#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখা – মুনিরা সুলতানা।
পর্ব – ২১।
—————-*
চোখের পাতাগুলো এত ভারি লাগছে কেন? মনে হচ্ছে যেন আঠা দিয়ে আটকে আছে। কিছুতেই চোখ মেলে তাকাতে পারছিনা। মাথাটাও প্রচন্ড ব্যাথা করছে। কেমন ভার হয়ে আছে। অনেক্ক্ষণ যাবৎ চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু কিছুতেই পারছিনা। বারবার কেন যেন অথৈ সাগরে তলিয়ে যাচ্ছি। গভীর থেকে আরো গভীরে ডুবে যাচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো আম্মা আমার আশেপাশে আছে। ফিসফিস করে কিছু বলছেও বোধহয়। কিন্তু কিছুই শুনতে বা বুঝতে পারছিনা। না বুঝতে পারলেও আম্মার উপস্হিতিতে আমার সাহস ও মনোবল ফিরে এল। মনে হচ্ছে এইতো আমার সবচেয়ে নিরাপদ সঙ্গ। যেই মানুষটা আশেপাশে থাকলে আর কোন কিছুর প্রয়োজন হয়না। একটু একটু চেষ্টায় জোর করে এবার চোখ মেলে তাকালাম। কোনরকমভাবে আধবোজা চোখে দেখার চেষ্টা করছি। ঝাপসা অবয়ব চোখে পরছে। কিন্তু দেখতে দেখতে অবয়বটা পিছিয়ে যেতে যেতে চলে গেল। ভালো করে দেখতে না পারলেও আম্মাই ছিল এটা নিশ্চিত। কিন্তু আমি কি সত্যি দেখলাম নাকি স্বপ্ন ছিল বুঝতে পারছিনা। কোথায় আছি? চারপাশে দেখার চেষ্টা করলাম। মনে হচ্ছে হাসপাতাল। এখানে কেন আমি? মনে করার চেষ্টা করলাম। মাথাটার ভিতরে একদম ফাঁকা লাগছে। একেবারে শূন্য হয়ে আছে। কিছু ভাবতে পারছিনা। ক্লান্ত চোখ দুটো আবারও বুজে আসতে চাইছে কেবলই। কতক্ষণ কেটে গেছে জানিনা। হঠাৎ একসময় অদ্ভুত অনুভব হওয়ায় তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা ছুটে গেল। নিজেকে আবিষ্কার করলাম স্ট্রেচারের উপর। কোথাও নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। একসময় স্ট্রেচার থেকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হলো। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম কেবিনে আনা হয়েছে আমাকে। এবারে ঘুম ঘুম ভাবটা কেটেছে। চোখ মেলে ভালো মতো দেখতে পারছি। এখন মনে পরছে আমি রাস্তার মাঝখানে চলে গিয়েছিলাম। একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম। তারপর সোমা, কামরান ওরা ছিল ওখানে। তারপর… আর কিছু মনে করতে পারছিনা। নিজের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলাম। কতটুকু আহত হয়েছি বুঝতে পারছি না। একটু পরেই কর্তব্যরত ডাক্তার আমাকে দেখতে এলেন। সবকিছু দেখেশুনে আমাকে শুধালেন,
” কেমন ফিল করছেন এখন? ”
কষ্ট করে মুখে ম্লান হাসি ফুটিয়ে মাথা নেড়ে ক্ষীন স্বরে বলার চেষ্টা করলাম, “বেটার। ”
ডাক্তারের ঠোঁটে হাসি দেখা গল। বললেন, ” দ্যাটস গুড। আর কোন চিন্তা নেই। বিপদ কেটে গেছে। খুব শীঘ্রই বাড়ি ফিরতে পারবেন ইনশাল্লাহ। ”
” সত্যি! ”
” অফকোর্স। আপনার ফ্যামিলি মেম্বাররা উদগ্রীব হয়ে আছে আপনাকে দেখার জন্য। আপনাকে সাবধান করছি একদম বেশি কথা বলবেন না এবং উত্তেজিত হওয়াও চলবেনা। এখন সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা হচ্ছে প্রপারলি রেস্ট। মনে থাকবে?”
আমি হাসি মুখে মাথা নেড়ে সায় জানালাম। ডক্টর উনার ডানহাত উঠিয়ে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললেন, ” অল দ্যা বেস্ট। ”
ডক্টর চলে যাওয়ার পরেই আম্মা আব্বাকে একসাথে কামরায় ঢুকতে দেখলাম। উনাদের দেখা পেয়েই আমি হঠাৎই অতি আবেগপ্রবণ হয়ে পরলাম। চোখ দুটো ভিজে গেলো আমার। কতদিন পরে এই অতি প্রিয় ও আপনজনদের চোখের সামনে দেখার সুযোগ হলো। আম্মা কাছে এসে বিছানার একপাশে বসেই আমার একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। আমি কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কেবলই দেখে গেলাম। আব্বা কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে অবশেষে কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
” শায়লা কি শুরু করেছ বলোতো? ডাক্তার কি বলেছেন ভুলে গেছ? ওকে এখন কোনরকমের মেন্টাল স্ট্রেস দেওয়া যাবেনা। এখন তুমি যদি এভাবে কাঁদতে থাকো ওর জন্য সেটা কি ভালো হবে?”
আম্মা নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করছেন। আমি দুর্বল ভাঙা ক্ষীণ স্বরে বললাম, ” আম্মা আমি এখন একদম ঠিক আছি। তুমি অযথা কেন এমন কান্নাকাটি করছ? ”
আমার হাতটা তুলে ধরে হাতের পিঠে তালুতে চুমু দিলেন আম্মা। কান্না ধরা গলায় বললেন, ” আমরা কতো ভয় পেয়েছিলাম তুই কি বুঝবি? তোর যদি কিছু হয়ে যেত? যখন মা হবি বুঝতে পারবি সন্তানের কিছু হলে মায়েদেরর কেমন লাগে। ” বলেই আবারও ফুপিয়ে উঠলেন।
আমি মৃদু হেসে বললাম, ” কিছু হয়নিতো আম্মা। তোমাদের দোয়া আমার সাথে আছেনা। দেখো আমি একদম ঠিক আছি। একটু আধটু চোটে কিছু হয়না। বুঝলে।”
আব্বা ব্যাঙ্গাত্বক গলায় বললেন, ” মেয়েকে সাহস দিবে ভয় না পেতে, উল্টো অসুস্থ হওয়ার পরেও সেই তোমাকে সাহস দিচ্ছে। সত্যিই চমৎকার!”
আম্মা কটমটে দৃষ্টিতে আব্বার দিকে তাকালেন। আমি এবার শব্দ করে হেসে উঠলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা কেমন টনটন করে উঠলো। কষ্টে সৃষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম। উনাদের বুঝতে দিলাম না। একটুক্ষণ সময় থেকে উনাদের চলে যেতে হলো। কাউকে বেশিক্ষণ থাকার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। কতদিন পরে মা বাবাকে কাছে পেয়ে একদম দুরে যেতে দিতে ইচ্ছে করছিল না। আমার আবার একটা বদভ্যাস ছিল সেই ছোটবেলা থেকেই যখনই আমি একটুখানি অসুস্থ হতাম একদম মায়ের আচল ছাড়তে চাইতাম না। সেই বদভ্যাস বড় হয়েও যায়নি। যখনই জ্বর হত মায়ের জন্য সত্যিই খুবই পীড়াদায়ক ছিল। সবসময় একা ঘুমালেও সেই সময়গুলো আম্মা আমার সাথেই ঘুমাতেন। আমিও আদুরে বিড়ালের মত মায়ের গায়ের সাথে সেঁটে থাকতাম। আপন মনে হেসে উঠলাম। সত্যি সোনালী দিনগুলো কখনোই একরকম থাকে না। কখন যে চোখের পলকে সময়গুলো তাদের রং রুপ ধরন সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলে টেরই পাওয়া যায়না। জীবন আমাদের প্রতি পদে পদে নতুন নতুন পরিস্থিতিতে ফেলে নতুন কিছু শিক্ষা দিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরিয়ে দিয়ে যায়। আর আমরাও কেমন করে ঠিকই সেইসব অভিজ্ঞতার আলোকে জীবনের সবরকম পরিস্থিতির সাথে নিজেদের মানিয়ে গুছিয়ে নেই। একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে নিজেকে আবারও একবার নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে প্রস্তুতি নিলাম।
একটা অল্প কিছুদিনের পরিচিত সুগন্ধির সুবাস কামরায় ছড়িয়ে পরেছে। অজান্তেই শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। জানিনা এ কেমন অনুভুতি। মানুষটা আশেপাশে থাকলেই কিংবা তার কন্ঠস্বরের আওয়াজ শুনলে এমনকি তার গায়ের গন্ধ পেলেও শরীরটায় কেমন একটা অদ্ভুত ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত শিহরণ বয়ে যায়। এখনও ওর উপস্থিতি টের পেলাম। মাথাটা হালকা কাত করে ঘুড়িয়ে দরজার দিকে তাকালাম। সুরমা রংয়ের প্যান্টের পকেটে হাত গুজে কামরান দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। ওর পোশাকের অবস্থা দেখে অবাক হলাম। ও ভিষণ সৌখিন তার পরিধেয় পোশাকের ব্যাপারে। বাইরে যাওয়ার সময় একদম গুছিয়ে তৈরি হয় সে। কিন্তু আজকের যেই টিশার্টটি পরেছে যেটা সাধারণত ও বাসায় থাকলে পরে। একটু অগোছালো কেমন উসকোখুসকো লাগছে তাকে দেখতে। আমাকে তাকাতে দেখে কামরান বিছানার কাছে এগিয়ে এলো। বিছানার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কিছু না বলে কেবল তাকিয়ে রইল। যেন নিবিড় দৃষ্টিতে কিছু পর্যবেক্ষণ করতে ব্যাস্ত। ওর দৃষ্টিতে কি জানি আছে। যার প্রচন্ড গরম আঁচ। আমার ভিতর পর্যন্ত যেন জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম ওর উত্তপ্ত দৃষ্টি দিয়ে। সহ্য করতে না পেরে আস্তে করে চোখ দুটো নিচে নামিয়ে নিলাম। এভাবেই কেটে গেল কিছু সময়। এখনও সে ঐভাবেই তাকিয়ে আছে। না তাকালেও বোঝা যায়। অস্বস্তি হচ্ছে আমার। হঠাৎ করে চোখের সামনে সেদিনের সেই দৃশ্য ভেসে উঠলো। পিউলির সাথে ওর সেই আলিঙ্গনরত দৃশ্য। মনটা নিমিষেই তিক্ততায় ছেয়ে গেল। মনটাও ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। মাথাটা অন্যপাশে ঘুরিয়ে নিলাম সাথে সাথে। এবার কামরান নড়েচড়ে উঠলো। বিছানার আরও কাছে এগিয়ে এলো। বিছানার উপরেই একপাশে বসে আমার স্যালাইন ছাড়া খালি হাতটা তুলে নিল নিজের হাতে। আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও এদিকে ফিরলাম। কামরান বললো,
” তুমি এতো কেয়ারলেস জানলে ওখানে দাঁড় করিয়ে না রেখে একেবারে সাথে নিয়েই যেতাম। কিন্তু জানব কি করে বল? তুমি আগে বললেই পারতে। তাহলে এমন অঘটন আর ঘটতো না। কি ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিলে। এরপরে আর এমন ভুল করবনা। প্রমিজ। এরপর যখনি আমরা বাইরে যাব তোমার হাত আমি আর কখনো ভুলেও ছাড়বনা।”
আমি ভ্রুকুটি করে তাকালাম। মানে কি? আমি কেয়ারলেস? কামরান এখন আমাকে ব্যাঙ্গ করছে? ওদের নির্লজ্জতা দেখেই তো আমার হুস উড়ে গিয়েছিল। আর কখন যে আনমনা হয়ে মাঝ রাস্তায় চলে গেছিলাম টেরই পাইনি। কিন্তু কিছুই বললাম না। ওর সাথে আমার কথা বলতেই রুচিতে বাঁধছে। বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চোখ সরিয়ে নিয়ে হাতটাও ওর হাতের বাঁধন থেকে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করছি। কিন্তু সফল হলাম না। বরং ও আরও চেপে ধরে আছে। এবার কামরান আবারও বললো,
” কি সমস্যা? এমন করছ কেন? হাতে কি ব্যাথা লাগছে?”
ওর দিকে না তাকিয়ে ওভাবেই বললাম, ” না। ”
” তাহলে? শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তারকে ডাকবো? ”
এবার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে চুপ করে গেলাম। ওর দিকে ফিরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কিছু সময়। কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। ওর সাথে কোন কথাই বলতে চাই না। কেননা ওর দিক থেকে তো আমার প্রতি কখনো কোন অনুভূতি প্রকাশ করেনি। কখনো কোনরূপ প্রত্যাশাও দেয়নি। তাহলে আমি কি অভিযোগ করতে পারি? আমার সেই অধিকারই তো নেই। কোন কৈফিয়তও চাইতে আর ইচ্ছে করছে না। কি হবে কৈফিয়ত চেয়ে। নিজেকে কেবল হ্যাংলাই মনে হবে। তাই মনের কথা মনের মাঝেই গুমরে মরুক। আমি আর না কিছু জানতে চাই আর না এখানে থাকতে চাই। তাই নিশ্চুপ থাকাই শ্রেয়। আমি শুধু চাই ওর থেকে দুরে চলে যেতে। যেখানে গেলে রোজ রোজ এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে পারবো। কামরান আমার দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তাই ভাবনার রাশ টেনে শুধু বললাম,
” আমি ঠিক আছি। কোন প্রবলেম হচ্ছে না। ”
ও এবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ওকে ভিষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ওর সুন্দর মুখটায় বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। চোখের নিচে কালি পরেছে। ওকি গতরাতে ঘুমায়নি? আমাকে ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে ও শুধালো,
” ওভাবে কি দেখছ বলতো তখন থেকে? আর এতো কি ভাবছইবা?”
আমি যে এতক্ষণ ধরে ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছি খেয়ালই করিনি। বিব্রতবোধ করতে লাগলাম। অস্বস্তি ভরা চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম, ” আপনি গতরাতে ঘুমাননি? চেহারার এমন হাল হয়েছে কেন আপনার? ”
কামরান ম্লান হেসে বললো, ” তুমি যে কান্ড ঘটিয়েছ। তাতে আমার নাওয়া খাওয়া ঘুম সব হারাম হওয়াটাই স্বাভাবিক নয়কি? যতক্ষণ তোমার সেন্স না ফিরেছে ততক্ষণ ডাক্তার কোন পজিটিভ আশাই দেননি। এই অবস্থায় কি আর নিশ্চিন্তে ঘুম আসে বল? কি একটা দিন গেল আমাদের সবার। কি ভয়টাইনা পেয়েছিলাম। ” বলেই একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললো সে।
আমি অবাক হয়ে ফিরে তাকালাম। আমার জন্য এতো দুশ্চিন্তা সত্যিই হয়েছে ওর? কিন্তু কেন? পরক্ষণেই মনে হলো নাহ আসলে আমি তো এখন ওর দায়িত্ব। আমার ভালো মন্দ কিছু হলে তার দায় তো ওর ঘাড়েই চাপবে। তাই হয়তোবা এতো দুশ্চিন্তা। আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গেলেই তখনই কর্তব্যরত নার্স কামরায় এলো। এগিয়ে এসে সে কামরানের উদ্দেশ্যে বললো,
” পেশেন্টকে এখন রেস্ট নিতে দিন। আপনি বাইরে যান। একটু স্টেবল হতে দিন আগে তারপর যত খুশি কথা বলার বলবেন। ওকে?”
আমি নিঃশব্দে হেসে উঠে বললাম, ” আপনিও রেস্ট নিন। ভালো হয় বাসায় গিয়ে খেয়ে দেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিন।”
কামরান ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমার উদ্দেশ্যে বলল,
” আমি ঠিক আছি। তুমি আগে সুস্থ হয়ে উঠো তারপর সব হবে। এখন রিল্যাক্স থাকো ঠিক আছে? তুমি রেস্ট নাও, আমি বাইরে আছি কোন প্রয়োজন হলে ডাকবে। আসি। ”
কামরান বেরিয়ে গেল। নার্স এগিয়ে এসে আমাকে ভাল করে চেক দেখল, স্যালাইন চেক করল। তারপর বলল,
” আপনি এখন রেস্ট নেন। এখন যত রেস্ট নেবেন ততো দ্রুত আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। ঠিক আছে? অল দ্যা বেস্ট। ”
নার্স আমার বিছানা, গায়ের চাদর সব ঠিকঠাক করে দিয়ে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আমি আর কি করবো ঠিক ঠাক হয়ে শুয়ে থাকলাম। নড়াচড়াও সেভাবে করতে পারছিনা। শরীর ক্লান্ত থাকায় কিংবা ঔষধের প্রভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। যখন ঘুম ভাঙলো তখন দুপুর পেরিয়ে বোধহয় প্রায় বিকেল হওয়ার পথে। দিন রাতের হিসাব এখন ঠাওর করা মুসকিল। আমার কামরায় তখন আম্মা এবং শাশুড়ি মা বসে আছেন। কেবিন টা অনেক বড়। এখানে আরেকটা বিছানা এবং একপাশে বড় সোফা রাখা আছে। সেই সোফায় বসে আম্মা ও শ্বাশুড়ি আম্মা কথা বলছিলেন। সম্ভবত সে কথার গুনগুন আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙেছে। আমি ওনাদের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর ওনাদের নজর আমার দিকে পড়লে দুজনেই প্রায় হন্যে হয়ে ছুটে এলেন আমার কাছে। আম্মা বললেন,
” উঠেছিস? এখন কেমন লাগছে? শরীর ঠিক আছে তো? ”
আমি আলতো করে হাসার চেষ্টা করলাম মাথা নেড়ে বললাম, ” আমি ঠিক আছি। ” শাশুড়ি মায়ের দিকে ফিরে বললাম, ” আম্মা আপনারা কখন এসেছেন? কেমন আছেন? বড় আপুর বেবিরা কেমন আছে? ”
শাশুড়ি মা হেসে বললেন, ” আমরা সবাই ঠিক আছি মা। কিন্তু তোমার এই হাল কেন? সুস্থ-সবল রেখে গেলাম এসে দেখি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছ। এটা তো ঠিক না মা। সাবধানে চলাফেরা করতে হয় তো।”
আমি লজ্জায় নুয়ে পড়লাম। কি বলব বুঝতে পারছি না। সত্যিই তো এমন বোকার মত কাজ করেছি। যদিও এক্সি*ডেন্ট তো এক্সি*ডেন্টই। তবুও আমার সাথেই এমন হতে হলো? কি ভাবছে সবাই আমার সম্পর্কে? এত বড় একটা মেয়ে রাস্তায় ঠিকমত চলাফেরা করতেও পারিনা। ব্যাপারটা আসলে খুবই লজ্জাজনক। উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি সেদিকে উনার দিকে ফিরে লাজুক হাসলাম। কোনরকম আবার আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো,
” আমি ঠিক আছি আম্মা। ”
” হুম, সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। ” কথাটা বলার সময় ওনার চোখের তারায় কৌতুক ঝিলিক মেরে গেল। ” যাহোক এখন আর এত লজ্জা পেতে হবে না। এক্সি*ডেন্ট যেকোনো সময় ঘটতে পারে যেকোনো কারো সাথেই ঘটতে পারে। তাই এখন তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো এবং বাড়িতে ফিরে চলো। ঠিক আছে? ”
আমি ডাইনে-বাঁয়ে মাথা হেলিয়ে সায় জানালাম। আমার আম্মা এগিয়ে এসে আমার মাথায় মুখে গালে হাত বুলিয়ে দিলেন।
” তুই চোখ মেলে তাকিয়েছিস, কথা বলছিস আমার এতেই শান্তি। এখন জলদি সুস্থ হয়ে ওঠ মা। ”
এরই মধ্যে নার্স এসে আমার স্যা*লাইন শেষ হয়ে গেছে দেখে খুলে দিয়ে গেলেন। হালকা তরল জাতীয় খাবার খাওয়ার অনুমতি দিলেন। এর পরের সময় গুলো আমার একে একে সবার সাথে দেখা করেই কেটে গেল। শুধু কামরানের দেখা পেলামনা। পরে জেনেছি শাশুড়ি মা জোর করে ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। সন্ধায় আবার আসবে। এর মধ্যে মামী খাবার নিয়ে হাজির। স্যুপ রান্না করে এনেছেন আমার জন্য। খাবার দেখে আমার পেটের ভিতর কেমন প্রচন্ড খিদে টের পেলাম। সেই সাথে গলাটাও কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। আম্মা আমাকে খাইয়ে দিলেন। সবাইকে একসাথে পেয়ে বেশ ভালো লাগছে। কতদিন পরে মা-বাবার সঙ্গে দেখা হল। এত লম্বা সময় তাদের থেকে কখনও দূরে থাকা হয়েছে বলে মনে পরেনা। তাই আমার এক্সি*ডেন্টকে এখন সাপে বর মনে হচ্ছে। একেতো আপনজনের থেকে দূরে ছিলাম। আর যে কাছে ছিল সেকি আমার আদৌ আপনজন? কিজানি তা আর হয়ে উঠতে পারলো কোথায়? তার সাথে তো স্বাভাবিক সম্পর্কটাই গড়ে ওঠেনি। আবার এসব কথা মনে পরতেই মনটা তিক্ততায় ছেয়ে গেল। চোখ দুটোও বারবার ভিজে উঠে এসব কথা মনে হলে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আপাতত এইসব অস্বস্তিকর ভাবনাগুলোকে মন থেকে সরিয়ে রেখে আপনজনদের সান্নিধ্যে কাটানো ভালো সময় টুকু উপভোগ করায় মনোযোগ দিলাম।
চলবে ইনশাআল্লাহ।