#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখা – মুনিরা সুলতানা।
পর্ব – ২৬।
————-*
ভালোবাসার মানুষটা এতো কাছে এসেছে আজ। হৃদপিণ্ডে রক্ত ছলকে উঠলো। কতদিন এইক্ষণটার জন্য প্রতিক্ষায় ছিলাম। আজ এভাবে কামরান আমায় কাছে টেনে নিবে কল্পনায়ও ভাবিনি। হঠাৎ ওর এমন স্পর্শে নিজেকে কেমন হারিয়ে ফেলছি। কেমন গলে যাচ্ছি। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিনা। শরীরটা কেমন অসার হয়ে গেছে। আমি যেন ডুবে যাচ্ছি। তলিয়ে যাচ্ছি। শরীরটা একদম পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে গেছে। নিজের ভার কখন কামরানের উপর ছেড়ে দিয়েছি তাও জানিনা। বৃষ্টিতে ভিজেও সম্পূর্ণ শরীর থেকে যেন গরম আগুনের হলকা বের হচ্ছে। কান মাথা গাল প্রচন্ড তাপদাহে যেন জ্বলছে। এ কেমন অনুভুতি। আমার হাত পা ঠকঠক করে কাপছে। কিন্তু এটা ঠান্ডার কারনে হচ্ছেনা। অন্য রকম শিহরণে আমি এভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছি। কখন যে আমি নিজেও ওর ডাকে সারা দিয়েছি নিজেও জানিনা। কতক্ষণ সময় এভাবে পেরিয়ে গেছে জানিনা। হঠাৎ সেদিনের সেই ওদের আলিঙ্গনরত দৃশ্য ভেসে উঠলো চোখের সামনে। আর তখন কোথা থেকে এত শক্তি আমার শরীর মনে ভর করল জানিনা। সজোরে ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিলাম। টালমাটাল পায়ে সরে এলাম ওর কাছ থেকে। শরীরটা কেমন অসার হয়ে আছে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। বহু কষ্টে সৃষ্টে নিজেকে ধাতস্থ করতে চেষ্টা করছি। কামরান বোধহয় এক মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গিয়েছিল। তারপর আমার টলমলে অবস্থা বুঝতে পেরে এগিয়ে এসে আমাকে আগলে ধরল। আমার এই মুহুর্তে কেমন অদ্ভুত একটা অভিমানে গলার ভিতরে ভার ভার কান্নারা দলাপাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি কাঁদতে চাইনা। ওর সামনে তো নয়। নিজেকে সামলে নিয়ে আবারও ওর কাছে থেকে ছাড়িয়ে নিলাম নিজেকে।
” এসব কি?কেন এমন করছেন? প্লিজ আমার কাছ থেকে দুরে থাকুন। ” কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম।
কামরান আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, ” বউ হও তুমি আমার। অধিকার আছে তোমার কাছে যাওয়ার। দূরে কেন যেতে বলছ আমায়? আমি জানি আমাদের অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিয়েটা হয়েছিল বলে শুরুর দিকে মানিয়ে নিতে দুরত্ব বজায় রেখেছিলাম যেন তুমি সহজ হতে পারো। তারপর রোজা শুরু হলো। এখন তো রমজান মাসও চলে গেছে। এখন কেন বউয়ের কাছে থেকে দুরে থাকব বল? তুমি কি তাহলে এখনো এই সম্পর্কে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছনা?”
আমি কয়েক পল কামরানের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর মনের ভিতর আসলে কি চলছে? সত্যিই ও আমাদের সম্পর্কটাকে সামনে এগিয়ে নিতে চায়? এতদিন আমিওতো তাই চাইতাম। আজ এতোদিন পরে ও আমার কাছে আসতে চাইছে। কিন্তু আমার মনের ভিতর জমে থাকা প্রশ্নের উত্তর না পেলে যে আমি কিছুতেই সামনে এগোতে পারবোনা। আমাকে আগে জানতে হবে সত্যিটা। ওর মন কি চায় স্পষ্ট করে জানতে হবে। তাই শুধালাম,
” আপনি সত্যিই চান আমাদের সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিতে?”
কামরান অবাক স্বরে পাল্টা শুধালো, ” কেন চাইবনা? আমাদের বিয়ে হয়েছে। এটাই কি স্বাভাবিক নয়?”
” হ্যা এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু…? ”
আমার কথায় বাধা দিয়ে ও বলে উঠলো, ” দেখ হীবা বেশ কিছুদিন যাবৎ তোমাকে কেমন অদ্ভুত বিহেব করতে দেখছি। আগের মত নেই তুমি। একদম চুপচাপ আমাকে এড়িয়ে চলছ বেশ বুঝতে পারছি। কিন্তু কেন করছ এমন যদি খুলেই না বল আমি কিভাবে বুঝতে পারব বল? তোমার মনে কোন সংশয় বা প্রশ্ন থাকলে বল। আমি সবকিছু সল্ভ করে দিব।”
আমারও মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলা দরকার। অন্তত কৈফিয়ত চাইতেই পারি। এটা আমার অধিকারও।
“সেদিন আড়ংয়ের সামনে আমি আপনাকে পিউলির সাথে আলিঙ্গনরত অবস্থায় দেখেছিলাম। ”
কথাটা বলতে আমার ভিষণ অস্বস্তি লাগছে। গলাটাও কেঁপে উঠলো। কামরানের দিকে অস্বস্তি সহকারেই তাকিয়ে আছি। ওর ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু ওর মধ্যে কোন ভাবান্তর ঘটেনি। না চমকালো, না ভড়কালো। কেবল কপালের চামড়ায় কয়েকটা ভাজ পরল। কয়েক মুহূর্ত নিরবে কেটে গেল। কামরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবে কি দেখছে? আমি অস্বস্তিতে এবার চোখ সরিয়ে নিলাম। কিছু সময় পরেদ অবশেষে নিরবতা ভেঙে কামরান মুখ খুললো,
” সব দৃশ্য দেখতে যেমন লাগে আদতে ঘটনার পিছনের সত্যিটা ঐরকম নাও হতে পারে। তাই মনে সন্দেহ বা প্রশ্ন জাগলে সেটা মনের ভিতর চেপে না রেখে ক্লিয়ার করে নিতে হয়। তাহলে অযথা মনকষ্টে যেমন ভুগতে হয়না তেমনি সম্পর্কের ভিতরে দ্বিধা দন্দ্ব তৈরি হয়না। ”
” আমার মাথা কাজ করছিল না। সবকিছু এতটাই আচম্বিত আর আনএক্সপেক্টেড ছিল যে আমি তখন আমার করনীয় নির্ধারন করতে পারিনাই। একমুহূর্তের জন্য আমার কোন বোধ শক্তিই কাজ করছিল না।”
” আর তাই সেদিন এই কারনেই বোকার মত মাঝ রাস্তাই গিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গেলে? মৃত্যুই কি সবকিছুর সমাধান? একবার সত্যি মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজন মনে হলো না? ”
আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। কি ভাবছে এই লোকটা? আমি আত্ম*হত্যা করতে চাইছিলাম এটাই ভাবছে? তাই ওর ভুল ভাঙতে বললাম,
” এমা না না, আমি মোটেও ওমন কিছু করতে যাইনি। আসলে সেদিন এতটাই ধাক্কা খেয়েছিলাম যে কিছুক্ষণের জন্য আমি নিজের মধ্যেই ছিলাম না। কখন যে রাস্তার মাঝখানে চলে গিয়েছিলাম টেরই পাইনি। ওটা এক্সি*ডেন্টই ছিল। ইচ্ছাকৃত নয়। কিন্তু আপনি যেটা বোঝাতে চাইছেন তা যদি সত্যি হয় তাহলে আপনারা ওখানে কি করছিলেন? ভরা রাস্তার মাঝে ওভাবে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন?”
” তুমি খেয়াল করে দেখলে বুঝতে পারতে আমি ওকে জড়িয়ে ধরিনাই। কেবল পিউলি ধরে ছিল। ওদের বাসা ওদিকেই। শপিংয়ে এসেছিল। আমার কাছে ওর ইন্টেনশন সুবিধার লাগছিল না তাই ওর সাথে কাজ করতে মানা করে দিয়েছিলাম এবং ওকে এড়িয়েও চলছিলাম। তাই হঠাৎ ঐদিন আমাকে দেখে কেমন পাগলামি শুরু করেছিল। আমি বুঝতেই পারিনি হঠাৎ ঐভাবে জড়িয়ে ধরবে। কয়েক মুহূর্ত আমি স্টোনিশ হয়ে গিয়েছিলাম। যখন বুঝতে পারলাম একচুয়েলি কি ঘটছে তখনি ওকে জোর করে সরিয়ে দেই আর তখনি দেখি ওদিকে তোমার এক্সি*ডেন্ট হয়েছে। ”
তখনি তামান্নার গলা ভেসে এলো। ছাদের আসার সিড়ি থেকে আমাকে ডাকছে,
” হীবা আপু তোমরা কি ছাদে? ”
আমি চটজলদি দরজার কাছে গিয়ে গলা চড়িয়ে জবাবে বললাম, ” হ্যা আমরা ছাদে।”
” এতো সকালে বৃষ্টির মধ্যে ছাদে কি কর আপু? নাস্তা খেতে ডাকছে তোমাদের। জলদি নিচে আসো। ”
আমি গলা উঁচিয়ে বললাম, ” এইতো এখুনি আসছি। ”
ততক্ষণে কামরানও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ও বললো, ” আমাদের কথা বলা দরকার হীবা। তিয়া তাসমির মতো পিউকেও আমি সবসময় বোন হিসেবেই দেখেছি। সেই ওকে জড়িয়ে এমন সম্পর্কের সন্দেহ করাটা আমার জন্য খুবই অস্বস্তিকর, লজ্জাজনক এবং বিশ্রী ব্যাপার। অযথা মিসআন্ডারেস্টিং সম্পর্কের মাঝে তীক্ততায় ভরিয়ে দেয়। যা একটা সম্পর্ক নষ্ট করতে যথেষ্ট। ”
কামরান ঠিক বলেছে। না বুঝে আমিও এতদিন এত কষ্টে ভুগেছি। সত্যিইতো ওদের মাঝে যদি কিছু থাকতোই তাহলে আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে ও সিরিয়াস কেন হবে? আমি তো জানতামই পিউলিই কামরানের পিছনে পরে আছে। এখানে কামরানের কোন দোষ নেই। তাহলে অযথা আমি এভাবে অভিমান করে নিজেদের মধ্যে দুরত্ব তৈরি করে ঐ মেয়েটাকেই জিতিয়ে দিচ্ছিলাম না? কি বোকামোটাই না করছিলাম। সত্যিই এই নিয়ে আমাদের খোলামেলা কথা বলতে হবে। বললাম,
” ঠিক আছে। আজকের বিয়ের ঝামেলাটা আগে পার হোক। তারপর আমরা কথা বলবো। নাস্তা খেতে ডাকছে। এখন নিচে চলেন। তাছাড়া অনেক্ক্ষণ যাবৎ ভেজা হয়েছে। শরীরটা না আবার খারাপ হয়।”
কামরান কেমন কাতর গলায় বললো, ” আমাকে ভুল বুঝনা হীবা। কারও সাথে রিলেশনশিপে থাকা অবস্থায় অন্য আরেকজনকে বিয়ে করব এতটাও নীচ মেন্টালিটির মানুষ আমি নই। এইটুকু বিশ্বাস অন্তত রেখো।”
কামরানকে এমন মরিয়া হয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার চেষ্টা করতে দেখে আমার মনটা নিমিষেই সিক্ত হয়ে উঠলো। আমি স্মিত হেসে মাথা দুলিয়ে সায় জানিয়ে বললাম,
” আমি জানি। সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। দেরি হচ্ছে। এখন নিচে চলেন। ”
তারপর সিড়ি ঘরে ঢুকে নিচে নামতে লাগলাম। আমার পিছনে কামরানও আসছে।
বাড়িতে এত আত্মীয় স্বজনের ভীড়ে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা কয়েক ভাগে সারতে হচ্ছে। আমরা নাস্তা করতে বসলাম দ্বিতীয় ব্যাচে। অনেক মানুষ তাই রুটি পরোটার ঝামেলা না করে খিচুড়ি রান্না হয়েছে। গরম গরম খিচুড়ি ডিমের অমলেট, বেগুন ভজা, সালাদ দিয়ে তৃপ্তি সহকারে সবাই খাওয়া দাওয়া সেরে নিল। নাস্তা শেষে কামরানকে দাদির রুমে নিয়ে গেলাম। বিয়ের সময় দাদি ঢাকায় যেতে পারেননি তাই কামরানের সাথে প্রথম দেখা হল। গতকাল ও আসার পর থেকে ব্যস্ততার কারনে দাদির সাথে কামরানের সেভাবে কথাই হয়নি। তাই দাদিই এখন ডেকে পাঠিয়েছে ওকে। বেশ কিছুক্ষণ সময় দুজনে কথা বললো। আমি এর মধ্যে একবার বাইরে এসেছিলাম। আবার ফিরে এসে রুমের ভিতরে পা রাখতেই দাদিকে বলতে শুনলাম,
” একটা সম্পর্কের বন্ধন শক্ত হইতে অনেক সময় লাগে। যেকোনো সম্পর্কের প্রথমের দিকে টান, মায়া, মমতা, বিশ্বাস ও ভরসার জায়গাটা বেশ দুর্বল থাকে। তাই একটু এইদিক ওইদিক হইলেই সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস, দুরত্ব চইলা আইলেই সেটা ভেঙে যাইতে একটুও সময় লাগেনা। এই সময়টা খুবই নাজুক সময়গো নাতজামাই। তাই এই সময় সম্পর্কের প্রতি সবচাইতে বেশি যত্নশীল হইতে হয়। একটু একটু করে বিয়ের মত পবিত্র সম্পর্কের মানে বুঝতে হয় এবং ধীরে ধীরে সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে সেই সাথে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসার গভীরতাও বাড়তে থাকে। তাই এই সময়টা সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা হইল ধৈর্য্য। পরিস্থিতি যেমনই হোকনা কেন প্রতি মুহূর্তে ধৈর্য্য ধরে পরিস্থিতি সামলাইতে হয়। আমাদের হীবা এমনিতেই খুবই বুঝদার। কিন্তু একটু বেশি অভিমানী। ওর মনে কোন সংশয়, সংকোচ বা কোন প্রশ্নও যদি জাইগা থাকে তবুও তার একটাও মুখে আনবে না। নিজের মনের মধ্যে চাইপা রাখবে।”
কামরান বললো, ” কিন্তু এটা তো ঠিক না দাদি। মনে যদি কোন প্রশ্ন আসে সেটা সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই তো সব দ্বিধা কেটে যায়। নয়তো সেটা মনে চেপে রাখলে নিজেও শান্তি পাবেনা অপরকেও শান্তি দিতে পারবে না। ”
দাদি হাসলেন, ” আমি জানি এইটাই হীবার সমস্যা। এইজন্য স্বামী স্ত্রীকে পরস্পরের আয়না স্বরুপ হতে হয়। যাতে মুখে কিছু না বললেও একে অপরের ভাব ভঙ্গিতেই মনের ভিতর চলা দ্বিধা দ্বন্দ্বগুলো পরস্পর বুইঝা নিতে পারে। সময়ের সাথে তোমাদের সম্পর্কও একদিন মজবুত হইবো। তখন তোমরাও মুখ দেখেই অনেক কিছুই বুইঝা যাবা। কিন্তু এখন সময় তোমাদের একে অপরের সাথে বেশি করে সময় কাটানো এবং পরস্পরকে চেনা, জানা ও বোঝার চেষ্টা করা।”
এতক্ষণ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছিলাম। ওরা কেউ আমাকে দেখেনি। এখন এগিয়ে গিয়ে দাদির উদ্দেশ্যে বললাম, ” একি দাদি, নতুন জামাইয়ের কাছেও তোমার জ্ঞানের ভান্ডার খুলে বসেছ?”
কামরান মুচকি হেসে বললো, ” তোমার দাদি সত্যিই অনেক জ্ঞানী হীবা। আসলে বুজুর্গ মানুষরা জীবন থেকে, এতো বছরের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শিখেছেন। সেই শিক্ষা থেকে আমাদের সত্যিই অনেক কিছু শেখার থাকে। আমার দাদী সেই ছোটবেলায় মারা গিয়েছেন। তাই ওনার কথা ঠিক মতো মনেও নেই তবে আমার দাদার সাথে সম্পর্কটা একদম তোমার সাথে তোমার দাদির মতোনই ছিল। আমার দাদাও এরকম নানা রকম উপদেশ দিতেন যেগুলো আমার জীবনে অনেক কাজে লেগেছিল। মাথার ওপর এরকম বুজুর্গ রূপে বটগাছের মত ছায়া থাকা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। অথচ দেখো উপর বাবা দাদা তারা কেউই এখন আর নেই। ”
মন খারাপ গলায় কথাগুলো বলে থামলো কামরান। আমারও মনটা আদ্র হয়ে গেল। সত্যি বলতে মাথার উপর বাবা মায়ের ছায়া আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় নিয়ামত। অনেকে এর মূল্য না বুঝে বাবা মায়ের প্রতি অবহেলা, অবিচার করে। আবার কেউ তাদের আগলে রাখতে চাইলেও বিধাতা সেই সুযোগ দেয়না। জীবনটা সত্যিই বড় অনিশ্চিত। চাইলেও আমরা নিজের জীবনেরই কোনকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। একটা প্রলম্বিত শ্বাস বেড়িয়ে এল আমার বুক চিড়ে। দাদি অনেকটা স্বান্তনার সুরে বললেন,
” আমি বুঝতে পারতেছি তোমার কষ্টটা। কিন্তু এইটাই তো জীবনের নিয়ম গো। মন খারাপ করেনা। আমিতো তোমারও দাদি। তোমার যখন মন চাইবো আমার কাছে চইলা আইসো।নয়তো ফোন দিও। ”
কামরান হেসে উঠে বললো, ” দাদি আপনি কিন্তু অনেক আধুনিক মনষ্ক। আপনাদের সময়কার মহিলারা বেশ সেকেলে মেন্টালিটির হয়। অথচ আপনি কত স্মার্ট। ”
দাদি এবার শব্দ করে হেসে ফেললেন। উনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও হেসে উঠলাম।
———–*
মাগরিবের নামাজ আদায় করে ঝটপট রেডি হয়ে নিলাম। কামরানের দেয়া ঈদের শাড়িটাই পরলাম। এখনো হাত নাড়াতে সমস্যা হয়। বিশেষ করে হাত উঁচু করা কাজে অসুবিধা হয়। তাই চুলগুলো কারও কাছে আচরিয়ে নিতে হয়। আজও তাই চাচীর কাছে আচরিয়ে নিয়েছি। কিন্তু এখন হিজাব পরা বাকি আছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাজগোছ সম্পূর্ণ করলাম। যেমন বরাবর সাজি তেমনই হালকা সাজেই সেজেছি। হাতে চুড়িগুলো পরছি তখন কামরান এসে আমার পিছনে দাঁড়িয়েছে। অবাক হয়ে আয়নার ভিতর দিয়ে ওর প্রতিবিম্বের দিকে চাইলাম। আমার চোখে প্রশ্নবোধক চাহনি। কামরান এক পলক আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে দুই কাঁধের উপর ধরে আমাকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে নিল। আমি ওর দিকে ফিরে দাঁড়ালাম। কামরান ছাই রঙের পাঞ্জাবী পরেছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। সে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা চৌকোনা বাক্স বের করল। সেটা খুলতেই খুব সুন্দর একটা হোয়াইট গোল্ডের উপর ডায়মন্ড বসানো ব্রেসলেট দৃষ্টিগোচর হলো। ব্রেসলেটটা অনেকটা ঘড়ির মত ডিজাইনের। শুধু ঘড়ির ডায়ালের জায়গার বদলে হিরে বসিয়ে কারুকার্য শোভিত মনোমুগ্ধকর ডিজাইন করা। আমি বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছি। কামরান বাক্স থেকে ব্রেসলেটটা হাতে তুলে নিয়ে বাক্সটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দিল। আমার হাতটা তুলে নিয়ে সেটা সযত্নে আমার হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বলল,
” লন্ডনে যখন জুয়েলারি শপে ব্রেসলেটটা প্রথম দেখলাম আমার কেবলই মনে হয়েছিল এটা শুধুমাত্র তোমার জন্যই তৈরি হয়েছে। দেখ কি সুন্দর মানিয়েছে তোমার হাতে।”
কথাটা বলেই হাতটা তুলে ধরে টুপ করে ঝুকে আমার হাতের পিঠে চুমু খেলো। আমার হাতটায় যেন বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হলো। সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেল। লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ঝট করে পিছনে ঘুরে দাঁড়ালাম। কিন্তু সে তো সরে যাবার পাত্র নয়। বরং আরও গা ঘেঁষে দুই কাঁধে ধরে দাঁড়িয়েছে কামরান। এবার ঘাড়ে ও গলার মাঝামাঝি জায়গায় ঠোঁটের স্পর্শ টের পেলাম। শিরশিরে অনুভূতি সর্বাঙ্গে এবার কাঁপন ধরিয়ে দিল। এমন ভাবে ঘেঁষে আছে সে আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কামরানের গাঢ় নিঃশ্বাস আমার পিছনে ঘাড়ে আছড়ে পরছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। পা দুটো কেমন নড়বড়ে লাগছে। মনে হচ্ছে এখুনি হুড়মুড় করে পরে যাব। কোন রকম একটা শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
” কি করছেন? দেরি হয়ে যাচ্ছে। এখুনি কেউ চলে আসবে কিন্তু।”
কামরান আমার কানের লতিতে চুমু দিল। তারপর এক পা সরে দাঁড়াল। আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে আছি। লজ্জায় অস্বস্তিতে কাঠ হয়ে জমে গেছি। এখনো আমার শরীর মৃদুভাবে কাঁপছে। কামরান আমাকে ধরে আবারও নিজের দিকে ঘুড়িয়ে নিল। কপালে আলতো ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে আমার মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
” টিনএজ মেয়েদের মতো এতো লজ্জা! আমারই ভুল হয়েছে। অযথা তোমার মন বোঝার অপেক্ষা না করে আরও আগেই লজ্জা ভাঙার ব্যাবস্থা করতাম তাহলে আর এতো অভিমান জমতনা তোমার মনে। স্বামী স্ত্রীর শরীর ও মনে বিন্দু পরিমাণ ফাঁক রাখতে নেই। ফাঁক থাকলে সেই ফাঁক গলে শয়তান ঢুকে পরে। কথাটা কিভাবে যে ভুলে গিয়েছিলাম জানিনা। নইলে তোমাকে এতোদিন দুরে সরিয়ে রাখতাম নাকি? আর সেই ভুল করতে রাজি নই। এখন আমাদের মাঝের সমস্ত ফাঁক মিটিয়ে ফেলতে চাই। তাই এখন আর লজ্জা শরম করলে চলবে না। তবে তোমার লাজুক মুখটা দেখতে কিন্তু বেশ লাগছে। আমার লাজুক বউ।”
আমি খুবই নীচু গলায় বললাম, ” আমি অভিমান করে আছি কিভাবে বুঝতে পারলেন?”
” তোমার এই আপনি সম্বোধনটা ছেঁটে ফেলো। এই যুগে কেউ বরকে এমন আপনি আজ্ঞে করে? আর তোমার গত কিছুদিনের আচরণই বলে দেয় ম্যাডামের অভিমান হয়েছে শুধু তাই নয় মনে অবিশ্বাসও জন্মেছে তাই না?”
” অবিশ্বাস হওয়ার সুযোগ দিলে আমার কি দোষ? নিজে এমন সব বোকার মতো কাজ করে বেড়াবে আর আমার রাগ অভিমান হবে না? ”
” অবশ্যই রাগ হবে কিন্তু সেই রাগটা মনে পুষে না রেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেনা কেন? তাহলে তো এতোদিন অভিমান করে এতো কষ্ট পেতে হতোনা তাই না?”
” কেন জিজ্ঞেস করবো? আমার বয়েই গেছে জিজ্ঞেস করতে। ”
” তাই না? খুব চালাকি শিখেছ দেখছি। কি সুন্দর সম্বোধন ছাড়াই কথা বলছ। কিন্তু তা চলবে না। তোমার মুখে তুমি শুনতে চাই আমি। বুঝলে? ”
“কিরে হীবা তোর হলো? হিজাব পরবি বলে আয়।”
কথাটা বলতে বলতে আমার ফুপাতো বোন হঠাৎ রুমে প্রবেশ করতেই আমরা দুজনেই ছিটকে দু’দিকে সরে দাঁড়ালাম। যদিও আমরা কেবল কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তাছাড়া মিলা আপু নিজের মনে হাতে ঘড়ি পরতে পরতে এসেছিল বলে নজর তার হাতের দিকে ছিল। তবুও মুখ তুলে তাকাতে কামরানকে রুমে দেখে আপু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কামরান ঝটপট বললো,
” ইউ গাইস ক্যারি অন।”
বলেই ঝড়ের বেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমিও ইতস্তত হেসে খাটের উপর রাখা হিজাবটা নিয়ে এসে আপুর হাতে দিলাম। সেটা হাতে নিয়ে আপু আমাকে হিজাবটা পরিয়ে দিতে লাগলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ।