তোমায় ছেড়ে যাবো কোথায় পর্ব-২০

0
933

#তোমায়_ছেড়ে_যাবো_কোথায়।
লেখা – মুনিরা সুলতানা।
পর্ব – ২০।

——————-*
এখনও আইসিইউতে আছে হীবা। জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত ডাক্তার নিশ্চিত ভাবে কিছু বলতে পারছেনা। সারাদিন পেরিয়ে এখন রাত। হীবা আইসিউতে থাকায় আমাদের এখানে রাতে হাসপাতালে থেকে অযথা ভিড় করার কোন দরকার নেই বলে আমাদের বাসায় চলে যেতে বলা হয়েছে।ভালোই ভীড় ছিল। পরে হীবার মামারা আমার ফুপু খালা মামা সবাই এসেছিল। ওর বাড়ি থেকে আমার শশুর শাশুড়ীরা রওনা দিয়েছে। পৌঁছাতে অনেক রাত হবে। তাই হয়ত সকালেই হসপিটালে আসতে পারবে। হীবাকে এক নজর দেখে একটু আগেই আমরা বাসায় ফিরে এসেছি। কামরায় এসে আগে ঝটপট গোসল সেরে নিলাম। একে গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার তার উপর শুকিয়ে যাওয়া র*ক্তের জন্য চটচট করছে। তিয়ানার পিড়াপিড়ির জন্য কোনরকমে অল্প কিছু মুখে দিয়েই খাওয়া সেরেছি। সারাদিনের রোজার পরে ইফতারি করা নামে মাত্র। পানি মুখে দিয়ে আর সামান্য কিছু খেয়ে রোজা ভেঙেছি কেবল। হীবা ওইভাবে অনিশ্চিত ভাবে বিছানায় পড়ে আছে। খাবার কি আর গলা দিয়ে নামে? বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। নামাজ আদায় করে হীবার জন্য দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য দোয়া করলাম। কতটা সময় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রইলাম। আজ আর ঘুম আসবেনা। কিন্তু সারাদিন রোজা রেখে এত ছোটাছুটি এবং ধকলের কারণেই শরীরটা ভেঙে আসছে যেন। একটা সিগারেট ধরিয়ে বেতের চেয়ারে বসলাম। আমার সিগারেটের নেশা নেই। তবুও টেনশনের মুহুর্ত গুলোর সঙ্গী হিসেবে এটা মন্দ নয়। মাঝে মাঝে তাই হাতে তুলে নিই অবলীলায়। আসলে যখন থেকে আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছি তখন থেকেই এই জিনিসটা সময় অসময় কিভাবে যেন আমার সাথে জড়িয়ে গেছে। এর আগে কখনও ছুঁয়েও দেখিনি।

লন্ডন থেকে ফিরে আসার সময় থেকে আমার জীবনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। এর আগে কি সুন্দর নিশ্চিত নির্ঝঞ্ঝাট ছিল জীবনটা।লন্ডনে গিয়েছিলাম মুলত প্রোকৌশলী পড়তে। আমার আব্বা ও দাদার এমনটাই ইচ্ছে ছিল। আমারও অপছন্দের ছিলনা। তাই সানন্দে লন্ডনে পারি জমিয়েছিলাম সনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উদ্দেশ্যে। তবে আমার একটা নেশা ছিল। ফটোগ্রাফি নিয়ে। আর এটাকে একটা প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের ছাপ ফেলার আকুলতা ছিল। বলা যায় বুকের ভিতর লালিত স্বপ্ন ছিল সেটা। যদিও ব্যাপারটা পেশাগত লক্ষ্য নয় বরং অনেকটা শখের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। পড়াশোনার ফাঁকে প্রতি উইকেন্ডে ক্যামেরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়তাম। যখন গ্রাজুয়েশন প্রায় শেষের দিকে তখন আমারই মতো একজন ফটোগ্রাফারের সাথে পরিচয় হলো। তার কাছে অবশ্য এটা কোবল শখ ছিলনা ফটোগ্রাফিতে প্রফেশনাল কেরিয়ার গড়ার লক্ষ্যে সে পড়াশোনা করছিল। জুনিয়র ছিল। ওর নাম জাইমা। লেবানিজ বাবা এবং আমেরিকান মা। মুসলিম ছিল সে। যদিও আমেরিকায় জন্মসূত্রে জীবন যাপনে সম্পূর্ণ আমেরিকান ছিল। তবে ওর সম্পূর্ণ পরিবার লন্ডনেই থাকতো। শখ এবং ফটোগ্রাফিতে আমার সাবলীলতা দেখে জাইমাই আমাকে উৎসাহিত করেছিল এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে। তাই একদিকে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য সময় দিয়ে অন্যদিকে ফটোগ্রাফি নিয়েও পড়াশোনা শুরু করলাম। আস্তে ধীরে জাইমার সাথেও কখন যে জড়িয়ে গিয়েছিলাম নিজেও টের পাইনি। মেয়েটির ব্যাক্তিত্ব ছিল আকর্ষণীয়। দেখতেও ছিল চমৎকার। ঐ দেশের লাইফ স্টাইল অনুসরণ করলেও ও যথেষ্ট শালীনতা বজায় রাখতো। আমাদের মধ্যে চুমু, আলিঙ্গন এটুকু ঘনিষ্ঠতা থাকলেও চুড়ান্ত ঘনিষ্ঠতা কখনো হয়নি। আমাদের দুজনেরই পারিবারিক শিক্ষা যথেষ্ট রক্ষণশীল ছিল বিধায় সম্পর্কের মাঝে শুদ্ধতা বজায় রেখেছিলাম। তাছাড়া আমার মধ্যে কিছুটা সংকোচ, জড়তা কাজ করতো কেন যেন। আমি নিজে থেকে জাইমাকে কখনো চুমু খেয়েছি কিনা মনে পরেনা। যেটুকু ছিল জাইমার আগ্রহে।
এভাবেই বেশ চলছিল। পিএইচডি সম্পূর্ণ করলাম। ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনাও প্রায় শেষের দিকে। সেই সময় দাদা বাড়ি ফিরে যাবার জন্য তাড়া দিতে শুরু করলেন। সাথে আব্বাও। আমার তখনই ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছে ছিলনা। সত্যি বলতে আমি দেশে ফিরে যেতে চাইনি। ওখানেই গুছিয়ে নিতে চাইছিলাম। কিন্তু আব্বা একদিন বললেন আমার জন্য মেয়ে দেখেছেন। তাও নাকি ছোট বেলা থেকেই দাদা ঠিক করে রেখেছিলেন। এখন উনারা চাইছিলেন আমি দেশে ফিরলেই বিয়েটা সেরে ফেলবেন। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরেছিল। শেষে বাধ্য হয়ে জাইমার কথা বলেছিলাম। কিন্তু সেটাই যে কাল হয়ে দাঁড়াবে ভাবতেই পারিনাই। এই নিয়ে বেশ কিছুদিন আব্বা আম্মার সাথে বাকবিতণ্ডা চলেছিল। যেদিন আব্বার সাথে শেষ কথা হয়েছিল আমি রাগের বসে বলেছিলাম,

” উনারা যদি নিজেদের জেদ বজায় রাখে তাহলে আমি আর কখনো দেশেই ফিরবনা। তোমরা যখন আমার খুশি, ইচ্ছে অনিচ্ছার মুল্য দিতে চাওনা আমিও তবে নিজেরটা নিজে বুঝে নিতে বাধ্য হব। ”

আমি জানিনা কিভাবে এই কথাগুলো বলেছিলাম। আমার কি তখন মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল? সত্যি খুব বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম। যার জন্য আজও আফসোস হয় নিজের সেই সময়ের ব্যাবহারের জন্য। কিন্তু যেই সময় চলে যায় হাজার আফসোস করলেও সেটা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। না সময় ফিরে আসে না চলে যাওয়া আপনজন ফিরে আসে। আমার সেদিনের ব্যাবহার আব্বা নিতে পারেনি। হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন। খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলাম দেশে। আমার ভাগ্য সহায় ছিল বোধহয়। তাই শেষ দেখা হয়েছিল। ক্ষমা চাওয়ার সুযোগও পেয়েছিলাম। আব্বার চলে যাওয়ার সময় কথা দিয়েছিলাম তার সমস্ত দায়িত্ব আমি পালন করব। দাদার অসম্মান হয় এমন কোন অবাধ্যতা কখনো করবোনা। আব্বা চলে গিয়ছিলেন না ফেরার দুনিয়ায়। আর উনার সেই কথা রাখতেই জাইমার সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে ঐ দেশের সব লেনাদেনা মিটিয়ে একেবারে দেশে ফিরে এসেছিলাম। সেই থেকে সব দায়িত্ব পালন করছি। প্রথম পাঁচ ছয় মাস দাদা আমার বিয়ে নিয়ে কোন কথা বলেননি। আমিও সব কিছু ভুলে থাকতে নিজেকে কাজের মাঝে ডুবিয়ে রেখেছিলাম। সবকিছু ঠিক মতো বুঝে নিয়ে কাজে মনোনিবেশ করতেও অনেকটা সময়, লেগেছিল। এরপর হঠাৎ আম্মা আমার বিয়ে নিয়ে পিছনে পরলেন। তখন আমি সবকিছু মিলে এত ঘেটে ছিলাম যে বিয়ের মত আজীবনের বন্ধনে ঐ মুহুর্তে বাঁধা পরতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলকা না। আর তাছাড়া আম্মার আনা পাত্রীকে দাদা নাকচ করেও দেন। আম্মা কি জানতেন না দাদার ঠিক করা পাত্রীর কথা? আমি ঠিক জানিনা। তাই ব্যাপারটা এড়াতে ইনডায়রেক্টলি এখন কোনমতেই বিয়ে করবনা বলে দিয়েছিলাম। কিছুদিন কেউ আর বিয়ের কথা তোলেনি। অথচ শেষ পর্যন্ত দাদার শেষ ইচ্ছে রক্ষা করতেই তার পছন্দ করে রাখা সেই মেয়েটাকেই অবশেষে বিয়েও করে ফেললাম। আমি তকদীরে বিশ্বাস করি। জন্ম বিয়ে এবং মৃত্যু এসব আমাদের হাতের বাইরে। আল্লাহ এইসব ক্ষেত্রে তকদীরে যা রেখেছেন তাই হবে। তাই শেষপর্যন্ত অজানা অচেনা অদেখা মেয়েটাকে বিয়ে করলাম এবং মেনেও নিয়েছি। হ্যা মন থেকেই মেনেছি। একেবারে অচেনা অদেখা হীবাকে প্রথম দেখি বিয়ের দিনে, তাও বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর। ঘোমটার আড়ালে আনতো মুখটা আবছা ভাবে দেখেছিলাম। সেভাবে দেখার সুযোগ হয়নি। আসলে সেদিন দাদাকে নিয়ে ভিষণ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমাদের যেভাবে বিয়েটা হয়েছিল এভাবে আদৌ কারোও বিয়ে হয় বলে আমার জানা নেই। আমার মাথায় কেবল একটা ভাবনাই চলছিল, আর তা হলো যত দ্রত সম্ভব দাদার শেষ ইচ্ছে পুরোন করা। নাতবউয়ের মুখ দেখানো। বলতে গেলে সবকিছু কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঘটে চলেছিল। তারপরের ঘটনা গুলো একের পর এক এত দ্রুত গতিতে ঘটে যাচ্ছিল যে হীবার দিকে সেভাবে তাকিয়ে দেখাই হয়নি। আসলে মন মানসিকতা ছিলনা সুযোগও হয়নি। দাদা মারা যাবার পরে যে কয়দিন ও এখানে ছিল আমি আমাদের কামরাতে খুব একটা যাইনি। দাদার কামরাতেই থেকেছিলাম। একেতো শোকের বাড়ি সেই কারণে মাত্র বিয়ে করা নববধূর কাছে যেতে ঐ সময় বিবেকে কেমন বাঁধছিল। বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের ভীড় ছিল। তাই লজ্জা ও সংকোচে যেতে পারিনি। সেই সময় এবং পরিস্থিতিটাই আমাদের সম্পূর্ণ প্রতিকূলে ছিল।
রাতে যখন ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিতাম বিছানায় প্রায় রাতেই অতিরিক্ত শারিরীক ও মানসিক চাপে মাথায় ব্যাথাও ভিষণ পীড়ন দিত। মনে মনে প্রতিক্ষাও থাকতাম ও হয়ত উঁকি দিয়ে অন্তত খোঁজ নিতে আসবে। কিন্তু একদিনও আসেনি বরঞ্চ পিউলি এসে মাথা টিপে দিত। পিউলি ছোট বেলা থেকে বেশির ভাগ সময় এই বাড়িতেই তিয়া, তাসমির সাথে হেসে খেলে বড় হয়েছে। আমি ওদের দুজনের মত পিউকে আমার নিজের আরেক বোনই ভেবে এসেছি। সেই হিসেবে সহজ স্বাভাবিক ভাই বোনের সম্পর্কই ছিল আমাদের মধ্যে। যাইহোক অবচেতন মনে হীবার জন্য কেন যে অপেক্ষায় থাকতাম জানিনা। কিন্তু ও না আসায় হতাশ হতাম। পরে ভেবে দেখলাম হয়তো সেও লজ্জা শরম শিকেয় তুলে আসতে পারেনি আমার কাছে। কিংবা হঠাৎ করে এভাবে বিয়েটা হয়েছে বলে মেনে নিতে পারেনি এখনো। তাই আমিও আপাতত দুরত্ব বজায় রাাখাটাকেই শ্রেয়তর ভেবেছিলাম। তারপর সবকিছু মিটে গেল। সবাই ধীরে ধীরে চলে গেলে বাড়িটাও ফাঁকা হলো। সেদিন রাতে আম্মার পিড়াপিড়িতে আমাদের বেডরুমে প্রথম ওর সাথে ঘুমিয়েছিলাম। যখন আমি রুমে যই ততক্ষণে ও গভীর ঘুমে। ডিম লাইটের আবছা আলোয় ওকে অনেক রাত অবধি দেখছিলাম। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভব আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। এই মেয়েটা এখন থেকে আজীবন এভাবেই আমার সাথে থাকবে। অদ্ভুত একটা শিহরণ জাগছিল আমার সমস্ত শরীরে। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। কত রাত পর্যন্ত যে জেগে ছিলাম তাও বলতে পারবনা। একসময় বোধহয় ঘুমিয়ে পরেছিলাম। কিন্তু পরদিন সকালেই শুনলাম আমার শশুর শাশুড়ি চলে যাচ্ছে। হীবাও ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে যাচ্ছে। ওর সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা ছিল। ওর সাথে সেভাবে ভালো করে কথাও হয়নি। তাই আমাদের মধ্যে মানসিক কোন বন্ধন বা টানও তৈরি হয়নি। তাই আমি ভাবলাম পরীক্ষা শেষ করে তারপর নাহয় একবারেই আসুক। তার আগে আমাদের মাঝে যেমন চলছিল থাকনা এই দুরত্ব। সব ঝামেলা শেষ করেই নাহয় নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে গুছিয়ে সংসার শুরু করা যাবে। হীবা চলে যাবার পরে খুব কমই আমাদের যোগাযোগ হয়েছিল। আমার যে ওকে ফোন করতে ইচ্ছে করতনা তা নয় তবুও নিজেকে সংযত রাখতাম যাতে ওর পড়াশোনায় কোন ব্যাঘাত না ঘটে। তবে হঠাৎ কখনও এক-আধবার ফোনে কথা হয়েছিল। তাও আম্মাই যখন কথা বলত। ফাকে আমাকে ধরিয়ে দিত। সেভাবে কোন কথা হতনা। শুধুমাত্র দুয়েকটা সৌজন্যমুলক কথা হত। দুটো মানুষ ফোনের দুপাশে নিরব হয়ে থাকতাম। সত্যি বলতে অচেনা অজানা বউয়ের সাথে ঠিক কি কথা বলা যায় সেটাই তো বুঝতে পারতামনা।
এভাবেই কেটে গেছে বেশ অনেকটা সময়। একদিন হঠাৎ বাসায় ফিরে দেখি হীবা কোন খবর না দিয়ে একাই চলে এসেছে হুট করে। সেদিন প্রথম ভালো করে পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেছি। বিশেষ করে রাতে যখন ও ঘুমিয়ে ছিল। আমি ওর পাশেই শুয়ে অনেকটা রাত পর্যন্ত জেগে থেকে কেবল ওকেই দেখছিলাম। আর কেমন অদ্ভুত একটা অচেনা অনুভুতির সাথে পরিচয় হয়েছিল সেদিন। কেবলই মনে হচ্ছিল এাইযে আস্ত একটা মানুষ এখন থেকে শুধুই আমার। এখন থেকে প্রতিদিন সে এভাবেই আমার পাশে ঘুমাবে এই রুমেই আমার সাথে থাকবে। এসব ভাবতেই কেমন অন্য রকম শিহরণে শিহরিত হচ্ছিলাম। এই মেয়েটা একান্তই আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। আমি কেবল ডিম লাইটের আবছা আলোয় ওর মুখপানে তাকিয়ে দেখছিলাম। এর পরের দিন গুলো কেমন স্বপ্নের মত কাটতে লাগলো। যদিও আমাদের মধ্যে দাম্পত্য জীবন পূর্ণ রুপে শুরু হয়নি। জানিনা কি এক সংকোচ আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে বাঁধ সাধতো। ওর দিকে যখনি এগোতে চাই লজ্জা ও জড়তায় থেমে যেতাম। হীবা কি চায়, ও যদি মাইন্ড করে এসব উদ্ভট যুক্তি মনের ভিতর দ্বিধা দ্বন্দ্বের দেয়াল তুলে দিত। তবুও ওকে ছোঁয়ার ওর কাছে যাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে রাতে যখন হীবা ঘুমিয়ে পরত আস্তে করে ওর অজান্তে লুকিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতাম। একদিন ধরা খেয়ে কিযে লজ্জায় পরেছিলাম।
এভাবে আস্তে আস্তে আমাদের সম্পর্ক সহজ স্বাভাবিক বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল। দিনদিন আমি ওর প্রতি একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যে পিউলির ফটোসেশনের জন্য রিসোর্টে যাওয়ার পর আমার বোকামির কারণে এই প্রথম হীবার সাথে মনোমালিন্য হয়েছিল। ও কয়দিন আমার সাথে ভালো করে কথা বলেনি। সেই কটাদিন আমার জন্য কিযে যন্ত্রণাদায়ক ছিল বলো বোঝানো সম্ভব নয়। তখন অনুভব করলাম হীবা আমার জীবনের একটা অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। ওকে ছাড়া আমার জীবন এখন কল্পনাও করতে পারিনা। রোজা শুরুর দিকে পিউলি আবারও ওর ফটোসেশানের জন্য আমার কাছে এসেছিল। আমি এমনিতেও এখন ওর কাজ করতামনা। আমার এই মাসে প্রচুর ব্যস্ততা। সামনে লন্ডনে যাবো বলে কাজগুলো গুছিয়ে নিতে হচ্ছে। সেদিন পিউলি আসার পরে আরমান হঠাৎ আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বললো,

” আমরা পিউকে নিজেদের বোন বলে ভেবে এসেছি। কিন্তু পিউ তোমাকে কখনও ভাইয়ের দৃষ্টিতে দেখেনি তা জানো তুমি? খালামনি তোমাদের বিয়ের জন্য প্রস্তাব রেখেছিলেন তাও পিউর ইচ্ছে অনুযায়ী জানো তুমি? ”

আমি হতভম্ব হয়ে গিয়ছিলাম আরমানের কথা শুনে। কি বলছে ও? আমি বোকার মত কয়েক মুহূর্ত ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

” কি বলছিস তুই? মাথা ঠিক আছে তোর? ”

” আমার মাথা ঠিক আছে, কিন্তু পিউর মাথা ঠিক নেই। তমি আগে এই ছবিগুলো দেখ তারপর বল এসবের মানে কি?”

আরমান কথা শেষ করে ওর সেলফোন এগিয়ে দিলো। স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি রাখতেই আমার চোখ দুটো কপালে উঠে গেল। এগুলো তো সেই রিসোর্টে তোলা ছবি। কিন্তু ছবিগুলো কখন তুললো? পার্সোনাল ফটোগ্রাফার ক্যাপশন দেখে রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে যেন। কি সাংঘাতিক ব্যাপার। এই মেয়ের মাথায় এসব চলছে আর আমি কিনা অজান্তেই ওকে লাই দিয়ে যাচ্ছিলাম? আমি বললাম,

” এটাতো কবেকার ঘটনা। এতোদিন বলিসনি কেন? আর বিয়ের কথা কেমন করে ওঠে? দাদার ইচ্ছের কথা জানা সত্ত্বেও? ”

” তখন আম্মাও জানতো না। খালামনির প্রস্তাবের পরেই তো দাদা ভাবীর কথা জানাইছিলেন। তারপর কথা ওখানেই শেষ। কিন্তু আম্মার কাছে শুনলাম পিউ আপু নাকি ওর জেদে অটল। আম্মাকে চ্যালেন্জ করছে তোমাকে নাকি পেয়ে ছাড়বে। তাই তোমাকেও সব জানালাম। এখন তোমার জন্য পিউ থেকে দুরে থাকাই বেটার। বাকি তুমি ভালো জানো।”

আমি সত্যি এতোটা অবাক কখনো হয়েছি কিনা মনে পরেনা। বললাম, ” ভালো করেছিস সত্যিটা জানিয়ে। এসব ছবি হীবার চোখে পরলে ও শিওর আমাকে সন্দেহ করতো। জানিনা অলরেডি দেখেছেও কিনা। আমি আমার জীবনে আর কোন ঝামেলা চাই না। ”

সেই থেকে পিউকে এড়িয়ে চলছি। তারপরও কোথা থেকে কি হয়ে গেল। সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। আজ হীবা হসপিটালের বিছানায় শুয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ঝুলে আছে। ওকে আমি কিছুতেই এই অবস্থায় দেখে সহ্য করতে পারছি না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। রুমে ফিরে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে অজু করে এসে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করতে বসলাম। শুনেছি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ে দোয়া করলে নাকি সেই দোয়া আল্লাহ তায়ালা কবুল করেন। তাই নামাজ আদায় করে হীবার আরোগ্য লাভের জন্য প্রার্থনা করলাম।

ভোরবেলায় শেহরি খেয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে আর শুইনি। আবারও বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। একটা নির্ঘুম রাত কেটে গেল। এখনও সেভাবে আলো ফোটেনি। ভোরের হালকা ঠান্ডা বিশুদ্ধ বাতাস বইছিল। তারই ছোঁয়ায় বেলকনির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাধাচূড়া গাছের ঝিরিঝিরি পাতাগুলো মৃদুভাবে দুলছে। বুক ভরে লম্বা শ্বাস নিলাম। চারপাশে হালকা ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে পরছে খুব ধীরে ধীরে। একটু পরেই হয়তো পূব আকাশে সূর্যরশ্মি উঁকি দিতে শুরু করবে। সেই সময় হসপিটাল থেকে ফোন এলো। হীবার জ্ঞান ফিরছে। আমি আর দেরি না করে দ্রুত কাপড় পাল্টে রেডি হয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি পার্ক করে লিফটের সামনে আসতেই হীবার বাবা মায়ের সঙ্গে মুখোমুখি হলাম। হীবার মা বাবা ভাই এবং মামা দাঁড়িয়ে আছেন আমার সামনে। উনাদের দেখে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বললাম,

” আসসালামু আলাইকুম। কখন পৌঁছেছেন আপনারা? আমাদের বাসায় গেলেন না কেন? ”

হীবার বাবা বললেন, ” ওয়ালাইকুম আসসালাম। এইতো মাঝরাতে পৌঁছেছি। তোমাদের বাসায় তোমার মা নেই। এমন পরিস্থিতিতে আমরা আর ঝামেলা বাড়াতে চাইনি। পৌঁছে সবার আগে হসপিটালেই আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শালাবাবু বলল এইসময় গিয়ে লাভ নেই। তাই বাসায় গিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। তারপর ভোর হতেই আর দেরি না করে চলে এলাম। মেয়েটাকে একজর না দেখা পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিনা। কেমন আছে মেয়েটা আমার? ”

আমি প্রতিত্তোরে বললাম, ” একটু আগেই হসপিটাল থেকে ফোন করে জানিয়েছেন হীবার নাকি একটু একটু করে সেন্স ফিরছে। এইজন্যই তো আমিও এই ভোরবেলাই চলে এলাম। আপনারা আসেন আমার সাথে। ”

বলেই লিফটের দিকে এগোলাম। ভোরবেলা হওয়ায় মানুষ জনের আনাগোনা কম। আমরা ছাড়া আর কেউ নেই লিফটে। আগেই ডাক্তারের সাথে দেখা করলাম। উনি জানালেন,

” সেন্স ফিরেছে। ভয় কেটে গেছে। শি ইজ নাউ আইট অব ডেঞ্জার। কিছুক্ষণের মধ্যে কেবিনে শিফট করে দিলে আপনারা ওর কাছে যেতে পারবেন। ”

হীবার আম্মা ব্যাকুল হয়ে বললেন, ” আমি মেয়েটাকে একনজর দেখব। এখনই। দয়া করে আমাকে আমার মেয়ের কাছে যেতে দিন। যখন থেকে আমার মেয়ের এক্সি*ডেন্টের কথা শুনেছি ওকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে আছি। এতদুর থেকে ছুটে এসেছি। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিনা। ”

হীবার মামা সোহেল বললেন, ” প্লিজ ডক্টর, আপাকে জাস্ট একনজর দেখার জন্য ভিতরে যাওয়ার পারমিশন দেন। মায়ের মন বোঝেনই তো।”

ডাক্তার বললেন, ” ঠিক আছে যান। তবে পেশেন্টকে রেস্ট করতে দিবেন। শুধু মাত্র দেখে আসবেন। কোন কথা বলবেন না। ওকে?”

” হ্যা হ্যা আমি ওকে একটুও ডিস্টার্ব করবনা। কোন কথাও বলবনা। শুধু একনজর দেখেই চলে আসব। ” অস্থিরতার সাথে তৎক্ষনাৎ কথাটা বললেন হীবার মা।

আমরা সবাই আইসিইউর সামনে এসে পৌছলাম। হীবার মা ভিতরে গেলেন। আমরা সবাই প্রবল উৎকন্ঠা নিয়ে বাইরেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রইলাম।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে