#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখা – মুনিরা সুলতানা।
পর্ব – ২৫।
—————-*
কামরান কথন
কিছু একটার খট করে শব্দে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ঘুম জড়ানো চোখ মেলে চারিদিক দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম কটা বাজে। অন্ধকারের ডিম লাইটের আলোয় কিছু ঠাহর করতে পারলাম না। পাশে তাকিয়ে দেখি হীবা তার জায়গায় নেই। বাথরুমের দরজার নিচ দিয়ে আবছা আলো বেরিয়ে আসছে দেখে বুঝলাম সে ওয়াশরুমে। গতকাল রাতে ওর চোখে মুখে মাসখানেক আগের মত লজ্জায় রাঙা হতে দেখলাম না। কেমন যেন একটা অস্বস্তি, জড়তা কিছুটা কাঠিন্য কাজ করছিল ওর মুখভঙ্গিতে ওর আচরণে। যেন আমার থেকে দূরে থাকতে চায়, এড়িয়ে যেতে চায়। বেশ কিছুদিন যাবৎ এটাই চলছে। তাইতো ও গত রাতে ওয়াশরুমে গিয়ে যখন অনেক্ক্ষণ যাবৎ বাইরে আসছিল না তখন মনে হল হীবা ইচ্ছে করে আমার কাছে থেকে পালিয়ে আছে। তাই ওকে ওয়াশরুম থেকে দেরিতে বের হতে দেখে আমি ইচ্ছে করে ঘুমিয়ে থাকার ভান করেছিলাম। যাতে ওকে অস্বস্তিতে পরতে না হয়। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? এবার ওর সাথে কথা বলতেই হবে। বালিশের পাশ থেকে সেলফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম সোয়া চারটা বাজে। ফজরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। হীবা নিশ্চয়ই নামাজ পড়তে উঠেছে। ওর এই ব্যাপার গুলো আমার খুব ভালো লাগে। নিয়ম করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, পর্দা মেনটেইন করে চলার চেষ্টা করে। শান্ত এবং প্রচন্ড ধৈর্যশীলা, মিষ্টতায় ডোবা, স্নিগ্ধ এবং ভিষণ লক্ষ্মী একটা মেয়ে। যাকে দেখলে কেবল মুগ্ধতায় তলিয়ে যাই, একটু একটু করে কখন যে সে আমার মন প্রাণ জুড়ে বিচরণ করতে শুরু করেছে বলতে পারবনা। শুধু এটুকুই জানি ওর প্রতি আমার মনে ভালোবাসার গভীরতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। মেয়েটা আমাকে কি পরিমাণ আকর্ষণ করে কিভাবে তার দিকে আমাকে চুম্বকের মত টানে তা যদি জানতো। কিন্তু আমি নিজেকে সামলে রেখেছি। আমাদের যেই পরিস্থিতিতে যেভাবে বিয়েটা হয়েছিল তাতে করে কেউই মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলামনা। হীবা তো পরীক্ষার পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত ছিল। হঠাৎই দাদার অসুস্থতা এবং উনার শেষ ইচ্ছে পুরোন করতে গিয়ে একদমই হুট করেই বিয়েটা হয়ে গেল। আমরা কেউ বুঝতেই পারলাম না কিছু অনুভবও করলামনা সবকিছু স্বপ্নের মতো চোখের পলকেই যেন ঘটে গেল। তারপর আরও এলোমেলো হয়ে গেল আকস্মিক দাদার মৃত্যুতে। এরপর কেবল দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল যেন নদীর বহমান স্রোতধারার মত। আর আমরা সবাই কেবল সেই স্রোতধারার সাথে ভেসে যাচ্ছিলান। তাই আর দশটা নতুন দম্পতির মত আমরা একে অপরের জন্য সেভাবে সময় দেয়ার সুযোগ পাইনি পরস্পরকে চেনা জানা ও বোঝারও সুযোগ হয়নি। ওর পরীক্ষার জন্য বাাবার বাড়িতেই ছিল। গত দেড়’মাস আমাদের একসাথে কেটেছে। এরমধ্যে একমাস রমজান মাস গেল। তাও এর মধ্যে এক্সিডেন্ট তারপর আমার বিদেশে যাওয়া।
হীবা অজু করে এসে নামাজে বসেছে। একটা প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাহ আর কোন দুরত্ব নয়। হঠাৎ করে ওমন অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিয়েটা হয়েছিল বলে আমি নিজেও সংকোচে ছিলাম। তাই হীবাকেও বিব্রত করতে চাইনি। সহজ হওয়ার জন্য সময় দিয়েছিলাম। এখন নিশ্চয়ই ওর আপত্তি থাকার কথা নয় আমাদের সম্পর্কটাকে সামনে এগিয়ে নেয়ায়। ওর সাথে কথা বলতে হবে। এক্সিডেন্টের পর থেকে ওর ব্যাবহারও কেমন যেন অদ্ভুত খাপছাড়া। আমার সাথে বলতে গেলে প্রয়োজন ব্যাতিত তেমন কথাই বলেনা। কি হয়েছে ওর জানিনা। কেন আমার সাথে এমন ঠান্ডা আচরণ করছে আমাকে জানতে হবে। সেই যে এক্সিডেন্টের সময় ফোন ভাঙার পরে সে ফোনও কিনেনি। তাই এইবযে এতগুলো দিন হীবার সাথে ভালো করে কথাই হয়নি। ওর বাবা মায়ের ফোনে কল দিয়ে আর কত কথা বলা যায়? ওর জন্য একটা সেলফোন এনেছি। সারাদিনের ব্যাস্ততায় হীবাকে দেয়া হয়নি। আজ মনে করে দিতে হবে। হীবা নামাজ আদায় শেষ করে জায়নামাজ ভাজ করে রেখে দিয়ে কামরার বাইরে চলে গেল। আমি এবার উঠে বসলাম। আমি হলাম ফাঁকিবাজ নামাজি। এক ওয়াক্ত পড়লে আরেক ওয়াক্তে ভুলে যাই। এই সময় হীবা উঠে দেখে মাঝে মধ্যে ঘুম ভেঙে গেলে উঠে নামাজ পরা হয়। আজ উঠেছি যখন নামাজ আদায় করে নেই। ঝটপট উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নিলাম। রুমে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে বসলাম।
নামাজ শেষে জায়নামাজ তুলে রেখে রুম সংলগ্ন বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সারারাতই বলতে গেলে বৃষ্টি হয়েছে বারান্দা বৃষ্টির পানিতে ভিজে আছে। এখন অবশ্য বৃষ্টি নাই। বাড়ির আশপাশে ঢাকা শহরের মতো খুব বেশি লাগোয়া বিল্ডিং নেই। এই বাড়ির আশপাশে অনেকটাই খোলা জায়গায় প্রচুর গাছপালা। সামনে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলাম। এখনো আঁধার কাটে নাই কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোর হবে। আকাশের দিকে চেয়ে দেখলাম সূর্য উঠবে বলে মনে হয় না। কিছুক্ষণ পর মনে হয় আবারো বৃষ্টি হবে। আকাশে এখনও কালো মেঘেদের আনাগোনা। গাছগুলো থেকে এখনো টুপটাপ বৃষ্টির পানি ঝরে পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। বৃষ্টিভেজা ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটায় শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। রাতের আঁধারকে কেটে গিয়ে আবছা আলো ফুটতে শুরু করেছে। এই প্রকৃতির অদ্ভুত খেলা। কিন্তু ঘন কৃষ্ণ মেঘের কারণে সূর্যের দেখা মিলবে বলে মনে হচ্ছে না। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে রুমের ভিতর দিয়ে কামরার গিয়ে আব আরেক পাশের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। হীবাদের বাড়িটা বেশ বড় তবে একটু পুরনো ধাঁচে তৈরি। বাড়ির সামনের দিকে পুরোটা জুরে লম্বা টানা বারান্দা। বাড়ির চারিদিকে বাউন্ডারির দেওয়া। সামনে অনেকটা খোলা জায়গায় ফুল ও ফলের নানা রকম গাছগাছালিতে ছাওয়া। বাড়ির আশপাশে প্রতিটা বাড়ির বেশিরভাগেই একইরকম। এর মধ্যে কিছু বাড়ি হয়ত চার-পাঁচতলা বহুতল ভবন। ঢাকা শহরের পাড়ার রাস্তা গুলো রিক্সা গাড়ির শব্দে সব সময় সরগরম থাকে। কিন্তু এখানে রাস্তাঘাট প্রায় খালি বলা যায়। তাই চারিদিকে নিরিবিলি পরিবেশ। এখন ভোর বেলা চারিদিকে কোনো মানুষের আনাগোনা নেই একদম নিরব নিস্তব্ধ। এমন পরিবেশে মনটা ভালো হয়ে যায়। কিন্তু আমার মনটা বিচলিত হয়ে আছে হীবার ঐরকম নিশ্চুপ হয়ে থাকার কারণে। বারান্দার রেলিংয়ে হাতদুটোর ভর দিয়ে হেলান দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে একটা চায়ের মগ এগিয়ে ধরে হীবা বলে উঠলো,
” এত ভোরে উঠে পড়লেন যে, রাতে ঘুম হয়নি ভালো? ”
আমি হাত বাড়িয়ে মগটা ধরলাম। স্মিত হেসে বললাম, ” ঘুম ভেঙে গেল তাই উঠে পরলাম। তবে অনেকদিন পরে আজ ঘুম ভালোই হয়েছে। ”
বাইরের দিকে আবারও একই ভাবে চেয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। হীবা ট্রেটা দেয়াল ঘেঁষে রাখা টেবিলের উপর রেখে বিস্কিটের প্লেটটা হাতে তুলে নিয়ে আমার সামনে ধরল। আমি দুটো বিস্কিট তুলে নিলাম। হীবাও একটা বিস্কিট নিয়ে প্লেটটা টেবিলে রেখে নিজের মগটা হাতে নিয়ে আমার মত একইভাবে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“সারা রাত বৃষ্টি ঝরায় বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ছিল। নইলে গরমে কাহিল অবস্থা হতো। শোনেননি রাজশাহী শহরে গায়ে ফোস্কা পরা গরম পরে। আপনার ভাগ্য সত্যিই সুপ্রসন্ন বলতে হবে। কাল আপনি এলেন আর কতদিন পরে বৃষ্টিও এলো। যেন আপনাকে স্বাগত জানানোই তার উদ্দেশ্য। ”
কথা শেষে হীবার চোখে মুখে মিষ্টি হাসি ঝিলিক দিয়ে গেল। আমি মুগ্ধ চোখে চেয়ে দেখলাম। ওর কথায় আমিও হেসে উঠে বললাম, ” তাই বুঝি? তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতেই পারো সেটা হতে পারে অন্য ক্ষেত্রেও। ”
আমি মিটিমিটি দুষ্টুমি হাসি মুখে হীবার দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। ও কি বুঝল কে জানে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। আমি চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললাম,
” তোমাদের বাড়িটা বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে তাইনা?”
” হুম। ” সংক্ষিপ্ত জবাব হীবার।
আমি গাছগাছালির দিকে তাকিয়ে শুধালাম, ” আচ্ছা? তোমাদের এই এতো বড় জায়গা এভাবে ফেলে রেখেছো কেন? ”
হীবার ভ্রুকুঞ্চন বৃদ্ধি পেল। কেমন অবাক হয়ে বললো,
” কোথায় জায়গা ফেলে রাখা হয়েছে? ”
আমি হাত নাড়িয়ে চারপাশে দেখিয়ে বললাম, ” এইযে এতো জায়গা খালি পরে আছে। এখানে কত বড় বিল্ডিং হতে পারে ভাবতে পারো?”
হীবা হেসে উঠে বললো, ” আপনি না সত্যি! এখানেও আপনার ইন্জিনিয়ারের নজরে আর বিজনেসম্যানের দৃষ্টিভঙিতে দেখতে শুরু করেছেন? আপনারা ডেভেলপাররা যেখানে জমি দেখবেন ওমনি মাথায় বিজনেস প্লানিং শুরু হয়ে যায় তাইনা? ”
” ভাবতে কি দোষ আছে? এখনকার এই যুগে এতো বড় জায়গা কেউ ফেলে রাখে। তুমিই বল? ”
” এই বাড়িটা আমার দাদা বানিয়েছিলেন সেই আমলেই। তাই সেই সময় অনুযায়ী ডিজাইন করাটাই স্বাভাবিক তাইনা? দাদীর খুব শখ ছিল চারিদিকে প্রচুর গাছগাছালির ছায়ায় মাঝখানে বাড়িটা হবে। দাদা দাদীর সেই শখ পুরোন করেছিলেন। আপনি কিন্তু দাদীর সামনে ভুলেও এসব বলতে যাবেননা।”
” এই আগের যুগের মানুষগুলো ভিষণ ইমোশনাল হয়। কেন যে এমন আঁকড়ে ধরে রাখা স্বভাব থাকত উনাদের? অথচ কেউ এই দুনিয়ায় চিরকাল এসব আঁকড়ে পরে থাকতে পারেনা। আমার দাদা বাবাকেই দেখনা, কেমন সবকিছুই পরে আছে কিন্তু উনারা সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাই আমার মনে হয় এসব জাস্ট ইমোশনাল ফুল ছাড়া কিছু নয়।”
কথা শেষে আমি একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা হীবার দিকে বাড়িয়ে দিতে ও সেটা নিয়ে টেবিলে রাখা ট্রেতে রেখে দিয়ে আমার দিকে ফিরে বললো,
” তবুও আবেগ ছিল ভালোবাসা ছিল। দাদা দাদীকে ভালোবেসে তাকে তার পছন্দ মত বাড়ি উপহার দিয়েছেন। দেখেননি বাড়ির নামটাও তো আমার দাদীর নামে ‘নাহার ভীলা’। আমার দাদীর নাম শামসুন্নাহার। এইযে ইমোশনাল ফুল বলে আপনি মানুষের মনের আনন্দ আকাঙ্খা পূরণে যে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যায় সেটাকেই হেয়ো করছেন। অথচ মানুষের জীবনের সুখী হওয়ার জন্য একে অপরের প্রতি এই ইমোশনটাই কিন্তু প্রাণস্পন্দন। অর্থ সম্পদ প্রয়োজন আছে কিন্তু সংসারে পরস্পরের প্রতি যদি আবেগ ভালোবাসাই না থাকে তাহলে মানুষ সুখীও হতে পারেনা স্বস্তি কিংবা শান্তিও পেতে পারেনা। যেখানে ভালোবেসে মানুষ ভালোবাসার মানুষের জন্য কত কি করছে সেখানে এটাতো সামান্য একটা বাড়ি। আজ দাদা বেঁচে নেই। কিন্তু দাদী দাদার দেয়া স্মৃতি বিজড়িত উপহার স্বরূপ এই বাড়িতে তাকে অনুভব করেই বেঁচে আছে।”
আমি মুগ্ধ হয়ে হীবার কথাগুলো শুনছিলাম। ও কতটা আবেগ নিয়ে সম্পর্ক গুলোকে মুল্যায়ন করে এটা আজ বুঝতে পারছি। আমার খুব ভালো লাগছে ওর এমন মনোভাব জেনে। আমি বললাম, ” তোমার কথা শুনে সত্যি আমার খুব ভালো লাগছে। আমি আসলে এতো গভীর ভাবে ভেবে দেখিনি। ”
হীবা একটু হাসলো। ওর হাতের মগটা ট্রেতে রেখে ট্রেটা তুলে নিয়ে বললো, ” আপনি চাইলে ছাদে যেতে পারেন। ভোরবেলায় ছাদে হাটাহাটি করে ভালো লাগবে। ”
” যাওয়া যায়। যদি তুমিও যাও। ”
” আপনি এগোন আমি এগুলো রেখে আসছি।”
হাতে ধরা ট্রের দিকে ইশারা করে বলল হীবা। ও ভীতরে চলে গেলে আমি ছাদে যাওয়ার সিড়ির দিকে এগোলাম। ছাদে এসে দাঁড়াতে ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়ায় বেশ ভালো লাগছে। ভোরের আলো ফুটেছে। তবে মেঘের আড়ালে সূর্য ঢেকে থাকায় কেমন ম্লান ফ্যাকাশে আলোয় ছেয়ে আছে চারিদিকে। হাটতে হাঁটতে ছাদের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে চারিদিকে চোখ বোলালাম। সম্পূর্ণ ছাদ জুড়ে সারি সারি টবে নানা রকমের ফুল ও পাতাবাহারের গাছ লাগানো। বৃষ্টির পানিতে ভিজে থাকায় গাছের পাতাগুলো গাঢ় সবুজ ও চকচকে দেখাচ্ছে। বৃষ্টি থামার পরের এই মুহুর্তটা ভিষণ স্বর্গীয় আবেশ ছড়িয়ে দেয় প্রকৃতিতে। সবকিছুকে কেমন ধুয়ে মুছে স্বচ্ছ সজীব ও পবিত্র করে তোলে।
ছাদের মেঝেতে জায়গায় জায়গায় বৃষ্টির পানি জমে আছে। সাবধানে হাঁটতে হাঁটতে ছাদের এক কিনারে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাড়ির চারপাশে প্রচুর গাছ। কি গাছ নাই বলা মুশকিল। রাধাচূড়া, রেইনট্রি আছে গেটের কাছাকাছি একটা কামিনী। দেয়াল ঘেঁষে বিশাল বড় একটা ছাতিম গাছও আছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে ছাতার মতো ছায়া দিচ্ছে যেন।
আমি উদাস দৃষ্টিতে দুরে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে পিছনে ফিরতেই দেখলাম হীবা দাঁড়িয়ে আছে কিছুটা দুরেই। দৃষ্টি আমার মতোই দুর সীমানায়।
” কখন এলে? ”
“যখন আপনি দুর সীমানায় উদাসীন হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। ”
” ডাকলেনা কেন? ”
হীবা কিছু বলল না শুধু একটু হাসলো। ওর হাসিটা এত মিষ্টি। মন চায় কেবল তাকিয়েই থাকি। ও হাসলে একটা গজদন্ত বেরিয়ে ওর সৌন্দর্যকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। উজ্জ্বল শ্যামলা ত্বকে কাটাকাটা খাারা নাক ঘন কালো পাপড়ি যুক্ত টানাটানা চোখ। কি অসীম মায়া খেলা করে ওর সেই চোখ দুটির গভীরে। যখন ও ঠোঁট নেড়ে কথা বলে তখন আমি কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো সম্মোহিত হয়ে পরি। কিছুক্ষণ নিরবতার পর হীবা আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,
” আপনি আগে কখনো রাজশাহীতে আসেননি না?”
আমি হীবার দিকেই এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ওর কথায় অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কিন্তু তা সামলে নিয়ে মাথা নেড়ে বললাম,
” নাহ কখনো সুযোগ হয়নি আসার। এখানে বোধহয় এখনো ডেভলপাররা কাজ করেনা। তাইনা?”
” ইদানিং কাজ শুরু হয়েছে। তবে ঢাকার তুলনায় অনেক কম বলা যায়। প্রায় চোখেই পড়ে না।”
আমি ছাদের চারিদিকে গাছগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললাম, ” তোমাদের ছাদটা কিন্তু খুব সুন্দর। এতো রকমের গাছ। এগুলোর যত্ন নেয় কে? ”
হীবাও একবার গাছগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে জবাবে বলল, ” দাদি এবং আম্মার শখ। দাদির বয়স হয়েছে তাই আগের মত যত্ন নিতে পারেনা। এখন আম্মাই দেখে। তবে ভাইয়াও সময় দেয়। বিশেষ করে গাছ কিনে আনা থেকে লাগানো ভাইয়াই করে। ”
হঠাৎ করেই বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। যেনতেন বৃষ্টি নয় একদম ঝমঝমিয়ে। সাথে সাথেই আমাদের ভিজিয়ে দিল। আমি দৌড়ে ছাদের দরজার দিকে চলে এলাম সেখানে গিয়ে পিছন ফিরে দেখলাম হীবা ওর জায়গায় স্থীর দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওকে বললাম,
” কি হলো, এই ভোরবেলায় বৃষ্টিতে ভিজছ যে, ঠান্ডা লেগে যাবে তো। ”
কিন্তু হীবা আমার কথা কানেই তুললো না। সে ওখানে দাঁড়িয়ে দুদিকে হাত ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা উপভোগ করতে লাগলো। আমি ওর দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। বৃষ্টির পানী ওকে সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিয়েছে শরীরের সাথে জামাটা সেঁটে গেছে ইতিমধ্যে। যদিও ও সুন্দর করে ওড়না দিয়ে তার মাথা ঢেকে রেখেছে সেটাও ওর গায়ে জামার ওপর জড়িয়ে গেছে। বৃষ্টির পানি ওর চোখ মুখ ছুয়ে দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে। আমার হঠাৎ বৃষ্টির পানিকে খুব হিংসা হলো। আমার বউকে আমিই এখনো ছুয়ে দেখলাম না সেখানে বৃষ্টির কি সৌভাগ্য ওকে ছুঁয়ে দিতে পারছে৷ আমি সম্মোহিত পায়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। হীবা এতটাই মগ্ন আমি ওর সন্নিকটে দাঁড়িয়ে তা ও টেরই পেলনা। আমার কি হল জানিনা হঠাৎই আমি দুহাত বাড়িয়ে হিবাকে কাছে টেনে নিলাম। হীবা চমকে উঠলো। দুচোখ মেলে তাকালো। দু’হাতে ওর মুখটা আঁজলা করে ধরে আমি ওর আরও কাছে এগিয়ে গেলাম। হীবা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা প্রগাঢ় চুম্বনে ওর ঠোঁট জোড়া আবদ্ধ করে নিলাম। আচমকা আমার এমন আচরণে হীবা প্রথমে কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কয়েক মুহূর্ত স্থির থেকে পরে বুঝতে পেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলো। কিন্তু আমি এক হাতে ওর পিঠের ওপর দিয়ে ওকে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলাম। ও আর বাঁধ সাধেনি বরং সাড়া দিল। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই হঠাৎ হীবা আমাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ওর হঠাৎ এমন আচরনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে। হীবা কেমন টলমলে পায়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আমি এগিয়ে গিয়ে ওকে ধরলাম। কিন্তু ও নিজেকে সামলে নিয়ে আমার থেকে ছাড়িয়ে নিল।
” এসব কি? কেন করছেন এমন? দূরে থাকুন আমার থেকে।”
আমি আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, ” বউ হও তুমি আমার। তোমার কাছে যাওয়ার অধিকার আছে। তুমি দুরে কেন যেতে বলছ আমায়? ”
চলবে ইনশাআল্লাহ।