তোমায় ছেড়ে যাবো কোথায় পর্ব-০২

0
1005

#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়?
লেখাঃ মুনিরা সুলতানা।
পর্বঃ ২ ।

————*
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের আবির্ভাব হয়েছিল। সেই অদেখা অচেনা মানুষ থেকে চোখের নিমিষেই আজন্ম কালের জন্য আপন হয়ে যাওয়া মানুষটার সাথে প্রথম শুভ দৃষ্টি ঘটেছিল যখন তাকে আমি যেই কামরায় বসেছিলাম সেখানে আনা হয়েছিল।
কিছুক্ষণ আগেই কবুল বলার পর্ব চুকে গিয়েছিল। এখন খাওয়া দাওয়ার পালা চলছে। বিয়ের অনুষ্ঠান বাসায় হচ্ছে বিধায় বরকে বরযাত্রীদের সাথেই অন্য কামরায় বসানো হয়েছে। আমাকে ভিতরেই একটা প্লেটে করে খাবার নিয়েসে আম্মা আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে গেলেন একটু আগেই। কতদিন পরে আম্মার হাতে খেতে গিয়ে আমার চোখ দুটো বারবার ছলছল করে উঠছিল। বড় হওয়ার পরে পরীক্ষার দিনগুলোতে যখন সময়ের অভাবে কিংবা টেনশনে খেতে চাইতাম না তখন এভাবে খাইয়ে দিতেন আম্মা। সেই এইচএসসি পরীক্ষার পরে হয়তো কখনো জ্বরে টরে পরলে দুয়েকবার খাইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তো আমার দিন। আজ যে আমি বিয়ের কনে। তাই আজ সব কিছুই আমার জন্য স্পেশাল।
খাওয়া শেষে আমি চুপচাপ বিছানার উপর বসে ছিলাম। আমি সেদিন অবিবাহিতা মেয়ের পরিচয়ের বিসর্জন দিয়ে বিবাহিতা মহিলার পরিচয় ধারণ করেছিলাম। বিছানার উপর অনুভূতিহীন মন নিয়ে বিরসবদনে নিরবে বসে ছিলাম। সত্যি বলতে সেই মুহূর্তে আমার মনে কিছুই ছিলনা। একেবারে শুন্য অনুভব, মানে একদম বোধশক্তিহীন হয়ে পরেছিলাম তখন। যেন একটা স্রোতোবহা নদীর মতো কেবলই বয়ে চলেছিলাম। নদীর পানি যেমন আপন খেয়ালে বয়ে যায়, আমিও ঠিক সেভাবেই সময় ও পরিস্থিতির স্রোতে কেবলই বয়ে যাচ্ছিলাম। কামরার মধ্যে মেয়ে এবং মহিলাদের ভীড় লেগে ছিল। তারা নানা ধরনের হাসি ঠাট্টা মন্তব্যে পরিবেশটাকে মুখরিত করে রেখেছিল। কিন্তু আমার কানে কোন কিছুই প্রবেশ করছিল না। আমি তাকিয়ে তো ছিলাম কিন্তু কিছু দেখছিলাম না। আমি সব শুনছিলাম কিন্তু সব কিছু আমার বোধগম্যের বাইরে ছিল।
এমন সময় হঠাৎ পাশে বসা কারও ধাক্কায় আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখি আমার মামাতো বোন তামান্না দরজার দিকে দেখার জন্য ইশারা করছে। আমি দরজার দিকে চোখ দুটো তুলে তাকালাম। এবং তাকে প্রথম দেখলাম। তিনিও আমার দিকেই চেয় ছিলেন। আমাদের চোখাচোখি হলো। যদিও আমি তাকে আগে কখনও দেখিনি। তবুও আমায় বলে দিতে হলনা যে উনিই আমার সদ্য বিবাহিত বর কামরান আহমদ। উনার সাথে আরও কয়েকজন পুরুষ মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। কেউ ছেলেমানুষ আবার কেউ বয়স্ক। দুয়েকজন ছাড়া সবার পরনেই পাঞ্জাবি। আমার বর কামরানের পরনেও হালকা কারুকাজ করা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি। পরিস্থিতি অনুযায়ী শেরওয়ানিতে বোধহয় কামরান কম্ফোর্টেবল থাকতোনা। তাই বোধহয় পাঞ্জাবিই বেছে নিয়েছে। মানুষটা অনেক লম্বা। কত হবে? ছয় ফুট হবে মনে হচ্ছে। উজ্জ্বল রঙের ত্বক। চোখে মুখে একটা অদ্ভুত ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন গাম্ভীর্যতা জড়িয়ে রেখেছিল তাকে। এককথায় সুস্বাস্থ্যের অধিকারী একজন সুদর্শন সুপুরুষ। তার বোধহয় গরমে নাজেহাল অবস্থা। কেননা বারবার টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছতে হচ্ছে তাকে। কিন্তু কিছুই করার নেই। আমার মামার রাজশাহীতে বাড়ি থাকলেও এখানে ভাড়ায় থাকেন। এসি বিলাসিতা উনার পক্ষে অত্যন্ত ব্যায়বহুল। আর সেই পুরনো দিনের মত আমাদের বিয়েটা কমিউনিটি সেন্টারে না হয়ে ঘরোয়া ভাবে মামার বাসায় হচ্ছে। এখন নভেম্বর মাসের মাঝামাঝির দিকে। এই সময়ে গ্রামাঞ্চলে হেমন্ত কালের ঠান্ডার রেশ শুরু হলেও ঢাকায় পা দিতেই সেই ঠান্ডার রেশটুকুও ছিলনা। ভোর বেলায় যখন ট্রেন থেকে নেমেছিলাম তখন হালকা শীত শীত অনুভব করেছিলাম। কিন্তু দিন যত বাড়ছিল রৌদ্রময় উজ্জ্বল দিনের সঙ্গে সঙ্গে গরমের দহনও বেড়ে গিয়েছিল। এইযে সাজুগুজু করে এবং ভারী শাড়ি গহনা পরে আমারই তো বেহাল দশা। আর উনি তো বলাই বাহুল্য। আমি বোধহয় নির্লজ্জের মতো চেয়ে ছিলাম তার দিকে। তার ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হয়ে যেতে দেখে আমি সম্বিত ফিরে চট করে চোখ নামিয়ে নিলাম। জানিনা কতক্ষণ ওভাবেই তাকিয়ে ছিলাম। এরপরে লজ্জায় মুখ তোলা অসম্ভব মনে হচ্ছিল আমার। এরপরে আমি মস্তক অবনত করেই বসে রইলাম। ততক্ষণে কামরায় অবস্থান রত মহিলারা তটস্থ হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে অস্থির চিত্তে বরকে ভিতরে আসার জন্য জায়াগা করে দিয়েছিলেন। বিছানায় একদম আমার পাশে এনে বসানো হয়েছিল তাকে। বসার সময় আমার গায়ে তার একটুখানি ছোঁয়া লাগতেই আমার শরীর অস্বস্তিতে কুঁকড়ে গিয়েছিল। আমি সংকোচে জড়োসড়ো হয়ে গিয়েছিলাম। আমার গ্রীবাদেশ একদম বুকে গিয়ে ঠেকেছিল। উনার শরীর থেকে পারফিউম এবং পুরুষালী ঘ্রাণের মিশ্রণযুক্ত সুগন্ধির মিষ্টি একটা অচেনা সুবাস আমার নাসারন্ধ্রে এসে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছিল। এই সুবাস এর আগে কোথাও পাইনি। অবশ্য সুগন্ধি সম্বন্ধে আমার ধারণা খুবই কম। মানুষটার পাশে বসে আমার বুকের ভিতর কেমন ধরফর করছিল। আমি লজ্জায় ও অস্বস্তিতে কাঠ হয়ে একেবারে দমবন্ধ করে বসে ছিলাম।
মুরুব্বি গোছের আত্মীয়ারা আমাদের দুজনকে মিষ্টিমুখ করালেন। আরও কিছু সামাজিক নিয়মনীতি পালন করা হলো। মিষ্টি খাওয়ার সময় আমি লজ্জায় মুখ খুলছিনা দেখে কেউ একজন বলে উঠলো,

” না না ভাবি মুখ খুলে খেতে হবে। ”

সাথে সাথে আরও কয়েকজন কন্ঠও তাল মিলিয়ে একই কথা বলে উঠলো। আমি না পারতে অবদমন মস্তকে কোনমতে একটুখানি মিষ্টি মুখে নিয়েছিলাম। সবাই করতালি দিয়ে উঠেছিল। একই গ্লাসে আমাদের দুজনকে শরবত খেতে হল। পাত্র পক্ষের তাড়া থাকায় কিছুক্ষণ পরেই কনে বিদায়ের মুহূর্তটি চলে এসেছিল। আব্বা এসে তার জামাইকে একটা ঘড়ি পরিয়ে দিলেন। এটা কখন কিনেছেন আমি দেখিনি। হয়ত আজকের কোন ফাঁকে কিনে এনেছেন। যাইহোক আমার হাত কামরানের হাতে তুলে দিয়ে বললেন,

” আমার কলিজার টুকরো মেয়েটাকে আজ তোমার হাতে তুলে দিলাম। আজ থেকে তোমার ভরসায় এমন হুট করে কোন প্রস্তুতি ছাড়াই ওর সমস্ত দায়িত্ব তোমায় দিলাম। আমার বিশ্বাস তুমি আমার ভরসা বজায় রাখবে। ”

আব্বার কথা শুনে টুপ করে কফোটা উষ্ণ জল আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে পরল। আমি পাশ থেকে তার হাতে ধরা আমার হাতে আলতো ভাবে চাপ দিয়ে মৃদু স্বরে তাকে বলতে শুনলাম,

” আমি আমার সাধ্য মতো চেষ্টা করব আপনার ভরসা বজায় রাখতে। আপনি নিশ্চিত থাকুন। ”

আমি এক মুহূর্তের জন্য চমকিত হলাম। ভেলভেটের মত মসৃণ ও মোলায়েম কন্ঠস্বর। আর তার কথা বলার ধরন এতো সুন্দর! প্রতিটি শব্দ আমার কানে প্রবেশ করা মাত্র মনে হলো যেন কোন সুরের মূর্ছনায় আমি অভিভূত হয়ে পরলাম।
তারপর সে আস্তে করে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে নিজের হাতটা সরিয়ে নিল। এরপর আমার মামা এসে আমাদের দুজনের মাথায় হাত রেখে দোয়া করে বললেন,

” তোমাদের বিয়েটা এমন একটা সিচুয়েশনে হলো বলে সেভাবে কিছুই করা সম্ভব হলনা। কিন্তু এটাই সুন্নত তরিকার বিয়ে। আমি দোয়া করি তোমাদের দাম্পত্য জীবনটা বরকতময় হবে এবং তোমরা জীবনে অনেক সুখি হবে। ইনশাআল্লাহ।

” ইনশাআল্লাহ, দোয়া করে যাবেন। ” কামরান বিনয়ী কন্ঠে বললো কথাটা।

বিদায়ের ক্ষনে আমার কান্নার বেগ বেড়ে গিয়েছিল আরও। এরপর সবাই কে সালাম জানিয়ে আমাদের বিদায় নেওয়ার সময় হয়ে গেল। এতক্ষণের চেপে রাখা কান্নার দমক এবার লাগাম ছাড়া হয়ে গিয়েছিল। আমার আম্মা আব্বা ভাইয়া মামা মামি চাচা চাচি আরও কাছের যাকে পাচ্ছি জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছি আমি। আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল সবাইকে ছেড়ে যেতে। তাও একেবারে অজানা অচেনা মানুষজনদের সাথে। সেই সাথে একটা ভয়ও কাজ করছিল আমার মনের গহিনে। ওরা বোধহয় আমার বাড়াবাড়ি কান্না দেখে বিরক্তই হচ্ছিল। শেষে কেউ একজন মহিলা আমাকে প্রায় জোর করেই ধরে নিয়ে বাইরের দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন।

গাড়িতে এসে বসলাম আমরা। বিয়ের গাড়ির মতো ফুল টুল দিয়ে সাজানোর সুযোগ কিংবা মন মেজাজ বোধহয় কারও ছিলোনা। এই পরিস্থিতিতে অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়ির বাইরে তাকালাম। আমার বর আমার পাশে উঠে বসেছিলেন। আমার আরেক পাশে তামান্না বসেছিল। আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম তামান্না আমাদের সাথে যাচ্ছে দেখে। যাক আমার চেনা কেউ একজন সাথে থাকছে তো। ড্রাইভিং সিটে একটা সুদর্শন ছেলে উঠে বসেছে। আমার বরের সাথে তার চেহারার বিস্তর মিল দেখে ধরে নিলাম আমার দেবর সে। তার পাশে প্যাসেঞ্জার সিটে সুন্দর মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ে বসেছিল। বরের বোন সে। বরযাত্রী আসার পরে মেয়েদের দল যখন আমাকে দেখতে এসেছিল তখন পরিচয় দিয়েছিল আমার মনে পরছিল। কিযেন নাম বলেছিল? আমি মনে করার চেষ্টা করলাম। হ্যা মনে পরছে তিয়ানা। ড্রাইভিং সিটে বসা আমার দেবর মহাশয় ঘাড়ের ওপর থেকে পিছনে তাকিয়ে বললো,

” সবাই ঠিক ঠাক বসেছে? স্টার্ট করবো? ”

কামরান তার হাতঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে জবাব দিল, ” হ্যা ছাড়। এমনিতেই এনাফ টাইম চলে গেছে।”

” ওকে ভাই। ভাবি কোন প্রবলেম নেই তো? ”

শেষোক্ত কথাটি আমার উদ্দেশ্যে বুঝতে পেরে আমি চোখ তুলে তাকিয়েছিলাম তার দিকে। তখনও আমার চোখ, গাল ভিজে ছিল। হাত তুলে গালের পানি মুছে নিয়ে নাক টেনে মাথা দুলিয়ে ক্ষীন স্বরে বললাম,

” হুম, ঠিক আছি। ”

কথাটা বলে আমি পাশে বসা তামান্নার দিকে তাকালাম। তামান্না আমর দিকেই চেয়ে ছিল। সে আমাকে একটা উষ্ণ হাসি দিয়ে সাহস যোগাল। দেবর সাহেব বললেন,

” ওকে তাহলে যাত্রা শুরু হোক। ”

সে চটজলদি গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি এগিয়ে যাওয়ার মুহুর্তে আমার বুকটা হুহু করে উঠেছিলো। আমি একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। জানলায় বাবা মা ভাইয়া ও অন্যান্যদের মুখ দেখে আমি উন্মনা হয়ে তাকালাম। উনারা আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছিল। জানালার গ্লাস তুলে দেয়া বলে কারও কথা শোনার উপায় নেই। কামরান বুঝতে পেরে উইন্ডো গ্লাস নামিয়ে দিল। মুখ বাড়িয়ে আমিও ক্লেশ হেসে হাত নাড়ছিলাম। আমার বরও দেখলাম তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছিল।

গাড়ি চলতে শুরু করল। আমার প্রিয় মুখ গুলো ধীরে ধীরে আমার থেকে দুরে সরে যেতে থাকল। আমার ভিতরটা কেমন শুন্য মনে হচ্ছিল। কেমন হাহাকার করে উঠছিল। মন অজানা আশংকায় উৎকন্ঠিত হয়ে রইল সামনে ঠিক কেমন দিন আমার জন্য অপেক্ষা করছে এই ভাবনায়।

————*
গাড়ি হঠাৎ থেমে যেতে এতক্ষণ আমি আনমনা হয়ে থাকায় চমকে উঠেছিলাম। বোধহয় গন্তব্যে চলে এসেছি ভেবে বাইরে তাকালাম। কিন্তু গন্তব্যের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেলাম। হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে আছিল গাড়িটা। একে একে প্রায় সবাই গাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেছিল। কেবল আমিই হতবিহ্বল হয়ে বসে আছি। কামরান বাইরে থেকে ঝুকে মুখ বাড়িয়ে তাড়া দিলেন,

” কি হলো বসে আছ কেন? বের হও।”

আমি আর কালবিলম্ব না করে বেরিয়ে এলাম। যদিও সেটা খুব স্বস্তিকর ব্যাপার ছিলনা এসব শাড়ি গহনা পরে থাকার কারনে। কেননা আমি এসব পরতে অভ্যস্ত নই। আমি দেখলাম কামরান বোনের উদ্দেশ্যে কিছু একটা ইশারা করতে তিয়ানা চটপট আমার কাছে প্রায় দৌড়ে এলো। আমার বেশবাস টেনে টুনে ঠিক করে দিল। ততক্ষণে তামান্নাও এসে দাঁড়িয়েছিল আমার পাশে। আমি তিয়ানার দিকে তাকিয়ে নার্ভাস ভাবে হেসেছিলাম। সেও প্রতুত্তরে হাসল। দুই ভাই অপেক্ষা করছে দেখে আমরাও এগিয়ে গিয়েছিলাম।

বিয়ের পরে বঁধু বেশে সব মেয়েরা প্রথমে শশুর বাড়িতে যায়। আমিই বোধহয় প্রথম কনে যে কিনা শশুর বাড়ির বদলে হসপিটালে গিয়েছিলাম। আমার দাদার বন্ধু এখন আমার দাদা শশুর উনি হসপিটালে ভর্তি ছিলেন। উনার নাতবউ দেখার ইচ্ছে পুরোনের জন্যই এতো চটজলদি বিয়ের আয়োজন। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই সবার আগে উনার কাছে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। লিফটে চড়ে নির্দিষ্ট তলায় গিয়ে দাদার কেবিনে পৌছেছিলাম। দাদার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। উনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলেন। একহাতে সেলাইন চলছিল। উনার শিয়রের কাছে বসে ছিলেন একজন মাঝবয়েসী নারী। ভেবেছিলাম দাদা ঘুমিয়ে ছিলেন। কিন্তু না আমাদের পদশব্দ শুনেই উনি চোখ মেলে তাকালেন। আমি জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আচমকা আমাকে ঘাবড়ে দিয়ে কামরান আমার কাঁধের উপর দিয়ে একহাতে আগলে ধরে আমাকে সামনে ঠেলে নিয়ে গেলেন। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমি অস্ফুটস্বরে সালাম দিলাম। দাদা বোধহয় শুনতে পাননি। ততক্ষণে মহিলাটি উঠে দাঁড়িয়েছেন। তিনি আমার কাছে এসে দাদার হয়ে সালামের জবাব দিলেন। একহাত বাড়িয়ে আমার থুঁতনি ধরে বললেন,

” বাহ কি মিষ্টি মুখখানা। আর কি লম্বা! আমাদের কামরানের পাশে কি সুন্দর মানিয়েছে তোমাকে। আমরা তো চিন্তায় ছিলাম কামরান এতো লম্বা ওর পাশে মানাবে এমন মেয়ে খুঁজে পাব তো। কিন্তু দেখ আল্লাহ ঠিকই জোড়ি মিলিয়ে দিয়েছে। কি নাম যেন তোমার?”

প্রথমে একটু লজ্জা লাগলেও উনার কথা শুনে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। রোগীর সামনে দাঁড়িয়ে এসব না বললেই কি নয়? আমি বিব্রতভঙ্গীতে কামরানের দিকে চাইলাম। ও কিছুটা বিব্রতবোধ করছে মনে হলো। তবুও স্মিত হেসে মৃদুস্বরে জবাব দিলাম,

” হীবা ওয়াফিয়া।”

” বাহ্ খুব সুন্দর নাম। এমন পরিস্থিতিতে বিয়েটা হলো। দেখনা বিয়েতে চাইলেও থাকতে পারলামনা। বুঝতেই পারছ অবস্থা। ”

” জি। ” মাথা দুলিয়ে বললাম

” উনি আমার ফুপু। ” কামরান পরিচয় করিয়ে দিলো।

ফুপু হাসি মুখে সায় জানিয়ে বলছিলেন ” হ্যাগো আমি তোমার ফুপি শাশুড়ি।”

আমি সৌজন্যতা স্বরুপ হালকা হেসে তারপর দাদার দিকে ফিরে তাকিয়েছিলাম। তিনি ম্লান দৃষ্টিতে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিলেন। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছিলেন। হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডেকেছিলেন। বুঝতে পেরে আরও কাছে এগিয়ে গিয়ে আমি উনার দিকে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ছিলাম। উনি প্রায় বিরবির করে কোনরকমে জড়ানো স্বরে বলেছিলেন,

” আমার নাতিটাকে দেখে রেখ। এবার আমি শান্তিতে যেতে পারব। তোমরা সুখী হও। ”

উনার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে দেখে আমি বললাম,” আপনি শান্ত হন দাদু। আমি দেখব। তার আগে আপনি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসেন। ”

দাদা ম্লান হেসে হাতটা উপরে তোলার চেষ্টা করছিলেন। আমি হাতটা ধরতেই উনি হাতটা আমার মাথার উপর রাখলেন।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে