমার বোন? আমি যতদুর শুনেছি তোমরা এক ভাই, এক বোন, তাই না? ”

আমি বলেছিলাম, ” আপনি ঠিকই শুনেছেন। ও তামান্না। আমার মামাতো বোন। ”

” আচ্ছা ঠিক আছে, বুঝতে পারছি।” কথাটা বলে তিয়ানার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ” তিনু ওকে তোমার রুমে নিয়ে যাও। ” এরপর তামান্নার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ” তুমি তিনুর সাথে যাও মা। একদম সংকোচ করবেনা। নিজের বাড়ির মতো করে থাকবে কেমন? যাও কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে নাও। ”

তামান্না বলেছিল, ” ঠিক আছে আন্টি। ” বলে সে তিয়ানার সাথে ভিতরের দিকে চলে গিয়েছিল। আমার বর ততক্ষণে জুতো খুলে ডাইনিং রুমে গিয়ে বসেছিল। আমি ডাইনিং রুমে ঢুকে দেখি ও পানি খেয়ে গ্লাস নামিয়ে টেবিলে রাখছিল। আমাদের দেখে মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়েছিল,

” ওরা সবাই কি চলে গেছে? রাতের খাবার খেয়ে গেলেই পারতো? ”

শাশুড়ি মা বললেন, ” আমি বলেছিলাম। কিন্তু ওরা বললো, আমাদের এই ঝামেলার সময় ওরা ঝামেলা বাড়াতে চায়না।”

আমি বুঝতে পারছিলাম ওদের সাথে বরযাত্রীতে যাওয়া মানুষ গুলোর কথা বলছিল সে। আমরা হসপিটালে প্রায় পুরো সন্ধাটাই কাটিয়ে এসেছিলাম। বরযাত্রীতে আরেকটা মাইক্রোবাস গিয়েছিল। সেটা আমাদের সাথে হসপিটালে না গিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল।

শাশুড়ি মা আমার উদ্দেশ্যে বললেন, ” যাও মা। সারাদিন এতো ভারী পোশাকে নিশ্চয়ই খুব অস্বস্তি হচ্ছে। এসব পাল্টে একটা সুতির শাড়ি পরে নাও কেমন। ”

কথাটা শেষ করে নরম হাসিতে ছেয়ে গিয়েছিল উনার মুখে।
তাসমিয়া এগিয়ে এসে বললো,

” চলো ভাবী তোমাকে তোমাদের রুমে পৌঁছে দেই। আরমান তোমার লাগেজ রুমে দিয়ে এসেছে। ”

আমি খেয়াল করেছিলাম আমার দেবর আরমান সেখানে ছিলনা। সে ইতিমধ্যে ভিতরে চলে গিয়েছিল। আমাকে কামরায় পৌঁছে দিয়ে তাসমিয়া চলে গিয়েছিল। আমি কামরায় একা তখন। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কামরার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ কামরায় একবার চোখ বুলিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল বসন্তের বাতাবরণের কোন রঙিন জগতে চলে গিয়েছিলাম। দেয়াল গুলো হালকা ঘিয়ে রঙের। দড়জা ও জানালার ভারী পর্দা, বিছানার চাদর সব কিছুই ঘিয়ে রঙের। না একদম একরঙা নয়। ঘিয়ে রঙের উপর সেলফ কালারের জ্যাকার্ড প্রিন্ট আছে। বড় কোন সোফা বা কাউচ নেই। দুটো সিঙ্গেল সোফা আছে তাতেও একইরকম ঘিয়ে রঙের গদি এবং এর উপর হলদে সোনালী ও কফি রঙের প্রিন্টের কুশন। আসবাবপত্র গুলোও গাঢ় কফি রঙা বার্নিশ করা। দেয়াল জুড়ে কাঠের আলমারি, ড্রেসিং টেবিল সব একই রকম। ড্রেসিং টেবিলের ডিজাইনও একদম অন্য রকম। সম্পূর্ণ নিচে পর্যন্ত আয়না লাগানো আলমারির পাল্লার মত। ভিতরে কসমেটিক সামগ্রী রাখার জায়গা আছে সম্ভবত। তবে আয়নার সাথে পাশেই সংযুক্ত সামনে কাচ লাগানো চিকন মত খোপওয়ালা র‍্যাক আছে। সেখানে পুরুষদের ব্যাবহার উপযোগী কিছু কসমেটিক সামগ্রী এবং হরেক রকমের সুগন্ধির সুদৃশ্য বোতল সাজিয়ে রাখা ছিল। সবকিছুই একদম ছবির মতো সুন্দর। আমি বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে দেখছিলাম সবকিছু। আমার ধ্যান ভাঙলো যখন কামরান রুমে এসে বলে উঠেছিল,

” কি ব্যাপার তোমার কি ক্লান্ত লাগছেনা এখনো? এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? ”

কামরানের উপস্থিতি টের পেয়ে আমি শক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ কামরায় কেবল আমরা দুজন। আজ দুপুর বেলা থেকেই আমরা বেশির ভাগ সময় একসাথেই ছিলাম। কিন্তু একবারের জন্যও আমাদের দুজনের একা একত্রে হওয়ার সুযোগ মেলেনি। তাই ঐ মুহূর্তে আমি ভিষণ ভাবে অস্বস্তি বোধ করছিলাম। সারাদিনে আমাদের মধ্যে সেভাবে বলতে গেলে কোন কথাই হয়নি। অথচ তার সাথে কিনা আজ থেকে একই রুমে থাকতে হবে। কথাটা ভাবতেই আমার হাত পা কেমন হিম হয়ে আসছিল। আমাকে একই ভাবে গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই বোধহয় কামরান এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি হাত কচলাতে ব্যাস্ত তখন। ও বলে উঠেছিল,

” এনি প্রবলেম? কোন কিছুর প্রয়োজন হলে নিঃসংকোচে বলতে পার। তোমার লাগেজ দিয়ে গেছে। যাও চেঞ্জ করে নাও। ইচ্ছে করলে গরম পানি দিয়ে একটা শাওয়ার নিতে পার তাহলে ফ্রেশ লাগবে। ওয়াশরুমের গিজারটা অন করা আছে। ”

কামরানকে সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে দেখে আমি তখন কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছিলাম। তাই চোখ তুলে চেয়েছিলাম ওর দিকে। ওর মুখে তখন খুবই সুক্ষ হাসির রেখা ফুটে উঠতে দেখেছিলাম। আমিও প্রতিত্তোরে কেবল একই রকম হাসি মুখে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর পরক্ষণেই কামরায় চোখ বুলিয়ে নিজের লাগেজটা চোখে পরতেই সেদিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। ঝটপট লাগেজটা খুলে একটা ম্যাজেন্ডা রঙের শাড়ি ব্লাউজ এবং তোয়ালে নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে ঢুকে পরলাম।

একেবারে গোসল করে নিয়েছিলাম। সত্যি ভিষণ সতেজ লাগছিল। আস্তে করে ওয়াশরুমের দরজা খুলে কামরায় উকি দিয়ে দেখলাম আমার বর বিছানায় শুয়ে ছিল। আমি আস্তে করে কামরায় প্রবেশ করেছিলাম। গহনাগুলো বিছানার পাশে সাইড ডেস্কের রেখে দিয়েছিলাম। একবার আড়চোখে কামরানের দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম। ও সটান হয়ে শুয়ে আছে। একহাত কপালের উপর আড়াআড়ি ভাবে দিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে কাপড় চোপড় বদলে নিয়েছে। পাঞ্জাবি ছেড়ে একটা কালো ট্রাউজার ও হালকা ধুসর রঙের টিশার্ট পরেছে। চুলগুলো ভেজা। তারমানে অন্য ওয়াশরুমে গিয়ে গোসল করেছে। আমি ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ফেলে হাতে ধরে রাখা শাড়ি ব্লাউজ গুলো বেলকনিতে গিয়ে তারে নেড়ে দিলাম। তারপর বেলকনির গ্রীল ধরে ঐখানেই দাঁড়িয়ে বাইরের অন্ধকারে নিমজ্জিত খোলা আকাশের দিকে চোখ রাখলাম। আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা হাজারো নক্ষত্রের মাঝে একখানা অর্ধেক খোয়া চাঁদের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিলাম। কিছু সময়ের জন্য আমি অতীত বর্তমান ভবিষ্যতের সমস্ত ভাবনা সরিয়ে রেখে শুধু মাত্র ঐ মুহূর্তটাকে উপভোগ করছিলাম। একটু একটু করে আজ সারাদিন ধরে রাখা স্নায়ুর চাপটা আমার শরীর মন থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল। আমি একটু নিজেকে শান্ত করতে পেরেছিলাম। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সামনের আসা মুহূর্ত গুলোর মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো মনোবল সঞ্চয় করে নিয়েছিলাম। তারপর আস্তে ধীরে কামরায় ফিরে এসে স্যুটকেশ থেকে আমার জায়নামাজ বের করে কাজা নামাজ সহ বাকি নামাজ গুলো আদায় করে নিয়েলাম। নামাজ শেষে জায়নামাজ ভাজ করে রাখতে রাখতে কামরনের দিকে চাইলাম। কোন সারা শব্দ নেই। ক্লান্তিতে বোধহয় ঘুমিয়ে পরেছে। আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। সংকোচিত মন নিয়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম অবশেষে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রাতের খাবার খেতে বসা হয়েছিল। তখন তাসমিয়ার বরের সাথে দেখা হয়েছিল। যদিও বিয়ের পরে কামরানের পাশে উনাকে দেখেছিলাম। কিন্তু পরিচয় হয়েছিল খাবার টেবিলে বসে। আমি কোনরকমে অল্প কিছু খেয়েছিলাম। এই বাড়ির মানুষ গুলো বোধহয় খুব কম কথা বলে। একদম নিরব পরিবেশ। খাওয়ার সময় টুকটাক কথা বলছিল সবাই। নতুন পরিবেশে আমি পুরোটা সময় নিরব ছিলাম। তাসমিয়ার বর রিয়াজ টুকটাক দুয়েকটা কথা বলেছিল আমার সাথে। এরপর কামরানের সাথে কথা বলতে ব্যাস্ত হয়ে গিয়েছিল।

খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে সবাই একএক করে উঠে পরেছিল। কামরান ও আরমান হসপিটালে যাওয়ার জন্য রেডি হতে যাচ্ছিল। শাশুড়ি মা হঠাৎ কামরানকে থামালেন।
তিনি বলেছিলেন,

” আজ তুমি ঘরে থাকো বাবা। তোমার ফুপু আছেন ওখানে। আরমানও যাচ্ছে। তোমার মাত্র আজ বিয়ে হয়েছে। নতুন বউকে একা রেখে যাওয়াটা ভালো দেখায়না বাবা। ”

” কিন্তু আম্মা… ” কামরান কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন শাশুড়ি মা,

” কোন কিন্তু না কামরান। সকালে যেও। একটা রাতেরই তো ব্যাপার। এখন ঘরে যাও।”

কথাগুলো তিনি বেশ কোমল গলায় বললেন। তবুও শুনতে বেশ কঠোর মনে হচ্ছিল। কামরান আর কোন তর্কে গেলনা। থমথমে মুখে কামরার দিকে চলে গেল। আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ। নতুন বউ হিসাবে কি বলা উচিৎ, কি করা উচিৎ কোনটা আমার করনীয় ভাবছিলাম। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এরপরেও সাহস করে শাশুড়ি মায়ের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। দাদাকে যেমনটা দেখে এসেছিলাম তাতে করে আমার মনের মাঝে কেমন একটা অস্বস্তিজনক বিচলিত অনুভূতি কাজ করছিল। এমনটা আমার দাদা মারা যাওয়ার সময়ও হয়েছিল। কেন জানিনা আমার বারবার মনে হচ্ছিল দাদা বোধহয় আজকের রাতটা পার করতে পারবেন না। এই অবস্থায় কামরানকে জোর করে আটকে রাখার পরে সেই অঘটন ঘটে গেলে ওর মনের মধ্যে আজীবন অপরাধ বোধ থেকে যাবে। আর তার ফলে আমাদের সদ্য বিবাহিত না হওয়া দাম্পত্য জীবনের উপর খুব বাজে ভাবে প্রভাব ফেলবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলাম,

” আন্টি যদি মাইন্ড না করেন আমি কিছু বলতে চাই। ”

উনি আমার কথা শুনে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ” হ্যা বল কি বলবে? ”

” হায়াত মউতের কথা তো কেউ বলতে পারেনা। দাদার বয়স তো অনেক হয়েছে। উনাকে আজ দেখে খুব ভালো অবস্থা মনে হয়নি আমার। এখন যদি উনার যাওয়ার সময় হয়ে যায়, মানে কোন অঘটন ঘটে গেলে তখন আপনার ছেলে ব্যাপারটা মেনে নিতে পারবে বলেন? উনি আজীবন অপরাধ বোধে ভুগবেন সেই সাথে আমার জন্য হসপিটালে যেতে পারেননি বলে আমাকেও দুষবেন। আমাদের যে অবস্থায় বিয়েটা হয়েছে এই অবস্থায় সব নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করাটাকি খুব দরকার? সময় ভালো হলে সবই হবে ইনশাআল্লাহ। তাই বলছি প্লিজ আজকের উনাকে যাওয়ার পারমিশন দিন।”

শাশুড়ি মা আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে ছিলেন। আমি নার্ভাস ভাবে শুকনো ঢোক গিলেছিলাম। উনি বেশ গম্ভীর এবং রাশভারী ধরনের মানুষ। উনার ব্যাক্তিত্বের কারনে উনার সামনে একটু আধটু ভয় ভয় অনুভূত হয়। কামরানও সম্ভবত মায়ের মত ব্যাক্তিত্ব পেয়েছে। যদিও সেই কয়েক ঘন্টা যথেষ্ট ছিল না একটা মানুষকে ঠিক ঠাক ভাবে জানার জন্য।

শাশুড়ী মা গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিলেন, ” সিচুয়েশনে অনুযায়ী তোমার বিচক্ষণ আচরণ দেখে ভালো লাগলো। ঠিক আছে ওকে বল যেতে আমি আরমানকে বলছি অপেক্ষা করতে। ”

আমার ঠোঁটে আপনা আপনি হাসি ফুটে উঠেছিল। চটপট কামরায় চলে গিয়েছিলাম। কামরান তখন অস্থির ভাবে পায়চারি করছিল। আমি এগিয়ে গিয়ে বলেছিলাম,

” আপনাকে আমার জন্য বাসায় থাকতে হবেনা। আপনি হসপিটালে যান।”

ও পায়চারি থামিয়ে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ” তুমি শোননাই আম্মা কি বললো? ”

” শুনেছি। কিন্তু সেটা এই মুহূর্তে যুক্তিসংগত হবেনা। আমাদের বিয়েটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে হয়নি। আপনার দাদার জন্যইতো এভাবে বিয়েটা হলো। তাইনা? আজ যদি দাদার কিছু হয়ে যায় তাহলে এই কারনে আপনি নিজেকেই মাফ করতে পারবেন না। আর আমি সেটা কিভাবে দেখি বলেন? আন্টি পারমিশন দিয়েছেন। আপনি যান। ”

কামরান আর দেরি করেনি। তৎক্ষনাৎ ঐ পোশাকেই কামরা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমিও ওর পিছনে পিছনে গিয়েছিলাম। ডাইনিং রুমে গিয়ে থমকে গিয়েছিলাম। সেখানে একজন মাঝবয়েসী মহিলা এবং অল্প বয়সী একটা সুন্দরী মেয়ে আমার শাশুড়ি মায়ের সাথে বেশ উচ্চস্বরে কথা বলছিল।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে