তোমায় ছেড়ে যাবো কোথায় পর্ব-২২

0
871

#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়।
লেখা – মুনিরা সুলতানা।
পর্ব – ২২।

—————–*
ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেলো। চোখ মেলে তাকাতে অচেনা জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করলাম। কোথায় আমি? চারিদিকে চোখ দুটো বুলিয়ে মনে পরে গেলো সবকিছু। আমিতো হাসপাতালে। কামরার একপাশে একটা বড়সড় সোফা আাছে। সেখানে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে কামরান। বোধহয় অনেক সকাল এখন। গতকাল রাতে সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই এখানে থেকে গেছে। আমার আম্মা খুব করে চেয়েছিলেন আমার কাছে থাকতে। কিন্তু কামরান কিছুতেই রাজি হলেতো। জার্নির দোহাই, ক্লান্তির দোহাই, বয়সের দোহাই দিয়ে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় পাঠিয়েই ছেড়েছে। শেষে বাধ্য হয়েই মামার বাড়িতে চলে গেছেন আম্মা। এই মানুষটাকে দেখলেই আমার পিউলির সাথের সেই মুহুর্তটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর তখনই বুকের ভিতরে অসহনীয় যন্ত্রণা শুরু হয়। কিন্তু সেতো বুঝতে পারছেনা। আমার যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিতে ওকেই এখানে থাকতে হবে। ভাগ্যিস শারীরিক অসুস্থতা হোক বা ঔষধের ডোজের কারনে হোক রাতে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে হয়নি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা।

পাশে সাইড টেবিলের দিকে ফিরে আমার সেলফোন খোঁজার চেষ্টা করলাম। কয়টা বাজে দেখবো। কিন্তু সেটা নেই ওখানে। থাকবে কি করে? সেদিন শপিং মলে সোমার নাম্বার নেয়ার জন্য সেলফোনটা ব্যাগ থেকে বের করেছিলাম। তারপর আর ব্যাগে রাখা হয়নি। হাতেই ছিল। এখন মনে পরছে ওটা বোধহয় এক্সিডেন্টের সময় পড়ে গিয়ে ভেঙে নষ্ট হয়ে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আমার বুক চিড়ে । শুয়ে থাকতে থাকতে আমার পিঠ ব্যাথা হয়ে গেছে। একটু উঠে বসতে পারলে ভালো লাগতো। মাথার চুলগুলো কেমন ভারি এবং পাখির বাসার মতো এলোমেলো হয়ে আছে। কেমন অস্বস্তি ও বিরক্ত লাগছে। ডানহাতে ব্যাথা। বামহাতের ভর দিয়ে বসার চেষ্টা করলাম। নাহ। পারছিনা। শরীরে কোন শক্তিই নেই যেন। হাঁপিয়ে উঠেছি এই সামান্য চেষ্টায়। তখনই কারোও স্পর্শে সচকিত হয়ে পাশে তাকালাম। দেখি কামরান আমার দিকে ঝুকে দাঁড়িয়ে আছে। দুপাশ থেকে আমার দুই বাহু ধরে আস্তে ধীরে খাটের হেড বোর্ডে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

” আমাকে না ডেকে আবার কি মাতব্বরি করছিলে? যদি বেকায়দায় কোথাও লেগে যেত? অসুস্থ অবস্থাও তোমার ছটফটানি কমেনা? ”
কামরানের ধমক শুনে আমি চুপসে গেলাম। কত অধিকার নিয়ে ও আমাকে ধমক দিচ্ছে আজ। অথচ এতদিন এভাবে কোন ব্যাপারে অধিকার দেখায়নি। ওর এই অধিকার খাটানো ভালো লাগলো কিন্তু সেভাবে উপভোগ করতে পারছিনা। মনের মধ্যে অদ্ভুত জ্বলুনি আমার ভিতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। কামরানের কথায় আমার ভাবনার জাল ছিড়ে গেল। খেয়াল হল ও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ও আবার বলল,

” কি হলো কিছু বলবে তো? কিছু লাগবে বল? ”

আমি নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বললাম, ” না মানে কটা বাজে এখন? ”

কামরান হাত উল্টে ঘড়ি দেখে বলল, ” সকাল এখন। সাড়ে সাতটা বাজে। তুমি এত সকালে উঠেছ কেন? আরেকটু ঘুমিয়ে নিতে। বাসা থেকে খাবার আসতে 9:00 বাজতে পারে। তোমার কি খুদা লেগেছে? গরম পানি আছে হরলিক্স আছে দেবো? ”

রাতে জলদি ঘুমিয়ে পড়ায় খাওয়া হয়নি কিছু। আমার এখন সত্যিই খিদা লেগেছে। কিন্তু লজ্জায় বলতেও কেমন বাধছে। আমার কাচুমাচু মুখ দেখে কামরান কি বুঝল কেজানে। ঝটপট ব্যাগ থেকে ব্রাশ ও টুথপেষ্ট বের করে বাথরুমে গিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে আসলো। আমার কাছে এসে বললো,

” আগে দাত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে নাও। তারপর হরলিক্স করে দিচ্ছি গরম হরলিক্স এর সাথে বিস্কুট দিয়ে খেয়ে নাও। ”

আমি ডান হাত চেষ্টা করে উঠাতে পারলাম না প্রচন্ড ব্যাথা। কামরান বুঝতে পেরে এগিয়ে এলো। আমাকে এক হাতে আগলে ধরে অপর হাতে দাঁত ব্রাশ করিয়ে দিল। আমি লজ্জায় সংকোচে কোনরকমে কাজ সারলাম। কামরান বিছানার নিচে রাখা বোওল বের করে তাতে আমাকে কুলি করিয়ে দিল। মুখ ও হাত ধুয়ে দিল। গতরাতে ফ্লাক্সে করে গরম পানি সাথে মগ প্লেট দিয়ে গিয়েছিল। মগে গরম পানি ঢেলে তাতে হরলিক্স এবং গুড়ো দুধ মিশিয়ে নেড়ে নিল। একটা প্লেটে বিস্কুট সাজিয়ে আমার কাছে নিয়ে এলো। কি সাবলীলভাবে সব করছে। আমার ভীষণ লজ্জা করছে। আচ্ছা কেন করছে ও এসব? এত যত্ন নিচ্ছে নিজের হাতে তাও। কেন? ও তো পিউলিকে পছন্দ করে। তাহলে আমার জন্য এসব করার মানে কি?

” কি হলো খাও।”

কামরান হরলিক্সে একটা বিস্কুট ভিজিয়ে আমার মুখের কাছে ধরে আছে। আমি বাম হাত দিয়ে বিস্কিট টা ধরতে গেলে ও বাধা দিয়ে বলে,

” উহু। তোমার হাত লাগাতে হবেনা। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। চুপচাপ লক্ষ্মী মেয়ের মত খেয়ে নাও।”

অগত্যা ইচ্ছে না করলেও কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেতে শুরু করলাম। শেষে বামহাতে মগটা ধরে হরলিক্স টুকু পিয়ে খেয়ে নিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম,

” আপনি কিছু খেলেন না? ”

” এক্সিডেন্টের কারণে তোমার স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে বোধহয়। এটাযে রোজার মাস চলছে ভুলে বসে আছ?”

তাইতো রোজা চলছে আমার খেয়ালই নেই। রোজাগুলো মিস হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ এটা কি হলো আমার সাথে তাও এই রোজার মাসে। কামরান আমার দিকে তাকিয়ে আছে বোধহয় আমার উত্তরের আশায়। আমি মন খারাপ করে বললাম,

” সত্যিই মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল। আমার রোজা গুলো কেমন কাজা হয়ে গেল।” কথা শেষে আমার মুখ দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

” তাতে কি? মানুষের অসুখ বিসুখে রোজা রাখার মত অবস্থা না থাকলে রোজা ভাঙা যায়। আল্লাহ অপশন রেখেছে তো। আল্লাহ তায়ালা অনেক দয়াবান। কোন কিছুতেই জোর জবরদস্তি নেই। পরে সুস্থ হয়ে কাজা করে নিলেই হবে। এসব নিয়ে অযথা মন খারাপ করবেনা। ”

আমি শুধালাম, ” তারমানে আপনি রোজা আছেন। সেহরি কোথায় খেয়েছেন? ”

” গতরাতে তোমার মামি রাতের খাবারের সাথে সেহরি সহ একগাদা খাবার পাঠিয়েছিলেন। সেহরি খাওয়ার পরেও আরও খাবার বেঁচে গেছে। ”

হঠাৎ ও উঠে দাঁড়াল যেন কিছু মনে পরেছে এমন ভঙ্গিতে লাগেজ ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে আবার বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল। ওর হাতে একটা চিরুনি।

” তোমার চুল গুলোয় দুদিন চিরুনি পরেনি। দেখ কেমন পাগলি পাগলি লাগছে। আসো আচরিয়ে দেই।”

বলেই আমার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। আমি অস্বস্তিতে কাটা হয়ে গেলাম। লোকটা কি করছে টাকি? এতো যত্ন! একসাথে এতটা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে। জট পাকানো চুলের বেনীটা খুলে আচরাতে শুরু করতেই চুলে টান পরে আমি ব্যাথা পেয়ে আহ্ করে মৃদু চিৎকার করে উঠলাম। কামরান সঙ্গে সঙ্গে তটস্থ ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

” সরি সরি, আস্তে আচরাচ্ছি। দেখেছ কি পরিমান জট লেগেছে? ”

এরপর খুব সাবধানে অল্প অল্প করে চুলগুলোর জট ছাড়িয়ে নিয়ে সুন্দর করে একটা আঁটো সাটো বেনী করে দিল। সামনে সরে এসে হাসিতে উদ্ভাসিত মুখ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করল ঠিকঠাক হলো কিনা। তারপর বললেন,

” দেখতো ঠিকঠাক হয়েছে কিনা। ”

আমি বেনীটা সামনে এনে দেখলাম। একদম পারফেক্ট বেনী করেছে। একটা ছেলেমানুষের হাতে এমন কাজ দেখে আমি সত্যিই পুলকিত, শিহরিত। কামরান উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে যেন আমার মুখে মন্তব্য না শুনলে ওর শান্তি হচ্ছেনা। আমি বললাম,

” আপনিতো সত্যিই আমাকে অবাক করলেন। মেয়েদের চুল বাঁধা শিখেছেন তাও একদম পারফেক্ট। কিভাবে? হু?”

কামরানের মুখে উজ্জ্বল লাজুক হাসি। মাথার পিছনে চুলকাতে চুলকাতে পাশের চেয়ারে এসে বসলো সে। বেশ উৎসাহের সাথে বললো,

” আসলে ব্যাপারটা হলো তিয়ানার চুলে বেনী করে দিতাম ওর স্কুলে যাওয়ার সময়। এভাবেই শিখেছি। ”

আমি অবাক হয়ে তাকালাম, ” সত্যি? ”

” হুম সত্যি। তুমি তো জানো আম্মা জব করতো। তখন স্কুলে যাওয়ার সময় প্রায়ই কেউ থাকতোনা। মানে আম্মাতো সকালে চলে যেত। তাসমিয়ার স্কুলও সকালে কিন্তু তিয়ানার স্কুল ছিল ডে শিফটে্। তাই বাধ্য হয়েই বলতে পারো আমাকেই ওকে রেডি হতে হেল্প করতে হত। ”

আমি শুধু হালকা হাসলাম। এরমধ্যে নার্স এসে ঔষধ খাইয়ে দিল। আমি আবারও শুয়ে পরলাম। কামরান কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গেছে। তখন খাবার নিয়ে হাজির হলো তিয়ানা ও আরমান। ওদের পিছনেই কামরানও ঢুকলো। ওরা আসার পর সময়টা বেশ ভালো কাটলো। পেট ভরা ছিল বলে একটু দেরিতেই নাস্তা খেলাম। সবাই রোজা থাকায় ওদের সামনে খাওয়াটাযে কি অস্বস্তিকর। তবুও খেতে হয়। যত দ্রুত উঠে দাড়াতে পারবো তত দ্রুত বাসায় ফিরে যেতে পারবো। আমার জন্য সবার কিযে হয়রানি হচ্ছে। ব্যাপারটা আমার জন্য খুবই লজ্জাজনক। যদিওবা জানি ওরা সবাই আমার আপনজন। যা করছে ভালোবেসেই করছে। তবুও আমার কাছে বড়োই বিব্রতকর।
পুরো সকাল পেরিয়ে দুপুর পর্যন্ত ওরা এখানেই ছিল। এরপর আম্মা আব্বা আমার মামাতো ভাই বোন এরা সবাই এলো। হাসপাতালে আছি মনেই হয়না। সারাদিনে সবাই আসছে এখানে। আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য লম্বা সময় এখানেই কাটিয়ে দিচ্ছে। সত্যিই তা অভাবনীয়। দিন যে কোন দিক দিয়ে চলে যায় তা টেরই পাইনি। আমি এখন অনেকটা সুস্থতার দিকে। সেজন্য আমার কেবিনে কাউকে থাকতে নিষেধ করা হচ্ছেনা। আম্মারা এসেই কামরানকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। শ্বশুরবাড়ি এবং মামার বাড়ি থেকে মোটামুটি খাবার এসেছিল। সেগুলো দিয়ে সবাই ইফতারী করলো। কামরান এল সন্ধ্যার পর প্রায় রাতে। তারাবি নামাজ পড়া শেষে। আজও কাউকে থাকতে দিল না। সবাইকে জোর করে রাতে বাসায় পাঠিয়ে দিলো সে। সবাই চলে গেল একে একে। কেবিনটা নির্জনতায় কেমন গুমসুম হয়ে গেল। সারাদিন সম্পূর্ণ হসপিটাল মানুষের ভীড়ে গমগমে হয়ে থাকে। কিন্তু রাত বাড়ার সাথে সাথে ভিসিটরসদের আনাগোনা থেমে যেতেই এই কেবিন সাইডগুলোয় কেমন শুনশান নীরবতায় গা ছমছমে রহস্যময়তা ছেয়ে থাকে। হসপিটালে আসাটা আমার কোনকালেই ভালো লাগেনা। শুধু আমার কেন আমার তো মনে হয় অধিকাংশ মানুষেরই ভালো লাগে না। তবুও আমাদের প্রায় প্রত্যেকেরই বোধহয় কোন না কোন সময় জীবন মরনের সন্ধিক্ষণে এখানে আসতেই হয়। কেউ হয়ত এখান থেকেই ওপারে পারি দেয় আবার হায়াৎ থাকলে কেউ কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারে। কত অসহায় আমরা সবাই তাই না। আমাদের জীবনটা কতটা অনিশ্চিত। আল্লাহর রহমতে এই যাত্রায় আমি বাড়ি ফিরে যেতে পারবো ভাবতেই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় মনটা নিমিষেই সিক্ত নরম হয়ে যায়।
এতক্ষণ সবাই ছিল আমার সময়টাও বেশ আনন্দেই কেটে গেছে। কিন্তু এখন এই কামরায় একা আমি এবং কামরান। তাই পুরনো অস্বস্তিটাও আবার ফিরে এলো। সত্যি বলতে এই কদিনে ওর সাথে অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছিলাম। মনে মনে স্বপ্নের জ্বাল বুনতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু সেদিনের পর কেন জানি কিছুতেই কামরানের সামনে আগের মত সহজ হতে পারছিনা। বারবার সেদিনের সেই আলিঙ্গন দৃশ্য মনে পরে যায়। আর সেই সাথে বুকের ভেতর প্রচন্ড ভাঙচুর শুরু হয়ে যায়। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা আল্লাহর প্রদত্ত পবিত্র সম্পর্ক। আল্লাহর তরফ থেকেই হয়তো পরস্পরের প্রতি একটা মায়া, বন্ধন, টান তৈরি হয়ে যায়। তাই হয়তো খুব দ্রুতই ভালোবাসা জেগে ওঠে মনে। তার ফলশ্রুতিতে কষ্টটাও আজ একটু বেশিই হচ্ছে। কিন্তু এই ভালোবাসা একতরফা কেন হবে? দুইদিক থেকে কেন নয়?কখনও কামরানের এতো বেশি যত্ন নেয়া, এভাবে পাশে থাকা দেখে মনে হয় সেও বোধহয় আমাকে ভালোবাসে। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিনা। মন বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকে। হৃদয়ের গভীরে বিচলন, হতবিহ্বল, অস্থিরতা বারতেই থাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস আমার বুক চিরে বেরিয়ে এলো।
নার্স আমার রাতের শেষ ওষুধ খাইয়ে আমাকে যত্ন করে শুইয়ে দিয়ে চলে গেল। কামরান একটা বই হাতে পাশের সোফার উপর বসে আছে। স্বস্তিদায়ক একটা ব্যাপার মানুষটা কথা কম বলে। বই পড়ে সেল ফোন হাতে নিয়ে দিব্যি তার সময় কেটে যায়। এইযে হসপিটালেও সে সাথে করে বই নিয়ে এসেছে। মানুষটা এই কয়দিন কি যত্নটাইনা করছে আমাকে।

” তোমার কিছু লাগবে? এখনো ঘুমাওনি যে জেগে আছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে না তো? ”

কামরানের কথা শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কেননা আমি এতক্ষণ ওর দিকেই ক্যাবলার মত তাকিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছিলাম। ও কখন যে আমার দিকে খেয়াল করলো টেরই পাইনি। বিব্রত ভঙ্গিতে চোখ দুটো নামিয়ে নিলাম। কামরান ততক্ষনে আমার কাছে চলে এসেছে। সে বিছানায় আমার মুখোমুখি হয়ে বসলো। হাত বাড়িয়ে আমার অগোছালো চুল কানের পিঠে গুজে দিল। গালে আলতো হাত রেখে নরম গলায় বলল,

” কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছে তো? বল আমাকে ডাক্তার ডাকব? ”

ওর এভাবে বলা কথাগুলো শুনে আমার মনটা কেমন নরম কাদার মত দ্রবীভূত হয়ে গেল। আমি কেমন ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কামরানও কেমন যেন অন্যরকম ভাবে নিবিড় দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। ওর হাতটা এখনো আমার গাল ছুয়ে আছে। অসহ্য রকম এক ভালোলাগায় বুকের ভেতরটা তির তির করে কাঁপছে। আমি কেমন দুর্বল হয়ে পড়ছি। না আর আমার দুর্বল হলে চলবে না। আমাকে শক্ত হতে হবে। এই মানুষটা আমাকে নয় অন্য কাউকে ভালোবাসে। আমার নিজেকে সামলাতে হবে। আমি আস্তে আস্তে চোখ দুটো মুঝে নিয়ে বললাম,

” আমি একদম ঠিক আছি, আমাকে নিয়ে অযথা চিন্তা করবেন না। ”

কামরান হাতটা সরিয়ে নিলো। তার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। ” আচ্ছা বুঝলাম। তবে কি ঘুম আসছে না? এস তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই তাহলে জলদি ঘুম চলে আসবে। তোমার এখন প্রচুর ঘুম এবং পর্যাপ্ত রেস্ট দরকার। তবেই না দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবে। ”

বলতে বলতেই কামরায় উঠে এসে আমার শিউরের পাশে বসে সত্যি সত্যিই আমাকে অবাক করে দিয়ে কি যত্ন সহকারে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। একদিকে অদ্ভুত এক ভালো লাগা অন্যদিকে একটা অস্বস্তি মিলেমিশে মিশ্র অনুভূতি আমার মনের ভিতরটায় ছড়িয়ে গেল। হঠাৎ আমার মনে পড়ল কামরানের বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল একটা সেমিনারে অংশ নেয়ার জন্য।

” আপনার না বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল? কবে সেটা? সারাদিন এখানেই কাটাচ্ছেন। প্যাকিং করেছেন? ”

” না ভাবছি যাবো না। তোমাকে এই অবস্থায় রেখে যেতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। ”

আমি ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকালাম। লোকটার মাথা ঠিক আছে তো? তার স্বপ্নের সাথে জড়িত সেমিনারে সে যাবেনা তাও আবার আমার জন্য। না এটা হতে পারেনা। আমি অন্তত এটা হতে দিতে পারিনা। বললাম,

” ভুলেও এমনটা ভাববেন না। এটা আপনার স্বপ্ন আপনার প্যাশন। জীবনের চলার পথে অনেক ব্যাপারেই আমরা সেক্রিফাইস করে থাকি। আমাদের বাধ্য হয়ে করতে হয়। কিন্তু স্বপ্নের সাথে কম্প্রোমাইজ করা একদম ঠিক নয়। তাহলে যে আমাদের বেঁচে থাকার আনন্দটাই মরে যায়। আর তখন আমাদেরকে সারাজীবন আপসোস করে কাটাতে হয়। আমি আপনাকে কিছুতেই এমনটা করতে দেবনা। আপনি অবশ্যই যাবেন। আপনাকে যেতে হবে। ”

” কখনো কখনো মানুষকে আপনজনের জন্য স্যাক্রিফাইস করতে হয়। এবং সেটাও জরুরি। প্রায়োরিটি অনুযায়ী বেছে নিতে হয় কখন কোথায় কম্প্রোমাইজ করতে হবে। আমিও তাই করছি। এই মুহুর্তে তোমার পাশে থাকাটাই আমার প্রায়োরিটি। এবং আমি সেটাই করেছি। এতে আমার কোন আফসোস নেই। ”

কামরানের মুখ নিসৃত কথাটা আমায় যারপরনাই অবাক করল। আমি ওর প্রায়োরিটি কবে কখন হলাম? ওর এভাবে সবকিছু ছেড়ে আমার পাশে থাকাটা আমার মনটাকে আবারও আচ্ছন্ন করে ফেলতে চাইছে। একমন বলছে দেখ মানুষটার কাছে তুই কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আবার আরেকমন বলছে তাহলে সেদিনের চোখের দেখা সবকিছু সেটাওতো সত্যি। মনের ভিতর চলতে থাকা দ্বিধার দ্বন্দ্বকে জোর করে দমিয়ে ফেললাম। যতক্ষণ না সঠিক সত্যিটা জানতে পারছি মনকে কিছুতেই দুর্বল হওয়া চলবে না।

” আমাকে বোধহয় কাল পরশুর মধ্যেই বাড়ি যেতে দিবে? ”

” হ্যা তুমি সব কথা লক্ষ্মী মেয়ের মত মেনে চললে যত দ্রুত রিকভার করবে তত দ্রুত বাসায় ফিরে যেতে পারবে।”

” সবাই তো আছে এখানে। আর আমিও এখন ভালো আছি। এই দুয়েক দিনের জন্য কোন প্রবলেম হবেনা ইনশাআল্লাহ। আপনার ফ্লাইট কবে যেন?”

কামরান বললো, ” কাল রাতে। ”

” তাহলে কাল বাসায় গিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিবেন। ঠিক আছে? আপনি এই সেমিনারে অংশগ্রহণ করলে আমার সত্যি খুব ভালো লাগবে।”

” কিন্তু…! ”

” না, আর কোন কিন্তু নয়। আপনার স্বপ্ন পুরোন হতে দেখাটা আমারও স্বপ্ন। আমার জন্য আপনার এত বড় সুযোগটা হাতছাড়া হলে আমার সারাজীবন আপসোস থেকে যাবে। প্লিজ এমনটা করবেন না। ”

কামরান কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর একটা প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বললো,

” ঠিক আছে। তুমি চাইলে তাই হবে। কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে কোন অনিয়ম করবেনা। প্রোপারলি নিজের খেয়াল রাখবে যত্ন নিবে ঠিক আছে? ”

আমি স্মিত হেসে মাথা দুলিয়ে বললাম, ” ঠিক আছে। ”

” এইতো লক্ষ্মী মেয়ে। ” বলেই কামরান আমাকে চমকে দিয়ে ঝুঁকে এসে আমার ললাটে ঠোঁট জোড়া আলতোভাবে ছুয়ে দিল।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে