তোমায় ছেড়ে যাবো কোথায় পর্ব-২৪

0
874

#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখা :- মুনিরা সুলতানা।
পর্ব :- ২৪ ।

—————–*
জীবনটা আমার কাছে কেমন যেন গোলকধাঁধার মত হয়ে গেছে। যেদিকেই পা বাড়াই না কেন কেবলমাত্র দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আর কনফিউশন। কোন কিছুই আমার কাছে পরিষ্কার নয়, বোধগম্য নয়। আসলে কি হয়েছে আমার সাথে সেটাই বুঝতে পারছি না। এই যে কামরানকে যখন আমি মনেপ্রাণে চাইতে শুরু করলাম তখন তাকে যতই চেনার চেষ্টা করতাম জানার চেষ্টা করতাম কাছে চাওয়ার চেষ্টা করতাম ততই সে ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যেত। যেন সে এক মরীচিকা। আমার যখন মনে হলো সে আসলে আমায় নয় বরং পিউলির, আমি নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইলাম। তখন সে আবার আমার পিছু পিছু ঘুরছে। এত যত্ন এত কেয়ার করছে সবকিছু কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছে আমার কাছে। কেবলই মনে হচ্ছে যেন আমি কোন একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখছি ঘুম ভাঙলেই সবটা ভেঙে যাবে। কামরানের আচরণ আমার কাছে এতোটাই রহস্যময় আমি পজেটিভ নেগেটিভ কোন ভাবনাই মাথায় আনতে পারছিনা। সব কিছুই এত কনফিউশনের যে আমার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। কেন করছে সে এরকম? পরিষ্কার করে তো কিছু বলছেও না শুধু আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। বিয়ের এতগুলো মাস পর আমার স্বামীর কাছ থেকে আজ প্রথম চুম্বন পেলাম। অথচ আমি এটাই বুঝতে পারছিনা এতে আমি খুশি হব না দুঃখ পাবো। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে একটুখানি যত্ন, একটু আদর, একটুখানি স্পর্শ পাওয়ার পরে তাকে এড়িয়ে যাওয়া এতো সহজ নয়। অথচ আমার কি দুর্ভাগ্য আমি না নিতে পারছি না ফেলতে পারছি। একটা প্রলম্বিত শ্বাস বেরিয়ে এল আমার বুক চিড়ে। নাহ্, ভাইয়ার বিয়েটা হয়ে গেলে কামরানের সাথে কথা বলতে হবে খোলামেলা ভাবে। এভাবে চলতে পারে না যেকোনো একটা সমাধান তো করতেই হবে।

কিছুক্ষণ বাদেই তিয়ানা ও আরমানও রেডি হয়ে এলো। তিয়ানাও আজ হলদে রঙের শাড়ি পরেছে। আমার পাশে এসে দাঁড়াতেই আমি বললাম,

” বাহ্ শাড়িতে তো তোমাকে দারুণ লাগছে। ”

তিয়ানার গাল দুটোয় একটু লাজুক লালিমা ছুয়ে গেল। তাতে যেন ওর সৌন্দর্য আরো ঠিকরে পরছে। সেও বললো,

” আর নিজেকে দেখেছ কেমন স্নিগ্ধ লাগছে। আমি হলপ করে বলতে পারি ভাইয়া আজকের তোমার থেকে চোখ ফেরাতেই পারবে না। ”

আমি লাজুক ভঙ্গিতে হাসলাম। কিছু একটা বলতে যাব তখনই কামরানকে এদিকে আসতে দেখে চুপ করে গেলাম।
কামরান একটা ঘিয়ে রঙের হালকা কাজ করা পাঞ্জাবি পরেছে। কি চমৎকার লাগছে মানুষটাকে। এই মানুষটার মধ্যে একটা অন্যরকম ব্যক্তিত্ব আছে। যা স্বচ্ছ আলোর স্ফুরণ আকারে প্রস্ফুটিত হয়। ও যখন এই রুমে এলো তখন এই রুমের অধিকাংশ চোখগুলো ওর ওপর হামলে পড়ল যেন। আর আমি তো তার মায়ায়, তার ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে, কিংবা ভালোবাসার জ্বালে কবেই আটকা পড়েছি। কামরান রুমের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে আমাকে খুঁজে পেতেই আমার দিকে যখন দৃষ্টি স্থাপন করল আমাদের অপ্রত্যাশিত ভাবে চোখাচোখি হয়ে গেল। আমি তখনও নির্লজ্জের মত কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ড্যাব ড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কামরানের ঠোঁটে একটা দুর্বোধ্য হাসি ফুটে উঠল। দুই ভ্রু উচিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইল সে। এবার আমার ঘোর কেটে গেল। আমি অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বিচলিত দৃষ্টি সরিয়ে এদিক সেদিক অস্থির ভাবে তাকাতে লাগলাম। কিছু মূহুর্ত বাদে আবারো আড়চোখে কামরানের দিকে চাইলাম। সে এখনও একইভাবে আমার দিকেই চেয়ে আছে। এবার আমি লজ্জায় দৃষ্টি নত করে ফেললাম। আর ভুলেও সেদিকে তাকানো যাবেনা। কিন্তু অবাধ্য বেহায়া দৃষ্টি কি আর মানে। কিছুক্ষণ যেতে যেতেই না চাইতেও বেহায়ার মত আড়চোখে তার দিকে চাইতে লাগলাম আর আমাদের কতবার যে চোখাচোখি হলো তার হিসেব নেই। কেননা তার দৃষ্টি বান আমার উপরই সারাটাক্ষন সেঁটে ছিল।

সম্পূর্ণ ঘরোয়া ভাবেই আমাদের বাড়ির উঠোনে সুন্দর ভাবে ভাইয়ার হলুদ ছোয়ানো হলো। একে একে সবাই ভাইয়াকে হলুদ ছুইয়ে দিল। এই বাড়িতে হলুদ অনুষ্ঠান শেষ হতেই বিকেল বেলায় মেয়ের বাড়িতে হলুদ পাঠানো হলো। আমার খুব ইচ্ছে ছিল ওই দলের সাথে আমিও যাব। কিন্তু দুর্ভাগ্য মাত্র একটা দুর্ঘটনা থেকে উঠলাম বলে আমাকে যেতে দেয়া হলো না। কি আর করা মেনে নিতে হলো। বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজনে গিজগিজ করছে। কোথায় একটু স্থির হয়ে বসার জায়গা নেই। কাল বিয়ে তাই কতো কাজ। বাড়ির প্রত্যেকেরই ব্যস্ততা সীমাহীন। তাছাড়া এত মানুষের তিন বেলার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা, এতেই বাড়ির মহিলাদের চরম ব্যস্ততা। তাই আমারও বসে থাকার জো নেই। যতটুকু পারছি সহায়তা করতে চেষ্টা করছি।
রাতে বেশ অনেক রাত পর্যন্ত কামরানরা তিন ভাই বোন আমার কাজিন মহলের সাথে বেশ জমিয়ে আড্ডায় মেতে উঠেছে। আমি কিছুক্ষণের জন্য বসে ছিলাম ওদের সাথে। কিন্তু খুব ক্লান্ত লাগছিল বলে একটু পরেই উঠে গেলাম আমার রুমে গিয়ে শাড়ি পাল্টে ঢিলাঢালা দেখে একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে নিলাম। আগেই নামাজ আদায় করে নিয়েছিলাম। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে সেলফোন হাতে নিয়ে বিছানার হেডস্ট্যান্ডে হেলান দিয়ে বসলাম। ভিষণ ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু কামরান রুমে না আসা পর্যন্ত ঘুমাতেও পারছি না। কতদিন পরে দেখা। তাও আমাদের বাসায় প্রথম এসেছে। তাই ওকে রেখে আগেভাগে ঘুমিয়ে পরাটা নিশ্চয়ই শোভনীয় দেখায়না। একটা লম্বা হাই তুলে সেলফোনে মনযোগ দিলাম। তবে বেশি দেরী করতে হলো না কিছু সময় বাদেই কামরান চলে এলো।

” কি খুব ক্লান্ত? তাহলে বসে আছো কেন? ঘুমিয়ে পড়তে। ”

” তা একটু ক্লান্ত। এই তো ঘুমাবো। আপনি জার্নি করে এসেছেন। সারাদিনের এত ধকল গেল। আপনিও শুয়ে পড়ুন। কাল আবারও সারাদিন প্রচুর ব্যাস্ততা যাবে। ”

কামরান ওর লাগেজ ব্যাগ খুলতে খুলতে বললো,” এইতো ঘুমাতেই এলাম। ওরা যে আড্ডায় মেতে গেছে। ছাড়তেই চায় না। ঘুম পাচ্ছে বলে উঠে এলাম। ”

” ওরা ঘুমাতে যায়নি? এখনও আড্ডা দিচ্ছে? ”

কাপড় বের করতে করতে কামরান আমার দিকে এক পলক তাকালো। আবার কাজে মনোযোগ দিয়ে বলল, ” নাহ্ সবকটা এখনো ওখানেই বসে আছে আল্লাই জানে ওরা কত রাতে ঘুমাবে? আরমান ও তিয়ানাও ওদের সাথে বেশ মিলে মিশে গেছে। কারো চোখে ঘুমের বালাই নেই।”

আমি একটু হেসে বললাম, ” আপনার ভাই বোনেরা কিন্তু বেশ মিশুক। ”

কামরান ব্যাগের চেইন বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। বলল,” হ্যাঁ তা আর বলতে। যদিও আরমান একটু চুপচাপ থাকে। তবে আড্ডার বেলায় সবাই একই এই বয়সে। ”

কামরান একটা আড়ংয়ের ব্যাগ হাতে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। ব্যাগটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

” এটা ঈদ উপলক্ষে তোমার জন্য কিনেছিলাম। তুমিতো এটা ছাড়াই ঈদ করলে। তবে কাল কিন্তু এটাই পরতে হবে। ”

আমি কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নিলাম। ব্যাগের ভেতর শাড়িটা দেখে আমি একটু অবাক হলাম। এটা সেই শাড়িটা। যখন আমাকে পছন্দ করতে বলেছিল তখন ভাবি নি এটা আমার জন্যই নিচ্ছিল। শাড়িটা সত্যিই খুব সুন্দর। আমার মনটা নিমিষেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। কামরান আমার দিকেই চেয়ে আছে এতক্ষণ। সে দিকে তাকিয়ে বললাম,

” এটা আমার জন্য ছিল? থ্যাঙ্ক ইউ। ”

কামরান মুচকি হেসে বলল, ” কার জন্য আবার? এত সুন্দর শাড়িটা আমার বউ ছাড়া আর কার জন্য নিব? বিয়ের পর আমাদের প্রথম ঈদ ছিল। কিন্তু তোমার অ্যাক্সি*ডেন্টের কারণে একটু উলটপালট হয়ে গেল। সে যাক নো প্রবলেম কাল বিয়েতে এই শাড়িটাই পরছ। এটাই ফাইনাল। ”

ওর এভাবে ‘আমার বউ’ বলা শুনে আমার এতো ভালো লাগলো আবেগে আমার চোখ দুটো ভিজে উঠলো। একটার পর একটা চমক দিয়ে যাচ্ছে লোকটা। নিজেকে সামলে নিয়ে আমি হাসিমুখে সায় জানিয়ে বললাম,

” আপনার যেমন ইচ্ছে, কাল এটাই পরব। খুশি?”

কামরান প্রতিত্তোরে হাসল শুধু। শাড়িটা উল্টে পাল্টে দেখতে গিয়ে ভাঁজের ভিতরে ব্লাউজ পেটিকোট দেখে অবাক হলাম। শুধালাম,

” এটাতো শাড়িরই ব্লাউজ কখন সেলাই করালেন?”

” দেশে আসার পর দেখলাম শাড়িটা কাবাডে ওভাবেই পরে আছে। তুমি নিয়ে আসোনি। তখন খেয়াল হল এটা যে তোমার জন্য তোমাকে সেটা বলারি সুযোগ হয়নি। তখন তিয়ানাকে দায়িত্ব দিলাম। ওই তোমার একটা ব্লাউজ নিয়ে ওর চেনা টেইলর থেকে এমারজেন্সি বলে বানিয়ে এনেছে। আর পেটকোটটা রেডিমেড কিনেছে। ”

তখনই রুমের দরজায় করাঘাত হতে দুজনেই সচকিত হয়ে দরজার দিকে তাকালাম। আমি শাড়িটি বিছানার উপর রেখে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে ওপাশে। হাতে এয়ারকুলার। ইতস্তত ভঙ্গিতে সে বললো,

” সরি এতো রাতে তোদের ডিস্টার্ব করলাম। আসলে এতো গরম পরেছে। ঢাকায় তো তোর জামাইয়ে এসিতে থাকার অভ্যাস তাইনা? কিন্তু এখানে তো এসি নেই। তাই এটা দিয়েই কাজ চালাতে হবে। ” এয়ারকুলারটা দেখিয়ে বললো সে।

” আরে কেন শুধু শুধু কষ্ট করছেন? আমার কোন প্রবলেম হচ্ছে না। আমি ঠিক ম্যানেজ করে নিব।” আমার পিছনে থেকে কামরান বলে উঠলো,

কামরান পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কখন টেরই পাইনি। আমি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম। ভাইয়া ভিতরে এসে এয়ার কুলারটা জায়গামত সেট করতে করতে বললো,

” আপনি হলেন নতুন জামাই। এই প্রথম এলেন। আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করবো আপনার সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রাখার। এটুকু আমাদের কর্তব্য। ”

কামরান বললো, ” সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু ব্যাপারটা আমার জন্য অস্বস্তিকর আপনাদের এত দুশ্চিন্তায় পরতে হলে এরপর কিন্তু এখানে আসার আগে আমাকে অবশ্যই ভাবতে হবে। ”

ভাইয়া সাথে সাথে প্রতিত্তোরে বললো, ” শোনেন আপনি হলেন আমাদের বাড়ির জামাই। এসব কথা বললে তো চলবেনা। একটু তো খাতির যত্ন সহ্য করতে হবে। যদিও এটা সহ্য করার নাকি উপভোগ করার ব্যাপার জানিনা। তবুও জামাই আদর বলে একটা কথা আছে। মানতে তো হবেই।”

কামরান আমার দিকে অসহায় চোখে চাইল। আমি কাঁধ ঝাকিয়ে চোখের ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম আমার কিছু করার নেই। ও একটা প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলল,

” ওকে, যথা আজ্ঞা কি আর করা। ” বলে হেসে উঠল সে।

ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল, ” এইতো এবার ঠিক আছে। বিয়ের চার মাস পর এই প্রথম আমাদের বাড়ি এলেন। এটুকু তো করতেই হবে। ঠিক আছে অনেক রাত হয়েছে। আজ সারা দিন জার্নি করে অনেক ধকলও গেছে। আবার কাল সারাদিনও প্রচুর ধকল যাবে। এখন ঘুমিয়ে পড়েন। আমি গেলাম গুড নাইট। ”

ভাইয়া বেরিয়ে যেতেই কামরান বলে উঠলো, “তোমার ভাইয়া দেখি একটা চিজ। ”

আমি ওর কথা বুঝতে না পেরে থতমত খেয়ে বললাম,
” মানে? ”

কামরান চট করে উত্তর দিল,” কিছুনা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। ” বলেই সে দ্রুত গতিতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

আমি এক মুহূর্ত নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর মাথা নাড়িয়ে গেলাম বিছানা ঠিক করতে। হঠাৎ করে ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করল। বেলকনির দরজাটা খোলা থাকায় পর্দাটা প্রায় ঘরের মাঝ বরাবর মাথার ওপর উঠতে শুরু করেছে। মুহূর্তের মধ্যে এক ঝাপটা ঠান্ডা বাতাস হুহু করে ঘরের ভেতর ঢুকে পরল। বৃষ্টি ভেজা বাতাস। যাক সারাদিনের ভ্যাপসা গরমের পরে বৃষ্টি আসছে। আমি দৌড়ে জানালা বন্ধ করলাম। তারপর বারান্দায় চলে এলাম। এখন বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। আহ্ কি শান্তি। একেই বলে আল্লাহ তায়ালার লীলাখেলা। তিনি চাইলে মুহূর্তের মাঝেই সব করে ফেলতে পারেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। বৃষ্টির ছাঁট বেলকনির দিকে তীক্ষ্ণ বেগে আসছে। চোখেমুখে বৃষ্টির ছাঁট লেগে আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমি চোখ দুটো বুজে ফেললাম। ঠান্ডা বতাসে শরীর মন জুড়িয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি দুহাতে মাখিয়ে নিচ্ছি।

” এতো রাতে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজছ কেন। ঠান্ডা লেগে যাবেতো। ”

কামরান কখন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি। ওর কথা শুনে হাত ভিতরে সরিয়ে নিলাম। পিছনে ফিরে দেখি ও দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তোয়ালে। গোসল করে ওকে কি স্নিগ্ধ সতেজ লাগছে। রাতের ঘুমাবার পোশাক সুতি কালো সাদা চেক ট্রাউজার ও পাতলা সাদা টিশার্ট পরেছে। আমি এগিয়ে গিয়ে ওর হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে তারে টাঙিয়ে ক্লিপ আটকে দিলাম। ভিতরে যেতে যেতে বললাম,

” কি সুন্দর ঠান্ডা বাতাস বইছে দেখেন। তাই একটু বাতাস খাচ্ছিলাম। সারাদিন যে ভ্যাপসা গরমটা গেল। ”

কামরান আমার দিকে তাকিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললো, ” বাতাস খেতে গিয়ে তো কাকভেজা হয়ে এসেছো। ভেজা কাপড়ে এখন ঠান্ডা লেগে যাবে। যাও ভেজা কাপড় পাল্টে নাও।”

আমি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে ভেংচি কেটে মনে মনে বললাম, ‘ একদম আনরোমান্টিক একটা মানুষ বউকে এভাবে আধভেজা অবস্থায় দেখেও তার মধ্যে কোন রোমান্টিকতার ছোঁয়া নেই। বেরসিক লোক একটা।’ ওর দিকে ফিরে বললাম, ” হ্যাঁ যাচ্ছি। এইটুকু সামান্য ভিজে কারও ঠান্ডা লাগে না। আমারতো আরও লাগেনা। ”

” তাই বুঝি? তাহলে এই ভেজা কাপড়েই থাকো। দেখতে মন্দ লাগছে না। বেশ হট লাগছে। দুষ্টুমি হাসি হাসতে হাসতে বললো সে। ”

আমি ভ্রুকুটি করে তাকালাম কামরানের দিকে। ও এরকম অসভ্য কথা বলতে পারে স্বপ্নেও ভাবিনি। ও আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে বলতে লাগলো,

” আমাকে পাগল করতে যদি চাও তো বেশ। ভুলভাল কিছু করে বসলে তখন আমাকে কিন্তু দোষ দিতে পারবে না। আমাদের সম্পর্কটা আরেক ধাপ এগোতে অবশ্যই তোমারও পূর্ণ সহায়তা চাই। এতদিন যখন ওয়েট করতে পেরেছি আজ আমি নিজের ওপর কন্ট্রোল হারিয়ে ভুলভাল কিছু করতে চাইনা। আমি তোমার হৃদয় ও মন সহ সম্পূর্ণ তোমাকেই চাই। আর তাই তো তোমার এগিয়ে আসার অপেক্ষায় আছি। ”

আমি হতবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে কামরানের মুখের দিকে চেয়ে ওর কথা শুনছি। ওর চোখেমুখে এক অদ্ভুদ দ্যুতিময় জ্যোতি ছেয়ে আছে। গম্ভীর অথচ কি একখানা মন্ত্রমুগ্ধময় স্বর্গীয় হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে আছে ওর সুন্দর কান্তিময় মুখখানা জুড়ে। সে পলকহীনভাবে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। আমার সর্বাঙ্গে কেমন কাটা দিয়ে উঠলো। এমন হৃদয় ফুঁড়ে দেওয়া কথামালা গেঁথে গেল আমার বুকের গোপন গহীন অলিন্দে। কারও কথার দ্বারা কারও শরীর মন এমন প্রভাবিত হতে পারে আমার কাছে অজানা ছিল। আমার সমস্ত শরীর অসার হয়ে আছে। হাত পা মৃদুভাবে কাঁপছে। ওর দৃষ্টি বাণে আমি যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছি। অনেক কষ্টে শুকনো ঢোক গিলে দৃষ্টি অন্য দিকে ফিরিয়ে নিলাম। নিজেকে কোনরকমে টেনে নিয়ে গেলাম ওয়ার্ডরোবের কাছে। একটা জামা বের করে দ্রুত পায়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লাম। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলাম। জামার দিকে চেয়ে দেখি সত্যিই প্রায় ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। কি লজ্জা! কি লজ্জা! এইভাবে ওর সামনে ছিলাম এতক্ষণ?
চোখে মুখে পানি ঝাপটা দিলাম। কাপড় পাল্টে শুকনো জামা পরে নিয়ে ভেজা জামাটা ধুয়ে ফেললাম। নইলে বৃষ্টির পানিতে ভেজা কাপড় এভাবে রেখে দিলে তিলে পরে যেতে পারে। দরজার কাছে গিয়ে দরজা খুলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। খুব অস্বস্তি এবং লজ্জা লাগছে মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। একটু আগে যে কথাগুলো বলল কিছুদিন আগে বললে অন্যরকম অনুভূতি হতো ভালো লাগা কাজ করতো বেশি। অথচ আজ অস্বস্তি হচ্ছে বেশি আজ আমি কনফিউজড। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা আমি ঠিক ধরতে পারছিনা। কিছুক্ষন ইতস্তত করে নিজেকে সামলে নিলাম এভাবে আর কতক্ষণ বাথরুমে দাঁড়িয়ে থাকবো। অবশেষে মনোবল সঞ্চয় করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। কামরান শুয়ে পড়েছে। সন্তর্পণে আলতো পায়ে হেঁটে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালাম। লোশনের বোতল নিয়ে মুখে হাতে লোশন মাখলাম। লাইট অফ করে ডিমলাইট জ্বালিয়ে দিলাম। বিছানার পাশে এগিয়ে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ও জেগে আছে না ঘুমিয়ে গেছে। নড়াচড়া নেই। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা স্বস্তিদায়ক নিঃশ্বাস আমার বুক ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সারাদিনের প্রচুর ধকল যাওয়ায় বোধহয় খুব ক্লান্ত ছিল। আমিও ধীর পায়ে আস্তে-ধীরে বিছানায় উঠে একপাশে শুয়ে পড়লাম। বাইরে মধুর ছন্দময় শব্দে আমি অবিরাম বৃষ্টি ঝরে চলেছে। বোধহয় আজ সারারাতই ঝরবে।বারান্দার দরজা খুলে রেখেছি। সেখান থেকে বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করে ঘরের ভেতরে বেশ ঠান্ডা ভাব এনে দিয়েছে। নিজেও খুব ক্লান্ত ছিলাম। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের জগতে তলিয়ে গেলাম।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে